আর গোটা কয় ভাত হবিলানে মা। নারে বাপ এখন সবগুলান ভাত খাইয়ে লিলি রাতের বেলায় না খাইয়ে থাকতি হবিনি। মিলন মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। পাতের ওপর সামান্য যে ভাত ছিল, দীর্ঘ সময় ধরে আঙুল দিয়ে নাড়াচাড়া করতে থাকে এ সময়। মনে হয় তার পেটের অর্ধেকটাও ভরেনি। যে মগে করে ভাত দেয় তার মা, এমন তিন মগ ভাত সে একাই ভেতে পারে। অথচ এ বাড়িতে এক মগের বেশি ভাত কারও কপালে কখনো জোটে না। ছেলের চাহনি দেখে মাজেদার চোখ ভিজে যায়। কেন যে তার এই অভ্যাস গড়ে উঠল! আর এক পট চাউল বেশি নিলে এমন কী আর হতো! নিজের ভাতের পাত থেকে কিছু ভাত ছেলের পাতে তুলে দিয়ে যায় মাজেদা। হাত বাড়িয়ে বাধা দেয় মিলন। না রে মা। আমি তোক এমনিই কইলিম। আমার আর ভাত লাগবি নানে। তাহলি চালু যে। আর কোনো কথা বলে না মিলন। ভাতের থালে পানি ঢেলে উঠে দাঁড়ায়। ছেলের আধা পেট খাওয়া দেখে বুকের যন্ত্রণাগুলো আরও বেড়ে যায় মাজেদার । এদিক-ওদিক তাকিয়ে নিজেও থালার ওপর পানি ঢেলে ওঠে পড়ে। এমন যে মাজেদার নতুন হয়েছে তা কিন্তু নয়। এ বাড়িতে বউ হয়ে আসার পর থেকে এমটাই দেখে এসেছে সে। তার শাশুড়ি তাকে এভাবেই মেপে মেপে ভাত খাওয়া শিখিয়ে ছিলেন একদিন। তখন তাদের সংসারে অভাব আর অভাব।
আব্দুল কাদির হাল আবাদ করে। যত সামান্য জায়গা জমি রেখে বাপ তার যুদ্ধের সময় হারিয়ে গেল। কাদিরের মা পথ চেয়ে প্রতিদিন দাঁড়িয়ে থাকে। কিন্তু আর কোনোদিন ফিরে এলো না হাচেন মুন্সী। অথচ সংসারে এতগুলান মানুষ। মাথার ওপর যেন আকাশ ভেঙে পড়ে কাদিরের মার। ঘরের ধানে পুরো বছর যায় না কখনো। বস্তা নিয়ে অন্য বাড়িতে ধানের জন্য গিয়ে বসে থাকতে হয়। তখনকার দিনে তো আর এখনকার মতো হাটে বাজারে চাউল বিক্রি হতো না। যত সামান্য রাজাপুর হাটে পাওয়া গেলেও তার দাম শুনে কৃষকের বেটার মাথা ঘুরত। আর চাউল কিনে খেলে মনে হতো বাড়ির অপমান। কোনোদিন দুই চার দশ সের চাউল কিনলেও চোরের মতো বাড়ি ফিরতে হতো। মাজেদার চোখের সামনে এখনো কত কত স্মৃতির রোজনামচা। মনে হয় এ তো সেদিনের কথা। একবার হলো কী, ঘরের ধান ফুরিয়ে গেল। যে চাউল আছে ঘরে তা আর দু’দিনও যাবে না। মাঠের ধান পাকতে আরও ক’দিন চলে যাবে। ধানের জমির আইলে বসে ধান পাকার দৃশ্য দেখে কাদির। তখন সবেমাত্র দু’চারটি ধানের শিষে রঙ ধরেছে। সবুজের মাঝে সোনালি হয়ে আসার দৃশ্যকল্প। মাঠ ভর্তি ধান অথচ ঘরে কোনো ধান নেই। আর গোটা পাঁচ দিন গেলে মাঝে মধ্যে দেখে শুনে দশ বিশ আটি ধান কাটা যেতে পারে। মাঝের এ ক’দিনের কথা ভেবে ঘুম