মনে রাখতে হবে, জীবিত নেতার চেয়ে আমাদের কাছে প্রয়াত নেতা অনেক বেশি শক্তিশালী। সিনিয়র সহ-সভাপতির এমন বক্তব্যে ফিরে আসে কিছুটা স্বাভাবিকতা। হতবিহ্বল কর্মীরা এতক্ষণ মাঝিহীন জাহাজের যাত্রীর মতো দুলছিল। সিনিয়র নেতার এমন বক্তব্যে দূরে কোথাও এক চিলতে আলোর রেখা দেখতে পাচ্ছে তারা। মরুভূমির প্রান্তরে বয়ে গেলো যেনবা স্বস্তির বাতাস। মূল পার্টি, যুব পার্টি, ছাত্র পার্টি, মহিলা পার্টি; এমনকী স্বেচ্ছাসেবক পার্টির যেসব নেতা বুঝতে পারেননি কী করবেন, কী করা উচিত এই অসময়ে, তাদের ভেতর জেগে ওঠে নব-জীবনের গান। নেতার রুহের মাগফেরাত কামনা করে জেলার প্রতিটা সাংগঠনিক ওয়ার্ডে আয়োজন হবে মেজবানের। চিকন চালের ভাত, গরুর মাংস আর ডাল। যারা গরু খায় না তাদের জন্য ছাগল।
এই বিশাল আয়োজনের দায়িত্ব পড়ছে পার্টির মূল দলের প্রতিটা ওয়ার্ড কমিটির কাঁধে। আয়োজনে যত ধরনের আর্থিক সহযোগিতা দরকার তা করবে মন্ত্রীর নেতৃত্বে গঠিত জেলা শোক কমিটি। পার্টির যুব শাখার কাজ অনুদান আদায়ে সহযোগিতা করা, নিমন্ত্রণ আর শৃঙ্খলা বিধানে নিয়োজিত থাকা। ছাত্র পার্টির কাজ প্রচার ও প্রকাশনা। জেলাজুড়ে ব্যানার-ফেস্টুনে ছড়িয়ে দিতে হবে নেতার মৃত্যুর খবর। স্বেচ্ছাসেবক পার্টির দায়িত্ব রাত জেগে মেজবানির রান্নাবান্নায় বাবুর্চিদের সঙ্গে কায়িক শ্রম দেওয়া।
বাইরের লোক একেবারেই অ্যালাউ হবে না এসব কাজে। বোঝা তো যায় না, কে কোন মতলব নিয়ে থাকে। মহিলা পার্টি মেজবানে আসা মা-বোনদের সামাল দেবে। হাই প্রোপাইল নেতারা ঠিকঠাক খেলেন কি না, কোনো অসুবিধা হলো কি না, তাও খেয়াল রাখতে হবে জেলার মহিলা পার্টির দায়িত্বশীলদের। ধনী-গরিব-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই আসবে মেজবান খেতে। এজন্য অন্যান্য প্রচারের ফাঁকে ব্যাপকভাবে করতে হবে মাইকিং। অমুক ভাইয়ের চরিত্র, ফুলের মতো পবিত্র টাইপের কড়াস্বরের ক্যানভাস নয়, ধীরলয়ে যথাযথ শোক কণ্ঠে ধরে ছড়িয়ে দিতে হবে দাওয়াতের বাণী।
