হাঁপাতে হাঁপাতে লঙ্কেশ্বরের বাড়িতে হাজির হয় গোরাচাঁদের মা সুচাঁদ।
লঙ্কেশ্বর বাড়ি আছ?
কে?
তনয়।
কণ্ঠস্বর শুনে ঘরে অর্গল খুলে বের হয়ে আসে লঙ্কেশ্বর। রাত তখন ৯টা সাড়ে নয়টা। ইলেকট্রিসিটিবিহীন গ্রামে তখন গহীন আঁধার। সেই আঁধারে কামাখ্যা দেবীর মন্দির থেকে ছুটতে ছুটতে এসেছে গোরাচাঁদের মা। গোরাচাঁদ জমিদারকে বলেছিল, ‘দর্শাবতার আজ যে জমিতে ধান হয় একদিন সেই জমি ছিল জঙ্গল। সেই জঙ্গল সাফ করতে গিয়ে আমাদের পূর্ব পুরুষেরা বেঘোরে জেবন দিছে। কেউ মরেছে সাপের কামড়ে, কেউ গেছে বাঘের পেটে। লাশের হদিসটাও পাই নাই। আজ তাদের জেবনের দামে এটুকুই তো জমি হুজুর। খাজনা দিতে গেলে বৌ-বাচ্চা যে বাঁচে না।’ তখনকার মতো কিছুই বলেননি জমিদার। কিন্তু ঠিক সময়মতোই চৈতন্যনগরে হাজির হয়েছিল জমিদারের লেঠের বাহিনী আর সরকারি পুলিশ। গ্রেপ্তার করা হলো গোরাচাঁদ, লঙ্কেশ্বর, সুরেন্দ্রসহ চার জনকে। বছর তিনেকের মাথায় তিনজন ফিরে এলেও ফেরেনি গোরাচাঁদ। তাজও তাই গায়ের কামাখ্যা মন্দিরে হত্যেদিয়ে পরে থাকে গোরাচাঁদের মা। আজ ছুটতে ছুটতে সে এসছে লঙ্কেশ্বরের কাছে।
কী হয়েছে খুড়িমা?
সুচাঁদ বসে পড়ে দাওয়ায়। ধাতস্থ হয়ে বলে—শোন, লঙ্কেশ গায়ে ভারী বেপদ। পালা তুই পালিয়ে যা; লঙ্কেশ্বর সুচাঁদের পাশে মাটিতেই বসে পড়ে। লঙ্কেশ্বরের নিকনিতে, গোত্রে বয়স্কমানুষকে অসম্মান করার রীতি নেই। সবাই জানে গোরাচাঁদকে হারিয়ে সুচাঁদের মস্তিস্ক বিকৃতি ঘটেছে। তাই বলে কেউ তাকে পাগল বলে এড়িয়ে যাবে কিংবা গাল দেবে তেমন সমাজ সুচাঁদের নয়। রংকেশ্বর সুচাঁদের হাতটা ধরে পরম মমতায় বলে—যাব, পালিয়ে যাব। কিন্তু তার আগে বলো দে—কী হয়েছে? সুচাঁদ-লঙ্কেশ্বরের বাথানটায় পাশ দিয়ে গায়ের একমাত্র কামাখ্যা মন্দিরের দিকে তাকায়। একটু দূরে ফাঁকা জায়গায় জমির মধ্যে মন্দির। দেখো দেখো আঙুল তুলে মন্দিরটার দিকে দেখায় সুচাঁদ। লঙ্কেশ্বর তাকায়। মাথানের পাশ দিয়ে আমগাছের ফাঁক দিয়ে সে তাকায় মন্দিরের দিকে। বটগাছের ফাঁক দিয়ে আকাশটা দেখতে পায় সে। চাঁদবিহীন আকাশে অসংখ্য তারার মেলা। তারার আলোয় মন্দির ঘরের বারান্দাটা দেখা যায়। লঙ্কেশ্বর বলে কী খুড়িমা? কিছু দেখতে পাও না?
