ঠা-ঠা রোদ নেমেছে বাইরে। আকাশজুড়ে নীল-সাদা মেঘের ভেলা পাল উড়িয়ে আনন্দে ভাসছে অজানা গন্তব্য বরাবর। সেদিকে চোখ পড়তেই দারুণ খুশিতে মন নেচে উঠলো রাকিবের। গলা ছেড়ে ‘নীল আকাশে কে ভাসালে সাদা মেঘের ভেলা রে ভাই, লুকোচুরি খেলা’ গেয়ে উঠতেই রিকশাঅলা চমকে তাকালো তার দিকে। পাত্তা না দিয়ে রাকিব তার আনন্দটাকে ছড়িয়ে দিল হাওয়ায়, সুর ভাসিয়ে দিলো চারপাশে।
রাকিবের আনন্দটা রিকশাঅলাকেও ছুঁয়ে দিল হয়তো, আচমকা রিকশার গতি বাড়িয়ে দিল সে-ও। হাওয়া কেটে রিকশা ছুটলো শন শন। দুপুরটা ভারী নির্জন। শরতের আকাশে ভাসা নীল-সাদা মেঘ আর চোখে ধাঁধা লাগানো রোদ্দুর প্রকৃতিতে কী যেন এক অলসতা ছড়িয়ে দেয় এ সময়টাতে, মফস্বলের এই পিচঢালা রাস্তার প্রতি পরতে পরতে কী যেন এক মায়া উড়তে থাকে মরীচিকা হয়ে। রাস্তায় লোকজন বড় একটা চোখে পড়ে না এ সময়ে। কেমন একটা ভাপ ওঠা উত্তাপ ছড়িয়ে থাকে বাতাসে, রোদের সঙ্গে মিতালি করে সে উত্তাপ যত বাড়তে চেষ্টা করে, হাওয়ার গায়ে মিশে থাকা শীতলতা তত তাকে পর্যুদস্ত করার চেষ্টায় ছোটে। দুয়ের চেষ্টায় শেষে কাটাকাটি হয়ে না গরম না ঠাণ্ডা আবহাওয়া বইতে থাকে তখন অগত্যা।
কেবিনের দরজা সরিয়ে ভেতরে যেতেই একমুখ হাসলো মিনু। দেখে বুকের ভেতরটায় দারুণ একটা সুখ উথলে উঠলো রাকিবের।
রিকশাঅলার হঠাৎ তোলা গতিতে রাকিবের কণ্ঠ কেঁপে ওঠে হাওয়ার ধাক্কায়, সুর কেটে যেতে চায় যেন-বা। কিন্তু ওসবে গা করে না রাকিব। এমন আনন্দ সহসা আসে না জীবনে। হঠাৎ হঠাৎ আসে। তখন একটু বেপরোয়া হতে হয়, একটু বেহিসেবি, একটু নিয়মের বাইরে গিয়ে হাঁটতে হয় তখন। রাকিবের জীবনে এমন একটা দিন সহজে তো মেলে না, মেলেনি। বহুদিনের সাধনার পর, বহুবছরের প্রতীক্ষার পর, এমন একটা দিন সহসা কড়া নেড়েছে তার দরজায়, খুলেছে নিজের ওপর জমে থাকা ঘন পর্দার ঝালর। আজ তাই বাঁধভাঙা আনন্দ তার, পাল ছেঁড়া উচ্ছ্বাস। আজ মিনু ছাড়া পাবে ক্লিনিক থেকে। গত শুক্রবারে হঠাৎ লেবার পেইন ওঠায় তাকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছিল রাকিব। কী যে ভয় পেয়েছিল সে তখন।
মাঝ-রাত্তিরে ঘুম থেকে ডেকে তুলে মিনু যখন তাকে ভয়ার্ত গলায় জানিয়েছিল পেইন উঠেছে তার, দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে, সদ্য ঘুম-ভাঙা রাকিবের মাথা তখন পুরো খালি। কী করবে বুঝতেই পারছিল না প্রথমটায়। পরে তড়িঘরি একটা অ্যাম্বুলেন্স ডেকে সে মিনুকে নিয়ে ছুটেছিল সবচে কাছের ক্লিনিকটায়। সে রাতেই সিজারে ছোট্ট একটা বার্বিডলের