জলধোয়া। আমাদের গ্রাম। দূর থেকে দেখতে যেন ঠিক একটা চোখের মণি। চারপাশে শাদা। মাঝখানে কালো। কিংবা ওটা একটা দ্বীপ। মাঝখানে গ্রাম। চারপাশে পানি। পশ্চিম দক্ষিণ উত্তর ঘিরে বিশাল বাঁওড়। তার স্বচ্ছ পাথুরে জল ছুঁয়ে ছুঁয়ে গ্রাম। খামারপাড়া। সোনানেন্দে। লক্ষণপুর।
ওদের বুকেই এগ্রামের সব কুটুমবাড়ি। ইশকুল মাদ্রাসা। আর হাট-বাজার। তার ওপাশে একটা বিল। বিলটা ভবঘুরে খুব। ঘুরতে ঘুরতে এপাশ দিয়ে ওপাশ দিয়ে এ গ্রাম ছুঁয়ে ওগ্রাম ধুয়ে আমাদের গ্রামে এসেছে। পড়ে আছে পুবের পাশে বিছেন পেতে। আমাদের তিনপাশে তাই বাঁওড় ঘুমোয়। আরপাশে ওই বিল।
বিলটা পার হলে মাটির পথ। পথটা পায়ে পায়ে থানায় গিয়ে উঠেছে। তবে খুব দরকার না হলে লোকজন ও-পথ মাড়ায় না। কাজ বলতে তাদের গোসল করা আর কাপড় কাচা। বর্শি জালে মাছ ধরা আর ঝিনুক তোলা। পাট জাগ দেয়া আর আঁশ ছাড়ানো। বেচাকেনা আর আড্ডা খাওয়া। সব মেটে ওই বাঁওড়ে। আর বাঁওড়ের ওপারে। আর বিলে।
যাতায়াতের জন্য ডিঙিই ভরসা সবার। যাদের নেই তারা চলে ভেলায়। তবে সে এক ঝক্কি। অধিকাংশ লোকই তাই পারাপার হয় নৌকোয়। ভাড়া দিয়ে।
নৌকোটা গ্রামের মোড়লের। মোড়লের নাম হাবি সদ্দার। গ্রামের সবচে’ ধনী। সবচে’ চতুর। আর সবচে’ সবল। সে-ই আপন সবার। পর বলতেও সে-ই। সে-ই বকে ভুল হলে। বুকেও টানে প্রয়োজনে। লোকজন তাই মেনেই চলে তাকে।
ভাড়া খাটা নৌকোটা ছাড়াও আরেকটা নৌকো আছে তার। পারিবারিক কাজের জন্য। সেটা চালায় কালো ভীষণ বেঁটে এক লোক। নাম আরব আলি। এক পা তার খোঁড়া। নামটা তাই মনে রাখে না কেউ। ডাকে ‘খুঁড়া মাঝি’ বলে।
ওই লোকটাই আমার বাবা।
আমার মাও মোড়লবাড়ি কাজ করে। রান্নাবাড়া আর বাসন মাজার কাজ। ঘরদোড় ঝাড় দেওয়া আর উঠোন লেপার কাজ। ধান সিদ্ধ শুকনো করা আর ঢেঁকি ভানার কাজ। এর বাইরে তার আরো আরো কাজ আছে যেগুলোর হিসেব আমি রাখতে পারি না। ও হ্যাঁ, বাড়ির বউদের চুল আচড়ানো আর তেল মাখানো আর বকুনি শোনার কাজও মাকে করতে হয়।
আগে কত ঝামেলা ছিল। কত মানুষ, কত কাজ। মা সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকত। আব্বাকে তো প্রায় দেখাই যেত না। সারাদিন শুধু বাঁওড় আর মাঠ। বিল আর বাজার।
আমাদের আসল বাড়ি ছিল বাঁওড়ের ওপারে। দাদা-দাদি মারা গেছেন আব্বার ছোট বেলায়। জমি জায়গা নেই। পা অচল। তাই করার-ও কিছু নেই। এ-বাড়ি ও-বাড়ি চেয়ে খেয়ে দিন কাটে। সেই অসময়ে হাবি সদ্দারই তাকে ডেকে নিয়েছিলেন। আশ্রয় দিয়েছিলেন। কাজে লাগিয়েছিলেন। মোড়লের বউ তার সবচে পছন্দের কাজের মেয়েটার সাথে বিয়ে দিয়ে দিলো তার। একজন মাঝি আর একজন ঝি তাই হয়ে গেল বাবা-মা আমার।
তারপর থেকে আর এ বাড়ির বাইরে যাওয়ার দরকার পড়ে না তাদের। ফলে এখন এই গ্রামই ঠিকানা আমাদের।