কই না তো!
একটা সুন্দরী মেয়ে সাদা শাড়িপরা। দেখতে পাও না?
লঙ্কেশ্বর দ্বিগুণ আগ্রহ নিয়ে সুচাঁদের দৃষ্টি বরাবর নিজের দৃষ্টি নিবদ্ধ করার চেষ্টা করে।
পেইলা কিছু দেখতে?
দেখো দেখো ওই সাদা শাড়ি পরা মেয়েটি মন্দির থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। দেখো, দেখো, তার হাতে খালি একখানা বেও।
ঝটপট বেওটা বানার সঙ্গে বেঁধে
ঘরে নিয়ে যথাস্থানে রাখে
লঙ্কেশ্বর হতাশ করে সুচাঁদকে।
সুচাঁদ বলে যাউকগা, কিন্তু তুমি কী কও লঙ্কেশ্বর? আমি কদিন খালি এইটা দেখতেছি।
লঙ্কেশ্বর একটু ভয় পেলো। চিরকালের তন্ত্র-মন্ত্রে বিশ্বাসী মানুষ লঙ্কেশ্বর। বললো—খুড়িমা, মনে হয় কামাখ্যাদেবী সে। সুচাঁদ কপাল কুচকে তাকায়। মাথানেড়ে বলে—দেবী কেন পাথান রেখে শাড়ি পরবে? কিন্তু হাতে যে সে বেও ধরা। বেও তো অন্য কোনো গোত্রের মানুষ ব্যবহার করে না। সুচাঁদ কিছু বুঝে ওঠে না। সে লঙ্কেশকে বলে, বাবা তুমি পালাও। লঙ্কেশ হসে। পালাব, কিন্তু যাবো কই? সে তো জানি না। তারপর বিড় বিড় করতে করতে সুচাঁদ যেমনি এসেছিল, তেমনি চলে যায়। লঙ্কেশ্বর প্রমাদ গোনে। সে টের পায় হাজোদের আর শান্তি ফিরবে না। লঙ্কেশ্বর ভাতঘরে গিয়ে কুমুদের বানাটা তুলে আনে। বানার সঙ্গে বেওটা। হাত তিনেক লম্বা, আড়াই তিন ইঞ্চি চওড়া একমাত্র তীরের ফলার মতো চোখা বেওটা হাতে নিয়ে বারান্দায় আসে। কাঠের তৈরি এই বেওটা কুমুর দাদা বানিয়ে এনেছিল। বেও ছাড়া বানা অচল। প্রত্যেক হাজোর ঘরে মাহলাদের দখলে থাকে বানা আর বেও। বাঁশের তৈরি বানা নিয়ে নির্জন দুপুরে মহিলারা নিজেদের কাপড় নিজেরাই বুনতে বসে যায়। বানা আর বেও-এর থের থের শব্দে চৈতন্য নগরের দুপুর মুখর হয়ে ওঠে। লঙ্কেশ্বর বেওটা হাতে নিয়ে উঠোনে এসে দাঁড়ায়। সোজা তাকায় মন্দিরের দিকে—এবার সত্য একটা কিছু দেখতে পায় সে। চোখ বড় বড় করে তাকায়। সে দেখতে পায় একটা বেও উড়ে গিয়ে মন্দিরের মধ্যে পড়ছে; লঙ্কেশ্বর দ্রুত উঠে আসে দাওয়ায়। ঝটপট বেওটা বানার সঙ্গে বেঁধে ঘরে নিয়ে যথাস্থানে রাখে। কুমু তখন ঘুমে আচ্ছন্ন। লঙ্কেশ্বর তার পাশে গিয়ে শুয়ে পড়ে।
দুই.