হারিয়ে যায় কাদিরের। তার পাশের জমি ছিলো মজিদ সেখের। তারও কাদিরের মতোই সংসার। জমির আশপাশে কাঁচি নিয়ে ঘুরতে দেখে মজিদ সেখকে। পারলে সে আজই ধানের জমিতে কাঁচি লাগাই। কাঁচিতে ধার দিয়ে আরও একদিন পার করে। পরেরদিন আর কিছুতেই যায় না। সাত সকালে মজিদ সেখ বড় ছেলের সাথে ধানের জমিতে ফ্যাস দেয়। কাদিরের চোখ চকচক করে ওঠে। এবার একটা উপায় হবেই। মজিদ শেখের কাছ থেকে দু’এক মন ধান নিয়ে এবার না হয় আকাল পাড়ি দেবে।
সন্ধার কিছু সময় আগে, তখনো মলন মলা শেষ হয়নি মজিদ সেখের। মের গরুটা বারবার দাঁড়িয়ে পড়ছে। মজিদ সেখের তিন গরুর সাথে কাদিরের এক গরু দিয়ে মলন মলছে মজিদ। মজিদের বউ কাদাল দিয়ে মলনের বাইরে আসা ধানগুলো তুলে দিচ্ছে কখনো। গতরাতে বৃষ্টি হয়ে যাওয়ার কারণে কিছু ধান মাটির সাথে গেথে যাচ্ছে। এম সময় একটা বস্তা নিয়ে মলনের সামনে গিয়ে হাজির হয় আব্দল কাদির। মজিদের বউ কাদাল রেখে এগিয়ে যায়। তা মুন্সীর ছাওয়াল যে, এই ঘোর সন্ধ্যায় আবার কী মনে কইরি? চাচি আর কইয়ো না। ধান পাকে নাই ঠিক। কিন্তু পেট পাইকি গিচে তো। আমার ধানে ফ্যাস দিতি আরও দই চারদিন চইলি যাবি একুনো। এই কয়দিন তো আর চলতি পারতিছিনি চাচি। তাই বস্তা লিয়ি আইলিম, চাচির কাচে যদি মন খানিক ধান পাওয়া যায়! আমারে যেনা আউস ধান, কয় মন আর হবিনি। তা বসো দেকা যাক। কাদির যেন হাব চাউরি যাবে। টেমর থেকে একটা বিড়ি বের করে আগুন লাগায়। মজিদ সেখ এগিয়ে আসে। তা বেটা বিড়ি কি একলা ধরালি হবিনি। আমাকেও একটা দেও। ততক্ষুণ গরুগুলান একটু দম লিক।
এক মন ধানের বস্তা মাথায় করে বাড়ি ফিরতে ভাতঘুম শেষ হয় কারও কারও। বারান্দায় ধানের বস্তা রেখে মাজেদাক ডাকতে থাকে কাদির। মাজেদা বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। কুপিবাতিটা জ্বালিয়ে এগিয়ে যায় বারান্দার দিকে। চোখের সমানে এক বস্তা ধান দেখে বুক ভরে বাতাস নেয়। কাদিরকে সঙ্গে করে বারান্দায় ধান ঢেলে ধামাতে উঠাতে থাকে। এই রাতের বেলায় চারিতে ধান ভিজিয়ে রাখতে হবে আবার। ভোর বেলায় সিদ্ধ করতে হবে। পরের দিন সকাল বেলায় আকাশে মেঘ জমল। কিছু সময় পর থেকে বৃষ্টি পড়তে শুরু হলো। সেই বৃষ্টির আর থামার নাম গন্ধ নেই। বারান্দায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টি থামার অপেক্ষা করে মাজেদা। কত কত সময় চলে যায়। দুপুর হয়ে আসে বৃষ্টি থামার নাম গন্ধ নেই। যে চাউল আছে বড় জোর সকাল পযর্ন্ত চলতে পারে। তারপর মাথা আর খেলে না মাজেদার। রাতের বেলাও সেই বৃষ্টি। তরে সারাদিনের মতো