যে দু’জনের গল্প এটা, তাদের মিলিত বয়স বিরানব্বই। এটা বয়স বের করার পাটিগণিতের অঙ্কই। গল্প শেষে প্রেম বাদ দিয়ে হিসাব করলে আপনারা তাদের বয়স বের করতে পারবেন। আপাতত প্রেমে মন দিন। এটা প্রেমের গল্পই, প্রেমের গল্প ছাড়া আর কিছু লিখতে পারি না। আমার নিজের প্রেমের গল্পগুলো এত কমন যে অন্যদের প্রেমের গল্পে মন দিতে হলো। আর পাবো কোথা? বিরানব্বই নিয়ে আপনাদের মাথাব্যথা হচ্ছে? চল্লিশ প্লাস বাহান্ন, নাকি ত্রিশ প্লাস বাষট্টি? যেকোনো যোগ অঙ্ক করে নিন। অথবা গল্পে মন দিন, বয়সে কী-ই বা আসে যায়!
তাদের প্রেম হয়েছিল একটা বাস জার্নিতে। বাসের সিটে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দীর্ঘ পথ ভ্রমণ করলে প্রেম তো হতেই পারে, না? কিন্তু তাদের ভিন্ন ব্যাপার ঘটেছিল, একজন বাস জার্নি করছিল, অন্যজন অ্যাক্সিডেন্ট হতে পারে ভেবে চিন্তায় মরে যাচ্ছিল।
যুগলের নারীটি বাসে ছিল, পুরুষটি অফিসে। বাসটা ছাড়ার আগ পর্যন্ত তাদের প্রেম ছিল না। তাদের বন্ধুত্বও ছিল না। তারা বড়জোর পরিচিত ছিল। দেখা হয়েছে মোট তিনবার, তাও অনেক লোকের মাঝখানে। গল্পটা বেশি আগেরও নয়, সড়কে নিরাপত্তা চাই আন্দোলন নিয়ে ছোটরা যখন রাজপথ কাঁপাচ্ছিল, বড়রা যখন ভাবছিল, দেশে আরও বড় বড় সমস্যা আছে, তখনকার।
তারা দুই জন আলাদা আলাদা আমাকে গল্পটা বলেছিল। যেহেতু তাদের আমি চিনি, কাজেই তাদের বয়স কষ্ট করে বের করতে হয়নি আমার। কিন্তু অঙ্ক একটা আমাকেও করতে হয়েছিল, প্রেমের অঙ্ক। দুই জনের প্রেম চল্লিশ-ষাট, নাকি পঞ্চাশ-পঞ্চাশ। নাকি দুই জনের আলাদা আলাদা একশো-একশো।
বাসটা যেই ছেড়েছে ওমনি ফোন করেছে পুরুষটি। আচ্ছা তাদের নাম দেওয়া দরকার, না? আসল নামতো বলা যাবে না, নকল নাম বানাই চলেন। সাদাসিধা নাম, যে নামে তাদের বয়স, শ্রেণি, পেশা আন্দাজ করা যাবে না। এসব ক্ষেত্রে আমি আমার বন্ধুদের নাম ব্যবহার করি। স্বপ্না আর মারুফ, কেমন হয়? মন্দ না, কী বলেন?
মারুফ ফোন করে জিজ্ঞাসা করলো, স্বপ্না, আপনি কই? বাসে তখন ‘মে কিউ কালা রাধা কিউ গরি বাজছিল’, বললো, আমি বাসে।
বাসে কী?
শব্দ করেই হাসলো স্বপ্না, বাসে আর কী, আমি তো আর ড্রাইভার না, মন্ত্রীও না, মামুলি যাত্রী।
মারুফ বললো, মন্ত্রীরা বাসে ওঠে না কি?