সোমেশ্বরীর বুক দিয়ে অনায়াসে যেমন জল বয়ে যায়। তেমনি সময়ও বয়ে যাচ্ছিল। সোমেশ্বরীর তীরে একটা পাথরে পাশে বসেছিল সুচাঁদ। গোরাচাঁদ ফিরলে গ্রামে ঢোকার আগে এখানেই সে আসবে। পাথরটার গায়ে হাত বোলাচ্ছিল সে। হঠাৎ পেছন থেকে লঙ্কেশ্বর ডাকে ‘খুড়ি মা!’ কামাখ্যা মন্দিরে ফেরারি জীবন তার। এখানে কী করো? গোরানাই তো কী! এয় আছি, সুরেন আছে, আমলা আছে।’ শোন—কিছুক্ষণ বিষণ্ন চোখে তাকিয়ে থাকে, তারপর ভিজে ওঠে চোখ। সোমেশ্বরীর পারে ধান কাটা চলছে। সেদিকে তাকায় দুজন। বুদ্ধা বলে—ইসব কী দান ফলনের ক্ষেত আছিল? আছিল না। তোর দাদা আর বাপ জংলা সাফ করতে গিয়ে আর ফেরে নেই। ফেরেনি তোর খুড়াও। তাগোরে কি বাঘে খাই লো, না ভাল্লুকে খাইলো আরজও কেউ জানে না। আইজ সেই জমির ধানময় বুঝে পাও না। সেই জমির মালিক আমলা ভি নাই। লঙ্কেশ্বরে চোয়াল শক্ত হয়। বলে একটা বিহিত তো করতেই হবে খুড়িমা। জান দেব তো ধান দেব না। গোরাচাঁদের বউ বাসন্তী শাশুড়িকে খুঁজতে খুঁজতে সোমেশ্বরীর কাছে আসে। লঙ্কেশ্বরকে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে ওঠে।
—ই দাদা কুথা থ্যাইকা আইলা? ইস্ কুমুদকে কয়েছিলাম মোক্ লগে যাতি। কুমু আলোনা। আর্গন বুনতাছে। ইস্ যদি আসতো, দেখাহই যাতো। লঙ্কেশের তা যে বাসন্তী বুঝতে পেরেছে, ভাবতেই লজ্জায় সিইযে যায় মাটির সাথে, কোনো খবর জানো?
—কোন্ খবর কও দেখি? লঙ্কেশ্বর জানে বাসন্তী কী জানতে চায়, তবু প্রশ্ন করে।
আমরা কী জমি বুঝে পাব?
লঙ্কেশ্বর দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। ধান পালি, জমি পাব। ওয়াদের কাছে যেমন জানের চেয়ে ধানের দাম বেশি, আমলাদেরও তাই।’ লঙ্কেশ্বরের মুখে দুশ্চিন্তার কালো মেঘ। বাসন্তী মুখ ঝামটা দেয়। ই দাদা, আমলা কারও দয়ায় থাকি না। আমলাদের হাতে পাথরেও ধান হয়, জংলায়ও ধান হয়। ’ লঙ্কেশ মাথা ঝাঁকায়।
বাসন্তি বলে, আজ চৈতন-নগরে দুআঁটি হালাধান ঘরে নেয়ার একটা মরদও নাই। দুদিন বাদে চৌতন আর হালা ধান ঘরে উঠবে। এমনদিন এসেছে কোনো দিন, না কেউ দেখেছে?
বাসন্তী কমলা রঙের একটা পাথান পরে এসেছে। চুলগুলো উঁচু করে বাঁধা। অন্য সময় হলে সে খোঁপায় একটা জংলি ফুল দিতো। জবা, নিদেন পক্ষে ধুতুরা। কিন্তু এই সময় এখন নয়। লঙ্কেশ্বর কপালে হাত ছুঁয়ে বলে—সবই কপাল। বুঝলে সবই কপাল। নইলে যখন জমিদার আছিল না, তখন কী এ তল্লাটে মোক্ বাপ দাদারা আছিল না! সোমেশ্বরী যখন সিমসং ছিল তখন এ তল্লাটে কার জমিদারি ছিল? ঘাজংরা কামাখ্যা দেবী ছাড়া কাকে দিত ফসলের ভাগ? মোক্ ঘরের বেড়া হোলি গেছে তো তোয়ারা ঠেকনা দিছো, তোমার ঘরোত্ আগুন লাগছে তো সুরেন্দ্র বালতি লিসে। সুরেন্দ্রর বাপ হাতি খেদায় মরছে গোরচাঁদ লাশ কাঁধে করে আনছে। নিকনির ঝগড়া নিকনিতে মিটাইছি, নয়তো পুষে রাখছি। পুলিশ মামলার নাম লই নাই। শুনিও নাই। কও জেবনে শুনিছ পুলিশ কী? থানা জেল কী?
