এক.
অন্ধকারের চাদরে মোড়া রাত, মাটির কুপি জ্বলছে মাথার কাছে। অসুস্থ মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে সুনীল মালোর। চাঁদ নিজেকে আড়াল করেছে, চারপাশে শুধু নিকষ কালো অন্ধকার। এই মধ্যরাতে ঘুমন্ত জেলেপাড়ার অতন্দ্র প্রহরী যেন সুনীল আর লিপি মালো। অন্ধকার ভেদ করে সুনীলের ঘর থেকেই তেজহীন আলোর রেখা দেখা দিচ্ছে। কিন্তু কতক্ষণ এ বাতি জ্বলবে বুঝতে পারছে না সুনীল। ঘরে এক ফোঁটাও কেরোসিন নেই, বারবার বলেছিল লিপি মালো।
হাট করে সুনীলের পকেটে তখন কুঁড়ি টাকার একটা ময়লা নোট বেঁচে ছিল। মাছ বিক্রি করে সুনীল একসের মোটা চাল, ছোট মেয়েটার জন্য এক কৌটো বার্লি, আধাকেজি মসুরের ডাল, একপোয়া সয়াবিন তেল, নিরামিষের জন্য সস্তা দুই তিন রকমের সবজি, মোটা নুন দশ টাকার আর পনেরো টাকার কাঁচা মরিচ কিনেছিল। বউ অনেকবার বলে দিয়েছিল, ঘরে একফোঁটা কেরোসিনও নেই।
এক লিটারের পানির বোতলের মুখের কাছে দড়ি দিয়ে বাঁধা, যেটাতে কেরোসিন থাকে, উঁচু করে দেখিয়েছিল লিপি মালো। সুনীল ভেবেছিল কেরোসিন কিনবে সবার আগে, কিন্তু হলো না কেনা। কুড়ি টাকার তেল কিনতে পারতো হয়তো সে, তাহলে সকাল বেলা মেয়েটার পরোটা খাওয়ার বায়না মেটাতে পারতো না।
আজকাল অনামিকার শরীর খারাপ হওয়ার পর থেকে সকালবেলা ঘুম থেকে উঠেই বাজারে দোকানে বসে পরোটা ডিম খাওয়ার জন্য বায়না করে। ঘরে বসে খাবে না কিছুতেই। দোকানে বসেই খাবে। রহিম ব্যাপারির খাবার হোটেলে সকালবেলা পরোটা ভাজে, ডিমের ওমলেট, মামলেট, ভুনা খিচুড়ি, শুকনো মরিচ ভাজা, আলু ভর্তা পাওয়া যায়। খিচুড়ি খাওয়ার জন্য রহিম ব্যাপারির দোকানের সামনে সারাবছর রাখা থাকে আমের আচারের তিন চারটে বড় বয়াম, খদ্দেরও গমগম করতে থাকে এই হোটেলে। সবাই বলাবলি করে রহিম ব্যাপারি ব্যবসা বোঝে!
অত সকালে কোনো দোকানে টাকা না দিয়ে খাওয়া যায় না। এছাড়া সুনীল ধার দেনা করতে বা বাকিতে খেতে একদমই পছন্দ করে না। তাই কেরোসিন না কিনে কুড়িটাকা বাঁচিয়ে বাড়ি নিয়ে এসেছে সে। কিন্তু চিন্তা অন্য জায়গায়। মেয়েটা তার একদমই অন্ধকারে থাকতে পারে না। অন্ধকারে খুব ভয় পায় অনামিকা। অন্ধকার থাকলে পাগলের মতো করতে থাকে। রাতে ভালো করে ঘুমায় যেদিন, সেদিন সুস্থ থাকে, ঘুম না হলেই পাগলামি করতে থাকে। মেয়ের সঙ্গে সঙ্গে অন্ধকারকে ভয় করতে শুরু করেছে সুনীল আর লিপিও।
দুই.