মতো মেয়ে হয়েছে মিনুর। মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আনন্দে চোখে জল এসে গেছিল রাকিবের। আহা! তার এই ছন্নছাড়া জীবনটাকে সংসারের শক্ত খুঁটোয় মিনু বেঁধেছিল ঠিক, তবু হঠাৎ হঠাৎ মন বড় উচাটন হতো তার। বড় আঁইঢাঁই করতো সব ছেড়ে আবার নিরুদ্দেশ হতে। সেই ছোট থেকে বাবা-মাকে হারিয়ে মুক্ত বিহঙ্গ ছিল রাকিব। সংসার নামক মায়ায় আটকে রাখার মতো কেউ ছিল না তার কৈশোর বা প্রথম যৌবনে। দিন কেটেছে পথে-ঘাটে, রাস্তায় রাস্তায়। তাতে লাভের লাভ যা হয়েছে, তা হলো দিব্যদৃষ্টি পেয়েছে সে। অল্প বয়সেই জীবন খুলে দিয়েছে তার তৃতীয় নয়ন।
অনেক ঘাটের জল খেয়ে অবশেষে সে বুঝেছে, জীবন আদতে এক মায়া। অর্থহীন এক পুতুল খেলা। যতই তাকে সাজাও, যতই তাকে বাজাও, সে ঠিক হুট করে গুটিয়ে নেবে তার মোহঘোর, একটানে চোখ থেকে সে সরিয়ে নেবে তার ইন্দ্রজাল। হতবুদ্ধি হয়ে তখন তুমি দেখবে খেলাঘর শূন্যে মিলিয়ে গেছে, মুছে গেছে তার ছায়াটুকুও। তখন তোমার জন্য পড়ে থাকবে অনন্ত শূন্যতা, অসীম হাহাকার। রাকিব তাই জীবনের ছুড়ে দেওয়া লড়াইটা লুফে নিয়েছে কৈশোরকাল থেকেই। ইচ্ছেমতো সে লড়েছে বা লড়েনি, জিততেই হবে তেমন ইচ্ছে কখনো স্থান পেতে দেয়নি মনে। সে জানে, আদতে হার-জিত বলে কিছু নাই জীবনে। যা আছে, তা নিতান্তই এক ছেলেখেলা। আপেক্ষিক তার ফল। এই হয়তো মনে হবে সে হেরেছে, গো হারা হেরে সে হারিয়ে ফেলেছে জীবনের সমস্ত সঞ্চয়, সময়ের পলি পড়ে পরে আবার মিথ্যে হয়ে যাবে সেই জানাটাই। তখন হয়তো আবার মনে হবে মোটেই হারেনি সে, তুমুল জিতেছে বরং সময়ের বিচারে। রাকিব তাই সহসা উত্তেজিত হয় না কখনো। কিন্তু আজকের হিসাব ভিন্ন। আজ মিনু ফিরবে। সঙ্গে ফিরবে রাকিবের বার্বিডলটা। আহা। কী যে মায়ার একটা টুকরো তার জন্য মিনুর মাধ্যমে পাঠিয়ে দিয়েছেন ঈশ্বর! সেই ঈশ্বর! যাকে জন্মাবধি কখনো মনেও পড়েনি রাকিবের, সেই ঈশ্বরের প্রতি হঠাৎ কৃতজ্ঞতায় হৃদয় পূর্ণ হয়ে ওঠে তার। সেদিন নার্স তার কোলে বার্বিডলটাকে দেওয়ার পর আনন্দে কাঁদতে কাঁদতে দু রাকাত শোকরানা নামাজ পর্যন্ত পড়ে ফেলেছে সে।
রিকশার সাঁই সাঁই গতি, নির্জন পথ-ঘাট আর প্রকৃতিতে হঠাৎ নেমে আসা অপার সৌন্দর্য রাকিবের খোলসে লুকিয়ে থাকা আদি সত্তাটাকে টান দিয়ে বের করে আনে আজ। বরাবরের মুখচোরা, লাজুক রাকিব তাই গলা ছেড়ে গান ধরে সব ভুলে। মিনু! মিনুও তার পানসে জীবনে সহসা উড়ে আসা এক শান্তির সুবাতাস। পথে পথেই ঘুরতো হয়তো সে মুক্তকচ্ছ হয়ে। কোত্থেকে সেখানে উড়ে এলো মিনু। এসেই