বুলা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। টেবিলের পাশে সাজিয়ে রাখা বোতল থেকে আরও একগ্লাস দিলাম ওকে। গলায় ঢাললো একটু। বুক জ্বলে যাচ্ছে আম্মা—এইটুকু বলেই রেখে দিলো বাকিটা।
—খা।
—এত! আম্মা বাঁচুম না।
আমার দৃষ্টি এতদিনে চিনেছ ও। বাধ্য হলো। বুলার চোখ ক্রমেই লাল হয়ে উঠতে শুরু করেছে, টলছেও একটু। পড়ে যাবে না তো? আমার ভরসা হয় না। তাকে ধরে টেনে তুলি। উঠে বসাই। টলছে, টলুক, যেন-তেন রোগ নয়। প্যানডামিক সিম্পটম।
বুলা গতকাল একবার বলেছিল বাড়ি যাবে, আমার চিৎকারে ঢাকা পড়ে গেলো সব । এই ফ্ল্যাট থেকে টু শব্দও যায় না ওপাশে। তবু আমার বাড়তি সতর্কতায় কোণার এই ঘরটাকেই বেছে নিয়েছি থাকার জন্য। একবার ভেবেছি—যাক চলে যাক। পরক্ষণেই মনে হয়েছে—এই যে আমার এত রাত জাগা, কাচের গ্লাসের এলোমেলো ভাঙা টুকরো, অ্যাস্ট্রেতে জমিয়ে রাখা ছাই—এগুলো সরিয়ে রাখার জন্যও একটা মানুষ লাগে। পুরুষে আমার ঘেন্না ধরে গেছে সেই কবে। তবু রাত হলে ম্যাজমেজে শরীরটার জন্যে হলেও একটা মানুষ লাগে। হোক সে কানা খোড়া, মেয়ে বা বুড়ো; তেলচিটচিটে ফকিরের বাচ্চা হলেও চলে।
আচ্ছা বুলা কি সুস্থ হবে? অবশ্যই। কেন না? অ্যালকোহলে সারে এসব, ড্রাগেটিক আরও কী কী ওষুধ দিলাম তো দুপুরে। রাতে যদি কাঁদে? কেন কাঁদবে। কার জন্য কাঁদবে? এই যে ছমাস ধরে পড়ে আছে এ বাসায়, একবারও কি কেউ এসেছে দেখতে? অবশ্য আমিই বলেছিলাম, একা থাকতে পছন্দ করি। আসলেই কি তাই! হয়তো। কেন জানি ডিভোর্সের পর থেকে লোকজন একদম সহ্যই হয় না আমার। অথচ এরকম ছিলাম না। একটু মানুষসঙ্গের আশায় একসময় দিনের পর দিন, রাতের পর রাত পড়ে থেকেছি বন্ধুর বাসায়, এখানে-ওখানে ক্লাবঘরে, নাইট বারে। যাই হোক। সময় পাল্টেছে। এখন সব চলছে একভাবে। রোবটিক জীবন মন্দ লাগছে না। জীবনের প্রয়োজন এখন আমার কাছে খুব বেশি কিছু না। কিছু নামি-দামি ব্র্যান্ড, ফরাসি বা স্পেনিশ। হঠাৎ হঠাৎ স্লিপিং পিল। মামুনকে উটকো কিছু গালিগালাজ আর যা কিছু লাগে, মেয়টা আছে বলেই চলছে। প্রথম দিন ওকে যখন অন্তর্বাসের নিচের কিছু চেনাতে হলো, সেদিনও ওর চোখ এমন জবার মতো ছিল, কেমন বিস্ময় চোখে। কী ভেবেছিল সে? তার চিবুকে প্রথম ঠোঁট ছোঁয়াবে কোন ঘোড়ামুখো ব্যাটাছেলে? বোকা মেয়ে!