তীব্র মাথা ঝাঁকে বাসন্তী। এখন কও, ধান কি গোলায় রাখতে পারবানে?
সোমেশ্বরীর দিকে তাকায় লঙ্কেশ্বর। গোরাচাঁদের মা কখন সেখান থেকে উঠে চলে গেছে টের পায়নি লঙ্কেশ্বর ও বাসন্তী। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। সোমেশ্বরীর পাড়ে একটা গরু ডেকে উঠতেই বাসন্তী সেদিকে আগায়। লঙ্কেশ্বর ঘুম আসে না। অতীত ঘেঁটে ঘেঁটে রাত পার হয়। সকালের দিকে চোখটা লেগে এসেছিল। কুমুর ডাকে ধড়মর করে ওঠে। গায়ে আগুন লাগছে,আগুন। পালাও। ঠিক এই সময় সুরেন্দ্র আসে। বলে পালাও-পালাও। নুরুল আমীন মিছা আশ্বাস দিছিল। সরকারের লোকেরা জাগীর পাতায় আগুন দিচ্ছে ওরা পালিয়ে এদিকেই আসছে। লঙ্কেশ কুমুদকে সাবধানে থাকতে বলে বেরিয়ে যায়। চৈতন্য নগরে তখন ধান কাটা প্রায় শেষ। কাচি ধোয়া অনুষ্ঠান শেষ হলেই কুমুরা চৌতন গোলায় তুলবে, হালধান নিয়ে ফিরবে কিষাণ। ঠিক এই সময় চৈনত্য নগরে বিভীষিকা নেমে আসে। গোরাচাঁদের মাকে কোথাও দেখা যায় না। জাগীর পাড়া দখল করে নিয়েছে মোরগ পোষা মানুষেরা। দিস্তামনি, ক্ষিরোদ, দুবরাজ, বীরঙ্গরা পালিয়েছে। পুলিশ আর সরকারের সমর্থকরা ঢুকে পরে চৈতন্যনগরে। বাসন্তী আর্গনটা বুক থেকে টেনে সরিয়ে কোমরে বাঁধে। তেড়ে আসা পাগলা হাতির মতো সে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। চিৎকার করে সবাইকে জড়ো করে। বাসন্তীর চিৎকারে গ্রামবাসী ছুটে আসে বড় রাস্তার ধারে। মেয়েদের হাতে বেও। পুরুষেরা ধরে আছে বর্শা আর চেওয়ার। সময় মতো তারা ঝাঁপিয়ে পড়ে শক্রর ওপর। তীরের মতো উড়ছে বেও। চৈতন্যনগরের আকাশে বিভীষিকা। বেগতিক দেখে পালিয়ে যায় ওরা। দিস্তামনি এসে গোরাচাঁদের ঘরে ঢোকে। ক্ষিরোদ, দুবরাজ বুক চাপড়ে কাঁদছে। বাসন্তী ফনা তোলা সাপের মতো ফোঁস ফোঁস করছে। কুমুদ বলে, শালার পুলিশ, সরকার। আমলার জমিতে ধান হলি তোমার সেই জমি চাই? বদমাসের দল। দিচ্ছি তোমায় জমি!
