আরিফের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে আছে। তাকিয়ে দেখতে গ্রামদেশের শীতকালের সকালবেলার খোলামাঠের কথা মনে পড়ে যায়, সেখানে দূর্বাঘাসের ডগার ওপর ফোঁটায় ফোঁটায় নিহার জমে থাকে। আরিফের ভেতরটা ছিঁড়েখুঁড়ে যাচ্ছে,সে মাত্রাছাড়া অস্বস্তিতে ভুগছে। এমনপর্যায়ে যে মনে হচ্ছে সে বোধহয় উলঙ্গপাগল হয়ে এই সমুদ্রপাড়ে আরেকটুঁ হলেই দৌড়ে ছুটতে শুরু করবে!
অসীমের সংস্পর্শে এলে ক্ষুদ্রের বোধের বিকাশ ঘটে, তাতে নিজের দুঃখকষ্টগুলোকে নিতান্ত তুচ্ছ মনে হয় এবং মন প্রফুল্ল হয়। আর এমনটা স্মরণে আসতে সে নিদ্রাহীন রাত পার করে এই ভোরসকালে সমুদ্রের কাছে আশ্রয় নিয়েছে। সাগরও তার মনের মতো বিক্ষিপ্ত আজ! ক্ষিপ্তহাওয়া দিগন্তরেখা ছেদ করে শো শো আওয়াজে তটের দিকে ছুটে আসছে ,মনেহয় যেন একনিমিশে উড়িয়ে নেবে বিশ্বধরার সমস্তকিছু। হাওয়ার তোরে শাদাফেনাভরা-ঢেউ ফুলেফেঁপে গোখরসাপের মতো ফণা উঁচিয়ে সমুদ্রতীরে ধেয়ে আসছে। হাওয়ার এমন বাড়াবাড়ি দাপটে দাঁড়িয়ে থাকা দায় হয়ে দাঁড়ায়, আরিফ বালুর ওপর বসে পড়ে। তার মাথার ওপর আকাশটাতে কয়েকখণ্ড সীসারঙা মেঘ, নীলসমুদ্রজলে ভেসে বেড়ানো বালিহাঁসের আদলে ভেসে কোন দূর অজনায় ছুটে চলেছে, কে জানে।
কয়েকবহর সাগরপাখি এই ভোরবিহানে কক কক শব্দে তার মাথার ওপর আকাশটায় অর্ধবৃত্তাকারে ঘুরতে থাকে। পুবদিকের আকাশে পিঙ্গলবর্ণ ছড়িয়ে, সূর্য কেবল ওঠ ওঠ করছে। চারদিকে ছড়িয়েছিটিয়ে থাকা এতসব অতিশয্যের মাঝেও তার মনটায় স্থিরতা ফেরে না!
সে পকেটের জঠরে হাত রাখে। প্রায় পনের বছর হয়ে এলো ধুমপানের সঙ্গে তার সম্পর্ক নেই অথচ কী মনে করে কে জানে, আজ খুব যত্ন করে সিগারেটের প্যাকেট-লাইটার পকেটে পুরে নিয়ে এসেছে। প্যাকেট খুলে একটা সিগারেট ঠোঁট চাপায় রেখে, দু’হাতে হাওয়া আটকে লাইটার চেপে ধরার মুহূর্তে মনে পড়ে যায়, এদেশে সাগরপাড়ে ধূমপান নিষেধ। সিগারেটে একফুঁক না দিতে কতসব ঝামেলায় জড়িয়ে যেতে হবে, তার কি ইয়ত্তা আছে! এদেশের অযাচিত নিয়মের ওপর মনটা নতুন করে যেন তেঁতিয়ে উঠলো। তবে মন্দের ভালো বলে একটা কথা আছে। এতক্ষণ বয়ে বেড়ানো সমস্ত উৎকণ্ঠা সিগারেটের ঘাড়ে চেপে কোথায় যেন ফুড়ুৎ করে হাওয়া হয়ে গেলো। সামান্য সময়ের জন্যে হলেও তার সমস্ত ব্যাকুলতা অন্যকূলে আশ্রয় নিলো।
সিঁদুররঙের টিপের মতো গোলগাল সূর্যটা ততক্ষণে সমুদ্রবক্ষ ছেদ করে দিগন্তরেখার ওপর দাঁড়িয়ে গেছে। সূর্যের মৃদু আলো ভোরের ঝাপসা নীলআঁধার সরিয়ে দিতে মায়ামি শহরের আধজাগা ঘুম ভাঙে। এসময়ে সাগরের ধারঘেঁষা অগণিত নানান ডিজাইন ঢঙ্গের হোটেলগুলো থেকে সমুদ্রপ্রেমীরা ছুটে আসে সাগর পাড়ে। প্রায় অনাবৃত শরীরে তাদের সাগরপাড়ের বালির পরে আধকাত হয়ে শুয়ে ফিরে প্রকৃতির এই অপারযজ্ঞে মুগ্ধ হতে দেখা যায়। ক্রমেই মানুষের ভিড় বাড়তে থাকে। আরিফ বুঁদ হয়ে থাকা সময় ছিটকে নিজের ভেতর ফিরে আসতে, মনটা সহসা আবার চৈত্রমাসের ফসলশূন্য মাঠের মতো খাঁ খাঁ করে ওঠে। সে দাঁড়িয়ে পড়ে। সাগরপাড় ধরে সম্মুখে বিস্তীর্ণ বালুরমাঠ, সেপথ ধরে হেঁটে চলে যায় বহুদূর। বালুর পথে হেঁটে চলা, সহজ কাজ নয়,অল্পতেই পা ধরে আসে। অনেকটা পথ পেড়িয়ে এসে ক্লান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। এতক্ষণে তার মনে পড়ে, সে গাড়ি পার্ক করেছে উল্টোপথে !
