এক.
গরিবের ঘর।
খানা-খাদ্যের ঠিক নেই। ঘরবাড়ির আব্রু নেই। শুধু মেয়েদের নামগুলো মনোহর। মেয়েও কম না, সব মিলায়ে দেড় গণ্ডা। আল্লাহর রহমতে খালি মাইয়্যে না, ছাওয়ালও পোনে এক হালি। তয় গাও-গেরামের আর দশজনের মতো ছাওয়াল নিয়ে গহর পাগলার কোনো আহ্লাদ নেই। বউ তার বছর বিয়ানি—ফি বছর এট্টা করে বিইয়েই যাচ্ছে। মাঝে একবার একসাথে একজোড়াও বিইয়েছিল। বাঁচেনি। এট্টা করে বাচ্চা না হয় মায়ের বুকের ওম আর মালশার আগুনের তাপে শীতকালেও ঠিকঠাক টিকে যায়। কিন্তু গরিব-গুর্বোর ঘরে একজোড়া গ্যাদার গতি কে করে? না, চার মেয়ে একছেলের পর আরেক জোড়া মেয়ে হয়েছিল বলে গহর কিছুমাত্র বেজার হয়নি যে, হেলা করে আঁতুড়ে মারবে। ও পাড়ার শামছুর মতন সে কন্যেবিদ্বেষী নয়। হতভাগা শামছুর রকম দেখো—বউ তার পরপর দুটো চাঁদপানা মাইয়্যে জম্ম দিলে হারামজাদা বউয়েরে তিন তালাক দেয় আর কি! ভাগ্যি যে বউডার মাইজে ভাই পুলিশের আরদালি না কী যেন—তাই সে যাত্রায় কোনোমতে রক্ষা। তয় তালাক ঠেকে গেলেও ঠেকে থাকে না শামছুর হম্বিতম্বি। যাচ্ছেতাই মুখ করার পাশে সে শ্বশুরবাড়ির আঁতুড় ঘরেই তেড়ে যায় বউয়েরে মারতে। আরদালি ভাই হয়তো সেখানে উপস্থিত ছিল, তাই শামছুর বউ-বাচ্চা সে যাত্রায় বেঁচে যায় এবং ভালোমানুষ বউটা স্বামীর রাগ পড়ার অপেক্ষায় মাসতিনেক বাপের বাড়ির মাটি কামড়ে পড়ে থেকে শেষে নিজ থেকেই ছানাপোনা কোলে ফিরে এসে শামছুর খোঁড়োপোড়ো ঘর-দোর আলো করে তোলে।
তিনবারের বার বউয়ের বাপ-ভাইয়েরা নাইয়র নেওয়ার গরজ না দেখালে শামছু দয়াপরবশ হয়ে বলে, যা বিয়েবি, আমার বাড়ি থাহে বিয়ে, আমার ইচ্ছে হলি সে চান-সুয্যির মুখ দেখবি, ইচ্ছে না হলি না। বউ ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সময়ের আগেই তিন দিন ব্যথায় কাৎরে এক মৃত কন্যা প্রসব করে। এর পরের বার শামছুর বউ মোটামুটি সুস্থভাবে এট্টা জিওল রঙের (শামছুর বরণের মতন) মাইয়্যে জম্ম দিলে শামছু শ্বশুরকে ডেকে সোজা আণ্ডা-বাচ্চাসহ মুরগি বুঝে নিয়ে পথ মাপতে বলে। নারাজ শ্বশুর প্রতিবাদ করলে শামছু তার মস্ত গোল চোখ জোড়ায় সিঁদুরে মেঘ ঘনিয়ে বলে, ওই খোল খালি মাগী জম্মাবার খোল। শামছু মিয়া ওতে আর মোতে না।
গ্রাম জুড়ে ছিঃ-ছিক্কার আর হাসি-তামাশা দুই-ই চলে দিনকতক। নিস্তরঙ্গ গ্রামজীবনে শামছু মিয়া বেশ একটু আমোদ জোগালো। কিন্তু দিনে দিনে শামছুর ঘর যে শ্মশানপুরী! বাধ্য হয়ে একদিন সে বউয়েরে আনতে এক পাড়াতো ভাইপোকে পাঠায়। আর দেখো, বউটা কেমন সুড়সুড় করে এক কাঁখে পুঁটুলি, আরেক কাঁখে চামচিকার ছা তুল্যি ছয়মেসে ছানা, আর হাড়-চামড়াসর্বস্ব বছর ছয়-আটের দুটো মেয়ে নিয়ে টলমল পায়ে বাড়ি ঢুকে ‘যেন কিছুই হয়নি’ ভঙ্গিতে শামছুর ঘর-সংসার ফের ভরে তোলে। মাইয়্যেমানুষ পারেও বটে! বছর না ঘুরতেই শামছুর বউ শামছুরে এক পুত্রধন উপহার দিয়ে সারে। কিন্তু ফের বছর না আসতেই শামছুর মুখে কালি, চোখে সরষে ফুল। এত সাধের পুত্তুর বুঝি তার বোবা-কালা-হাবলা!