লঙ্কেশ্বর গোরাচাঁদের উঠোনে বসে পড়ে। কবুতরগুলো বকম বাক শব্দ তুলে উঠোনময় ঘুরে বেড়াচ্ছে। শান্তির পাখির সোহাগী ডাকে পরান কেমন জুড়িয়ে যায়—বলে লঙ্কেশ। ই শান্তি বেশি দিন যাবার লয় দাদা। কবুতরে ডাক লয়, মোরগের কক্করক্কক ডাক শুনে গা তুলবা ভি বিছানা থেকে। সেই দিন আসতাছে। লঙ্কেশ প্রমাদ গোনে। হঠাৎ তার মনে হয়, ক্যাম্পের নির্যাতনের কথা। যে দিন গোরাচাঁদ লঙ্কেশ আর সুরেন্দ্রকে ধরে নিয়ে যাচ্ছিল হাতে শিকল বেঁধে, পুলিশরা বলছিল—‘হাজংরা বড় ভালো হয়। জেলে তারা ভালো ফাইফরমাস খাটে। অতটা অবাধ্য নয় তারা। গোরাচাঁদকেই সবচেয়ে বেশি নির্যাতন করেছিল সেদিন পুলিশ। ডাণ্ডার বাড়ি দিতে দিতে বলছিল—‘ধান দেবানা শালা চুতিয়ার জাত। ধানও হামরা নেবো, বউ বিটিও নেব। তাদের দ্বায়িত্ব নিতে হবে না তোর, দুই চোখ ফেটে জলের ধারা গড়াচ্ছিল গোরার। যেন সোমেশ্বরীর দুই চোখ। ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়ার দিন হঠাৎ বাজার থেকে খাজনা খোরেরা মুরগী কিনলো। পা বাঁধা মুরগী ধরে যখন লঙ্কেশকে বললো বয়ে নিতে, তখন তার অন্তরাত্মা যেন বেরিয়ে যেতে চাইলো। এই পাপ যে করতে পারে না। তার নিকনিতে, তার গোত্রে এ নিষেধ। দুই কদম পিছিয়ে গিয়ে সে দু-হাত নেড়ে অসম্মতি জানালো। ফ্যাকাশে রক্তহীন মুখ। এরপর সৈনিকটি গোরাচাঁদের দিকে এগিয়ে গেল। সাহসী গোরাচাঁদ মুরগীগুলো নিয়ে পায়ের বাঁধন ছেড়ে দিল। মুরগীগুলো উড়ে পালালো। সৈনিকরা এই কাণ্ড দেখে বেদম মেরেছিল, আলাদা জায়গায় রেখেছিল তারা গোরাচাঁদকে। গোরাচাঁদের হয়ে লঙ্কেশ ক্ষমাও চেয়েছিল কিন্তু মন গলেনি তাদের। গলার কথাও নয়। লঙ্কেশ্বর আজকের ঘটনায় উদ্ভ্রান্ত দিশেহারা। কেবল লঙ্কেশ্বর নয়, চৈতন্য নগরের দুবরাজ জানালো সরকার হাজংদের ভিটায় বাঙালি কৃষক ওঠাবে। কথাটা শুনে লঙ্কেশের বউ কুমু ফুসে ওঠে। হাতের বেওটা মাটিতে গেঁথে বলে হামরা কুনো অন্যায় করি নাই। আমলার জমি লি যাবে, আর আমলা ভুখে মরব? হা। কিন্তু রঙ্কেশ আর দুররাজরা চৈতন্য নগরের চৌতনধান জমিতেই পড়ে থাকে, আটি বাঁধা। লঙ্কেশ্বর ফের ফেরারি হয়। এদিকে কুলাউড়া টিলায় নরেন্দ্রদের হাত বোমায় দশজন সিপাই হতাহত হয়। ভবনীপুরে দুই জন ইপিআর মরেছে। ধান কাড়ারী আন্দোলন এখন সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন বলে খেপেছে সরকার। লঙ্কেশরদের উচ্ছেদ করতে ইপিআর, আনসার নেমেছে, নেমেছে সুযোগসন্ধানী লেঠেল বাহিনী, মোরগ পোষার দল।