শোনা যাচ্ছে মিলিটারিরা গ্রামে গ্রামে আসছে। ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিচ্ছে। মানুষ মেরে ফেলছে।
আমাদের গ্রামটাতে সহজে আসার পথ নেই বলে আসতে পারেনি। তবু লোকজন গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে লাগল। মোড়ল বাড়িরও কেউ কেউ চলে গেল। মোড়লকেও নিতে চেয়েছিল তারা। কিন্তু বাপের ভিটে ছাড়তে চাননি মোড়ল। কিন্তু দিনকে দিন সব উল্টে যেতে লাগল। পাল্টে যেতে লাগল। থাকার আর উপায় থাকল না। একদিন তাই বাকি লোকদের ডাকলেন তিনি। অসহায় চেহারাটা মুখে নিয়ে বক্তৃতা করলেন। ‘অবস্তা তো খারাপ হই গিয়েচ। আর থাকা যাবে নাই। কাইল বিয়ানে শিকেরপুরি হামলা হয়েচে। পরশু হয়েচ মাজামারায়। গোড়পাড়া তো আগেই শুশান। বাঁওড় পারোয়ে এদিকিও চলে আসতি পারে যেদিন সেদিন। আমাদের চলে যাওয়াই উচিত মনে হচ্চে।’
যাওয়ার জন্য মুখিয়ে ছিল সবাই। রাতের মধ্যেই রওনা হয়ে গেল।
মা বাবাও গুছিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু আমরা ‘গেলি বাড়িঘর দ্যাকবেনে কিডা? আর গেলিই বা কী? সব গিরামের তো একই হাল। একেনে যেমন, সেকেনেও তেমন।’
কথা ঠিক। ‘তুমরা থাকো। ধান চাইল সব থাইকলো। দেকে শুনে রাকো। আর সারা জীবনের জন্যি তো যাচ্চিনে। দুদিন পর সব ঠান্ডা হয়ে যাবেনে। তকন আমরা চলে আসবানে।’
মোড়লের কথার ওপর কখনো কথা বলে না আব্বা। এবারও বললো না।
আমরা তাই থেকে গেলাম। সেই একলা গ্রামে, একলা বাড়িতে একা আমরা তিনজন। মা প্রায়ই বলে ‘চারদিক খুব ভর হয়েচ। গা কিরাম ছমছম করে।’ ভয় পাওয়া গলায় আব্বা সাহস দেয় মাকে। ‘ওরে কিচ্চু হবে নাই। শুয়োরে বাচ্চারা সাঁতার কাটতি পারে না। বাঁওড় পারোয়ে আসা ওই শালাগের কম্ম না।’ মা’র গায়ে তবু কাঁটা দেয়। হুটহাট চমকে চমকে ওঠে। তাই বিড়বিড় করে সারাক্ষণ। দোয়া পড়লে নাকি বিপদ আসে না।
বিপদের কিছু আমি বুঝি না। আমার ভালোই লাগে। আগে কত ঝামেলা ছিল। কত মানুষ, কত কাজ। মা সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকত। আব্বাকে তো প্রায় দেখাই যেত না। সারাদিন শুধু বাঁওড় আর মাঠ। বিল আর বাজার।
কিন্তু এখন সব বদলে গেছে। মা আমাকে সময় দেয়। গান গল্প ছড়া শোনায়। আব্বাও বাড়ি থাকে। বাঁশি বাজায় সন্ধে হলে।
মাঝে মাঝে আমরা বাঁওড়ে যাই। নৌকো চড়ি। ঘুরি। আব্বা কথা বলে। মা গান গায়। কখনো আমার সাথে। কখনো আমাকে নিয়ে।
খুব ভালো লাগে আমার।
মা আমাকে বাঁওড়ের সুন্দর নীল পানি দেখায়। মাছরাঙা আর বক দেখায়। মাছের ঝাঁক দেখায়। পানির উপর ঝিঁঝিঁ পোকার নকশা দেখায়। আর দেখায় পানির মধ্যে আকাশের ছবি। ‘দেকিচাও, কী সুন্দর পানি! পানির মদ্যি আকাশ কিরাম করে শুয়ে রয়েচে, দ্যাকো!’
