ঈদের দ্বিতীয় দিন। বারে শুক্র। শীতের আবছা কুয়াশার আনাগোনায় ঘুমনেশা ভাব। কিছুটা বিষণ্নতা,কিছুটা খাপছাড়া। সূর্যের সোনালি ছটকে ঘাসের মাথা থেকে শিশিরজল উবে যাচ্ছে এমন সময়।
ছুটির দিন বলে ঝাউগাছের ফাঁকে-ফাঁকে প্রেমিক-প্রেমিকা সাপের জোড়ার মতো লেগে থাকে। মা-বাবা, আত্মীয়-স্বজন যেই আসুক চোখে হাত দিক, নয়তো হাঁটুক না দেখার ভান ধরে। এখানে সবাই সমবয়সী।
হাতে হাত ঢলতে ঢলতে, কালো চশমার ভেতর থেকে একজন আরেকজনকে খুঁজে শতজনমের তৃষ্ণায়, এ লবণাক্তের সমুদ্রপাড়ে। কালো চশমায় ঢেকে থাকা চোখগুলোর সামনে যেন আরাধনার মানুষটি কাপড় খুলছে, খুলুক; আড়ালে থেকে আড়ালেই ওর ওপর হামলে পড়বে, চেটে দেবে অমৃত লালায়।
ঈদের আনন্দের দিন হলেও ঝাউবাগানে আসতে ম্যাড়ম্যাড়ে মনে সায় দিচ্ছিল না। রুবেল ও সাগর ছিল নাছোড়বান্দা। রুবেল প্রায় জোর করে বললো, দোস্ত তুই না গেলে কী আনন্দ হবে? প্লিজ, না করিস না।
আমার ভালো লাগছে না বারবার বলার সত্ত্বেও রুবেল ও সাগরকে শোনে আমার কথা। রুবেল বলেই যাচ্ছে—মন ভালো করার জন্যই তো মানুষ ওখানে যায়। ওখানে গেলেই দেখবি মন ভালো হয়ে যাবে। প্লিজ, দোস্ত…
ঝাউবাগানে নামতে সরু পথটার চিকন গাছগুলোর মাথা দস্যি বাতাসে ঘুরপাক খাচ্ছিল। কেউ কেউ ওপরে উঠে আসছে। বুঝি সুখের গর্তগুলো ভরাট করে । আমরা যাচ্ছি পাড়ে ।
তীরের দক্ষিণ ও উত্তরে বাঁশ দিয়ে তৈরি ঝুপড়ি মার্কা দোকান। দোকানের সামনে কয়েকটা চেয়ার ও টেবিলে সাজানো দুই তিনহাত পরপর। ইমিটেশনের তৈরি অলঙ্কারের ঝনাৎঝনে হাসি। লবণাক্ত হাওয়ায় মিশে রংধনুর পরিবেশ। পাড়ে নামতে গিয়ে আমার পা আটকে গেছে। চোখ গেলো নীল টেবিলটার দিকে। সেখানে দু’জন অসম বয়সী অসহ্য আদমি খেলায় মেতে উঠেছে।
শরীর আচমকা চার্জ হয়ে নীরবে ঝাঁকুনি দিলো যেন। বেড়ালের হাঁটা টের পাচ্ছি লোমকূপে; উসকো-খুসকো মাথাভর্তি চুলের এক যুবক বালি থেকে তুলে এনে, ঘোলা পানীয় টেবিলে দিয়ে চোখ টিপে কী যেন ইশারা করলো।
মেয়েটি পুরুষটির মেয়েবয়সী। ঘুচঘুচে গোঁফ বারবার মেয়েটির তুলতুলে হলদে গালে সুঁড়সুঁড়ি দিয়ে রক্তিম করে তুলছে। আমার ভেতর কে যেন হাত উঁচিয়ে মেয়েটির দৃষ্টি ফেরাতে চায়, হে যুবতী, আমি যুবক, আমি আসছি…
হঠাৎ নিজেকে শামুকের খোলসের মধ্যে ঢোকাতে চাইলাম যেন। বাউলা হয়ে তাদের পাশের টেবিলটায় বসে কান পেতে আছি ওই টেবিলে। শুনতে পেলাম মেয়েটির দৃঢ় কণ্ঠ—এত শখ উঠলো যখন, আমাকে বিয়ে করলে তো পারিস্।
আমার চেতনা ফিরলো। মেয়েটি এমন বয়সের পুরুষকে এত বাজে ব্যবহার করছে কচিমুখে! নিজেকে জানিয়ে দিলাম, নারীর হজমশক্তি অবিশ্বাস্য।
পুরুষটিও আশ্বাসে বললো, লক্ষ্মীসোনা, ধৈর্য ধরলে যখন আর কটা দিনও ধরো। ডাক্তার জবাব দিয়েছে, ওকে আর বাঁচানো যাবে না। মরারোগে ধরেছে।
মেয়েটি হুঁস করে চেঁচিয়ে উঠলো—ইস্, কখন বউ মরবে তখন! আমি পারবো না আর। মাও বলে—পুরুষ মানুষ বলতে নাকি চিটার!
