আষাঢ়ের প্রথম রাতের বৃষ্টি দিয়ে তার বিষের বড়ি খাওয়ার হাউস উঠেছে। মাঝরাত। চোখে ঘুম নেই। টেবিলের ওপর পানির গ্লাস আর একশো একটি বিষের বড়ি। কিন্তু বৃষ্টির খবর নেই। এই খায়েশ না মিটিয়ে তার মরার ইচ্ছে করছে না। এগুলোকে বিষের বড়ি না বলে ঘুমের বড়ি বললেই ঠিক হবে। মেয়েটি প্রতিদিন কিনেছে দুটা করে তার প্রেমিক ছেলেটি আরেকটা মেয়েকে বিয়ে করার পর থেকে। আর একটা বড়ি সে কিনেছিল প্রেমিকটির বিয়ের আগেই। বৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করতে করতে মেয়েটি তার বদলে ফেলা নম্বর থেকে বিয়ে করা প্রেমিককে ফোন দেয়। ছেলেটি তখন কি করছিলো তা মেয়েটির জানার কথা না। ছেলেটি তখন প্রিপারেশন নিচ্ছিল। এমনকালে ফোনটা বাজে।
মেয়ে: হারামজাদা বিয়ে যদি না করবি তবে কামড়েছিলি কেন?
ছেলেটি প্রথমে ভ্যাবাচেকা খায় তারপর বলে, কে আপনাকে কামড়েছে? কী যা তা বলছেন!
ছেলেটির বউ যে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে পারফিউম মেখে বিছানায় যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল, সে এবার তার স্বামীর দিকে কটমট করে তাকায়।
তখন আষাঢ়ের প্রথম বৃষ্টি নামে।
২.
আষাঢ়ের প্রথম বৃষ্টি তখনো ভালোভাবে জমেনি। মেয়েটি কাচের গ্লাস হাতে ছাদে পা ফেলে। দুয়েক ফোঁটা হয়তবা গ্লাসে পড়ে। বিজলি আলো ফেললে মেয়েটার থমথমে মুখে মউতের নেশা ভর করে। আর তখন বৃষ্টি উদার হয়। হয়তবা বৃষ্টি চেয়েছে মেয়েটির থমথমে চেহারা থেকে মৃত্যুচ্ছায়া ভাসিয়ে দিতে। কিন্তু নিয়তি অন্যভাবে লেখা। মেয়েটি গ্লাসভরা জল নিয়ে ঘরে ফেরে। গ্লাসটা টেবিলে রেখে একটা একটা করে বিষের বড়ি গ্লাসে ফেলে। বড়ি থেকে ওঠা বুদ্বুদে সে স্মৃতিকাতর হয়। আর তখনই মোবাইলটা বেজে ওঠে।
৩.
মোবাইল বাজতে বাজতে একসময় আপনাআপনি থেমে যায়। ভরাগ্লাসে একশো একটা বড়ি গলে যায়। তখন মেয়েটি বড়িগলা জলের গ্লাসটায় চুমুক দেওয়া শুরু করে। হাল্কা একচুমুক দেওয়ার পর তার মনে হয় একচুমুকে নিজেকে না মেরে তিলে তিলে মারি। কিংবা সে মৃত্যুটা উপভোগ করার কথা ভাবে। মৃত্যু উপভোগ করবে, এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরপরই বড়ির অ্যাকশন শুরু হয় তার ভেতরে। আবার আরেক চুমুক দিয়ে সে স্মৃতিকাতর হয়। স্মৃতিচারণের শুরুতে নিজেকে প্রশ্ন করে, তার আটাশ বছরের জীবনে সবচেয়ে বেশি কার সঙ্গে কথা বলেছে?
৪.
