রমজান মাসের মাঝামাঝি। হঠাৎ করে বৃষ্টি শুরু হলো বাইরে। অনিমেষ শুয়েছিল খাটের ওপর। জানালা খোলা। জানালা দিয়ে বাইরে থেকে মৃদু ঠাণ্ডা বাতাস আসছে। অনিমেষের তাতে ভালোই লাগছে। বাতাসে শরীরটা কেমন শীতল হয়ে আসছে।
অনমিষে আজ একটু তাড়াতাড়িই ফিরেছে অফিস থেকে। রমজান মাসে অফিসে তেমন একটা কাজ থাকে না। ইচ্ছে করলেই কিছু সময় আগে বেরোনো যায়।
আজ মতিঝিলে কী একটা কাজ ছিল। সেনাকল্যাণ ভবনে সেই অফিস। বিশ তলায়। প্রায়ই সেখানে যেতে হয় অনিমেষকে। আজও গিয়েছিল। অফিসের কাজে। সেখানে খুব একটা সময় লাগেনি। সেখান থেকে বেরিয়েই সোজা বাসে উঠে বাসায়।
বাড়িতে আসার পথেই দেখেছিল আকাশ খুব কালো হয়ে আসছে। বাড়িতে আসার পর তার বর্ষণ শুরু হলো। রমজান মাসে এগুলো হলো অনাবৃষ্টি। বলা কওয়া নেই, যখন তখন হুট করে নেমে যাবে। বিয়াইন বাড়ির আবদার আর কি!
স্ত্রী আয়ুসী বাসায় নেই। তার আজ মার্কেটে যাওয়ার কথা। গতকাল বউকে ঈদের শপিং করার জন্য টাকা দিয়েছে অনিমেষ। তাই আজকে তাকে আর সারাদিনেও পাওয়া যাবে না। শপিং নিয়েই ব্যস্ত থাকবে কয়েকদিন। কাপড় কেনা হয়ে গেলে কসমেটিকস, সেন্ডেল কিনতেও কয়েকদিন লেগে যায়। এ মার্কেট সে মার্কেট করতে করতে হাঁপিয়ে ওঠে সে।
অনিমেষ আয়ুসীর সাথে কখনো মার্কেটে যায় না। মহিলাদের স্বভাব হলো দোকানে দোকানে ঘোরাঘুরি করা। অনিমেষের সেটা পছন্দ না। তাদের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে পায়ের আর কিছু থাকে না। মহিলারা ক্লান্ত হয় না। কিন্ত অনিমেষ ক্লান্ত হয়ে যায়।
একবার রোজার ঈদে ঘুরেই তার যে শিক্ষা হয়েছে। তারপর কান ধরে বলেছে আমি আর তোমার সঙ্গে নেই বাবা!
আয়ুসী সেদিন হেসে কুটি কুটি হয়েছিল। রাগও হয়েছিল একটু।
মাইনষের জামাইদের দেখি সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বউয়ের পেছনে পেছনে ঘোরে। তুমি একদিন গিয়েই এ অবস্থা! কপাল আমার।
মানুষ ঘুরলে ঘুরুক বাবা! আমার এত অ্যানার্জি নেই। তোমার সঙ্গে থাকলে আমার পাগল হতে সময় লাগেব না। মানুষ এত ঘুরতে পারে? বাবা!
বৃষ্টি থামে না। একটানা বর্ষণ হয়েই চলেছে। জানালা দিয়ে একবার বাইরে তাকায় অনিমেষ। আমপাতার ওপর ঝিরঝির করে পড়ছে বৃষ্টি। অনিমেষ উপুড় হয়ে আরেকটু ভালোভাবে ঘুমানের চেষ্টা করে। বাইরের দরজাটা বেশ করে শব্দ হলো একবার। আচমকা বাতাস এলে এমনটা হয়- অনিমেষ সেটা জানে। তাই সে আর খুব বেশি চমকালো না। বেশ আরাম করেই ঘুমানোর চেষ্টা করল।
সহসা অনিমেষ তার পিঠের ওপর বেশ একটা ওজন অনুভব করল। মনে হচ্ছে কেউ যেন তার পিঠের ওপর চেপে বসেছে। হঠাৎ মনে হলো আয়ুসী বুঝি শপিং করে বাড়ি ফিরেছে। আর ফিরেই তার পিঠের ওপর দুই পা দুই দিকে ছড়িয়ে দিয়ে ধপ করে বসে পড়েছে। কারণ, এই কাজটি আয়ুসী ছাড়া আর কেউ করে না। আয়ুসী এটা প্রায়ই করে। কোনো কোনো সময় মাঝরাতে ঘুম থেকে জেগেও সে অনিমেষের পিঠের ওপর চড়ে বসে থাকে।
কী ব্যাপার, শপিং করা শেষ?