তার ডাগর কালো চোখের মায়ায় আটকে ফেললো রাকিবের পরিযায়ী মনটাকে। অতঃপর ঘরের মোহ টের পেলো রাকিব। পরিযায়ী চলন ভুলে সে-ও মাতাল হলো অতঃপর পুতুল খেলার নেশায়। একটু একটু করে আটকে যেতে থাকলো সংসার নামক ফাঁদে। মাঝে মাঝে মন তবু কাঁদে। ছোট্ট সংসারটাকে মিনু যতই আগলে রাখে, একটু একটু করে যতই সাজিয়ে গুছিয়ে পূর্ণ করে তোলে, রাকিবের মনের ভেতরের উড়নচণ্ডী পাখিটা তত ডানা ঝাপটে ওঠে হঠাৎ হঠাৎ। ইচ্ছে করে আবার সে উড়াল দেয় দূরে।
ছন্নছাড়া বোধটা এলোপাথারি ঘোরে মন জুড়ে। কিন্তু বার্বিডলটাকে দেখার পর থেকে ভারি শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে সে বোধটা, থিতু হয়েছে প্রায় সংসার নামক মোহে। সত্যি বটে ডলটা তার নিজের নয়। কিন্তু নিজের নয়ই বা কেন? ডাক্তার তাকে জানিয়েছিল বাবা হতে পারবে না কখনো রাকিব। মৃত শুক্রানু দিয়ে বাবা হওয়া যায় না কিছুতেই। কিন্তু মিনুর মা হওয়ার স্বপ্নের কাছে সেসব মিথ্যে হয়ে গেছে। একান্ত গোপনে ডাক্তারের আর বিজ্ঞানের সহায়তায় মিনুকে তার স্বপ্নের কাছে দাঁড় করানো গেছে। পুতুলটাকে কোলে নেওয়ার পর মিনুর মুখে যে হাসি ছিল, তা পৃথিবীর যে-কোনো সৌন্দর্যের কাছে নস্যি। আর মিনুর অভ্যন্তরে একটু একটু করে বেড়ে ওঠা স্বপ্নটাকে রাকিব নিজেও আঁকড়ে ধরেছে কখন নিজের অজান্তেই, সেসব আজ আর মনে নেই। শুধু মনে আছে স্বপ্নটা মিনুর একার ছিল না শেষ অবদি, ছিল তাদের, ছিল দুজনের।
কেবিনের দরজা সরিয়ে ভেতরে যেতেই একমুখ হাসলো মিনু। দেখে বুকের ভেতরটায় দারুণ একটা সুখ উথলে উঠলো রাকিবের। ডলটা পাশের ছোট্ট বিছানায় গুটিসুটি হয়ে ঘুমোচ্ছে।
এত দেরি করলে যে?
মিনুর দ্বিতীয় অ্যাটাকটা ততক্ষণে হয়ে গেছে। তাদের দুজনের স্বপ্নটাকে একা রাকিবের ওপর চাপিয়ে দিয়ে ততক্ষণে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে গেছে সে।
মিনুর কণ্ঠের কৈফিয়ত চাওয়ার ভঙ্গিতে হাসে রাকিব। মিনুকে সে বলেনি, জমানো টাকা থেকে সে সংসারের জন্য টুকিটাকি কিছু জিনিস কিনেছে গেলো দুদিন ধরে। মিনু অনেক সময় বায়না করলেও যেগুলো কিনে দিতে পারেনি রাকিব আগে, ইচ্ছেও হয়নি। কিন্তু বার্বিডলটাকে দেখার পর থেকে তার কী যেন একটা হয়েছে। ইচ্ছে করছে পৃথিবীর সমস্ত সুখ চুরি করে এনে সে ছড়িয়ে দেয় মিনুর পায়ের কাছে, বার্বিডলটাকে একান্ত করে আঁকড়ে রাখে বুকের মধ্যে। ঘুমন্ত মেয়েটাকে দুহাতে অতি সাবধানে তুলে নেয় রাকিব, চুমু খায়। দেখে মিনু হাসে। তার চোখে জল টলটল করে, উপচে পড়ে দু ফোঁটা।
আমাদের মেয়ে!