মেজবানের খানাপিনা শুরু করার আগে হবে দোয়া মহফিল। মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিনদের অবশ্যই শরিক হতে হবে দোয়ায়। মন্দির প্যাগোডায় প্রার্থনার ব্যবস্থা করবেন পুরোহিত-ভিক্ষুরা। তারও আগে মেজবান স্থলের অস্থায়ী মঞ্চে হবে আলোচনা সভা, নেতার জীবন ও কর্ম নিয়ে সামান্য আলোকপাত। অবশ্য সময় আরেকটু পাওয়া গেলে করা যেতো একটা স্মরণিকাও। এবার হয়নি, সামনে নেতার জন্মবার্ষিকীতে হতে দোষ কোথাই! পুস্তিকা করার দায়িত্ব আগ বাড়িয়ে নিয়ে রেখেছেন জেলার সাংগঠনিক সম্পাদক, তিনি আবার টুকটাক ফেসবুকে লেখেন কি না! আয়োজনে এসে আমজনতা দেখুক নেতার জন্য জেলা পার্টি কী করলো! মন্দলোকেরা দেখুক নেতার কলিজা কত বড়, নেতার বিদেহি আত্মার প্রতি কতটা শ্রদ্ধাশীল তার হাতে গড়া সংগঠনের কর্মীরা। কোন ত্রুটি গ্রাহ্য করা হবে না এই আয়োজনে। ত্রুটি মানে নেতার আত্মাকে কষ্ট দেওয়া, নেতার স্মৃতির প্রতি অসম্মান করা।
জেলা পার্টির সভাপতির মৃত্যুখবর ইতোমধ্যে দেশের লোকজন জেনে গেছে টেলিভিশন আর অনলাইন নিউজের কল্যাণে। অবশ্য তারও দ্রুতবেগে ছড়িয়ে গেছে ফেসবুকের কারণে। এর ভেতরেই পার্টির স্পার্ট ছেলেরা নেতার ছবি দিয়ে প্রোপাইল-ফ্রেম বানিয়ে নিয়েছে ফেসবুকে। তারা নেতাকে বুকে ধারণ করে এটা প্রকাশের এ-এক বড় সুযোগ। এর আইডি ওর আইডি হয়ে নেতা এখন ফেসবুকের দুনিয়ায় ঘুরছে দ্রুতবেগে। নেতা আমৃত্যু জেলা পার্টির সভাপতি, কেন্দ্রের দাপুটে প্রেসিডিয়াম। পার্টি প্রধানের কাছে নেতার আছে বিশেষ কদর। সে এক লম্বা ইতিহাস। দুনিয়ায় কেউ এমনে কদর পায় না, নেতা পেয়েছেন তার কর্মের জোরে। পার্টি আর পার্টিপ্রধান তো বেখবর নন, দুঃসময়ে জেলার রাজনীতি আর পার্টি অফিস দুটোই আগলে রেখেছিলেন এই বর্ষিয়ান নেতা। মাঝে অবশ্য একবার পার্টি-প্রধান ভুল বুঝেছিলেন, তাও ক্ষণিকের জন্য। ব্যাপার তেমন গুরুতর না। নেতার ছোট ছেলে প্রেম করে পালিয়ে বিয়ে করেছিল বিরোধী পক্ষের এক নেতার মেয়েকে। মেয়ের বাবা অপহরণ মামলা করে শেষতক রাজনীতির মাঠ ঘোলা করতে চাইলেও সে সুযোগ দেননি নেতা। নেতার হাত কত লম্বা আর রণ-কৌশল কত মজবুত তা প্রবীণ নেতারা এখনো আওড়ায় ফাঁকতালে।
নেতার কলা তো কাটতে পারেনি উল্টো মেয়ের জামাইকে সাদরে বরণ করতে হয়েছিল বিরোধী নেতার। মিডিয়া নেতার ছেলের বিবাহোত্তর অনুষ্ঠানকে আখ্যা দিয়েছিল রাজনৈতিক-সামাজিক মেলাবন্ধন হিসেবে। অথচ পার্টির যারা নেতাকে কিছুটা অপছন্দ করতেন, তারাই কেন্দ্রকে ভুল তথ্য দিয়েছিল এরকম চমৎকার একটা ব্যাপারে। পারেনি, তারা কচুরি ফেনার মতো ভেসে গেছে নেতার কৌশলে। কেন্দ্র এতক্ষণে বিবৃতি তৈরি না করার কথা না, হয়তো শোকবার্তা মিডিয়ায় পৌঁছে যাবে অনতি বিলম্বেই।