বাসের গা কেটে সাঁই-সাঁই করে চলে যাচ্ছে অন্য বাস আর বাতাস, নসিমন-করিমনকে পেছনে ফেলে ছুটছে ন্যাশনাল বাস, বাসে ততক্ষণে ‘মে তেরে পেয়ার মে ঘায়েল হো জায়েঙ্গে’ গান। কথা ভালো বোঝা যায় না।
স্বপ্না বললো, কী বলেন! ওঠে না? উঠে আবার সিটেও বসে না, বাঁদুরের মতো ঝুলে থাকে।
মারুফ বললো, হ্যাঁ, দেশ এখন উন্নত হইছে, কিন্তু আপনি যাচ্ছেন কোথায়?
—যাচ্ছি না, ফিরছি, বাড়ি গেছিলাম। আপনার ব্যপার কী, হঠাৎ ফোন?
বাসে এবার ঝুমকা হারিয়ে যাওয়া গান। এরমধ্যে তিনটা গান হয়ে গেলো না? মানে কম করেও বারো মিনিট। এরা কথা তো বেশি বলেনি, বারো মিনিটের হিসাব মেলে না, স্বপ্না যখন বলছিল, আমি বারো মিনিটের হিসাব মেলাতে পারিনি।
যখন মারুফ আমাকে বলেছিল, তখন মিলেছে হিসাব। তাহলে এরা আলাদা আলাদা একশো একশো নয়। মানে একজনের কাছে শুনলে আমি কখনো বুঝতে পারতাম না যে, ব্যাপার আসলে কতটা গুরুতর।
স্বপ্নাকে আরও অবাক করে দিয়ে বললো, আপনি যে বাড়িতে গেলেন, আমাকে কেন বললেন না?
যাই হোক, বাস জার্নিতে ফিরি। বাসের শব্দে কথা ভালো শোনা যায় না বলে, তারা টেক্সট চালাচালি করতে শুরু করেছিল। নেট পাওয়া গেলে ফেসবুকের ইনবক্স আর না পাওয়া গেলে ফোনের ম্যাসেজ দিয়ে এত কথা তারা বলেছিল যে, অল্প পরিচিত দুজনের এত কথা কিছুতেই হতে পারে না।
মারুফ আমাকে বলেছিল, আমার মনে হচ্ছিল, যদি আমি ওর সঙ্গে কানেক্টেড না থাকি, তাহলে বাসটা অ্যাক্সিডেন্ট করবে। বুঝুন অবস্থা, মারুফ কবি, তাই বলে এমন বায়বীয় কথা আমার পক্ষে হজম করা কঠিন। আমি হাসি লুকাতে পারিনি।
রাজশাহী থেকে ফিরছিল স্বপ্না। চলন্ত গাড়িতে বই পড়া যায় না, গতি জড়তা আর স্থিতি জড়তার সমস্যায় মাথা ঘোরে। ফোনে চোখ রাখলে অতটা সমস্যা হয় না, ব্রেক পাওয়া যায়। কিন্তু ফোনের স্ক্রিনে চোখ রেখে মারুফের বার্তা পড়তে পড়তে তবু ঘুম পেয়ে গেছিল স্বপ্নার। সেটা মারুফকে বলতেই, না না করে উঠেছিল মারুফ, একদম ঘুমাবেন না! স্বপ্নাকে আরও অবাক করে দিয়ে বললো, আপনি যে বাড়িতে গেলেন, আমাকে কেন বললেন না?
স্বপ্না এবার বলেই ফেললো, মারুফ, কী হয়েছে আপনার?
মারুফ তখন বললো, হেড ফোন আছে না আপনার কাছে?
আছে তো, কেন?
মারুফ আমাকে বলেছিল, আমি নির্লজ্জের মতো বলেছিলাম, ওটা কানে লাগান, আপনাকে কবিতা শোনাবো।
আর স্বপ্না আমাকে বলেছিল, আমার বিরক্ত হওয়া উচিত ছিল, কিন্তু আমি খুশি হয়ে হেড ফোন কানে লাগিয়েছিলাম।
তারপর পুরো একঘণ্টা নিজের ও অন্যদের কবিতা পড়েছিল মারুফ। চোখ বন্ধ করে আধো ঘুমে-আধো জাগরণে কবিতা শুনেছিল স্বপ্না। বাসটা যখন চলনবিল পেরিয়ে এসে একটা হাইওয়ে রেস্টুরেন্টে বিরতির জন্য থামলো, স্বপ্না বললো, ফোন কাটলাম, নামবো। মারুফ বললো, আপনার কাছে পাওয়ার ব্যাংক আছে না?