ফিসফিস করে রাকিব।
হু। আমাদের।
সায় দেয় মিনু। কেবিনে টোকা পড়ে তখনই। ডাক্তার ঢোকেন। পাশে নার্স। ডাক্তারকে দেখে সালাম দেয় তারা দুজনেই। রাকিবকে লক্ষ করে ডাক্তার বলেন, কী খবর? বাবা হয়ে কেমন লাগছে?
জি ভালো! আপনাদের অনেক ধন্যবাদ!
ধন্যবাদের কিছু নেই। এটা আমাদের দায়িত্ব। কিন্তু আপনাদের সাহস, বিশেষ করে আপনার স্ত্রীর এত শারীরিক জটিলতা, হার্টের সমস্যা সত্বেও তিনি যে লড়াইটা এতদিন লড়েছেন, সেটা সত্যিই ভীষণ প্রশংসাযোগ্য। ডাক্তার হলেও আমরাও তো মানুষ ভাই! আমরা নিজেরাই ভয় পেয়ে গেছিলাম কিন্তু! যাক, শেষ পর্যন্ত সবকিছু যে ভালোয় ভালোয় মিটেছে, আপনারা সন্তানসহ আজ হাসিমুখে বাড়ি ফিরতে পারছেন, এটাই স্বস্তির।
রাকিব মাথা নাড়ে। সত্যি। সব ভালোয় ভালোয় মিটেছে। আজ বাড়ি ফিরবে তারা। এই তো, খানিক পরেই। মিনু হঠাৎ মনে পড়ার ভঙ্গিতে বলে, কাল রাতে আমার বুকে ভীষণ ব্যথা করছিল, নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল।
রাকিব চমকে তাকায়। কই, আমাকে তো বলোনি?
তুমি ঘুমাচ্ছিলে, ডাকতে ইচ্ছে করলো না আর।
এটা ঠিক করেননি। সিস্টারদের ডাকতে পারতেন! ডাক্তার গম্ভীর কণ্ঠে বলেন।
এখন কেমন লাগছে? ডাক্তারের স্বরটা উদ্বিগ্ন শোনায়।
এখনো হালকা ব্যথা আছে। হঠাৎ হঠাৎ সূঁচের মতন একটা ব্যথা খোঁচা দিচ্ছে।
ডাক্তারের মুখটা সহসা সাদা মনে হয় রাকিবের। সিস্টারকে দ্রুত কিছু নির্দেশ দেন তিনি। রাকিবকে বলেন কতগুলো ওষুধ আনতে। কিছু টেস্ট করাতে হবে। ভেরি আর্জেন্ট!
বিকেলটা হঠাৎই ম্লান হয়ে আসে। বৃষ্টি নামে দুম করে। রাকিব ওষুধ আনতে ছোটে, দ্রুতই ফেরেও। মিনুর দ্বিতীয় অ্যাটাকটা ততক্ষণে হয়ে গেছে। তাদের দুজনের স্বপ্নটাকে একা রাকিবের ওপর চাপিয়ে দিয়ে ততক্ষণে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে গেছে সে।
অ্যাম্বুলেন্সে ফিরছে রাকিব। হতভম্ব। আজ তাদের বাড়ি ফেরার দিন। তার কোলে বার্বিডল, পাশে মিনুর নিথর শরীর। বাইরে ভাদর কাঁদছে।