বৃষ্টি নামবে। ঈষৎ শিশির-ছোঁয়া বসন্ত রাত্রে দক্ষিণ থেকে বইবে যে হাওয়া, তাতে থাকবে সমুদ্রের আর্দ্রতা, ফাটল-ধরা শুকনো মাঠ আর পাতাঝরা গাছের শাখায় শিহরণ জাগিয়ে দিয়ে সেই অতি-দূরে পাহাড়ের চূড়ায় ঘনীভূত হবে, এরপর গর্জনে বজ্রে বিদ্যুতে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে সারাটা আসমান, মঙ্গলসুধার মতো অজস্রধারায় নামবে বৃষ্টি। গাছের শুকিয়ে যাওয়া ডালপালাগুলো কচি পাতায় ভরে উঠবে, সারা খামার ছেয়ে যাবে সবুজে সবুজে। দুপুরের রোদে পাটক্ষেতের চারা বাছতে গিয়ে শরীর থেকে হয়তো দরদর করে ঘাম ঝরবে, কিন্তু তাতে আসবে না এতটুকু ক্লান্তি। কেননা নতুন ফসলের খোয়াব প্লাবনের মতো মিশে থাকবে রক্তের বিন্দুতে।
কিন্তু সে বছর এসব কিছুই হলো না। ফাল্গুন চলে গেল, উত্তরদিকটা কিঞ্চিৎ কালোও হলো না; চৈত্র শেষ হতে চলল, আকাশে দু-একদিন গুরু গুরু আওয়াজ হলো, গুমোট হয়ে রইল সারাটা প্রকৃতি; কিন্তু এর বেশি কিছু নয়।
এরপর এলো বৈশাখ। আর এখনো সূর্য আগুনের ফুলকি উড়িয়ে তীব্র তেজে জ্বলতেই লাগল, মাটির বুক চিরে মাথা উঁচিয়ে-ওঠা পাটের চারাগুলি আস্তে আস্তে কুঁকড়ে গেল। ওপরে খাঁ-খাঁ শূন্য, নিচে আদিগন্ত মুক্ত সুদূর, তারও নিচে বাঘবন্দি নকশার মতো জমিগুলি রোদে-পোড়া, বিবর্ণ। দুপুরবেলা ক্ষেতের আলের ওপর গিয়ে দাঁড়ালে কলজেটা সহসা ছ্যাঁৎ করে ওঠে, ঝলসানো তামাটে জিহ্বা বার করে সারা মাঠটা ডাইনির মতো হাঁ করে আছে। জ্বলন্ত ক্ষুধা নিয়ে সে নিজের বুকের শিশুশস্যকে গ্রাস করেছে, আগামী বছর যে গজব নেমে আসবে তাতে সন্দেহ নেই।
কিন্তু কেন? এর পিছনে নিশ্চয় কোনো গুরুতর কারণ আছে। সেদিন জুম্মা নামাজের পর আলোচনা উঠল। মিম্বরের কাছে দাঁড়িয়ে মৌলানা মহীউদ্দিন বলতে লাগলেন, ‘বেরাদরানে-ইসলাম! আমি অধম বান্দা, আপনাদের খেদমতে কী বয়ান করব, আপনারা সব বিষয়েই ওয়াকিফহাল। কিতাবে আছে, খোদার গজব নামে তখনি, যখন দুনিয়া গুনাগারিতে ভরে যায়। আমরা এখন কী দেখছি? না, ছেলে বাপের কথা শোনে না, জেনানা বেপর্দা, চুরি-ডাকাতি বদমায়েশিতে দুনিয়া পূর্ণ হয়েছে। এদিকে নামাজ নেই, রোজা নেই, হজ-জাকাত নেই। আজ চলুন, আমরা তাঁর দরবারে জার-জার হয়ে কাঁদি, মাঠে গিয়ে সবাই হাত তুলে মোনাজাত করি, তিনি রাহমানুর রহিম, ইচ্ছা করলে একটু দয়া করতেও পারেন।’
মৌলানা সাহেবের কণ্ঠস্বরে গুরুগম্ভীর ধ্বনিতরঙ্গে পাকা মসজিদের ভিতরটা গমগম করতে লাগল। মুসল্লিদের মধ্যে থেকে উঠে দাঁড়ালেন হাজি কলিমুল্লাহ। থুতনিতে একগুচ্ছ সাদা দাড়ি, মাথায় কিস্তি টুপি, নামাজ পড়তে পড়তে কপালের মাঝখানটায় দাগ পড়েছে। তিনি প্রথমে গলা খাঁকরানি দিলেন, পরে আবেগকল্পিত গলায় বলতে লাগলেন, ‘মৌলানা সায়েব যা বললেন তা অবশ্যই আমরা পালন করব। কিন্তু এইসঙ্গে একটা কথা সক্কলের মনে রাখতে হবে, কুকর্মের বিচার চাই। এই অনাবৃষ্টি কেন হলো, আপনারা ভেবেছেন কি? খোলাখুলি বলতে গেলে, নিশ্চয় কোনো মেয়ে অবৈধভাবে গর্ভবতী হয়েছে, তৌবা, আস্তাক ফেরোল্লা। এই অঞ্চলে, আশেপাশের কোনো গ্রামে অথবা আমাদের গ্রামেও হতে পারে। এদের তালাশ করে বার করতেই হবে, নইলে এই আজাবের হাত থেকে ছাড়া পাওয়া যাবে না। এরে দুররা মেরে ঠাণ্ডা করতে হবে।’
ডান হাতের আঙুলগুলো দাড়িতে একবার চালিয়ে গরমে কাঁপতে কাঁপতে বসে পড়লেন হাজি কলিমুল্লাহ, তাঁর মগজের কোষে কোষে সত্যিকারের অপরাধীকে খুঁজে পাওয়ার ভাবনা।
দুপুরের ঝাঁ ঝাঁ রোদ্দুরে ফুটবল খেলার ময়দানে যেদিন ‘মেঘের নামাজ’ হওয়ার কথা, তার এক দিন আগেই অসুখে পড়লেন সুফি মৌলানা মহীউদ্দিন।
জামাতে ইমামতি করার জন্য হাজি সাহেবকে গাঁয়ের তরফ থেকে অনুরোধ করা হলো। প্রথমে বিনয় করলেও, সকলের খেদমতে পরে রাজি হলেন।
সেদিন নামাজ শেষ হওয়ার পর পশ্চিম থেকে পূর্বদিকে মুখ করে দাঁড়ালেন হাজি কলিমুল্লাহ, বহু দূর চাউনি বুলিয়ে দেখলেন, দুনিয়াটা এখনো জিন্দেগির অযোগ্য হয়ে ওঠেনি, এখনো ডাক দিলে আলেমুল গায়েবের দরবারে হাজিরা দিতে হাজার লোককে পাওয়া যায়। তিনি চেয়ে রইলেন, আর দেখলেন অগুনতি টুপির শোভা, হোক না সেগুলি তেল-চিটচিটে অথবা ছেঁড়াখোঁড়া। খোলা প্রান্তরে গালভাঙা তামাটে মানুষগুলি বসে আছে অসহায়ের মতো, সবারই মনে একটুখানি রহমের প্রার্থনা। হাজি কলিমুল্লাহ দুহাত তুলে দরাজ গলায় উচ্চারণ করতে লাগলেন: ‘ইয়া আল্লাহ, ইয়া বারে খোদা, তুই চোখ তুলে চা, একটু দয়া কর তোর বান্দাদের। তুই আসমান-জমিন, চান-সুরুজের মালিক, তোর অঙ্গুলি হেলনে সাগর দোলে, হাওয়া ছুটে চলে, নহর বয়, তোর একটুখানি ইচ্ছায় এই দুনিয়া ফুলে-ফসলে ভরে উঠতে পারে। মেঘ দে, পানি দে, ছায়া দে, শান্তি দে তুই!’
