ঘরের টিকটিকিটা সেদিন একটা গোপন সংবাদ দিয়ে গেলো। টিকটিকি সত্যি কথা বলে আগে থেকেই জানতাম। বলেছিল, এ বাড়িতে দুটো মৃত্যু ঘটবে, এর মধ্যে একজন আমার সৎমা, আরেকজন তিতুল। মৃত্যুর কারণ দুর্ঘটনা, ইলেকট্রিক শক। সময় আসন্ন। সংবাদ জানিয়েই টিকটিকিটা হাওয়া হয়ে যায়। সত্যি সত্যি পরদিন সন্ধ্যায় এ বাড়ি থেকে দুটো লাশ ময়নাতদন্তের জন্য নিয়ে গেলো পুলিশ। আশ্চর্যের বিষয়, সে-রাত থেকে দেখছি দেয়াল ফুঁড়ে ভূতের মতো মুখ করে আমার ঘরে দাঁড়িয়ে থাকে একটা তেঁতুল গাছ। মধ্যরাতে এর পাতারা ঘুমায়, সেই অবসরে গাছটার মগডাল হয়ে ওঠে জীবন্ত। গলায় ফাঁস লাগিয়ে ঝুলে থাকে দুটো মানুষ!
তিতুল মরে গেছে। এই দুর্ঘটনা আকস্মিক! এটাকে খুন ভাবার কোনো কারণ নেই। এক বাড়িতে একইদিনে একজন নারী আর একজন পুরুষ একই ঘটনায় মরতেই পারে। কোনো কিছুই অস্বাভাবিক নয়। তিতুল মরে না গেলেই বরং সেটা খারাপ হতো। রোজ আমাকে দেখতে হতো রাতের অন্ধকারে এক বিবস্ত্রা রমণীর ব্রীড়া। সেই রমণী আর কেউ নয়, আমার বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী। রহস্যময় আলোয় নগ্ন সে রমণীর বুক, পিঠ, কোমর, জঙ্ঘার শীতল ঘোরে আমায় আরও কত রাত পুড়তে হতো মেয়েলি জ্বরে, কে জানে! তারচেয়ে এই ভালো, এখন আমি একটু একটু করে পুরুষ হয়ে উঠছি; নাকের নিচে জন্মে যাচ্ছে পুরুষ্টু গোঁফ! তিতুল মরে গেছে। আমার এসব মৃত্যু বিষয়ক স্বস্তি ভাবনায় একটু অপরাধী লাগে। আমি পোস্টারে স্যালুট পাওয়া একটা মানুষের কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করি। রায়বাবু তুমি কি জানো, তোমার তিতুল এখন কোথায় আছে? অন্ধকার মর্গে পড়ে আছে তার লাশ! দিনের বেলা সেখানেই থাকে, শুধু রাত হলে উঠে আসে আমার জানালায়!
