আকাশসমান একটা দায় বুড়ো লোকটিকে স্থিরভাবে ঘরে থাকতে দেয় না। একমাত্র ছেলেটি আমন মৌসুমে ধান কাটতে গিয়েছিল জাগুয়ার চরে। ফেরার পথে ভটভটির চাপায় থেঁতলে গিয়েছিল মাথাটা। বাড়িতে এসেছিল ছেলের রক্তমাখা নিথর দেহ। এর কয়েকদিন বাদে চৈত্রের খরায় যম এলো হনহনিয়ে। সঙ্গে করে নিয়ে গেলো আধমরা বুড়িটাকে। থাকার মধ্যে আছে একমাত্র নাতনি মিনু। মা-মরা মিনুর ভেতরে বুড়ো খুঁজে পায় বুড়ির ছায়া। কিছুটা আদর, কিছুটা রহস্য করে বুড়ো নাতনিকে ডাকে ঝামেলা। মিনুর বিয়ের জন্য বুড়ো সকাল থেকে রাত অবধি দোকানের বেঞ্চে বসে বিয়ের রায়বার খোঁজে।
মিনুর চেহারায় আকর্ষণীয় কিছু নেই। এমন অনেক মুখ আছে, যা দেখেই মনে হয় ভাস্করের তৈরি। কারোটা বেশ দরদ দিয়ে, যত্ন নিয়ে গড়াচ আবার কারোটা মনে হয় নিতান্তই সাধারণ। কিন্তু মিনুর মুখ দেখে মনে হয় যেন পোড়া কাঠের ওপর খোদাই করা একটা অবয়ব। কোথাও যেন সুডৌল, ললিত রেখার লেশমাত্র নেই। এমন পাত্রীর জন্য পাত্র পাওয়া বিশেষ ভাগ্যের ব্যাপার বটে। কিন্তু বুড়ো পাত্র ঠিক জোগাড় করেই ফেললো।
ছেলেটি পাশের গ্রামেই থাকে। নাম ফরহাদ। জমি জিরাত হাল গোরু সবই আছে। বাবা মরেছে বছর দুই হলো। যেমন তেমন হোক একটি মেয়ে হলেই চলে তার। ঘরদোর সামলানো, ভাত রাঁধা আর মায়ের জন্য এক আধটু সেবাযত্ন। এ গাঁ-ও গাঁ থেকে ডজন খানেক বিয়ের প্রস্তাব এসেছে তার জন্য। কিন্তু বছর খানেকের প্রমেহর ধকল সামলে সাহসে কুলিয়ে ওঠেনি। একটা সুন্দরী মেয়েকে ভাত কাপড়ের সঙ্গে সঙ্গে আরও কিছু দিতে হয়। কিন্তু ওই আরও কিছু জিনিষটা তার কাছে পর্যাপ্ত নেই। থাকার মধ্যে আছে একটা চেহারা। পশ্চিমা সাহেবদের মতো গায়ের রঙ, লম্বাটে মুখে গালের দুপাশের হাড়দুটো একটু উঁচু। নির্বিকার মুখ, কারও দিকে তাকালে বড় চোখদুটো বিশেষ ঝলক দিয়ে ওঠে। চকচকে কালো চুলগুলো নুয়েপড়া ফুলের পাপড়ির মতো ঘাড়ে, কপালে ঝুলে পড়ে। চিরুনি কিছুতেই ও চুলের শাসন মানে না। দেখে যে কারও প্রথম দর্শনে ভালো লাগার মতো। কিন্তু এই ভালোলাগা-ই যে তার জন্য কাল, তার একটা বিশেষ ইতিহাস আছে।
আমরা বরং সেই ইতিহাসের দিকে না গিয়ে মিনুর সঙ্গে তার বিয়ের গল্পটা শুনি।
বৈশাখের প্রথম দিনে মিনুর সঙ্গে ফরহাদের বিয়েটা সম্পন্ন হলো। বর সেজে যাওয়ার জন্য বিশেষ কোনো আড়ম্বর ছিল না ফরহাদের। গোসল করেছে ঠিক কিন্তু দাড়িটা কামানো হয়নি। মুখের ওপর কেমন খড়িওঠা ভাব। পট্টি দেওয়া পুরান জুতাটা পরেছে পায়ে। সোলের তলায় বহু দিনের লেপটানো কাদা ঝেড়ে পরিষ্কার করা হয়নি। বালিশের নিচে রাখা ভাঁজ করা জামাটা পরেছে সাধারণভাবেই। বুড়ো লোকটি বয়সের ভারে নেতিয়ে গেলেও অভিজ্ঞতা মরে যায়নি তার। নাতজামাইয়ের অগোছালো, অপ্রস্তুত চেহারা দেখে কেমন যেন ঠেকে তার। বিয়ের আসরে ফরহাদের কাছে এসে দু-হাঁটু ভাঁজ করে বসে। তারপর বোতামের মত তার ছানিপরা চোখদুটোর খেয়ালি দৃষ্টি ফরহাদের মুখের দিকে। ঢিলে চামড়ার হাড্ডিসার ডান হাতটা রাখে হবু নাতজামাইয়ের মাথার ওপর। চুলের ওপর হাত বুলিয়ে ছুঁয়ে দেখে ফরহাদের খরখরা মুখ। বুড়ো অনুমান করতে পারে, ফরহাদের মুখে যুবকের সেই পেলব ভাবটি নেই। যেন মিথ্যা চামড়ায় মোড়ানো একটা শরীর। কোমরটা ভাঙা, হাত পায়ের পেশীগুলো অসাড়, নিশ্চল। হবু নাতজামাইয়ের মুখের দিকে চেয়ে বুড়ো হাসতে চেষ্টা করলো কিন্তু ঠোঁটদুটো তার দরজার খিলের মতো আটকে যায়। ফোঁকলা দাঁতের মাড়িটা যেন মোমের মতো গলে গলে যেতে লাগলো গলার ভেতরে। বুড়ো দাঁড়িয়ে বাড়ির পেছনে গিয়ে চিরচির করে পেচ্ছাব করে নিজেকে কিছুটা হালকা করে। অনেক খুঁজেটুজে বাপ-মা মরা আদরের নাতনির জন্য একটা বর জোগাড় করলো অথচ সবকিছু থেকেও ছেলেটির কী যেন নেই! বিয়ের আকদ হয়ে গেলো, একলা নিভৃত ঘরের কোণে পড়ে রইলো বুড়ো।