—আম্মা পানি। আবার চোখ খুলেছে। আমি বিরক্ত হই। আমাকে কেন সে আম্মা বলে, হোয়াই? হাউ স্টুপিড! মেয়েটাকে এত বলি! আমি গ্লাসে করে আরও একপেগ শ্যাম্পেইন এগিয়ে দেই, এমন করে গিলে যেন রেটল স্নেক ওয়াইন, মূর্খ কোথাকার! ওর জড়োসড়ো হয়ে পড়ে থাকা জুবুথুবু ব্যাপারটায় কেমন জম্বি জম্বি ভাব। আমার বিছানার পাশেই ওর তেলচিটে বালিশ। বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছে। এটা ছাড়া নাকি ঘুম হয় না। যাক ঘুমোক। আমি কাবার্ড খুঁজে কফিবার খুঁজতে থাকি। কিছু নেই কোথাও। রাত যত বাড়ে, ততই এমন হয়। কোথাও কিছু খুঁজে পাওয়া যায় না। আমার বিরক্তির কাটা দ্রুত ঊর্ধ্বগতিতে ছুটছে। ইদানীং প্রায়ই চিন্তায় আসে আঠারো তলার ওপর থেকে হঠাৎ লাফ দিলে কেমন হয়! মাথা থেঁতলে গেলে কেমন লাগবে দেখতে? একবার রাস্তায় একটা কুকুরের মাথা দেখেছিলাম অমন, কী যে কুৎসিত! আমি বেসিনের কল ছেড়ে কলকল শব্দ শুনি, মাথা থেকে কুকুর তাড়াই। সাড়ে চারমাস গৃহবন্দি ভাবা যায়!
আমি ড্রয়ার খুলে ফার্স্ট এইড খুঁজি। কাকে ফোন দেবো এখন। এসব প্যাশেন্ট কি ভর্তি নেবে সঙ্গে সঙ্গে? কতকিছু হচ্ছে চারপাশে। ধুর ভাল্লাগে না হাঙ্গামা।
ইন্দোনেশিয়ান প্রজেক্ট ডেভেলপমেন্টের টাকাটা একসঙ্গে হাতে না পেলে এইসব ফালতু লকডাউনে আমার মতো ইন্ট্রোভার্ট মানুষের কী অবস্থা হতো! ভাগ্যিস অ্যালকোহল আমার মগজ খেয়ে বসেনি এখনো। টুকটাক করে-টরে খাওয়া না হয় অসম্ভবই হতো। হাতের সিগারেট নিভে গেছে। সিগারেটের ওপরও নাকি কাদের শকুনি দৃষ্টি পড়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় খুব হাউকাউ চলছে কদিন দেখেছি। হাউ ফাকিং এটেনশন সিকিং সোশ্যাল ক্যাওয়াস!
আচ্ছা বুলা যদি এবার বাড়ি গেলে আর না আসে? উঁহু আসবে। ড্যাম শিওর! ইশ, না এলে কী যে বিপদ! দুদিন পর পর এজেন্সি ধরে হাউজ মেইড খোঁজা সো ডিসটার্বিং। এর চেয়ে ভালো হবে একেবারেই যেতে না দিলে। নো ওয়ে টু গো। ধুর এসব কী ভাবছি। কোথায় কবে ঠিক হবে সব, তার পর না বাড়ি। যাই বুলার পাশে গিয়ে বসি। জ্বর বেড়েছে ওর। ঘরে কোথাও থার্মোমিটার আছে হয়তো। বুলা আমার হাত টেনে বুকের কাছে নেয়। ওর আচরণ আমার নিকির মতো। আদর পেলে নেতিয়ে যায়। আমি আমার আরেকটা হাত রাখি বুলার মাথায়! কুঁচকে যায় ও। আমি ডাকতে শুরু করি
—বুলা বুলা। আপেল খাবি?