আমি দেখি। আমার মজা লাগে।
মাঝে মাঝে বিলে যাই আমরা। পদ্মচাকা তুলি। শাপলা তুলি। নাইল দিয়ে মালা বোনে মা। একটা দুটো শাপলাফুল গুঁজে দেয় খোঁপায়। তারপর হেসে ওঠে। খিকখিক। খিলখিল।
আমার ভালো লাগে।
আপুটাকে দেখতে ইচ্ছে করছিল আমার। ওই ঘরটা আবার একটু দেখতে ইচ্ছে করছিল। মা আর নিয়ে গেল না। শুয়ে শুয়ে কাঁদল।
একদিন দেখি একটা লোক ভাসছে পানিতে। লোকটা কে? বোঝার চেষ্টা করছিলাম। অমনি অক অক করে উঠল মা! অমনি নৌকো গেল ঘুরে। অমনি বাড়ি চলে এলাম আমরা। সেদিন থেকে আর আমাদের নিয়ে যায় না আব্বা। একা একা বের হয়। ফিরে আসে নৌকোবোঝাই খবর নিয়ে। ওই গ্রামে এই হয়েছে, ওই হয়েছে। অমুক গ্রামে আগুন। তমুক গ্রামে ক্যাম্প। এ কমিটি সে কমিটি। এত মানুষ ধরেছে। এভাবে মেরেছে। সাত-সতেরো।
খুব ভয় করে আমার। তাই গুটিশুটি হয়ে থাকি। নড়ি না। চড়ি না। মনে হয় আমি নড়লেই আগুন জ্বলে উঠবে। নড়লেই আমায় মারতে আসবে কেউ।
একদিন একদল লোক নিয়ে আসলো আব্বা। গরিব-গরিব চেহারা সবার। তাদের মধ্যে একটা ছেলে আর একটা মেয়ে দেখলাম অসুস্থ। গায়ে রক্ত। ধরাধরি করে আনল সবাই। পিঠে সবার একটা একটা বোঁচকা। কাপড় চোপড় হবে হয়তো। আর কী একটা করে জিনিস। নল মতো। মা বলল অস্ত্র। ওরা সব মুক্তি।
রান্না হলো। খাওয়া হলো। গল্প হলো।
ভেবেছিলাম চলে যাবে কুটুম আসার মতো। কিন্তু গেল না। দুতিনটে ঘর বেছে নিয়ে থাকা শুরু করল।
মা-বাবার ব্যস্ততা গেল বেড়ে। আবার। আগের মতো।
আরও পড়ুন: নির্বাচিত নবীনের কবিতা
মা থাকে রান্নার জোগাড়-যন্তর নিয়ে। সারাক্ষণ। আগে আমার সাথে কত কথা বলত, এখন বলতে গেলে বলেই না। গল্প করে না। গান শোনায় না। দোল দেয় না। আমি যেন কেউ না! ওই মুক্তিরাই সব। তার কাজই যেন শুধু রান্না করা। আর ওদের খাওয়ানো। খাওয়ানো আর রান্না করা। আগ বাড়িয়ে আবার দু’একজনের কাপড়ও ধুয়ে দেয়। মুক্তিদের সাথে যে মেয়েটা আছে, তার সাথে খুব ভাব হয়েছে মা’র। সময় সুযোগ হলেই বসে যায় দু’জন। গল্পের তখন আর শেষ থাকে না। রাগ হয় আমার। খুব রাগ হয়। মোড়লের বকা খেয়ে কিংবা কেউ কিছু বাজে কথা বললে আব্বা যখন মারত মাকে, তখন যেমন রাগ হতো, তেমন করে জ্বলি আমি। কিন্তু কিছু বলি না।
আব্বা তো আরো বেশি! প্রায়ই রাতে ওদেরকে নিয়ে চলে যায়। কোথায় যায় জানি না। মা বলে ‘যুদ্দ কত্তি যায়’। ফিরতে ফিরতে ভোর।