‘আল্লাহুম্মা আমিন! আল্লাহুম্মা আমিন!’ সারা জামাতজোড়া একই কাতর আওয়াজ। হাজি কলিমুল্লাহর সাদা দাড়ি চোখের পানিতে ভিজে গেল। কেঁদে জার-জার হয়ে তিনি দোয়া খতম করলেন, ‘সোবহানাকা রাবি্বকা রাবি্বল ইজ্জাতে আম্মাইয়াসসেফুন, আসসালামু আলাল মুরসালিনা, আলহামদু লিল্লাহে রাবি্বল আলামিন!’
একইভাবে এক দিন, দুই দিন, তিন দিন ময়দানে গিয়ে জামাতে শামিল হলো ছেলে-বুড়ো-জোয়ানেরা। তাদের এক চোখ আকাশের দিকে, আরেক চোখ ফসল কুঁকড়ে যাওয়া খামারের দিকে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা, এক মায়ের এক পুত্রের গায়ে চুনকালি মাখিয়ে, তার মাথার কুলোয় কোলাব্যাঙ আর বিষকাঁটালির গাছ রেখে রাতের পর রাত মেঘ-খেলা খেলল, নদীর ধারে শিন্নি রেঁধে কলাপাতায় ফকির-ফকরাকে খাওয়াল। তাদের ঘাড়ে ব্যথা হয়ে গেল ওপরের দিকে চেয়ে থাকতে; কিন্তু সেই রোদ-চুয়ানো কাকচক্ষু নীল একখণ্ড মেঘের আভাসও দেখা গেল না।
মাগরিবের নামাজের পর পাটিতে বসে তসবিহ জপতে জপতে এসব কথাই ভাবছিলেন হাজি কলিমুল্লাহ। তাঁর চোখের পুতুলিতে অবসাদের ছায়া। গভীর ভাবনার কারণ আছে বৈকি! সুতোর চোরাকারবার থেকে যে কয়েক হাজার টাকা পেয়েছিলেন, তার অর্ধেক দিয়ে গুদাম কিনেছেন মেঘনার বন্দরে, বাকি অর্ধেক দিয়ে কিনেছেন দুন দেড়েক জমি। নিজে পাট কিনে মজুদ করতে না পারলে গুদাম কেনার ফায়দা নেই। মাসিক দেড় শ টাকা ভাড়ায় আর কী হয়! অথচ এ বছর গুদামটাকে নিজে ব্যবহার করতে পারবেন বলে মনে হচ্ছে না। এদিকে সবগুলো জমি নিজে চাষ করেছেন। এখানটায়ই হয়েছে চরম বোকামি। যদি পত্তনি দিতেন, তাহলে হাজার দেড়েক টাকা নগদ পাওয়া যেত, কিন্তু মুনি-মজুর ও জমির তদারক করতে জান বেরিয়ে যাচ্ছে। বীজ বোনা থেকে এক নিড়ি পর্যন্ত পয়সাকড়ি কম খরচ হয়নি, ভবিষ্যতে আরো হবে, অথচ এদিকে আকাশের যা হাল, তাতে ফসল পাওয়ার বিশেষ আশা নেই।
সুতোর কারবার ছেড়ে দিয়েও ভালো কাজ করেননি। গত বছর হাওয়াগাড়িতে চড়ে গিয়ে হজ করে এসেছেন; ভেবেছিলেন, অতঃপর সংসারের ঝামেলাতে নিজেকে এতটা জড়াবেন না, গুদামটা ছেলেদের হাতে ছেড়ে দিয়ে নিজে জমিজমা নিয়েই থাকবেন। কিন্তু টাকার অভাবে সব ভেস্তে গেল। আসলে ব্যবসা ব্যবসাই, এতে সৎ-অসৎ-এর প্রশ্ন নেই, নিয়ত ভালো থাকলে দান-খয়রাত করলেই হলো।
জানালার বাইরে আমের বোলের তীব্র গন্ধ ভেসে আসছিল, বাঁশঝাড়ে শালিকের কিচিরমিচির অনেকটা মন্দীভূত। তসবিহর গুটিগুলি চঞ্চল হয়ে ঘুরছে হাজি কলিমুল্লাহর আঙুলে আঙুলে, এই সঙ্গে তাঁর মনটা ক্রমেই আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে।
জৈগুন ঘরে বাতি দিতে এসে যেন চমকে উঠল। বলল, ‘মিয়াসাব এখানে? মসজিদে যাননি?’
