লোকটাকে মাঝে মাঝে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় বৈকি। ইচ্ছে হয় চোখবুজে বিশ্বাস করে বুকভরে আরেকবার দম নিতে। কত যে লোককথা ছড়িয়ে থাকে মানুষের মুখে মুখে, দৈনন্দিন জীবনের প্রতি পরতে পরতে! সত্যিই। সেসব কথার কথা না হয়ে সত্যি হলে বেশ হতো। জীবনটা অন্যরকম হতো তাতে, অন্যরকম হতে পারত নিশির জীবনও। ভেবে বড় একটা শ্বাস ছাড়ে নিশি। বুকের ভেতর জমে যাওয়া দুঃখগুলো খানিক বুঝি উড়িয়ে দেয় হাওয়ায়। তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয় থির হয়ে গেঁথে যাওয়া বেদনার ক্ষত। হয় না। সব সত্যি হয় না। অন্তত তার জীবনে হয়নি। ভালোবাসার কাঙালপনায় একজীবন কেটেছে তার। কেউ ভালোবাসেনি। ভালোবাসার মুখোশ পরে যেসব পুরুষ এসেছে জীবনে, কেউ তারা প্রেমিক ছিল না আদতে। ছিল মুখোশের অন্তরালে ঘৃণার দগদগে ক্ষত, স্বার্থের নোংরা সব মুখ। লোকটাকে তাই বিশ্বাস করার কারণ নাই কোনো। সবার জীবনে প্রেম আসে না, এটাই চরম সত্যি। বাকি সব মিথ্যে।
লোকে বলে প্রথম প্রেম ভোলা যায় না। কথাটা নেড়েচেড়ে অনেকবার দেখেছে নিশি মনে মনে। উল্টেপাল্টে যাচাই করার চেষ্টা করেছে সত্যতা। কথাটা মনে হয় মিথ্যেও নয় খুব। পলাশকে ভোলেনি সে আজও। পলাশ কি ভুলেছে তাকে? হয়তো। তাতে কী-ই-বা এসে যায় কার। পলাশ প্রথম প্রেম ছিল তার। কিন্তু পলাশকে সে স্মরণ করে প্রেমে নয়, প্রবল ঘৃণায়। এই পলাশই তাকে চিনিয়েছে নরকের পথ। নামিয়েছে আস্তাকুঁড়ে। অথচ পলাশকে সে ভালোবেসেছিল। পলাশও বলেছিল ভালোবাসে। দিনগুলো ছবির মতো চোখে ভাসে নিশির। সিনেমার মতো মনের পর্দায় দোলে।
স্কুলপড়ুয়া নিশির তখন উড়ু উড়ু মন। মাথায় সিনেমার পোকা। শাবনূর, সালমান শাহের সিনেমা দেখার জন্য সারাক্ষণ আঁকুপাঁকু মন। স্কুলে ক্লাসের ফাঁকে বান্ধবীরা যখন সিনেমার গল্প করে, নিজেদের প্রেমিককে নিয়ে সিনেমা দেখতে যাওয়ার অভিজ্ঞতা ফিসফিসিয়ে বিনিময় করে, উত্তেজনায় রীতিমতো গায়ে কাঁটা দেয় তখন নিশির। কী যে দুঃখ হয় তখন তার। পৃথিবীর সবচেয়ে দুঃখী মেয়েটা হয়ে যায় সে তখন। জীবন কেন যে এত পানসে হয়ে ধরা দিল তার কাছে! ভেবে দুঃখে জল এসে যায় তার চোখে। তারও কি অমন গোটাকতক সিনেমা দেখা উচিত ছিল না এতদিনে? উচিত ছিল না কি গোটাকয়েক প্রেমপত্র পাওয়া, নিদেনপক্ষে একটা প্রেমিক জোটা? অথচ সেসব কিচ্ছু না। তার মাস্টারমশাই বাপের প্রতাপে তল্লাটের কোনো ছোকরার সাহসই নেই নিশির সামনে এসে দাঁড়ায়, সেখানে প্রেমপত্র তো দূর কী বাত! চোখের জল মুছে, মনের দুঃখ চেপে শেষপর্যন্ত এসএসসি পাশই করে ফেলল নিশি। বাপের নাগাল থেকে বের হওয়ারও মওকা মিলল অবশেষে। নিশি তখন ছাড়া পাওয়া বল্গা হরিণ, সদ্য ডানা গজানো মুক্ত বিহঙ্গ। তখনই পলাশ আলটপকা হাজির হলো এসে নিশির সামনে। নাচুনে বুড়ি নিশির সামনে ঢোলের বাড়ি হয়ে আচমকা বেজে উঠল সে ভালোবাসার অমিয় বীণায়।