পুরোদিনের রৌদ্রের আলো ম্লান হয়ে গুমোট হয়ে এলো আকাশ। সন্ধ্যা নেমেছে চরাচরে। বুড়ো দেখলো—একখণ্ড কালো মেঘে ঢেকে গেছে দখিনের আকাশ। বিদ্যুতের তরবারির আঘাতে ক্ষণে ক্ষণে মেঘ ঝলকায়। হু হু বাতাসের সঙ্গে জাবর কাটতে শুরু করেছে মেঘেরা। বুড়ো উঠানে নামলো, বৃষ্টির হলকায় ভিজে যাচ্ছে তার শরীর। তাকিয়ে দেখলো, বাগানের আড়ালে প্রতিবেশী বাড়িগুলোর আলো নিভে নিভে আসছে। মচমচে পাতাগুলো জলে ভিজে একটা উটকো গন্ধ এলো নাকে। বুড়ো চুপচাপ উঠানে দাঁড়িয়ে চারপাশের বৃষ্টিমিশ্রিত আঁধারের দিকে চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ। তখন থেমে গেছে বিয়ে বাড়ির সব গোলমাল। ঝিমিয়ে পড়েছে ছেলেগুলো, যারা এতক্ষণ ধরে হুল্লোড়ে মেতেছিল। বৃষ্টির সঙ্গে মাতাল হাওয়ায় নেশা ধরলো অপুষ্ট মহিলাদের। তারাও চুপ করে শুয়ে পড়েছে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে। শুধু নির্ঘুম চোখদুটো জ্বলজ্বল করছে বুড়োর।
বুড়োর চুপচাপ কাটলো কিছুক্ষণ, উঠোনের চারপাশ ঘুরে হয়তো কিছুটা স্বস্তি পেয়ে ঘরের দাওয়ার ওপর বসে অপেক্ষা করছে নাতনি আর নাতজামাইয়ের বাসর ঘরের কিছু একটা অঘটনের আশঙ্কায়। বুড়ো বারকয়েক এদিক ওদিক হেঁটে এগিয়ে গেলো নাতনির ঘরের দিকে। তারপর লুকিয়ে উঁকি দিলো ঘরের ভেতর। সেখানে খুঁটির সঙ্গে ঝুলছে হারিকেনের আলো। লালচে শিখাটার ঝাপসা আলো পড়েছে বিছানার ওপর। আদরের নাতনি চৌকির ওপর বসে আছে একা। চৌকির বাইরে এককোণে একটা খুঁটির সঙ্গে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নাতজামাই। চোখেমুখে তার বিষণ্ণ ভাব। কী যেন ভাবতে ভাবতে দরজা খুলে বেরিয়ে এলো বাইরে। তখন বৃষ্টি থেমে গেছে, নিঝুম, নিশ্চুপ হয়ে এ বাড়ির মানুষগুলো অঘোরে ঘুমায়। বারান্দায় নাতজামাইয়ের মুখোমুখি হলো বুড়ো।
আঁধারে স্পষ্ট দেখা যায় না পরস্পরের মুখ। আরেকটা হারিকেন এনে আলোটা উসকে দিয়ে নাতজামাইয়ের মুখের দিকে তাকালো দাদু। যুবতীর ছ্যাচা শরীর কাছে পাওয়ার দমকা ফুর্তির ছিটেফোঁটাও নেই ফরহাদের মুখে। থমথমে চেহারা, জ্বলজ্বলে চোখ। লম্বা শ্বাস-প্রশ্বাসে ওঠানামা করছে বুক। হারিকেনটা উঁচু করে নাতজামাইয়ের মুখের কাছে এগিয়ে বুড়ো বললো, কী অইলরে দাদু?
বুড়োর ভাঙা ভাঙা কণ্ঠ, নরম স্বর। বলার ভঙ্গিতে এতটুকু জবরদস্তি নেই। কেবল ভ্রূ দুটো সাধারণ হাবভাবের বিপরীত। প্রায় সমকোণে বাঁকা হয়ে রেখাঙ্কিত হয়েছে অযুত জিজ্ঞাসার। দাদু, বেবাক খুইল্যা কও মোরে, বুড়ো বললো। নড়েচড়ে না ফরহাদ। বুড়ো আবার বললো, ও দাদু, চুপ মাইরা রইলা ক্যা? কতা কইতে মুনচায় না তোমার? গাছের শুকনো ডালের মতো হাতটি দিয়ে বুড়ো মাথায় ঝাঁকুনি দিলো নাতজামাইয়ের। অনেকক্ষণ ইতস্তত করে বুড়োর হাত ধরে ফরহাদ বুড়োকে নিয়ে যায় ছোট বারান্দার দরজার কাছে। বুড়ো আরেকটু খাতির দেখিয়ে ঘরের ভেতর থেকে মাদুর এনে চৌকাঠের কোল ঘেঁষে পাতে। তারপর পাশাপাশি দুজন বসে মাঝখানে রাখে কেরোসিনের অভাবে ধুঁকে ধুঁকে জ্বলা হারিকেন।
তখন মধ্যরাত পেরিয়েছে, নিস্তব্ধ চারিদিক । আঁধার কালো আকাশে মিটমিট করছে অল্পকিছু তারা। উঠানের শেষে নিচু জমিতে জমানো জলে ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ করছে ব্যাঙেরা। জলে ভেজা বাতাস খোলা দরজা দিয়ে গায়ে লেগে শিরশিরিয়ে ওঠে দাদু আর নাতজামাইয়ের শরীর। বুড়ো বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে ফরহাদের দিকে। ফরহাদ তার যৌবনের প্রথম গল্পটা বলা শুরু করলো।
