হঠাৎ সুমির কথা মনে পড়ছে হাফিজের। এভাবে প্রায়ই তার কথা মনে পড়ে। খুব করে মনে পড়ে। পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে হাফিজ। স্ক্রিনে চোখ রাখে, মোবাইলটা হাতে নিয়ে একটি নম্বর অনুসন্ধান করে। নম্বরটি সুমির। সুমির মোবাইল নম্বরটি তার মোবাইলে সেফ করা আছে কি না, হাফিজ নিশ্চিত হতে চায়। হাফিজের মনে পড়ে—এবারে ঈদে সুমি তাকে নতুন একটা নম্বর থেকে কল দিয়েছিল। হাফিজ সেই নম্বরের অনুসন্ধান করে। শেষপর্যন্ত নম্বরটি খুঁজেও পায়। সেই নতুন নম্বরটি হাফিজ মোবাইলে সেভ করে রেখেছে।
সুমিকে আজ দুবার কল দিয়েছে হাফিজ। সাড়ে চার বছর সুমির বিয়ে হলেও মাঝে মাঝে সঙ্গে কথা বলে হাফিজ। কেবল হাফিজ নয়, সুমিও বলে। মাঝে মাঝে বলতেই প্রতিদিন কিংবা প্রতি সপ্তাহে না কিংবা প্রতি মাসেও না। কখনো কখনো, হঠাৎ হঠাৎ দুজন দুজনকে স্মরণ করে। সুমির সঙ্গে আজ কথা বলতে ইচ্ছে করছে খুব। দুবার কল দেওয়া হলেও রিসিভ করেনি সে। হাফিজ ভাবে কেবল সকাল সাতটা। হয়তো সুমির স্বামী ঘরে আছে। স্বামীর ভয়ে কোনো মেয়ে যতই পরিচিত হোক কিংবা অন্য কেউ তার যতই পরিচিত হোক না কেন তার কল ভীতু নারী ধরবে না—এটিই স্বাভাবিক। হাফিজ ভাবছে সুমি হয়তো তার স্বামীকে ভীষণ ভয় পায়। এই কারণে সুমি মোবাইলের কলটি এই মুহূর্তে ধরছে না।
এমনও হতে পারে, সুমি তার স্বামীকে কোনো ভয়ই পায় না। হাফিজের ভাবনা ভুল হতে পারে। সে স্বামীকে বন্ধুর মতো মনে করে হয়তো। হয়তো সুমির স্বামী মামুন তাকে মোবাইলে কথা বলার সব স্বাধীনতা দিয়েছে।
হাফিজ এবার আরেকটি চিন্তা করে এখনো হয়তো সুমি ঘুমিয়ে আছে। কয়েক মিনিট কথা বলার তাগিদে তাকে ঘুম থেকে এই মুহূর্তে জাগিয়ে না তোলাই উত্তম। হাতের মোবাইলটা হাফিজ আবার নিজের পকেটে লুকিয়ে রাখে। আজ সুমির সঙ্গে তার কথা হবে কি না—সে নিশ্চিত না।
কিছুক্ষণ পর সুমির মিসড্ কল। সুমি হাফিজকে কখনোই মিসড্ কল দেয় না। হাফিজ চিন্তা করে হয়তো তার মোবাইলে টাকা নেই কিংবা হাফিজের নম্বরটি এই কয়েকদিনের ব্যবধানে সুমি মোবাইল থেকে ডিলেট করে দিয়েছে। হাফিজ জানে সুমি এখন তার কেউই না। নম্বরটি মোবাইল থেকে যদি ডিলেট করে দেয় তাহলে হাফিজ চাইলেও সুমির কাছ থেকে কোনো কৈফিয়ত চাইতে পারবে না। সে অধিকার হাফিজের নেই। হাফিজের মোবাইলে খুব বেশি টাকা নেই। কারণ এই চারদিন সে একবারের জন্যও বাইরে যায়নি। অন্যদিন মোড়ের দোকানে গিয়ে চা খেয়ে আসে। মাঝে মাঝে দোকান থেকে শখ করে একটা গোল্ডলিফ কিনে খায়। এই কয়েকদিন চা-সিগারেট কোনো কিছুই তার ভালো লাগছে না। মোবাইলে চারদিন আগে টাকা রিচার্জ করেছিল। এখন মাত্র পাঁচ টাকা অবশিষ্ট আছে। এই টাকা দিয়েও সুমিকে কল দেওয়া যেতে পারে। সুমির মিসড কল, খুব না হোক অন্তত দুমিনিট কথা বলা যাবে। কলব্যাক করে হাফিজ।