উদ্ভট কাজের মানুষ ছিল তিতুল। বাবা বলেছিলেন, ওর জন্ম হয়েছিল চেন্নাই হাসপাতালে। সেখানকার এক নার্সের টিয়া পাখির নামে নাম। থাকতো কোন সেই নৈনিতাল! অনেক গঙ্গা-যমুনা পেরিয়ে এদেশে এসেছে ওরা। তিতুলের খুব আঁকার নেশা, কলেজেও পড়ত। মধ্যখানে হঠাৎ কোনো এক অজানা কারণে দুম করে মাথায় বায়ু চড়ে গেল, চলে এলো ফিরে। এরপর রায় বাবুর আশীর্বাদে ঘরের দেয়াল থেকে শুরু করে বাসন-কোসন সমস্ত কিছুতেই চলতো তার নান্দনিক শিল্পচর্চা। এই একটান দিত তো হয়ে যেত মস্ত ডাইনোসর, আগুনমুখো ড্রাগন! আরেক টান দিত তো হয়ে যেত দৈত্য, দানো, রাক্ষস, খোক্কস।
বেঁচে থাকতে তিতুলের সকল রকম উদ্দেশ্যহীন কাজের আমি ছিলাম মুগ্ধ দর্শক। সকাল সকাল শুরু হতো তার হাতি, ঘোড়া, শেয়াল আঁকা পর্ব। পুরোটা শেষ না হতেই দেয়ালে সেঁটে রাখা রায় বাবুর পোস্টারে একটা লম্বা স্যালুট দিতো। এরপর হাতে মিশে থাকা হরেক রঙ মাখিয়ে দিতো আমার গালে। আহ্লাদে টিপে দিতো আমার চ্যাপ্টা নাক। একটু আদরও করতো তখন! তিতুলের সে স্পর্শে আমার কপাল কুঁচকে যেতো। হু হু করে বেড়ে যেতো মনের বয়স। বুক কেঁপে, ঠোঁট কেঁপে আমি ভিজে যেতাম একদম। মনে পড়ে যেতো তিতুলের মধ্যরাতের চিত্রপাঠ। সত্যি বলতে তিতুলকে নিয়েই শুরু হয় আমার নারী হওয়ার কাল। আমি শিশু হতে, কৈশোর হতে খোলস পাল্টেছি তিতুলের জন্য। সাপ হওয়ার বিষ পেয়েছি, সেও তিতুলের জন্য।
অনাত্মীয় হলেও এ বাড়িতে তিতুলই ছিল আমার সবচেয়ে আপন। তিতুল ছাড়া আমাকে রোজ রোজ তোয়াজ করবে এত ধৈর্য কার! আমার বাবার দ্বিতীয় স্ত্রীকে আমি মা বলতে বাধ্য হলেও সময় সময় বাবা নিজেই তার আদরের বৌকে কুত্তি বলে ডাকতেন। সব সময় না, মাঝে মাঝে। যে সময় বাবার মেজাজ তিরিক্ষি থাকত, সে-সময়। বাবার মেজাজ তিরিক্ষি হলে বাবা নেশা করতেন খুব। ভরপেট নেশা হয়ে গেলে বাবা মাতাল হতেন। চিৎকার করে, চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় তুলতেন। আমার বিড়ালের মতো বাবা তখন রীতিমতো সিংহ! মাকে জোর গলায় বলতেন, তুই একটা কুত্তি, তুই একটা বেশ্যা। রাতের আঁধারে চলে তোর শিল্পপাঠ, সব জানি, আমার না-হয় আগের মতো জোর নাই শরীরে, তোর তো চাই! সব বুঝি, তবু তোকে পুষতে ভালো লাগে। তোর নাগর পুষতে ভালো লাগে। তোদের নাটক দেখতে ভালো লাগে। দেখিস, একদিন তোদের নাটক শেষ হলে সব ভালোলাগা একসঙ্গে বেচে দেবো হাটে।
সৎমা নির্বিকার!
তুই আবার ভাবিস না তোকে আমি ভালোবাসি। কুত্তি, তোরে আমি থু দেই রোজ।
থু
থু
থু
প্রায় দুপুরে বাবার এমন থুতুতে ভরে উঠতো তাদের শোবার ঘরের বালিশ, কাঁথা, মেঝে। অথচ এই বাবাকেই দেখেছি যখন হুঁশে থাকেন তখন মায়ের পাশে ম্যাঁও ম্যাঁও চিঁ চিঁ ছাড়া কথা বলতে পারতেন না। ঠিক এ সময়টা দেখার জন্য আমি টানটান উত্তেজনা নিয়ে দেয়ালের ফুটোতে আটকে রাখতাম চোখ। রঙ্গমঞ্চে উদ্ভট রস গাঢ় হয়ে জমে ওঠার আগেই তিতুল হাজির হয়ে যেতো। আমাকে নিয়ে জোর করে পালাতো বাড়ি থেকে। কানে আঙুল চাপা দিত আমার। আমি রাগে ফুঁসতাম। আহা, বাবার অশ্লীল শব্দগুলো শোনা হলো না আর। তব যতটুকু শুনতাম ততটুকুই আমার মনের মধ্যে গুনগুন করে গান হয়ে ভাসতো।
কুত্তি, কুত্তি, কুত্তি
বেশ্যা, বেশ্যা, বেশ্যা!