তখন বয়স কত হবে ফরহাদের! অনুমান উনিশ কুড়ি হবে হয়তো। শরীর থেকে সবে বের হচ্ছে সদ্য জোয়ানের গন্ধ। আকাশের রঙ, ফুল, পাখি দৃষ্টিতে সব যেন প্রেমিকা তার। সদ্য গজিয়ে ওঠা বলকানো যৌবনে রক্তের স্রোত খেলা করে। হঠাৎ করে একদিন মরে গেলেন বাবা। সবকিছু কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেল তার। যেন নিঃশব্দে মাথার ওপর ভেঙে পড়লো আকাশ। শোকের ছায়াটা ধীরে ধীরে কেটে যাওয়ার পর ফরহাদের ফুফু তার দুই মেয়েকে নিয়ে আসে তাদের বাড়িতে। না, থাকার জন্য নয়। পিতৃহারা ভাইপোকে কিছুটা সান্ত্বনা দেওয়া আর জমিজমার নিজের অংশ হিসাব করে বুঝে নিতে। ফরহাদের মা ব্যাপারটা স্বাভাবিকভাবেই নিলেন। সম্পত্তির প্রশ্নে তিনি নির্বিকার। পিতার অংশ তার মেয়ে পাবে, এটা তার হক। এছাড়া সংসারের প্রিয় মানুষটি হারানোর শোক ভুলে থাকার জন্য সবাই কিছুদিন একসঙ্গে থাকা মন্দ নয়। মোটামুটি দিনগুলো ভালোই এগুচ্ছিল। ফুফুর বড় মেয়ে মিলি। বাড়বাড়ন্ত শরীর, চেহারায় বিশেষ আকর্ষণ নেই। বসন ভূষণে সাধারণ। একা একা থাকতে ভালোবাসে এবং সম্পূর্ণ আলাদা জগৎ তার। সিরিয়াস কোনোকিছু চিন্তা করার সময় তার নেই। বয়সে বড়দের সঙ্গে তার অমিল কিন্তু ছোটদের সঙ্গে ভাবের অন্ত নেই। গ্রামীণ নিয়মে বিয়ের বয়স পার হয়ে যাচ্ছে।কিন্তু রায়বার ঘটকের টিকি-পাত্তাটি নেই। মেঝ মেয়ে লিলির বিয়ে হয়েছে আগেই।
পূর্বমুখী কাঠের দোতলা ঘরের যে বারান্দায় ফরহাদ ঘুমাতো। একদিন রাতে সেখানে ধুম করে কি যেন একটা শব্দ হলো। টের পেয়ে বুকে থুথু ছিটিয়ে উঠে বসলো ফরহাদ। জানালার বাইরে শোনা গেলো মানবকণ্ঠের ফিসফিসানি। বিষয়টি বোঝার জন্য কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলো ফরহাদ। তখন ফিসফিসানি আরও বেড়ে গেলো। কেমন মড়মড় শব্দে জোরে নড়ে উঠলো দরজাটা। মিলি বাইরে থেকে বললো, ফু। ফরহাদ জিজ্ঞেস করলো, কেঁদো?
—ফু, মুই। দুয়ার খোল।
ফরহাদ দরজাটা খুলে দেখলো বাইরে দাঁড়িয়ে আছে মিলি। কেমন এলোমেলো চেহারা, অস্থির চোখ। একহাত বাড়ানো ফরহাদের দিকে। বাড়ির সামনে যে কুয়োটি খুঁড়ে উঠানের মাটি ভরাট করে উঁচু করা হয়েছিল, মিলি টানতে টানতে ফরহাদকে নিয়ে গেলো সেই কুয়োর কাছে। শুকনো কুয়োটা জলের তেষ্টায় খাঁখাঁ করছে। খটখটে মাটিগুলোতে চাঁদের রূপালি আলো ভেঙে ভেঙে পড়ছে। সেখানে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ফসলহীন নগ্ন ক্ষেতের মাঝখানের সরু আলের পথ ধরে মিলি ফরহাদকে নিয়ে গেলো ছোট নদীটির পাড়ে। নদীর ওপর তখন মেঘের আড়ালে আধমরা চাঁদের আলো। পাশাপাশি দুটি নৌকা জালের সঙ্গে বেঁধে অঘোরে ঘুমাচ্ছে জেলেরা। ঢেউয়ের তোড়ে দোল খাওয়া নৌকায় জলের আঘাতে ছলাৎ ছলাৎ শব্দে মুখরিত হয়ে উঠলো ছোট নদীটির এপার ওপার। সরসর করে জল নামছে ভাটিতে। জালের টোনের সঙ্গে বাঁধা দড়িটা জলের তোড়ে এমনভাবে দুলছে, যেন এঁকেবেঁকে চলছে সাপের লেজ। হোতার মুখে বাঁধা ছোট নৌকাটা দেখিয়ে মিলি বললো, ল ফরু, দড়িটা ধইরা জালের টোন খুইল্যা মাছ লইয়া আই। ফরহাদ নড়ে না। দেহটা যেন তার নিশ্চল পাথরের মূর্তি। তখন মাথার ওপর আকাশের তারাগুলো খই ফোটার মতো দপদপ করে ফুটছে। জলের তরঙ্গে কেঁপে কেঁপে উঠছে মেঘ কেটে যাওয়া চাঁদের আলো। ফরহাদকে টেনে পাড়ে হোতার ভেতর বাঁধা ডিঙ্গি নৌকায় ওঠায় মিলি। লগি খুঁচিয়ে জলের ভেতর নৌকাটা ছেড়ে দিয়ে চরাটের গুড়ার ওপর বসে ঘাড় উঁচু করে মিলি তাকায় ঝলমলে আকাশের দিকে। জোসনার অসীম আলোয় ঝলমল করে ওঠে মিলির যৌবন। ফরহাদ মিলির দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে জলের সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে যায়।
