বারবার ডাকাডাকিতে বেডরুম থেকে বেরিয়ে এলেন রাহনূমা সিদ্দিকা। ধানমন্ডি ২৭-এর যে বাড়িটায় তিনি পরিবার নিয়ে বসবাস করছেন, সেখানে ঈষৎ গাড়ির হর্নও আসে দিনে-রাতে। তবে রাহনূমা সিদ্দিকার ঘুম ভাঙানোর মতো হর্ন অন্তত গত ২৫ বছরে বাজেনি। মফস্বল শহর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কলেজ পাড়ার যে বাড়িতে বড় হয়েছেন তিনি, সে বাড়ির পেছন দিক দিয়ে সোজা পূর্ব-দক্ষিণ কোণ ধরে চলে গেছে ঢাকা-সিলেট-চট্টগ্রাম রেললাইন। মধ্যরাতে আন্তঃনগর ট্রেনের ‘পোঁওও’ করা বিকট শব্দেও ঘুম ভাঙেনি রাহনূমা সিদ্দিকার। ২৫ বছর আগে জন্মশহরটি খানিকটা মফস্বলই ছিল দেখতে। পুরো শহরে ছয়তলা বাড়ি বলতে কাওতলী-নতুন স্টেডিয়ামের পূর্বপাশের একটি হালকা সবুজরঙা বাড়ি। ওই বাড়িটির ওপরেই মোবাইল
কোম্পানিগুলোর টাওয়ার বসে প্রথম। মেড্ডা দিয়ে শুরু শহরের শেষপ্রান্তে ছিল কাওতলী বাজার। আর কুরুলিয়া খালের ব্রিজ পেরুলেই ভাদুঘর। ছোট্ট এ শহর এখন অনেক বড়। বিস্তার ঘটেছে ইট-পাথরের। শহরের পূর্বপাড় ঘেঁষে চলে যাওয়া তিতাস নদীর জলেও টান পড়েছে। এই তিতাস পাড়ে বসেই নৌকাবাইচের সঙ্গে বন্ধুত্ব ছিল রাহনূমা সিদ্দিকার। নব্বইয়ের শুরুর দিকেও শহরজুড়ে সবুজ গাছভরা আর পুকুরে সমৃদ্ধ ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর। মহকুমা এ শহরের রাজ্যের ব্যস্ততা বলতে কোর্ট-কাচারী। বিকাল হলে বড় জোর শহরের নিউ মার্কেট আর কাচারী পুকুরপাড়ে ছেলেপেলেদের ক্রিকেট খেলা। এই কয়েকটি জায়গা ছাড়া পুরো শহরই ছিল কোলাহলমুক্ত।
বিয়ের পর স্বামীর ঠিকানা ঢাকায় পা ফেলতেই রাহনূমা সিদ্দিকা অনেকটাই বিপর্যস্ত ছিলেন। নরম শহর ছেড়ে ইট-পাথরের গ্যারেজে কারই বা মন টেকে! কিন্তু রাহনূমা টিকে গেলেন নীরব বাসা পেয়ে। ব্যবসায়ী স্বামী সকাল হতেই বাসা থেকে বেরুতেন, আর ফিরতে ফিরতে সেই মধ্যরাত। এই পুরো সময়টাতেই বইয়ে-বইয়ে কাটিয়ে দিয়েছেন তিনি। যদিও বিয়ের চার বছরের মাথায় কোলজুড়ে আগমন ঘটে মেয়ে চন্দ্রলেখার। ব্যস, বই আর মেয়ে। মেয়ে আর বই ঘিরেই রাহনূমা সিদ্দিকার জীবন যায়।
স্বামী রেজওয়ানুল হাইওয়ানের ডাকে রাহনূমা সিদ্দিকার বেডরুম ছেড়ে বেরিয়ে আসেন ড্রইংকক্ষে। আড়মোড়া ভাঙা শব্দ গোঙানি দিয়ে বের করেন রাহনূমা—কী হলো, এত রাতে এত জোরে শব্দ করছ কেন? কী হয়েছে?
