যতই আণুবিক্ষণিক হোক, মানুষের জ্ঞান-বিজ্ঞানকে চ্যালেঞ্জ করে এক গভীর হতাশার দিকে ঠেলে নিয়ে যাওয়া প্রবল পরাক্রমশালী অণুজীবটির নাম কেন করোনা হবে, তা আমি ভেবে পাই না। ল্যাটিন এই নামটি মনে হলেই আমার চোখে ভেসে ওঠে রাগি রাগি চেহারার শীর্ণকায়া এক নারীর মুখ। সে যেন আমাকে কিছু বলতে চায়। আমিও ভাবি কিছু বলি, কিন্তু সে নারীর ধারে কাছে যেতে ভয় লাগে। অথচ ইন্টারনেটে দেখেছি, অণুজীবটি কী সুন্দর! যেন বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল। এমন সুন্দর একটা অণুজীবের নাম কেন এত মামুলি হবে? তারচেয়ে এর নাম হতে পারতো বেশ আভিজাত্যে পূর্ণ। শুনেছি ল্যাটিন ভাষায় করোনা অর্থ মুকুট, আর ভাইরাসকে ডাকা হয় বিষ নামে। আর তাতেই আমার ইচ্ছে হয়েছে জীবাণুটিকে ‘বিষমুকুট’ নামে ডাকি। নামটা প্রচার পেলে অবশ্য সেটা দেশবাসীর জন্যই নিপাতনে সিদ্ধ হতে পারে। জীবন ও জীবিকাকে নিলামে চড়িয়ে লকডাউন-লকফ্রির নামে যে বিপজ্জনক খেলাটা আমরা খেললাম তাতে সংক্রমণ আরও চরমে উঠবে সেটাই স্বাভাবিক। বিষ মুকুট নিয়ে তখন অন্তত নিজেদের সান্ত্বনাটা দিতে পারবো। ঠাকুর কবি এক্ষেত্রেও আমাদের সঙ্গী হতে পারেন। আমরা জাতিগতভাবে তখন গাইতে পারবো, ‘মোরা জেনেশুনে বিষ করেছি পান।’
তো ঘটনা হলো একদিন আমিও এই বিষের মুকুট মাথায় পরে নিলাম। মাসের প্রথম দিনটাতেই আমাকে জানিয়ে দেওয়া হলো, আমি সেই ঝাঁকের কইদের একজন, যাদের দেহকোষে বাসা বেঁধেছে অসুখটি। তার আগে অবশ্য নাসা গহ্বরের ভেতর তুলো প্যাঁচানো লম্বা কাঠি ঢুকিয়ে কুৎসিত এক তরিকায় হাসপাতালে নমুনা পরীক্ষার জন্য দিয়ে এসেছি। খানিকটা উপসর্গ থাকলেও আমি তখনো বদ্ধপরিকর যে কিছুই হয়নি, হবে না। কিন্তু যখন খুদেবার্তায় জানানো হলো, ফল ইতিবাচক, তখন সত্যিকার অর্থেই হকচকিয়ে গেলাম। মা-বাবা, স্ত্রীর উদ্বিগ্ন মুখ দেখে খানিকটা অসুস্থও লাগলো। ততক্ষণে এ খবর রটে যেতেই শুরু হলো সমবেদনা আর কৌতূহলী মানুষের ফোন। অনলাইনেও যেন সবাই খানিকটা নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে জানতে চায়, কোথা থেকে সংগ্রহ করেছি আমি এই বিষ, নিশ্বাস-প্রশ্বাসটা ঠিকমতো চলছে তো! নাকি বাতাসের জন্য বুভুক্ষু হয়ে হা-পিত্যেষ করছি। এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে জ্বরের ঘোরে আমার নেশা নেশা লাগে। চাপ ধরা বুক আর মাথাব্যাথা নিয়ে স্থবির হয়ে থাকি। ব্যাথায় দুই চোখ নাড়াতে পারি না। কেবল তাকিয়ে থাকতে হয় সামনের দিকে। যেন কেউ আমাকে মাথার দিব্যি দিয়েছে যে, সামনে ছাড়া আশপাশে দেখা যাবে না। যেন একঘেয়ে স্বরে কেউ গেয়ে চলেছে-সমুখে এবার দৃষ্টি তোমার পেছনের কথা ভোল।
জীর্ণ সেই মন্দিরের মেঝেতে ভক্ত কুকুরটাকে নিয়ে আষ্ঠেপৃষ্ঠে কম্বলমুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকবে কুঞ্জ। আমার সাড়া পেতেই লজ্জিত মুখে সে কচলে নেবে নিজের অন্ধ চোখ। তাকে বলবো, আমি এসেছি কুঞ্জ, আমাকে কালচে সবুজের বনে নিয়ে যাবে না?