টলতে টলতে নিজের ঘরের দিকে যেতে যেতে জহিরকে বলে লোকটাকে বিদায় করে দরজাটা বন্ধ করে দিতে।
নিশিও মুগ্ধতায় ডুবলো পলাশে, বেজে উঠলো তার সুরে। অতপর সিনেমা, নাটক বহুকিছুই হলো অল্প সময়ের মধ্যেই। বিয়ের প্রসঙ্গটা এত তাড়াতাড়ি তুললো পলাশ যে রীতিমতো ভড়কে গেলো নিশি। মাস্টারমশাই বাপের মেয়ে সে, আর যাই করুক, পড়াশোনা বাদ দিয়ে মাথায় আধহাত ঘোমটা টেনে সংসারের চৌহদ্দিতে ঢুকতে সে মোটেই প্রস্তুত নয় তখন। প্রেম, সিনেমা দেখা, ঘোরাঘুরি পর্যন্তই তার দৌড়। তার বেশি কিছুর সাহস সে সঞ্চয় করে উঠতে পারেনি তখনো। কিন্তু পলাশ নাছোড়বান্দা। তার নিয়মিত ঘ্যানঘ্যানানিতে অতিষ্ঠ হয়ে নিশিও রাজি হলো অগত্যা। পরিবারের কাউকে না জানিয়ে, বন্ধুদের কাউকে কিছুমাত্র আভাস না দিয়ে পলাশের সঙ্গে এক ভোরে বেরিয়ে পড়লো সে। বিয়ের জন্য হাপিত্যেস করে মরা পলাশ বিয়ের নামগন্ধও না নিয়ে তাকে নিয়ে এক হোটেলে উঠলো দিনশেষে। নিশির সব ওজর-আপত্তিকে একফুঁয়ে উড়িয়ে দিয়ে এক সপ্তাহ দাম্পত্য জীবন কাটলো তাদের। সপ্তাহপরের এক নতুন ভোরে নিশি চোখ খুলে নিজের পাশে আবিষ্কার করলো সম্পূর্ণ অপরিচিত এক মাঝবয়সী লোককে, যার মুখ ভর্তি বসন্তের দাগ, কুঁতকুঁতে গর্তে বসা দুটো চোখ, ভাঙা গাল আর মস্ত এক থলথলে ভুঁড়ি। প্রবল আতঙ্কে নিশির তখন জ্ঞান হারানোর দশা। সেই সতেরো বছর বয়সে নিশি প্রথম বুঝলো পৃথিবীতে আসলে প্রেম বলে হয় না কিছুই। যা হয়, তা প্রেমের মুখোশে ঢাকা স্বার্থের জঘন্য, কদাকার মুখ। মুখোশ সরালেই যেখানে চোখে পড়ে স্বার্থের ঘৃণ্য কঙ্কাল, প্রয়োজনের দগদগে ক্ষত। পলাশ ঠিক কত টাকার বিনিময়ে তাকে লোকটার হাতে তুলে দিয়ে পালিয়েছিল, সেটা আর জানা হয়নি নিশির কোনোদিন। জানার ইচ্ছেও জাগেনি। বিকৃত রুচির সে লোকটার কবল থেকে মাসখানেক পরেই পালিয়েছিল নিশি নিজেও।
লোকটা ঘুমিয়ে গেলে রাতের অন্ধকারে শূন্যহাতে বাথরুমের পেছনের উঁচু খুপরি বেয়ে সে বেরিয়ে এসেছিল আবার পৃথিবীর মুক্ত হাওয়ায়। তখন তার সারা শরীরে ক্ষত। জ্বলন্ত সিগারেটের ছ্যাঁকা, কামড়ের দাগ, নখের তীক্ষ্ণ আঁচড় শক্ত হয়ে গেড়ে বসেছে তখন তার শরীরের প্রতি ইঞ্চিতে প্রায়। এ অবস্থায় কোথায় যাবে সে? ভাবছিল আনমনে। মাস্টারমশাই বাপের কাছে ফেরার প্রশ্নই ওঠে না। বাপের মুখে চুনকালি