একটা কমলা রঙের সাইকেল উড়িয়ে নিয়ে যেত আমাকে আর তিতুলকে। সাইকেলের মাথায় বাঁধা ছিল একটা দেড় ব্যাটারির রেডিও। তিতুল আমায় সাইকেলের সামনে বসিয়ে দিত। ফুল ভলিউমে বাজতো গান:
হাওয়া মে উড়তা যায়ে, মেরা লাল দোপাট্টা মলমল কা…
দুজনে উড়ে যেতাম হাওয়ায়, যেন সাত সমুদ্র তেরো নদী পার হয়ে তেপান্তরে পৌঁছে যাওয়ার তাড়া আমাদের। বন-জঙ্গল আর আকাশে উড়ে বেড়াতাম ইচ্ছে মতোন। সোহাগপুরের কাছে কলাবতী দিঘির ছায়ায় বসতাম। শীতল জলে ছায়া ছায়া মুখ। স্বচ্ছ পানিতে কত শত মাছ! মুহূর্তে আমি ভুলে যেতাম বাড়ির বদ্ধ পরিবেশের সেই কুকুর বেড়ালের যুদ্ধ।
তিতুল আমায় রঙ চেনাত। পুকুরের মাছ সব এক রঙের, তবু ও জিজ্ঞেস করতো
বল তো বুড়ি, মাছের গায়ে কী রঙ?
রূপোলি।
রূপোলি? তিতুল হাসতো।
তার হাসিতে আমার রাগ হতো, মনে হতো মিথ্যে বলেছি। রূপোলি নামে হয়তো সত্যি কোনো রঙ-ই নেই। তিতুল বলতো:
মাছের গায়ে থাকে ‘আড়াইসুনি’ রঙ।
আড়াইসুনি? এটা আবার কেমন রঙ?
হলুদ আর পান্তুয়া মিশিয়ে বানায়।
ও!
হু।
দেখ দেখ, ওই মাছটার গায়ে কেমন বড় বড় কুড়িয়া আর আকরাই ফোঁটা!
কুড়িয়া কী?
লালের সঙ্গে আকাশি যা!
তুমি যে কী!
আমি আর আকরাইয়ের কথা জিজ্ঞেস করি না উল্টোপাল্টা কিছু শোনার ভয়ে!
এমনি কত চিত্র-বিচিত্র রঙ, ফুল পাখি লতার সঙ্গে কাটতো সময়। তিতুলের সঙ্গে রোজ আমি ভেসে যেতাম রাশি রাশি রঙের স্রোতে! ভেসে ভেসে হয়ে উঠতাম বিচিত্র বর্ণের এক মৎস্যকন্যা। আমার সবচেয়ে প্রিয় রঙ কালো। ঘরে একটা কালো হাতলওয়ালা ছুরি রাখি আমি। তিতুলের কাছ থেকেই নিয়েছিলাম। মাঝে মাঝে ছুরিটার গন্ধ শুঁকে দেখতাম, ভালো লাগত। আলোর বিপরীতে ধরে দেখতাম ছুরির বুক। চকচক করে; একদম ওর আঁকা ন্যাংটো ছবির মেয়েটার বুকের মতো। ঘরে একটা কালো হাতলের কাঁচিও আছে, ওটাকেও দেখি। নির্দোষ! এটা দিয়ে আমার নাক কাটার কথা। গোঁফ পাকিয়ে তিতুল বলতো: আয় কাছে আয়, তোর বোঁচা নাকটা ঠিক করে দেই। ভয় পাস নে, গর্দান থেকে কিংছু মাংস এনে জুড়ে দেব নাকে, তোর গর্দানে অনেক তেজ!