এই শহরে আরিফের ব্যবসাপাতি মানে দোকানপাট রয়েছে। তার নিজের বাড়িও এই কাছেধারেই। কিন্তু এই মুহূর্তে বাড়ি ফেরার একদম ইচ্ছে নেই। প্রভা, তার স্ত্রীর কাছে যে চেয়ে ধরা দেওয়ার মানে হয় না। তার মুখোমুখি পড়লে রক্ষা নেই, নির্ঘাত সে ধরা পড়ে যাবে। তার বিশেষ ক্ষমতা রয়েছে, চোখের দিকে তাকিয়ে মানুষের আদ্যেপান্ত গড়গড়িয়ে বলে দিতে পারে। কথার কথা নয়,পরীক্ষিত। এতসব ঝামেলা এড়িয়ে একটু নির্ভারে ফিরতে দোকানে চলে আসে সে।
আরিফ দোকানের স্টোরেজে ছোটখাটো একটা বিশ্রামাগার বানিয়েছে। দেশিয় মুদি-দোকানের ভেতর যেমন বাঁশেরচাঙ্গের একপাশ হয়ে শুয়ে পড়ার দেড়হাতি সাইজের একটা বিছানার মতো থাকত, ঠিক সেরকম না হলেও ধারণাটা সেই থেকে তার নেওয়া। এখন সেরকম দেশের মুদি দোকানগুলোতে থাকে কিনা তার জানা নেই তবে আরিফের ছোটবেলায় তাদের বাড়িরপাশের কাঁচা রাস্তার ধারে রফিক চাচা মুদি দোকানের পেছনটায় সে ব্যবস্থা করা ছিল, তার স্পষ্ট মনে আছে। রফিক চাচা নির্জন দুপুরে মাঝেমধ্যে তার ঝুপড়ি দোকানের ঝাঁপ অর্ধেকটা টেনে নামিয়ে, বাঁশের চাঙ্গে মরামানুষের মতো সোজা হয়ে হাত দুটো বুকের ওপর তুলে শুয়ে পড়তেন। প্রতিদিন নয়, মাঝেমধ্য্ যেদিন তার মন খুব উতলা হতো,সেদিন। যেদিন শুতেন, সেদিন ছোটদের দুপুর বেলাটায় নরকের কষ্ট এসে ভর করতো।
চাচা তাদের দিয়ে দুনিয়ার ফুটফরমাশ করাতেন-ঘটি ভরে নদী থেকে পানি আনা, দোকানের চারিপাশ পরিষ্কার করা, কাগজের ঠোঙ্গা বানানো আরও কত কী। মুজুরি হিসেবে জুটত দু’একটা করে কাঠি লজেন্স নয়তো গুটিকয় নানান রঙের টিকটিকির ডিম। আধাঝাঁপ টানা দেখলে ওদের মন খুব খারাপ হতো। ওরা নিশচুপে বাঁশের বেড়ার চৌকোনা-ফুটা দিয়ে চাঙ্গের সেই বিছানায় তাকিয়ে দেখতে, চাচার পলকহীন বিষণ্ন চোখজোড়া। মার্বেলের মতো দেখতে চোখের তারাগুলো এদিক-ওদিক ঘুরছে কিন্তু চোখদুটো স্থির হয়ে আছে ওপরের বাঁশেরচালায়। পরখ করে দেখলে নিঃশব্দ ঝুপড়িঘরে দু’চারটে টিকটিকি ছাড়া আদতে কিছুই দেখার ছিল না! তারপরও চাচা এমন অনড়চোখে কী দেখতো কিংবা কী ভাবতো, কে জানে ! কী মনোবেদনা ছিল তা ও-বয়সে তাদের জানার অধিকার ছিল না। কিন্তু আরিফের স্পষ্ট মনে আছে, চাচার কষ্টগুলো তাদের বুকে শেলের মতো ছুটে এসে ছোট্ট অবুঝ বুকগুলোকে মন কেমন করনিয়া বোধে ডুবিয়ে মারতো। এতদিন পরে চাচার সেই মনঃকষ্টেরা বোধহয় রঙচঙ মেখে তার নিজের মনে ভর করেছে। তাই যদি না হবে তো এত দূরের দেশে সেই আদলে চাঙ্গ-শোবার ব্যবস্থা আরিফ কেনই বা করে রাখবে!
আরিফ সেরকম একটা চাঙ্গ-কামরায় ঢুকে সিগারেট ধরালো। ছেলের সঙ্গে গতরাতের আলাপের বিষয়আশায় নিজমনে আওড়াতে থাকে। তার কাছে পুরোবিষয়টা কেমন গোলমেলে হযবরল মনে হয়। একবার মনেহয়; ছেলে হয়তো তার সঙ্গে মশকরা করেছে, কারণ ছেলের সঙ্গে তার সম্পর্ক কাছেরবন্ধুর মতো। ছেলে এবং মা মিলে মাঝেমধ্যে তাকে নিয়ে ঠাট্টাতামাশা করে। এটা সেরকম কিছু কিনা! সে আশঙ্কা ঝেড়ে ফেলার মতো নয়। অবশ্য সেরকম কিছু হলে তার চেয়ে সুখিমানুষের সন্ধান এধরায় পাওয়া মুশকিল হবে। কিন্তু এমনতর ঘটনা নিয়ে মশকরা হয় কী করে! ঠাট্টারবিষয় হলে শেষে তো খোলাসা করতো, সেটাও তো হয়নি। বরং ছেলের কণ্ঠ ছিল বাড়াবাড়ি রকমের রাশভারী, অনেকটা স্কুলের অংকমাস্টারের মতো সিরিয়াস। আরিফের মাথাটা কেমন এলোমেলো হয়ে ওঠে। সামর্থ্যের বাইরে যেয়ে অতিরিক্ত উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা মগজ নিতে পারে না কিন্তু এঅবস্থা থেকে বের হওয়ার পথও তো তার জানা নেই। এমন জটিল সমস্যায় তার বিগত জীবনে কখনো পড়তে হয়নি। তখনকার দিনগুলো কি এখনকার মতো জটিল ছিল! হয়তো না কিংবা হয়তো ছিল, সে টের পেতো না। কিংবা সেই বয়সটা হয়তো জটিল করে ভাবতে শেখাতো না। প্রভার সঙ্গে বিয়ের বিষয়টা কি ছেলের চাপিয়ে দেওয়া সমস্যার চেয়ে বড় ছিল না! হয়তো ছিল, কিংবা নয়; এই মুহূর্তে সবটুকু স্মরণেও আসছে না।