‘না, শরীরটা খুব ভালো নয়।’ হাজি সাহেব ওর মুখের দিকে চেয়ে বললেন, ‘তা ছাড়া তোর গিন্নিমা বোধ হয় একখুনি এসে পড়বেন।’
দিন-পনেরো হলো নতুন গিন্নি বাপের বাড়ি গিয়েছিল নাইওর করতে, আজকে তার আনবার তারিখ। হাজি নিজে যেতে পারেননি, প্রথম তরফের তৃতীয় ছেলে খালেদকে পাঠিয়েছিলেন সকালবেলায়। আসলে বৌকে বাপের বাড়িতে বেশিদিন থাকতে দিতে তিনি সব সময়ই নারাজ। প্রথম স্ত্রীকে দশ দিন থাকতে দিয়েছিলেন, তাও একেবারে নতুন অবস্থায়। দ্বিতীয় স্ত্রীর বেলায় দিনের সংখ্যা আরো কিছুটা বেড়েছিল। তবে এখন পড়তি বয়েস, সব ব্যাপারে কড়াকড়ি চলে না। দুবছর আগে দ্বিতীয় স্ত্রী মারা যাওয়ার পর সংসার থেকে তাঁর মন একেবারে উঠেই গিয়েছিল। কিন্তু খোদার কুদরত, কার সাধ্য তার কিনারা করে? তিনি কপালে যা লিখে রেখেছেন, তা একদিন ফলবেই। গতবার যখন হজে গিয়েছিলেন, তার মাসখানেক আগে সবাই ধরে বসল, এমন সোনার সংসার, একজন গৃহিণী না থাকলে কোনো কিছুই ঠিক থাকবে না।
কিন্তু পাত্রী? বয়েস ষাট পুরো হতে চলল, এখন হাতে ধরে কে নিজের মেয়ে দিতে যাবে?
‘হাসালেন হাজি সাহেব, হাসালেন। আপনার কি না পাত্রীর অভাব?’ মজু প্রধান দাড়িতে হাত বুলিয়ে কন যে বিয়ে করবেন, আমি পাত্রী ঠিক করে দিচ্ছি। তাও যেমন-তেমন নয়, এমন কন্যা দেব, চোখে পলক পড়বে না।’
হাজি কলিমুল্লাহর চোখের তারা দুটো খুশিতে চকচক করে উঠল। একটা অজানা অনুভূতিতে তাঁর হৃৎপিণ্ডটা ধুক ধুক করছিল; কিন্তু বাইরে আগাগোড়া ম্লান হয়েই রইলেন, আগেকার সহধর্মিণীদের স্মৃতি এত শিগগির ভুলে যাওয়া উচিত নয়। তিনি একটা ঢোক গিলে বললেন, ‘দেখুন, তিনকাল গিয়ে এককাল পড়েছি, এখন আমোদ-আহ্লাদ করার সময় নয়। ঘরের তদারক আমার ফাইফরমাশটা করতে পারলেই হলো।’
‘তা তো বুঝলাম।’ মজু প্রধান যুক্তি দেখালেন, ‘ভাঙা নাওয়েও কাজ চলে, আবার নতুন নাওয়েও চলে; কিন্তু কোনটা আমরা চাই? কোনটা দিয়ে গাঙ পাড়ি দিতে সুখ?’
এর পর সাতকানি জমি সাফকাওলা করে দিয়ে যে পাত্রী ঠিক হয়েছিল, সে মজু প্রধানেরই মেয়ে-ঘরের নাতনি। বয়স একুশ-বাইশ বছর হবে। এ দেশের মেয়েরা কুড়িতেই বুড়ি হয়, সে হিসেবে হাজি সাহেবের সঙ্গে সম্বন্ধটা মোটেই বেমানান হয়নি।
রান্নাঘরের হাঁড়ি-পাতিল গুছিয়ে জৈগুন এলো। অর্থপূর্ণ গাম্ভীর্যের সঙ্গে একটা পিঁড়ি টেনে নিয়ে বসল। হাজি সাহেবের ওজিফা তখনো শেষ হয়নি। মুখের বিড়বিড় খানিকক্ষণের জন্য থামিয়ে তিনি জিগগেস করলেন, ‘কিরে, কিছু খবর আছে?’
জৈগুন বলল, ‘আছে।’
‘কী শুনি!’ তসবিহর মালায় আঙুল থেমে গেল হাজি কলিমুল্লাহর, তিনি উৎসুক দৃষ্টিতে চাইলেন। কাজকর্মের ফাঁকে ফাঁকে গোপন খবর সংগ্রহের জন্য তিনি জৈগুনকে নিযুক্ত করেছিলেন, আর সে জন্যই এই আগ্রহ।
‘আমি আজ গিয়েছিলাম বাতাসীর কাছে। গিয়ে দেখি, সে তার খাশিটার জন্য আমপাতা পাড়ছে। আমাকে দেখেই সে নানান কথা বলতে লাগল, কিন্তু আমি চেয়ে রইলাম ওর শরিলের দিকে।’ দরজায় একবার চেয়ে নিয়ে জৈগুন বলল, ‘ওর তলপেটটা বেশ ফোলা মনে হলো।’
হাজি চিন্তিতভাবে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ওর জামাই না কবে মারা গেছে?’
‘তা সাত-আট মাস তো হবেই!’ জৈগুন হিসাব করে বলল, ‘কিন্তু ওর পেট মনে হলো চার-পাঁচ মাসের।’
‘তাই নাকি? তাহলে তো বেশ অনেক দিনের ফাঁক।’ হাজি কলিমুল্লাহ যেন সত্যদর্শন করেছেন, তাঁর চোখে আশার আলো ফুটে উঠল। নিচুগলায় জিগগেস করলেন, ‘আচ্ছা, বাতাসীর ঘরে যে লোকটা থাকে, তাকে দেখলি?’
‘হ্যাঁ, দেখলাম। অসুখ এখনো সারেনি, তবে আগের চেয়ে একটু ভালো। আমি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে দেখি, সে ঘরের ভিতরে বিছানায় শুয়ে আছে।’
‘তা হোক, তা হোক।’ হাজি অসহিষ্ণুর মতো বললেন, ‘শুয়ে থাকলে কী হবে? শুয়ে থাকলে কি আর এসব কাজ করা যায় না? নিশ্চয় যায়। তুই কী বলিস?’
‘হ্যাঁ, আপনি ঠিকই কইছেন। তা ছাড়া বাতাসীর চলাফেরা আমার ভালো মনে হয় না। রজবালি বেঁচে থাকতেই এর সম্বন্ধে কত লোক কত কথা বলেছে। নামাপাড়ার ছমু যে ওর দরজা খুলেছিল, তা কি কেউ শোনেনি? রজবালি টের পেয়েছিল বলেই না দোষটা ছমুর ঘাড়ে গিয়ে পড়ল। না-হলে মেয়েমানুষের চোখঠারানি ছাড়া কি অমন কাজ কেউ করতে সাহস পায়?’
