ভাঙা সাইকেল লাফিয়ে লাফিয়ে চলেছে। মাটির রাস্তায় বড় বড় খাদ, গর্ত। শীতের দুপুর বাজবরনতলায় কুড়ি পয়সা দিয়ে খাল পার হলাম সাইকেল কাঁধে নিয়ে। বাঁশের নড়বড়ে সাঁকো পার হওয়া চাট্টিখানি কথা! পা হড়কালেই পচা পাঁকের খালে সটান পড়ে যেতে হবে। যাব কাঁঠালতলা মদনপুর। সেই দুপুর থেকে ঠিকানা খুঁজছি। এই অঞ্চলে যে কত কাঁঠালতলা কত মদনপুর আছে, ঈশ্বর জানেন। এর আগে একদিন এই গ্রামের আশেপাশে চরকি খেয়ে গেছি। কেউ ঠিকমতো বলতেই পারেনি রতন মালের বাড়ি কোথায়? এক বুড়ো ভ্যানচালক অবশেষে এই ঠিকানার সন্ধান দিয়ে বলেছিল, শুধু কাঁঠালতলা বললি হবেনে, মদনপুরও বলতি হবে। নাহলি কেউ বুঝবে না। সেদিন আর খোঁজার সুযোগ ছিল না। শীতের সন্ধ্যে শ্বাস ফেলছিল ঘাড়ে। পরের সাইকেল ফেরত দেওয়ার তাড়াও ছিল। রতন মালের নামটা কোথায় যেন পড়েছিলাম! ভাঙর অঞ্চলের সংগ্রামী কৃষক নেতা রতন মাল জোতদারের মস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রথম কৃষক প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন এই অঞ্চলে ষাটের দশকে। তখন একটা অদ্ভুত রোমান্টিকতায় আচ্ছন্ন হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম এই মানুষদের। একদিন আচমকা এক বিয়ে বাড়ির বাজনদলের বাজনা শুনতে শুনতে রতন মালের নাম শুনলাম। তখন ঠিকানা নেওয়ার কথা মনে হয়নি। কিন্তু পরে আবার যখন মনে পড়ল তখন আর উপায় নেই। তখন মোবাইল ফোনের যুগ নয় যে এক ফোনেই মিলে যাবে সব। যারা বায়না করেছিল তারা ভাঙড়ের বেশি ঠিকানা বলতে পারল না। ওদের দোষ নেই, এসব বাজনার বায়না টায়না চেনা পরিচিতির মাধ্যমেই হয় গ্রামে-গঞ্জে।
সাইকেল ঠেঙিয়ে চলেছি। ধুলোয় ভরা পথ। ফাল্গুনের শুরুতেই বড় বড় পলাশ গাছের মাথায় আগুন রঙা ফুল বেশ লাগছে। ধূ-ধূ সবুজ গালিচা ছড়ানো মাঠ পেরিয়ে মদনপুরে এসে এক বিশাল বটের নিচে দাঁড়ালাম। এই গাছ কত দিনের হতে পারে! অজস্র ঝুরি নামিয়ে নিজেই নিজের শরীরটা হারিয়ে স্থবির হয়ে আছে। আরও খানিক চললাম। কাঁঠালতলা আর মদনপুরের সীমানায় এসে আবার থামলাম। রাস্তার পাশে একটা কালোভূতের মতো বড় ছেলে মাছ ধরছিল ছাকনি জাল দিয়ে। ওকে হেঁকে বললাম, রতন মালের বাড়িটা কোথায় বলতে পারো? ছেলেটি আমার দিকে জিজ্ঞাসার চোখে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ, তারপর জানতে চাইল রতন মাল? আমি বেশি কিছু বলা ঠিক হবে কি না এইসব ভাবতে ভাবতে বললাম, বাঁশি বাজায়। ও তড়াক করে লাফ দিয়ে জল থেকে উঠে এসে বলল, বায়না? এসো চল তোমায় নিয়ে যাচ্ছি। আমার দাদু হয়। এখন কি দেকা পাবে দাদুর! মনি হয় বিড়ি দিতি গেচে শীতলার হাটে। এসো এসো কাছেই বাড়ি। ওই যে তালগাছ অই অই। চললাম ওর পেছন পেছন। যাক, এতদিনে পেলাম যাই হোক!