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিষয়ে পড়তো ওরা। সাত বন্ধুর একটা দল ছিল এদের। দলছুট হয়ে ক্যাম্পাসে কেউ তাদের দেখেছে এমন ঘটনা মাস্টার্স পর্যন্ত কেউ মনে করতে পারে না। ক্লাস শেষে ক্যাম্পাসে কিংবা হলে আড্ডা জমতো। আরিফ ঢাকায় থাকতো বড় ভাইয়ের সঙ্গে মেস-বাড়িতে। প্রায়ই বেশ রাত হয়ে যেতো মেসে ফিরতে তারপরও একটা সময় পর দেখা গেলো আড্ডাটা ছেড়ে ওঠা দায় হয়ে দাঁড়াতো। একসময় তারা শেষবর্ষে এসে ভিড়লো, ক্যাম্পাস অচিরেই ছেড়ে যেতে হবে। এমন একটা সময়ে আরিফের মনে হলো, প্রভাকে ছাড়া বাকিজীবন বয়ে নেওয়া তার জন্যে সম্ভব নয়। প্রভার মনের অবস্থাও তথৈবচ। যদিও এতদিনে কেউ কাউকে বলায় প্রয়োজনবোধ করেনি।
ভিন্নধর্মের ছেলে-মেয়ের মধ্যে বন্ধুত্ব হলেও দু’পক্ষের মাঝে একটা অদেখা আব্রুবেড়া বলতে গেলে নিজেদের অগোচরে এসে দাঁড়িয়ে যায়। দু’পক্ষই মুখে না বললেও মনেমনে তা দৃঢ়ভাবে মেনে চলতে তটস্থ থাকে। যদিও এক্ষেত্রে ধর্মের চেয়ে সমাজের চোখটা যেন বেশি পাত্তা পেয়ে ওঠে। আরিফ কিংবা প্রভার মাঝে এই প্রতিবন্ধকতাকে অস্বীকার করার উপায় নেই কিন্তু একটা সময় পর বেড়াটা দু’দিক থেকেই ফাঁকা হতে শুরু করলো এবং শেষপর্যন্ত এসে বাকি কিছু রইলো না।
তারা একসময় বিয়ে করে সোজা বড়ভাইয়ের মেসে এসে উঠলো। তারপরের সমস্ত বাধাবিপত্তি অবশ্য একহাতে বড় ভাই সামলে নিলেন। দু’পরিবারের হাঁ-হুতাশ টাইপের সমস্যা সামলে ওঠা কোনো ব্যাপার ছিল না বটে। কিন্তু ওই যে সমাজ ! সমাজের চোখে এমন সমাজবিরুদ্ধ বিয়ে নিয়ে হেনস্থার পরিসীমা রইলো না। একটা সময় পর্যন্ত বিভিন্ন উৎসব আয়োজনে দেশের বাড়ি যাওয়া বন্ধ করে দিতে হয়। এরপর অবশ্য প্রাকৃতিক নিয়মে সমাজের চোখগুলো অনভ্যস্ত বিষয়ে ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। সেসব ভোগান্তির দিনগুলোর কথা এখন মনে পড়লে বড্ড আফসোস হয়। পাছে লোকে কী বলে ভেবে চমৎকার সবসময় তাকে বিদ্রূপ করে বয়ে গেছে ! এখনো কি আরিফের সে-রকম হচ্ছে না! ব্যত্যয় কী কিছু দেখা গেলো! হয়তো এইসময়ের জন্যেও তাকে মনস্তাপে দগ্ধ হতে হবে বাকিজীবনে।
মায়ামি শহর ঘুমায় না,দিনরাত কলরবে সজাগ থাকে তবে ভোর থেকে বেলা ওঠা অবধি সামান্য ঝিমিয়ে থাকে, তা বলা যায়। বেলা বাড়তে শুরু করেছে,গভীর অরণ্যে সূর্যের প্রথম আলোর স্পর্শে গাছপালা পশুপাখি যেমন ধীরেসুস্থে আড়মোড়া ভেঙে জেগে ওঠে, ঝিমিয়ে পড়া শহরটাও তেমন করে জেগে উঠছে। আরিফের প্রায় পুরো প্যাকেট সিগারেট শেষ! যার বেশিরভাগের আগায় আগুন ধরিয়ে আঙুলের দু’পাশে চেপে রেখে পুড়িয়েছে মাত্র। অনেক দিনের অনভ্যস্ত ঠোঁট স্বাদ নিতে হয়তো ভুলে গেছে, বিস্বাদ তেতো লাগে। সিগারেটের ধোঁয়া বদ্ধ ঘরটাকে পৌষমাসের ঘন কুয়াশার মতো ঢাকা দিয়ে আছে। আরিফ একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেছে, তাড়িখাওয়া লোকের মতো ঢুলুঢুলু হাতে প্যাকেটের তলানিতে পড়ে থাকা শেষ সিগারেটের মাথায় আনমনে লাইটার চেপে ধরে। দু’ঠোঁটের মাঝখানে চেপে ধরে ঠিকই তবে টান দিতে যেন ভুলে যায়। সিগারেট তার আপন মনে পুড়তে থাকে এবং ঠোঁটের কাছে পোড়া অংশের তেজ টের পেতে তার চেতন ফেরে।
এ সময় আবার বলতে গেলে হুট করেই ছেলেটার কথা স্মরণে আসে। একদিন এমন করে জ্বলন্ত সিগারেট ঠোঁটে চেপে মরতে বসেছিল ও। তখন আরিফের ধূমপানের কড়া অভ্যাস ছিল, একটার পশ্চাদ্দেশ দিয়ে আরেকটা ধরাতো, এতটা। একদিন হুট করেই সে সিগারেট ছেড়ে দিলো। ছেলেটার বয়স তখন অল্প, প্রাইমারীতে সবে ভর্তি হয়েছে। স্কুলে শেষে আরিফ তাকে তুলে দোকানে নিয়ে আসে। প্রভা, কাজ শেষে ছেলেকে দোকান থেকে নিয়ে বাসায় ফিরে যায়। সবেমাত্র ব্যবসাটা শুরু হয়েছে। মাথার পরে হাজারটা চাপ। চাপ কমাতে সিগারেট ফোঁকা, সিগারেট মানসিক চাপ কমায়; এসব প্রচলিত কথায় সত্যমিথ্যের