বেলায়েত হোসেন গালে হাত দিয়ে বসে আছে টুলে। ইউনিফর্মটা পিঠ ও বগলের কাছে খানিকটা ভেজা। দুই ঘণ্টা ধরে লোডশেডিং চলছে। গেটকিপারের রুমে একটা সিলিং ফ্যান আছে বটে কিন্তু জেনারেটরের লাইনে সেটা সংযুক্ত করা নেই। তাই লোডশেডিং হলে ফ্যানটা আর চলে না। স্থির হয়ে ঝুলতে থাকে মাথার ওপরে।
বাড়ির মালিক এ বাড়িতে থাকেন না। তিনি উত্তরায় আলিশান একটা ছত্রিশ শ স্কয়ার ফিটের ফ্লাটে পরিবার নিয়ে থাকেন। পরহেজগার মানুষ। নিয়মিত তাবলিগ-চিল্লায় যান দেশে-বিদেশে। মাঝে মাঝে লোকজন নিয়ে এ বাড়ির পাঁচতলায় বসে ধর্মীয় বিভিন্ন শরিয়ত নিয়ে বয়ান করেন। বেলায়েত সেই সময়ে তাদের আপ্যায়নের জন্য চা-পান-নাস্তার আয়োজনে ব্যস্ত থাকে। মাঝে মাঝে এই বয়ান ও আলোচনায় বিভিন্ন বয়সের নারী ও স্কুল কলেজগামী ছেলেরাও অংশ নেয়।
বেলায়েত হোসেন চা পান সরবরাহের সময় মাঝে মাঝে চেষ্টা করে অতিরিক্ত সময় ধরে পাঁচতলায় অবস্থান করতে। কিন্তু বাড়িওয়ালা কাশেম আলীর কারনে সেটা সম্ভব হয় না।
আগামী মাসে মেয়ের বিয়ে। বিয়ে উপলক্ষে তার সাতদিন ছুটি দরকার। কিন্তু এই বাড়ির গেট থেকে ছাদ পর্যন্ত সব দায়িত্ব তাকেই পালন করতে হয়। এমনকি নিচতলা থেকে চার তলার আটঘর ভাড়াটের ভাড়া তোলা, মালিককে পৌঁছে দেওয়া, ব্যাংক ও অফিসে বিভিন্ন রকমের বিল-কাগজপত্র নিয়ে তাকেই ছোটাছুটি করতে হয়। বাড়িটা প্রথমে চারতলা ছিল। বছর কয়েক আগে পাঁচ তলা তৈরি করে বাড়িওয়ালা তার ব্যক্তিগত প্রয়োজনে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দরকারে ব্যবহার করছেন। পাঁচ তলার ফ্লাটের একটা চাবি বেলায়েতের কাছেই থাকে। কিন্তু মালিকের হুকুম নেই একা একা তালা খুলে ভেতরে যাওয়ার।
চার তলায় একঘর ভাড়াটে এসেছে। যার সঙ্গে কাশেম আলীর খুব ভালো সম্পর্ক বুঝতে পেরেছে বেলায়েত। কারণ অন্য কোনো ভাড়াটের সঙ্গে কোনো আন্তরিক সম্পর্ক নেই কাশেম আলীর কিন্তু এই বাসায় চার তলার ভাড়াটেদের সঙ্গে বাড়িওয়ালার সম্পর্ক বেশ হৃদ্যতার। সময় অসময়ে যাওয়া-আসা খাওয়া-দাওয়াও চলে মাঝে মাঝে।
বেলায়েত এর মেয়ের বিয়ে আর কয়েকদিন পরে। সে বাড়িওয়ালাকে বলে ছুটি নিয়েছে। এই মাসের বেতনের সঙ্গে কিছু টাকা মেয়ের বিয়ের জন্য সাহায্য হিসেবে পেয়ে মনটা তার খুবই খুশি। মেয়ে জামাইয়ের জন্য একটা ঘড়ি কিনে দিয়েছে চার তলার ভাড়াটে যার সঙ্গে বাড়িওয়ালার সম্পর্ক বেশ হৃদ্যতার আছে তিনি। তার বউটা বেশ সুন্দরী তবে পর্দানশীল মহিলা। বেলায়েত তার চোখ ও হাত পায়ের পাতার গড়ন ও রঙের দিকে তাকিয়ে বুঝে নিয়েছে মহিলা বেশ সুন্দরী। কাশেম আলীর ঘনঘন যাতায়াতের কারণ সে মনে মনে অনুমান করে শরীরে বেশ শিহরণ জাগে তার।
সকাল বেলা এ বাড়িতে কাজ করতে আসে সালমা। য়ের রঙ শ্যামলা কিন্তু স্বাস্থ্যবতী মহিলা। তিনটা ফ্লাটে বুয়ার কাজ শেষ করে সালমা দুপুরের দিকে চলে যায় বের হয়ে।মাঝে মাঝে যাওয়ার সময় বেলায়েত এর সঙ্গে ঠাট্টা তামাশা করে।