কুমার নদীর পাশে শিমুলতলী গ্রাম। শিমুলতলী গ্রামের বাজারের নামডাক আছে খুব। বাজারের উত্তর দিকে নদীটার পাড়ঘেঁষে একটা মসজিদ। মসজিদের পাশে বাঁধানো ঘাট। সেই ঘাটে এসেই শিমুলতলীর খেয়াটা দাঁড়ায়। এখনো ব্রিজ হয়নি নদীর বুকে। ওপাশে ফুলসুতি গ্রাম। ওপাড়ের লোকজনও এ গাঁয়ের বাজারে আসে। এ গায়ের মানুষ খেয়াপার হয়ে ওপারের মাটির রাস্তা ধরে শহরে যায়। দুই গ্রামের দুই জন মাঝি খেয়া পারাপার করে। দুটো খেয়া থাকে সবসময় এ ঘাটে।
তাই ওদের কাছে পাওনা টাকা চাইতে সাহস পায় না কেউ। পুলিশ, জেল ওদের কাছে মূল্যহীন। যত ভোগান্তি সাধারণ মানুষের!
সেই খেয়াঘাটের বামপাশ ধরে, বাজার থেকে একটু নিচু জমিতে ছোট ছোট ঘুপছি ঘর। আছে দুই-একটা পাকাও। এটা জেলেপাড়া। পরিমল মালো, সুনীল মালো, বাদল মালোর ঘর একদিকে, নদীর পাড়ঘেঁষে। তারপর একটা বড় বাঁশঝাড়, ঘন। বাঁশঝাড়ের ওপাশে পাকা আধাপাকা কতগুলো ঘর নিয়ে কয়েক ঘর জেলের বাস। সুনীল মালোর ঘরের পাশেই বাঁশঝাড়।
উঠানের রোদে জাল ফেলে শুকাতে দিয়েছে সুনীল। নদীর পাশ ঘেঁষেই সুনীলের ঘর। ভেসাল পেতেছে সুনীল নদীতে। এই বর্ষাকালে দিনে-রাতে ভেসালে থাকে, সন্ধ্যায় আর সকালে ভেসাল থেকে নেমে মাছ বিক্রি করে সুনীল। ছোট ছাউনিঘেরা নৌকা আছে সুনীলের। বিছানা পাতা নৌকার ছাউনিতে। ঘুমিয়ে নেয় ওখানেই সে। ভেসালে যাওয়ার সময় খাবার নেয় নৌকায়, একটা গ্লাস। নদীর পানিই খেয়ে নেয় পরম তৃপ্তিতে!
কয়েকদিন থেকে ভেসালে রাতে যায় না সুনীল। মেয়েটার পাগলামি বেড়েই চলেছে। এত ফুটফুটে মেয়েটা তার। হঠাৎ কোথা থেকে কী হয়ে গেলো। এত ভালো পড়ালেখা করতো। প্রাইমারি শেষ করেছে মেয়েটা দুবছর হলো। বাজারের পাশেই যে ওয়াজেদ স্যারের হাইস্কুল হয়েছে, সেখানেই ভর্তি করে দিয়েছে মেয়েকে। মেয়ে শহরের স্কুলে ভর্তি হতে বায়না ধরেছিল, দিতে পারেনি সুনীল। দুমাস আগে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেছিল মেয়েকে। মাগুরায়, খুব ভালো ডাক্তার। ঘুমের ওষুধ দিয়েছিল মেয়েকে, কিছু ভিটামিনও। মেয়ের ব্রেনে চাপ পড়েছে, পুষ্টির অভাবে এমনটা হচ্ছে, বলেছিল ডাক্তার। তারপর ঘুম হয় না, ঘুম হলে ঠিক হয়ে যাবে। কিছুদিন ভালোও ছিল মেয়েটা। আর যায়নি সুনীল ডাক্তারের কাছে। মেয়ে ঠিক হয় গেছে ভেবে আর ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি ওরা। তাছাড়া ডাক্তার দেখানোর এত টাকা পাবে কোথায় সুনীল? অনামিকা ছাড়া আরও তিন ছেলেমেয়ে আছে ওদের। তাদের লেখাপড়া, খাবার খরচ রয়েছে। বৃদ্ধ মাও রয়েছে সুনীলের সংসারে। এবছরের শুরুতে একটা এনজিও থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা লোন নিয়েছে সুনীল। ভেসালের জাল রিপেয়ার করা, ভেসালের জন্য বাঁশ কেনা আর নৌকা মেরামতেই গেছে সব টাকা। মাথার ওপরে লোনের বোঝা, সংসারের চিন্তা, অনামিকার পাগলামি; সব মিলিয়ে এ কয়দিনেই যেন অনেকটাই বুড়িয়ে গেছে সুনীল মালো।
তিন.