মিশেল থাকলেও, সিগারেটের দৌলতে জীবনঝঞ্চাট ভুলে থাকা যায়, এটাতে একফোঁটা মিথ্যে নেই। সেই হিসেবে সারাক্ষণ তার ঠোঁটে সিগারেট ঝোলে। তো ছেলে দোকানে ঘণ্টাখানেক তার পেছন পেছন ঘুরঘুর করে। জরুরি কাজে আধ-খাওয়া সিগারেট স্টোররুমের টেবিলে রেখে সে দোকানের সামনে আসে। সেই ফাঁকে ছেলে সিগারেট নিজের ঠোঁটে চেপে নেয়। ওইটুকু বয়সে তার বোঝার কথা নয়, সিগারেটের কোন অংশ বাইরে থাকবে কিন্তু সে জ্বলন্ত অংশ ঠোঁটের বাইরে রেখে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সিগারেট পুড়ছে এবং তার ঠোঁট স্পর্শ করার মুহূর্তে আরিফের স্মরণ হয়। সে দৌড়ে আসতে ছেলেটা রক্ষা পায়। ভয়ানক এক বিপদ দোরগোড়ায় এসে ফিরে গেলো।
আরিফ এতদিনে এখানে আছে কিন্তু তার চোখে কাক খুব একটা পড়েনি অথচ আজ কিনা অবিকল সবপ্নে-দেখা দাঁড়কাকটার মতো একটা কাক অবিরত কা কা শব্দে ডেকেই যাচ্ছে।
আরিফ সেইঘটনায় সিগারেট ছাড়লো! প্রভা ভেবেছে তার কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিল,ছেড়ে দেবে, তাই দিয়েছে। ওদিকে তার ডাক্তার তাকে নিষেধ করেছেন সেটাও একটা কারণ, অনেকে তা মনে করেছে। কিন্তু সে খোলাসা করে কাউকে কিছু বলেনি কিংবা যেকোনো বিষয়ের কারণ তার কাছে গুরুত্ব বহন করে না, এসবের বাড়তি পাত্তা তার কাছে নেই। তার এমনই স্বভাব। আজকের সমস্যাটাও বলতে গেলে তার বেখেয়ালিপনার খেসারত। ছেলেটা হার্ভার্ড-এ ল’ পড়ছে। এমন না যে, সে খুব একটা বদলে গেছে। সে আগের মতো আছে তাতে সন্দেহ নেই কিন্তু গত ক’দিন আগে কিংবা তারও আগে ছুটিছাটায় যখন বাড়ি আসল, তাকে কী সব যেন বলছিল। আরিফ স্বভাবমতো সেসব এড়িয়ে গেছে, ভেবেছে কথার কথা। আদতে ছেলে তাকে কৌশলে মনেরকথাটি জানিয়ে গেছে। এখন এই মুহূর্তে, এই ধোঁয়াভরা দমবন্ধ কক্ষটিতে বসে সেসব যেন নাটাইয়ে সুতা ছাড়ার মতো ফড়ফড় করে মস্তিস্কখোঁড়ল ছেদ করে বেরিয়ে আসছে। এখন কত কথাই মনে পড়ছে। এই যেমন, প্রভার এক কাছের আত্নীয়ের ছেলে এদেশে পড়তে আসল। বয়স আরিফের ছেলের দু’এক বছরের এদিকসেদিক হবে, হয়তো। স্বাভাবিকভাবে সেই ছেলের দায়িত্ব প্রভার উপর পড়ল। ছুটিছাটায় সে তাদের বাড়িতে চলে আসে। অল্পকদিনে তাদের সঙ্গে ছেলেটার একটা চমৎকার সম্পর্ক দাঁড়িয়ে যায় বিশেষ করে প্রভা, নিজের ছেলের কাতারে তাকে খুব সহজেই তাকে জায়গা করে দেয়। ছেলেটাও বেশ অমায়িক। ছেলের দাদা স্বাধীনতা যুদ্ধে শহিদ হয়েছেন। এমন শহিদপরিবারের ছেলে শেষে কিনা পাকিস্তানী এক সহপাঠীর প্রেমে পড়ল। প্রভা বহু চেষ্টা করেও ছেলেটাকে সেসম্পর্ক থেকে সরাতে পারল না। ছেলে অবশ্য তার স্বপক্ষে কড়া যুক্তিসাপদ দাঁড় করাল। এই যেমন- দিন বদলেছে, এসব এখন অহরহ হচ্ছে। তাছাড়া পাকিস্তানী সরকার-মিলিটারি আর সাধারণ মানুষ এক বিষয় নয়। সেদেশের সাধারণ মানুষ এই হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে মিছিল মিটিং পর্যন্ত করেছে। ছেলেটির মুখে এমন ছেঁদোকথা শুনে আরিফ খুব কষ্ট পেয়েছিল, এখনো মনে পড়লে বুকটায় মৃদু হাওয়ায় বাঁশপাতা যেমন ঝিরঝিরিয়ে কেঁপে কেঁপে উঠে তেমন করে কেঁপে ওঠে। প্রভা অবশ্য এরপরে এপ্রসঙ্গে টুঁ শব্দটি পর্যন্ত করে করেনি। সে যখন কিছু নিয়ে খুব কষ্ট পায়, একদম চুপ হয়ে যায়। তারপর থেকে সেই ছেলের সঙ্গে যোগাযোগ তো দূরে থাক এবাড়িতে তার নামও উচ্চারিত হয় না।
এতদিন পর এবার বাড়ি এসে তার ছেলে বিনাপ্রসঙ্গে সেই ছেলেটার কথা তুলল। ছেলের সঙ্গে ওর নিয়মিত যোগাযোগ হয়। ছেলেটা নাকি পাকিস্থানি সেই বান্ধবীকে বিয়ে করে নির্দ্বিধায় সংসার পেতেছে এমনকি দেশে বউ নিয়ে ঘুরে এসেছে। অবাক করা বিষয় হলে: সেই ছেলের পরিবার নাকি তাকে সাদরে বরণও করেছে। তখন প্রসঙ্গ অপ্রাসঙ্গিক মনে হলেও আরিফ এখন অনেককিছুই মিলিয়ে নিচ্ছে। প্রভার অনুপস্থিতিতে ছেলে তাকে কত কী ইশারা ইঙ্গিত করলো অথচ সে কিছুই গায়ে মাখেনি!