আমি চোখ তুলে তাকাতাম! ওর টিপ্পনিতে ধক করে জ্বলে উঠতো চোখ, কিছু করার ইচ্ছেয় উশখুশ করতো হাত-পা। এগোবার আগেই তিতুল হাঁটুগেড়ে বসে যেতো পায়ের কাছে।
মা মনসা, আমার বিষহরী, তোমার বুকভরা বিষ জানি আমি, ছোবল দিও না। দোহাই মা, এই আমি পা ধরছি। ক্ষমা করো—বলেই তিতুল আমার পা জাপটে ধরতো। আমি পায়ে অনুভব করতাম তিতুলের পুরুষালি মুখের স্পর্শ। ফিসফিস করে বলতো কিছু, পায়ের পাতায় নাক ঘষে ঘষে লেপ্টে দিতো কথার স্রোত! তিতুলকে সে সময় আমার বাবার মতো পোষ মানা বেড়াল মনে হতো। দ্বিধা হতো, বয়সে কে বড়, আমি না তিতুল? যতটা সময় তিতুল আমার পা ধরে থাকতো, ততটা সময় আমি অনন্ত নক্ষত্রকাল থামিয়ে রাখতাম। আমি অপেক্ষা করতাম কোনো মহাপ্রলয়ের। জলোচ্ছ্বাস বা ঘূর্ণিঝড়ের। তবেই না তিতুল নাক ঘষার মধ্য দিয়ে থামিয়ে দিতো বাধ্যতার গাঢ় প্রণয়!
এই ছুরি আর কাঁচির সঙ্গে শুধু তিতুল নয় আমার বাবা আর সৎমাকে স্মরণ করার একটা সম্পর্ক ছিল। বাবা-মায়ের ঝগড়ার সময়ে আমি এই ছুরিটাকে ভালোবাসতাম খুব, শাণ দিয়ে রাখতাম। কাঁচিটাকেও। এগুলো আমার হাতের কাছে রাখতে ভালো লাগতো। মনে হতো কত আপন! প্রয়োজনেই পাবো কাছে।
মাঝে মাঝেই আমার নির্বাসনে যাওয়ার কথা উঠতো ঘরে। বিচারকদের রায়ে মুমিনুন্নেছা আইডিয়াল লেডিস হোস্টেল নির্ধারিত হতো শেষ পর্যন্ত। শুনেছি সেখানে কোনো জাত-পাত নেই, টাকা হলেই রেখে দেয় যে কাউকে। এই নিয়ে সপ্তমবার! কিছুদিন আগেই আমি গার্লস ছিলাম আর আমার সৎ মা ছিলেন লেডি! এখন তিনি জুরিবোর্ডের সদস্য, আমি আসামি। মায়ের চোখে বিজয়িনীর চঞ্চল উচ্ছ্বাস। আমাকে দেখলেই তার চোখে ছলকে ওঠে কুতকুত করা হাসি। আমার ঘরের মধ্যরাত আর মধ্যদুপুরের দুই দুইটা ফুটোয় আঙুল ছুঁইয়ে হাসতে থাকেন হা হা করে।
এক্কেবারে বস্তিবাড়ির ঘর!
কী নোংরা!
কী জঞ্জাল!
নোংরা বলতে আমার সংগৃহীত বিভিন্ন ইলেকট্রিক্যাল ডিভাইস, পিসি, প্রজেক্টর, ইলেকট্রনিক্সের বই, স্টিম্যুলেশন, নয় ব্যাটারির জেনোরেটর আর তিতুলের আঁকা হাবিজাবি স্কেচ সবগুলোকেই বোঝায়! মায়ের ডাকে কতবার ফেরিওয়ালা আসতো। প্রতিবারই জঞ্জাল পরিষ্কার হতো অনেক। চোখের সামনে আমার স্বপ্নজগৎ চলে যেতো অন্য বাড়ি।
ঝড়ের আনাগোনায় তিতুল আসে গোপনে। ডাকে আমায়। ঘরের পেছনে পুরনো বাংলাঘরে দাঁড়াই দুজন। আমি যেহেতু শখের ‘ইলেকট্রিক ইঞ্জিনিয়ার’, ও ঘরটা তাই আমার শখের ল্যাবরেটরি! এখানেই ডাকতো সে।
বল তো টুনাই, আমি তোর কী হই?
তুমি আমার তিতুল হও।
কাকু বলবি না?