তার না ফেরা পর্যন্ত কাঁথা সেলাই করে মা। পিটপিট করে চোখদুটো তার। পিটপিটে চোখ টানটান করে দেখার চেষ্টা করে। আর ঢুলে ঢুলে পড়ে। আর হাই তোলে বারবার। তবু শোয় না। গল্প করে। নানাবাড়ির গল্প। ভূতের বাড়ির গল্প। এক গল্প বলতে গিয়ে আরেক গল্পে চলে যায় ঘুমের ঘোরে। তবু আমার ভালো লাগে। সবচে’ ভালো লাগে সোনার দেশের গল্প। এই গল্পটা বলার সময় তাল কাটে না।
আমাদের বাঁওড়ের তলায় নাকি একটা দেশ ছিল। সোনার দেশ। ঘরবাড়ি দালানকোঠা সবই সোনার। সেদেশের লোকজন খুব ভালো। আর দয়ালু। আর উপকারি। চাইলেই তারা মানুষকে সাহায্য করত। তবে চাইতে হতো কায়দা করে। যেমন কেউ হয়তো খুব গরিব। মেয়ের বিয়ে দিতে পারছে না। বা চিকিৎসা করাতে পারছে না। বা ঘরবাড়ি নেই, কোথায় কোথায় থাকে। সে যদি সাহায্য নিতে চায়, তাহলে তাকে বাঁওড় কান্দায় গাব গাছটার নিচে যেতে হবে।
সন্ধ্যার সময়। পুবদিকে মুখ করে চোখ বুজে দাঁড়াতে হবে। তারপর প্রয়োজনটা বলতে হবে। মুখ ফুটে না, মনে মনে। অনুরোধ করতে হবে সোনার দেশের রাজার কাছে। লোকটা যদি লোভে প’ড়ে মিথ্যেমিথ্যি ওসব চায়, তাহলে পাবে না। কিন্তু সত্যিই যদি তার দরকার হয়, তাহলে যখন সে গোসল করতে যাবে, বা মাছ ধরতে বা কাপড় কাচতে, দেখা যাবে তার পায়ে একটা আংটি এসে ঠেকলো। বা বালা। বা নোলক। এগুলো হলো দান। ফেরত দিতে হবে না। শুধু ধন্যবাদ দিলেই হবে।
আবার যদি এমন হয় যে, কারও বিয়ের অনুষ্ঠান বা মিলাদ বা খানা। অনেক বাসনকোসন লাগবে। বা গয়না লাগবে। বা অন্যকিছু। তাকেও ওইভাবে অনুরোধ করতে হবে। পরের ভোরবেলা দেখা যাবে গাবগাছের শিকড়ের ভিতর সোনার বাসন সোনার গ্লাস সোনার বাটি সোনার গয়না লুটোপুটি খাচ্ছে। হাসছে। কাজ শেষে এসব আবার ঠিকঠাক ফেরত দিতে হবে সেখানেই। এবং ধন্যবাদ দিতে হবে মনে মনে।
এই ফেরত দিতেই একবার দেখা গেল কিছু থালাবাসন কম। আগের রাতে দাওয়াত খেতে এসেছিল পাশের গ্রামের লোকেরা। তারাই নিশ্চয় মেরে দিয়েছে। না কি হারিয়ে গিয়েছিল, কে জানে। তার পর থেকে আর এসব পাওয়া যায় না।
ইশ! এখনো যদি সব আগের মতো থাকত! এখনো যদি ওরা মানুষের কথা শুনত! আমি শুধু দুটো কানের দুল চেয়ে নিতাম। সোনার দুলের খুব শখ মা’র। এসব ভাবি। আর গল্প শুনি। ভাবতে ভাবতে আর শুনতে শুনতেই ঘুমিয়ে পড়ি।