বাইরে প্রাণচাঞ্চল্য বেড়েছে। সময় ক’টায় গড়াল আরিফ জানতে পারছে না কারণ ফোনটা গাড়িতে রয়ে গেছে। তবে বাইরের কোলাহলে আন্দাজ করা যায়, বেলা বেশ গড়িয়েছে। দোকানের যে ছেলেটি এই কামরাটিতে ঘুমায়, সে বোধহয় আজ অন্যকোথাও রাত কাটিয়েছে। বিছানারকোণে ভাঁজকরা কাঁথাবালিশ পড়ে আছে। ছেলেটি বহুকষ্টে বলা যায় যমদূতের সঙ্গে যুদ্ধ করে করে অবশেষে আমেরিকায় ঢুকেছে। অবৈধ উপায়ে আমেরিকাতে ঢুকে বেশিরভাগ মানুষ নিজেকে কলম্বাসের কাতারে ভাবতে শুরু করে। অল্পসময়ে বন্ধুবান্ধব জুটিয়ে, মইজমাস্তিতে মেতে থাকার অভিনয় করে এবং স্বর্গজয়ের সেই চরম উন্মাদনায় খেই হারিয়ে মিথ্যেগল্প তালঠোকা কায়দায় ভিডিও কলের মাধ্যমে নিজদেশে কাছেরজনদের কাছে প্রচার করে ফেরে। পরিবার,বন্ধুবান্ধব ওসব দেখে পুলকিত হয়। এবং তার স্বর্গসুখে ভাগ বসাতে বিভিন্ন ফন্দিফিকির খোঁজতে থাকে। বছর না ঘুরতে অবধারিতবাস্তবতা তার ঘাড়ে পোক্তভাবে চেপে বসতে,নানান দুর্দশায় জীবন মাকড়ের আঁশের মতো জড়িয়ে যায়। ওদিকে দেশের মানুষের চাহিদা যা কিনা তারই কর্মের প্রায়শ্চিত্ত মেটানো, এদিকে নিজের কাজ, কাগজপত্রের বেহাল দশায় জীবন অনেকটা কাদায়ডুবা হস্তীর মতো বেকায়দাময় হয়ে পড়ে।
কিন্তু এই ছেলেটা ব্যতিক্রম। মনদিয়ে কাজ করে,আলগা আমুদ-ফুর্তিতে নেই। আরিফকে বড়ভাইয়ের মতো সম্মান দেয়। আরিফও ছেলেটাকে একটু বেশিই প্রশ্রয় দেয়। নিজের ছেলের বয়সী ছেলেটা, দেখলেই মনটা কেমন করে। ছেলেটার পরিচিত এখানে কেউ আছে বলে মনে হয় না। তাহলে সে কোথায় রাত কাটাবে ! মায়ামি শহরে রাত কাটানোর মতো জায়গার অভাব নেই। সারাদুনিয়ার ধনী মানুষজন এখানে এসে আমুদপ্রমোদ করে। যারা একজীবনে এইশহরে পা রাখতে পারে না; তাদের আক্ষেপের শেষ নেই ওদিকে আবার এমন শ্রেণীও আছে; এখানে স্বছলভাবে থেকেও দিবারাত্র অনুতাপের আগুনে পুড়ে ছাই হচ্ছে এই যেমন আরিফ নিজে! আসলে মানুষের খেদের শেষ নেই! তবে তাকে এই মুহূর্তে দোকানের এই ছেলেটার জন্যে উদগ্রীব হতে দেখা যায়।
আরিফ কাঁথাবালিশের স্তূপে পিঠ ঠেকা দিয়ে রফিক চাচার ন্যায় উদাস হয়ে ছাদ বরাবর তাকিয়ে থাকে। ছাদে ফুটো নেই তবে বাঁ দিকে একটা বন্ধ কাঁচঘেরা জানালা আছে। ঘরটাতে এই একটামাত্র ছোট্ট জানালা- গয়নানৌকার পেট বরাবর যেমন ছোট্ট একটা খাঁজকাঁটা জানালা থাকে দেখতে অনেকটা সেরকম। ওইটুকু জানালা দিয়ে বিস্তর আকাশের একখণ্ড চোখে পড়ে। আকাশ অতিরিক্ত নীল, চোখ ঝলসে যাওয়ার মতো রং। সেই নীলসমুদ্রে শাদা ধবধবে বকের মতো সাগর পাখিরা ছুটোছুটি করছে। আরিফের চোখদুটো সেদিকে স্থির হয়ে থাকে। রাতজাগা ক্লান্ত পরিশ্রান্ত চোখ দুটোতে রাজ্যের ঘুম জমে আছে এবং আলগোছে চোখ বুজে আসে।
সবে ভোরের নীলচে আলো ফুটতে শুরু করেছে। প্রভার মা পুকুরে স্নান শেষে, পাড়ে যেই উঠতে যাবে একটা কালো কুচকুচে বিড়াল হুট করে এসে তার পথ আটকে দাঁড়িয়ে যায়। সে খুব করে চমকে ওঠে। একটা বিড়াল, সামান্য একটা বুনোবিড়াল,যা কিনা গ্রামদেশে অহরহ ঘুরে বেড়ায়,তা দেখে এমনহারে ঘাবড়ানোর কোনো কারণ নেই। তারপরও মনটা কেমন ছ্যাঁত করে উঠল। সময়টা যে ভালো না, সারাক্ষণ বুকটা কেমন দুরুদুরু কাঁপে। শাড়ির ভেজা-নেত্যানো আঁচলটা কোনমতে টেনেটুনে কপালের অগ্রভাগ অবধি তুলে নিয়ে চটজলদি বাড়ির পথে পা বাড়ায় সে। বাড়ি নাই ফিরতে ঘটে আরেক বিপত্তি, অঘটন। সিঁদুরের কৌটোটা হাত ফসকে উপুর হয়ে কোলের ওপর পড়ে যায়। শাদা শাড়িটা চন্দনের লাল টকটকে রঙে গোধলিবেলার আবীরমাখা আকাশের মতো হয়ে ওঠে। মনটা এবার তার পুরোদস্তুর বিবশ হয়-কপালে কোন ফাঁড়া আছে, কে জানে !