‘যদি এই ঠিক হয়, তাহলে তো আর কোনো কথাই নাই। আমার বিশ্বাস, বাতাসীই এ কাম করেছে—না হলে বৃষ্টি হবে না কেন?’ হাজি আবার তসবিহ জপতে লাগলেন, খানিকক্ষণ চুপ থাকার পর বললেন, ‘তবু রাখ্, আমি নিজে একটু পরখ করে নিই, এর পর একটা কিছু করা যাবে।’
জৈগুন চলে গেলে আবার গভীর চিন্তামগ্ন হলেন হাজি কলিমুল্লাহ। তাঁর কপালের বলিরেখা আরো কুঁচকে গেল। তসবিহর গুটিতে ঘন ঘন আঙুল চলতে লাগল। বাতাসী, বাতাসী, বাতাসী। বাতাসী ছাড়া এ কাজ আর কারো নয়। অল্প বয়েসে স্বামী মারা যাওয়ার এই দোষ! কেননা, স্বামীসঙ্গ একবার যে পেয়েছে, সে সেই স্বাদ কি সহজে ভুলতে পারে? এ হচ্ছে আফিমের মতো, ভাত ছাড়া যায়, তবু ছাড়া যায় না এর নেশা। তা ছাড়া ওর পুরো জোয়ানী। যেমন তেমন দু-একজন পুরুষ ওর কাছে কিছু নয়, এক চোখের বাঁকা চাউনিতেই কাৎ করে ফেলতে পারবে। অথচ কথা বলার কী কায়দা। মামাতো ভাই, দিনমজুরি করত, কালাজ্বরের কবলে পড়ে বিপদ হয়েছে, কেউ নেই, না দেখলে চলে না। এসব কথা দিয়ে আর চিঁড়ে ভিজবে না। আসলে লোকটাকে এনেছে এক বিছানায় রাত কাটাবার বুঝতে বাকি নেই।
কিন্তু এর শাস্তি হবে কী? কিতাবের হুকুম মানলে, গলা-ইস্তক মাটিতে পুঁতে এর মাথায় পাথর মারতে হবে, যতক্ষণ না প্রাণটা বেরিয়ে যায়। কিন্তু এ যুগে তা কি সম্ভব? থানা আর পুলিশ রয়েছে যে। তাহলে উপায়? জুতো মারা? একঘরে করে রাখা? গ্রাম থেকে বের করে দেওয়া?
হাজি কলিমুল্লাহ যখন এসব ভাবনায় তন্ময় ছিলেন, তখন খালেদ তার নতুন মাকে নিয়ে মরা-গাঙের পানির কাছে এসে দাঁড়িয়েছে।
পূর্ণিমা-চাঁদ দেখা দিয়েছিল বাড়ি থেকে রওনা দেয়ার অনেক আগেই, এইবার তো বাঁশঝাড়ের মাথা ছাড়িয়ে উঠে ঝলমল করছে। চারদিক নিঝঝুম, গাছপালায় বাতাসের নড়াচড়ার গরজ নেই।
মরা-গাঙে এখন হাঁটু পানি। দুই পাশে কাদা ঠেলে ডাঙার সঙ্গে যে সরুপথটার মিল হয়েছে তার পরিষ্কার বালুর ওপর দিয়ে ঝিলঝিল করে কেটে চলেছে ফোয়ারার স্রোত। পানির ভেতর থেকে গজিয়ে ওঠা বোরো ক্ষেতগুলিতে কচি ধান-পাতার জড়াজড়ি।
নিচু হয়ে জুতোজোড়াটা ডান হাত দিয়ে খুলে ফেলল জোহরা। তার কাঁধে ছোট ছেলেটা। আর অসুবিধা হচ্ছে দেখে পেছন থেকে খালেদ পাশে এসে বলল, ‘সাজুকে আমার কাছে দিন।’
ওরা দুজনে প্রায় সমবয়সী। প্রথম প্রথম ‘আপনি’ বলতে লজ্জা করত খালেদের, কিন্তু এখন আর সে ভাবটা নেই।
জোছনায় আলোকিত বড় ছেলের মুখের দিকে চাইল জোহরা, টানা ভুরুর নিচে ওর সুন্দর চোখ দুটো আরো সুন্দর মনে হলো তার, একটা অব্যক্ত অনুভূতির ছলছলানিতে বনের অন্ধকারে শিহরিত নদীর মতো দুলে উঠল বুকের ভিতরটা। আচ্ছন্ন স্বরে জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার কষ্ট হবে না তো?’
খালেদ হাসল! বলল, ‘না, এ আবার কষ্ট কী?’
সাজুকে পাঁচ বছরের রেখে ওর আম্মা এন্তেকাল করেছেন দুবছর আগে, আদর-যত্ন না-পাওয়ায় ওকে কান্নারোগে ধরেছিল। কিন্তু বর্তমানে তা নেই। নতুন মাকে তার এমনি ভালো লেগেছে যে সে এক মুহূর্তের জন্যও তার কাছছাড়া হয় না। জোহরা যখন নাইওর করতে যায়, তখন ও তার কোলে উঠে চলে গিয়েছিল।
অন্য কাঁধের ওপর থেকে অঘোরে ঘুমিয়ে থাকা ছোটভাইটিকে নিজের কাঁধে নিতে গিয়ে খালেদের মনে হলো, কপোতের বুকের মতো উষ্ণ, প্রবালের মতো কোমল কিসের মধ্যে যেন তার বাঁ হাতের আঙুলগুলি ক্ষণিকের জন্য হঠাৎ হাওয়ায় চাঁপার কলির মতো কাঁপুনি খেয়ে গেল। নিমেষে তার সমস্ত শরীরটা শিরশির করে উঠল ভরামেঘে বিদ্যুৎ সঞ্চারের মতো। পলকের জন্য তার চোখে পড়ল, সহসা কেমন রাঙা হয়ে উঠল মেয়েটির মুখ, তার সারা চেহারায় রক্তের প্রবাহ বহ্নির মতো ছড়িয়ে গেল। খালেদ আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না; আরেক জন্মের কোনো নিবিড় স্মৃতি অস্পষ্ট মনে পড়ার মতো কী এক অজানা বেদনায় মুখ ফিরিয়ে নিয়ে ঝিরঝিরে পানির ওপর দিয়ে সুমুখে হাঁটতে লাগল।
কিন্তু জোহরা দাঁড়িয়েই রইল। কাপড়টা ঠিক করে নিয়ে চাঁদের দিকে মুখ উঁচিয়ে চাইল একবার, আবার চাইল সামনে চলমান মূর্তিটার দিকে। এর পর সে চঞ্চল হয়ে উঠল। সেই রুপালি বালুর ওপরে ফোয়ারার স্রোতে বয়ে চলা রাস্তাটায় ত্রস্ত হরিণীর মতো পা ফেলে হাঁটুপানির কাছে গিয়ে আবার দাঁড়িয়ে পড়ল। দুই পায়ের ফাঁক দিয়ে পিছন থেকে শাড়িটা কুচকে এনে ডান হাতে হাঁটুর কাছে ধরা, জোছনা-উছল কালো পানির দিকে মুখ নিচু করে জোহরা দেখল, তার মূর্তিটা ভেঙে ভেঙে যাচ্ছে, এই সঙ্গে ছোট ছোট ঢেউয়ে ভেঙে যাচ্ছে চাঁদের চেহারাটাও। হঠাৎ মুখ তুলে সে ডাকল, ‘খালেদ!’