ওপাশে সুমির কণ্ঠস্বর কে? হাফিজ ভাবে যা ভেবেছিল তাই। এই কয়েকদিনের ব্যবধানে সুমি তার নম্বরটি মোবাইল থেকে ডিলেট করে দিয়েছে। যখন কথা বলার দরকার হয়, তখন সুমি হয়তো কোথাও নম্বরটি লিখে রেখেছে, সেখান থেকেই সে নম্বরটি নিয়ে হাফিজকে কল দেয়। যেন সুমির স্বামী তার মোবাইলে হাফিজের নম্বরটি না দেখতে পায়। হাফিজ নিজের নাম বলে আমি হাফিজ মণ্ডল। নাম বলতেই সুমি চিনতে পারে।
সুমির জিজ্ঞাসা—কী ব্যাপার! আমার কথা কি মনে ছিল তোমার? হাফিজ কী জবাব দেবে, খুঁজে পায় না। কোনো কথা না বলেই সুমি এই প্রশ্ন হঠাৎ করে বলে বসবে তা হাফিজ জানত না। কিছুক্ষণ ভাবতে চায় হাফিজ। প্রশ্নের উত্তর তৈরি করে মনে মনে। এর মধ্যে হাফিজের মোবাইল কলটি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। মোবাইলে টাকা শেষ। সুমি এবার কল দিলো।
হাফিজ জিজ্ঞাসা করে—তোমার মেয়ের বয়স কত বছর? সুমি কিছুটা সময় নেয়। হয়তো এই ফাঁকে সে হিসাব করে। হাতের আঙুল গুনে গুনে মেয়ের বয়স যাচাই করে। সুমির উত্তর, তিন বছর চার মাস।
হাফিজ বলে—দ্যাখো! অনেক সময় পেরিয়ে গেছে আমাদের মধ্যে। সংসার হয়েছে তোমার, মেয়ে হয়েছে। আমার আজও কিছুই হলো না। আমি সেরকমই রয়ে গেছি।
হাফিজ ব্যাকুল হয়ে আরেকটি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে সুমিকে তোমার কি সেই দিনটির কথা মনে আছে? যেদিন আমাদের প্রথম দেখা হয়েছিল। সুমি একটু টানা নিশ্বাস নেয়। এরপর গলা একটু ভারি করে বলে—স্পষ্ট মনে আছে। থাকবে না কেন? হাফিজ বলে—আমিও কিছুই ভুলিনি। কিছুই ভুলতে পারিনি আজও।
সুমির সঙ্গে হাফিজের পরিচয় হয়েছিল বছর চারেক আগে। সুমি তার এক বান্ধবীকে কল দিতে গিয়ে হাফিজের মোবাইলে ভুল করে কল দিয়েছিল। এভাবেই পরিচয়।
দুই.
রাতের লঞ্চ চলছে শাঁ শাঁ শব্দে। হাফিজ যাচ্ছে অপরিচিত এলাকায়। মাঝরাতে নদীর বুক চিরে চলছে সে, চলছে তার লঞ্চ। এই প্রথম লঞ্চ জার্নি করা হাফিজের। গন্তব্য বরিশাল। সুমির কাছে যাওয়া। এই প্রথমবার তার সঙ্গে দেখা হবে সুমির। হাফিজ সদরঘাট থেকে সোজা চলে এসেছে লঞ্চঘাটে। একা নয়, তার বন্ধু জয়ও আছে। জয়ের কোনো ভয় নেই, কারণ এর আগেও জয় বেশ কয়েকবার লঞ্চ জার্নি করেছে। এ কারণে জয়কে বেশ উৎফুল্ল লাগছে। প্রথম জার্নি হওয়ায় মনের ভেতর কেমন যেন ভয় ভয় করছে হাফিজের। এত পানি! রাতের অন্ধকারে নদীর পানি আরও ভয়ানক মনে হচ্ছে, আগ্রাসী মনে হচ্ছে। নদীর কালো জলে হাফিজ যদি কোনোভাবে পড়ে যায় তাহলে তার উদ্দেশ্য পূরণ হবে না। কিংবা রাতের বেলা এই লঞ্চটি যদি নদীতে ডুবে যায়, তাহলে সুমির সঙ্গে