খেয়া পার হয়ে ভ্যানে করে বড় বড় চাড়ে করে মাছ আসা শুরু হয়েছে বাজারে। ইলিশ, গলদা চিংড়ি, পাঙ্গাস, তেলাপিয়াগুলো এত বড় যে এক একটায় দেড়কেজি হয়। আছে চাষের বড় বড় মাগুর, কই, মিনার কাপ, সিল্ভার কাপ। দুই-একজন জেলে গ্রামের বড় বড় পুকুর লিজ নেয়, সেসব পুকুরের মাছও উঠেছে আজ বাজারে। মাছ বাজারের শেষ মাথায় এককোণে বসে আছে সুনীল। ভেজা লুঙ্গির ওপর দিয়ে শুকনো লাল রঙের গামছা গিট্টু দিয়ে পরা। মেয়েটা গতকাল খুব পাগলামি করছিল। ঘরে থাকতে চাইছিল না। দৌড়ে দৌড়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে যাচ্ছিল। অমন মেয়েকে রেখে কী করে ভেসালে গিয়ে নিশ্চিন্ত থাকে সুনীল? তাই আর বাড়ি থেকে বের হয়নি। মাঝরাতের দিকে মেয়ে ঘুমিয়ে পড়লে নৌকার দড়ি ছেড়েছিল সে। খেয়াঘাট থেকে তিন-চারটা ঘাট পরেই ভেসাল বেঁধেছে সুনীল। ভোর রাত থেকে সকাল পর্যন্ত যে কয়টা মাছ পেয়েছে তাই নিয়ে বাজারের এককোণে এসে বসে আছে সে । দেশি মাছের দাম একটু বেশি, তবু বাজারের ইলিশ চিংড়ির ভিড়ে এ দিকে ঘেঁষছেইনা কেউ। রক্তজবার মতো লাল হয়ে আছে সুনীলের চোখ, মেয়েটার সঙ্গে সঙ্গে রাত জাগছে আজ পনেরো দিন হয়ে গেলো। মাছ না মারলে সংসার চলবে কিভাবে! আর কোনো কাজও শেখেনি, বাপ ঠাকুর্দার এই কাজই চলবে যুগের পর যুগ ধরে। ভেবেছিল মেয়েটা লেখাপড়া করে চাকরি করলে কোনো চাকরিজীবী ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিতে পারবে। কিন্তু কী থেকে যে কী হয়ে গেলো, সুনীলের বোঝার বাইরে যেন সবটা।
বাজারের ওপর দিয়ে যে পাকা রাস্তা চলে গেছে, সে রাস্তার ওপারে কাইয়ুম, কামরুল মোল্লার বাড়ি। কাজকর্ম করে না কিছুই, পার্টি করে আর ঘুরে বেড়ায়। ভোটের আগে আগে যা রোজগার করে নিতে পারে দুই ভাই! বাজারে এমন কোনো দোকানদার নেই যে, ওদের কাছে টাকা না পায়, তাতে কোনো লজ্জা নেই ওদের। বরং টাকা চাইতে গেলেই উল্টো ক্ষতি করে দেবে। তাই ওদের কাছে পাওনা টাকা চাইতে সাহস পায় না কেউ। পুলিশ, জেল ওদের কাছে মূল্যহীন। যত ভোগান্তি সাধারণ মানুষের!
কী রে সুনীল, কী মাছ নিয়া আইছস বাজারে? তোর ভাবি তো দেশি মাছ নিয়া যাবার কইছে বাড়ি!
কামরুলের কথায় সুনীল মালো মনে মনে ভগবানকে ডাকতে শুরু করে দেয়, যেন তার মাছ কামরুল না নেয়। এই মাছ বিক্রির টাকা দিয়ে বাজার করতে হবে তাকে। কিনতে হবে কেরোসিন তেল। সুনীলের মা নাতনির মঙ্গলের জন্য আজ ঠাকুরের কাছে পুজো দেবে, তার জোগাড়ের জিনিসপত্র কিনতে হবে।
—কী রে! ওই মালাউনের বাচ্চা! কী জিগাই তোর পছন্দ হয় না? কতা কস না ক্যারে?