নাহ!
কেন?
কারণ, তুমি এ বাড়ির কেউ না। তুমি সেই বিষ খেয়ে মরে যাওয়া রাঙা দিদার ছেলে!
তাহলে?
তাহলেও তুমি কাকু নও, শুধু তিতুল! জানি রাঙা দিদা খুব সুন্দর ছিলেন। ঠিক তোমার মতো। দিদা যখন হাসতেন তখন তার গালে টোল পড়তো, বাবা বলেছেন।
হুম। সুন্দর, তবে তাতে কী! আমরা যে ব্রাত্যজন টুনাই। ব্রাত্যজন কখনো কি কারও আপন হয়? হয় না। কাছে থাকলেও হয় না, দূরে গেলেও হয় না। আমার মা হয়নি। আমিও না।
হয় না তো হয় না, এত আক্ষেপ কিসের! যতই আক্ষেপ করো, তোমায় আমি কাকু বলতে পারব না। তুমি আমার কাছে তিতুল! শুধু তিতুল!
মানলাম, কিন্তু তোকে আমার দিনকে দিন অপরিচিত লাগে কেন? তোর চোখে কিসের আগুন?
বয়স বাড়ছে, আমার বয়সের অপরিচয় তোমার সঙ্গে। আমার চোখে হাজার হাজার ভোল্টেজের আগুন। সাবধানে থেকো তিতুল, পুড়বে কিন্তু!
ফাজলামো না টুনাই, তুই যেন কেমন! এত তেজ তোর! তুই হাসিস একা, রাগিস একা, চলিস একা। তোকে যেন কেমন লাগে। মনে হয় তুই যেন কিসের অপেক্ষায়!
কী রকম?
জানি না। আত্মহননে যে সাহস লাগে, সেটা তোর আছে। আমার মায়েরও ছিল।
হা হা হা! নাহ মরবো না, তবে হ্যাঁ, আমি সাহসী। আমার দাদাও এমন ছিলেন। জানোই তো, এককালে আমার দাদা এ পরগণার জমিদার ছিলেন। বন্দুক নিয়ে বাঘও মেরেছেন! কত সাহস ছিল তার! শোনোনি গল্প? রাঙা দিদা তো সব জানতেন। দাদুর সে সাহস বৃদ্ধকালেও ছিল! বাঘ না মারলেও পরমা সুন্দরী এক রাঙা দিদাকে ঠিক ঠিক শিকার করেছিলেন। চুরি করে এনেছিলেন সেই নৈনিতাল থেকে! কোন সেই মুলুক, কে আর এলো বাহাস করতে? কজনের আছে সে সাহস!
আচ্ছা, ঠিক আছে হলো, এবার বল তোর সাহসের কী দরকার? তোর দাদার মতো কাকে চুরি করতে চাস তুই?
ডাইনিপুরীতে বন্দি এক অসহায় রাজকুমারকে।
আমার সস্তা রসিকতায় তিতুল হাসে না, চুপ করে থাকে। বাতাস ভারী হয়। বুকটা টনটন করে রাঙা দিদার জন্য, তিতুলের জন্য। আমি এবার বাতাস সহজ করি।
জানো তিতুল, সেই রাঙা দিদার একটা পিচ্চি ন্যাদু পুত্র ছিল! ছোটবেলায় সে ভূতের ভয়ে খাটের নিচে লুকাতো।
তিতুল একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে; মুহূর্তেই চোখ পাকায়!
ওরে পাকা বুড়ি, তোর জন্মের আগের ঘটনা তোর এত স্পষ্ট মনে আছে? বুড়ি! বুড়ি! বুড়ি! তুই একটা বুড়ি!
হু, বুড়িই তো। তুমি জানো না সবার চেয়ে আমার মনের বয়স সব সময় দশবছর এগিয়ে!
তিতুল হাসে প্রশ্রয়ের হাসি, হুঙ্কার দেয়। এই থাম থাম, ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির ঠিকাদার। ইতিহাস বন্ধ কর। মাথা ধরে যাচ্ছে আমার!