উঠোন থেকে দাওয়া বেশ উঁচু। খড়ের চাল সটান নেমে এসে দাওয়ার মুখ ঢেকেছে। সুন্দরবনের গৃহনির্মাণ রীতি এখনো এই অঞ্চলে প্রকট। বাড়িতে হৈ হৈ পড়ে গেল। একদঙ্গল মেয়ে বউ দাওয়ায় টিভি দেখছিল, আস্তে আস্তে সরে গেল এদিক-ওদিক। রতন বাবুর ছেলের বউ বসার জন্য মোড়া এগিয়ে দিয়ে বলল, বাবা বিড়ি দিতি গেছে এসি পড়বে কিছুক্ষণের মদ্দ্যি। দাঁড়ে একটা গাঙশালিক বসে বকবক করছিল, মনে হয় আমার উদ্দেশেই কিছু বলছিল, এতক্ষণ বাদে খেয়াল করলাম। ছেলেটি বলল, দাদা বসো এট্টু আমি ঝপ করে চান করে আসতিচি।
২.
ভাগ্যিস শীতকাল নয়, দ্রুত সন্ধ্যে নামার কোনো ভয় নেই। বসে রইলাম চুপচাপ। শালিকটার বকবকানি শুনতে শুনতে ঝিম ধরল একটু। সাইকেল চালিয়ে এসেছি প্রায় কুড়ি কিলোমিটার পথ। ক্লান্তি ঘিরে ধরছিল। আমি যা ভেবেছিলাম তা ঠিক নয়। মেয়ে বৌরা আমাকে দেখে চলে যায়নি। টিভিতে কি একটা হচ্ছিল তাই দেখছিল বসে। ও পাড়ায় একটাই টিভি। যা চলছিল তা এখন শেষ তাই চাটাই গুটিয়ে চলে গেছে। বুঝলাম রতন মালের ছেলের বৌয়ের চিৎকারে। তখনো কিছু বাচ্চা ছেলে টিভির সামনে বসে ছিল। ছুটে এসে পট করে নব বন্ধ করে দিল বৌটা। দাওয়ায় চার পাঁচটা বিড়ি বাঁধার কুলো পড়ে আছে। তাতে কিছু পাতা কুচোনো। আর কিছু বেঁধে রাখা বিড়ি। আর ধৈর্য ধরছে না। কাঁহাতক এই কাঠির মোড়ায় বসে হাই তোলা যায়। উঠে পড়লাম। দাওয়া থেকে নেমে উঠোনে এসে দাঁড়ালাম। সামনেই এক বিরাট ঝাঁকড়া মনসা সিজের গাছ। পড়ন্ত বেলা ওর কাঁটাবৃত শাখার মাঝখানে এসে বিশ্রাম নিচ্ছে বলে মনে হলো।
এই অঞ্চলে প্রায় সব বাড়িতেই মনসা বিরাজ করছেন। একসময় এইসব গ্রাম জলা জংলা সুন্দরবনের অন্তর্ভুক্ত ছিল। আজ তেমনটা বলা না গেলেও মনসার ভয় এখনও কাটেনি। পুজোর পর থেকে নানা উপলক্ষে মনসার ভাসানগানের দল ঘরে ঘরে বায়না নিয়ে ফেরে।
মাঝখানে বুড়োর বড় ছেলে দুপুরে ভাত খেয়ে টেয়ে বিশ্রাম না নিয়েই চলে গেল বিড়ি ঠোঁটে গুঁজে। যাবার সময় আমাকে প্রতিশ্রুতি দিয়ে গেল বাবা এই এলো বলে। আমি ক্রমশ অস্থির হয়ে উঠলাম। বহুদুর পথ চলে এসেছি। রাস্তাঘাট ভালো নয়। জায়গা ভীষণ না হলেও বেশ অচেনা, খারাপও হতে পারে। তখন মোবাইল আসেনি বাড়িতে খবর দেবারও উপায় নেই। এইসব সাতপাঁচ ভাবছি, এমন সময় এক প্রৌঢ় হন্তদন্ত হয়ে ঢুকল। গায়ে একটা রংচটা ফতুয়া আর হাঁটুর ওপরে পড়া খাটো ধুতি।