কিন্তু নেতার ছোট ছেলে সুইডেন থেকে আসবেন, যথাসময়ে এয়ার-সিডিউল না পেলে তার আসতে আরও দুদিন লাগতে পারে। এর মধ্যেই যাবতীয় প্রস্তুতি শেষ করতে হবে।
সবকিছু তো আর কেন্দ্রের দিকে তাকিয়ে থাকলে হয় না। জেলার সিনিয়র সহসভাপতি আর সেক্রেটারি তাই ঘোষণা করে বিপুল কর্মযজ্ঞের। তাতে শোক সন্তপ্ত কর্মীদের মাঝে খেলে যায় আশার ঝিলিক। পার্টির এক প্রবীণ নেতা স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠেন। নেতা আমাকে খুব ভালো জানতেন, ভাইয়ের মতো ভালোবাসতেন। এই শরীরের রক্ত-মাংস সবটাই নেতার দয়া। বয়সকালে কতজনকে দেখলাম কিন্তু তার মতো মানুষ হয় না এই জমানায়। আচমকা অদৃশ্য এক ছায়া প্রবীণ নেতার কানে কানে বলে, আর কত? নেতা বেঁচে থাকতে ডিগবাজি কম খাওনি, বদনামিও কম করোনি, এবার থামো! যুব পার্টির ডাকসাইটে আরেক নেতা যেনবা ধমক দিয়ে ওঠেন, এখন শোক করার সময় নয়।
আমি কোথাই ছিলাম, কী হলাম সব নেতার জন্যে। ফুটপাতের এক হকারকে নেতা বুকে ঠাঁই দিয়েছিলেন বলেই… আতকা কেঁদে ওঠে যুবনেতা। ছায়াটি যুবনেতার কানের কাছে শোনায়, ছিলে হকার্স মার্কেটের পকেটমার, এখনো কমিশন না পেলে রক্তারক্তি করতে ছাড়ো না; ধোয়া তুলসিপাতা সাজতে হবে না আর! ছাত্রনেতা দমার পাত্র নয়। সে বলা শুরু করে, নেতা নেতা-ই। তার পয়দা হয়েছিল বলেই হাজার হাজার ছাত্র আজ স্বপ্ন দেখে, রাজনীতির মাঠে আসতে পারে সাহসের সঙ্গে। তিনি ছিলেন হাজারো ছাত্রের লিডার, আমাদের পিতা। তার গলা ধরে আসে, বসে পড়ে চেয়ারে। ছায়াটি ছাত্রনেতার কানে বাজিয়ে দেয়, ছাত্রদের কোনো কল্যাণে কাজ করেছ তুমি? বিয়েথা, নেশাখোরদের আখড়া বানিয়েছ পার্টিকে। টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি কোনটা করো না, তোমরা? স্বেচ্ছাসেবক পার্টির এক নেতা ফ্লোর নেন এই সুযোগে, কী আর বলবো, জেলায় আমাদের রাজনীতি করার কোনো সুযোগ ছিল না। নেতা কমিটি দিয়েছেন বলেই খেয়েপরে বেঁচে আছি। নেতা ছিলেন আমাদের আস্থা আর বিশ্বাসের ঠিকানা। তিনিও চোখ মুছলেন রুমালে। ছায়াটি স্বেচ্ছাসেবক নেতাকে মনে করিয়ে দেয়, রিলিফের চাল-গম থেকেও কমিশন খাও, কালভার্টে লোহার বদলে দাও বাঁশ; এখন মায়াকান্না শোনাতে লজ্জা করে না?