—হুমম, আছে তো, কেন?
—ওটা ফোনে লাগাবেন?
এতক্ষণে স্বপ্নার মনে হলো, হ্যাঁ আধাচার্জ শেষ হয়ে গেছে। ফোনে পাওয়ার ব্যাংক লাগিয়ে বাস থেকে নামলো। হাত মুখ ধুয়ে নাস্তা খেলো, সকালে নাস্তা খাওয়া হয়নি। তাড়াহুড়া করে একটা চাও খেলো। বাসে উঠে সিটে বসতেই পাশের সিটের লোকটাও এলো। স্বপ্নার মনে হলো, এতক্ষণ যে তার পাশে বসেছিল এ সে নয়। নাকি মারুফ তাকে এতটা ব্যস্ত রেখেছিল যে, সে এক ইঞ্চিরও কম দূরত্বে বসা একটা লোকের চেহারা খেয়াল করেনি। এটা কিভাবে নিশ্চিত হওয়া যাবে যে, শুরু থেকে এই লোকই পাশে বসেছিল!
মারুফের টেক্সটের বিপ বিপ শব্দে আপাতত মুলতবি হয়ে গেলেন পাশের ভদ্রলোক। ফিরেছেন বাসে? কী খেলেন?
স্বপ্নার খুব হাসি পেলো, তার এক্স হাজব্যান্ডও খুব খাওয়া-দাওয়ার খোঁজ নিতো। রোজ দুপুরে ফোন করে জিজ্ঞাসা করতো, খেয়েছে কিনা, কী খেয়েছে! আচ্ছা মানুষসহ যাবতীয় প্রাণী তো খাবে, ঘুমাবেই, না হলে তো টিকতে পারবে না, তাহলে মায়েরা এবং প্রেমিকেরা কেন খাওয়া-দাওয়া নিয়ে এত কনসার্ন! হঠাৎ স্বপ্নার মনে হলো, আচ্ছা গাছ কি ঘুমায়? খাওয়া-দাওয়াবিষয়ক প্রশ্ন এড়িয়ে স্বপ্না লিখলো, একটা অদ্ভুত ফিলিংস হচ্ছে, বাসে ফিরে মনে হচ্ছে, এতক্ষণ যার পাশে বসে ছিলাম, এ সে নয়!
হাহাহা করে হেসে মারুফ লিখলো, আপনি ঠিক সিটে বসেছেন তো! অথবা আপনার পাশের ভদ্রলোক ভুল করে সিট আগু-পিছু করে ফেলে নাই তো!
স্বপ্না মনে মনে মারুফের বুদ্ধির তারিফ করলো, নিজের টিকিট আর সিট নম্বর চেক করলো, ঠিকই আছে! এখন পাশের লোকের টিকিট দেখতে চাইবে? এটা অভদ্রতা না? সেই সময় সুপারভাইজার সমস্যার সমাধান করে দিলেন, টিকিট নিয়ে ছিঁড়ে একপাতা রেখে বাকিটা ফিরিয়ে দিলেন। আর স্বপ্না আড়চোখে পাশের লোকের টিকিটের নম্বর দেখলো, ঠিকই আছে, ডি-টু! এখন সুপারভাইজারকে জিজ্ঞাসা করবে, এই লোকই রাজশাহী থেকে উঠেছে কিনা?