—কতা কমু না ক্যা দাদা! এইযে দেহেন কয়ডা সরপুডি, পাবদা আছে কয়ডা আর শোল টাহি আর কয়ডা বড় বাইল্লা মাছ পাইছি। রাইতের মারা মাছ তো বেশি ভালো অবে না দাদা। ভালো মাছ অইলে আমি বাড়ি যাইয়া দিয়া আসুমনে।
—আমার লগে চালাকি করোস তুই? এই মালাউনের বাচ্চা মালাউন, জাইল্যাগিরি ছুডাইয়া দিব জন্মের মতো! মাছ দে ব্যাগে ডাইল্যা।
— দাদা, মাইয়াডার বড় অসক। কয়ডা টাহা যদি দেন,খুব উপকার অয় দাদা। আগেরো কয়ডা টাহা।
—বান্দির বাচ্চা, ছোটলোকের জাত! তুই আমার কাছে টাকা চাস? তোর কলিজাডা কত বড়! আমার দেখার খুব শখ রে! তুই খরচের খাতায় পইড়া গেলি আইজকারতন। মনে রাহিস। নিশ্চিন্তে মাছ ধরস। চোর ডাকাত নাই , আরামে ঘুমাস। মাইয়া বড় অইছে, রাস্তা দিয়া বুক ফুলাইয়া হাঁইট্যা বেড়ায়। তোর কোন বাপগো লাইগ্যা? টের পাস না কিছু, তাই না? টের পাওয়াইতাছি, সবুর কর।
এক টাকাও না দিয়ে সব মাছ ব্যাগে ঢেলে নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা হয়ে গেল কামরুল। দুই জেলে আবার খুব খাতির করে কামরুলের ব্যাগে দুইটা ইলিশ মাছ আর গলদা চিংড়ি দিয়ে দিলো ভাবির জন্য। কামরুল সুনীলের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বিদ্রূপের হাসি হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেলো বাজার থেকে। সুনীল অসহায়ের মতো মাছ বাজারের বেদীর ওপর পা মেলে বসে পড়ে।
চার.
বাজারের পাশেই একটা বড় মাঠ, মাঠের পাশেই সরকারি স্কুল। স্কুলের ঠিক উত্তর পাশে কালীমন্দির। সবাই বলে এখানকার মা খুব জাগ্রত। সকাল থেকে সুনীলের মা নাতনির জন্য পূজার জোগাড় করছে। নিজ হাতে মন্দির ধুয়ে মুছে সাফ করছে। গাছ থেকে ফুল তুলে নিজ হাতে মালা গেঁথেছে সুপ্রিয়া মালো। পূজার থালায় সাজিয়ে এনেছে একটা বড় খোলের নারকোল, একছড়া রুম্বি কলা, দুটো আপেল, বেশকিছু নাড়ু, জবা ফুল, কিছু ছানার সন্দেশ, একটা নতুন গামছা, ধুপকাঠি আর একটা মাটির প্রদীপ।
মাদুরের এককোনে বসে আছে অনামিকা। চুলগুলো এলোমেলে, রক্তবর্ণ চোখ দুটি অস্বাভাবিকভাবে ফুলে আছে, হাত দুটি বাঁধা। মাথা নিচু করে আপনমনে বিড়বিড় করে চলেছে।
শাশুড়ির কথামতো সকালবেলায় স্নান সেরে কাচা কাপড় পরে মন্দিরে এসেছে লিপি। এনেছে অনামিকাকেও। মন্দিরের এক কোণে বসে রয়েছে অনামিকা। চোখ দুটি অতিমাত্রায় লাল। মুখটা ফ্যাকাশে। এমনিতেই দেখতে ফর্সা অনামিকা। কিন্তু এখন ওর চেহারা কাগজের মতো সাদা, ফ্যাকাশে। খুব খুশি মনে, ভক্তিভরে পূজা করছে সুপ্রিয়া মালো। ঠাকুর মন্ত্র পড়ছে, লিপি হাত জোড় করে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে ঠাকুরের সামনে। পুজায় মন বসছে না তার। স্বামীর কাছে বাজারের সকাল বেলার ঘটনা শুনেছে। মনের মধ্যে ভয় কাজ করছে খুব, কখন কোন বিপদ ঘটায় ওই কামরুল। এছাড়া কিভাবে সংসার চলবে, সে চিন্তাতেও অস্থির লিপির মন। মেয়ে অনামিকার অন্নপ্রাশনের সময় বাপের বাড়ির আত্মীয়দের কাছ থেকে তিন জোড়া ছোট কানের দুল পেয়েছিল উপহার হিসেবে, ভেবেছিল তিন জোড়া ভেঙে একটা দুল গড়ে দেবে মেয়েকে। সেই তিন জোড়া দুল আর লিপির কানের পাশা নিয়ে বন্ধক রেখে টাকা এনেছে সুনীল মালো আজ। মেয়েকে লিপি একা সামলাতে পারে না, মেয়ের কাছে থাকতে গিয়ে মাছ ধরতে যেতে পারে না সুনীল! কী যে হবে, ভেবে অস্থির লিপি!