মাঝে মাঝে উঠোনে গিয়ে গিয়ে আমরা দেখে আসি মুক্তিরা আসছে কিনা। তারপর আবার এসে বসি। মা আমাকে যুদ্ধের কথা বলে। স্বাধীনতার কথা বলে। ‘একদিন স্বাদিনতা আসপে। আমরা স্বাদিন হব। তকন তুমাকে নানিবাড়ি নিয়ে যাব। ভুতবাড়ি দেকাব।’
ভূতবাড়ি দেখার খুব শখ আমার। তাই নানিবাড়ি যেতে ইচ্ছে করে। স্বাধীন হতে ইচ্ছে করে। খুব।
মাঝ রাতে কখনো, কখনো শেষ রাতে ফিরে আসে বাবা। আদর করে আমাকে। মাঝে মাঝে মাকেও। তারপর শুয়ে পড়ে। নাক ডাকে ঘড়াৎ ঘড়াৎ।
সকালে ঘুম ভাঙতেই কাজ শুরু করে দেয় মা। আমি পর হয়ে যাই। আবার।
আব্বা আর মুক্তিরা ওঠে বেলা করে। গান বাজনা করে। রেডিও শোনে। সুন্দর সুন্দর গান হয়। আমি শুনি। একটা লোক কিরাম ভাষায় যেন কথা বলে, ছ্যাড়াবেড়া ক্যারাব্যারা করে, শোনে আর হাসে, হাসে আর গড়ায়ে পড়ে মুক্তিরা। আর আনন্দ করে। আব্বাও। মাও।
কোনো কোনো দিন খুব খুশি থাকে সবাই। কোনো কোনো দিন মনমরা।
এমন এমন ভাষায় কথা বলে মুক্তিরা, কারও কারও কথার ক-ও বুঝি না। কারো কারো কথা শুনে হাসি পায়। কিন্তু আমি হাসি না। মা বলেছে কাওকে দেখে হাসি আসলেও হাসতে নেই। ওতে তারা কষ্ট পায়। আর মানুষকে কষ্ট দেয়া হলো সবচে’ বড় পাপ। আমি তাই মুখ চেপে রাখি।
মা বলে মুক্তিরা সবাই ভালো। আমারও তাই মনে হয়। বাড়ির লোকেদের মতো ওরা কেউ আব্বা মাকে গালাগালি দেয় না। বকাবকি করে না। মারধর করে না। আপনি আপনি করে কথা বলে। ভালো লাগে আমার।
একদিন এক মুক্তিকে ধরাধরি করে আনল ওরা। সেই প্রথম দিনের মতো। লোকটা কাঁদছে না। কিন্তু চোখে পানি। কাপড়ে রক্ত আর রক্ত। সব ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করল মা। মুক্তিদের সঙ্গে একজন আছে ডাক্তার মতো, সে কাপড় বেধে দিল।
আর একজন লোক এল ওরকম আহত হয়ে।
ওদের দেখাশুনার দায়িত্ব পড়ল মার উপর। মার ব্যস্ততা আরো বাড়ল। মা রান্না করে। খাওয়ায়। থালাবাসন মাজে। কাপড় ধোয়। আবার ওদের সেবা করে। কত কাজ! বুঝি খুব কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু কিছু করার নেই। মাও কিছু বলে না। হাসতে হাসতে করে ফেলে সব। অথচ আগে এরচে’ কত কম কাজ করতে হতো। তাও মাঝে মাঝে গজগজ করত। ঝগড়া করত। রাগ ঝাড়ত। এমন কেন হয়? অবাক লাগে আমার।