নয়। গতিটা বেশ কমেছে। সকালের ভাত দিয়ে দুপুর পার করেছে কোনো মতে। একবেলা পার হলে আরেক বেলার চিন্তা এসে ভিড় করে মাথার ওপর। এ বাড়িতে মাজেদার আসার পর থেকে সংসারের সব দায়িত্ব যেন তার। শাশুড়ি যেন শুধু হুকুম দেবায় ব্যস্ত। খাবার সময় এসে দেখবে কারও পাতে বাড়তি ভাত গেল কি না। সেদিন রাতের বেলায় আর রান্না হলো না। দুই পোয়া চাউল ভেজে নিয়ে এলো মাজেদা। চাউল ভাজায় সুবিধা এই যে, কোনো তরকারির প্রয়োজন পড়ে না। আর অল্পতেই পেট ভরে যায়। চাউল ভাজা খেতে খেতে দাঁত লেগে আসে। কাদির একটা পিয়াজ আর কাঁচা মরচের আবদার করে। কাঁচা মরিচ দু’চার থাকলেও কোনো পিয়াজ নেই ঘরে। দুই রঙ ধরা কাঁচা মরিচ কাদিরের সামনে এনে দেয়। চাউল ভাজা খাওয়ার পরই ঘুমের আয়োজন হয়। কুপিবাতি নিভাতেই মশার উৎপাত ঘটে। বৃষ্টির পর গরম যাচ্ছে না কিছুতেই।
________________________________________________________________________________________________ জমিও গেল ব্যবসাও গেল। তবে লাভ একটা হয়েছিল কাদিরের। সে হলো নুতন এক মাগি জুটেছিলো তার জীবনে। নতুন কাপড়ের ব্যবসা করে কাদির তখন। এ গ্রাম সে গ্রাম করে পাঁচ গ্রাম ঘুরে বেড়ায়। আর সপ্তাহে একদিন যায় মোকামে। সেখানেও তাঁতী বাড়ি ঘুরে ঘুরে একটু কম দামে কাপড় কেনার চেষ্টা করে। আর তাতি বাড়ি ঘুরতে ঘুরতে একদিন পরিচিয় হয়েছিল জুলার বউ তছিরনের সাথে। দু-চারদিন কখনো থেকেও যায় কোনো এক তাঁতি বাড়ি। তবে আতাহার তাঁতীর সাথে তার বড় ভাব। দোস্ত বলে ডাকে তাকে। তার বাড়িতেও থেকে যায় মাঝে মধ্যে। কখনো অকারণেও থাকে সেখানে। তাঁতীর বউকে একবার দেখলে বার বার দেখতে ইচ্ছে করে। শুধু এক নজর তছিরনেক দেখার উদ্দেশ্য সেখানে সে যাতায়াত করে। তছিরনের জন্য কখনো এটা ওটা নিয়ে যায়। এটা ওটা দেওয়ার উছিলায় কথা বলে।
________________________________________________________________________________________________
মধ্য রাতে ঘুম ভেঙে যায় মাজেদার। কিছুতেই আর ঘুম আসে না। প্রচণ্ড ক্ষুধা অনুভব হয়। পেটের মধ্যে মোচড় দিয়ে ওঠে বার বার। তারপরও বিছানায় এপাশ ওপাশ করতে করতে চলে যায় দীর্ঘ সময়। মনে মনে ভাবতে থাকে, এই মরার বৃষ্টি না গেলে, ভোর বেলায় আবার চুলায় ভেজা ধান শুকানো লাগবে। সেই ধান উনচানো হলে আবার ঢেকিতে নিয়ে চাউল বানাতে হবে । সেই চাউল হলে তবেই ভাত হবে আগামীকাল।