সিঁড়ি দিয়ে কোমর দুলিয়ে ওঠার সময় সালমার নিতম্বের দুলুনি থেকে চোখ ফেরাতে পারে না বেলায়েত। শরীরের মধ্যে একটা শিরশির ভাব টের পায়। অস্থির লাগে মনের মধ্যে। গ্রামে ফেলে আসা লিকলিকে শুকনা বউয়ের সঙ্গে শেষবারের মতো রাত্রির আহ্লাদে নারী-পুরুষের সঙ্গমের দৃশ্যটা মোচড় দিয়ে ওঠে যেন। ইশ কতকাল যেন মধুর স্বাদ ঠোঁটে লাগেনি শুধু মনের ভেতর একটা উচাটন ভাব। সালমাকে সকাল বেলা সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে দেখতে দেখতেই বেলায়েতের আদিমস্পৃহা জেগে ওঠে শরীরে। অতপর সে গোসলখানায় কিছু অতিরিক্ত সময় ব্যয় করে প্রতিনিয়ত।
গ্রামের রাস্তা দিয়ে একটা ভ্যান পুলিশের পোশাক পরা মানুষ নিয়ে গন্তব্যের দিকে ছুটে চলছে, একটা অপমৃত্যুর লাশ দাফন করতে।
আজ দুপুরবেলায় টুলে বসে ঝিমুচ্ছিল সে। হঠাৎ সালমার চিমটি খেয়ে ধরফর করে জেগে ওঠে বেলায়েত।
-কী গো মিয়া ঘুমাইতাছ ক্যান? রাত্রিরে কেউ আইছিলো নাহি?
-সালমা বেগম ছাড়া আমার জন্যি অন্য কারও কি পরান পুরতে পারে না! আইলে তুমি কাইজ্জা করবানি?
-হ হ বুঝছি বুঝছি নতুন ছেমড়ির দিকে তুমার নজর পড়ছে; শুনছি তারে নাকি চা-বিস্কুট খাওয়াইছো মঙ্গলবার।
-তওবা তওবা অসতাগফেরুল্লা! নবীর কিরা আমি তার দিকে ফিররাও চাইনাই। তুমি তো আমার পরীমনি। আমি তোমার শাকিব খান। আমি হের দিকে চাইমু কেন?
বেলায়েত আসে পাশে তাকিয়ে ভালো করে চারপাশ দেখে নেয়। তারপর ইশারায় সালমাকে সিঁড়ির নিচে অন্ধকার ঘরে ঢুকে দরজাটা লাগিয়ে দেয়।
০২.
বেলায়েত হোসেনের ছুটি দরকার। মঞ্জুরও হয়েছে। পরশু তার মেয়ে হাঁসুলির বিয়ে। সে আগামীকাল সকালে গাবতলী থেকে বাসে রওয়ানা হবে। ব্যাগ গুছিয়ে নিচ্ছে। নিজের দুইটা লুঙ্গি গেঞ্জির সঙ্গে মেয়ের জামাইয়ের জন্য কেনা প্যান্ট শার্ট ও উপহার পাওয়া ঘড়িটা সুন্দর করে ব্যাগের ভেতর রেখে দেয়। আবার ভাঁজ না হয়ে যায়। গোছগাছ শেষ প্রায়। রাতের খাবার ছিল ডাল আর শুটকি মাছের বেগুন আলু চচ্চড়ি।
এ বাড়ির গেট বন্ধ করে রাত এগারোটায় কিন্তু বাড়িওয়ালার হুকুমে গেটের একটা চাবি চারতলার দাড়িওয়ালা ভদ্রলোকের কাছে দিতে হয়েছে। ভদ্রলোকের নাম হামিদ কাওসার। বাড়িওয়ালার সঙ্গে সম্পর্ক খুব ভালো। একমাত্র তার কাছে ভাড়া বিল পরিশোধ করার তাগাদা দেওয়া নিষেধ আছে মালিকের। ভদ্রলোকের সম্পর্কে তাই কখনো কিছু জানার আগ্রহটা মনে মনে দমন করে রেখেছে বেলায়েত।
আগামীকাল সকালে তাড়াতাড়ি উঠতে হবে তার বদলে নতুন একটা ছেলেকে দায়িত্ব পালন করার জন্য চার তলার হামিদ কাওসার একটা ছেলেকে বদলি নিয়োগ দিয়েছে। এখন এ বাড়ির অনেক ব্যাপারে হামিদ কাওসার নাক গলায়। আগে সবকিছু বেলায়েত একাই সামলে নিতো।
মাঝরাতে হঠাৎ পুলিশের গাড়ির শব্দ হুইসেল চেঁচামেচিতে ঘুম ভেঙে যায় বেলায়েতের। কলাপসিবল গেটে জোরে জোরে ধাক্কার শব্দ। বেলায়েতের ঘুম ভেঙে গেলে প্রথমে কিছু বুঝতে পারে না। পরে গেটকিপারের রুম থেকে বের হয়ে বুঝতে পারে পুলিশ পুরো বাড়ি ঘিরে রেখেছে। পুলিশ ছাড়াও পাড়ার রাতজাগা কিছু লোকজন জড়ো হয়েছে। ইতোমধ্যে বাড়ির কলাপসিবল গেট ভেঙে পুলিশ বাহিনী হনহন করে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে গেছে।