মারুফ বললো, বাদ দিন, বসে আছে থাক! আপনার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে না পড়লেই হলো! এবার শয়তানিতে পেলো স্বপ্নাকে। বললেঅ, আহা ঘুমালে ঘুমাতে দেব, বহুদিন কাঁধে মাথা রাখে নাই কেউ। মারুফ এবার দাদিমার মতো বললো, ভালোয় ভালোয় ঢাকায় ফিরে আসুন, আপনার কাঁধ আর খালি থাকবে না। স্বপ্না লিখলো, কে আমার কাঁধে সওয়ার হবে, আপনি?
জানো তো, যত বড় ক্রিমিনালই হোক, প্রেগন্যান্টদের জন্য সবার মনেই খানিক মায়া থাকে।
মারুফ হাসলো, কয়টা ইন্টারভ্যু করেছেন? চমকালো স্বপ্না! স্বপ্নার পেশাটা বলতেই হচ্ছে, যেহেতু ইন্টারভিউয়ের ব্যাপারটা এসে গেলো। স্বপ্না সাংবাদিক। কয়েকজন পরিবহন নেতার ইন্টারভিউ করতে রাজশাহী গিয়েছিল। কিন্তু এটা খুব গোপন ট্যুর। কেউ জানে না। রিপোর্টারও নয় স্বপ্না। তার অফিস বিষয়টা এতই গোপন রাখতে চেয়েছে যে, কোনো রিপোর্টার না পাঠিয়ে তাকে পাঠিয়েছে। চিফ রিপোর্টার ছাড়া অফিসের কেউও জানে না। সবাই জানে সে পারিবারিক কাজেই রাজশাহী যাচ্ছে। স্বপ্না কাজ করে ফিচার সেকশনে। মারুফের কোনোভাবেই জানার কথা নয়! অবাক হওয়া গোপন করলো স্বপ্না। বললো, করেছি কয়েকটা। মারুফ প্রশ্ন করলো, লিখেছেন? না কি এখনো অডিও?
স্বপ্না বলল, লিখি নাই।
এবার মারুফের প্রশ্ন আরও মারাত্মক, সব আপনার কাছেই, না কি অফিসে কপি পাঠিয়েছেন? মারুফ কিভাবে জানলো, এই প্রশ্ন করবে কি না, বুঝতে পারে না সে।
যমুনা ব্রিজ পেরিয়ে এসে স্বপ্না অন্য ফোনটা দিয়ে, যেটা অফিস তাকে দিয়েছে, চিফ রিপোর্টারকে ফোন করলো, আমি রাজশাহীতে কী কাজে এসেছি, সেটা খুব গোপন থাকার কথা ছিল না? সিআর আপা বললেন, হ্যাঁ তো, কেউ তো জানে না। স্বপ্না মারুফের টেক্সটের জবাবে লিখলো, লেখকদের ইন্টারভিউ অনেক বড় বড়, অডিও শুনে শুনে লিখতে সময় লাগবে।
সিআর আপাকে বললো, সম্পূর্ণ বাইরের একজন আমাকে একটু আগে জিজ্ঞাসা করেছে, কয়টা ইন্টারভিউ করেছি! সিআর আপা অবাক হয়ে প্রায় চিৎকার করে বললেন, কে জানতে চেয়েছে? স্বপ্না বললো, সেটা আমি বলবো না।
সিআর আপা বললেন, বিশ্বাস করো, আমার বয়ফ্রেন্ড মারুফ ছাড়া আর কেউই জানে না। সেদিন হলো কি, তুমি যেদিন রাজশাহী রওনা করলা, সেদিন ওর বাসায় দুই জনে খুব ড্রিঙ্ক করে আদর আহ্লাদের এক ফাঁকে বলে ফেলেছি। মারুফকে চেনো তো? ওই যে কবি, কিছুদিন হলো ওর সঙ্গে ডেট করছি। ও কাউকে বলেছে কি না, বুঝতে পারছি না। বলার তো কথা না। তোমাকে কে জিজ্ঞাসা করলো, বলবা না?
স্বপ্না বললো, না, যাই হোক বাদ দেন।
মারুফ লিখলো, কোন কোন লেখকের ইন্টারভিউ করলেন? হক, নিউটন?