দেখা হবে না আর। আজেবাজে চিন্তা হাফিজের মাথায় কিলবিল করে। মনে হয়, এই বুঝি যে তলিয়ে যাবে। ব্যাগের ভেতর সুমির জন্য একটি উপহার কিনে রেখেছে সে। সদরঘাটের মোড় থেকে এই উপহারটি কেনা। হাফিজ ভাবে, সুমির সঙ্গে দেখা হলেই সে বলবে চোখটা বন্ধ করো তো? সুমি হয়তো চোখ বন্ধ করতে একটু আধটু ভয় পাবে। ভাববে কী না কী করে বসি? হাফিজ বলবে—তোমার ডান হাতটা আগে দাও।
চোখ বন্ধ করে সুমি বলবে—আমার কেন জানি ভয় ভয় করে! হাফিজ বলবে ভয় নেই, এত ভয় ভয় করো কেন? এরপর ডান হাতের পরে তার বাম হাত। সুমি এবার নিজেই বাম হাতটি এগিয়ে দেবে। হাফিজ উপহারটা তার জন্য মেলে দেবে। সুমির জন্য ষাট টাকা দিয়ে দুই ডজন রেশমি চুড়ি কিনেছে। সারাপথ এই দুই ডজন চুড়ি সে সাবধানে রেখেছে। এই চুড়ি যেন ভেঙে না যায়।
লঞ্চঘাট থেকে নেমে হাফিজ আর তার বন্ধু সোজা হাঁটা শুরু করে। এই শহরের নাম হাফিজ কেবল মুখে শুনেছে এর আগে বহুবার। সুমি তখনো ঘুমাচ্ছে হয়তো। সুমিকে বিরক্ত করা ঠিক হবে না এই ভোরবেলায়। হাফিজ ভাবে আশপাশে কোনো আবাসিক হোটেল পেলেই সেখানে উঠবে। হাফিজের চোখের পাশাপাশি জয়ও চোখ রাখে আশপাশে। হঠাৎ চোখের সামনে তারা দেখে রাস্তার পাশে একসঙ্গে তিন চারটে আবাসিক হোটেল। হাফিজ আর জয় এরমধ্যে আবাসিক হোটেলে উঠেছে। এখন ফ্রেশ হবে, রাতের বেলা জার্নি করেছে তারা। কেমন ক্লান্ত লাগছে শরীরটা। এর ভেতর সুমিকে একবার কল করে হাফিজ। সুমি হাফিজকে জানায়—সে বারোটার দিকে আসবে। লাইন কেটে দেওয়ার আগে হাফিজ বলে—তুমি অবশ্যই সেজেগুজে আসবে। মেয়েরা সাজলে আমার অনেক ভালো লাগে। কারণ আমি সৌন্দর্যের ভক্ত। সুমি বলে—ঠিক আছে সেজেগুজেই আসব। হাফিজ ঘুমায়, একটু বিশ্রাম নেওয়া দরকার।
ঘুমের ঘোরেই সুমির ফোন। সুমি এসেছে হোটেলের সামনে। আগে থেকেই তাকে জানিয়ে রাখা হয়েছিল হোটেলের লোকেশন। সুমির পথ চিনতে কষ্ট হয়নি। হাফিজের ভয় ভয় লাগছে। না জানি সে কোনো বিপদে পড়তে যাচ্ছে। জয়কে হাফিজ বলে সুমিকে আনতে, এই বলে হাফিজ হাতমুখ ধুতে বাথরুমে চলে গেলো। জয় নির্ভয়ে নিচে নেমে গেলো। সুমি আসবে কিছুক্ষণের মধ্যে।
একটি কক্ষে হাফিজ আর সুমি। হাফিজ জানে তার বন্ধু জয় সহজে আসবে না। জয় একটু সময় নিয়েই আসবে। কারণ সে নিচে গেছে। নির্জন ঘরে প্রেমিক-প্রেমিকা থাকলে তাদের কিছুটা সময় দিতে হয়—এ কথা জয় ভালো করেই জানে। জয় এতটা নির্বোধ নয়। হাফিজ সুমির দিকে মুখ বাড়িয়ে দেয়। তার দুহাত দিয়ে সুমির কপাল চেপে ধরে।