মেয়েটির নির্মীলিত চোখে মৃত্যুর হালকা ছাপ পড়তে শুরু করেছে। সেটা অগ্রাহ্য করে তার কেবলই মনে হতে থাকে মৃত্যু উপভোগ করতে হবে। তখন সে জীবনে সবচেয়ে বেশি কথা বলেছে যে, মানুষটার সঙ্গে তার নাম খুঁজতে থাকে। তখন কেবলই তার নিজের নাম মনে পড়ে। সে প্রথমে এটাকে আমল দিতে চায় না। এরপর আবার যখন সে ভাবে তখনো তার নিজের নামটাই মনে আসে। এবার সে বিশ্বাস করে। আর তখন সে মনে করার চেষ্টা করলে মনে পড়ে, ওইসব দিনে যখন সে প্রেম শুরু করেনি, তারও আগে জামা থেকে লাল রং যখন উঠতো, তখন বিছানায় শুয়ে কত কথা বলত নিজের সঙ্গে। ওইসব কথা তার মাথায় ভারভার ঠেকলে বিষের বড়ির গ্লাসে আরেকবার চুমুক দেয়।
তখন আবার ফোনটা বেজে ওঠে। এবার সে ফোনটা রিসিভ করেই কথা বলা শুরু করে। আবার সেই আগের কথা তবে জড়ানো গলায়: হারামজাদা বিয়ে যদি না করবি, তবে কামড়েছিলি কেন? ফোনের আরেকপাশ থেকে একটা নারীকণ্ঠ কথা বলে।
নারীকন্ঠ: কী যা তা বলছেন! আর আমার হাজব্যান্ডের সঙ্গে আপনার কিসের সম্পর্ক?
মেয়েটির নাম এবার জানা যাক। মেয়েটির নাম পারুল। পারুল তখন বিষের বড়ির গ্লাসে আরেকবার চুমুক দেয়। তারপর বলে, আমার দুধে তোমার হাজব্যান্ড কাড়মালো ক্যান? এইকথা বলার পর পারুলের হাত থেকে মোবাইলটা পড়ে যায় মেঝেতে। মোবাইলটা খুলে খুলে ছিটকে যায়। ফোনের ওপাশ থেকে হয়তবা কোনো কড়া জবাব আসছিল কিন্তু সেটা আর জানা হয় না। তবে এটা অনুমান করা যায়, পারুলের প্রেমিক ছেলেটি যে-তার স্তনে কামড় দিয়ে দাগ বসিয়েছে, তার সঙ্গে ওর বউয়ের একটা ক্যারফা লাগে। বিয়ের রাতে নাকি পারুলের প্রেমিকটি তার বউকে বলেছিল, সে কোনো মেয়ের হাতও ধরেনি। তারপর তার বউয়ের হাত ধরে বলে, এই প্রথম ধরলাম। তো যখন বউটি ফোনে তার স্বামীর এমন কীর্তির কথা শোনে, তখন সে ফ্রিজের ঠাণ্ডা পানি গলায় ঢালে, তারপর বাস্টার্ড বলে চিৎকার করে একটা জলের গ্লাস তাক করে মারে। গ্লাসটা তার স্বামীকে অতিক্রম করার পরপরই সে হাউমাউ করে কান্না শুরু করে। তারপর ফোনটা হাতে নিয়ে আবার পারুলকে ট্রাই করে। পারুল তখন আরেকটা প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে থাকে। সে কাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবেসেছে? এই প্রশ্নটা করার পর পারুলের মনে হয় প্রশ্ন করে করে মৃত্যুটাকে উপভোগ্য করা যাবে না। কিন্তু প্রশ্নটা তখন তার মাথায় ঘুরপাক খাওয়া শুরু করে। সে যতই প্রশ্নটার ভেতর থেকে বের হয়ে আসতে চায়, ততই পাক খায়। তার মনে একটা ধারণা ছিল যে, তার প্রেমিক ছেলেটি যে-তাকে ছেড়ে আরেকজনকে বিয়ে করেছে, তার নামটাই উত্তরে আসবে। আর উপভোগ্য এ সময়ে সে তার নামটা কিংবা