নো সাউন্ড, আমি নিজেই খাই। ছোটবেলায় যখন জ্বর হতো আমি একা একা কামড়ে কামড়ে আপেল খেতাম। কী যে বিস্বাদ সেসব। কখন যে এত ক্ষুধা লেগেছে বুঝিনি। এই বিল্ডিংয়ের কেয়ারটেকার আমার মাসকাবারি বাজার করে দেয়। বুলাকে বাইরে যেতে দেইনি একদম। তবু কেমন করে কী হলো বুঝতে পারছি না। আচ্ছা মেয়েটা কি প্রেগন্যান্ট! এটুকু বয়সে? হা হা হা কী ভাবছি এসব। মেয়েতে মেয়েতে বাচ্চা! হাউ অ্যাবসার্ড! বুলা ঘুমের ঘোরে কাঁপছে। ফুলে ফুলে উঠছে পিঠ। আমার কম্বলটা কি দেব ওর গায়ে? না থাক বুলার গায়ের বিশ্রী গন্ধ প্রায়ই নাকে এসে লাগে। তেল দেয় মাথায় কী যেন নাম! আমি এসির পয়েন্ট কমিয়ে দেই।
আচ্ছা মামুনের দেশে এখন সকাল না দুপুর। উফ এইসময় আবার মামুন কেন। ফ্রড একটা। আমার মুখে থুতু জমে। সাড়ে আট বছর সংসার করেও ঘূন্নাক্ষরেও টের পাইনি হারামজাদা আমার জমানো সব টাকাপয়সা নিয়ে ভেগে যাবে। আলাস্কায় গিয়ে রোদ পোহাবে ওই ঘোড়ামুখীর সঙ্গে। আসলে ছোটলোকের ঘরের ছেলে চোর ছ্যাঁচড় তো হবেই। ফাকিং লোয়ার ক্লাস, আমি গালি দেই ইচ্ছেমতো ‘অ্যা সান অব অ্যা বিচ, অ্যা বিট্রায়ার’ আপেলটা ছোটবেলার মতোই বিশ্রি লাগতে শুরু করে আবার।
—আম্মা আম্মা। বুলা আবার সেই কুৎসিত সম্বোধনে কাতরাচ্ছে।
—পানি খাবি?
—না আম্মা। খামু না, বমি করমু। কিছু ভাবার আগেই বুলা উগড়ে দেয় সব। আমার ভেতরটা সিঁটিয়ে যায় ঘেন্নায়।
—বুলা এসব কী?
—আমি মইরা যাইতাছিগা আম্মা। আমার বাপেরে খবর দ্যান। আমার কোলের ওপর ধপ করে পড়ে যায় ও।
—কী সব ন্যুইনসেন্স কথাবার্তা! তুই মরবি কেন? ওষুধ দিচ্ছি। ঘরে প্যারাসিটামল আছে। জ্বর সারবে।
—সারবে না আম্মা। আমি মইরা যামু। এই রোগে মানুষ বাঁচে না।
—ধুর কী সব বলিস, পেইন হচ্ছে? পেইন কিলার দেব?
—আম্মা আফনে আমারে বাড়ি নিয়া যান। আমি মইরা যামু।
আমি বুলাকে কোল থেকে সরিয়ে দেই। রাগ লাগছে। বুলাকে কি সত্যি পাঠিয়ে দেবো বাসায়। এত রাতে? ওই তো কেমন নিঃসাড় হয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ কেমন যেন লাগে আমার। ওর আম্মা ডাকে এত রাগ না হলেও তো হয়। মামুনকে একবার বলেছিলাম বেবি এক্সেপ্টিংয়ের কথা। বিয়ের প্রথম প্রথম। ও আমলে নেয়নি। আমার মুখে আবার থুতু জমে। আমি ড্রয়ার খুলে ফার্স্ট এইড খুঁজি। কাকে ফোন দেবো এখন। এসব প্যাশেন্ট কি ভর্তি নেবে সঙ্গে সঙ্গে? কতকিছু হচ্ছে চারপাশে। ধুর ভাল্লাগে না হাঙ্গামা।
কটা হট শাওয়ার নেই। শ্যাম্পু করি। নেশার ঘোর কেটে গেছে। ক্ষুধা লেগেছে। ফ্রিজ খুলি। বাসি পিৎজা আছে। কতদিন আগের কে জানে, খাই একটু।