‘কী!’—কিছুদূর থেকে খালেদ সাড়া দিল।
‘আমাকে ফেলেই চলে যাচ্ছ।’—স্বপ্নের স্বরে যেন জোহরা বলল, ‘আমি চলতে পারছি না। দ্যাখো, দ্যাখো! পানিটা কী সুন্দর!’
খালেদ ফিরে এল। বলল, ‘আপনার কী হয়েছে বলুন তো, চলুন তাড়াতাড়ি। অনেক রাত হয়ে যাচ্ছে।’
‘ও তাই তো। অনেক রাত হয়ে যাচ্ছে!’ পানি ঠেলে কিছু দূর এগিয়ে আবার থমকে দাঁড়াল জোহরা। ঝিলিমিলি ঢেউয়ের দিকে চেয়ে বলল, ‘দেখছ, কী সুন্দর পানি! এমন পানিতে মরতেও সুখ।’
কোনো জবাব দিল না খালেদ, মুখ নিচু করে চুপচাপ এগোতে লাগল।
ওপারে কোথায় একটা পাখি ডেকে যাচ্ছে—‘বৌ কথা কও।’
নদী পেরিয়ে এসে চপচপ পানি থেকে পা দুটো ঝাড়া দিয়ে নতুন জুতোজোড়াটা পরার সময় জোহরার মনে হলো তার বুকের ভিতরে কিছু নেই, বিবাগী হাওয়ার মতো কিসের এক রিক্ত হাহাকার গুমরে গুমরে মরছে। নিজের কথা ভাবতেই সে আঁতকে উঠল, তার শরীরটা ঝিম ধরে অবশ হয়ে এলো।
খালেদ আস্তে আস্তে হাঁটছিল। পেছন থেকে সে একটা কাতর-স্বর শুনতে পেল—‘একটু দাঁড়াও!’
‘আবার কী হলো আপনার!’
‘কী জানি কিছু বুঝতে পারছি না! আমার চোখ দিয়ে এমন পানি পড়ছে কেন?’ জোহরা ব্যাকুলভাবে এগিয়ে গিয়ে খালেদের চোখের সামনে নিজের চোখজোড়া বিস্ফারিত করে দাঁড়াল, চাঁদের আলোয় দেখা গেল, তার টলটলে দুটো চোখ দিয়ে মুক্তোর মতো অশ্রুবিন্দু গড়িয়ে পড়ছে।
খালেদ আবার উচ্চারণ করল, ‘কী হলো আপনার?’
‘তুমি কিচ্ছু জানো না, কিচ্ছু বোঝো না!’ কাপড়ের খুঁট দিয়ে চোখ দুটো মুছে জোহরা অপ্রকৃতিস্থের মতো বলল, ‘সাজুকে দাও আমার কাছে। চলো শিগগির। লোকজন নেই, আমার বড্ড ভয় করছে।’
ওরা যখন মুখোমুখি হয়েছিল, তার কিছু আগে থেকে কিঞ্চিৎ হাওয়া বইতে শুরু করেছিল, আর যখন চুপচাপ চলতে শুরু করল, তখন একখণ্ড ঈষৎ কালো মেঘ দক্ষিণ থেকে ধীরে ধীরে ভেসে আসতে লাগল। খড়ম পায়ে উঠোনে পায়চারী করছিলেন হাজি কলিমুল্লাহ, আকাশের দিকে চেয়ে তিনি চমকে উঠলেন। তাহলে তাঁর আন্দাজই ঠিক?
‘জৈগুন! ও জৈগুন!’ তিনি থমকে দাঁড়িয়ে বলতে লাগলেন, ‘দেখে যা, আমরা যা ভাবছি তাই ঠিক। আসমানে সাজ দেখা দিয়েছে।’
জৈগুন চৌকাঠের কাছে এসে মুখ বাড়িয়ে বলল, ‘তবু তো আপনি বলছেন, আরো পরখ করতে। আমার মনে কোনো সুবা-সন্দে নেই। বাতাসী যা ছিনাল।’
আকাশে চলমান মেঘটার দিকে চেয়ে আবার পায়চারী করতে লাগলেন হাজি কলিমুল্লাহ, এর বিচারটা কী হবে তিনি তার কিনারা করতে পারছেন না।
আধঘণ্টা পরে জোহরা যখন এলো, শুয়ে শুয়ে তার সঙ্গে আলাপ করতেও বারবার তাল কেটে যেতে লাগল, অনেক রাত পর্যন্ত চোখে ঘুম এলো না!