স্মৃতি কোনোটাই আনতে চাচ্ছে না। ব্যাপারটা বেশি পাক খেলে সে বড়ির গ্লাসে আরেকবার চুমুক দেয়। গ্লাসের অর্ধেক খালি হয়ে গেছে। এবার তার ঢুলু-ঢুলু চোখ নিজের চেহারাটা দেখতে চায়। তখন সে অর্ধেক খালি কাচের গ্লাসটায় নিজের চেহার খোঁজে। যে গ্লাসটার তলানীতে তার মরণ, সেই গ্লাসের প্রেমে পড়ে সে। মরার আগে তার নার্সিসাস হওয়ার ইচ্ছা জাগেনি। কিন্তু সে ভাবে নিজের সৌন্দর্যের মুগ্ধতা মৃত্যুর আকাঙ্ক্ষাকে যত কমাবে, ততই সে উপভোগের চরম সীমানায় থাকবে। ব্যাপারটা সে অন্যরকমভাবে ব্যাখ্যা করতে চায় কিন্তু গুছিয়ে বলার অবস্থা তখন তার নেই। এবারের চুমুকটা আগের বারের চেয়ে একটু বড় হয়। সে তখন বুঝে তার ফেরা আর হবে না। তখন তার নিজেকে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হয় সিনেমাটিক স্টাইলে, কই আখেরি খায়েশ? প্রশ্নটা করার পর সে ভাবতে চায়। যদিও তখন ভাবনাচিন্তা করার মতো আর কিছ্ইু তার মধ্যে বাকি থাকে না। তার একটা স্বপ্ন দেখতে ইচ্ছে করে। সে মনে করে মৃত্যুর আগে এটাই তার শেষ ইচ্ছা।
সময়টা স্বপ্ন কিংবা মৃত্যুর মাঝামাঝি। হয়তবা সময়টাকে স্বপ্ন বলা যাবে হয়তবা মৃত্যু। সে কেবলই দেখে তার জামার লাল রং পুকুরের জলে ভাসে। মৃত্যুপূর্বকালে জামার লাল রং এবং পুকুরের জল অন্যকোনো ব্যাপারের সঙ্গে যুক্ত কি না—এমন খোঁজ করলে মানুষ হত্যার একটা ইচ্ছা সম্পর্কে জানা যায়।
মেয়েটি যার নাম পারুল এবং যে কিনা বিষের বড়ি খেয়ে মরার জন্য ঝুলছে কিংবা এতক্ষণে মরেও গেছে আখেরি খায়েশে তার স্বপ্নটা ছেলেবেলার একটা ঘটনা। তার মায়ের গর্ভে পরপর সাত কন্যা জন্ম নেওয়ার পর তার বাপ আরেকটা বিয়ে করলে সেই ঘরে প্রথম সন্তানটাই পুত্র হয়ে জন্মায়। সাত কন্যার মধ্যে সে সপ্তম হওয়ায় আদরযত্ন তার তেমন না জুটলে সে এটার জন্য তার বাপের পুত্র সন্তানটাকেই দায়ী করে। এটা সে করতো না, যদি তার জামা থেকে লাল রং না উঠতো। দিঘির জলে যখন শুধু তারই জামার রং ভাসতো, তখন তার প্রিয় লাল রংটা আর প্রিয় থাকত না। এভাবে চলতে থাকলে সে লাল রংকে ঘৃণা করা শুরু করে। তখন সে সাদা রংয়ের কাপড় নেয়। তখন দিঘির ঘাটে তার কাপড়ের রং না ভাসলে সে খুশি হয়। কিন্তু তাকে কে যেন বলে, সাদা তো কোনো রং না। এটা বিধবার কাপড়। তখন তার মধ্যে আবার বিতৃষ্ণা নামে। তখন এক ভরদুপুরে মনের মধ্যে প্রশ্ন নিয়ে সে ঘোরে। তার কাপড়ের রং ওঠার জন্য দায়ী কে? দিনদিন এই প্রশ্ন মনের মধ্যে বাড়তে থাকলে শেকড়বাকড় আর ডালপালা গজায়। তখন মনে ‘কু’ আর ‘সু’-এর খেলা চলে। এই খেলায় আদিম প্রবৃত্তি ‘কু’ জয়ী হলে তাকে বারবার বলে, কোনো এক ভরদুপুরে যখন বাড়ির সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকে, না-হয় ঘুম তাদের বন্দি রাখে, তখন সে চায় তার সৎভাইটাকে যে-দিঘির জলে লাল রং ভাসে সেই জলে ভাসিয়ে দিতে। ছেলেটা ভেসে গেলেই লাল আবার তার প্রিয় রং হবে। ‘কু’ কথাটা বারবার মনের ভেতর ঘ্যান ঘ্যান করতে থাকে।