চোখ বন্ধ রেখেই প্রশ্ন করে অনিমেষ।
কোনো উত্তর না পেয়ে আবারও জিজ্ঞেস করে, শপিং শেষ হলো বুঝি?
এবারও নিরুত্তর।
অনিমেষ আর কোনো প্রশ্ন না করে ঘুমানোর চেষ্টা করে। কিন্তু পিঠের ওপর থেকে ভারটা কিছুতেই নামছে না। অনিমেষ এবার একটু ডান দিকে কাত হতেই হাসির রিনরিন আওয়াজ শুনতে পায়।
এ হাসি তো আয়ুসীর নয়। তাহলে? তাহলে কে এলো আমার ঘরে? চোখ খুলতেই দেখে তার শাশুড়ি বিছানার ওপর বসে অষ্টাদশী কুমারীর মতো হাসছে। অনিমেষ চট করে উঠে বসে। তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে থাকে।
অনিমেষ চমকে যায়। মা আপনি?
শাশুড়ি অনিমেষের মুখ চেপে ধরে বলে, চুপ। একদম চুপ। আজ আর আমি তোমার শাশুড়ি নই। এখন আমি তোমার ফ্রেন্ড। বান্ধবীও বলতে পারো।
মা আপনি এসব কী বলছেন? আমি আপনার মেয়ের বর।
চুপ। একদম চুপ। মেয়ের বর হয়েছো তাতে কী হয়েছে? আমার সঙ্গে সম্পর্ক করতে তোমার কী এমন ক্ষতি? মানুষ একসঙ্গে দু’তিন জনের সঙ্গে সম্পর্ক করে না? তাছাড়া আমি তো আর বাইরের কেউ নই। তুমিও বাইরের কেউ নও। তাহলে? আমি কি আমার মেয়ের চেয়ে দেখতে কম সুন্দরী নাকি অ্যাঁ? আমি এখনো আমার মেয়ের থেকে অনেক রূপসী।
আপনি এসব কী বলছেন মা। আপনি আমার মায়ের মতন। আমি আপনার মেয়ের হাজব্যান্ড। আপনার সঙ্গে আমার অন্য কোনো সম্পর্ক মানায় না।
আবার? বলছি না এসব ন্যাকা ন্যাকা কথা আর বলবা না। মেয়ের হাজব্যান্ড হয়েছো তাতে হয়েছে কী? আমার সঙ্গেও তোমার শারীরিক সম্পর্ক চলবে।
অনিমেষ ক্রমাগত ঘামতে থাকে। তার ঘাড় বেয়ে পানি গড়িয়ে নিচে পড়তে থাকে।
মা। আমার শ্বশুর মারা গেছে আজ পাঁচ বছর। এই পাঁচ বছরে আমি একবারও আপনার দিকে বদ নজরে তাকাইনি। মায়ের আসন ছাড়া আপনাকে আমি কোনোদিন অন্য কিছু ভাবিনি। আপনি আমার নিজের মায়ের মতো। আমার মা নেই। আপনাকে আমি আমার নিজের মায়ের চেয়েও বেশি ভালো জানি। আপনি আজ এসব কী বলছেন, আমার মাথায় ধরছে না। আপনার সঙ্গে কোনো অনৈতিক সম্পর্ক করলে আল্লাহ নারাজ হবে মা। আপনার মেয়ে কোনোদিন জানতে পারলে গলায় দড়ি দেবে।
শাশুড়ি রিনা বেগম এবার আরও কাছে এসে অনিমেষের গলা ধরে ঝুঁকে বসে। ব্লাউজের ফাঁক দিয়ে বক্ষ যুগল স্পষ্ট দেখা যায়। শাশুড়ি আজ একটা সবুজ রঙের শাড়ি পরেছে। ঠোটে গাঢ় লাল লিপস্টিক। তাকে ফুরফুরে মেজাজে বেশ রোমান্টিক লাগছে। তাতে অনিমেষের মনের ভেতর অন্য রকম কোনো অনুভূতি হয় না। সে শাশুড়ির মুখের ওপর থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে গলা থেকে শাশুড়ির হাত সরানোর চেষ্টা করে। ইতস্তত করে বলে, কেউ আসবে মা।