সুপ্রিয়া মালো এসবের কিছু জানে না, মনপ্রাণ দিয়ে ডাকে ঠাকুরকে। তার বিশ্বাস, এতদিন থেকে বিশ্বাসভরে ডাকে ঠাকুরকে, তাকে ঠাকুর ফিরিয়ে দেবে না। অনামিকা এবার ঠিক ভালো হয়ে যাবে!
পাঁচ.
সকাল থেকে সুনীলের ছোট উঠানজুড়ে জেলে পাড়ার মানুষজন জমা হচ্ছে। এসেছে পাল পাড়া থেকে কেউ কেউ, মুসলমান পাড়া থেকেও এসেছে অনেকে। অনামিকাকে ভালোবাসে সবাই। টেকেরহাট থেকে এক ফকির বাবা এসেছে, অনামিকার চিকিৎসা করতে। তাই দেখার জন্যই সুনীলের উঠানে আজ লোক সমাগম। উঠানের মাঝখানে ফকির বাবার নির্দেশমতো আগে থেকেই গোবর, তুষ মিশিয়ে লেপে রাখা , সেখানে একদম নতুন মাদুর পাতা হয়েছে। মাদুরের মাঝখানে রাখা হয়েছে পিতলের বাটিতে সরিষার তেল, আইস্যাল গাছের ডাল, একমুঠো পাটকাঠি, শুকনো মরিচ, এ কটা ম্যাচবাক্স যার গায়ে সিঁদুর ছোঁয়ানো। মাদুরের এককোনে বসে আছে অনামিকা। চুলগুলো এলোমেলে, রক্তবর্ণ চোখ দুটি অস্বাভাবিকভাবে ফুলে আছে, হাত দুটি বাঁধা। মাথা নিচু করে আপনমনে বিড়বিড় করে চলেছে। উপস্থিত লোকেদের কেউ কেউ ব্যথাতুর মন নিয়ে তাকিয়ে আছে অনামিকার দিকে, চোখের সামনে ফুটফুটে মেয়েটার এমন অবস্থা, সত্যিই সহ্য করা কঠিন। লিপি একটু পর পর মুখে আঁচলচাপা দিয়ে ডুকরে উঠছে। ফকির বাবার জন্য খাবারের আয়োজন করা হয়েছে, কিন্তু তিনি রোগী না ঠিক করে এ বাড়ির জলও স্পর্শ করবেন না বলে জানিয়ে দিয়েছেন। তার কথায় এমন কিছু ছিল যে, দ্বিতীয়বারের মতো কেউ তাকে খাবারের কথা বলতে সাহস পায় না।
লাল রঙের গেরুয়া পোশাক পরা, চুলগুলো লম্বা, কপালে লাল কাপড় বাঁধা, গলায় অনেকরকম পাথরের মালা, দুহাতের আঙুলে আট-দশটা আংটি পরা, তাও আবার দামি দামি পাথরের।
ফকির বাবা এসে বসলো মাদুরের ওপর। অনামিকাকে ধমক দিয়ে তার চোখের দিকে তাকাতে বললো।
—তুই আমার চোখের দিকে তাকা, তাকা বলছি!