তার একটুপরে বাহির-বাড়িতে মানুষের ফিসফাস কানে আসে, এত সকালে সাধারণত কেউ কারও বাড়িতে বিপদে না পড়লে আসে না,তাও আবার দেশের এমন দুর্দিনে। সে বিড়ালপায়ে বন্ধ জানালার ফুটু দিয়ে বাইরে তাকায়। এই বরাবর তাকালে বড়ো ভাসুরের ঘরটা স্পষ্ট দেখা যায়। সেদিকে চোখ রাখতে- ক্ষুধার্ত সিংহের সামনে পড়ে হরিণশিশুর যেরূপ দশা হয় ঠিক তেমন,সে অনায়ত্ত-নিঃসহায় হয়ে পড়ে ! কোনমতে অসাড় পা দু’টোকে টেনে বিছানার রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে থিরথিরিয়ে কাঁপতে থাকে। এরপরই শুরু হয় দরজায় সজোরে লাথি, আঘাতের জেরে ঘরটা খেলনা ঘরের মতো কেঁপে কেঁপে ওঠে,এতটাই জোরে যে মনেহয়ে যেন ঘরটা বুঝি হুরমুড়িয়ে মাথার পরে ভেঙ্গে পড়ল। প্রভার বাবা ঘুম থেকে ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসেন।
গভীর ঘুমের মানুষটা কিছুই আঁচ করতে পারে না। চোখের সামনে স্ত্রী কাঁপছে, সে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। লাথির চোটে দরজার একপাশের কবজা ঝনঝন শব্দে ভেঙ্গে পড়ে। দু’জন খাকিপোষাকের লোক ভাঙ্গা দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে। প্রভার বাবা বিস্ফোরিত চোখে তাকায়, তার মাথা এখনো কাজ করছে না। এরপর কেউ একজন দরজাটাকে একপাশে টেনে সরিয়ে দিয়ে ঘরে প্রবেশ করে। তার চোখমুখ কালোকাপড়ে ঢাকা কিন্তু প্রভার মা তার শরীরের অবয়ব দেখে স্পষ্ট চিনে ফেলে। গতবছর স্কুল পাশ করল ছেলেটা। গরীবঘরের ছেলে- তার ভাসুর নিজখরচে ছেলেটিকে পড়িয়ে স্কুল পাশ করিয়েছে। সেই ছেলেটি হাতের ইশারায় প্রভার বাবাকে দেখাতে- খাকিপোষাকের লোকেরা একঝটকায় চিলের মতো ছু মেরে তাকে টেনেহেঁচড়ে এবং পেছনে ধাক্কা দিয়ে উঠোনে নিয়ে ফেলে। তার কপাল ফেটে দরদরিয়ে রক্ত ছুটে। ততক্ষণে প্রভার জ্যাঠা, স্থানীয়স্কুলের অংক শিক্ষকেও দু’হাত পেছনে বেঁধে উঠোনে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়।
শরৎকাল। ইছামতী নদীর কিনারা অতিরিক্ত প্যাঁককাদায় মাখামাখি হয়ে আছে। নদীর পানি শুকিয়ে তলানিতে নেমে গেছে। গাঁয়ের ছেলেপুলেরা এই সকালবেলায় ওঁছা বেঁয়ে গুঁড়ামাছ ধরে গেছে- যাদের পায়ের ছোটবড় ছাপ, ওঁছার খাঁজকাঁটা ছোপছোপ ছাপ এখনো কাদায় মিলিয়ে যায়নি। প্রভার বাবা-জ্যাঠাসহ চল্লিশজন লোককে পাকিস্থানি মিলিটারি এককাতারে সেইখানে দাঁড় করাল। এরা প্রায় সবাই শেষরাতের ঘুমে বিভোর ছিল তাদের চোখেমুখে এখনো তার চিহ্ন লেগে আছে। কেউ পরনে ধুতি, কেউ লুঙ্গি, কারো শরীরে বগলকাটা গেঞ্জি দেখা গেলেও বেশিরভাগের উপরের অংশের কাপড় সিথানে রয়ে গেছে। এদের কাপড় পরা তো পরেরবিষয় প্রিয়জনের চোখে শেষবারের মতো চোখ রাখার সুযোগ দেওয়া হয় নাই। নানান ধরনের লোকজন, ছাত্র, শিক্ষক,মাঠেঘাটে, খেতখামারে খেটে-খাওয়া সাধারণ মানুষ।
প্রত্যেকের হাত শক্ত করে বাঁধা, কালোমুখোশ পরা দু’জন লোক এরপর এক এক করে এদের চোখে কালোকাপড় জড়িয়ে দেয়। প্রভার জ্যাঠার পালা আসতে সহসা তিনি হুহু করে কেঁদে উঠলেন। তিনি পাথরের মতো শক্তমনের মানুষ, সে কিনা কাঁদছে! তবে মৃত্যুভয়ে নয়, কৃতকর্মের মনস্তাপে দগ্ধ হয়ে! লোকটা অত্র এলাকার অংকের শিক্ষক, অত্যন্ত মান্যলোক- মনটা শামুকের ভেতরের অংশের মতো নরম তুলতুলে। ছাত্রদের কথা আমলে নিয়ে আজঅবধি অকৃতদার রয়ে গেছেন। কড়া শিক্ষক, ছাত্রদের বেতের প্রহারে অংক শেখাতেন এরপর নিজেই কেঁদেকেটে অস্থির হতেন। একহাতে চোখের পানি মুছতেন অন্যহাতে ছাত্রদের ব্যথার অংশে মলম ঘষে দিতেন। নিজ বেতনের বেশিরভাগ অংশ চলে যেত গরীবঘরের ছেলেপুলেদের পড়াশুনার পেছনে। সেরকম একজন ছাত্র, তার বড়ো স্নেহের, নিজ খরচে নিজহাতে মানুষ করছেন-সেই ছেলে তার চোখ বেঁধে দিতে আসলে তিনি বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন। নিজ পুত্রের আসনে যাকে বসিয়ে রেখেছেন সে কিনা অনায়াসে তাকে খুন করতে উদ্যত হয়েছে! তার নিজের উপর ঘৃণা জন্মাল, এ পরিতাপের যে শেষ নেই! তিনি বিমর্ষচোখে ছাত্রের দিকে তাকিয়ে রইলেন, ছাত্রেরমুখ মুখোশে ঢাকা; অভিব্যক্তি বোঝা গেলো না!