এর আগে বাড়ির চৌদিকে মোটামুটি চোখ বুলিয়ে নিয়েছি। ঘর দাওয়া বেশ তকতকে। উঠোনে ধানের মরাই একটা। বিকেলে গোটা তিনেক গরু এসে ঢুকেছে। চার পাঁচটা ছাগল দেখছি ঘুরছে উঠোনে। মুরগি হাঁসের দেখাও মিলেছে। ধনী কৃষক না বলা গেলেও গরিব কৃষক এরা নয় নিঃসন্দেহে।
ঘরে ঢুকেই বেরিয়ে এলো রতন মাল, বাবু আমাকে খুঁজতি এসেছেন, অনেক দেরি হয়ি গেল আজ আমার। আজ আবার হপ্তার দিন টাকা দিতি মহাজনের বড্ড দেরি হয় বাবু। চিরকালের নিয়ম। তা বিয়ে না ভাত। কোত্থেকে আসা হচ্ছে। ইস ফাগুনেই বড্ড গরম ছেড়েছে। হ্যাঁ মা বাবুরে জলবাতাসা দেচ? আমার কথা শোনার আগেই সে নানা প্রশ্ন করল উত্তরের প্রতীক্ষা না করেই। আমার কেমন যেন মনে হচ্ছিল যে ঠিক জায়গায় আসিনি। বুড়োর কথার ধরন শুনে সংশয় আরও বাড়ল।
৩.
আমার আসার কারণ শুনে হকচকিয়ে গেল রতন মাল। না বাবু আমি কোনোদিন পার্টি করিনি। আমি লেখালেখি করি শুনে আরও কুঁকড়ে গেল বুড়ো। আমি আটপৌরে ভাষায় তাকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম, কিছু কথা বললাম। কিছুক্ষণ চুপ থেকে হঠাৎ সে এগিয়ে এলো কানের কাছ, আপনি মনি হয় রতন মাশটারির কতা বলছেন। ওই পার্টিতো আমিও কত্তুম, সে সব অনেককাল আগের কতা। আর সেসব কি আচে? রতন মাশটার চাষিদের ঘরের লোক ছিল, বড় আপন লোক। সে একদিন ছিল বাবু। এখন সরকারি বামের দাপট। আমিও অই করি। গাঁয়ে থাকতি গেলে এছাড়া উপায় নেই! তা যাননা এই পথ দে সোজা চলি যাবেন। কাঁটালতলা মোড়। ইশকুল। ইশকুলের ধারেই বাড়ি। আমি ভাবছি বিকেল গড়াচ্ছে। এখানে অহেতুক সময় নষ্ট হলো! আবার কতদূর যেতে হবে কে জানে! মনের ভাব বুঝেই বুড়ো বলে উঠল, বেশি দূর নয়। দু কদম হাঁটলি চলে যাবেন। আমি যাই বাবু চান করে আসি। তারপর আমার সঙ্গে দুটো খেয়ি যাবেন। আমি খেয়েছি বলাতে সে বলে উঠল, তা বললি হয়, এতটা বেলা হল, কখন কী খেয়েচেন, কাঁচা বয়সে সে সব কি আর পেটে আছে! পেছনে তাকিয়ে দেখি সেই কালো ছেলেটা দাঁড়িয়ে আছে। অনেক্ষণই এসেছে হয়তো খেয়াল করিনি। বুড়ো দাওয়া থেকে গামছা পেড়ে ঘাড়ে রেখে তেলের কৌট খুলে সরষের তেল নিয়ে পায়ে ঘষতে ঘষতে বলল, এ বুনো শুনলি তো সব। বাবুরে নে যাবি। পারবি? ছেলেটা বলল, রতন মাশটার কে? তুই চিনিবি না অই যে মাখন মাল, ওর ছেলে বিলাস ছেলে পড়ায়, চিনিস? বুনো ঘাড় নেড়ে সায় দিল। বুড়ো পুকুরে যেতে যেতে বলল, তুই চিনবি কী করি, মাশটার তো অনেকদিন মরি গেচে।