গহর পাগলা নামে পাগল হলেও বিবেচক মানুষ, হুঁ। ঘরে বউ থাকলে বছরে এট্টা কি দুডে বাচ্চা বিয়োবে—হোক তা ছাওয়াল কি মাইয়্যে। পুরো ব্যাপারটাই তো আল্লাপাকের ইচ্ছে, মাইনষের এতে হাত কী! কিন্তু পরিকল্পনার আপারা কয়, এতেও নাকি মাইনষের হাত আছে! ব্যাপারটা গহরের মাথায় ঠিক খেলে না, খেলে না তার বউয়ের মাথায়ও। আপারা রঙিন বইয়ের ছবি দেখায়ে কী সব বোঝায়, আর বউটা শরম মাখা মুখে দাঁতে আঁচল কাটতে থাকে। গহরের অবশ্য অত শরম-ভরম নেই। সে বাড়ি থাকতে পরিকল্পনার আপারা এলে সোজা তাদের সারা শরীরে তার জুলজুলে দৃষ্টির অমার্জিত জিহ্বা বোলাতে বোলাতে বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে হাসে। আপামনি গো, বালো আছেন? গহরের কুশল জিজ্ঞাসার ভঙ্গিতেই আপামনি সঙ্কুচিত হয়ে পড়ে। এরপর গহর পাগলা নিতান্ত নাদানের মতন মুখভঙ্গি করে আপামনির কাছে কনডমের ব্যবহার কৌশল জানতে চায়। না, এ ব্যাপারটা বউয়ের বুঝে নিলে চলবে না। বউয়ের বুঝব্যবস্থার পরে বড় ভরসা গহরের নেই। নাদান মাইয়্যেমানুষ—কনডম খায় কী মাথায় দেয়, তাই কি সে জানে! কাজেই গহর নিজেই এটা আপামনির থেকে শিখে নিয়ে ‘টিরাই’ করতে চায়। গহরের বউয়ের হাতে একপাতা বড়ি ধরিয়ে তড়িঘড়ি ব্যাগ গুছিয়ে কেটে পড়া আপামনি আর কোনোদিন গহরের বাড়ি মুখো হয় না। সরকারের পরিকল্পনা ভণ্ডুল করে গহরও সুস্থ-সবল ছয় মেয়ে তিন ছেলের বাপ হয়ে দিব্যি বেঁচে-বর্তে থাকে।
দুই.