লঙ্কেশ্বরের জীবনে প্রতি মুহূর্তে মৃত্যু যেন ছায়ার মতো অনুসরণ করছিল। হাজং পাড়ায় শুরু হয় শুরু হয় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। হাজং মরছে, হাজংদের ভিটেবাড়ি, ধানের গোলা জ্বলছে। হাজংদের চোখে শুধু সোমেশ্বরী। হাজং পালাচ্ছে, সোমেশ্বরী পাড় হয়ে পালাচ্ছে। বেগতিক দেখে পার্র্টি আন্দোলন বন্ধ করার সিদ্ধান্ত জানায় লঙ্কেশ্বরকে। লঙ্কেশ্বর আকাশের দিকে তাকিয়ে কামাখ্যা দেবীকে গালি দেয়। বাস্তুরানি সে। দেবীকে খুশি করতে সে প্রতিবছর পৌষ সংক্রান্তিতে জোড়া কবুতর বলি দিতো। না, সেই পুজা তার মন মতো হয় নাই। কোথায় তার অপরাধ জানে না লঙ্কেশ্বর। দেবীর উদ্দেশে সে গালি দেয়। তু কি রাক্ষসী হলি মা! আমলা এখন কী করি, কোয়ানে যাই? কার পালায় পড়লাম রে মা। অংরেজ সরকারের তাও ধর্ম আছিল, উয়াদের যেকোনো ধর্ম নাই।
লঙ্কেশ্বর দাওয়া থেকে নেমে যায়
ধানকাড়ারী উঠে গেছে। তার সঙ্গে উঠে গেছে পাথর আর আর্গন বোনার বানা। সরকার আদেশ জারি করেছে আজকের পরে যাদের ঘরে বেও পাওয়া যাবে, তাদের কমিউনিস্ট বলে চালান করা হবে জেলে। ততদিনে হাজংরা পুলিশ চিনেছে, জেল চিনেছে। ভয়ে মহিলারা বানা সমেত বেও পুড়িয়ে দিয়েছে, কেউ লুকয়ে রেখেছে। কুমু জানতে চাই, ইজা কেমন কথা!
কোনডা?
বেও ঘরে থাকলেই কমুস্ট! আমলা কবে কমুস্ট হলাম? উত্তর দেয় না লঙ্কেশ্বর। কেবল দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। কুমু বলে তাইলে পিন্ধনের পাথানের কী হবে? আমলা পিন্ধুম কী? ভাই তো! ধানের জন্য যুদ্ধ করতে করতে জমি গেলো, পিন্ধনের পাথান গেল। হাজং-এর আর রইলো কী? ঠিক এই সময় কোয়েলী এসে নালিশ করে লঙ্কেশকে মোরগপোষা ছগন আমার গায়ে হাতদিছে। হাজং পাড়ায় মেয়ে মানুষের গায়ে হাত দেওয়ার মানে এতদিনে পরিষ্কার হয়ে গেছে। এই তো দেড়যুগ আগেও তারা জানতো না মেয়ে মানুষের গায়ে হাত দেওয়ার মানে কী। লঙ্কেশ্বর দাওয়া থেকে নেমে যায়। হন হন করে ছগনের বাড়ির দিকে হাটতে থাকে। ছগনের বাপকে পেয়ে যায়, ছড়ার পাশে, বাঁশ বাগানে।