জালের কাছে গিয়ে টোনের মুখটা খুলে মাছগুলো ঢেলে দেয় চরাটের ওপর। মিলি যত্ন করে মাছগুলো ওড়নায় বাঁধে। তখন স্রোতের টানে ডিঙ্গিটা চলে যায় খানিক দূরে। সেখানে চরের ওপর হোগল পাতার জঙ্গল। বাতাসে নুয়ে নুয়ে পড়ছে পাতাগুলোর নরম মাথা। বাতাসের শনশন শব্দে কী এক ঘোর জাদু! মাদকতায় বিভোর হয় মিলি। ওড়নাহীন বুক সুউচ্চ ঢেউয়ের মতো ওঠানামা করছে বারবার। মাথার ওপর সুউচ্চ আকাশ, চারদিকে জোছনার হাসি, আউলা ঝাউলা মিলির দুরন্তপনায় ফরহাদ নিজের ভেতর পৌরুষের অস্তিত্ব টের পায়।
হোগলের জঙ্গল ঠেলে চরের ভেতরে গিয়ে একটু উঁচু খোলা জায়গা। চারপাশে ঘেরা সবুজ হোগলের পাতাগুলো নির্জন আবাস তৈরি করেছে সেখানে। একলা দাঁড়িয়ে থাকা মান্দার গাছটিকে স্বর্ণলতা জড়িয়ে রেখেছে পরম মমতায় । লতা আর পাতার ফাঁকে জোনাকিরা স্বর্ণের দানার মত জ্বলছে। কেমন ঘোর ঘোর ভাব, যেন আলো আঁধারের পরম রহস্য। হোগলে ঘেরা চারপাশ আর নির্জন গাছের নিচে আধভেজা মাটির বিছানা মিলির কাছে স্বর্গোদ্যান মনে হয়। কানের কাছে শুনতে পায় পিপাসার্ত যৌবনের আকুতি। নিঃশ্বাস গরম হয়ে ওঠে তার। তখন ঝোপের ভেতর ঝিল্লি পোকার ডাক, আরও দূরে শেয়ালের সমস্বরে চিৎকারে গা ছমছম করে ওঠে। মিলি ফরহাদের বুকে মাথা গুঁজে নাকে শুষে নেয় লোমশ বুকের ঘ্রাণ। কাছের নদীটিতে তখন উছলে ওঠে জোয়ারের বান। আকাশে শত সহস্র তারার সঙ্গে চাঁদের বহুমাত্রিক মিলন। আর নির্জন গাছের নিচে একজোড়া নরনারী উন্মুক্ত করে দেয় সব লজ্জার আড়াল।
পরদিন থেকে ফরহাদ আর কথা বলেনি মিলির সঙ্গে। কতবার সামনে দিয়ে এলো গেলো শুধু আড়চোখে তাকিয়েই দেখেছে। গতরাতের ঘোর যেন আর কাটে না তার। কত ভাবনা উঁকি দেয় ফরহাদের মনে। অভাবিত, অপ্রত্যাশিত, যেন হঠাৎ পথের বাঁক নিতেই দেখা হয়েছে অচেনা মিলির সঙ্গে। তার থেকে বয়সে বড় মিলি নিমিষেই কেমন অচেনা হয়ে গেলো।
ফরহাদ মিলির কাছে যায় না, ভীষণ লজ্জা লাগে তার। চোখ তুলে তাকাতে পারে না কিন্তু কেবলই ঘুরেফিরে ভাবনায় আসে মিলির কথা। মিলি হাসে, মিলি কাঁদে। উদাসী গলায় গান করে সে। রাত্রে মিলি দেখা দেয় স্বপ্নে। মিলি শুভ্রা, উষ্ণা, রক্তাভ চোখের ওপর টানা ভ্রুতে যেন জাদু খেলা করে। আর নিশ্বাসে ওঠানামা করে তার টানটান বুক।
এর কয়েকদিন বাদে আবার দরজায় টোকা পড়লো। এ বাড়ির প্রত্যেকটা কক্ষ, ঘরদোর আর উঠোনে পরিপূর্ণ নীরবতা। বাড়ির সবাই গভীর ঘুমের স্বপ্নে বিভোর। নিথর হয়ে আছে পৃথিবীটা। শুধু পাশের নদীটি থেকে আসছে মালটানা ট্রলারের ইঞ্জিনের ঘরঘর শব্দ আর মিলির ধুকপুক করা শ্বাসপ্রশ্বাস।
উদ্বেগহীন বিছানা, মাথার ওপর টিনের চালা, তার ওপরে আকাশ, তার আরও অনেক অনেক দূরে আসমানের সীমানায় ঈশ্বরের বহুমুখী দৃষ্টি। সব মিলিয়ে ফরহাদের মন নড়েচড়ে ওঠে। ভেতর থেকে ফুলে ওঠা শিরার মতো জেগে ওঠে অপরাধ-বোধ। প্রথমবারের মতো নারী শরীর সে হজম করতে পেরেছে কি পারেনি তার উত্তর অমীমাংসিত। কিন্তু পুনরায় এমন পরিস্থিতির সে আশা করেনি। মিলি তখন উত্তাপে জ্বলছে। ফরহাদকে নিয়ে এমনভাবে বিছানায় গড়িয়ে পড়লো যেন, এক চুমুকেই শেষ করে ফেলবে জলের গেলাস। মিলির স্পর্শে ঝলকে উঠল ফরহাদের দেহ কিন্তু সুখ শীৎকারে মিলির নাক নির্গত উষ্ণ নিশ্বাস মনে হলো ইট ভাটার চুঙা নির্গত ধোঁয়া। ফরহাদের ভেতরের উষ্ণতায় তুষার পড়তে শুরু করে। এক ঝাঁকুনিতে শীতল হয়ে যায় তার সমস্ত শরীর। এভাবে কয়েকদিন পরপর ফরহাদের দরজায় টোকা পড়ে আর বাইরে থেকে আসে ফিসফিসানির আওয়াজ। শরীরের ভেতর লুকিয়ে থাকা সুখগুলো ধীরে ধীরে নিষ্প্রাণ হয়ে অস্থির অনুভূতি তাকে হররোজ তাড়িয়ে বেড়ায়।