মনস্থির করে পরদিন সকালে তিনি গিয়ে উঠলেন বাতাসীর বাড়িতে, পুবপাড়ার আমবাগানের ওধারে। বাঁশের চালার নিচটায় পাকালের ধারে বসে ও খুদের জাউ রাঁধছিল, হাজি সাহেবের সাড়া পেয়ে একটা চৌকি হাতে উঠানে এল। এমন গণ্যমান্য লোক, সাতজন্মে একবার এসেছেন ওর এখানে, কী দিয়ে মেহমানদারি করবে, সে ঠাহর করতে পারল না।
মাথায় কাপড় টেনে ও কী বলছিল সেদিকে হাজির মোটেই নজর ছিল না, তিনি গোপনে আড়চোখে হরিদ্রাভ লাবণ্য-স্নিগ্ধ ওর দেহটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিলেন।
এদিকে বাড়ির নাশতা-পর্বের তদারক শেষ হওয়ার পর জোহরা গুম হয়ে বসেছিল তার শোবার ঘরে চৌকির কিনারায়।
বিয়ে হওয়ার পর থেকে কিসের যেন এক আশ্চর্য মায়ায় বিনা কাজের সময়টুকু সে এখানটায় বসেই কাটিয়ে দেয়। এ কিসের জাদু? কিসের মন্ত্রণা? জোহরা তা বুঝতে পারে না। বাড়ির চেহারা বোধ হয় অনেকদিন থেকেই অদলবদল হয়েছে, কিন্তু এ কামরাটায় কোনো পরিবর্তন নেই, দিনে দিনে নতুন জিনিস যোগ হয়েছে মাত্র। আগেকার গিন্নিদের হাতের ছাপ অনেক কিছুতেই এখনও টাটকা হয়েই আছে, অন্ধকারে বসে থাকলে তাদের ঠোঁটের ফিসফিস আলাপও যেন সে শুনতে পায়। তখুনি ওর মনে হয়, এ ঘরে ঢোকবার কোনো অধিকার তার নেই, এখানকার সব দখল করে সে ডাকাতের কাজ করল।
কিন্তু আমার কী দোষ? আমি তো রাজি হতে চাইনি! নানা বলল, বোন কাঁদিসনে, দু-একটা বছর সবুর কর, বুড়োটা মরল বলে। তখন বেশ জোয়ান দেখে একটা বর জুটিয়ে দেব। এখন সম্পত্তিটা হাত করে নে।’
জোহরা আপন মনে আওড়াল, ‘ছাই সম্পত্তি!’
দগদগে ঘার ওপর দিয়ে গরম বাতাস বইতে থাকলে যেমন করে জ্বলে, ওর বুকের ভিতরটা তেমনি করে জ্বলতে লাগল। দম যেন ক্রমেই বন্ধ হয়ে আসছে। একসময় সে প্রায় চেঁচিয়ে উঠল। ওর চোখের দুটো তারায় জ্বলজ্বল করতে লাগল একটা দুর্বিনীত বন্যতা!
মগজটা গিজগিজ করছিল, এলোচুলে ঝাঁকড়া মাথাটা একবার ঝাড়া দিয়ে জোহরা বাইরে চলে এলো। চোখ তুলে চাইতেই ওর দৃষ্টি পড়ল কুয়োর ধারে মেহেদি গাছটার দিকে, ভিজে মাটির রসে তাতে ঘন হয়ে কচিপাতা দেখা দিয়েছে।
কদিন সংকল্প করেও সে মেহেদি গাছটা কাটতে পারেনি। কিন্তু আজকে ডান হাতটা শিরশির করতে লাগল। ত্রস্ত পায়ে সে চলে গেল রান্নাঘরের ভেতরে। সেখান থেকে ধারালো বঁটিটা এনে একেক কোপে একেকটি ডাল কেটে ফেলতে লাগল।
‘আহা হা, করে কী গিন্নি মা’—জৈগুন দৌড়ে এলো। বলল, ‘গাছটা অনেক দিনের, মানুষের কত কাজে লাগে। কর্তা শুনলে ভীষণ রাগ করবেন।’
‘তুই এখান থেকে যা তো। কে রাগ করবেন না করবেন, তোর চাইতে আমি ভালো বুঝি। আমার ইচ্ছা হয়েছে, আমি কাটবই।’
‘আমি কাম করে খাই, আমার কী? আপনার ভালোর জন্যই বলছিলাম।’
‘আশ্চর্য!’ জোহরা মুখ তুলে চাইল। বলল, ‘আমার ভালো-মন্দের চিন্তা তোকে করতে হবে? দুনিয়াতে আর লোক নেই।’
কর্তার প্রিয় গিনিকে আর ঘাঁটাতে সাহস করল না জৈগুন, মুখ কালো করে সে নিজের কাজে চলে গেল।
কেমন করে দুপুর হলো, কেমন করে এলো বিকেল, আর কেমন করেই বা রাত্রি এসে পৃথিবীর মুখ ঢেকে দিলো, জোহরা কিছুই বলতে পারবে না। তার হৃদয়ের একটা অংশ কে যেন ঝকঝকে ধারালো ছুরি দিয়ে কেটে নিয়ে গেছে, প্রতিদিনের উচ্ছ্বল ঢেউ সেখানে লাগে না, সেখানে তুষের আগুনের মতো শুধু একটি জ্বালা।
এশার নামাজের পর বিছানায় শুয়ে হাজি কলিমুল্লাহ বললেন, ‘যা ভেবেছিলাম, বাতাসীই কুকাম করেছে।’
‘কেমন করে জানলেন?’—জোহরা শুধাল।
‘এসব জানতে কি আর খুব বুদ্ধি লাগে? তারে ঠিকমতো ঘা দিলাম, আর তা বেজে উঠল। ব্যস্ আর ভাবনা নেই। বিচারটা করতে পারলে বৃষ্টি হবেই। হাজি একটুখানি নীরব থেকে বললেন, ‘আগামী শুক্রবার রাত বারোটার পর বিচার বসাব। দেখা যাক কী হয়।’
জোহরা চুপচাপ শুয়ে বাইরের দিকে কান পেতে রইল। আমের বোলের গন্ধ এমন মাতাল কেন? রাত কেন এমন কালো, অন্ধকার? সূর্য যদি আর না উঠত, তাহলেই ছিল ভালো, সবার চোখের আড়ালে চিরদিনের জন্য সে হারিয়ে যেত, যেখানে কেউ নেই, কেউ থাকবে না।
কপালে কোমল হাতের ছোঁয়া পেয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই নাক ডাকতে শুরু করলেন হাজি কলিমুল্লাহ। ওই শব্দটুকু বাদ দিলে, জোহরার মনে হলো, তার পাশে শুয়ে আছে একটা মৃতলোক, বুক থেকে পা পর্যন্ত সাদা কাপড়ে ঢাকা। সে লোমশ হাতটা ছাড়িয়ে কিছুক্ষণ চুপ হয়ে রইল। এরপর আস্তে আস্তে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াল। অতি সন্তর্পণে দরজার খিলটা খুলে উঠানের একপাশে আমগাছতলায় এলো।
‘সারা দিন কোথায় ছিলে তুমি?’ খালেদ চুপি চুপি বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই সাঁ করে তার সামনে গেল জোহরা, চাপা-গলায় বলল, ‘না খেয়ে থাকতে খুব ভালো লাগে, না?’