ঘুম-ঘুমচোখে রাহনূমা সিদ্দিকা স্বামীর চেহারায় ভালো করে তাকাতেও পারেননি। অবশ্য স্বামীর মুখের দিকে কখনোই খুব মনোযোগ দেননি রাহনূমা সিদ্দিকা। মুখের বড় বড় কাটা দাগ দেখে তার সব সময়ই এক ধরনের উচাটন ছিল। এরশাদ সরকারের শুরুটায় রাহনূমার স্বামী জগন্নাথ কলেজের ক্যাডার ছিলেন। কোনো এক রাতে ক্যাম্পাসের প্রতিপক্ষ ছাত্রনেতারা মিলে দাপটশালী রেজওয়ানুল হাইওয়ানের মুখে-গায়ে-পাছায় চাপাতির কোপ দিয়েছিল। তাতে ওই সব স্থানেই কাটা দাগের চিহ্ন ছিল। বিয়ের প্রথম রাতে বাসরঘরেও রাহনূমা স্বামীর গালে চুমু খাননি। এতে অবশ্যই রেজওয়ানুল হাইওয়ানের মনে কোনো ক্ষোভ তৈরি হয়নি। এর অবশ্য কারণ আছে, ব্যবসার সূত্রে তিনি বেশকিছু মেয়ের সন্ধান পেয়েছিলেন বন্ধু-বান্ধবের সূত্রে। ক্লাবে কখনো কখনো ইচ্ছেমতন চাটিয়েছেন রেজওয়ানুল হাইওয়ান। স্ত্রীবহির্ভূত সঙ্গমে তিনি এই চাটাটা বেশ উপভোগ করতেন। এ কারণে স্ত্রী গালে চুমু খেল কি না, এ নিয়ে কোনও খেদ ছিল না এরশাদ আমলের এই ক্যাডারের।
ঘুম ভেঙে-ভেঙে রাহনূমা স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে খানিকটা বিরক্ত কুকুরদৃষ্টিতে বললেন, আরে হলো কী, বলো না কিছু। রেজওয়ানুল হাইওয়ান নিজের আইফোনের স্ক্রিনে চেয়ে স্ত্রীর দিকে তাকান—দেখো!
আইফোনের রঙিন ঝকঝকে স্ক্রিনে তাকিয়ে রাহনূমা সিদ্দিকা চোখে-মুখে বিরক্তি নিয়ে বললেন, এটা তো পুরোনো অভ্যাস তোমার। এতে নতুন কী আর? কাশ্মীর থেকে আনা মখমলের সোফা থেকে উঠে নাইটি সামলে উঠবেন এমন অবস্থাতেই রেজওয়ানুল হাইওয়ান বললেন, এটা তোমার মেয়ের ভিডিও। স্বামীর রুদ্র লজ্জিতভুখা দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে ঘুম-ঘুমভাবে থাকা রাহনূমা মনে-মনে আতঙ্কে পড়েন। ভয়ভয় কণ্ঠে উচ্চারণ করেন—কী বলো, চন্দ্রলেখার ভিডিও কিভাবে ওখানে যাবে? ও তো ঘুমাচ্ছে।’ বিশ্বাস করাতে চাইছেন না রাহনূমা। পুরো ভিডিওতে নিজের একমাত্র কন্যা চন্দ্রলেখার সঙ্গমদৃশ্য দেখে রাহনূমা সিদ্দিকা থমকে যান, তার কানে সশব্দে কাজতে থাকে, আহ, বেবি ওয়াও। ওয়াও। আরও একটু চোষো। প্লিজ।’ ভিডিওর শিৎকারধ্বনি রেজওয়ানুল হাইওয়ানের ড্রইংকক্ষে ছড়িয়ে পড়ে। হাই রেজ্যুলেশনের ক্যামেরায় করা ভিডিওতে একমাত্র মেয়ের হাতের নিচের ছোট-ছোট চুলও চোখে পড়ে মায়ের। পরশু সকালে নিজের হাতেই মেয়ের ‘ওয়াক্সিং’ করাতে চেয়েছেন তিনি। এমনকী মেয়ের যে ব্রা পছন্দ, সেটিও নিজেই গুলশান ২ নম্বরের অভিজাত এক বিপনী থেকে কিনে দিয়েছেন।