তখন ‘সু’ তাকে ঠেকানোর জন্য কিছু বলতে চায় কিংবা মিনমিন করে দোহাই দেয় যে, সেটা আর শোনা যায় না।
এভাবে ‘কু’ কথা শুনতে শুনতে সে একরাতে স্বপ্ন দেখে তার জামার রং আবার লাল হয়ে উঠছে। দিঘির জলে আর রং ভাসছে না।
তখন ‘কু’ কথায় সে সায় দেয়।
তারপর কোনো এক ভরদুপুর যখন কাক চিৎকার করতেও ভয় পায় কিংবা কাকের ডাকে কলিজা কাঁপে আর ঘুঘুরা কেবলই অবিরাম কাঁদে। এমনই একদিন তার সৎমায়ের পেটে জন্ম নেওয়া ভাইটা বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। কেউ তারে দেখেনি। কিংবা বলা যায় এমন দিনগুলো এমনই হয়। সেই আড়াই বছরের ছেলেটা হাঁটতে শেখার পর এই প্রথম বাড়ির বাইরে পা দেয়। আর তখন পারুল নামের মেয়েটি যার কাপড়ের লাল রং দিঘির জলে ভাসতো সে দৃশ্যটা দেখে। আড়াই বছরের ছেলেটা হাঁটা দিয়ে আর কোনো দিকে না গিয়ে দিঘির দিকে যায়। নিস্তরঙ্গ শ্যাওলা পড়া দিঘির পাড়ে সে কিছু এটা দেখে। হয়তবা দিঘির জলে তার নিজের ছায়া দেখে কিংবা প্রতিচ্ছায়া। আর তখন তার হাতের কাঠের ঘোড়াটা সে দিঘির জলে মারে। জলের মৃদু কম্পনে তার কাঠের ঘোড়া ভাসতে থাকলে সে দেখে তার ঘোড়া লাগামছাড়া হয়ে রাজ্য থেকে বের হয়ে যাচ্ছে। তখন সেখানে পারুলের দেখা পাওয়া যায়। কাঠের ঘোড়ার মালিক পারুলকে দেখেনি। সে কেবলই দেখে তার কাঠের ঘোড়ার ভেসে থাকা। তখন সেও কাঠের ঘোড়ার কাছে যায়। দিঘির নিস্তরঙ্গ জলে হালকা তরঙ্গ ওঠে। পারুল সেটা দেখে। তখন কাঠের ঘোড়ার মালিক পানিতে তলাতে থাকলে পারুল দেখে এতদিন ধরে তার জামা থেকে ভেসে যাওয়া লাল রং যেটা পুকুরের পানিকে লাল করেছিল, সেটা আর লাল থাকে না। কাঠের ঘোড়ার মালিক পুরোপুরি তলিয়ে যাওয়ার আগে একটা হাত কেবলই পারুলের দিকে বাড়িয়েছিল। আর আরেক হাত ছিল তার কাঠের ঘোড়ার দিকে। ঘোড়াটা ভাসতে থাকে আর তার মালিক তলিয়ে গেলে পারুলের চোখ থেকে দিঘির লাল জল সরে চিরতরে নীল হয়ে যায়।
৫.
মেয়েটি যার নাম পারুল—যে একশো একটা বিষের বড়ি খেয়েছে। মৃত্যুর আগে আখেরি খায়েশ হিসেবে একটা স্বপ্ন দেখার সাধ করেছিল। সে কাঠের ঘোড়ার মালিককে একটা হাত বাড়িয়ে দেয় ধরার জন্য কিন্তু কাঠের ঘোড়ার মালিক সে হাত ধরে না। মেয়েটিও তখন তলিয়ে যেতে থাকে কিংবা তলিয়ে গেছে, কেবল তার হাতটা থাকে বিছানার ওপরে। আষাঢ়ের বৃষ্টি বাড়তে থাকে।
বৃষ্টির রং নীল।
মন্তব্য