মিলন বাড়ি থেকে বের হয়ে যাওয়ার আগেই মাজেদা তৈরি হয়ে নেয়। তুলার মেলে এই বয়সেও কাজ করতে হয় তাকে। মিলন মোটর গাড়ির হেলপার। এখনো সেই ভাবে উপার্জন শেখেনি। বাড়ির আঙিনা পার হতে কাদিরের হাতে লাগানো পেয়ারা গাছটার দিকে নজর পরে যায় মাজেদার। মানুষটা এ বাড়ির অভাব দেকি আরেক মাগির কাচে গিয়ে উটলি। চাওয়াল পাওয়ালসহ আমাক সাগরে ভাসায়ে দিলি। কিন্তুক আমি তো মরিনি। চাওয়ালডা ডাইভার হতি পারলি আমার ভাতই কিডা খাবি। মাজেদা দুই পা গেলে তিন পা পিছায়। হঠাৎ তার মনে হয় সকাল বেলায় সে তো আজ মেল থেকে ছুটি নিয়ে এসেছে। তবে এখন কেন সে বাড়ি থেকে বের হচ্ছে আবার। ঘরে ফিরে আসে মাজেদা। বাড়ির সামনে গাছের মরা পাতার স্তূপ। পাতা গুলান ঝাড় নিয়ে এলেও কয়েক দিনের রান্না হবে তার। ঝাটা নিয়ে গাছের দিকে যেতেই লম্বা মতো পাকা দাড়িওলা এক মানুষকে এদিই আসতে থেকে চমকে উঠে মাজেদা। হঠাৎ বুকের মধ্যে কেঁপে উঠে তার। কে এই মানুষ মিলনের বাপ লা তো। মাটির রাস্তা থেকে এ বাড়ির দিকেই আসছে মানুষটা।
মানুষটার মাথায় গামছা। মুখে দাড়ি। প্রায় দাড়িই পেকে গেছে তার। আজ বছর দশক বাড়ি ছেড়েছে মানুষটা। আমরা কী খাইলিম! কোনে থাকলিম। ছাওয়াল মিয়ির কী হলি, তার কোনো খবর লিলিনা এতদিনেও। আর এখুন আইছে! মাজেদার সামনে এসে দাঁড়ায় আব্দুল কাদির। কিছু সময় কেউ কোনো কথা বলতে পারে না। একে অন্যের দিকে তাকিয়ে থাকে। চেনা মানুষের অচেনা হয়ে যাওয়ার গল্প শুনতে হবে এখন। কত রকমভাবে বানিয়ে একটা গল্প দাঁড় করাবে কাদির। মাজেদার মুখে কথার ঝড় আসে। কী জন্যি আইচেন কন তো আপনে। আমার তো নতুন কইরি রূপ বাড়ায় নাই। টাকাওয়ালা মাগি ধরি ছিলেন কী হলি তার? মানুষটা কোনো কথা বলে না, শুধুই কাঁদে। পুরুষের এমন কান্না দেখে রাগ বাড়ে মাজেদার। তারপরও একভাবে তাকিয়ে থাকে কিছু সময়। মাথার গামছা খুলে চোখ মুছে আব্দুল কাদির। দীর্ঘ সময় পর মুখ খুলে কাদির। কি রে মাজেদা। আমাক কি বাড়ির ভিতর যাতি কবুলা? যত দূরে থাকি তুই তো আমার প্রথম বউ। কী আমার বউ রে। ভাত দিবার মুরাদ নাই তো বউয়ের দাবি দিলে আইছে এতদিন পর। এতদিন যকুন ভুইলি থাকতি পারিছেন। এখুনও পারবেন। আমার সামনে থেকি যান কোচচি? তাছাড়া একটা কিচু কইরি ফেলাবোনে কিন্তু। আমার মাতায় খুন চাইপি গিচে! যান কচ্ছি। আমার কষ্টগুলান কি আপনে কোনোদিন বুজার চেষ্টা করিচেন। একুনো এক মগ ছাড়া দুই মগ ভাত কারুক দিতি পারিনি। আর আপনে আবার আইছি যুটলেন? আপনের তো এখন বুড়া বয়স। আপনাকেও তো খাওয়াতি হবি আমার। নারে বউ আমি একনো কিচু কাম কাজ করতি পারি। দরকার হলি আমি কামলা দেবো। কতজন আপনাক কামলা লিবিনি।