বলে, সাবধান হও ছগনের বাপ! সর্বনাশ হয়ে যাবে। এখনো লঙ্কেশ্বর মরে নাই। তোমার ছাওয়াল সামলাও। সেই হুমকিতে সর্বনাশ ছগন কিংবা ছগনের বাপের হয়নি। পুলিশ এসে ঢুকেছিল লঙ্কেশ্বরের ভাতঘরে। তন্ন তন্ন করে খুঁজেছিল কিন্তু। বার বার গালি দিচ্ছিল লঙ্কেশ্বরকে কমিউনিস্ট বলে। লঙ্কেশ্বর কোনো জবাব দেয়নি। ছগনের মা এসে উপযাজকের মতো পুলিশকে বলে, ‘সাচাই বলছি ভাই, উয়ার ঘরোত বেও আছে। কুমুদ চোখ রাঙিয়ে তাকায় ছগনের মায়ের দিকে। লঙ্কেশ কিংবা কুমুর বুঝতে বাকি নেই, পুলিশকে খবর কে দিয়েছে। কুমু শান্তভাবে জানায়, সে বেও পুড়িয়ে ফেলেছে অনেকদিন আগেই। ক্ষুব্ধ ছগনের মা বলে, পুড়িয়েছে না, ছাই। পোড়ালে পাথান পেন্দে কুথা থেকে? এই যে আমি এত শাড়ি বিকাই, একটাও কি সে কিনেছে, কোনোদিন? বড় কঠিন যুক্তি। পুলিশের মনে ধরে। কুমু একটা নীল রঙের পুরনো পাতান পরে আছে। তন্ন তন্ন করে ভাত ঘর খুঁজছে পুলিশ। কানা বা বেও কোনোটারই হদিস পায় না তারা। দাওয়া থেকে উঠোনে পা রাখতেই ছগনের মা চিৎকার করে ওঠে, হুজুর ওই যে! সে চালার দিকে আঙুল তোলে। পুলিশ এসে টেনে বের করে আধা ভাঙা একটা বেও’র সূচালো অংশ। কুমু আঁৎকে ওঠে। সে ছুটে গিয়ে পুলিশের হাত থেকে কেড়ে নেয় ভাঙা বেওটা। লঙ্কেশ্বর আর কুমুর বিয়ে হয়েছে প্রায় পঁচিশ বছর। কোনো সন্তান হয়নি তাদের। কোনো তন্ত্রমন্ত্রে কাজ হচ্ছিল না। সুঁচাদের নির্দেশে কুমু মাঠের রাখালদের ডেকে আনে বাড়িতে। তাদের বিশ্বাস, রাখালরা যখন নির্জন দুপুরে মাঠে গরু ছেড়ে দিয়ে বাঁশী বাজায় তখন, প্রাণমন উদাস করা বাঁশীর সুরে রসিক কৃষ্ণ গোলক ধামে বসে থাকতে পারেন না। তিনি নেমে আসেন রাখালদের কাছে। তাই নিঃসন্তান দম্পতি রাখাল পূজা করে রাখালদের কাছে বর চায়। কুমুও রাখালদের ধান-দুর্বা ছুঁইয়ে শাখ বাজিয়ে, মিষ্টি মুখ করিয়ে হাত জোড় করে বর চাইলো। কুমুর কাতর মিনতি শুনে রাখালদের নেতা সাণ্ডাল চোখ বন্ধ করে ছুটে গেলো মাঠে। ডান হাতের মুঠোয় লাঠির মতো কিছু একটা নিয়ে সে কুমুর আঁচলে মুখ লুকালো। সবাই যখন বলতে লাগলো দেখি গো, গোপাল, কী এনেছ? তখন আঁচলে মুখ লুকিয়েই ডান হাতের মুঠি খুলে দিলো সে। কুমু দেখলো একটা আধা ভাঙা বেও নিয়ে এসেছে রাখাল। সেই বেও খানা সে সযত্নে, সসম্মানে তুলে রেখেছিল ঘরে চালায়।আজ সেই বেও খানাই খুঁজে পেয়েছে পুলিশ। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। লঙ্কেশ্বর মন্দিরের দিকে তাকায় চোখটা ঝাপসা হয়ে আসে। দেখে অবিকল তার মতো দেখতে একজন ন্যাংটো লোক বেও হাতে হেঁটে যাচ্ছে সোমেশ্বরীর দিকে।