একসঙ্গে উনচল্লিশজন জলজ্যান্ত লোক সেদিন ইছামতীপাড়ে শহিদ হয়। তাদের লাল টকটকে রক্ত কাদাজলের সঙ্গে মিলেমিশে গড়িয়ে পড়ল নদীর স্রোতহীন জলের পরে। প্রভার মায়ের সিঁদুরে লেপটে যাওয়া শাদাশাড়িটা যেন হয়ে উঠল ইছামতীর বুক। লাল রং ছড়িয়ে পড়ল সর্বত্র; নদীর জলে, কাশফুলের গায়ে,আকাশে বাতাসে কোথায় নয় ! শরতের ছোপছোপ শাদামেঘেরা আকাশের বুকে উড়োউড়ি ভুলে যেয়ে জড়ীভূত হল। বহুদূর হতে হাওয়ায় ভর করে শিউলিফুলের সুবাস নদীতীরে মম করতে লাগল। সেসময়ে চারদিকের নিস্তব্ধতা ভেঙ্গেচূড়ে গুঁড়িয়ে দিয়ে কোথা থেকে একটা দাঁড়কাক শিয়ালের মতো কর্কশ স্বরে ডেকে ডেকে উড়ে আকাশের বহুদূরের কোণায় যেতে ক্ষুদ্র হতে ক্ষুদ্রতর হয়ে মিলিয়ে গেলো।
এ পর্যায়ে আরিফের স্বপ্নটা ভেঙ্গে যায়। সে ধরমড়িয়ে লাফ দিয়ে টঙয়ের বিছানায় উঠে বসে। এসি’র যমশীতল ঠাণ্ডাও তার ঘাম সামাল দিতে পারে না,ভিজে চুপচুপা হয়ে যায়। তন্দ্রা-জাগরণের মধ্যিখানে হুঁশ করতে পারে না- স্বপ্ন নাকি বাস্তব। জানালার ওপাশে দেবীদুর্গার একাধিক হাতের মতো অগণিত ডালপালা মেলে ধরে দাঁড়িয়ে থাকা ওকগাছের-ডালে বসে একটা কাক অবিরত সেই একই স্বরে ডাকছে। আমেরিকাতে সচরাচর কাক দেখা যায় না, সংখ্যায় খুব কম। আরিফ এতদিনে এখানে আছে কিন্তু তার চোখে কাক খুব একটা পড়েনি অথচ আজ কিনা অবিকল সবপ্নে-দেখা দাঁড়কাকটার মতো একটা কাক অবিরত কা কা শব্দে ডেকেই যাচ্ছে।
পুবদিগন্তের রংধনুর রেখাগুলো আরও স্পষ্ট আরও স্বচ্ছ পরিষ্কার হয়ে ফুটে উঠেছে, এমন চমৎকার দৃশ্য এজীবনে তার দেখা হয় নাই।
স্বপ্নটা হয়তো আর দশটা স্বপ্নের মতো ভ্রম বলে উড়িয়ে দেওয়া যেত নির্দ্বিধায়, কিন্তু আদতে এঘটনা উনিশএকাত্তর সালে প্রায় হুবহু প্রভার পরিবারে ঘটে গেছে। প্রভার কাছ থেকে আরিফ এ কাহিনী বহুবার শুনেছে। সেসময় প্রভার বয়স মাত্র চার।
বাস্তবে অবশ্য মেশিনগানের গুলিতে উনচল্লিশজন লোক একবারে মারা পড়ল না। বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে নাড়িয়ে দেখা গেল, কেউ কেউ বাঁচামরার মধ্যিখানে পায়ে-দলা একপাল পিঁপড়ের মতো দলা পাকিয়ে আছে। এককাতারে দাঁড়ালেও দেখা গেল গুলি কারো হাঁটু ভেদ করে গেছে, কারো বুক কিংবা পেট চিরে বের হয়েছে, কারো আবার মাথা বরাবর যেয়ে সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু হয়েছে। তীব্র যন্ত্রণায় মরারপথের মানুষগুলো কাতরাচ্ছে কিন্তু দমটা তখনও শরীরে ভর করে আছে। এরপর আরও কয়েক কিস্তিতে গুলি করে তাদের মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়।
প্রভার বাবা, প্রথম গুলি শুরুর পূর্বমুহূর্তে তীব্র আতঙ্কে মূর্ছে কাদায় লুটিয়ে পড়ে এবং এর সঙ্গে সঙ্গেই গুলি শুরু হয়। ব্যাপারটা এত দ্রুত ঘটে যায় যে, সে কারো নজরে পড়ে না। তার শরীরটা মৃতদের স্তুপে প্যাঁকের ভেতর গুঁজে আধমরা হয়ে পড়ে থাকে। এঘটনার পর সে আরও বিশবছর মরার মতো অথর্ব,মূঢ়, মূক হয়ে বেঁচে ছিল। প্রভা এবং তার পরিবার আজও বুকের উপর সেই কঠিন চাপ বয়ে নিয়ে চলেছে।
প্রায় দুপুর গড়িয়েছে। দোকানে লোকজনের কোলাহল কানে আসতে আরিফ কক্ষ থেকে বের হয়ে রাস্তায় নেমে আসে। ব্যস্ত শহর,চারপাশে বড্ড বেশি শব্দ এবং ক্রমেই তা গতিশীল হচ্ছে। সে গন্তব্যহীন পথে দলছুট পাখির মতো একা একা হাঁটতে শুরু করে। পথঘাটে পা ফেলার জো নেই। মায়ামীর রাস্তায় দুপুর না হতে কতোপ্রান্ত থেকে কতো যে গাড়ির বহর ছুটে আসে, যার কোন হিসেব নেই। রাস্তায় জ্যাম, গাড়িগুলো যুদ্ধের ময়দানে নিহত সৈন্যদের মতো এককাতারে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কবেদিনে এই জ্যাম খুলবে, কে জানে ! ফুটপাত দিয়েও মানুষের ঢল। সবাই ছুটছে সাগর ছুঁতে। দুনিয়ায় এত সাগর মহাসাগর থাকতে তাবৎ দুনিয়ার ধনীরা কেনো এই পাড়ে ছুটে আসে, আরিফের মাথায় ঢুকে না। ঘামজ্যাম এড়িয়ে অবশেষে সামান্যপথ আধঘণ্টায় পেরিয়ে সে সমুদ্রতীরে এসে পৌঁছে।