আচ্ছা গেলাম চুপ!
রে ভোঁতামুখী, আবার আচ্ছা! এবার বল, এ বাড়িতে আমি আছি কার জন্য?
বলব?
আমার মুখের ভাব দেখে তিতুল ভয় পায়, মুখ চেপে ধরে। না থাক, কী থেকে কী বলবি; তোর মুখ তো সাপ! তুই সাপেদের মা! তারচে’ চল আঁকতে বসি।
আঁকবো না।
খেলতে বসি?
খেলবো না।
তিতুল তখন দৌড়ে ছুটে আসে আমাকে ধরতে। পিঠে পড়ে যায় দুমদাম দু-চারটা কিল!
বাংলাঘরের ওপরে টিনের চালা, নিচে কাঠের পাটাতন। অদ্ভুত পরিবেশে আবার বসলাম দুজন। তিতুল আমায় ভোলায়! পিঠে হাত রাখে। নাক টেনে দেয় আদরে। বলে, টুনাই, ঘরের ফুটোয় শুধু কি সাপ আর অন্ধকার দেখে মানুষ? কোথাও কি আলো নেই, সুন্দর নেই?
আমি বলার মতো কিছু খুঁজে পাই না।
দেখ টুনাই, এই টিনের চালার ফুটো দিয়ে দেখ নারকেল গাছের বায়োস্কোপ! কেমন বড় বড় গাছ ছোট ছোট ছায়া হয়ে ঢুকে গেছে ফুটো দিয়ে। দেখ দেখ!
আমি দেখতে পাই ছায়াগাছ।
দেখলি টুনাই, কাঠের মাঝে কেমন অদ্ভুত সব বৃক্ষবিভ্রম। জানি, সত্যি নয় সব। মিথ্যে। তবু সুন্দর। জীবনটাও ঠিক এমন! জীবনে অনেক কুৎসিত আসবে, অসুন্দর আসবে; সব দেখতে নেই, সব বুঝতে নেই। দেখলেই কষ্ট, বুঝলেই যন্ত্রণা। আয়, তুই আর আমি সব ভুলে নকশা আঁকা জীবন দেখি। সব চমৎকার গায়ে মাখি, আয়।
আমি বড় বড় চোখ করে দেখি তাকে। বাংলাঘরের পরতে পরতে তার অতীত খুঁজি। এখানেই থাকত এককালে তিতুলের মা। আমি রাক্ষস-খোক্কস আঁকা সেই তিতুলের মুখে প্রেমিক মুখ খুঁজি। তিতুল আমার কাছে আসে, আমি তার গায়ের গন্ধ পাই। পুরুষ পুরুষ গন্ধ। অসহ্য যন্ত্রণায় মাতাল হই। তিতুলের হাত আঁকড়ে ধরি, চিৎকার করি। ঠোঁট কাঁপে আমার, কথা হয় না। তব গোঙাই, শীৎকারে বলি, তিতুল, তোমার জলরঙ কাটাকুটি ঘরে একবার আমায় নেবে? আমি তোমার নিষিদ্ধ বাতাসঘরে একবার নারী হতে চাই, মধ্যরাতের সাপ হতে চাই! দেয়ালের ফুটোয় ছড়িয়ে দিতে চাই হিসহিস শব্দ।
আমি জানি না, কেমন করে আমার আরাধনার প্রস্তুতিতে তৈরি করা মন পুরোপুরি অনাবৃত হয়েছিলাম জীবনের প্রথম কোনো অন্য কারও পোষ্য পুরুষের সামনে। তিতুল হাত সরিয়ে নেয়। আমার ঘোরের মাঝে তিতুল শুধু একবার বলে, তুই আমার মা, আমার আদরের মরে যাওয়া রাঙা মা।