এই গহরের মেয়ে সুদূরিকা।
সহায় সম্পদহীন গহর পাগলা ছানাপোনার মুখ ভরানোর তাগিদে জন খাটতে ‘বিদ্যাশ’ যায়। তার এই বিদ্যাশ নিজ জেলার বাইরে বিভিন্ন মফস্বল শহর, এমনকি চেনা এলাকার বাইরে কোনো অচেনা গ্রাম। হরেক রকম কাজে শ্রম বেচে যা সে হাতে পায়, তা ঘরে এনে দিনকতক বেশ মৌজে থাকে। শহর থেকে বাড়ি ফেরার পথে সে ছেলেপুলের জন্য সস্তা মিঠাইয়ের বেশি কিছু না আনলেও বউয়ের জন্য ঠিকই আনে রেশমি চুড়ি, রঙিন ফিতা, এমনকি এক কৌটা স্নো কিংবা বাসনা সাবান। আরেকটা বিশেষ জিনিস সে শহর থেকে সময় সময় বয়ে আনে—নাম। হ্যাঁ, শ্রুতিমধুর নামের পরে গহরের বড় আকর্ষণ। তার মেয়েদের নাম তাই গ্রামের আর সবার চেয়ে আলাদা।
কত বয়স তখন সুদূরিকার? বারো-তেরো? হয়তো তাই, কিংবা তার চেয়ে কম। রোদেপোড়া রুক্ষ-কালচে ত্বক, ক্ষীণ-খর্ব দেহ, আর শ্রীহীন লালচে-বাদামি, চুলের ঝুঁটি—এ সম্বল নিয়ে সে এলো গ্রামসম্পর্কীয় এক ফুপুর ঢাকার বাসায়। চাকরিজীবী ফুপুর কচি ছেলের কিলটা-চড়টার সঙ্গে সবার উচ্ছ্বিষ্ট ও বাসী খাবার এবং ফুপুর শত সতর্কতা সত্ত্বেও তার সংরক্ষিত দামি খাবারের ভাণ্ডার সাবাড় করে অল্পদিনেই সে দিব্যি ফুলে-ফেঁপে উঠল। চোত-বোশেখের নিদারুণ দাহে জ্বলে-পুড়ে খাক হওয়া দূর্বাদল আষাঢ়ের একটানা ঢলেই যেমন সবুজ-সতেজ হয়ে কলকলিয়ে ওঠে, সুদূরিকার শরীরও তেমনি জেগে উঠলো।
হঠাৎ একদিন ফুপু ভেঙে দিলো তার দশ বছর ধরে গড়ে তোলা শত সাধের সংসার।
কালবোশেখের এক ঝড়ে মাথার ওপর থেকে চাল উড়ে গেলে কেমন হয় তা জানে সুদূরিকা, মেয়ে মানুষেরে স্বামী তালাক দিলে তার কী দশা হয়, তাও সে দেখেছে। কিন্তু এটা সে ঠিক বুঝে উঠতে পারে না যে, মেয়েমানুষ কোন ভরসায় নিজের ঘরের চাল ওড়ায়। চাকরি আছে, তাই এত দেমাক? কিন্তু ফুপার দোষটা কী? সুযোগ পেলেই সুদূরিকাকে…। ফুপু বুঝে ফেলছে, না কি দেখছে কিছু? এত হিংসে! সুদূরিকার যে এটা খুব ভালো লাগে, তা বুঝেই বুঝি অত রাগ?
রাতভর ফুপার হাতে ঠেঙ্গানি খেয়ে ভোররাতে এক কাপড়ে ফুপু যে কোথায় পালায়ে গেলো! দিন চারেক পরেই এলো তার উকিল নোটিশ। ফুপা সারাদিন গুম হয়ে বসে থেকে শেষে কাঁদতে লাগলো। আর তখনই সুদূরিকার মনে হলো যে, এখানে আর না। তবু তাকে সেখানে আরও একমাস থাকতে হলো। তার বাপের কাছে খবর দিতে ও ফুপুর বাপের খরচে তার বাপের ঢাকায় এসে তারে বুঝে নিতে এ সময়টা গেলো। এ একমাসে সুদূরিকা একবারও ফুপার দিকে চোখ তুলে তাকায়নি। ফুপাও যেন কী বিরাগে তার দিক থেকে মুখ ফিরায়ে থাকলো।
বাপের ঘরে ফিরে এসে ফের সেই হাভাত দশা। দিন পনেরোতেই অসহ্য হয়ে সে উপায় খুঁজতে লাগলো। উপায় মিলেও গেলো সহজে। আরেক পাড়াতো ফুপুর চট্টগ্রামের বাসায় সে চালান হয়ে গেলো।
এখানকার ফুপা বড়ই চরিত্রবান। তার চরিত্র যেন ফুলের চেয়েও বেশি পবিত্র। সুদূরিকা সুদূরে থাক, নিজের স্ত্রীর দিকে ‘বিশেষ’ চোখে তাকাতেও তার যেন অনীহা। এখানে খাওয়া-দাওয়া ইচ্ছে-স্বাধীন, বিনোদন পরিমিত। সবচে বড় কথা চড়-চাপড় দেওয়ার মতো কেউ এ বাসায় নেই। তবু দেখো, সুদূরিকার মন সময় সময় কোন সুদূরে হারিয়ে যায়। মনে পড়ে আগের বাসার ফুপার কথা। উষ্ণ রক্তের তীব্র ঝলক তার শরীরের কোণায় কোণায় শিহরণ জাগায়।
কয়েকদিনেই শরীরজুড়ে অসহ্য দাপাদাপি। এক তীব্র সুখের দুর্নিবার কামনায় তার সারা শরীরের প্রতিটি কোষ অসহনীয় রকম উন্মুখতায় তাকে পাগল করে তোলে। সম্পূর্ণ অকারণেই সে কখনো হাসে, কখনো কাঁদে। হিস্টিরিয়াগ্রস্ত মেয়েটার দুর্দশায় বিবেচক ফুপু বিপন্ন বোধ করলেও এ থেকে তার আশু পরিত্রাণ দরকার। কর্মব্যস্ত জীবনে কাজের মেয়ে নিয়ে এত হ্যাপা কাঁহাতক ভালো লাগে! কাজেই ফের একমাসের মাথায় সুদূরিকা তার মায়ের কোলে ফিরে আসে।
তিন.