সকালের সঙ্গে এসময়ের সমুদ্রের বিস্তর তফাৎ।
সময় গড়াতে মানুষের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পাখিদের আধিক্যও বেড়েছে। দলবেঁধে পাখিরা পানিতে মনেরসুখে ভেসে বেড়াচ্ছে- দূর থেকে মনে হয় যেন কচুরিপানার মতো জলজ গাছলতারা ঢেউয়ের তোরে ভাসছে। পানির খুব কাছাকাছি আকাশে উড়োজাহাজের মতো পাখা স্থির রেখে উড়ার দলও সংখ্যায় কম নয়। কিছু সাহসীপাখি একটু জিরিয়ে নিতে বালুর পরে মানুষের কাছাকাছি নিশ্চিন্তমনে বসে আছে। ঢেউয়ের প্রাণচাঞ্চল্য সহসাই যেন অনেকটাই কমে গেছে- অন্ততঃ সকালের থেকে তো অবশ্যই। পূবদিকে যেখানে সূর্য- উঠার আগে আবীররঙের ছড়াছড়ি ছিল সেখানটাতে এখন এই মধ্যদুপুরে মোষেরপালের মতো মেঘেরা স্থানু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মেঘপাহাড়কে মনে হচ্ছে যেন জলছাপা শাড়ির ধূসর আঁচল, নির্ভাবনায় ঝুলে আছে বাড়ির ছাদের রেলিং এ। একসময় দিগন্তের কাছটায় ধূসর রং ঘন কালো হয়ে আসে। সেই ঘনকালো মেঘপাহাড়ে ঘন ঘন বিজলিবাতি অনেকটা আতশবাজির আদলে জ্বলে ওঠে।
আরিফ বালুর ওপর বসে অনেকের মতো সেই অপার মুগ্ধ সৌন্দর্যে চোখ রাখে। সেসময় দিগন্তের ধূসর মেঘপাহাড় ফুটো করে প্রকাণ্ড ভ্রমণতরী রাজহাঁসের মতো গলাপেট উঁচিয়ে তীরের দিকে ছুটে আসতে থাকে। এর সঙ্গে সঙ্গেই জলছাপার আঁচলটা ঝরঝরিয়ে খসে পড়ে সাগরের বুকে। মেঘ ঝরে পড়তে সাগরে হাওয়া বাড়ে, সমাতালে ধেয়ে আসে ঢেউ। এদিকটায় অবশ্য তখনও রোদ, মাথার উপর বিছিয়ে থাকা আকাশটায় মেঘের বিন্দুমাত্র আভাস নেই। থরে থরে টুরিস্ট শুয়ে আছে সাগরপাড়ে, রোদপোহায়। আরিফ এসময় উঠে দাঁড়ায়,পাড় ধরে হাঁটতে শুরু করে। পায়ের সঙ্গে জড়িয়ে যাওয়া ঝিনুক কুড়িয়ে বুকপকেটে জমিয়ে রাখে। ছোট একটি মেয়ে বড়দের চোখ ফাঁকি দিয়ে দৌড়ে নামে সাগরজলে। মুহূর্তে পেছন থেকে বাবা এসে ঝাপটে ধরে ফেলে মেয়েকে! দূর দিগন্তরেখা ছুঁয়ে রঙধনু জেগে উঠেছে। এদেশে বড়োছোট সবার কাছে রংধনুর বেশ কদর।
সাগরতীরে ছড়িয়ে থাকা খণ্ডখণ্ড সুখের এতসব দৃশ্যগুলোকে এমুহূর্তে তার কাছে বিস্তর বিলেরজলে ফুটে থাকা পদ্মফুলের মতো মনে হয়। দু’হাত ভরে যার যতো খুশি তুলে নিতে একবিন্দু বাধা নেই। প্রকৃতি সদয়ে উজাড় করে বিছিয়ে দিয়েছে অফুরন্ত সুখেরডালা। এতসব সুখের মাঝে সে গতরাতের সবকিছু ভুলে যায়। ছেলে বলেছিল, ‘বাবা, মাকে বুঝিয়ে রাজি করাও, আমি আমার পাকিস্থানি বান্ধবীকে বিয়ে করতে চাই।’ ঘুম হারাম করে মস্তিস্কের খোঁড়লে বিচ্ছুর মতো ঠুকরে ওঠা সেই নিষ্ঠুর বাক্যটিও সে এইমুহূর্তে ভুলে যায় কিংবা ভুলে থাকতে চায়! তার মনের অবস্থা এখন শান্ত স্থির অনেকটা বরফগলা নদীর মতো স্নিগ্ধশীতল। এমুহূর্তে চোখের সমূখে কতো মধুময়সব দৃশ্য; সেই ছোট্টমেয়েটি এবার নিরুদ্বিগ্ন আসন-বাবার কাঁধে চড়ে বসেছে। সাগরে হাওয়া বেড়েছে, বিশাল বিশাল ঢেউ আছড়ে পড়ছে তীরে, মেয়েটি ঢেউয়ের ছোঁয়ায় অতিরিক্ত আনন্দে চিৎকার করে উঠছে। আরিফ শিউলিফুলের মতো ঝকঝকে শাদারঙের ঝিনুক তুলে দু’হাত ভরিয়ে ফেলে। পুবদিগন্তের রংধনুর রেখাগুলো আরও স্পষ্ট আরও স্বচ্ছ পরিষ্কার হয়ে ফুটে উঠেছে, এমন চমৎকার দৃশ্য এজীবনে তার দেখা হয় নাই। সে হাতের আঙুল উঁচিয়ে ছোটদের মতো এক এক করে রামধনুর রঙের প্রকার গুনতে শুরু করে দেয়।