যা মাখার সেটা ইতোমধ্যেই পুরু করে মাখিয়ে দিয়েছে নিশি, আর সেটা নবায়নের কোনো প্রশ্নই ওঠে না। তাছাড়া, তার সারা শরীরে যে আঘাতের চিহ্ন, দগদগে সব ক্ষত, সেসব নিয়ে বাপের সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর শক্তিটুকু নিজের মধ্যে সে খুঁজেই পেলো না আর। স্টেশনের নির্জন কোণে বসে সে জীবনের গূঢ়তম সত্যটুকু উদ্ঘাটন করে ফেললো সেই ভোরে। জীবনে আপনার জন বলতে কিছুই হয় না আদতে। জীবন মানুষের একার, নিতান্তই একলার একযাত্রা এই জীবন। বাবা, মা, বা আর আর জন যারা, তারা সহযাত্রী বড়জোর, তার বেশি নয়। বড় রূঢ় এই সত্য, তবু জীবনের গূঢ় সত্যও এটাই।
নিশির জীবনের সেই অন্ধকারতম পথে আলো হাতে কেউ এসে দাঁড়ায়নি তখন পাশে, ভালোর নিশানা নিয়ে কেউ দেখিয়ে দেয়নি পথ। যদি সেদিন বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়াত নিশি, কী হতো তাহলে? কী? আজকাল প্রশ্নটা বড় ভাবায় তাকে। বাবা নির্ঘাৎ আত্মহত্যা করতেন। মা মারা গেছিলেন সেই শিশুবয়সে। মা কী করতেন সেটা নিয়ে ভেবে তাই আর সময় নষ্ট করতে হয়নি তাকে। কিন্তু মা যদি বেঁচে থাকতেন, কী করতেন তিনি নিশির সেই ঘেয়ো, নোংরা শরীর দেখে? গলায় দড়ি দিতেন? বিষ খেতেন? না কি নিশিকেই বিষ খাইয়ে মারতে চাইতেন? উত্তরটা জানা হবে না তার কোনোদিন। কারণ, সন্তানের প্রতি মায়ের স্নেহ ঠিক কেমন হয় সেটা জানে না নিশি। জানার কোনো সুযোগও নাই। মানসিক বিকারগ্রস্ত সেই লোকটা নিশির মা হওয়ার সম্ভাবনাকে চিরতরে নষ্ট করে দিয়েছিল এক ডাক্তারের সহায়তায়। জীবনকে চেনার আগেই তার বিভৎসতাকে চিনতে শিখেছিল নিশি।
চিনতে শিখেছিল তার অন্ধকারতম পিঠ, আলো চেনার আগেই। সেই সকালে স্টেশনে এসে দাঁড়ানো প্রথম ট্রেনটায় উঠে বসেছিল সে, এক অনিশ্চিত যাত্রায় নিজেকে ভাসিয়ে দিয়েছিল গন্তব্য না জেনেই। জীবন তাকে দেখিয়েছে অসংখ্য অসুন্দর মুখ, অগণিত সুন্দর মুখোশ। সুন্দরের আড়ালে লুকিয়ে থাকা অসুন্দর দেখতে দেখতে, সাধুর খোলসে লুকিয়ে থাকা পিচাশ চিনতে চিনতে এখন মুখ মাত্রই মুখোশ ভাবে সে, মুখোশ মাত্রই মুখ। কে যে কার আড়ালে, ভেবে কূল পায় না আর। লোকটাকে তাই বিশ্বাস করতে ভরসা পায় না নিশি। ঘর পোড়া গরু সে, সিঁদুরে মেঘেই ভয়ে জমে যেতে চায়। কিন্তু এই প্রায় পঞ্চাশে জীবনের আর কি-ই বা বাকি আছে তার? কী বাকি থাকে তার মতো কোনো এক বারবনিতার? তবু লোকটা কী চায় তার কাছে? কেন অমন হত্যে দিয়ে পড়ে থাকে প্রতিদিন তার ডেরায় এসে? মাঝে মাঝে ভারি অবাক লাগে তার।