আমি চমকে উঠলাম, মারা গেছে? যার জন্য এতদূর আসা! মনটা খারাপ হয়ে গেল। বুনো আমাকে ডাকল, দাদা এসো আমার ঘরে। আমি নিঃশব্দে ওর পিছু নিলাম। ভাবলাম যাইহোক এতদূরে এলাম যখন ঘুরেই আসি। কিছু তথ্য হয়তো পেতেও পারি। ওনার ভাই বেঁচে আছে শুনলাম, উনি নিশ্চই কিছু বলতে পারবেন।
দাদা এই আমার ঘর, বলেই বুনো ঘরে ঢুকে গেল। আমি ছেলেটার দিকে আগে ভালো করে খেয়াল করিনি। এবার ভালো করে নজর করলাম। কিশোর নয়, সদ্য ফোটা তরুণ যুবকের অবিকশিত চোয়াড়ে মুখ। গালে বিরলতর রোম, আচমকা দেখলে তাই বাচ্চা ছেলে বলেই মনে হবে।
আমি ওর ঘরের অপর্যাপ্ত দাওয়ায় দাঁড়িয়ে থাকলাম। বুনোও খুব জোর করল না। কোথায় বসতে দেবে! মাটির দেওয়ালের সর্বত্র, দরজার কপাটের আপাদমস্তকজুড়ে শুধু মিঠুনের ছবি। বাইরে গোটাকতক শুয়োর ঘুরে বেড়াচ্ছে। চারপাশে পচা খাবারের গন্ধ। বুড়োর বাড়ির তুলনায় বেশ অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ। এটা জেলেপাড়া, ক’ঘর সর্দারও আছে। ছোট ছোট ঘর তাদের একে অপরের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে। বুনো বলল, দাদা অন্যদিন হলি পাত্তুমনা আজ ঠেক বন্ধ তাই যাচ্ছি। আমি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকালাম। আমি মদ তুলি, বেশ পরোয়াবিহীনভাবে বলেই বুনো পকেট থেকে একটা তোবড়ানো সিগারেট বের করে আমার দিকে বাড়িয়ে ধরল। আমি খাই না বলতেই বিন্দুমাত্র দেরি না করে সিগারেটটা নিজের ঠোঁটে চালান করে দিয়ে ফস করে ধরিয়ে নায়কী ঢঙে ধোঁয়া উড়িয়ে বলল, ওসব বিড়িটিড়ি খাই না আমি মুকি গন্দ হয়। তা একন যাবে, না ভাত খেয়ি যাবে? শোনো দাদা আজ রাত্তিরি তুমি থেকি যাও ঠাণ্ডায় ঠাণ্ডায় ঘুইরে দেব অকন। আমি বললাম তা সম্ভব নয়, ফিরতেই হবে। আমি অজানা নতুন জায়গায় রাত কাটাতে চাই না এটা তাকে বুঝতে না দিয়ে মিথ্যে কিছু অজুহাত দিয়ে ওকে যেতে তাড়া দিলাম। মদের ঠেক মানেই গ্রামীণ দুষ্কৃতির আনাগোনা। দুষ্কৃতির সঙ্গে নেতাদের যোগ সুতরাং…।
আমি আচমকা সিদ্ধান্ত পালটে বুনোকে বললাম, আমি একাই যেতে পারব তোমাকে আর যেতে হবে না। কিন্তু বুনো নাছোড়বান্দা, যাবেই। আমি ওদের কুটুম, তাই কুটুমকে একা ছাড়া যাবে না। আমি সংকটে পড়লাম।
৪.
