লিফট থেকে নেমে ডানে-বামে কোনোদিকে না তাকিয়ে সোজা এসে রাস্তায় দাঁড়ায় নুরিতা। কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া ঘটনায় কেমন হতবিহবল হয়ে গেছে সে। কেমন করে কী ঘটে গেলো বুঝতে সময় নিতে নিতে শাঁ করে একটা গাড়ি এসে ব্রেক করে ওর পাশে। আরেকটু হলেই চাপা পরতো নুরিতা। ড্রাইভার ‘শালির মাগী’ বলে একটা গালি দিয়ে আবার চলতে শুরু করে। গালিটা কানের ভেতর ঘিনঘিন করে প্রতিধ্বনিত হতে থাকে। চট করে সামনে একটা খালি রিকশা পেয়ে দরদাম না করেই উঠে পড়ে। রিকশাওয়ালাকে বলে বাসস্ট্যান্ড যাও। রিকশাওয়ালা বাসস্ট্যান্ডের দিকে চালাতে থাকে ধীরগতিতে।
বাসস্ট্যান্ড নেমে নুরিতা হাঁটতে শুরু করে নিজের বাসার দিকে। কেউ যেন নুরিতার বুকের ভেতর একশো একটা হাতুড়ি পেটাচ্ছে। আজকের ঘটে যাওয়া ঘটনায় কেমন যেন মিশ্র একটা অনুভূতি হচ্ছে। নুরিতা হিসাব করে মেলাতে পারছে না ঘটনাটা কী? সেটা প্রেম, না কি যৌনতার খামখেয়ালিপনায় ভদ্রলোককে নুরিতা প্রশ্রয় দিয়েছিল? আর প্রশ্রয় না দিলে তো আশ্রয় মেলে না কোনো ক্ষেত্রেই। তাহলে নুরিতা কি সত্যিই সেই কিছুক্ষণ আগে দেখা ভদ্রলোকের প্রেমে পড়েছে?
রাত নেমে এসেছে। আকাশে খোলা ডিঙি নৌকার মতো চাঁদ ভাসছে। ঢাকা শহরের আকাশে শুধু চাঁদটাই দেখা যায় আশেপাশে ঝলমলে তারারা ফিনফিনে হয়ে যায় নিওন আলোর প্রতিফলনে। নুরিতা ছাদে হাঁটছে একা একা। বিকেলের ঘটনাটা মনের ভেতর শুধু খাবি খাচ্ছে। ভদ্রলোকের চেম্বারে গেছিল একটা অফিসের দরকারি কাজে। ঠিকানাটা দিয়েছিল তার ভাই। প্রথম দিন ভদ্রলোকের অফিসে বৃষ্টির মধ্যে কাকভেজা হয়ে জড়োসড়ভাবে উপস্থিত হতে হয়েছিল। সেদিন অনেক লোকের মাঝে প্রয়োজনটা ঠিক উপস্থাপন করতে পারেনি। তার ওপরে আবার বৃষ্টিতে ভিজে কেমন আড়ষ্ট ছিল। পরদিন অফিসে গিয়ে বসকে বলতেই সে খানিকটা উষ্মা প্রকাশ করে বললো, ঠিকঠাক মতো একটা কাজ যদি করতে না পারেন, তাহলে অফিস তো বন্ধ করে দিতে হবে। নুরিতা আর কিছু না বলে ফোনে ভদ্রলোকের সঙ্গে শুক্রবার দিনে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে। কাজটি করতেই হবে নাহলে তাকে সমস্যায় পড়তে হবে। দুই বছর ধরে সে মায়ের সঙ্গে থাকে।
নুরিতার স্বামী আছে কিন্তু সে অসুস্থ। দীর্ঘকালীন চিকিৎসা করতে তাকে নুরিতার ভাসুর দেবর মিলে একটা মানসিক চিকিৎসা ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে রেখে এসেছে তিন বছর আগে। সেই থেকে নুরিতা নিজের ওপর নির্ভরশীল হয়ে বাঁচার চেষ্টা করছে। ননদ ও জা’দের কটু কথায় অতিষ্ঠ হয়ে দুবছর আগে মায়ের কাছে ওদের বাবার বাড়ি এসে উঠেছে। বাড়ির একটা ফ্ল্যাট নুরিতার নামে। সেখানেই বর্তমান আবাসন।
দুই.