পুরুষটি মেয়েটির বুক থেকে একটু মুখ তুলে বললো, ওফ্, চেঁচাচ্ছ কেন! আর কটা দিনই তো।
পুরুষটির হাতে পেঁচিয়ে মেয়েটির পিঠে সুঁড়িসুঁড়ি দিতে দিতে ইশারায়-ইঙ্গিতে স্বাভাবিক হতে বললো।
যেন সারারাত কাটিয়ে সকালে বাসিমুখেই বলছে, একটু আদর দাও না প্লিজ।
আমাকে বিয়ে করবি, প্রমিজ কর্।
হুম
আমার কল্পনায় বাবার মুখ ভেসে এলো। বুকের ভেতর দীর্ঘশ্বাসের দখল। বসা থেকে উঠতে যেতেই রুবেলের জোরালো ডাক, কিরে দোস্ত, তাড়াতাড়ি আয়, এখনো নামলি না!
দীর্ঘশ্বাসটি ভেতরে চাপিয়ে দৌড়াতে গিয়ে পেছনে তাকিয়ে দেখি—পুরুষটি মেয়েটির কোমর ধরে দোকানের কালো পর্দার আলাদা ঘরে ঢুকছে। অতপর দীর্ঘশ্বাস বেরুলো। রুবেল ঢেউয়ের আগা ভাঙছে। প্রতিবারে জিতে তা নয়, হারেও। ঢেউয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে। সাগর ধস্তাধস্তি করে পুরোটা ভেজাতে চায়লো। রাগের ভাব দেখিয়ে রেহাই। তবে জিন্সের প্যান্ট টেনেটুনে নামলেও খেয়ালের বাইরে ভিজে যাই। সমুদ্রে কোমর পর্যন্ত নেমে জোড়া জোড়া ছবি তুলছে। ঢেউয়ের ধাক্কায় তারা টলেটলে যাচ্ছে, প্রতিবারই একজন আরেকজনকে চেপে ধরছে। পৃথিবীর সব প্রেম বুঝি এখানে গিজগিজ করছে।
কয়েকটা যুবকের ফুটবল নিয়ে দৌড়াদৌড়ি, ডলফিনের মতো লাফালাফি। কেউ কেউ হাতে হাত ধরে হেঁটে যাচ্ছে অনন্তের পথে। কেউ কেউ ঘোড়ার পিঠে চড়ে কিছুদূর গিয়ে টাকা গুনছে। লাল কাঁকড়ার ঝাঁকে পাড় ঢেকে যাচ্ছে লাল চাদরে। ধরতে গেলে মুহূর্তে গর্তে, ধরতে গিয়ে লাফিয়ে বালির ওপর চিৎপটাং। পরমুহূর্তে ঝেড়েঝুড়ে দাঁত গলানো হাসি। দস্যি হাওয়ায় লাল নীল হলুদ রঙের সোহাগি ছাতার পাখনা উড়ছে পতপত্ শব্দে।
রুবেল ও সাগর কিছুদূরে রমণীদের মনে ল্যাং মারতে ব্যস্ত। ও রুবেল,ও রুবেল—বলে দৌড়ে গিয়ে দুজনের কাঁধে বাদুড়ের মতো লটকে যাই। সমুদ্রপাড় থেকে উঠতে, তিনজনে ঢুলেঢুলে কাঁধে কাঁধে হাত রেখে সুর মিলিয়ে গেয়ে উঠি: এই নীলমনি হার, এই স্বর্ণালি দিন তোমাকে দিলাম…
গান গেয়ে ওপরে উঠছি আর তিনটা মেয়ে নামছে পাড়ে। পাশঘেঁষা মেয়েটির লাবণ্যময়ী হাসিতে হালকা চোখাচোখি। পাশ কাটিয়ে রুবেল ও সাগর দুজনে ঝগড়া লাগিয়ে দেয়, কাকে দেখেছে এটা প্রমাণ করতে। সাগর বলে উঠলো—মেয়েটি আমাকে দেখেছে মাথামোটা।
রুবেল মৃদু রাগ চড়ায়ে বলে উঠলো—ধুর, তোর মতো বাদুরকে দেখবে? আমাকে দেখেছে মদন, দেখ্ না রাজকুমার।