কথা বলার চেষ্টাও না করে খালেদ থ হয়ে রইল। হঠাৎ ডান হাতটা তুলে ওর গালে একটা চড় মেরে ক্ষিপ্তের মতো জোহরা বলল, ‘আমি আর এত কষ্ট সইত পারব না। বাড়ি থেকে চলে যাও, চলে যাও তুমি!’
কাপড় দিয়ে মুখটা ঢেকে ও প্রায় দৌড়ে উঠে গেল বারান্দায়, ঘরের ভেতরে গিয়ে খিল এঁটে দিল।
খালেদ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদতে লাগল। তার দুই চোখ থেকে ঝরঝর করে পানি পড়ছে, কণ্ঠরোধ হয়ে আসছে। ভোরবেলায় অন্যেরা ঘুম থেকে ওঠার আগেই সে বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিল, নদীর ধারে ধারে জমির আলের ওপর দিয়ে মিছিমিছি সে হেঁটে বেড়াল, এরপর চলে গেল বন্দরে, তার বড় দুই ভাই যেখানে কজ করেন, সেই গদিতে; কিন্তু কোথাও মন টিকল না। শেষ পর্যন্ত কি যেন এক অজানা আকর্ষণে বাড়ির দিকে রওনা হয়েছিল।
শুক্রবার রাত বারোটা বেজে গেলে একে একে সবাই গিয়ে হাজির হলো মৌলানা মহীউদ্দিনের বৈঠকখানায়। এর আগেই কানাঘুষার মারফতে ব্যাপারটা সারা গ্রামে জানাজানি হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সবার তো আর বিচারের ক্ষমতা নেই। আজকের মজলিশ শুধু গ্রামের আলেমমণ্ডলী ও মাতব্বরদের নিয়ে। দরজা-জানালা বন্ধ করার পর আসামিদের মাঝখানটায় বসিয়ে তাঁরা আলোচনা শুরু করলেন।
তিন দিন তিন রাত্রি হাদিস-কিতাব ঘেঁটে একটা ফতোয়া তৈরি করেছিলেন হাজি কলিমুল্লাহ। মৌলানার অনুমতি নিয়ে তিনি তা পড়ে শোনালেন।
বাতাসী অনেক আগে থেকেই বিনিয়ে বিনিয়ে গুনগুন করছিল, এবার ডুকরে কেঁদে উঠল। বিলাপ করে বলতে লাগল, ‘ও মা গো, এ-ও আমার কপালে ছিল গো! আঁতুড়ঘরে কেন মুখে নুন দিয়ে মেরে ফেললে না গো!’
‘এই বেটি কান্না থামা!’ হাজি ধমক দিয়ে উঠলেন। বললেন,—‘সে সময় বুঝি খুব ফুর্তি লেগেছিল?’
মৌলানা মহীউদ্দিনকে বেশ চিন্তিত মনে হলো। তাঁর সৌম্য মুখমণ্ডলে বেদনাতুর গাম্ভীর্যের কান্তি। ধীরে ধীরে মুখ তুলে শান্ত গলায় তিনি জিজ্ঞেস করলেন,—‘কি গো, তোমার কিছু কওয়ার আছে?’
‘কী কইব বাবা, আপনারা তো গরিবের কথা বিশ্বাস করেন না। আমরা তো মানুষ নই, কুকুর-বেড়াল! আমাদের আবার ইজ্জত কী! বাতাসী চোখ-মুখে বলল,—‘না হলে এমন বদনাম আপনারা আমার ওপর ফেলতে পারতেন!’
‘কিন্তু এসব কথা তো আর আসমান থেকে পড়ে না!’ হাজি কলিমুল্লাহ বললেন,—‘অন্য কারো নামে তো ওঠেনি?’
‘সে আমার কপালের দোষ। না হলে, ও বেঁচে থাকতেই আমি কতবার বমি করেছি, প্রতিরোজ পোড়ামাটি আর তেঁতুল না খেয়ে থাকতে পারিনি—এসব জিনিস কারো চোখে পড়ত না!’