গোলাপি রঙের লিলেন সিল্কের শাড়ির সঙ্গে ম্যাচিং করে সামান্য হালকা পাতলা গয়না পরে ছিমছাম সুন্দর সেজেগুজে সেন্ট্রাল রোডের বারোতলা বিল্ডিংয়ের আটতলায় অফিসের সামনে এসে দাঁড়ায় নুরিতা। অফিসে আজ শুভ্রনীল একাই আছেন। ল্যাপটপে আঙুলের দ্রুততর মুদ্রায় স্ক্রিনে সৃষ্টি হচ্ছে সুন্দর সুন্দর অভিনব কোনো স্থাপনার নকশা। সেন্ট্রাল রোডে অবস্থিত এই অফিসটি একটি ডেভলপার কোম্পানির। এখানে শুভ্রনীল চিফ আর্কিটেক্ট। ভদ্রলোক বয়সের তুলনায় অনেক তরুণ দেখতে—লম্বা ছিমছাম সুন্দর গঠনের শ্যামলকান্তি পুরুষ যাকে বলে। নুরিতা ভেতরে টেবিলের সামনে বসতেই বুকের ভেতর ধুঁকপুক শব্দ টের পায়। অফিসের দরকারি কাজের ফাঁকে ফাঁকে নিজেদের কথাও শেয়ার করে দুজনে কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে। হঠাৎ শুভ্রনীল চেয়ার থেকে উঠে হাঁটাহাঁটি করতে থাকে অস্থির পায়ে। নুরিতা অনেকক্ষণ সময় ধরে অফিসের চেয়ারে বসে আছে। পা টা ঝিমঝিম করছে তারও। নুরিতাও সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ায়। শুভ্রনীল হঠাৎ বলে, আসুন আপনাকে আমার বারান্দায় নিয়ে যাই।
অনেক সুন্দর ছোট্ট একটা বাগান বারান্দায় একপাশে পাখির বাসা অন্য পাশে ছোট্ট একটা দোলনা। পাখিগুলোর কিচির-মিচির শব্দে নুরিতা কেমন ঝলমলে হয়ে যায়। অনেক দিন সে পাখির ডাক শোনে না, বাগানের ফুলের সৌন্দর্য দেখেনি, দোলনায় দোল খায়নি, নুরিতা দুই হাত তুলে তিনশো ষাট ডিগ্রি ঘুরে একটা আনন্দে হঠাৎ খলখলিয়ে ওঠে। হাসতে হাসতে ছুটে দোলনায় চড়ে বসে। নুরিতা ভুলে যায় সে তার পত্রিকা অফিসের দরকারে শুভ্রনীল চৌধুরির কাছে তার কোম্পানির একটা বিজ্ঞাপন নিতে এসেছিল। নুরিতার মনে পড়ে বিয়ের পর স্বামীর সঙ্গে বেড়াতে গিয়ে রিসোর্টের সেই দোলনায় চড়ার স্মৃতি। চোখ বন্ধ করে নুরিতা দুলতে থাকে দোলনায়। নুরিতা দশ বছর আগে ফিরে যায় তার অনুভূতিতে। সে দোলনায় চোখ বন্ধ করে দুলছে। হঠাৎ টের পায় পেছনে কে যেন এসে দাঁড়ায়। দোলনায় দোল দেয়। শরীরের ভেতরে কিসের যেন ঝাঁকুনি। সমস্ত রক্তবিন্দু শিহরিত হয়ে লোমকূপ খাড়া হয়ে ওঠে। নাকে আসে চেনা অচেনা পুরুষালি মাদকতাময় একটা সুগন্ধ যা কেবল টানে। আগুনের দিকে যেমন পতঙ্গের টান, তেমনি একটান নিজের ভেতরে অনুভব করে। কতদিন ধরে নুরিতা এই গন্ধ এই স্বাদের অনুভব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে। শরীরের ভেতরে কেমন সবকিছু অবশ হয়ে আসে। নিজেকে সমর্পণ করতে ইচ্ছে করে শক্ত কোনো বাহুডোরে। নুরিতা দোলনায় বসে মাথাটা পেছনে এলিয়ে দেয়। একটা বুকের মধ্যে গিয়ে ঠেকে। চমকে উঠে নুরিতা ঝট করে দোলনা থেকে উঠে পড়ে।
আপনি থাকুন আমি আসছি বলে নুরিতা দৌড়ে অফিসের ওয়াশরুমে গিয়ে নিজেকে আড়াল করে একজোড়া মুগ্ধ দৃষ্টির সামনে থেকে।
কিছুটা নিজেকে ধাতস্থ করে আয়নায় নিজেকে দেখে মুখের ঘামটুকু মুছে ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে আসে নুরিতা। শুভ্রনীল বারান্দা থেকে ভেতরে এসে একটা ক্যামেরা বের করে। নুরিতা বের হয়ে আসতেই বলে, আপনার কয়েকটি ছবি তুলতে চাই। তুলবো?