ফরহাদের ভেতর অপরাধের বোধটা ধীরে ধীরে জমে পাথরের মতো শক্ত হয়ে ওঠে। বিগত রাত্রিগুলোর কথা মনে পড়লে সবকিছু বিষণ্ণ হয়ে ওঠে তার। দিনের আলোতে মিলির মস্ত দেহটা ফরহাদের কাছে সমুজ্জ্বল প্রতিভা। কোনোভাবেই প্রবোধ দেওয়া যায় না এই অসম শারীরবৃত্তির। তার খিদে লোপ পেতে থাকে, তেষ্টায় ঘন ঘন গলা শুকায় আর মনের ভেতর ভারী একটা পাথরচাপা অনুভব করে সব সময়।
গল্পটার এ পর্যন্ত শেষে করে ফরহাদ থামে। বুড়ো চোখদুটো গোল করে তাকায় নাতজামাইয়ের দিকে। খুক খুক করে দুতিনটা কাশি দিয়ে শ্লেষ্মা জমা করে মুখের ভেতর। খুঁটির সঙ্গে ভর দিয়ে দাঁড়ায় কোমর বাঁকা করে। একদলা থুথু বাইরে ফেলে বাঁশের চুঙ্গি থেকে বের করে ছেঁচে গুঁড়ো করা পান। গুঁড়োপান মুখে পুরে গাল বাঁকিয়ে জাবর কাটতে কাটতে বলে, মাগীর কপালডা জন্মের পোড়া।
বুড়ো একটু থেমে আবার বলে, তয় মোনে রাইখ্য দাদুবাই, জেবনডা এট্টা সমুদ্দুর, বেমালা বড়। যুদি পিছেরডা লইয়াই থাহো, তয় তোমার জেবনডা অইবে ফুডা নাওয়ের এল্লা মাঝির নাহান। পানি হেচপা আর এক পাড়ের দিক চাইয়া থাকপা। ওপার তো পইরা রইচে বহুত পোত। পোড়া কপালিডারে লইয়া সমুদ্দুর পাড়ি দেও বাই।
হঠাৎ পায়ের আওয়াজ শুনে ফরহাদ চমকে ওঠে। কান খাড়া করে শুনলো, ঘরের ভেতর থেকে আসছে টুংটাং চুড়ির শব্দ আর কাপড়ের খসখস। নরম দুটি আলতা মাখানো পা টিপেটিপে এগিয়ে আসছে এই দিকে। বাইরে নিঃশব্দ রাত, কৃষ্ণচূড়া পাতার ফাঁকে নিঃসঙ্গ চাঁদ আর ঈশ্বরের পৃথিবীতে ঘুমের নীরবতা। থেমে যায় ফরহাদ। উঠে দাঁড়িয়ে জলে ভেজা পাতার ফাঁকে চাঁদের দিকে তাকায়। কালো দাগঅলা চাঁদের কলঙ্ক তার কাছে মনে হয় প্রেয়সীর অলঙ্কার। তার কাঁধের প্রান্ত ছুঁয়ে দাঁড়ানো বউকে মনে হয় ঈশ্বরের আশীর্বাদ। সে বউয়ের হাত ধরে নিয়ে যায় টিনের বেড়ার আড়ালে চৌকির শয্যায়। পেছন থেকে ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে দুচোখের পাতা ভেজায় বুড়ো।
ঘুণপোকায় খাওয়া কাঠের দরজাটা বন্ধ করে ফরহাদ স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেললো। বড্ড ক্লান্ত লাগে নিজেকে। যেন গোটা রাত সে যুদ্ধ করে ফিরেছে এইমাত্র ঘরে। নতুন বউ চুপচাপ বসে রইলো চৌকির ওপর। কোনো কথা বললো না সে। গালদুটো ফুলে উঠছে আর বেঁকে যাচ্ছে কেঁপে ওঠা ঠোঁট। ফরহাদ চেয়ে দেখলো উসকে দেওয়া হারিকেনের আলোয় দেখা যায় নববধূর একজোড়া চোখ। সজল, করুণ আর মায়াময়। মনে হলো, অনেক দুঃখ-অভিমান আর বিস্তর দুর্ঘটনার সাক্ষী ওই দুটো রমণী চোখ। অশ্রু মুছে দিয়ে নববধূকে একটু আবেগ দিতে ফরহাদ এগিয়ে যায় বউয়ের কাছে। বুকের সবকটা বোতাম খুলে লোমশ বুকটা বের করে বউকে কাছে টানে। মুহূর্তে নববধূর শরীরটা চোখের সামনে পাল্টে রূপান্তরিত হয় আরেকটা শরীরে। যাকে প্রশ্রয় দিয়ে এসেছে কৈশোরের প্রথম থেকে, যৌবনে এবং এখনও। তার শরীর তীরের ফলার মতো বিদ্ধ করেছিল নিজেকে।
নববধূর সলজ্জ ভাবখানা মুহূর্তে কোথায় যেন হারিয়ে গেলো। মাথাটা উঁচু করে স্বামীর মুখের দিকে চেয়ে দেখে অপরিচিত একটি পুরুষের মুখ। পুরুষের যেমন মুখ সচরাচর দেখা যায় না। আলগোছে স্বামীর হাত ধরে বিছানায় গিয়ে বসে নিচুস্বরে জিজ্ঞেস করে, অ কী, কী অইল আফনের? মোরে কি মনে লাগে নাই?