না, ইয়ংদের। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্ট সব।
মিথ্যা কথা বলতে বিশ্রী লাগছিল তার।
মারুফ বলল, ওরা আপনাকে চিনে রাখে নাই তো! মুখ ঢেকে গেছিলেন?
স্বপ্না বলল, আপনার কবিতা লেখা কেমন চলছে?
মারুফ লিখলো, হেডফোন কানে লাগান, কোনো কথা বলবেন না, আমি কী বলি শুধু শুনে যান।
স্বপ্না আমাকে বলেছিল, কথা শেষ করে কেঁদেছিল মারুফ!
মারুফ আমাকে বলেছিল, কারও জন্য এমন টান বোধ করি নাই আগে।
হেডফোন কানে লাগানোর কথা শুনে বিরক্ত হয়ে স্বপ্না লিখলো, আর কবিতা শুনবো না। মারুফ বললো, প্লিজ আমার কথা শুনুন!
এবং হেডফোনের তার পেরিয়ে মারুফের কথা…। আমি জানতাম আপনি যাচ্ছেন রাজশাহী কিন্তু কবে যাচ্ছেন জানতাম না। আপনার পাশে যে লোক বসে আছে সে, পরিবহন নেতাদের কেউ। আপনি ঠিকই ধরেছেন, প্রথমে যে লোক বসেছিল, আপনার পাশে, এ সে নয়। বিরতির সময় লোক বদলেছে। আগের লোক বাসে ওঠার পর আপনাকে দেখে সিদ্ধান্ত বদলে জানিয়ে দিয়েছে, সে আপনাকে খুন করতে পারবে না। না, স্বপ্না কোনো কথা বলবেন না। চোখ বন্ধ করে গান শুনছেন এমনভাবে থাকুন। খুনিকে তারা আগে বলে নাই যে, আপনি প্রেগন্যান্ট। আমিও জানতাম না। আজ সকালে বুলা আমাকে বলেছে। স্বপ্না প্রায় প্রশ্ন করতে যাচ্ছিল, বুলা কে? তার আগেই মারুফ বললো, কথা বলবেন না। বুলা আপনাদের চিফ রিপোর্টার বনলতার ডাক নাম।
বনলতা আপা মারুফকে কী বলেছে, সেটা বলার আগে, মারুফ বললো, স্বপ্না পানি খেয়ে নেন, আমি জানি আপনি খুব শক্ত লোক, তবু।
মারুফের বয়ানে বুলার কথা একটুও শুনতে ইচ্ছে করছিল না আমার, আমাকে বলেছিল স্বপ্না। পাশে আমার খুনি বসে আছে, বাস থেকে নামলেই সে আমাকে খুন করবে, এটা জানার পর বসের বয়ফ্রেন্ডের মায়া মায়া কথা অসহ্য লাগে না?