কয়েকজন ডক্টরের পেসক্রাইব করা সাজেশান রেখেছিলাম স্ক্রিনশট। ওষুধও কিছু কিনিয়ে এনে রেখেছি। আমার জন্য নয়। বুলার জন্যই। আমি জানি আমার কিছু হবে না। ডক্টর ফস্টাস নাকি শয়তানের কাছে আত্মা বিক্রি করেছিল আর আমি করেছি শরীর, আমার তো কিছু হওয়ার কথা না। পেসক্রিপশন থেকে মিলিয়ে কয়েকটা নেই। বুলার জ্বর বাড়ছে। হাঁ হয়ে আছে মুখ। ওর কি শ্বাসকষ্ট হচ্ছে? কী জানি! আমি ওকে ঝাঁকিয়ে তুলি। চোখ খোলে না। আশ্চর্য! আমি ঠেলে ঠুলে চোখ খোলাই, হাঁ করা মুখে কয়েকটা ওষুধ পুরে দেই। অদ্ভুত বুলা চিবিয়ে চিবিয়ে খায় দ্রুত, যেন আমার হাত থেকে মুক্তি পেলেই আপাতত ওর শান্তি।
আমি ওর ঘুম ঘুম মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। আমার যখন ওর মতো বয়স, তখন রাতের বেলা হরর মুভি দেখে ভয় পেতাম। আম্মুর দরজার পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদতাম। যতই নক করতাম, আম্মু ততই বিরক্ত হতো। কেমন যে লাগতো! মনে হতো কোনো একদিন ঘুমের ঘোরে ডাইনি আম্মুর গলা চেপে ধরবো আমি। ও কি বুলার চোখ-মুখ এমন হয়ে যাচ্ছে কেন? আমার বুকের ভেতরে ধুকপুক শব্দ হয়। বুলা যদি উঠে বসে এখন কি ভয় পাবো? আমি ঘেমে যাই খুব। বুলাকে রেখে সরে আসি।
ওর সারা গায়ের লেপ্টে থাকা পচা অ্যালকোহলের গন্ধ এতক্ষণে আমার নাকে লাগেনি। এবার লাগছে। বমি পায় আমারও। ড্রেসিং টেবিলটায় রুম স্প্রে রাখি সবসময়। তড়িঘড়িতে ওটাও খুঁজে পাই না। সেন্টার টেবিলে কী একটা পারফিউম পড়ে আছে কাত হয়ে। পুরো ঘরে ছিটিয়ে দেই ওটাই। বাহ দারুণ তো। কি ফুলের স্মেল? কামিনী না জেসমিন? আর চোখে বুলাকে দেখি। আধখোলা চোখ পিট পিট করছে, জিভ বের হয়ে যাচ্ছে কুকুরের মত। ছিঃ কী জঘন্য! আমি ফ্রিজ থেকে বরফ কুচি নামাই। চানাচুর বয়ামে পড়ে আছে এখনো কিছু। গ্লাসে দুতিন পেগ ঢেলে দ্রুত চালান করে দেই পেটে। আজ এমনিতেই একটু বেশি হয়ে গেলো। সন্ধ্যার পর থেকে আমরা দুজনেই কিছু খাইনি। বুলার জ্বর, কাশি, শরীর ব্যথা। কিছুই বানায়নি। না রুটি না স্ন্যাংকস। গতকাল রেঁধেছিল লতি দিয়ে চিংড়ি। কেন যে রাঁধে এগুলো। লতা-পাতা, পোকা-মাকড় কে খায়? আম্মুকে কখনোই আমি রাঁধতে দেখিনি এসব। অফিস অফিস করেই মহিলা একটা জীবন কাটিয়ে কবরে আরামসে ঘুমোচ্ছে এখন। ডিমের ওমলেট আর মামলেটের স্বাদ নিতে নিতে জানিই না পৃথিবীতে কত রঙের খাবার আছে। আচ্ছা আম্মুর ডিভোর্সের প্রভাব কি আমার জীবনে পড়েছে? হাহ্! কী সব মিডল ক্লাস থিংকিং!
বুলা হাঁপাচ্ছে খুব। আমি এগিয়ে যাই। রাত প্রায় শেষের দিকে। কেমন জানি গা ছমছম করা সময়। নেশার ঘোরও হতে পারে। আমি তৃতীয় বারের মতো জিজ্ঞেস করি—বুলা, বুলা। পানি খাবি?