একটা ময়লা কাঁথা গায়ে জড়িয়ে বসে বসে কোঁকাচ্ছিল বাতাসীর মামাতো ভাই রহিমদ্দি। তাকে সওয়াল করলে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল শুধু।
বিচারের আলোচনা যখন এগিয়ে চলছিল, তখন দক্ষিণ দিক থেকে পালে পালে কালো মেঘ এসে সমস্ত আকাশ ছেয়ে ফেলেছিল। চাঁদ বারেবারে আড়ালে পড়ছে, গাছপালা ও খামারে-নদীতে আলোছায়ায় লুকোচুরি।
একসময় বাতাস বন্ধ হয়ে গেল, অনেকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইল সারাটা প্রকৃতি! ঘরবাড়ি কাঁপিয়ে কাঁপিয়ে মাঝে মাঝে গুরু গুরু আওয়াজ উঠল, সঙ্গে সঙ্গে চমকালো বিদ্যুৎ। ঘরের ভেতর সবাই ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠল।
ঠিক এমনি সময় হাজি সাহেবের বাড়িটার পিছনটায় আমগাছের নিচে দাঁড়িয়ে ছিল একটি মানুষের ছায়ামূর্তি। পা টিপে টিপে খোলা জানালার কাছে এসে অনেকক্ষণ সন্ধানী দৃষ্টিতে চেয়ে রইল, ঘরের ভেতরে আলো নেই; নাম-না-জানা অরণ্যের ভেতর কোনো প্রেতপুরীর মতো সমস্ত বাড়িটা রুদ্ধ-নিশ্বাসে ঝিম ধরে আছে।
জানালা থেকে সরে এসে মূর্তিটা ভিটির ধার ঘেঁষে চলতে শুরু করল, রান্নাঘরের পাশ দিয়ে ঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। একেকবার বিজলি চমকায় আর সে যেন শিউরে ওঠে গভীর আতঙ্কে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই বাতাস বইতে শুরু করল, মেঘে মেঘে সংঘাতে, গর্জনে চারদিক তোলপাড় হতে লাগল। দরজাটা হয়তো ভেজানো ছিল, আচমকা দমকা হাওয়ায় তা সশব্দে খুলে গেল। মানুষটা ত্রস্তপদে এসে উঠল বারান্দায়। এদিক-ওদিক খানিক চেয়ে একসময় মরিয়া হয়েই যেন ঘরে ঢুকে পড়ল। ওপরে-নিচে কেবল শব্দ, শব্দ আর শব্দ। জোর বাতাসের তোড়ে একেকবার মোচড় খেয়ে ওঠে করগেটের চালগুলি, কাঠের বেড়ায় অবিরত ধুপধাপ আওয়াজ।
খাটের কাছে এসে ইতস্তত করতে লাগল মানুষটা, কী করবে যেন ঠিক করে উঠতে পারছে না। শরীরে রোমগুলি কাঁটা দিয়ে উঠছে, ঢিবঢিব করছে হৃৎপিণ্ড, চিনচিন করে মস্তিষ্কে রক্ত উঠে চোখ দুটো ঝাপসা করে দিচ্ছে। তার ভাবনা, কোথায় এলো সে? এ কি জন্ম, না মৃত্যু? এ কি সব হারানোর হাহাকার, না মিলনের উন্মত্ত রংরাগ? কান পেতে সে যেন শুনল, চুরির রিনিঝিনি, একটি গভীর শান্ত নিশ্বাস, কাপড়ের মৃদু খসখস। ঘ্রাণ আসছে, এ কি আমের বোলের, না চুলের গন্ধ? না, না, এখানে নয়। এ তো সে চায় না, চাইতে পারে না।
এক পা-দু পা করে সে পিছিয়ে যাচ্ছিল, এমন সময় অনুভব করল, একটা সুপুষ্ট নম্র মসৃণ হাত অন্ধকার থেকে উঠে এসে গানের কলির মতো পরম আশ্বাসে তার হাতকে আকর্ষণ করল।
তখন সমস্ত আকাশে মেঘেদের হুড়োহুড়ি লুটোপুটি লেগে গেছে, মন্দ্র-গর্জনে একেকবার কেঁপে কেঁপে উঠছে সারা পৃথিবী। একটানা ঝড়ের তীব্র বেগে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে গাছপালা, মত্ত হয়ে কে যেন লেগেছে লুণ্ঠনের উচ্ছৃঙ্খল তৎপরতায়। স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল মন্থন করে যেন এক মহাপ্রলয়ের উচ্ছ্বসিত শব্দের ভয়ঙ্কর-সুন্দর রাগিণী।
এভাবে কতক্ষণ ঝড় চলল হয়তো কেউ বলতে পারবে না। বাতাস যখন কমতে লাগল, তখন অযুত মুক্তাবিন্দুর মতো নামল বৃষ্টি।
ধারালো হাওয়ার সঙ্গে প্রথম যখন বৃষ্টি নামল, তখন তাতে রইল শুধু নবজাতকের বিক্ষোভ, ঘরবাড়ির ওপর দিয়ে শুধু ঝরঝর ঝাপটা দিয়ে গেল। কিন্তু বেশিক্ষণ এ রইল না। ধ্রুপদ সঙ্গীতের বিলম্বিত লয়ের মতো বাতাস যতই কমতে লাগল, বর্ষণে ততই এল নিবিড়তা। এরপর শুধু ঝমঝম শব্দ।
এভাবে কতক্ষণ কেটে গেল জানা নেই। একসময় খোলা দরজা পার হওয়ার পর উঠোনে নেমে বৃষ্টির মধ্য দিয়েই টলতে টলতে উত্তর-ভিটির ঘরের ভেতর অদৃশ্য হয়ে গেল মানুষটা। তার পেছনে পেছনে এসে জোহরা এলোমেলো কাপড়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইল। তার শরীর ভিজে যেতে লাগল বৃষ্টির ছাটে।
খানিকক্ষণ পরে একটা ছাতা মাথায় ঘাড় নিচু করে ধুঁকতে ধুঁকতে বাড়িতে ঢুকলেন হাজি কলিমুল্লাহ। হঠাৎ তাঁকে দেখতে পেয়ে জোহরা বলে উঠল,—‘অত দেরি যে! আর ইদিকে আমার বড্ড ডর লাগছে।’
‘কী আর করি বলো, আপদ চুকিয়ে এলাম!’ ছাতাটা বেড়ায় ঠেস দিয়ে রেখে হাজি বললেন,—‘সে একটা পাঁড়-হারামজাদী, শেষ পর্যন্ত কিছুতেই দোষ স্বীকার করল না। কিন্তু বাতাসীর মতো মেয়েলোকের ফাই-ফুই বুঝি আমি ধরতে পারি না? দুটোকে দিলাম পঞ্চাশ জুতো করে, তার ওপর কালকে গাঁ ছেড়ে চলে যাবে। দেখলে আল্লাহর রহমত? সঙ্গে সঙ্গে বিষ্টি নামল!’
‘হ্যাঁ, তাই তো, বড় তাজ্জব ব্যাপার!’ কথাটা শেষ করে ঝমঝম বৃষ্টির মধ্যে বারান্দা থেকে উঠোনে নেমে গেল জোহরা, তার অঙ্গভঙ্গি রহস্যময়।
হাজি হৈ হৈ করে উঠলেন, বললেন,—‘আরে, আরে করছ কী? তুমি পাগল হলে নাকি? এত রাত্রে ভিজছ, সর্দি করবে যে।’
‘না, সর্দি আমার কোনোকালেই করে না।’ জোহরা বারান্দার কাছে এলো। চোখের ওপর থেকে একরাশ চুল ডান হাতে সরিয়ে ফোটা-ফুলের মতো উজ্জ্বল মুখটা তুলে মধুর হাসি-ওপচানো ঠোঁটে বলল—‘আপনি জানেন না? বছরের পয়লা বিষ্টি, ভিজলে খুব ভালো। এতে যে ফসল ফলবে।’
মন্তব্য