ধরা গলায় মহিলা পার্টির নেত্রী বলেন, নেতার মহাপ্রয়াণে মহিলা পার্টি আজ অভিভাবকহীন। নেতাই ছিলেন আমাদের মাঝি। কী বলবো, ভাবীর জন্যেও কষ্ট লাগছে। কথা আর বাড়াতে পারেন না মহিলানেত্রী। টিস্যু দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বসে পড়েন যথা আসনে। ছায়াটি কী ভেবে মহিলা নেত্রীর দিকে আর আসে না, তার কীর্তি সম্পর্কে এই শোকের দিনে না শোনানোই ভালো। লোকে ভরপুর পার্টি অফিস। অন্য সময় নেতাকে ঘিরে যারা আদবের সঙ্গে নিচু স্বরে কথা বলতেন, তারা আজ দিশাহীন। অনেকের স্বর কর্কশ, উগ্র। পার্টির সিনিয়র সহ-সভাপতি মুরব্বি হিসেবে সবার মাঝ বরাবর বসা। তার দিকে তাকিয়ে নেতা-কর্মীরা। ভাবেসাবে বোঝা যাচ্ছে, তিনি চট করে কিছু বলার পক্ষে না। সেক্রেটারিই মুখ খুললেন, শোনেন ভায়েরা, আমরা বড়ই দুঃসময়ের মধ্যে যাচ্ছি। আমাদের প্রয়াত নেতারও এরকম সময় গেছে। তিনি বারবার প্রতিপক্ষকে পরাস্থ করেছেন আপনাদের সাথে নিয়ে। আমরা গভীর শোকাহত তবু নেতার সম্মানের জন্য যেসব কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে, তা পালন করতে হবে। নেতা পার্টিকে, আমাদের দু’হাত ভরে দিয়েছেন, এখন তাকে সম্মান দেওয়ার পালা। মনে রাখবেন নেতা আমাদের সাথেই আছেন। কেন্দ্রে খবর নিয়েছি, পার্টি প্রধান আমাদের শোক-কর্মসূচিতে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। মন্ত্রী মহোদয়ের সাথে আলাপ হয়েছে। নেতার বড় ছেলের সাথে কথা হয়েছে, তিনিও আমাদের সাথে আছেন। তিনি বলেছেন, সিঙ্গাপুরের সেই হাসপাতাল থেকে নেতার লাশ দেশে আসতে একদিনের মামলা। কিন্তু নেতার ছোট ছেলে সুইডেন থেকে আসবেন, যথাসময়ে এয়ার-সিডিউল না পেলে তার আসতে আরও দুদিন লাগতে পারে। এর মধ্যেই যাবতীয় প্রস্তুতি শেষ করতে হবে। ভায়েরা আমার, শোককে শক্তিতে পরিণত করে এখন কাজ করার সময়, আপনারা কর্মসূচি পালনে ঝাঁপিয়ে পড়ুন।
জীবনকালে কত জনে নেতাকে মাফিয়া বলেছে, গালাগাল করেছে, তাদের মৃত্যুতে কি গাছের পাতাও নড়েছে! যতসব বিরোধীদের চক্রান্ত।
ঢাকায় এক দফা জানাজা হয়ে গেছে নেতার। এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে এবার জেলা সদরে আনার পালা। পার্টি অফিসে একেকটা সেকেন্ড কাটছে রাজ্যের উৎকণ্ঠায়। মন্ত্রী মহোদয় ঢাকা থেকে ফোনে যোগাযোগ রাখছেন সার্বক্ষণিক। জেলা শহরে পার্টি অফিসের জানাজা শেষে নেতাকে নেওয়া হবে তার জন্মগ্রামে। পিতার পাশেই নেতার জন্য খোঁড়া হয়েছে কবর। আহ্ নেতা! আজীবন জেলার রাজনীতি, জেলার মানুষকে