—আম্মা। আম্মাগো আমার বাপে আরেকটা বিয়া করছে আম্মা। বুলা হড়হড় করে আরও কী যেন বলতে চায়, বমির তোড়ে বলতে পারে না। নেতিয়ে পড়ে আমার কোলে। কেমন পীত আর সাদায় মেশানো ফেনা ফেনা পানি। এমন কেন? ওষুধের প্রভাব? আমার গা গুলিয়ে ওঠে। ঢুলতে ঢুলতে বাথরুমে পৌঁছাই। গিজার ছাড়ি। একটা হট শাওয়ার নেই। শ্যাম্পু করি। নেশার ঘোর কেটে গেছে। ক্ষুধা লেগেছে। ফ্রিজ খুলি। বাসি পিৎজা আছে। কতদিন আগের কে জানে, খাই একটু। এসিড হতে পারে, হোক। শোবার ঘরে ঢুকতে ইচ্ছে করে না। বুলা কার্পেটের ওপর চিৎ হয়ে পড়ে আছে। গেলেই হয়তো হাত-পা জড়িয়ে ডাকতে শুরু করবে—আম্মা আম্মা!
বেশির ভাগ সময়ই বুলাকে আমার কুৎসিত লাগে। এখনো লাগছে। নিতান্তই নিরুপায় না হলে ওকে আমি কাছে টানি না। আম্মু আমাদের বেছে বেছে যে খেলনাগুলো কিনে দিতো, সেগুলো সবসময় খুব সুন্দর হতো। এমনকি কোলে নিয়ে রাখার জন্য যেসব জীবন্ত বেড়াল বা ডগি এনে দিতো, সেগুলোর গাও থাকতো নরম তুলতুলে। অথচ মেইডগুলো সব এমন কেন? এসব বললে মামুন আমাকে বলতো, ‘ন্যাকা’। রেগে রেগে বলতো, ‘যাও গিয়ে দেখো এসো বাইরের ন্যাড়ি কুত্তা। ঠিকঠাক খেতে পরতে না পারলে সবই চর্মসার! কী কুত্তাবিলাই কী মানুষ!’ আচ্ছা বুলার ওপর আমার এইসব টর্চারগুলো কি মামুনের ওপর প্রতিশোধ? হতে পারে। ওহ শিট, আবার সেই ফাকিং মামুন!
টেবিলে অনেকগুলো ঘুমের ওষুধ ছিটকে আছে। আমি গোছাই সব। যত্ন করে গুনে দেখি ছাপ্পান্নটা।
আমি দীর্ঘসময় বুলার একটানা ‘আম্মা আম্মা’ ডাক উপেক্ষা করার ধৈর্যে উত্তীর্ণ হই। আর একবার ডাকলেই টুয়েন্টি মিলিগ্রাম ফ্রিজিয়াম পুরো কৌটা খাবো। আমি ভাবতে শুরু করি কোনো সুন্দর সময়। শেষ কবে আম্মুর সঙ্গে বেড়াতে গিয়েছিলাম, মহিলা সমিতিতে নাটক দেখেছিলাম! কবে? আচ্ছা আম্মু কেন ওভাবে মরে গেলো? ওটা কি সত্যি স্ট্রোক না মার্ডার ছিল। আম্মু খুব ঘুমের ওষুধ খেতো, সুইসাইড না তো! আম্মুর সবকিছুই কেন আমার করে দেখতে ইচ্ছে করে। কেন? আমি আর ভাবতে পারি না। কেন যেন আমার ভাবনা রোজ এই পর্যন্ত এসে থেমে যায়। কেন থেমে যায়? থাক আর ভাববো না। আমি ঘরে যাই। মেঝের ঠিক মাঝখানে বুলা এখনো পড়ে আছে। লাল কার্পেটে লাল ফুল। আমি কি ভেবেছিলাম, থাকবে না, হাওয়ায় উড়ে যাবে বুলা? আমি ওর গায়ে হাত দেই। জ্বর নেই। ঘামও নেই। আশ্চর্য শীতল শরীর। অদ্ভুত! ওর হাঁ করা মুখটা বন্ধ করার চেষ্টা করি। হচ্ছে না। না হোক।
বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াই। আকাশ ঘোলাটে হয়ে আছে। একটু পর লাল হবে। আমি আঁতিপাতি করে খুঁজে বের করি নেসক্যাফের প্যাকেট। কফি মেকারটা নষ্ট কি না, কে জানে। একমগ কফি বানাতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়। ধোঁয়া ওঠা কফির মগ হাতে আবার আকাশ দেখি। কী সুন্দর! ভোরের এই সময়টার নাম কী? মামুন জানতে পারে। ওর স্টকে বেশ ভালো ভালো বাংলা শব্দ ছিল, সৌপ্তিক, অহরাত্র, চণ্ডালিনী—এইসব! অথচ এখন ঘুরে ঘুরে মরছে এক ঘোড়ামুখো বিদেশিনীর পেছনে!