তবু কিছু না করার চেয়ে কানের মধ্যে কেউ কথা বলছে, সেটা শোনা ভালো।
মারুফ বলতে থাকে, বুলা আজ সকালে বললো, স্বপ্না পাঁচমাসের প্রেগন্যান্ট, আর ট্র্যাজেডি দেখো, মাস তিনেক আগে ওর বিয়েটা ভেঙেছে, বর আবার বিয়েও করে ফেলেছে। আমি বলেছিলাম, ব্যাটাকে শায়েস্তা করি আসো, স্বপ্না বলেছে, থাক বাদ দেন, ওর প্রেম হয়েছে, প্রেম কি আর সময় বুঝে আসে? এ পর্যন্ত শুনে কিছুই বলি নাই আমি, তারপর বুলা যেটা বলেছে, সেটা শুনে চমকে উঠেছি। বুলা বলেছে, এত রিস্কি জায়গায় ওকে পাঠিয়েছিলাম, প্রেগন্যান্ট বলে কিছু বাড়তি সুবিধা পাবে ভেবে।
জানো তো, যত বড় ক্রিমিনালই হোক, প্রেগন্যান্টদের জন্য সবার মনেই খানিক মায়া থাকে। কিন্তু স্বপ্না করেছে কী, শ্রমিক নেতারা ইন্টারভিউ দেওয়ার সময় বলেছে, কথা টেপ করবেন না। কাগজে লেখেন, দেখাইয়া নেন। কিন্তু স্বপ্না গোপনে রেকর্ড করেছে, সেগুলা অফিসে পাঠিয়েও দিয়েছে। সেই অডিওর একটা অংশ কাল রাতে আমাদের অনলাইন ভার্সনে আপ করেছি। কাজটা ঠিক হয়নি। স্বপ্না ফিরে আসার পর আপ করা দরকার ছিল। স্বপ্নার বাস ছাড়ার আগে আগে জানতে পারি, ওকে ফলো করছে কেউ।
মারুফ বললো, নাহ, আপনার এক্স হাজবেন্ডের বউটা ভাগিয়ে নিয়ে আমি আর বুলা।
এটুকু বলার পর, মারুফ বললো, শোনেন স্বপ্না এখন আমি যেটা বলবো, মন দিয়ে শুনবেন, ফোন কাটার পর, ফোনটা বন্ধ করে ফেলবেন। আপনার বাস আরেকটা ব্রেকের জন্য টাঙ্গাইল পার হয়ে এলেঙ্গায় দাঁড়াবে। আপনি শুধু হাতের ব্যাগটা নিয়ে নামবেন, হেডফোনটা সিটে রেখে যাবেন। খুব স্বাভাবিকভাবে হোটেলে ঢুকবেন। যদি আপনার এই ব্যাগে অন্য জামা কাপড় থাকে তাহলে হোটেলের বাথরুমে গিয়ে কাপড় বদলে ফেলবেন। হোটেলের উল্টা দিকে যে ফিলিং স্টেশন আছে, ওটা থেকে আরেকটু সামনে একটা সাদা রঙের গাড়ি আছে। খেয়াল করবেন আপনার পাশের লোক বাথরুমে ঢোকা মাত্র, আপনি দ্রুত ওই গাড়িতে এসে উঠবেন। গাড়িতে আমি থাকবো।
স্বপ্না আমাকে বলেছিল, আমার মাথা ঠিকমতো কাজ করছিলো না। যখন বাস থেকে নামলাম, শরীর খারাপ লাগছিলো খুব। হোটেলে ঢুকেই বমি করলাম। ব্যাগে শুধু একটা ওড়না ছিল, গায়ের ওড়না বদলে ওটা পরলাম। বেরিয়েই দেখি পাশের সিটের লোকটা বাথরুমে ঢুকছে, আমি আস্তে করে জেন্টস টয়লেটের সামনে দিয়ে আসার সময় ওই টয়লেটের বাইরের ছিটকিনিটা আটকে দিয়ে দ্রুত রাস্তা পেরিয়ে গিয়ে সাদা গাড়িতে উঠে বসলাম। মারুফ দ্রুত গাড়ি স্টার্ট করলো, গাড়ি চলতে শুরু করলো যমুনা ব্রিজের দিকে। আমার ধাতস্ত হতে অনেক সময় লাগলো।
মারুফ আমাকে বলেছিল, স্বপ্না প্রথম কথা জিজ্ঞাসা করেছিল, আপনাকে বনলতা আপা পাঠিয়েছে? আমার তখন কান্না পাচ্ছিল, এতটাও সরল হয় মানুষ! আমি বলেছিলাম, সেটা বলতে পারলেই সবচেয়ে খুশি হতাম আমি! কিন্তু আমাকে বলতেই হচ্ছে, আপনাকে আপনার অফিস কোরবানি দিয়েছে, হইচই ফেলা একটা সিরিজ রিপোর্টের বিনিময়ে।
একথা শোনার পরে স্বপ্না আর কথা বলেনি। সিটে মাথা এলিয়ে চোখ বন্ধ করেছে। গাড়ি ছুটে চলেছে যমুনা ব্রিজ পেরিয়ে বগুড়ার দিকে, তারপর বগুড়া পেছেনে ফেলে আরও দূরে। একসময় চোখ খুলে স্বপ্না জানতে চেয়েছে, কোথায় যাচ্ছে তারা?