লোকটাকে সে দিনের পর দিন অবহেলা, অপমান, অসম্মান করেছে, তাড়িয়ে দিয়েছে, লোকটা তবু আবার এসে হাজির হয়েছে পরদিন, বাড়িয়ে দিয়েছে টাকার বান্ডিল। জীবন চিনেছে নিশি আঘাতে, অপমানে, অনাচারে, অত্যাচারে। টাকা সংসারে বড় জরুরি জিনিস, তাকে অবহেলা করতে নেই, নিশির চেয়ে ভালো সে-কথা আর কেই-বা জানে! প্রথম প্রথম তাই টাকা নিত নিশি, লোকটার বাড়িয়ে দেওয়া হাত থেকে টাকাটা লুফে নিয়ে ট্যাঁকে গুঁজত অনায়াসে। কিন্তু একসময় বিরক্তি এল। নিশি যৌনশ্রমিক। শ্রমের বিনিময়ে টাকা নিতে আপত্তি থাকার তার প্রশ্নই নেই। কিন্তু বিনা পরিশ্রমে পারিশ্রমিক নেয়াও তার ধাতে সয় না বেশিদিন। নিজেকে ভিক্ষুকশ্রেণির মনে হয় তাতে। আর লোকটার উদ্দেশ্য নিয়েও বিস্তর সন্দেহ জাগে তার। বয়স নেহাত কম তো নয়। এই বয়সের একটা লোক এমন ছ্যাবলাকান্ত হয়ে নিশির মতো প্রায় বুড়ি বারবনিতার পায়ের কাছে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকবে এটা অবিশ্বাস্য। অগত্যা সেদিন লোকটার ওপর ক্ষেপে ওঠে নিশি। সব খদ্দের বিদেয় করে সবে তখন নিজের মতো একটু গুছিয়ে বসেছে নিশি, আয়োজন করছে ঘুমের। এই বয়সে এসে ঘুমটা বড় জ্বালায় ইদানীং। সময়মতো না ঘুমোতে পারলে বাকি রাত নির্ঘুম কাটে। সে বড় যন্ত্রণা। রাজ্যের কথা মনে পড়ে তখন, দুনিয়ার সব দুঃখ এসে ভর করে মনে। বুড়ো বাপটাকে মনে পড়ে জল আসে চোখে। পুরোনো ভুলগুলো কাঁটা হয়ে বেঁধে মনে। সে বড় কষ্ট। সেদিন তাই দরজায় টোকা দিয়ে জহির যখন বলে, লোকটা আবার এসেছে, নিশির সাক্ষাৎ চায়, নিশি তাই আগুপিছু না ভেবে লোকটাকে পাঠিয়ে দিতে বলে খাপছাড়া তরবারিটি হয়ে উঠে পড়ে বিছানা থেকে। না। লোকটাকে আর সহ্য করা যাচ্ছে না। আজ তার সঙ্গে একটা এসপার ওসপার না হলেই নয়।
আপনি কী চান? সরাসরি লোকটার দিকে চোখ রেখে তীক্ষ্ণ গলায় বলে নিশি। লোকটা বসেছে সোফার এককোণে, খানিকটা এলোমেলো ভঙ্গিতে। নিশির প্রশ্নে সরল, সোজা চোখে তাকায় নিশির চোখে। ম্লান একটু হাসে। বিরক্ত হয় নিশি। রোজকার এই পানসে নাটকটা আর টানা যাচ্ছে না। লোকটাকে কঠিন কিছু কথা বলে বিদায় করতে হবে।
দেখুন। লোকটার মনোযোগ টানতে খানিকটা ভূমিকা করার চেষ্টা করে সে। যদিও জানে তার দরকার নেই। লোকটার মনোযোগ তার দিকেই। তবু নিজেকে সহজ করতেই ভূমিকা টানে সে, দেখুন, আমাকে তো চেনেন। আমি নিশি। বেশ্যা। শরীর বেচি। তা দিয়েই চলে আমার। এখন যৌবন পড়তির দিকে। খদ্দের জোটে না তেমন, বুড়ি। আমার কাছে আপনার প্রতিদিন কী দরকার? শরীর চাইলে তো আমার আপত্তি ছিল না, ওটাই আমার পেশা। কিন্তু আপনি তো শরীর চান না! তাহলে কী বিষয়? কী চান? কেন বিরক্ত করেন আমাকে প্রতিদিন?