দিন যায়, কাউকে বলা হয় না টিনের চালার নকশা আঁকা সে বিভ্রম দিনেই তিতুলের গায়ের গন্ধ আমার গায়ে চলে এসেছে। অথচ আমার নারী হওয়ার কথা ছিল। হলো না! এ বাড়িতে তিতুলের কাজ চলছিল আগের মতোই। বাড়ির ছবির অ্যালবাম দেখে তেলরঙে আঁকে সবার মুখ। দাদা, দিদা, আমার না-দেখা মৃত মায়ের মুখও এঁকে রেখেছে সে। শুধু একটা মুখ দিনের আলোয় তাকে কখনো আঁকতে দেখিনি। কখনোই না। সেই ছবিটা আঁকার জন্য তার বিশেষ একটা সময় লাগে; মধ্যরাত! আমার পাঁড়মাতাল বাপ যখন মদ খেয়ে বেঘোরে ঘুমোয়, তখন তিতুল তার রঙের বাকসো খুলে বসে, নিবিষ্ট মনে ছবি আঁকে সে সময়। আঁকতে আঁকতে তার চোখ সাপ হয়ে যায়, যাকে আঁকে তার চোখও হয়ে যায় সাপ! তারপর তাদের দুজনকে দেখতে লাগে একটা সাপমানুষ। পুরুষ মানুষ, নাকি মেয়েমানুষ, আমি আর ঠিক ঠাহর করতে পারি না। রাত বাড়ে, তাদের ফোঁসফোঁসানি শব্দের হিসহিস আক্রমণে আমার শৈশবের গভীর শীতনিদ্রা ভেঙে যায়। দেয়ালের ফুটোয় চোখ রেখে আমিও খোলস পাল্টাই। বয়স্ক নারী আবেগে একা একা ডুবে যাই নিজস্ব অসুখে! সর্বত্র শুধু পুরুষ পুরুষ গন্ধ। এমনকি নিজেকেও মনে হয় রমণ পুরুষ। যখন তখন আয়নায় দাঁড়াই; এই তো নাকের নিচে জমছে ঘন নতুন গোঁফ। উজ্জ্বল বৈদ্যুতিক আলোয় চকচকে কালো। আমার অস্বস্তি হয়। হাত দেখি, পা দেখি; সময় নিয়ে দেখি চোখ, নাক, ঠোঁট। মুখ ছেড়ে আসি বুকে, পুরুষ্টু উদ্ভিন্ন। আমার অস্বস্তি বাড়ে! বুক আর গোঁফ অসমান। আয়নাটাকে আর বিশ্বাস হয় না!
হোস্টেল থেকে চিঠি এসেছে! লাস্ট ওয়ার্নিং! যেতে হবে, অথচ কত ক্লান্ত আমি। আমার গোপন খাতায় জমে আছে হাজার হাজার বিষাদ রঙ! কেমন করে যাই। ভালো লাগে না কিছু। ছবি আঁকতে বসি। অদ্ভুত সব মুখচ্ছবি মাথায় আসে। হাতিমি, হাঁসজারু আর বকচ্ছপের ছবি টেনে টেনে আঁকি। আঁকতে আঁকতে কখন যেন তালগোল পাকিয়ে ফেলি। কচ্ছপ, বক আর সজারু মিলে মিশে এক হয়ে যায়। গাছের আদল পায়।
গাছের নাম মনে করতে পারি না। জানালা খুলে দেই, একঝাঁক হাঁস একসঙ্গে প্যাক প্যাক করে উড়ে যায়। নির্বিকার দেখি আমি। উল্টোদিকে খুঁজি মিনজিরি পাতা, শিরীষের ডাল, ছাতিমের ফুল! নেই কিছু। আমার ছায়া ছায়া দেয়ালজুড়ে এখন সব ছায়াচিত্র। ছায়াগাছ, ছায়াফুল, ছায়াপাখি। এরপর পাখিরা মিলে যায় ফুলের সঙ্গে, ফুলেরা মিলে যায় পাখির সঙ্গে। সব মিলে আবার হয় একটা ছায়ামানুষ! এই মানুষটা আমার খুব চেনা। বিষাদঘরে তার ছবি আঁকি গোপনে প্রত্যহ। কেউ তো জানে না প্রত্যাখ্যানের কলমে তার নামেই লেখা আছে আমার প্রথম যৌবনের কষ্ট।