অগত্যা বুড়ো ফিরে আসার আগেই বুনোর সঙ্গে বেরিয়ে পড়লাম। বুনো খাবার জন্যে খুব একটা উপরোধ করল না, বলল চল বেশি দেরি হলি তুমি ফিরতি পারবে না। যাচ্ছি, রাস্তার দুপাড়ে বড় বড় পুকুর তারপর সবুজ ধানমাঠ।
কোথাও অকর্ষিত জমি। সেখানে ছাগল গরু চরছে। আমি নীরবতা ভাঙলাম, জিগ্যেস করলাম, বুনো মদের ঠেক কার, তোমার? ও অবলীলায় উত্তর দিল। না মদন সর্দারের, আমি জ্বাল দিই। তবে ওটা আমারি বলতি পারো। যা চাই তাই দেয়। আমি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকালাম। আবার খানিক নীরবতা নামল। রাস্তা বাঁক নিয়ে ঘুরে আরেক পাড়ায় গিয়ে পড়ল। বুনো বলল, এটা মোল্লাপাড়া। এর পরেই কাঁটালতলা। দাদা মাখন বুড়ো তোমার কে হয়, কী দরকার তোমার অখেনে! আমি বুঝিয়ে বললাম। রতন বাবুর সময়। তাদের আন্দোলন লড়াই এইসব নিয়ে। বললাম ক্ষমতার দাপটের কথা, তাদের দাপট ভেঙে প্রকৃত কৃষকের হাতে জমি ও ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার এক ভ্রূণপর্যায়ের কৃষক আন্দোলনের গল্প, যতটুকু জানতে পেরেছিলাম তার সবটাই। আমি খেয়াল রাখিনি কাকে বলছি আর কেনই বা বলছি। আবার নীরবতা নামল। বুনো কোনো উত্তর করল না। সামনেই একটা প্রাইমারি স্কুল দেখে বুঝলাম এসে পড়েছি। বুনো আচমকা দাঁড়িয়ে পড়ে আমাকে একটা পুরনো পাকা বাড়ির দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, দাদা তুমি যাও আমি এখেনে দাঁড়িয়ে রইলুম। আমি কিছুতেই তাকে আমার সঙ্গে যেতে রাজি করাতে পারলাম না। সে শুধু আমাকে স্বগতোক্তির মতো বলল, আমি ওদের বাড়ি যাই না। এই বলে চুপ করে গেল।
আমি বাড়িটার দিকে এগিয়ে গেলাম। দেখি বাড়ির সামনে একটি অগোছালো বাগানে এক বৃদ্ধ জল দিচ্ছেন গাছে। আমি কাছে গিয়ে জানতে চাইলাম যে এটা রতন মালের বাড়ি কিনা! বৃদ্ধ আমার দিকে অবাক বিস্ময়ে খানিক তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি কে? আমি একটু হেসে পরিচয় দিয়ে সংক্ষেপে বললাম আমার আসার কারণ। উনি এবার তৎপর হয়ে আমাকে বাড়িতে ডাকলেন। আচমকা বুনোর দিকে তাকিয়ে আমাকে বললেন, ও কি আপনার সঙ্গে এসেছে? আমি ঘাড় নেড়ে সায় দিতেই, বৃদ্ধ ওকে হাত নেড়ে ডাকলেন। বুনো অনিচ্ছুক পায়ে বাড়ির সীমায় এসে দাঁড়ালো। উনি ওকে আবারও ডাকলেন। বুনো এবার বাড়ির ভেতরে এসে দাঁড়ালো। উঠোনের বাগানে কিছু সূর্যমুখী ফুল, কয়েকটা মোরোগঝুঁটি, দোপাটি এলোমেলো হয়ে ফুটেছিল।