এসব ছেড়ে দিন।
মানে? দাঁতে দাঁত চাপে নিশি। অমন ধম্মগুরু জীবনে ঢের দেখেছে সে। সব শালা ইবলিস। প্রথম দিকে ধম্মের ধোঁয়া তুলে ধূপ জ্বালে ভক্তির, তারপর কদিন কাটলেই ভক্তির ধূপ নিভে যায়, ধম্মের ধোঁয়া সরে যায়। আরে ব্যাটা ভণ্ডের দল, অতই যদি ধম্মভয়, তাহলে নিশির মতো বেশ্যার কাছে কী কাজ তোদের?
লোকটার দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে কৈফিয়ত চায় নিশি। লোকটার এই রহস্যময় আচরণ আর হজম হয় না তার। সে বেশ্যা, বারবনিতা। আড়াল খুঁজেই কাটছে তার একজীবন। কিন্তু এই অহেতুক রহস্যের ন্যাকামি তার ভালো লাগে না মোটেই। তবু লোকটার মধ্যে বিশেষ কোনো ভাবান্তর চোখে পড়ে না একদম। নিশির চোখে চোখ রেখে সে আবার বলে, আপনাকে তো অনেকদিন থেকেই বলছি, এসব ছেড়ে দিন। আমার সঙ্গে চলুন।
মানে? আপনার সঙ্গে কোথায় যাব আমি?
আপনার থাকার জায়গা ঠিক করা আছে।
থাকার জায়গা ঠিক করা আছে মানে? কে ঠিক করেছে? আপনি?
জি।
আমি আপনার ঠিক করা জায়গায় যাব কেন? কে আপনি?
আমি কেউ নই।
এখান থেকে চলে যান। আর কোনোদিন এখানে আসবেন না।
কঠিন কণ্ঠে কথাগুলো বলে উঠে দাঁড়ায় নিশি। রাগে তার সর্বাঙ্গ জ্বলছে। কিন্তু লোকটার কোনো বিকার নেই। ওঠার কোনো লক্ষণও নেই।
আপনি এখন আসুন। বিষগলায় কথাগুলো আবার বলে নিশি।
ওঠার আগে টাকার বান্ডিলটা অভ্যাসবশত নিশির দিকে বাড়িয়ে দেয় লোকটা, অন্যদিনের মতোই। ঘৃণাভরে সরে যায় নিশি।
আপনার অনেক টাকা, না? রক্ষিতা পুষতে চান তো? তো যান না, এ পাড়ায় বহু কম বয়সী সুন্দরী বেশ্যা পাবেন। তাদের কাউকে নিয়ে যান। আমার মতো বুড়ির কাছে কেন এসে সময় নষ্ট করছেন অযথা?
আপনি মোখলেস নামের কাউকে চিনতেন?
কী নামের?
মোখলেস!
থমকে যায় নিশি। ভূত দেখার মতো চমকে ওঠে মনে মনে। কিন্তু বাজারের বারোয়ারি বেশ্যা সে, অভিনয়টুকু রপ্ত করেছে বহুদিনের শ্রমে। ভেতরের চমকটুকু ভেতরেই রাখে সে। থমকানো মুখে বলে, কোন মোখলেস?
মুখভর্তি বসন্তের দাগ ছিল লোকটার, বিশাল ভুঁড়িও ছিল। চিনতেন?
মনে পড়ছে না। আপনি এখন যান। অনেক রাত হয়েছে, ঘুমাবো এবার।
এসব ছেড়ে দিন। আমার সঙ্গে চলুন। আমাকে বিশ্বাস করতে পারেন।
বিশ্বাস! বিচিত্র একটুকরো হাসে নিশি। নিজেকেই সে বিশ্বাস করে না আজকাল। বাপ-মার দেয়া নামটা সে বহুকাল আগে ভুলে গেছে সেই অবিশ্বাস থেকেই। সে এখন নিশি। বেশ্যা।
আপনি চলে যান। শক্ত গলায় বলে নিশি।
মোখলেস আমার বাবা ছিলেন। নিশির দিকে তাকিয়ে অনেকটা পাপস্বীকারের ভঙ্গিতে এবার বলে লোকটা।
নিশির বহুদিনের, বহু কসরতে শেখা অভিনয়বিদ্যাটা বিশেষ কাজে আসে না এবার আর। সে সাপ দেখার মতো কেঁপে ওঠে আচমকা। তার চমকটা লোকটা চোখ দিয়ে দেখে শান্তভাবে। তারপর একই ভঙ্গিতে বলে, বাবা মারা গেছেন বছরদুয়েক আগে। খুব কষ্ট পেয়ে মারা গেছেন। প্যারালাইজড হয়ে বিছানায় পড়ে ছিলেন বহুদিন। পচন ধরেছিল শেষে শরীরে। বাবা মারা যাওয়ার আগে আমাকে আপনার কথা বলে গেছেন, বলে গেছেন আমি যেন আপনাকে এই জীবন থেকে মুক্তি দেই।