নুরিতা অপ্রস্তুত হয়ে বলে, না না সেকি এভাবে? মেকআপ ছাড়া ছবি পচা হবে।
আমি ন্যাচারাল ছবি তুলতে পছন্দ করি। আমি মন চাইলেই ক্যামেরা নিয়ে বের হয়ে পড়ি একা একা। ছবি তুলি। ক্যামেরা আমার থার্ড আই।
থার্ড আই! বাহ্ কী সুন্দর করে কথা বলেন আপনি।
তুলি ছবি—বলেই ক্যামেরা তুলে ক্লিক ক্লিক করে টিপতে থাকে শুভ্রনীল।
সে কি আপনি তো আমার এলোমেলো ছবি তুলছেন!
হ্যাঁ, শোন নুরিতা তোমার ঘাড় গ্রীবা আর পিঠ অনেক সুন্দর। তুমি কিছু মনে করো না এভাবে এলেমেলো ছবি তোলার জন্য। ওহ সরি, আমি তোমাকে তুমি করে বলছি। অবশ্য তুমি আমার চেয়ে ছোট এবং তাই মনে করলেও আমার কিছু খারাপ লাগবে না।
না না ঠিক আছে। আমিও তুমি বলতে শুনতে পছন্দ করি।
নুরিতা এসো তোমাকে আমার তোলা কিছু ছবি দেখাই।
নুরিতা শুভ্রনীলের কাছাকাছি এসে বসে। ল্যাপটপের দিকে চোখ রাখে। ছবি দেখতে দেখতে হঠাৎ দৃষ্টি আটকে যায় একটা মেয়ের ছবির দিকে। থমকে যায় আঙুল। একটা দীর্ঘশ্বাস মাথার ওপরে ঘুরতে থাকে।
নুরিতা প্রশ্ন করে ‘কে? কার ছবি?’
আমার এক বন্ধুর। হঠাৎ করে দূরে চলে গেছে আমাকে একা ফেলে।
ওহ্! সরি! নুরিতার মন খারাপ হয়ে যায় অজানা কোনো কারণে। কেন যেন একটু ঈর্ষা হয়! মনে মনে বলে এরকম কারও জন্য আমি হাজার দিন মাস অপেক্ষা করতে পারি। আর সে কি না এভাবে একা একা কষ্ট পাচ্ছে। নুরিতার মন খারাপ হয়ে যায়। শুভ্রনীলের দৃষ্টি এড়ায় না।
আরও পড়ুন: পাখিতোষ ॥ আশরাফ জুয়েল
শুভ্রনীলের সঙ্গে নুরিতা দরকারি কাজের কথা পাকাপাকিভাবে শেষ করে খুশি মনে। বলে এবার আমি যাবো।
তুমি কোথায় যাবে? আমি ফ্রি আছি এগিয়ে দেই?
না না ঠিক আছে, ধন্যবাদ—বলে দরজার দিকে এগিয়ে যায়।
নুরিতা শোন!
শুভ্র এগিয়ে আসে নুরিতার দিকে। খুব কাছাকাছি চলে আসে। নুরিতার পা থমকে যায়। কে যেন ভেতর থেকে বলে সমর্পণ করো নিজেকে। তুমি নারী, তুমি একা। তোমার একজন মানুষ দরকার একজন আপনার জন।
শুভ্রনীল এগিয়ে এসে দু’হাতে নুরিতার মুখটা তুলে ধরে বলে, শুধু একবার তোমাকে জড়িয়ে ধরে থাকতে দাও একটু সময়ের জন্য। আমার বুকের সব কষ্ট দূর করে দাও। আমার সব যন্ত্রণা।
নুরিতা চোখ বন্ধ করে। হাত থেকে ব্যাগটা খসে পড়ে ওর। মাথায় একশো একটা জোনাকি পোকা নাচানাচি করছে। নুরিতা আবেগে জড়িয়ে ধরে শুভ্রনীলকে। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে নুরিতার। শুভ্রনীলের ঠোঁটের উষ্ণতায় চঞ্চল হয়ে ওঠে নুরিতা। শরীরটা অবশ হয়ে যায়। শুভ্রনীলকে জড়িয়ে ধরেই নুরিতা মার্বেল পাথরের মেঝেতে পড়ে যায়। শুভ্রনীল কিছু না বুঝে উঠতে পারে না। হঠাৎ নুরিতার অবশ হয়ে যাওয়া শরীরটা পাঁজাকোলে করে ডিভানের ওপর শুইয়ে দেয়। আস্তে আস্তে ডাকে নুরিতা! নুরিতা!