কিন্তু নিম্ন আয়ের এ দেশেও গৃহপরিচারিকা প্রায় দুষ্প্রাপ্য জিনিস। যখনকার কথা বলছি, তখনকার সরকার দেশকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করার খোয়াব দেখেনি বটে, তবে নিম্নআয়ের জনগোষ্ঠীর নারীদের সামনে একদিকে তৈরি পোশাক কারখানার জনবল চাহিদা হা মেলে আছে, অন্যদিকে একবেলা পেটে জাবনা পেলে আর ফিরে শুতে অনিচ্ছুক সক্ষম-অক্ষম নাগরিকদের জন্য নানারকম ভাতা ব্যবস্থা সামাজিক নিরাপত্তার জাল বিছিয়ে চলছে। কাজেই সুদূরিকার পক্ষে চাকরি হারানোর চেয়ে চাকরি পাওয়া ঢের সহজ। কোনো পরীক্ষা নেই, কর্মদক্ষতার প্রশ্ন নেই, চরিত্রিক সনদের বালাই নেই, স্রেফ একজোড়া করে হাত-পা-চোখ-কান থাকলেই চলে। মাথা আছে কি না, সে প্রশ্ন কারও মনে নেই কারণ মাথার এক্ষেত্রে দরকার নেই, বরং মাথা থাকাটা ক্ষেত্র বিশেষে বিপজ্জনক হতে পারে। কাজেই বেকার জীবনের আনন্দ একসপ্তাহ উপভোগ না করতেই সুদূরিকার চাকরি হয়ে যায়।
এবারের চাকরি নিজ জেলার ছোট শহরে। মন চাইলে মাসে মাসে বাড়ি যাওয়ার সুবিধে আছে। প্রথম দুই মাসে সুদূরিকা তা করেও। কিন্তু তৃতীয় মাসে তার আর বাড়ি যেতে মন টানে না। নার্সারি পড়ুয়া মালকিনের কলেজ পড়ুয়া গৃহশিক্ষককে চা-নাশতা দিতে তার কী যে ভালো লাগে! কিন্তু জগতে গরিবের কোনো ভালো লাগাই বড়লোকেরা সুনজরে দেখে না। এখানেও সে নিয়মের ব্যত্যয় হয় না। উকিল মালিকের পুলিশ বউ একদিন তাকে এই বলে হুমকি দেয় যে, ফের যদি সে নাশতা দেওয়ার নাম করে নাতাশা বেবির পড়ার ঘরে ঢোকে তো সোজা বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হবে।
নাতাশা বেবির টিচারকে ফুলির মা নাশতা দেয়। অক্ষম আক্রোশে সুদূরিকা বালতিভরা পানিতে স্যাভলন ঢেলে তাতে ত্যানা চুবিয়ে ঘর মুছতে শুরু করে। কোনোমতে এক ঘর মুছেই সে সোজা গিয়ে ঢোকে বেবির ঘরে। দু’হাত কোমরে রেখে ছোটখাটো শরীরকে টান টান করে আগ্রাসী চোখজোড়া সোজা শিক্ষকের চোখের ভেতর দিয়ে বুকে বিঁধিয়ে বলে, ঘরটা মুছতে পারি?
তড়াক করে শিক্ষক সাহেব উঠে দাঁড়ান, নিশ্চয় নিশ্চয়।
সুদূরিকা ফিরতে উদ্যত হয়, না, থাক। বেবির পড়ায় ডিস্টার্ব হবে।
শিক্ষক ফের বসে পড়েন। ঘর ছেড়ে বেরুতে বেরুতে সুদূরিকা যেন আপন মনে চাপা অথচ শিক্ষক ঠিক শুনতে পায় এমন স্বরে বলে, কাপুরুষ!