রিনা বেগম ধরা গলায় বলে, আসুক। দেখুক, একজন মানুষ আরেকজন মানুষকে কিভাবে অ্যাভয়েড করছে। একজন মানুষের চাওয়ার কাছে আরেকজন মানুষের চাওয়ার কোনো মূল্যই নেই।
ছিঃ মা। আমার প্রচণ্ড রকম ভয় হচ্ছে। আমি মরে গেলেও এসব পারব না। আমাদের একটা সমাজ আছে। সমাজে কতগুলো মানুষ আছে। মানুষের কতগুলো চোখ আছে। সমাজের মানুষ এগুলো কিছুতেই মেনে নেবে না। সমাজে এগুলো কিছুতেই মানায় না।
তুমি আমাকে সমাজের দোহাই দিচ্ছো। এই, আমার দেহের কাছে কি সমাজ বড়? আমার দেহের শান্তির চেয়ে কি সমাজের শান্তি বড়? আমার জৈবিক ক্ষুধার কাছে কি তোমার সততা বড়? আমি তো ইচ্ছে করলে বাইরে গিয়েও এসব করতে পারতাম। তখন তো তোমাদেরই মান সন্মান যেত। মানুষ বলত, তোর শাশুড়ি খারাপ। তোর বউ না জানি আরও কত খারাপ। কি বলত না? কি করতি তখন? গলায় ফাঁসি দিতি? নাকি এলাকা ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যেতি?
মা, প্লিজ। প্লিজ মা। আপনি আমাকে এসব অনৈতিক কাজে জড়াবেন না। মায়ের সঙ্গে জেনা করা হারাম। আমি আপনাকে আমার মায়ের মতোই দেখি। আমি জানি, আপনি এখনো আপনার মেয়ের চেয়ে অনেক সুন্দর, ফর্সা, বহুগুণে গুণান্বিত। আপনার ফিগার এখনো আঠারো বছরের তরুণীর মতো। কিন্তু আমি আমার বিবেকের কাছে তো হেরে যাব। মানুষ জানলে কী বলবে?
মানুষ? কোন মানুষ? এ দেশে কি মানুষ আছে রে? প্রতিদিন দেয়ালের আড়ালে কত অঘটন ঘটছে, সেগুলোর খবর রাখে কে? কোত্থেকে মানুষ জানবে? এখানে তো তুমি আর আমি। বাড়িতে আর কেউ নেই। বরং আমার সঙ্গে কিছু না হলেই মানুষ জানবে যে, তুমি আমার সঙ্গে এই কাজটি করতে চেয়েছ, আর আমি তোমাকে বারণ করেছি বিধায় তুমি আমার এই অবস্থা করেছ। আয়ুসী বাড়ি ফিরে দেখে যদি তুমি ওর মায়ের সঙ্গে অনৈতিক কাজ করতে চেয়েছ, তখন? তখন তুমি কোথায় যাবা বাছা? মানুষ তো তখন তোমাকে আমার বাড়ি থেকে কুকুরের মতো ধুরধুর করে তাড়িয়ে দেবে। তখন কোথায় থাকবে তোমার মানসন্মান? কোথায় থাকবে তোমার বিবেক? আমার মেয়েও যখন তোমাকে তালাক দিয়ে দেবে, তখন? তখন কী করবে তুমি?
অনিমেষ ভেবে পায় না কী করবে। যে শাশুড়িকে এতদিন তিনি মায়ের মতো জেনে এসেছে, আজ সেই মা-ই তার সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে বাধ্য করছে, ভয়-ভীতি দেখাচ্ছে, এখন কী করবে সে?