বারান্দার লাল সিমেন্টের চাতালে বৃদ্ধের নাতনি দুটো আধভাঙা চেয়ার পেতে দিল আমাদের জন্য। আমি চেয়ারে না বসে মেঝেতেই বসলাম। বুনো কিছুতেই বসল না, ঠায় দাঁড়িয়ে রইল অনেক অনুরোধ সত্ত্বেও! বৃদ্ধ নিজের পরিচয় দিলেন। তিনি মাখন মাল রতন মালের ছোটভাই। কথা বলতে বলতে তাঁর চোখ সজল হয়ে উঠল। বহুকষ্টে দিন গেছে তাদের। জরুরি অবস্থার সময় যখন লড়াই নতুন পর্যায়ে প্রবেশ করতে যাচ্ছে তখন ব্যাপক ঘেরাও দমন নামে। রতনবাবুর কমরেডরা তাকে ঘর ছেড়ে আত্মগোপন করতে বলেন, কিন্ত পুরোনো গৃহস্থ মন নিয়ে রতনবাবু ঘর ছাড়তে পারলেন না। ফলে যা হওয়ার হলো। দুজন কৃষক নেতা জোতদারের গুণ্ডা আর পুলিশের যৌথ আক্রমণে নিহত হলেন; বাকি কমরেডরা অন্তরীণ অবস্থায় এলাকা ছেড়ে গেলেন। একা পড়ে গেলেন রতন। তাঁর ধান জমি বাড়ি সব লুট হয়ে গেল। থেমে গেল এই অঞ্চলের কৃষক সংগ্রামের এক অন্যতম অধ্যায়। তন্ময় হয়ে শুনছিলাম মাখনবাবুর স্মৃতিকথা। বুনোও দেখলাম মাথা নিচু করে শুনছে। চা এলো বিস্কুট সহযোগে। গ্রামের গুড়ের চা আর আটার বিস্কুট মন্দ লাগছিল না অনেকক্ষণ খালি পেটে থাকার পর! মাখনবাবু দাদার কমরেডদের প্রতি সন্তুষ্ট নন বোঝা গেল। বারবার বলছিলেন, ওরা কেউ দাদার খোঁজ নেয়নি। দাদা একা অভিমন্যুর মতো বেঁচে থেকেছে এই কাঁঠালতলা গ্রামে। কৌশল করে টিকতে চেয়েছে, কিন্তু শেষ অবধি পারেনি। গরিব চাষি আদিবাসি ওঁরাওরা সবসময় দাদার কাছে আসত। দাদা ছিল ওদের আপনজন। দাদা ওদের হয়ে কথা বলে ফেলত। গ্রামের সরকারি মোড়ল মাতব্বররা দাদার এই জনপ্রিয়তা মানতে পারছিল না। ভেড়ি ডাকাতি, ধান লুটের রাজনীতির বিরুদ্ধে দাদা বাইরের কোনো সহযোগিতা ছাড়াই প্রতিবাদ করে যাচ্ছিল। আমরা দাদাকে মানা করেছিলাম। স্বভাব বুঝলেন না, তা যাবে কোথায়? তুমি একা কী করবে এই খুনির রাজত্বে। ওদের বাধা দিলে তোমাকে কি ওরা ছেড়ে দেবে। কাঁচা বুদ্ধির লোক দাদা ছিল না, অনেক লড়াইয়ের জ্ঞান ছিল তার, কিন্তু ভাগ্য। আমি জানতে চাইলাম, কী হলো তারপর?