পলাশ তাকে লোকটার কাছে বিক্রি করে দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার পরের দিনগুলো ছবির মতো ভেসে ওঠে নিশির চোখের সামনে, বহু বহুদিন পর। লোকটার ঘৃণ্য মুখটা মনে পড়তেই অরুচিতে বমি আসে তার, গা গুলিয়ে ওঠে। সামনে বসা লোকটাকে সেই ভীষণ অরুচিকর লোকটার ছেলে ভাবতেই ঘেন্নায় বিষিয়ে যায় মন।
আপনি চলে যান। আর কোনোদিন আসবেন না এখানে। বলে উঠে পড়ে নিশি। টলতে টলতে নিজের ঘরের দিকে যেতে যেতে জহিরকে বলে লোকটাকে বিদায় করে দরজাটা বন্ধ করে দিতে।
আজ রাতটাও নির্ঘুম যাবে তার। ঘুমোতে দেবে না তাকে সুন্দরের মুখোশে ঢাকা অসুন্দরের এইসব ঘৃণ্য মিছিল।
অথচ লোকটা এতদিন দিব্যি মুখোশ এঁটে ছিল। এতদিন বলেছে সে নিশিকে ভালোবাসে! এখান থেকে নিয়ে যেতে চায়! বিয়ে করতে চায়! বেসিনে গিয়ে হড়হড় বমি করে নিশি। ভাগ্যিস লোকটা কোনোদিন উপগত হতে চায়নি নিশিতে! ছি! পরক্ষণেই থমকায় সে। সে বেশ্যা। টাকা দিয়ে যে কেউ খদ্দের হতে পারে তার। বাপ বা ছেলে, যে কেউ। তাতে এত উতলা হওয়ার কী আছে! বেশ্যার আবার সংস্কার কী! সংস্কারকে বলি দিয়েছে বলেই বেশ্যার খাতায় নাম উঠেছে তার। এখন নাচতে নেমে ঘোমটা দেওয়া চলে না। কিন্তু লোকটা তো খদ্দের হতে চায়নি কখনো। তার চাওয়া ভিন্ন, উদ্দেশ্য অস্পষ্ট। এতদিন বরং লোকটাকে বিশ্বাস করার গোপন এক বাসনা তাড়া করছিল তার অবচেতন মনে। কিন্তু আজ সব কেমন গুলিয়ে যায়। তীব্র এক অরুচি দলা পাকিয়ে ওঠে মনের কোণে। লোকটা আবার এদিকে এলে তার উদ্দেশ্যটা জানার চেষ্টা করা যাবে, ভেবে সারারাত এপাশ-ওপাশ করে নিশি। ঘুম হয় না একদম। পলাশ আর ওই ঘৃণ্য লোকটার মুখ সারারাত ভেসে থাকে মনের উচাটন দিঘিজুড়ে। থেকে থেকে লোকটার কথিত ছেলের মুখটাও মনে পড়ে।
পরদিন আর কোনো খদ্দের নেয় না নিশি। লোকটার অপেক্ষায় থাকে সারা সন্ধ্যা। আসে না লোকটা। সচরাচর রাত করে আসে সে, নিশির সব খদ্দের বিদায় নেওয়ার পরে। সেদিনও তেমনই ঘটে। নিশি জানে, লোকটা আসবে, যতই নিষেধ করুক নিশি, তবু আসবে। কিন্তু শুধুই কি বদমাস বাপের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে মরিয়া বলে লোকটা আসে? না কি আরও কোনো কারণ? জানতে উদগ্রীব হয় নিশি।
এতদিন এতসব নাটক করলেন কেন? মিথ্যে বললেন কেন?
নাটক করিনি, মিথ্যেও বলিনি।
মানে?
আব্বার কথা রাখতেই আপনাকে অনেক কষ্টে খুঁজে বের করেছি, এখান থেকে নিয়ে যাবার জন্য আপনার সঙ্গে দেখাও করেছি প্রথমদিকে আব্বার কথা রাখতেই। কিন্তু তার পরেরটুকু মিথ্যে বা নাটক নয়।
ফাজলামি করেন? বেশ্যার সঙ্গে মজা করেন?