ঘুমহীন চোখে একটু একটু করে তাকায় অনামিকা, একরাশ আলো হুড়মুড় করে অনামিকার চোখে ঢুকে পড়ে, চোখ নামিয়ে নেয় ও। মাথা ভারী হয়ে ওঠে ওর। কেউ যেন হাতুড়ি পেটাচ্ছে মাথার ভেতর। খুব ঘুমাতে ইচ্ছে করছে ওর। হাত দুটো যে কেন বেঁধে রেখেছে ওরা! দৌড়ে এখান থেকে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে ওর।
—দেখেছিস! আমার চোখের দিকে তাকানোর সাহস নেই ওর।
এই, মাথা নামিয়ে নিলি কেন? সাহস থাকলে তাকিয়ে থাক আমার দিকে, তাকা বলছি! তোর বাপ এসে গেছে। তোকে আজ এই মেয়ের ঘাড় থেকে পালাতে হবেই। শোনো সবাই, ওর ঘাড়ে একটা বদ জিন ভর করেছে।
জনগণ আজ বিচার চাইছে, কিন্তু কে বিচার করবে? কার বিচার করবে? পাগলের কোনো বিচার হয় না!
কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই সবাই হাতজোড় করে দাঁড়ায়। সুনীলের ঘরের পেছনের বাঁশঝাড় রাখা উচিত হয়নি, রাত-বিরাতে কাঁচা মাছ নিয়ে ঘরে ঢোকে সুনীল। গতমাসে ভাপা পিঠা বানিয়েছিল লিপি ঠিক সন্ধ্যাবেলা, এটাও উচিত হয়নি ওর। নানা কথা শোনা যাচ্ছে উপস্থিত লোকজনের মধ্য থেকে।
কেউ কেউ বলছে অনামিকার চালচলনও ভালো না, মেয়েরা বড় হলে একটু সাবধানে চলতে হয়। অনামিকা এ সব মানেনি কিছুই। দুপাতা লেখাপড়া শিখে নিজেকে কী না ভাবতো! দুপুর নাই সন্ধ্যা নাই, চুল ছেড়ে ঘুরে বেড়াতো। কেউ কিছু বললে শুধু হাসতো আর বলতো এসব কুসংস্কার তোমরা এখনে মানো?
এখন তার ফল ভোগ করছে। বোঝো এখন কথা না শোনার মজা!
ফকির বাবা হাত উঁচু করে সবাইকে থামার নির্দেশ দিলে। উপস্থিত লোকজন সাময়িকভাবে শান্ত হলেও আবার ফিসফাস করতে শুরু করে। ফকির বাবা একমুঠো পাটকাঠি হাতে নিয়ে আগুন জালিয়ে দিল। এবার সরিষার তেলের বাটিটা মুখের সামনে ধরে মন্ত্র পড়ে নিলেন আপন মনে। তারপর বাটি থেকে মুখভর্তি করে সরিষার তেল নিলেন এবং মুখ থেকে পাঠকাঠির আগুনে তেল দিতে লাগলেন। তেল পেয়ে পাঠকাঠির আগুন দ্বিগুণ শিখা নিয়ে জ্বলতে শুরু করে। আর ফকির বাবার হাতের জাদুতে অনামিকার দিকেই এগুতে থাকে।
—আ। ছেড়ে দাও আমাকে, লাগছে আমার। অনামিকা চিৎকার করে ওঠে।
— জয় মা কালি, জয় মা।
ফকির বাবার চ্যালা উপস্থিত সবাইকে জোরে জোরে জয় মা কালী বলতে বলে। নিমিষেই সুনীলের ছোট উঠানটা মা কালীর জয়ধ্বনিতে ভরে ওঠে। ভক্তিতে গদগদ হয়ে হাতজোড় করেই দাঁড়িয়ে থাকে কেউ কেউ।
অনামিকা হঠাৎ পাগলামি শুরু করে। গায়ের সমস্ত জোর দিয়ে নিজেকে মুক্ত করতে চায় ও, সমানভাবে চালিয়ে যায় চিৎকার। ফকির বাবার অট্টহাসিতে দুর্বল অনামিকার সে চিৎকার ম্লান হয়ে যায়। কতগুলো শুকনো মরিচের গায়ে সিঁদুর জড়িয়ে আগুনে পোড়ানো হলো। উপস্থিত জনতা নাকে কাপড় চাপা দিতে ব্যস্ত তখন। অনামিকা কাশতে কাশতে বমি করে দেয়, একসময় ক্লান্তিতে ঝিমিয়ে পড়ে।
দুর্বল ঝিমিয়ে পড়া অনামিকার শরীরে গাছের ডাল দিয়ে জোরে জোরে আঘাত করতে থাকল ফকির বাবা। লিপি চিৎকার করে ওঠে মেয়ের ব্যথায়, ওকে দুজন চেপে ধরে ফিসফিস করে বোঝাতে থাকে, চিল্লাও ক্যা বউ? এই বেতা তো আমাগো অনু পাইতাছে না, পাইতাছে জিনে।
ব্যথায় অনামিকার ঝিমিয়ে পড়া শরীরটার কোনো পরিবর্তন হলো না, নড়ার মতো একটুও শক্তি আর অবশিষ্ট নেই ওর শরীরে। শুধু সুন্দর পবিত্র মুখটায় ব্যথার চিহ্ন লেপে দিলো কেউ।
ছয়.