মারুফ হেসে জানতে চায়, খিদা পেয়েছে?
স্বপ্না বললো, না, কোথায় যাচ্ছি?
মারুফ বললেঅ, হাইডাউটে। হাইড আউটে থেকে গেরিলা যুদ্ধ করতে হবে আপনাকে, আর আমি আপনার বাবুর্চি।
সন্ধ্যার দিকে তারা কোথায় গিয়ে থামলো, জানে না স্বপ্না। ক্লান্তিতে সে আর দাঁড়াতে পারছে না। চারদিক অন্ধকারে ডুবে আছে, মারুফের হাঁকডাকে হারিকেন হাতে বুড়া একটা লোক এসে একটা ঘর খুলে দিলো, বলল, ইট্টু বাদে কারেন আসপি।
কখন কারেন্ট এসেছিল, কখন খেয়েছিল, লম্বা ঘুম দিয়ে পরের দিন দুপুর বেলা উঠে ঝাপসা মনে করতে পারে স্বপ্না।
চারমাস পর…
স্বপ্না বললো, আর কতদিন লুকিয়ে থাকবো, এবার তো ঢাকা যেতে হবে, বেবি আসার সময় হয়ে গেলো।
মারুফ বললো, একটা কথা বলবো, ঠাণ্ডা মাথায় শুনবেন?
স্বপ্না হাসে, এই লোকটা নিরীহ গলায় এমন সব সারপ্রাইজ তাকে দিয়েছে, এখন ভুমিকা করছে বলে হাসি পাচ্ছে—জি বলেন!
মারুফ বললো, আপনার এক্স হ্যাজবেন্ডের একটা চিঠি এসেছে। তিনি বলেছেন, আমি যদি বেবি হওয়া পর্যন্ত আপনার সঙ্গে থাকি আর বেবিটা আপনার কাছ থেকে চুরি করে তাকে দিয়ে দেই, তাহলে তিনি আমাকে এক বস্তা টাকা দেবেন!
আগের সারপ্রাইজগুলা ওভারটেক করেছে এবারেরটা। স্বপ্না হতবাক হয়ে প্রশ্ন করতে যাচ্ছিল, আমরা এখানে জানে সে? কিন্তু প্রশ্ন গিলে হেসে বললো, হ্যাঁ মারুফ, এই যে আমাকে উদ্ধার করে এতদিন ধরে যত্নআত্তি করলেন, বস্তাখানেক টাকা আপনার পাওনা হইছে। শুনে মারুফ হাসল হো হো করে, আর এত যে ভালোবাসলাম, সেটা?
স্বপ্না এবার দুষ্টু মেয়ের মতো বলল, সেটার জন্য আরও এক বস্তা টাকা পাওনা হইছে, মোট দুই বস্তা। এত টাকা দিয়ে কী করবেন? মারুফ বললো, তিনজনে মিলে সুইটজারল্যান্ড বেড়াতে যাবো।
চোখ টিপে স্বপ্না বললো, আমি, আপনি আর আপনার বুলা?
মারুফ বললো, নাহ, আপনার এক্স হাজবেন্ডের বউটা ভাগিয়ে নিয়ে আমি আর বুলা।
স্বপ্না বললো, আর আমার বাচ্চা নিয়ে বাপ মায়ের সুখের সংসার?
আরও আরও আড্ডা দিয়ে রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে গিয়েছিল তারা।
সকালে একটু দেরিতে উঠেছিল মারুফ। স্বপ্নাকে খুঁজে খুঁজে আবার ঘরে এসে সে বুঝতে পারলো, চলে গেছে সে।