মুখে যতই বকুক কাদিরেক কিন্তু অন্তর তার জন্যি বার বার কাঁদে। জোর করে আর কোনো মায়া বাড়াতে চায় না সে। এখনো খেয়ে না খেয়ে দিন যায় তাদের। জায়গা জমি তো তখনই বিক্রি করে ব্যবসা শুরু করেছিল আব্দুল কাদির। তিন বছরও গেল না। জমিও গেল ব্যবসাও গেল। তবে লাভ একটা হয়েছিল কাদিরের। সে হলো নুতন এক মাগি জুটেছিলো তার জীবনে। নতুন কাপড়ের ব্যবসা করে কাদির তখন। এ গ্রাম সে গ্রাম করে পাঁচ গ্রাম ঘুরে বেড়ায়। আর সপ্তাহে একদিন যায় মোকামে। সেখানেও তাঁতী বাড়ি ঘুরে ঘুরে একটু কম দামে কাপড় কেনার চেষ্টা করে। আর তাতি বাড়ি ঘুরতে ঘুরতে একদিন পরিচিয় হয়েছিল জুলার বউ তছিরনের সাথে। দু-চারদিন কখনো থেকেও যায় কোনো এক তাঁতি বাড়ি। তবে আতাহার তাঁতীর সাথে তার বড় ভাব। দোস্ত বলে ডাকে তাকে। তার বাড়িতেও থেকে যায় মাঝে মধ্যে। কখনো অকারণেও থাকে সেখানে। তাঁতীর বউকে একবার দেখলে বার বার দেখতে ইচ্ছে করে। শুধু এক নজর তছিরনেক দেখার উদ্দেশ্য সেখানে সে যাতায়াত করে। তছিরনের জন্য কখনো এটা ওটা নিয়ে যায়। এটা ওটা দেওয়ার উছিলায় কথা বলে।
সেদিন আতাহার তাঁতী হাঁটে গেছে । বাড়িতে একলা একা তছিরন। বাড়িতে তার আট দশটা তাঁত চলে সব সময়। তাঁতের ঘরের সাথেই তছিরনের ঘর। টিনের ঘর টিনের বেড়া। তাঁত ঘরে মেঝের সাথে তছিরনের মেঝর ওপর একটু কেটে এক ছানালার মতো জাগয়া তৈরি করা আছে। আতাহার না থাকলে সেই খোলা জায়গা দিয়ে এটা ওটা এগিয়ে দেয় তাঁত চালকদের। বাদ বাকি সময় বন্ধ করে রাখে। কারও কিছু প্রয়োজন হলে এদিক দিয়েই দেয় তছিরন। দুপুর বেলা তখন। তাঁত ঘরেই ছিল কাদির। কাউকে না দেখে ওই নিচু জানালায় চোখ রাখে। জানালা বন্ধ। টোকা দিয়ে শব্দ করে। তছিরন তখন নিজের ঘরেই ছিল। তাঁতীদের মতো করেই সে বলতে থাকে মাকু দিতে হবি যে। জানালা খুলে তছিরন। হাত বাড়ায় আব্দুল কাদির। মাকু নিয়ে এগিয়ে আসে তছিরন। জানালার এপারে মাকুসহ হাত এগিয়ে দেয়। মাকু না ধরে তছিরনের হাত ধরে ফেলে আব্দুল কাদির। তছিরন টের পায় এই হাতের মানুষ কে? অজান্তে বলতে থাকে তছিরন। মাকু লিবে মাকু লেও, হাত ধরো কে? আর কিছুতেই হাত ছাড়ে না কাদির। আমি তোক…আর বলতে পারে না কাদির। ব্যাকুল হয় দুজন। শরীরে শিহরণ দিয়ে যায়। মুগ্ধতা এসে ভিড় করে চারপাশে। হাত ছেড়ে দেয় বেশ অনেক সময় পরে।
তার বেশ কিছুদিন পর। আবার যখন দেখা হয় তছিরনের সাথে, তখন তছিরন বিধবা। এক ঝড়ের সন্ধ্যায় হাট থেকে বাড়ি ফেরার পথে নৌকা ডুবি মরে যায় আতাহার। সেই স্মৃতি তখনো পুরোটা ভোলেনি তছিরন। এমন এক দিনে আবার দেখা আব্দুল কাদিরের সাথে। সেই মাকুর পরিবর্তে হাত ধরার স্মৃতি জেগে ওঠে আবার। তছিরন সেদিন সেখানেই থেকে যেতে বলে কাদিরকে। তারপর আর ফিরে আসেনি আব্দুল কাদির। তছিরনকে বিয়ে করে তার কাছেই থেকে যায়। এসব কথা একদিন লোক মুখে সব জেনেছিল মাজেদা। আব্দুল কাদির সব ভুলে গেলেও এখনো কিছুই ভোলেনি মাজেদা।