সুমিকে হাফিজ বলেছিল—সেজে আসতে। হাফিজ ভেবেছে মুখে কিছুটা মেকআপ দেবে, ঠোঁটে দেবে চকচকে একটি লিপস্টিক, সঙ্গে লিপ লাইনার। কপালে একটি নীল রঙের টিপ। আইশ্যাডো দেবে চোখে আর চোখের পাতায় কিছুটা তরল কালি। এই হলে কোনো মেয়ের সাজতে আর বাকি থাকে না। সুমি এসবের কিছুই করেনি। যত সোনার গহনা ছিল সব পরে এসেছে সে। বাবার দেওয়া গহনা। সোনার আংটি, সোনার ব্রেসলেট, কপালে সোনার টিপ, নাকে হালকা একটা ফুল, কানে দুল, গলায় নেকলেস সেটাও সোনার। কপালে সোনার টিকলি। পায়ে রূপার পায়েল। সুমি হয়তো ভেবেছে সাজগোজ মানে এই। হাফিজ বলেছে—এভাবে সাজতে বলিনি, তুমি তো বড় রিস্ক নিয়ে এত সোনা পরে এসেছ। বাসা থেকে কেউ কিছু বলেনি? সুমি বলে—গহনাগুলো আমার কাছেই থাকে সবসময়? আমি তোমার সঙ্গে দেখা করতে আসব বলে আগে থেকে এগুলো লুকিয়ে রেখেছিলাম ব্যাগে, বাসার কেউ জানে না। সুমি বলে—সাজব যখন সোনা দিয়েই সাজব। রঙচঙ দিয়ে সাজতে আমার ভালো লাগে না।
হাফিজ পাশাপাশি শুয়ে আছে সুমির সঙ্গে। ও হাফিজের বুকে মাথা রেখে নিশ্চুপ হয়ে আছে পোষা পাখির মতো। নীরবে পড়ে আছে সুমি অন্য কোথাও নয়, হাফিজের বুকে। কিছুক্ষণ পর সুমি বলে—আমাকে কবে নেবে? হাফিজ বলে—তুমি যেদিন বলবে সেদিনই। সুমি বলে এবার যখন আসবে আমাকে সঙ্গে করে নিতে হবে।
হাফিজ বলে—আচ্ছা। হাফিজ বলে—এবার সত্যি সত্যি তোমাকে নিয়ে যাব।
তিন.
সুমির কাছ থেকে আসার পর হাফিজের আর কিছু্ই ভালো লাগছে না। কেবল মনে পড়ছে তার কথা। কেবল তাকে নিয়ে ভাবতে ভালো লাগছে। কিন্তু হঠাৎ করে সুমিকে মোবাইলে পাওয়া যাচ্ছে না। অনেকবার চেষ্টা করেছে হাফিজ। কিন্তু কিছুতেই তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হচ্ছে না। বারবার সুমির ভাবি কল ধরছে। কখনোবা সুমির বড় ভাই কথা বলছে। হাফিজ কথা বলে না। রঙ নাম্বার বলে লাইন কেটে দেয়। এভাবে সময় গেলো।
পাঁচদিনের মাথায় সুমির ফোন। হ্যালো বলতেই কেঁদে ফেলে সে। তার মোবাইলটা তার ভাবি এই কয়েকদিন কিছুতেই সুমিকে ব্যবহার করতে দেয়নি। সবসময় পাহারায় রাখা হয়েছে তাকে। সুমি যে হাফিজের সঙ্গে কথা বলতো, তা তার ভাবি কিছুটা আঁচ করতে পেরেছিল আগে থেকে।
পাত্র মামুনও কিছুটা বুঝতে পেরেছে হয়তো। হাফিজ আগেই জানে এই মামুন সুমিদের পরিচিত। সুমির বড় বোনকে বিয়ে করতে চেয়েছিল সে। কিন্তু সুমির বড় বোন অন্য একটি ছেলের সঙ্গে পালিয়ে যাওয়ায় সেই যাত্রায় বিয়ে ভঙ্গ হয় মামুনের। তবু নাছোড়বান্দা মামুন। সুমির বোনকে বিয়ে করতে পারেনি কিন্তু সুমিকে করেছে। বনেদি এই পরিবারের জামাই হওয়ার শখ তার।
সুমিকে বিয়ে করেছে সে। হাফিজকে সুমি তার স্বামীর মোবাইল দিয়ে বিয়ের খবরটি জানিয়েছে এই মাত্র। গতরাতে তার বাসরঘর হয়েছে। কিছুতেই খবরটি হাফিজের বিশ্বাস হচ্ছিল না। হাফিজের মনে হচ্ছে দূরে কোথা থেকে বিষণ্ন এক সেতার বাজছে। হাফিজের কানে আসে বিষণ্ন সেতারের টুংটাং আওয়াজ।