ফরাহাদ নববধূর মুখের দিকে চেয়ে শিশুর প্রতিচ্ছায়া দেখে। বুঝতে পারে স্ত্রী তার কাছে আদর সোহাগ চায়। তারপর স্ত্রীকে কাছে টেনে নিজেকে শতবার চেষ্টা করেও জাগাতে পারে না। উপরন্তু নারী শরীর তার কাছে কাঁচা মাছের গন্ধের মতো আঁশটে মনে হয়। গ্রাম্য সাধারণ মেয়েটি স্বামীর সেই আচরণটি খুঁজে পায় না, যা তার সমবয়সী বিবাহিত মেয়েদের কাছে শুনেছে। ফরহাদ শরীরটা ছেড়ে দিয়ে বিছানায় কাৎ হয়ে একপাশে শুয়ে পড়ে। তখন পেছন দিকের চালা ঘরের খোপ থেকে একটি মোরগ প্রভাত আগমনের ডাক ডেকে ওঠে। বেড়ার ফাঁক দিয়ে দেখা যায় দূর আকাশে তারারা ঝলক দিচ্ছে। ভোর হয়ে আসছে। ফরহাদ একঘুমে দীর্ঘ সময় পার করে উঠে দেখে শিয়রের কাছে নববধূটি ভেজাচুলে গামছা জড়িয়ে চুপ করে বসে আছে। ফরহাদের কাছে তখন জীবনের সব সত্যগুলো ভেঙে ভেঙে পড়ে।
নতুন বউটি বেড়ার কাছে একদৃষ্টিতে স্বামীর দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে আছে । ভীষণ মলিন চেহারা তার। বুড়ো দাদু হাতটা ধরে আছে যত্ন করে। কি অসহায় মুখ দাদুর! চোখের কোণে নাতনীর ভবিষ্যৎ চিন্তার করুণ প্রতিচ্ছবি। দাদু মাথাটা ঘুরিয়ে দেখে দুঃখী নাতনীর মুখে একফোঁটাও রক্তের ছাপ নেই। ফ্যাকাসে হয়ে গেছে যুবতী মুখটা। বুড়ো মুখ তুলে নাতজামাইকে বললো, পশশু ঘরদুয়ার ঠিক কইরা আবার আইও দাদু। পোড়ামুখিডায় তোমার পথ চাইয়া থাকপে। তখন নতুন বউয়ের চোখের জল প্রকৃতিকে বুঝিয়ে দিলো, নারীর কাছে আপন পুরুষ কী জিনিস। গতরাত তার জন্য ছিল মিথ্যা, সকালটা ছিল মানুষ ভোলানো ছলনা। পিতৃমাতৃহীন মেয়েটির কাছে সুখ কি অত সহজে ধরা দেয়!
বাড়ি গিয়ে ফরহাদ দেখে প্রতিহিংসায় জ্বলছে মিলির দুই চোখ। আচার আচরণে হিংস্র এক দানবী। মেঘ ও রৌদ্রের দুপরে ফরহাদকে টেনে নিয়ে যায় ঘরের পেছনে নির্জন জায়গাটিতে। সেখানে ঝরে পড়া ভেজা পাতার ওপর একদলা কালো পিঁপড়া ফরহাদের পায়ের তলায় নির্দোষে পিষে যায়। দুচোখে ক্রোধের অগ্নিশিখা জ্বালিয়ে মিলি ফরহাদকে শাসায়—নতুন গতরে বড় সুখ পাইছ মনে লয়? মোরে ভুইল্যা যাইতে চাও ফরু? দেখ, চ্যাতাইস না কোলম। বিয়া হরছ ভালো কতা, মোরে পায়ে ঠেলতে পারবি না।
নির্জন বিকেলে মনমরা ফরহাদের আর নিস্তার হয় না। পাড়া বেড়াতে গেছে এ বাড়ির সব মানুষ। মিলির চোখে জ্বলে ওঠে এক বিভৎস মশাল। জানালা দিয়ে গোঁ গোঁ করে প্রবেশ করে আউলা বাতাস। ভেতর থেকে গর্জে ওঠে আর্তনাদ। যেন কেঁপে উঠল পাথরের কলিজা। প্রতিহিংসার কামের ক্রোধে পুড়ে পুড়ে দগ্ধকালো হয় মিলির পুরো শরীর। মিলি ফরহাদকে আয়ত্ব করে প্রতিহিংসার ক্রোধে জল ঢালে। তখন বারান্দা পেরিয়ে ঘরে ঢুকলো ছোট বোন হাসি। বড়বোন আর ফরহাদের কীর্তি দেখে সাদা কাগজের মতো হয়ে যায় তার মুখ। ফরহাদ শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে হাসির দিকে। অসংলগ্ন অবস্থা থেকে উঠে হাসিকে সামাল দেওয়ার চেষ্টা করে মিলি।
কয়েকদিন বাদে আষাঢ়ের এক বৃষ্টির রাত। সারা দিনে সূর্যের টিকিপাত্তাটুকু ছিল না। ডোবা নালা, পুকুর সব বৃষ্টির জলে ডুবে টইটুম্বুর। সন্ধ্যায় কিছুটা বিশ্রাম নিতে চুপ হয়ে গেছে অবিরাম বর্ষণ। মান কচুর ডালের ওপর ঢালের মতো পাতা মাথায় দিয়ে একটা খবর দিতে এল পাশের বাড়ির মোজাল। গত কদিন ধরে তার কালো গাইটা খুঁড়া রোগে ধাওয়াচ্ছে। বোবা ধনের না বলা কষ্টটা অনুভব করে বর্ষা বাদলা উপেক্ষা করে শহরে গিয়েছিল পশু হাসপাতালে পরামর্শের জন্য। ফেরার পথে দেখা হয় মিলির মেঝোবোন লিলির সঙ্গে। শহরের ভেতর দিয়ে যে সরু খালটা বয়ে গেছে তার পাশেই একটা দালানে থাকে বরের সঙ্গে। লিলি রাস্তার ধারে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল খালের দিকে। তখন দেখা হয় বাপের দেশি মোজালের সঙ্গে। লিলির হাত পায়ে মারের দাগ, চুলগুলো এলোমেলো, গালে শুকিয়ে আছে কান্নার জল। এ অবস্থা দেখে মোজালের মনও ভারী হয়ে ওঠে। কিন্তু বলার মতো কিছু থাকে না।