ইনটারকম বাজছে। এত সকালে কে খুঁজবে আমায়। কেয়ার টেকার? ওকে কি বলবো বুলার কথা? না থাক মেয়েটা ঘুমোক।
—হ্যালো।
—আফা। এই শহরের কুত্তাগরে লকডাউনে খাওন দেওয়ার জন্য যে ব্যাডারে ঠিক করছেন, হেই ব্যাডা টেকা চাইতে আসছে বাজারে যাইবো।
—আমি বিকাশ দিচ্ছি রশীদ।
—আইচ্ছা, আফা আফনের মতো ভালা মানুষ দুনিয়ায় নাই। আইজকাইল মাইনষে মাইনষেরে দেহে না। আর আফনে দেহেন কুত্তাবিলাই!
—কেন অপ্রয়োজনে কথা বলছ?
—আর কমু না। কুত্তারে কি মাংস দিমু আফা?
—দাও। শোনো, কিছুদিন আর ফোন দেবে না, বাজারও লাগবে না। তোমাকে আরও কিছু পেমেন্ট দিয়ে রাখছি। কেউ যেন আমাকে ডিসটার্ব না করে। দেখবে।
আমি খট করে ফোন রাখি। রশীদকে আর কিছু বলার সুযোগ দেওয়া উচিত না। এই লোকটা হুটহাট ফোন দিয়ে অজস্র কথা বলে। সামনা-সামনি দেখা হলে কেমন করে যেন তাকায়। আচ্ছা বুলা কি কিছু বলেছে ওকে আমার সম্পর্কে? বলুক। আমি জানি রশীদ বাড়তি টাকা পেলেই চুপ। ওরাও কেমন জানি আমার নিকির মতো। পাতে কিছু পেলেই লেজ নাড়ে। ওহ, বুলা আসার আগে আমার একটা কুকুর ছিল—নিকি। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস আমি আর নিকি। নিকি আর আমি। তারপর! নাহ তার আর পর নাই। আমি ঘরের দিকে আগাই। সূর্য উঠে গেছে। বুলার গা বরফ শীতল। ঘুমুচ্ছে নাকি মরে গেছে, জানি না। আমি কিচেন খুঁজে দেখি ড্রাইফুডের স্তূপ। বুলা পুরো মাসের বিসকিট কেক পেস্টি স্টোরেজ করে রেখেছে। আপদকালীন সতর্কতা।
আচ্ছা একটা লাশ পচে গলে নষ্ট হতে কত দিন লাগে? জানি না, বুলা জানতে পারে। আমি উৎফুল্ল হয়ে উঠি নতুন কিছু নিয়ে চিন্তা করার পুঁজি পেয়ে। কিচেন রেখে শোবার ঘরে আসি। টেবিলে অনেকগুলো ঘুমের ওষুধ ছিটকে আছে। আমি গোছাই সব। যত্ন করে গুনে দেখি ছাপ্পান্নটা।
ঘরের জানালা গলে রোদ পড়ছে। বুলার গায়ে পড়েছে কিছু। আমার বেশ আরাম লাগে। বুলার পাশেই শুয়ে পড়ি। আহ কী সুন্দর করেই না মেয়েটা ঘুমোচ্ছে একা!