কী আর করা যাবে ভেবে সত্যিই আমি পেছনের কথা ভুলে নতুন অনিশ্চিত গন্তব্যের দিকে তাকালাম। একা একটা ঘরে বন্দি করে ফেললাম নিজেকে। মা-বাবা আর দুই মেয়ে দূর থেকে এসে দেখে যায়। সময়মতো এসে খাবার দিয়ে যায় হেনা। ততদিনে স্বাদ-গন্ধবিহীন সেই খাবার খেতে খেতে আমার নিজেকে কোনো এক অচ্ছুত কারাবন্দির মতো মনে হয়। যেন আমি কাউকে খুন করে এখন ফাঁসির আসামি। রাগে শরীরটা চিড়বিড় করতে থাকে। ইচ্ছে হয় বিষের মুকুট মাথা থেকে ছুড়ে ফেলি, ধুলায় পড়ে ওটা তছনছ হয়ে যাক। লকডাউনের নামে তিন মাস ঘরবন্দি থেকেছি এখন এই সাজা ভোগের জন্য নয়। ইচ্ছে করে আগের মতো হঠাৎ ব্যাগটা গুছিয়ে হেনাকে গিয়ে বলি, চললাম যেদিকে চোখ যায়।
এমনই এক ঘোরগ্রস্ত রাতে জ্বরে পুড়তে পুড়তে আমার মনে হলো, আর তো মাত্র কয়েকদিন। এই বিষ মুকুট খুলে রেখে সেদিন সত্যিই বেড়িয়ে যাওয়ার সময় আসবে। স্টেশনে গিয়ে কোনো একটা ট্রেনে চেপে বসলেই হলো। অন্ধকার ফুঁড়ে সেই অতিলৌকিক ট্রেন আমাকে নিয়ে যাক অজানা গন্তব্যে। ভোরের ঠিক আগে নেমে পড়া যাবে ছোট কোনো স্টেশনে। ধরা যাক গাঁয়ের নামে অচেনা সেই স্টেশনের নাম চন্দনী। প্লাটফর্ম থেকে বের হলেই সুলতানের কোনো ছবি থেকে উঠে আসা পেশীবহুল এক কালো মানুষ বসেছে দোকান খুলে। সে আমার জন্য অপেক্ষা করছে মরিচা রঙের চা আর সিগারেট নিয়ে। লোকটা জানায়, একটু হাঁটলেই দেখা মিলবে এক নদীর। নাম যার অঞ্জনা। তার পাড়েই একখানা ভাঙা ফাটল ধরা মন্দিরের কোণে বাসা নিয়েছে অন্ধ কুঞ্জ বিহারী। আত্মীয় কেহ নাই নিকট কী দূর, আছে এক ল্যাজকাটা ভক্ত কুকুর। আর আছে একতারা বক্ষেতে ধরে, গুনগুন গান গায় গুঞ্জন স্বরে। দোকানের সেই লোকটি জানায়, অনেকদিন ধরেই কুঞ্জ অপেক্ষা করে আছে আমার মতো কোনো অচেনা মানুষের জন্য। সে আমাকে নিয়ে যেতে চায় দূরের এক বনে। কালচে সবুজ পাতার সেই বন আর ঝিঁঝির ডাক ওঝা হয়ে আমার শরীরের সব বিষ নামিয়ে নিতে সক্ষম। এতএব সবকিছু ভুলে অঞ্জনা নদী তীর ধরে হেঁটে চলে যাওয়া যায় কুঞ্জের কাছে। ভোরের ঠাণ্ডা হাওয়া তখনো আদর বোলাবে গায়ে। জীর্ণ সেই মন্দিরের মেঝেতে ভক্ত কুকুরটাকে নিয়ে আষ্ঠেপৃষ্ঠে কম্বলমুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকবে কুঞ্জ। আমার সাড়া পেতেই লজ্জিত মুখে সে কচলে নেবে নিজের অন্ধ চোখ। তাকে বলবো, আমি এসেছি কুঞ্জ, আমাকে কালচে সবুজের বনে নিয়ে যাবে না?