একটা লোক মারা গেল সেদিন বিকেলে। মোড়লবাড়ির পেছনে একটা খেজুরবন। ওর সামনে একটা তেঁতুলগাছ। ইয়া লম্বা লম্বা তেঁতুল হয়। মা খুব খায়। ঝাল মরিচ বেটে নিয়ে আব্বাও খায় মাঝে মাঝে। গাছটার নিচে একটা গর্ত করে মরা লোকটাকে পুঁতে দিল মুক্তিরা। আমার খারাপ লাগছিল খুব। সবাই উপরে থাকবে আর একটা মানুষ মাটির নিচে! একটা গর্তে একা! ভয় করবে না লোকটার? মাও দেখলাম কাঁদছে। বলল ‘মরা মানষির জন্যি ওই গত্তই হচ্চে ঘর। তুমার নানানানিও ওইরাম দুটো ঘরে শুয়ে আচে। দাদাদাদিও। তুমার আগে তুমার এ্যাটটা আপু হইলো। কিন্তু ছেলের শক তুমার বাপের। তাই মেয়ে দেকে খুশি হইনি। কী কান্না তকন তার! তুমার আপুডারও মনে করো অবিমান খুব। আঁতুড় ঘরেত্তে বের করার সুমায় দিইনি। মরে গেচে। সেও শুয়ে আচে ওইরাম এ্যাটটা গত্তে।’ আপুটাকে দেখতে ইচ্ছে করছিল আমার। ওই ঘরটা আবার একটু দেখতে ইচ্ছে করছিল। মা আর নিয়ে গেল না। শুয়ে শুয়ে কাঁদল।
সবাই খুব মনমরা হয়ে থাকল ক’দিন।
তারপর আবার সেই আগের মতো। যাওয়া আর আসা। খাওয়া আর ঘুমোনো। ঘুমোনো আর যাওয়া।
তারপর একদিন ঝামেলা। কী একটা ভুল হয়েছে অপারেশনে। তাই নিয়ে গণ্ডগোল। যে করেছে তাকে খুব বকছিল ওরা। চুপ করে ছিল লোকটা। শুধু বলছিল ‘এরাম আর হবার লাই। এ্যালা ভুল হয়েচ। আর হবার লাই‘।
তার কয়েকদিন পরের কথা।
লোকটাও দেখল বাবাকে। মাকে ফেলে ঘুরে দাঁড়ালো। এগিয়ে গেল। অস্ত্রটা তাক করল আব্বার দিকে। আব্বা তখন মাকে দেখছে। মা আব্বাকে।
তখন রোজা। মুক্তিরা কেউ কেউ রোজা থাকে। খায় না কিছুই। কেউ কেউ আবার দিনভর জাবর কাটে। তবে ‘যুদ্দে যাওয়ায়’ বিরতি নেই। রাতে যায়। ভোরে ফেরে। তারপর সেহরি। আব্বা এসেই সেদিন বলল খুব ক্লান্ত। তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে গেল। সাতাশ রোজা সাতাশ রোজা করে করে মুখে ফেনা তুলে ফেলেছে মা। সেদিনই সেই রাত, অথচ মাও ঘুমোলো খুব। উঠলোও না, সেহরিও খেল না। শরীর খারাপ লাগছে। ওদিকে মুক্তিরা সেহরি করছে। গল্প টল্প হচ্ছে। কেউ নামাজ পড়বে এরপর। কেউ সোজা ঘুমোবে। কেউ ওঠেইনি এখনো। লোক ডাকছে। তবু ঘুমোচ্ছে। এমন সময় বাইরে গেল মা। কিন্তু গেল না। ফিরে আসলো। কাঁপছে সে।