অনিমেষ মাথা নিচু করে চুপ করে বসে থাকে।এই মুহূর্তে তার যদি মৃত্যু হতো তাহলে সে বেঁচে যেত। অথবা আয়ুসী যদি এসে পড়ত, তাহলে শাশুড়ি নিশ্চই তাকে ছেড়ে দিত। কিন্তু আয়ুসীও আসছে না।
শাশুড়ি একটা ঝাঁকুনি দিয়ে অনিমেষের কোলের ওপর বসে পড়ে। বুকটা বুকের সঙ্গে মিশিয়ে দেয়। কান্না জড়ানো কণ্ঠে বলে, কী হলো? তুমি কিছু বলছ না যে? আমার মতো বুকে সাহস বাড়াও। আমার শরীরে আজ আগুন বইছে। এ আগুন না নেভানো পর্যন্ত আমি তোমাকে ছাড়ছি না অনিমেষ। তোমাকে আজ আমার সঙ্গে…।
আপনি আমাকে মাফ করবেন মা। আমি আমার চরিত্রের মধ্যে কোনো কলঙ্কের দাগ ফেলতে চাই না। আপনি আমাকে মাফ করেন। আমাকে মাফ করেন।
একজন রমণী একজন রমনের জন্য জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে যাবে আর তুমি ভাবছ তোমার চরিত্রের কথা! আরে, বললাম তো, এই মুহূর্তে যদি আমি চিৎকার করে উঠি তাহলে কে বাঁচাবে তোমায় শুনি?
তখন কোথায় থাকবে তোমার চরিত্র আর তোমার ইজ্জত আর তোমার কলঙ্ক?
এখনো সময় আছে, একবার ভেবে দেখো। আমি আর স্থির থাকতে পারছি না অনিমেষ। তুমি আমাকে গ্রহণ করো। তুমি আমাকে গ্রহণ করো। আজ কতটা বছর আমি এই শরীরের জ্বালা একা একা বহন করছি। আজ আমি আর পারছি না। আমি আজ কিছুতেই পারছি না। আমি তোমাকে অনুমতি দিচ্ছি। এতে তোমার কোনো পাপ হবে না। একজন মানুষের চরম মুহূর্তে তুমি তাকে তার নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে দিয়েছ। নিশ্চই তুমি তার ক্ষতি করোনি। তোমার তাতে পাপ হবে না। তুমি তুমি…
বাইরে তখনো ঝুম বৃষ্টি। আজ আর বৃষ্টি কমার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। অনিমেষ কিছু না বলে একদৃষ্টিতে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। সে কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না। আত্মহত্যা করার মতো সুযোগ থাকলে এতক্ষণে সে এটি করে ফেলত। জীবনে কখনো এমনটি ভাবেনি। এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে এটাও কখনো ভাবেনি। আজ এটা সে কী শুনল। কী দেখল। একটা শরীরের জন্য মানুষ এত নীচে নামতে পারে? তাহলে কি মানুষের জৈবিক ক্ষুধার কাছে মানুষের বিবেক বোধ পরাজিত? নাকি এটাই পৃথিবীর নিয়ম? অনিমেষের মাথার ভেতর এ রকম আরও হাজারো প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে থাকে কিন্তু কে দেবে এসব প্রশ্নের উত্তর।
সহসা কলিংবেল বেজে ওঠে। অনিমেষ যেন দেহে প্রাণ ফিরে পায়। নিজের অজান্তেই বলে ওঠে- আল্লাহ তাহলে আমার কথা শুনতে পেয়েছেন।
রিনা বেগম অনিমেষের কোনো উত্তর না পেয়ে দুইগালে কষে দুইটা চড় মেরে বলে, কাপুরুষ কোথাকার!
তারপর নিজেই হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে দরোজা খুলতে চলে যায়।
দরোজা খুলেই দেখে আয়ুসী কাকভেজা হয়ে এসেছে। তার হাতে দুনিয়ার সব শপিংয়ের প্যাকেট আর প্যাকেট।
মেয়ের হাত থেকে প্যাকেটগুলো নিতে নিতে আয়ুসীকে বলে, চল, ছাদে যাবি? অনেকদিন ভিজি না, আজ ইচ্ছেমত ভিজব।
আজ যে তাকে ভিজতেই হবে। না ভিজলে এ শরীরের আগুন নেভাবে কে?
মন্তব্য