নুরিতা চোখ খুলে শুভ্রনীলকে জড়িয়ে ধরে বুকের মধ্যে চেপে চিৎকার করে কাঁদতে থাকে।
শুভ্রনীলের বুকের ভেতর জড়িয়ে ধরে নুরিতা কতক্ষণ কাঁদছিল মনে নেই। শুধু খোলা নাতিদীর্ঘ চুলের ভেতর পরম মমতায় শুভ্র আঙুল ছুঁয়ে দিচ্ছিলো। হঠাৎ কান্না থামিয়ে চোখ মুছে নুরিতা উঠে ব্যাগটা মেঝে থেকে তুলে নিয়ে দরজা খুলে কিছু না বলে ছুটে চলে যায়।
শুভ্রনীল কোনো কিছু বলার সুযোগ পায় না।
নুরিতা চলে গেলে শুভ্র চোখ বন্ধ করে ডিভানের ওপর শুয়ে থাকে। পকেট থেকে সিগারেট বের করে ধরায়। চোখ বন্ধ করে টানে। একটা শেষ হয়ে গেলে আরেকটি সিগারেট ধরিয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। দোলনায় বসে। হঠাৎ ছোটবেলার কথা মনে পড়ে। মায়ের কথা মনে পড়ে। শুভ্রনীলের মা যখন মারা যায় তখন তার বয়স দশ কী এগারো বছর। মায়ের মৃত্যুর একবছর পর বাবা আবার বিয়ে করে। অবহেলায় সবকিছু কেমন যেন পর পর লাগতো সেই ছোট বেলায়। স্কুলের ফাঁকে ফাঁকে মাঠে মাঠে বনে বাদাড়ে ঘুরে বেড়াতো একা একা। সন্ধ্যার পর বাবা একবার খোঁজ নিতো ঘরে ফিরেছে কি না। পড়তে বসেছে কি না। তারপর একটু বড় হলে এক বন্ধুর সঙ্গে ক্যাডেট কলেজে ভর্তি হয় শুভ্রনীল। সেই বারো বছর বয়সে ঘরছাড়া হয়ে আর কখনো আপন করে ঘরে ফেরা হয়নি। ক্যাডেট কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি। পাস করে কিছুদিন ঘোরাঘুরি তারপর ধীরে ধীরে নিজের মেধা ও পরিশ্রমে আজকের এই অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে সে।
তিন.
বেকার থাকা অবস্থায় বিয়ে করেছিল ভালোবাসার নারীকে। কিন্তু সেটাও স্থির হলো না। স্বল্প আয়ের সংসারে শুভ্রনীলের স্ত্রী সামিরা মানিয়ে নিতে পারেনি। সংসারে আয় উন্নতি করার মতো ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা ছিল না ধনীকন্যা সামিরার । মধ্যবিত্ত পরিবারের শুভ্রনীলকে মেনে নিতে একসময় ধৈর্যহারা হয়ে চলে যায় একমাত্র ছেলেকে নিয়ে। সেই থেকে শুভ্রনীলের ভেতরে ধনী হওয়ার জেদ চেপে যায়। রাতদিন পরিশ্রম ও পড়াশোনা করে নিজেকে তার ক্যারিয়ারের চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে আসে।
অন্ধকারে দোলনায় বসে সিগারেট টানছিল শুভ্র। সিগারেটের আগুন লাগছে অন্ধকারে জোনাকি পোকার মতো। উঠছে নামছে। আকাশে ডিঙি নৌকার মতো চাঁদ। সেন্ট্রাল রোডের আটতলায় যে চাঁদ আর জাফরাবাদের ছয়তলায় ছাদে বসে নুরিতার দেখা চাঁদের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। নুরিতা আর শুভ্রনীল দুজনেই ভাবছিল আজকের সন্ধ্যাবেলায় ঘটে যাওয়া ঘটনা। দুজনকে দুভাবেই হয়তো আকুল করে ভাবাচ্ছিল বুকের ভেতর শিরশিরিয়ে ওঠা অনুভূতি। সেটা প্রেম না কি কামনা, কেউ হিসাব করে মেলাতে পারছিল না।
শুভ্রনীল ও নুরিতা দুই প্রান্তে দুজন অন্ধকার থেকে উঠে দাঁড়ায়। নুরিতা নিচে নেমে ওর ফ্লাটে ঢোকে আর গাড়ির চাবি নিয়ে শুভ্রনীল নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করে চলে পথের আলো-আঁধারির মাঝে কোনো উদ্দেশ্য ছাড়াই।