তোতলাচ্ছে। ঝাকাতে লাগল আব্বাকে। তার ঘুম আবার লোহার মতো, সহজে ভাঙে না। কিন্তু আমারটা ভাঙল। হঠাৎ শুনি চেচামেচি। বাইরে দেখি অনেক মানুষ। সবার গায়ে একই রকম পোষাক। মাথায় টুপি। পায়ে জুতো। হাতে মুক্তিদের মতো অস্ত্র। চারদিকে ধোঁয়া। ঘরগুলোয় আগুন। জ্বলছে। আর শব্দ হচ্ছে ভীষণ। ঠাশ ঠাশ ঠাশ।
মুক্তিরা সব দৌড়োচ্ছে। কারো কাছে অস্ত্র, কারো হাত খালি। কয়েকজন দেখলাম পড়ে আছে। বারান্দায়। উঠোনে। পাশেই পড়ে আছে ভাতের থালা। পানির জগ। কলার ছড়া।
মা ওদের দিকে যেতে গেল। না করল আব্বা। বলল ‘পলাও’। মা পালাল না। দাঁড়িয়েই থাকল।
আব্বা চিৎকার করে বলল ‘বের হও, পলাও তাড়াতাড়ি’।
এরপর মা ছোটা শুরু করল। ঘরের পিছন দিকের গলি দিয়ে। ছুটছে তো ছুটছেই।
চার দিক থেকে শব্দ আসছে। চিৎকার চেচামেচি। আর ঠাশ ঠাশ।
আমরা বিলের দিকে যাচ্ছি। মার কষ্ট হচ্ছে খুব। আমার কষ্ট হচ্ছে খুব। আমরা আর পারছি না। সামনেই খেজুর বাগান। বাগানে ঢুকব এমন সময় গুলি লাগল মার গায়ে। মা পড়ে গেল। আমিও পড়ে গিয়েছি। উঠার চেষ্টা করছি। পারছি না। বাবাকে খুঁজছি। দেখছি না কোথাও।
মা চিৎকার করছে। হাত পা ছুড়ছে।
একজন লোক এল আমাদের দিকে। লোকটাকে আমি আগেও দেখেছি। মোড়লের কাছে আসত মাঝেমধ্যে। তার হাতেও অস্ত্র। কাছে এসে মাকে দেখল। লাথি মারল। আবার লাথি মারল। খোঁচা দিল পেটে। আবার খোঁচা দিল। কঁকিয়ে উঠল মা। তড়পাতে লাগল। হাত পা ছুড়তে লাগল। দম বন্ধ হয়ে আসতে লাগল আমার।
তখনই আব্বাকে দেখা গেল। এদিকে আসছে। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। গাল দিতে দিতে।
আমি আব্বার দিকে তাকিয়ে আছি। পেছনের তেঁতুল গাছের দিকে তাকিয়ে আছি। তার পিছনে বাড়িঘর। বাড়িঘরে আগুন। আগুনের দিকে তাকিয়ে আছি। তার ধোঁয়ার দিকে তাকিয়ে আছি। সব ফেলে আসা আব্বার দিকে তাকিয়ে আছি। আব্বা আসছে। পা টেনে টেনে। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। কিন্তু কী ভীষণ গতি তার! থামছে না।
লোকটাও দেখল বাবাকে। মাকে ফেলে ঘুরে দাঁড়াল। এগিয়ে গেল। অস্ত্রটা তাক করল আব্বার দিকে। আব্বা তখন মাকে দেখছে। মা আব্বাকে।
আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল। কাঁদতে ইচ্ছে করছিল খুব। ইচ্ছে করছিল লোকটাকে ধরতে। থামাতে। মারতে।
ইচ্ছে করছিল মাকে ছেড়ে আসতে। বিজয়ী হতে। স্বাধীন হতে।
কিন্তু পারিনি। কারণ তখনো পারতে শিখিনি।
না হলে হয়তো স্বাধীন হতাম। বিজয় দেখতাম।
আরও পড়ুন: প্রথম গল্প