অজস্র তারাভরা আকাশ আর অন্ধকার বনবিথির মাঝে দাঁড়িয়ে কথা বলতে চাই নিজের সঙ্গে। সুমন কেমন আছ, আমাকে চিনতে পারছ?
এর মধ্যেই একটা ভাঙা পুকুরঘাটে কুঞ্জ আমাকে তার দিনপঞ্জি জানায়। কম্বলটা তাকে দান করেছিলেন ভঞ্জের পিসি। সাতকড়ি ভঞ্জের মস্ত দালান, কুঞ্জ সেথায় করে প্রত্যুষে গান। হরী হরী রব ওঠে অঙ্গন মাঝে, ঝনঝনি ঝনঝনি খঞ্জনি বাজে। তারপর দুপুর পেরিয়ে সন্ধ্যা, আসে রাত। একসময় ছায়া ছায়া অন্ধকারে আমাকে নিয়ে কুঞ্জ রওনা হবে সেই নিঝুম বনের দিকে। আমি জানি, রাতের বন এক অদ্ভূত অলৌকিক ঘোর তৈরি করতে পারে। শত সহস্র ছোট ছোট শব্দ নৈশব্দ বিভ্রান্তির মালা গেঁথে উপস্থিত হয় সামনে। অন্ধ কুঞ্জ সেসব দেখতে না পারলেও অনুভব করবে নিশ্চই। তারপর খানিকটা ফাঁকা জায়গা দেখে আমরা আগুন ধরাতে পারি। আমি আর কুঞ্জ সেই আগুন ঘিরে বসে ভাবতে পারি এমন একটা কিছু, যা জীবনানন্দ ভেবেছিলেন। যেমন এখানে বনের কাছে ক্যাম্প আমি ফেলিয়াছি। সারারাত দখিনা বাতাসে আকাশের চাঁদের আলোয়, এক ঘাই হরিনীর ডাক শুনি।
জানো কুঞ্জ, আগের মতোই কোথাও আজ হরিণ হতেছে শিকার। শিকারীরা বন্দুক কাঁধে ঢুকে গেছে বনে। আর কাজহীন কোটি কোটি মানুষ বেড়িয়েছে পৃথিবীর রাস্তায়। ভিক্ষুকটা আবার দরজায় কড়া নেড়ে বলছে, কটা টাকা সাহায্য চাই। রোগাক্রান্ত এক মাকে রাস্তায় ফেলে গেছে সন্তানেরা। সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার আগে অফিসের কেরানিটি মুখ থুবড়ে পড়েছে ফুটপাতে। মুকুট বিষে নীল এক প্রাণহীনের শেষকৃত্যটাও হয়নি, লক্ষীন্দরের মতো ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে জলে অথচ বেহুলা নেই। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্তিতে রেললাইনের ধারে শুয়ে পরা শ্রমিকদের দুমড়ে মুচড়ে গেছে ট্রেন। তাদের রক্ত মাংস আর খণ্ড খণ্ড পাউরুটি পড়ে আছে রেললাইনে। রাস্তায় পড়ে যাওয়া দুধ একসঙ্গে চেটে খেয়েছে মানুষ আর কুকুর। মর্গগুলোয় জমেছে লাশের স্তুপ, কবরখানায় ক্রমগত নতুন কবর। ভাগ্য ভালো তোমাকে এসব দেখতে হয় না কুঞ্জ। কিন্তু আমি দেখি, রোজ রোজ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আমার পড়া লাগে এইসব বিপর্যয়। তাই তো সেই বিষ মুকুট পড়েও আমি সব ফেলে পালিয়ে এসেছি বনে। আমাকে তুমি পলায়নপর বলতে পারো। তবু এখন আমার কাছে বনের এই নৈশব্দটাই পরম আকাঙ্ক্ষিত। এখানে আমি আরেকবার গভীর করে শ্বাস নিতে চাই। অজস্র তারাভরা আকাশ আর অন্ধকার বনবিথির মাঝে দাঁড়িয়ে কথা বলতে চাই নিজের সঙ্গে। সুমন কেমন আছ, আমাকে চিনতে পারছ?