জরুরি অবস্থার পর বাম আমলে লাল ঝাণ্ডাধারী ভোল বদলানো কংগ্রেসি গুণ্ডারা দাদাকে মারল। আপনারা শহরে বসে অনেক কিছু দেখতে পান না কাগজ পড়ে জানেন। আমরা গ্রামগঞ্জের মানুষ সামনাসামনি অনেক কিছু দেখি। এখানে একটাই রাজনীতি, অর্থ আর ক্ষমতার।
বলে যাচ্ছিলেন মাখনবাবু। দাদাদের লড়াই যখন হয়েছিল সেই সময় কিছু খাস জমি খাস খাল আদিবাসী আর গরীব চাষিদের দেওয়া হয়। সেই জমিগুলো সরকারি বামেরা দখল নিয়ে নিজেদের কিছু লোকের হাতে দিতে চাইছিল, কিন্তু দাদা ছিল বাধা।
আসুন দাদার সমাধি দেখবেন আসুন! সমাধি? আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম। মাখনবাবু বললেন, হ্যাঁ। আমরা বাগান পেরিয়ে সদর উঠোনের সামনে দাঁড়ালাম। আসার সময় এদিক দিয়ে আসিনি। সামনেই একটি লাল সিমেন্টের বেদি দেখিয়ে মাখন বাবু নতজানু হলেন। আমি কিছুক্ষণ কথা বলতে পারলাম না। নীরবতা ভেঙে বৃদ্ধ বললেন, সেই রাত্রে গুণ্ডাবাহিনী আমাদের সামান্য একটু জমি ছিল তখনো, তার ধান লুট করে নেয়। আমাদের বাড়িতে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। দাদা একা ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে ওদের বাধা দিতে গেলে ওরা সরাসরি দাদাকে গুলি করে। দাদা বেঁচে ছিল তখনো। কিন্তু আমি বাড়িতে ফেরার আগেই দাদা মারা যায়। আমি দেখলাম বৃদ্ধের কুঞ্চিত চোখের কোণে সজল সমাবেশ, ভ্রাতৃপ্রেমের স্বাক্ষর। আমি বললাম, কিছু ফুল পাওয়া যাবে! মাখনবাবু দ্রুত বাগানে গিয়ে কিছু দোপাটি তুলে আনলেন। আমি হাত বাড়াতেই দেখি আরও দুটো হাত বাড়ানো রয়েছে।
মাখনবাবু বলে চললেন, আমিও বাঁচতুম না। আমি দূরের ইস্কুলে চাকরি করতুম। কিন্তু বাড়ি ফিরতাম রোজই। ইস্কুলে বড় পরীক্ষা থাকলে তখন ফেরা আর হতো না, প্রশ্ন পাহারা দিতে হবে! তাই সেই রাতে ফেরা হয়নি। দাদা বলে গেছিল, তার দেহ যেন পোড়ানো না হয়। বাড়িতেই তাই সমাধি দেওয়া হলো তাকে। আমি বেদিতে ফুল দেওয়ার পর বুনোও ফুল দিল হাঁটু গেড়ে।
৫.