কিছু বুঝে ওঠার আগেই কয়েকজন পুলিশ এসে বেলায়েতকে ঘিরে ধরে। হামিদ কাওসার ও কাশেম আলীর সম্পর্কে জানতে চায়। বেলায়েত কিছু বলতে পারে না। সে হামিদ কাওসারকে চেনে না। কোনোদিন তারপর সম্পর্কে জানতে চাওয়া নিষেধ ছিল। পুলিশকে বোঝানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে সে। হামিদ কাওসারকে পুলিশ খুঁজে বের করতে পারেনি। তারা গতরাতে গা ঢাকা দিয়েছে। বেলায়েত সেটা টের পায়নি। সে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়েছিল।
হামিদ কাওসারকে না পেয়ে বেলায়েত ও নতুন দারোয়ান ছেলেটাকে পুলিশ ভ্যানে ওঠায়। চার তলা থেকে নাকি কী সব জিহাদি বইপত্র লিফলেট সিঁড়ি আর বোমা তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়েছে বলে জড়ো হওয়া লোকজন বলাবলি করছিল।
ভোর হয়ে গেছে। সকালে গাবতলী থেকে বাসে রওয়ানা করতে হবে। আগামীকাল বেলায়েতের মেয়ের বিয়ে। বেলায়েত হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। ছেড়ে দেওয়ার জন্য পুলিশের কাছে কাকুতিমিনতি করে। তার মেয়ের বিয়ের কথা জানায়। পুলিশ বেলায়েতকে একটা লাথি মারে। সে কঁকিয়ে ওঠে। পুলিশ একদলা থু থু ফেলে বলে, শুয়োরের বাচ্চার ছুটি চাই। বেলায়েত হাউমাউ করে কেঁদে বলে, ‘স্যার, আমার মেয়ের বিয়ে আমারে ছাইরা দেন, স্যার আমার ছুটি চাই। আমার ছুটি চাই।’
পুলিশের ভ্যান ছুটে চলে বেলায়েত হোসেনসহ। যেতে যেতে ক্লান্ত বেলায়েত তন্দ্রার মধ্যে আধো আধো মেয়ে হাঁসুলির মুখটা দেখে বউয়ের সাজে। বেলায়েত বিড়বিড় করে বলে, ‘মা হাসুঁলি আমাকে ক্ষমা করে দিস।’
একসপ্তাহ পর জেলের মধ্যে বেলায়েত হোসেন একটা চিঠি পায়। তাকে প্যারোলে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। কারণ তাকে একবার গ্রামের বাড়ি যেতে হবে। পুলিশের ভ্যানে করে বেলায়েত গ্রামের বাড়ি আসে। গ্রামের উঁচুনিচু এবড়োখেবড়ো রাস্তায় গাড়ির ঝাঁকুনি খেয়ে সামনের সারিতে বসা পুলিশ বলে, ‘শালীর বেটি, বিয়ে ভেঙেছে বলে একেবারে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করলি তো না, আমাদের এখন যন্ত্রণায় ফেললি। যত্তসব উটকো সেন্টিমেন্ট।’
বেলায়েত হোসেন অনেকক্ষণ পর মুখ খুললো, পুলিশের দিকে হিমশীতল ভাবলেশহীন ক্রুদ্ধ চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, আপনার যন্ত্রণা কষ্ট কি আমার চেয়ে বেশি সাহেব?
ভ্যানের সবাই কথাটা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেছে। বেলায়েত হোসেন বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। বেলায়েত হোসেন দেখতে পায়নি ভ্যানের মধ্যে আরও দুই-একজনের চোখ টলমল করছে। কিন্তু তারা কর্তব্যের খাতিরে চোখের জল ফেলতে পারছে না। চোখের ভেতরেই সে জল আবার শুকিয়ে যাচ্ছে। গ্রামের রাস্তা দিয়ে একটা ভ্যান পুলিশের পোশাক পরা মানুষ নিয়ে গন্তব্যের দিকে ছুটে চলছে, একটা অপমৃত্যুর লাশ দাফন করতে।
আরও পড়ুন: নির্বাচিত নবীনের কবিতা