শিমুলতলী গ্রামের যেখানে খেয়াঘাটটা ছিল, সেখানে বিশাল ব্রিজ হয়েছে। কারেন্টের বাতি এখন ঘরে ঘরে। টিভি, ক্যাসেটে হিন্দি সিরিয়াল, গান বাজতেই থাকে বাজারের দোকানগুলোতে। স্কুল ফেরার পথে বই-খাতা বুকে চেপে ধরে চায়ের দোকানগুলোতে বসে টিভি দেখতে দেখতে বাড়ি যাওয়ার কথা বেমালুম ভুলে যায় ছাত্ররা। ব্রিজ দিয়ে নেতাদের গাড়ি ঘন ঘন আসে-যায়। রহিম ব্যাপারীর খিচুড়ির দোকানটা দোতলা হয়েছে। কেবল অশান্তি একটাই—সুনীল পাগলের যন্ত্রনা। মেয়েকে হারিয়েছে আজ দশ বছর হতে চললো, এতদিনেও পাগলামি সারলো না তার। তবে এর একটা বিচার দরকার। আজকের অন্যায় মেনে নিলে বড় অধর্ম হবে।
বাজারের মাঝে ইউনিয়ন পরিষদের ঝকঝকে পাকা বিল্ডিং। সেখানে উপস্থিত হয়েছে মান্যগণ্য ব্যক্তিরা সব। সুনীল পাগলের আজ বিচার করতেই হবে।
স্বপন পালের বোনটার বিয়ের বয়স পার হয়ে যাচ্ছে, বিয়ে দিতেই পারছে না। দিন দিন ওজন কমেই যাচ্ছে বোনের। তাই তো সিলেট থেকে এক ফকির আনার ব্যবস্থা করেছিল স্বপন। খুব নামকরা ফকির। অনেকদিন ধরে অপেক্ষা করার পর এই ফকির বাবার সিরিয়াল পেয়েছে স্বপন পাল। বাবা নিজেই তার বাড়িতে পায়ের ধুলো দিতে রাজি হয়েছে বলে স্বপ্ন মালোর অহঙ্কারে যেন পা মাটিতে পড়ছিল না। সেই অহঙ্কার, সম্মান সব ধুলোয় মিশিয়ে দিলো ওই পাগলটা! রাগে গজগজ করছে স্বপন। ছি ছি ছি কী লজ্জার কথা, বাবার গায়ে হাত শেষ পর্যন্ত? এ অধর্ম মেনে নেওয়াও পাপ। তাই বিচার বসেছে। প্রত্যেকের অভিযোগ এই পাগলটার বিরুদ্ধে। এবার ওকে গ্রাম ছাড়া করতেই হবে। জনগণ খুব ক্ষেপেছে আজ।
সুনীল হাসছে আপন মনে, আনন্দের হাসি, প্রশান্তির হাসি, জয়ের হাসি। জনগণ আজ বিচার চাইছে, কিন্তু কে বিচার করবে? কার বিচার করবে? পাগলের কোনো বিচার হয় না!