আগলে রাখতে গিয়ে কেন্দ্রে যাননি, নেননি রাষ্ট্রীয় দায়িত্বের স্বাদ। শেষবেলায় এসেও স্থান নিলেন অজপাড়াগাঁয়। এমন নেতার তুলনা করে কোন অর্বাচীন? গাড়িবহর রেডি করা আছে, নেয়া আছে প্রশাসনিক-রাজনৈতিক প্রস্তুতি। গ্রামে নেতার লাশ নিয়ে যাবে যে অ্যাম্বুলেন্স তার সামনে থাকবে পুলিশের গাড়ি, পেছনে বড়ছেলের গাড়ি, পরিবারের গাড়ি, তারপর পদমর্যাদা অনুযায়ী মন্ত্রী-এমপি-নেতা-পাতি নেতাদের গাড়ি। পার্টি অফিস থেকে নেতার গ্রামের বাড়ি পর্যন্ত দীর্ঘ রাস্তায় একটু পর পর দৃশ্যমান থাকবে শোক-ব্যানার। জীবনকালে নেতা কোথাও গেলে যেমনিভাবে থাকতো স্বাগতম-ব্যানার, তোরণ। নেতার বড় ছেলে খুশি হবেন, কেন্দ্র খুশি হবে, মন্ত্রী মহোদয় খুশি হবেন। মিডিয়া কভারেজও মন্দ হবে না। কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয় প্রচার-প্রকাশনায়।
ছাত্র পার্টির জেলা সভাপতি-সেক্রটারি আবার দারুণ করিৎকর্মা। ধরে আনতে বললে বেঁধে আনে। তারা পারবে, তাদের উপর নেতার আস্থা ছিল, আমাদেরও আছে, মনেমনে একটু সুখ অনুভব করেন পার্টির জেলা সেক্রেটারি। মৃত্যুও যে কত মহান করতে পারে একজন মানুষকে তা নেতার মৃত্যু না দেখলে বিশ্বাস করা যেতো না। জীবনকালে কত জনে নেতাকে মাফিয়া বলেছে, গালাগাল করেছে, তাদের মৃত্যুতে কি গাছের পাতাও নড়েছে! যতসব বিরোধীদের চক্রান্ত। নেতা যে কত বড়নেতা, তা কালকেই বুঝবে জেলার লোকজন।
ওয়ার্ড থেকে ফোন আসে, ইউনিয়ন-পৌরসভা থেকে ফোন আসে, উপজেলা থেকে ফোন আসে কোথাও শোক-ব্যানার ওঠেনি। সিনিয়র সহসভাপতি-সেক্রেটারি সিনিয়র নেতাদের নিয়ে বসেন আলোচনায়। সিনিয়র সহসভাপতির নতুন পাঞ্জাবির এক কোণা ছেঁড়া, তড়িগড়ি করে আসতে কোথাও লেগেছে হয়তো। সেক্রেটারির ফিনফিনে সাদা পাঞ্জাবি ঘামে জবজব করছে। ঘটনা কী, এমনটা হবে কেন? ছাত্র পার্টির জেলা সভাপতি-সেক্রেটারিকে ফোন লাগায়, সংযোগ পায় না। আকাশ ভেঙে পড়ার দশা। কেন্দ্র কী ভাববে, মন্ত্রী কী ভাববেন, নেতার পরিবার কী ভাববে! অকূল পাথারে পড়ে দুই নেতা শুরু করে দেয় পরস্পরের দিকে দোষাদোষী। খিস্তি-খেউড় শুনে মনে হবে চৈত্রের দাবদাহে দুই কুত্তার ঝগড়া। সিনিয়র সহ-সভাপতি রাগ ধরে রাখতে না পেরে চিল্লায়ে ওঠেন, সব তো আপনার লোকদের দায়িত্বে, এবার বোঝেন ঠেলা! আমি আগে থেকেই জানতাম এমন অশুভ কিছু হবে, সকালেই বেয়াক্কেল কাক কাঁ কাঁ করছে কি না জানলার পাশে! বারবার আমার লোকেরা সব জোগাড়জন্তর করবে, আপনার লোকেরা মাঠে মেরে দেবে। এই মুখ কেমনে দেখাবো কাল!