শব্দটা শিক্ষক মাত্র কয়েকদিন আগে এক প্লে পড়ুয়া ছাত্রের মায়ের মুখ থেকে উপহার পেয়েছেন। এখানে কাজের মেয়ের মুখে। লজ্জা-অপমানে কান ঝাঁ ঝাঁ করতে করতেও তার হঠাৎ বেশ মজা লাগতে থাকে। এই মেয়ে এমন ওজনদার শব্দ পেলো কোথায়! জিজ্ঞেস করার দরকার পড়ে না। বুদ্ধিমান শিক্ষক ঠিক বুঝে নেন যে, সারাদিন হা করে গেলা বাংলা ছবিতে এ জাতীয় ডায়লগ থাকে প্রচুর। তবে এ মেয়েটার প্রশংসা করার মত যোগ্যতা এর বাচনভঙ্গি। এ যে রকম বাংলায় কথা বলে, তা আয়ত্ত করা এ শ্রেণীর মেয়েদের কম্ম তো নয়ই, অনেক উচ্চশিক্ষিত ছেলেমেয়েদের জিভের দখলেও তা থাকে না। তাছাড়া এই মেয়ের আরেকটা বড় গুণ—গানের গলা ও গায়কি। অধিকাংশ সময়ই সে গুনগুনিয়ে যে গান করে, তাতে কান পাতলে যে সুস্বর শোনা যায়, তা যেমন সুরেলা, তেমনি মিষ্টি। কখনো কখনো পাশের ঘর কী ব্যালকোনি থেকে মৃদু চাপা খোলা গলার দুয়েকটা কলিও শোনা যায়। প্রকৃতিপ্রদত্ত অমৃত কণ্ঠে মাখা না থাকলে অমন সুর কখনো বেরুতে পারে না। এর মধ্যে একদিন তাকে একটা সাম্প্রতিক জনপ্রিয় গান গাইতে শোনা গিয়েছিল। একটা শিশুতোষ ছড়াকে রক নাকি জ্যাজের আদলে গান করে গাওয়া হয়েছে। অতিপরিচিত ছড়ার অংশ সুর করে গাওয়া হলেও এরই সঙ্গে আছে র্যাপ না কি কী। এত দ্রুত একগাদা কথা নিচুস্বরে বলে যাওয়া হয় যার অর্থ উদ্ধার করতে হলে গায়িকার মুখ থেকে প্রতিটি শব্দ আলাদা আলাদা করে শুনে খাতায় লিখে নিয়ে পড়তে হবে। কী থেকে কী হয়—এত দিনে শিক্ষক মেয়েটার প্রতি মনোযোগী হন। আর মনোযোগী হয়েই বুঝতে পারেন যে, এ ঘরে আসার ব্যাপারে মেয়েটার পরে বাধানিষেধ আরোপ করা হয়েছে। এবার তার অপমান বোধ হয়, আর হয় ক্ষোভ। এখন ফুলির মা নাশতা দিতে এলে পেটে খিদে থাকা সত্ত্বেও সুখাদ্যে রুচি হয় না। আগে এই নাশতার জন্য মনে একটা উদগ্রীব অপেক্ষা থাকতো। বিকেলের নাশতাটা নিখরচায় এখানে হলে তার পেটটাও ভরে আবার রাতটাও মুড়ি চিবিয়ে কাটিয়ে দেওয়া যায়। তাই কোনো চক্ষুলজ্জার ধার না ধেরে সব প্লেট খুটে পরিষ্কার করে খাওয়াটাই ছিল শিক্ষকের অভ্যাস। আর রিজিকের মালিক আল্লাহর রহমতে নাশতা যা আসতো, তাতে পেট ভরে ঢেঁকুর উঠতো। কিন্তু এখন ফুলির মা যা নাশতা আনে, তা পেটের কোন কোণায় গিয়ে পড়ে, তা মালুমও হয় না, আবার সবটা খেতেও ইচ্ছে করে না।
পেটের খিদে না কি অন্য কোনো ক্ষুধাবোধের তাড়নায় গৃহশিক্ষকের আচরণ হয়ে ওঠে ঘরবিবাগী ঘরানার। ছাত্রীর হোমওয়ার্কের খাতায় এমন কিছু আঁকিবুকি ফুটে ওঠে, যাকে শুধু বিমূর্ত চিত্রকলা বলে চালিয়ে দেওয়া যায় না। তাছাড়া টুকটাক আঁকাজোকার অভ্যেস থাকলেও তিনি তো আর পেশাদার ড্রয়িং শিক্ষক নন। আর নাতাশা বেবিকে ড্রয়িং শেখানোর দায়িত্বও তাকে দেওয়া হয়নি। কাজেই নাতাশার মা একদিন মাসের মাঝখানে শিক্ষকের হাতে পুরো মাসের বেতন তুলে দিয়ে সোজাসাপ্টা খোদাহাফেজ বলে দেয়। সুদূরিকাও সসম্মানে নিজ দায়িত্বে বাড়ি ফিরে আসে।
চার.