না। সত্যি। আমি মিথ্যে বলিনি।
ঘেন্না করে না আপনার? লজ্জা করে না? ছি! পারলে লোকটার মুখে থুতু ছিটিয়ে দেয় নিশি। ঘেন্নায় বিকৃত হয়ে যায় তার মুখ। লোকটা মাথা নিচু করে বসে থাকে অপরাধীর মতো।
তো? আমাকে এখান থেকে নিয়ে গিয়ে রক্ষিতা পুষবেন স্ত্রী-পরিবারের অগোচরে, এই মতলব? তাহলে বাপের কথাই বা বললেন কেন?
আমার কেউ নেই। বউ মরে গেছে ঢের আগে। সন্তান ছিল না আমাদের। আর আপনি যখন কিছুতেই আমাকে বিশ্বাস করলেন না, তখন আব্বার কথাটা বললাম। ভাবলাম অন্তত এখান থেকে আপনি সুস্থ একটা জীবনে ফিরে যান। নিজের মতো থাকুন। এসব ছেড়ে দিন। টাকার অভাব হবে না। আব্বা টাকার ব্যবস্থা করে গেছেন।
বাহ। মহৎ মানুষ আপনারা। আমাকে সুস্থ জীবনের সন্ধান দিতে এসেছেন! শুনুন, আমি বেশ্যা। দিনে অন্তত গোটাকতক পুরুষকে না ছুঁলে আমার ঘুম হয় না এখন। এটাই এখন সুস্থতা আমার কাছে। আর দেখছেন তো, বয়স হয়েছে আমার, কদিন পরে এমনিতেই সব ছেড়ে দিতে হবে, খদ্দের জুটবে না আর। আমার সুস্থ জীবন নিয়ে ভেবে আপনাকে আর ঘুম হারাম করতে হবে না। আমি কাউকে আমার এই জীবনের জন্য দায়ী করি না। আপনি চলে যান। আর কোনোদিন এখানে আসবেন না, এলেও আমাকে আর পাবেন না। আমি এখান থেকে কালই অন্যকোথাও চলে যাব। আপনি এখন আসুন।
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে বড় করে দম নেয় নিশি। জহিরকে বলে লোকটাকে বড় রাস্তা পযর্ন্ত এগিয়ে দিতে। মাথাটা বড্ড ধরেছে তার। হঠাৎই বিদ্যুচ্চমকের মতো ভাবনাটা মাথায় আসে তার। শুনুন!
আচমকা পিছুডাকে ফিরে তাকায় লোকটা। খানিকটা দ্বিধাগ্রস্ত।
মোখলেস নামক লোকটা কি তার কোনো সম্পত্তি আমার নামে করে দিয়ে গেছে?
কঠিনস্বরে প্রশ্ন করে নিশি। লোকটা ঘাবড়ে যায়। হ্যাঁ। একটা ফ্ল্যাট আর পঞ্চাশ লাখ টাকা!
কথাটা বলে নিজেই থতমত খায় লোকটা। কুঁকড়ে যায় লজ্জায়।
খিল খিল শব্দে হেসে ওঠে নিশি। তার হাসির শব্দে রাতের নৈঃশব্দ্য ভেঙে খানখান হয়। হাসি থামিয়ে নিশি অদ্ভুত নিরাসক্ত কণ্ঠে বলে, কাল দিনের বেলায় কাগজপত্র সব নিয়ে আসবেন। আমি আপনার নামে সব ট্রান্সফার করে দেব। চিন্তা করবেন না, আপনাকে আর অহেতুক প্রেমিক সাজার নাটক করতে হবে না।
লজ্জায় কুঁকড়ে যায় লোকটা। ছিটকে ঘর বের হতে গিয়ে তাড়াহুড়োয় দরজার সঙ্গে ধাক্কা খায় সজোরে। লোকটার চুপসে যাওয়া মুখটা দেখে হাসিতে আবার ভেঙে পড়ে নিশি। ঘৃণায় শিউরে ওঠে শরীর মন। লোকটার চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে ক্লান্ত শ্বাস ছাড়ে অজান্তেই। আজ রাতটাও নির্ঘুম যাবে তার। ঘুমোতে দেবে না তাকে সুন্দরের মুখোশে ঢাকা অসুন্দরের এইসব ঘৃণ্য মিছিল।