মাজেদার বারান্দায় পিড়া পেতে বসে আছে কাদির। আর মাজেদা বারান্দার খুঁটির সাথে হেলায় দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তখন। মাজেদার খোলা চুল বাতাসে উড়ছে মেঘের মতো করে। মলিন শাড়ির ভাঁজে দুঃখগাথা। কী করবে সে এখন। আরেক বউয়ের কাছ থেকে কি একেবারেই চলে এসেছে আবার। নাকি দেখতে এসেছে তাদের। তবে দেখতে এলে তো এতদিনেও আসতে পারত। তখনো চপু করে বসে আছে আব্দুল কাদির। কী ব্যাপার আপনে কি একেবারেই চইলি আইছেন নাকি? কোনো উত্তর করে না কাদির। চুপ কইরি আচেন ক্যান। কতা কোচ্ছেন না যে। কী কোব তোক ক? আমার যে আর কিচুই কবার নাই রে বউ। আমি যে সব হারাইচি। এখন তুই যদি আমাক না রাখিস, তালি আমি কোনে যাব ক। মাজেদা ভেবে পায় না। কী করবে সে এখন। তছিরনের কথা বাদ বাকি অজানাই থেকে যায়।
সে রাতে বাড়ি ফেরে না মাজেদার ছেলে মিলন। মাজেদার কাছেই থেকে যায় আব্দুল কাদির। হয়তো আজ আবার গাড়ির সাথে গেছে মিলন। মনে হয় কিছু সময়ের জন্য সব ভুলে যায় মাজদা। দীর্ঘদিন পর এক অন্য্য রকম রাত আসে তার জীবনে। এক অন্য রকম অুনভব। এই পড়ন্ত বয়সেও কাদিরেক বুকে আগলে ধরে রাখতে চায় সে আবার। হারিয়ে যাওয়া যৌবন ফিরে আসে আবার। কেউ সারারাতে ঘুমুতে পারে না। কথায় কথায় রাত্রী গভীর হয়। মাজেদা টের পায় এই এতদিন পর কাদির তাকে জাগিয়ে দিচ্ছে। বুকের সব হাহাকার ভুলে বুকের অনলে পোড়ে দুজনার মন। যতই অভাব আসুক আবার জীবনে। আবার যতই ভাতের হাড়ি শূন্য হোক। মাজেদার মনে হয়, সে যেন মলিন কাব্যের গোধূলি এক । ইচ্ছে করলে গোটা পৃথিবীটাকে সে আলিঙ্গন করতে পারে। ঠিক যেন আব্দুল কাদিরের মতো ধরে রাখতে পারে।
পরেরদিনও তুলার মিলে যাওয়া হয় না মাজেদার। কাদিরের জন্য রান্না করতে বসে নতুন মাটি দিয়ে লেপা চুলায়। মন যেন তার লকলকে কুমড়োলতার মতোত। চুলাতে মুরগীর ডিম সিদ্ধ করতে দিয়ে, ঘর থেকে তিন পট চাউল পাতিলে নিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। মনে হলো একটা ভ্যান এসে বাড়ির সামনে দাঁড়ালো তখন। মাজেদা তাকিয়ে থাকে। ভ্যানের ওপর একবস্তা চাউল নিয়ে বসে আছে মিলন। আব্দুল কাদির তখনো ঘুমিয়ে আছে। মনের মধ্যে ঝড় উঠল মাজেদার। সে মানলেও মিলন কি মেনে নেবে তার বাবাকে। এতদিন যাকে সে মৃত ভেবে এসেছে!