সূর্য নেমে গেছে এবারে ফিরতেই হবে। বহুদূর পথ পেরিয়ে যেতে হবে। মাখনবাবু কিছুতেই ছাড়বেন না। আমি আবার আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ফিরে চললাম বুনোর সঙ্গে বুনো অনেকক্ষণ কথা বলেনি। এবারে মুখ খুলল। আমি কেন ওদের বাড়ি যেতি চাইছিলুম না জানো! আমি ওদের বাড়ি বোম মেরেছিলুম! আমি চমকে ওর মুখের দিকে তাকালাম বলে কি ছেলেটা! ও দ্রুত মুখ নামিয়ে নিল। বলল, আমি কি জানতুম এসব। আমাদের জমি নেই পুকুর নেই কিচ্ছু নেই। ওরা আমাদের মদ খাইয়ে জমি লুট করায় ভেড়ি লুট করায়। তুমি এখেনে সব ঘরের খাটের নিচি মেশিন, পাইপগান, বোম পাবে! কিন্তু চাল পাবে না। আমাদের ভাত নেই দাদা! তাই আমাদের ওরা ডাকাত বাইনে রেকেচে। সবার নামে কেস। তুমি মুক ফুটে কিচু বলতি পারবে না। বললি পরেই পুলুশ এসি তোমারে তুলে নে যাবে। আমি ওর চোয়াড়ে মুখের মধ্যে বিষণ্নতার ছায়া পড়তে দেখলাম । ওর অন্তরাত্মা কথা বলছে। ওর শ্রেণীচেতনা দ্রুত ওর মনের দিকবদল ঘটিয়ে দিচ্ছে। আমি কোনোদিন রাজনৈতিক সংগঠক হিসেবে কাজ করিনি, কিন্তু বুনোর এই আকস্মিক পরিবর্তনে মনের মধ্যে এক অচেনা অনুভূতি এনে দিচ্ছিল, এক টুকরো আগুনের মতো। দাদা কিচু করতি যদি নাও পারি, কিন্তু ওই বাড়ির কারও গায়ে কাউকে হাত দিতি দেব না, এই বলে দিলুম তোমারে, বুনো চাপা গলায় বলে উঠল।
সন্ধ্যার ছায়া পক্ষ বিস্তার করতে শুরু করেছে। আকাশজুড়ে পাখিরা ফিরছে নকশা আঁকতে আঁকতে। পূর্ণিমার চাঁদ আকাশ দখল নিয়ে ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে। পুরোনো পড়া খবরগুলো চোখের সামনে চলমান পট হয়ে ভেসে উঠছিল একে একে। দেখছিলাম মশাল হাতে কৃষকেরা দ্রুত হেঁটে চলে যাচ্ছে। তারা বাজেয়াপ্ত করছে জোতদারের জমির ধান। দখল নেওয়া খাসজমি খাসখাল বিলিয়ে দিচ্ছে ভূমিহীন কৃষককে। কৃষক আদালত বসিয়ে ন্যায়বিচার করে দ্রুত রায় কার্যকর করছে। গ্রামীণ পালাগান যাত্রা সর্বত্রই যেন সেই কৃষক যুদ্ধের ছবি।
আমি সল্টলেকে আবার চলে যাব, আবার ট্যাক্সি চালাব। আর মদ জ্বাল দেব না; দাদা, বুনো ককিয়ে উঠল। দাদা এখেনে থাকলি শুধু পাপ করতি হবে।
বাঁশি রতনের বাড়ি এসে গেল। সন্ধ্যে ঘনিয়ে গেছে একেবারে। ধূলোপথ রূপোর মতো সাদা দেখাচ্ছে জ্যোৎস্নায়। দূরে কোত্থেকে কীর্তনের সুর ভেসে আসছে। এতক্ষণ হেঁটেই আসছিলাম। এবারে সাইকেলে উঠে পড়লাম। হঠাৎ বুনো ছুটে এসে পেছনের সিটে বসে পড়ল। বলল, দাদা থাকবে না ঝকন, আমি এট্টু তোমার সঙ্গে বাসইস্ট্যান্ড পর্যন্ত যাই। খানিকপথ চুপচাপ যাওয়ার পর সে আবার বলল, সামনের মাসে আমারে সল্টলেকে এলি পেয়ি যাবে, তুমি আসবে তো দাদা! ও হয়তো বুঝতে পারেনি যে আমি একজন সামান্য লেখক, যার কোনো ক্ষমতাই নেই তাকে ভরসা দেওয়ার । তবু আমি ঘাড় নেড়ে সায় দিয়ে বললাম, যাব।
বিদ্যুৎহীন গ্রামের সন্ধ্যাকাল আলো আঁধারিতে অদ্ভুত দেখাচ্ছে। আমি জোরে জোরে প্যাডেল করছি। বহু পথ সামনে। দখিনা হাওয়া প্রান্তর পেরিয়ে এসে জড়িয়ে ধরছে আমাকে। দূর অন্ধকারে মাঠের মধ্যে দপ দপ করে জ্বলে উঠছে অগুনতি আলো। মশালের মতো।