সাগরের মুখ মলিন হয়ে এলো। আমাকেও দেখেছে সেটা আর বলতে গেলাম না। তদুপরি কাকে দেখলো এটার দ্বন্দ্বে পড়ে গেলাম। তিনজনে ঝাউগাছের প্রকাণ্ড গোড়ায় এসে দাঁড়াই। মেয়েগুলো বারবার আমাদের দিকে তাকাচ্ছে। নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করে হাঁটছে। ঢেউয়ের আগায় নামার আগে পাশঘেঁষা মেয়েটি আমাদের দিকে তাকিয়ে বালিতে আঙুল দিয়ে কী যেন লিখলো। যতটুকু না কৌতূহল, তারও চেয়ে রোমাঞ্চের বাড়াবাড়িতে মেয়েটি কী লিখলো তা দেখতে উচাটন। মেয়েটি বালি থেকে আঙুল তুলে মৃদু হেসে কয়েক পা এগোলো। আমিও এগোলাম। কাঁপাবুকে এগিয়ে দেখি বালিতে লেখা—ঈদ। আমি তার সঙ্গে মিলিয়ে লিখলাম—মুবারক।
কী দারুণ হৃদয়ের ঘণ্টা ঢং করে বেজে উঠলো। মেয়েটির কৌতূহল বাড়লো। আমার লেখা দেখতে চেয়ে আছে অপলক। কয়েক পা এগিয়ে গেলে মেয়েটি লেখার কাছে এসে হেসে উঠলো। দুচোখের কোটরে আলাদা ঘর তুললো। কয়েক পা এগিয়ে লিখলো—কেমন আছেন…?
এরপর আরও কয়েক পা এগিয়ে পিছু ফিরে তাকালো। আমি গিয়ে লিখলাম—ভালো।
এরপরে আমিও কয়েক পা এগিয়ে গেলাম। মেয়েটি দেখতে এসে ঠোঁট ছাপিয়ে হাসলো। অতপর একটু ভাবিতও হলো যে, কী লিখবে আর। মেয়েটি দাঁড়িয়ে কেবল আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তাই আমি কয়েকপা এগিয়ে লিখলাম বালির বুকে, অনর্থক ইংরেজিতে। হয়তো অবাধ্য যুবকের শুদ্ধতম লিরিক— I wanna friend ?
এবার আমি আরও কয়েকপা এগিয়ে নিশ্বাস চেপে তাকিয়ে থাকি। মেয়েটি লেখার কাছে আসে আর ভাবে। কিছুক্ষণ হাটুমুড়ে লিখলো, কেন?
মেয়েটি লেখা থেকে কয়েকপা এগোলে, মেয়েটির প্রশ্ন দেখে বরঞ্চ উত্তেজনার গতি বাড়লো। আমি নাছোড়বান্দা। আবার লিখলাম একটু এগিয়ে?
মেয়েটি এবার বান্ধবীদের সঙ্গে খানিক শলাপরামর্শ করলো বটে। এসে এবার লিখলো— Yaap!
আমি উত্তরটি বালির বুকে দেখতে পেয়ে খানিক লাফিয়ে উঠি। যেন পেয়ে গেছি স্বপ্নের অভিষেকে প্রিয় ব্যাটসম্যানের উইকেটটি। এরপরে কেউ কিছু লিখছি না। কেবল হাঁটছি আর তাকিয়ে তাকিয়ে হাঁটছি। ওরা তিনজন,আমরাও তিনজন…
ঠিক মধ্যাহ্ন। স্নানের বেলা। অতিথি পাখিরা নাইতে নেমেছে পাখা ঝেড়ে ঢেউয়ের আগায়। ঢেউয়ের ফেনা দলা-মোচড়া হয়ে লুটিয়ে পড়ছে পাড়ে। সমুদ্রের দিকে তাকাতে চিকমিকি আলো চোখ বন্ধ করে দিচ্ছে হুটহাট। কপালে হাত দিয়ে দেখতে হচ্ছে দূর-দূরান্তে। আমরা হাঁটছি কেবল তাদের পেছনে গন্তব্যহীন। মেয়েটি হঠাৎ থেমে লিখলো—কোত্থেকে এলেন?
ওরা এগোলে আমি লিখি—আনোয়ারা। তুমি ?
সে পেছন ফিরে এসে লিখলো—শিকলবাহা।
কিসে পড়ো?
এসএসসি দিলাম এবার। আর আপনি?