মধ্যরাতে স্বামীর চিৎকারের কারণ বুঝতে আর প্রশ্ন করতে হয় না রাহনূমা সিদ্দিকার। হাতের আইফোন সোফার মখমলের ওপর পড়ে থাকে। রেজওয়ানুল হাইওয়ান নিশ্চুপ থেকে সিগারেট ধরান। বুকের ব্যথা বাড়লেও সিগারেটটা ছাড়তে পারেননি তিনি। চন্দ্রলেখার অনুরোধে ধূমপান কমাতে সক্ষম হয়েছেন যদিও। রেজওয়ানুল হাইওয়ানের দুই উরুর ফাঁকে নিতম্বের ব্যথাটা আবার ধরেছে। এই ব্যথা সয়ে চলেছেন গত ৩০ বছর ধরে। আশির দশকের শুরুতে যখন তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের এক খানদানি মাদ্রাসায় পড়তেন, জামাতে মিজানে; ওই বছরেই বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হওয়ার দিবাগত রাতে সহপাঠী শমসের মিজান পাছায় শিশ্ন ঢুকিয়ে দিয়েছিল। কালোমতন টাকিমাছের মতো শিশ্নের আঘাতে ওই সময় থেকেই পাছার পেছন দিকে ব্যথাটা টের পেতেন রেজওয়ান। ওই বছরেই মাদ্রাসার পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে বড় মামার হাত ধরে ঢাকায় শিফট হয়েছিলেন তিনি। বড় হলেও ওই ব্যথাটা বইতে হচ্ছে তাকে। ওই সময়ের পর থেকে রেজওয়ান টাকিমাছের কোনও পদ গ্রহণ করেননি। তার মায়ের হাতে টাকিমাছের ঝাল-ঝাল ভর্তা সুস্বাদু হলেও টাকি মাছ এড়িয়ে যেতে হয়েছে তাকে, বছরের পর বছর ধরে এবং এই ঘটনাটি রেজওয়ানের মুখ থেকে তার দশভাই-বোনের পরিবারের কেউ-ই শোনেনি। এমনকী স্ত্রী রাহনূমা সিদ্দিকাও ২৫ বছরের সংসারে স্বামীর পাছার ব্যথার কারণ জানতে পারেননি, এতকাল বছর-বছর কখনো কখনো ব্যথাটা টের পেলে রেজওয়ানের মুখ কালো হয়ে গেলেও জানাতে চেয়ে ব্যর্থ হয়েছেন।
এই মধ্যরাতে রাহনূমা স্বামীর পাছা ব্যথা হচ্ছে বুঝতে পারলেও তার মনে ও শরীরের ব্যথাটি আরও তীব্র। আরও গভীর। চন্দ্রলেখার সেক্স ভিডিও নিয়ে স্বামীকে বলার মতো কিছু নেই ভেবে নীরবে বেডরুমের দিকে হাঁটেন। রেজওয়ানুল হাইওয়ান নিজের আইফোন হাতে নিয়ে মেয়ের ভিডিও পাওয়া সাইট ক্যানসেল করতে চান, এরই মধ্যে আঙুলের স্পর্শে আরেকটি ভিডিও স্ক্রিনে ভেসে ওঠে। তার গালে লাল টকটকে জিহ্বায় চেটে দিচ্ছে টেলিভিশনের কমদামি নায়িকা মেহেরজান দিলরুবা। রিজওয়ানুল হাইওয়ান সচকিত হয়ে ওঠেন। টের পান তার উরু ভাঁজের ফাঁকে আবার ব্যথাটি সরব হয়েছে।