সেক্রেটারি কাকে যেন ফোনে বলছেন, নেতারটা পরে, আগে শহীদ ছাত্র নেতার ব্যানারটা সাঁটানো হোক জেলাজুড়ে।
ফোঁস দিয়ে ওঠেন সেক্রেটারি, সভাপতি আমার গ্রুপের হলে সেক্রেটারি আপনার গ্রুপের। একা কিছু তো করা যায় না। দেখেন গণ্ডগোলটা হয়তো আপনার ছেলেরাই পাকিয়েছে। বলি, এভাবে আমার নাক কাঁটা যাবে না, আমি ঝানু প্লেয়ার। শোক ভুলে মুহূর্তের উত্তেজনায় কাঁপছে দুই হেভিওয়েট জেলা-নেতা। উভয়ের নজর এখন খালি হওয়া নেতার চেয়ারের দিকে, এ লক্ষণ ভাষায় নয় শরীরে প্রকাশ পাচ্ছে বেশ। নিজেদের প্রেস্টিজের চাকা পাংচার হওয়া থেকে বিরত রাখার তর্কযুদ্ধের এই পর্যায়ে এক ছাত্রনেতা এসে সেক্রেটারির কানেকানে কী সব বলে দ্রুত সরে যায়। বলেছিলাম তো, এরকম কিছু একটা হবে। আমার লোক মারা পড়বে তা আগে থেকেই জানতাম। আমি তো রাজনীতি করি মীর জাফরদের সাথে! ক্রোধে ধুম করে বসে পড়ে সেক্রেটারি।
আরেক ছাত্রনেতা এসে সিনিয়র সহসভাপতির কানে কিছু একটা বলে যায়। অন্য সময় হলে চেহারায় যথেষ্ট কাচুমাচু ভাব ধরে রেখে হয়তো নেতার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকতো সে, আজ আবহাওয়া ভিন্ন। সিনিয়র সহসভাপতি ছেঁচিয়ে ওঠেন, এজন্যই নেতা বলতেন, ক্লিন ইমেজের পোলাপাইন নিয়া কাজ করবি। গাণ্ডুরা নেতা হতে পারে না, সন্ত্রাসী হয়ে পার্টির তরী ডুবায়। আজকাল আবার মেধাবী ছাত্ররা কদর পায় না আপনার কাছে! সেক্রেটারির সুর নরম হয়ে আসে। ভাই, কী করা যায় এখন? ওদিকে আসার পথে নেতার লাশ। উপস্থিত হাজেরানে নেতাদের দিকে মিনতিভরা চোখে তাকায় সেক্রেটারি। প্রবীণ এক নেতা নিরবতা ভাঙে এবার। মনেহয় এতক্ষণ ঝিম মেরে দাবার কোন কঠিন চাল বের করার চেষ্টায় ছিলেন। ধ্যানীর মতো করে তিনি বলা শুরু করলেন, বুদ্ধি তো একটা আছেই, যে কর্মীটি মারা পড়েছে তার লাশ নিয়ে শুরু করতে হবে রাজনীতি! জেলার লোক, মিডিয়াকে জানান দিতে হবে, বিরোধীদলের সন্ত্রাসীদের গুপ্ত হামলায় শহীদ হয়েছে সে। নেতার প্রয়ানে এত বড় আয়োজন সহ্য করতে না পেরেই বিরোধীমহল এহেন ঘৃণ্য কাজ করেছে। এর সুষ্ট তদন্ত ও বিচার চাই। সঠিক বিচার না হলে বিরোধী দলীয় একজন রক্তপিপাসুও রেহায় পাবে না, রক্তের বদলা রক্ত, খুনের বদলে খুন। প্রবীণ নেতার এমন অভয়ে চিক চিক করে ওঠে সেক্রেটারির মুখ।
বড় ঝড় শেষে পরিবেশ হালকা হওয়ার পস্ট তৃপ্তি দেখা যায় তার মুখে। সত্যিই তো, রাজনীতিকে দেখতে হবে রাজনীতির চোখে। ঢোক গিলে প্রবীণনেতা আবারো বলেন, আর হে, নিশ্চিত করতে হবে, ব্যানার ছাপানোর কমিশন নিয়ে দুই গ্রুপের কামড়াকামড়িতে আমাদের যে ছেলেটা মারা পড়ছে, এটা যেন কাকপক্ষীও টের না পায়; নেতার বড় ছেলে, মন্ত্রী মহোদয়ের কানে তো নয়-ই! সময় বেশি নেই হাতে, এর ভেতরে যা করার করতে হবে।
সেক্রেটারি কাকে যেন ফোনে বলছেন, নেতারটা পরে, আগে শহীদ ছাত্র নেতার ব্যানারটা সাঁটানো হোক জেলাজুড়ে।