কলেজে। সেকেন্ড ইয়ার।
এবার মেয়েটি লেখার দিকে একবার তাকিয়ে, আমার আগাগোড়া দেখছে। দৃঢ়তার মাঝে নির্ভরতার প্রতিচ্ছবি, মায়ার নির্ভেজাল আকুতি। খানিক পর আরও কয়েকপা এগিয়ে লিখলো—আচ্ছা, আপনার নাম কী?
নোমান, তোমার?
মুক্তা
আমি নামটি মনে আওড়াতে থাকি। নিজেকে বলি, সত্যিই তো মুক্তা। টানাটানা দুটি চোখ, টসটসে ঠোঁটের কোণায় তিলের ম্যাজিকে কদুর ফুলের মতো দাঁতগুলোর উপচেপড়া হাসি। টিলার মতো বুকের সম্মোহনে গায়েবি আগুনের ফুলকি ধেয়ে আসে ওঁতপেতে থাকা শিকারির চোখের দিকে। মুক্তার পেছন-পেছন হাঁটছি তিনজনে। তারাও হাঁটছে। নিজেদের পায়ের জুতাগুলো নিজেদের হাতে নিয়ে। হঠাৎ মুক্তা আবার লিখলো—আপনার পরিচয়টা মুখে বলুন।
চলন্ত গাড়ি যেন ব্রেক চাপে। ঝাউগাছের গোড়ায় দাঁড়িয়ে ইশারায়, ইঙ্গিতে তাদের কাছে যাওয়ার তাগাদা দিচ্ছে। রুবেল ও সাগর কুঁকড়ে গেছে এরমধ্যে। দুজনের কেউ আমার পেছনে যেতে চাচ্ছে না। রুবেল মিনমিনিয়ে বলে উঠলো—আল্লাহ জানে কী হয়,যেখানে যাস্ একটা ঘটনা করে আসিস্। মর্ গিয়ে।
দুজনের কথায় কান না দিয়ে অজানার টানে এগিয়ে যাচ্ছি। মনে হচ্ছে, আগের জনমের পরিচিতা। আমাকে ডাকছে। আমি যাচ্ছি, আমি যাবই।
বুকে হিমশীতল আবেগও তাঁতিয়ে উঠছে। সূর্যের আলো মিইয়ে আসছে পশ্চিমাকাশে। মুক্তার সামনে দাঁড়াতেই আমাদের দ্বৈতচারী হাসি স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়ানোর প্রণোদনা দিলো। মুক্তার মায়াবি চাহনি আমার দিকে তাক্ করে, হাত থেকে একটা জলপাই এগিয়ে বললো, খাবেন?
টক দেখলেই মেয়েদের জিহ্বায় জল খসে, ছেলেদের নয়।
কেন, অনেক ছেলেও তো খায়।
ওই রকম ছেলে আমি নই।
মুক্তার ডানপাশের বান্ধবীটি বলে উঠলো— ভালোবাসার প্রথম উপহার হিসেবে নেন না।
আমার স্বাভাবিক কথা বলা দেখে দু’বন্ধু কাছে ভিড়তেই এটা শুনে হা। আমার বুকে বাউলা বাতাস। মুক্তা আমার চোখে চোখ রেখে বোঝাতে চাচ্ছে, সে সত্যিই আমাকে ভালোবাসে। মুক্তার বাড়ানো হাত থেকে জলপাই নিতে পরস্পরে আঙুলের আলতো স্পর্শে, অদ্ভূত শিহরণ খেলে গেলো। ও রকম আমার ভেতর আর কখনো হয়নি। ঝাউগাছের আগা উত্তরালি বাতাসে সাঁই সাঁই করছে। ডিমের লালির মতো সূর্যের অর্ধেকটা ডুবে গেছে সমুদ্রে। মুক্তার পেছনে হেঁটে যাচ্ছি…
এমন সময় মুক্তার নাম ধরে কে যেন ডাক দিলো। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি, ছেলেটি মুক্তাদের ডাকছে। মুক্তাও নিজেকে গুছিয়ে নিলো একমুহূর্তে। পারলোও বটে। বুকের শ্বাস ওপরে তুলে বললো—আসি…
আসি বলতে বলতে চলে যাচ্ছে, আমি একা হয়ে যাচ্ছি, খুব একা। বুকে চিনচিন ব্যথা শুরু হচ্ছে। অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে মুক্তারা। আমার বাড়ানো হাত গুটায়ে বালিতে লিখি—ভালো থেকো।
আমার হৃৎপিণ্ড এই বুঝি বুক চি’রে বেরিয়ে পড়লো। লাথি দিয়ে দিয়ে খেলছে ফুটবল ওই দূরের যুবকেরা। এর পরপরই আমার চেয়ে থাকার মাঝে নামলো আঁধার…