বড়বোন মিলির থেকে লিলি দেখতে বেশ। হিলহিলে লম্বা, বড়বড় চোখ, কপাল পর্যন্ত ঘনো কালো চুল, চোখে মুখে পল্লীবালিকার সারল্য। ব্যবসায়ী ছেলেটি বেহাত না হয়ে যায়, বাধ্য হয়েই লিলিকে পাত্রস্থ করা হয়েছিল। কিন্তু মেয়েটি স্বামীর সুখ আহ্লাদ কিছুই পায়নি। বিয়ের পর আরও মিষ্টি হয়ে উঠলো লিলি। চলন-বলনে ধীর স্থির, শ্বশুর বাড়ির নিয়ম কানুন অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলত। তবুও যৌতুকের দাবিতে কটাক্ষ করে শাশুড়ি। মফস্বল শহরটির সব সুন্দরী যুবতীর দেখে দুর্বিনীত হাসি হাসে। সকাল থেকে রাত অবধি কোথায় থাকে কোথায় যায় ইয়ত্তা নেই। রাত হলেই বাড়ি এসে অহেতুক চ্যাঁচায়। পাড়ার লোকেরা কিছুদিন বড় গোলামালের আশঙ্কায় ব্যাপারটিতে মানা করলো। তারপর লিলিকে নিয়ে শুরু করলো আলাদা বাসায় বসবাস। খালের পাড়ে নির্জন বাসাটিতে লিলি একা একা থাকে সারাদিন। ব্যবসার নাম করে বর বের হয় ঘোর কেটে যাওয়া ঘুম থেকে উঠে। প্রতিরাতে মদ খেয়ে বাসায় ফেরে। রাত গভীর হলেই ধুপধাপ শুরু হয় লিলির ওপর চড়, কিল, থাপ্পড়। নেশার ঘোরে লোকটা খুব বাজে বকে। দালানের দেয়াল ভেদ করে এই অত্যাচার কিছুটা প্রতিবেশীর কানে যায় কিন্তু অত্যাচারের জন্য ফুঁফিয়ে কেঁদে যে অসহায়ত্ব বোধ করে, ঈশ্বর ছাড়া তার খবর আর কেউ রাখে না।
ঘটনা শুনেই ফরহাদ রওয়ানা দিল শহরে। লিলির মুখের করুণ চিত্রটি যেন চোখের সামনে দেখতে পায় সে। হৃদয়ের কোথাও গিয়ে আঘাতটা জোরেসোরে লাগলো, শুধু এটুকু টের পেলো মেয়েটা কষ্টে না জানি কত কেঁদেছে। বর একটা গোঁয়ার, কোন সুখের আশায় এমন বিয়ে হয়েছিল লিলির কে জানে! অথচ, ফরহাদ কত মায়া করত লিলিকে।
তখন মেঘ মেদুর সন্ধ্যা। বৃষ্টি ধোয়া কালো পিচের রাস্তাটা ফাঁকা। কোথাও মানুষজনের চিহ্নমাত্র নেই। চোখের সামনে দিয়ে একটা ট্রাক সাঁ সাঁ করে চলে গেল। পিটপিটে আলো নিয়ে ধুঁকতে ধুঁকতে এলো একটা লোকাল বাস। ফরহাদ ওই বাসটিতেই চড়লো। শহরে গিয়ে খালপাড়ের সেই বাসাটিতে পৌঁছতে রাতের আঁধার বেশ গাঢ় হয়েছে। কিছুটা ইতস্তত ফরহাদ। রাত বিরাতে তার অহেতুক আগমন লিলির বর কিভাবে নেয়, কে জানে! কিন্তু উপায় কী! মার খেয়ে মেয়েটা না জানি কত জোরে জোরে কেঁদেছে। পাশ ফিরে খুঁজেছে পরম আপনজনদের। কিন্তু চার দেয়ালের সঙ্গে ধক্কা খেয়ে কান্নার শব্দ নিজের কাছে ফিরে এসেছে দ্বিগুণ বেদনা নিয়ে। চারপাশে আপনজন কাউকে পায়নি সে।
তখন আবার ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়েছে। দালানের পাশে ছোট্ট টিনের চালার ওপর শনশন শব্দে বৃষ্টির ভারী ফোঁটাগুলো পড়ে দালানের অন্ধকার বারান্দায় নিস্তব্ধতা সৃষ্টি করেছে। ফরহাদ দরজার সামনে অনেক্ষণ অপেক্ষা করে জানালার ফাঁক দিয়ে ভেতরে চুপি মেরে দেখে ভেতরটা ভুতুরে অন্ধকার, মানুষজনের আলাপ নেই। আরেকটু অপেক্ষা করে সাহস করে দরজায় টোকা দিলো। বারকয়েক টোকার পর ভেতর থেকে আওয়াজ এলো। ম্যাড়ম্যাড়া কণ্ঠে লিলি বলছে—কে।
ঘরটা নির্জন, আলোহীন আর রহস্যময় আঁধারে আচ্ছন্ন। লিলি ছাড়া আর কেউ নেই। দুপুরে বেদম মার মেরে বরটা কোথায় গিয়েছে লিলি তা জানে না। হয়তো বর্ষণমুখর ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় শরীরটাকে উষ্ণ করার জন্য কোথাও বসে তরল গিলছে। অথবা লঞ্চঘাটের রেণ্ডিপাড়ায় পেশাদার যুবতীকে উসকাচ্ছে। সরু মোমের আলোটা ধরে দরজা খুলে দাঁড়িয়ে আছে লিলি। ফরহাদকে দেখে হাউমাউ করে কেঁদে জামাটা খামচে ধরে টেনে আনলো নিজের কাছে। ভয়ে গোল গোল হয়ে উঠলো ফরহাদের চোখ। মোমের কাঠিটা ছিটকে পড়ে গেলো মেঝের ওপর। মোমের তরল মেঝেতে ছড়িয়ে আলোটা উসকে গেল মুহূর্তে। ফরহাদ চেয়ে দেখলো, লিলির ফরসা সুন্দর মুখে কালো কালো দাগ। গালদুটো ফোলা, নিচের ঠোঁটে রক্ত জমাট বেঁধে কালচে হয়ে আছে। লালচে আলোয় মুখের ওপর হাত বুলিয়ে ফরহাদ লিলির মাথাটা চেপে ধরলো বুকের সঙ্গে। লিলিও চুপচাপ। তবে তার পাদুটো ধীরে ধীরে পিছলে এলো, তারপর গোটা শরীরটা ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলো। দুহাত ছড়িয়ে ফরহাদ মুখ থুবড়ে পড়ে গেলো মেঝের ওপর। প্রচণ্ড চোট লাগলো মাথায়। ফরহাদ মায়ার দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো লিলিরি দিকে। লিলি তার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলো বসার ঘর থেকে নিজের ঘরে। আঁচল দিয়ে ব্যথার জায়গাটা মুছে দিলো। ফরহাদ মাথাটা কাৎ করে এলিয়ে পড়লো লিলির দলানো মেচড়ানো চাদরের বিছানার ওপর। তখন খোলা জানালায় খেলা করছিল বাতাস আর মিহি গুঁড়োর মতো বৃষ্টির জল। ফরহাদের মায়াটা আঁধার ঘরে তখন অগ্নিশিখার মতো জ্বলে উঠলো। কিছুটা ধস্তাধস্তিও হলো লিলির সঙ্গে। লিলি ফুফিয়ে কেঁদে ওঠে এবং মুহূর্তে তার হাতপা নিশ্চল হয়ে যায়। পাশের ঘরের টিনের ছাউনির বৃষ্টির ঝুমঝুমানি লিলি আর ফরহাদের সেই রাত্রির সমস্ত সুখ-দুঃখ জড়ানো শব্দ আড়াল করে দিলো। তখন নিথর হয়ে আছে বাইরের ওই আঁধার পৃথিবীটা। পরিপূর্ণ নীরবতার মধ্যে শুধু শোনা গেলো দেয়ালে ঝোলানো ঘড়িটার চাপা শব্দের টিকটিক আর দুজনার শ্বাসপ্রশ্বাস।
এরপর লিলির সঙ্গে কয়েকদফা দেখা হয়েছে ফরহাদের। বরের অত্যাচারে থিতু হওয়া মনটাকে একটু আবেগ দিতে বাহানা করে বারকয়েক ডেকেছিল তাকে। ফরহাদ মনে মনে প্রশ্রয়টুকু প্রত্যাশা করেছিল। কেননা, লিলির প্রতি তার আশৈশব একটা টান আছে। সকালসন্ধ্যা তার মার খাওয়া ক্ষত মুখটা চোখে ভাসলে মায়ায় পড়ে যায় মন। কিন্তু ওই মায়া কাটাতে গিয়ে বাঁধা পড়ে যায় লিলির শরীরের খাঁচায়। কিন্তু এ অবস্থা বেশি দিন টেকেনি। লিলির বরের এক ভোরে সুমতি ফেরে। সমবয়সী এক বন্ধুর সঙ্গে দ্বীনের পথে বের হয়। চল্লিশ দিন পর বাড়ি ফিরে তার অবস্থার পরিবর্তন হতে থাকে ধীরে ধীরে। আর সেই সঙ্গে ফরহাদ অচেনা আর অপরিচিত হতে থাকে লিলির কাছে।
হেমন্তের এক ঘোর কৃষ্ণরাতে ফরহাদ বের হয়েছিল উঠানে। গোয়ালে গোরুগুলো কিভাবে আছে দেখার জন্য। এই গ্রামে মাসখানেক ধরে চোরের বড় উৎপাত। কুপির আলোটা উঁচু করে উঠানে টের পায় দু’টি মানুষের অস্তিত্ব। সুপারি বাগানের আড়ালে কেমন চোরের মতো গা ঢাকা দিচ্ছে লোকদুটো। ফরহাদ চোর ভেবে ভয়ে ভয়ে কাছে যায়। তখন কুপির কাঁপা কাঁপা আলো কিছুটা এদিক-ওদিক ছড়িয়ে পড়ছিল সামনে। সেই আলোয় মধ্যরাতের ভিজে যাওয়া পেয়ারা পাতা লাল হয়ে উঠলো। কেমন গা ছমছম করা একটা বাতাস চলে যাচ্ছিল পাশ দিয়ে। তবু সাহস করেই ফরহাদ আরেকটু সামনে এগোয়। কিন্তু চোখের সামনে যা দেখলো তা অবিশ্বাস্য। মিলি একজন পুরুষের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। অন্ধকারের মধ্যেও ঝলক দিচ্ছে লোকটির মোটা শরীরের নীল জামাটা। কুপির আলোটা সামনের দিকে আরেকটু বাড়িয়ে দেখা গেলো লোকটির পিটপিটে চোখ। এ যে মিলির ছোটবোন লিলির দ্বীনের পথে গিয়ে দিনে দিনে ভালো হয়ে ওঠা বর। মিলি ঠোঁটদুটো গোল করে কুপির ওপর ফুঁ দিলো। দপ করে নিভে গেলো কুপিটা। চিকন ধোঁয়াগুলো অন্ধকারে ছড়িয়ে যেতে থাকে আশেপাশের ঝোপঝাড়ে।
সে রাতে ফরহাদের আর ঘুম আসে না। সে শুধু ভাবতেই থাকে, ভাবতেই থাকে। সকাল অবধি অতীত জীবনের সব অনিষ্টগুলো তাকে জাপটে ধরে। প্রভাত হলে এ বাড়ি থেকে নিরুদ্দেশ হয় একজন। কিন্তু বুড়ো দাদুর হাত ধরে এ বাড়িতে আসে আরেকজন নতুন মানুষ। বুড়োদাদু বললো, বেমালা দিন পোত চাইয়া রইচে পোড়ামুহী। আইজ বেয়ানে কইলো, ল দাদু ও বাড়ি যাই।
ফরহাদ দেখলো, নরম নরম জলভরা দুটি ভীরু চোখ। মুখে কি সুন্দর কোমলতা। চেহারায় জৌলুস নেই কিন্তু এক পবিত্র প্রতিচ্ছবি মুখে ঝলক দিচ্ছে। কী বিরহ, কী মায়া বিরাজ করছে ধুঁকপুক করা মেয়েটির বুকে। খসখস করছে কাপড়, ঘোমটার আড়াল থেকে বের হয়ে আসছে কয়েকগাছি চুল, মাথাটা নিচু করে আছে দারুণ লজ্জায়। ফরহাদের একহাতের ওপর আরেকটি নরম হাত তুলে দিলো বুড়ো। পোষা পাখিকে আদরের মতো মেয়েটির পিঠের ওপর হাত রাখে ফরহাদ। ওই নিষ্পাপ মুখের দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে ভুলে থাকা যায় জীবনের সমস্ত গ্লানি, সব পরাজয়। তার সমস্ত ক্ষোভ, একাকিত্বের মানসিক যন্ত্রণা লোমকূপের গোড়া দিয়ে বের হয়ে যায়। তারপর সেই হেমন্তের বিকেলে ফরহাদ সমস্ত চেতনার যন্ত্রণা মাটিতে পুঁতে নববধূকে নিয়ে কোথায় যেন অদৃশ্য হয়ে গেলো, এই গ্রামের কেউ তা জানে না।