এবার সুদূরিকার বিয়ে।
আপনারা বলতেই পারেন যে, এ নেহাত বাল্যবিবাহ, কাজেই দণ্ডনীয় অপরাধ। সুদূরিকার বাপের জেল হওয়া উচিত। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন কথা বলে। নিষ্কর্মা সুদূরিকার মাথায় কোনো আইন নয়, কোন দণ্ড নয়, কোন অপরাধবোধও নয়, নিতান্তই দুটো খিদে কাজ করে। পেটের খিদেয় মাথা ঘুরলে মাথা বলে চেয়ে খা, নয় কেড়ে খা, নয় করে খা। আর বিশেষ ক্ষুধায় কাতর হলে বেকুব মাথা ঝিম মেরে সেই ক্ষুধাকে উপভোগ করতে করতে আরও যেন উসকে দিতে থাকে। মেয়ের শরীরের দিকে চেয়ে আর তার ছটফটানি বুঝে গহর পাগলা সোজা পথটাই ধরে। সুদূরিকার বিয়ে হয়।
কিন্তু খিদে ঘোচে না। এখানেও সেই হাভাত দশা।
নিষ্কর্মা এক কুঁড়ের বাদশা সুদূরিকার বর। গুণের মধ্যে তিনি প্রচুর গাঁজা টানতে পারেন আর গান গাইতে পারেন। তা গান তো সুদূরিকার বাপেও ভালো গায়। গহরের জারি শুনে তারিফ করেনি এমন মানুষ এ তল্লাটে আছে নাকি? গ্রামের কাঠমোল্লা পর্যন্ত গহরের জারিগানের তারিফ করে জারিকে হালাল বলে ফতোয়া দিয়েছে। যুক্তি হিসেবে অবশ্য এটাও বলেছে যে জারিতে বাদ্যিবাজনার ব্যবহার হয় না, অন্তত গহর তার আসরে বাদ্য বাজায় না। তবে সুদূরিকার স্বামীর একটা ঢোল আর সারিন্দা আছে। আছে একজোড়া করতালও। সুদূরিকার ধারণা, বাপ তার চালচুলো নয়, ওই ঢোল-সারিন্দা দেখেই তারে দলে টানতে মেয়ে বলি দেছে। বাপের এই অন্যায়ের প্রতিবাদ হিসেবেই কিনা সুদূরিকা একদিন স্বামীর ঘর ছেড়ে পালায়।
কিন্তু পালিয়ে কোন সুদূরে আর যেতে পারে সুদূরিকা?
গল্পটা এ পর্যন্তই। এক অখ্যাত লেখকের লেখা এ গল্পের পরের অংশটা কোথায় আছে বা এর পর আদৌ কিছু আছে কি না, তা আমার আর জানা হয় না। কারণ পুরনো ছেঁড়া সাময়িকীর পাতা ঠিক এরপর থেকেই আর নেই। কিন্তু গল্পটাকে আমার টানতে ইচ্ছে করে বড়। সুদূরিকার জীবনকাহিনী কি এক স্বামীর ঘর ছেড়ে গিয়ে শেষ হয় কোনোদিন! এর পর কী হতে পারে তার? আবার বিয়ে? এবার নিজের পছন্দে? তারপর দুটি সন্তান—একটি ছেলে একটি মেয়ের সুখী সংসার? না কি আবার হাতবদল? বদলাতে বদলাতে অবশেষে কোথায় ঠাঁই? ঠাঁই কি আসলে মেলে? দেহজ কামনা ও আর্থসামাজিক নিরাপত্তার নির্ভরতা খুঁজে ফেরা সমাজমানস যে ঠাঁই খুঁজে ফেরে তার সন্ধান কি পায় এই সুদূরিকা? মাথায় আমার ঘুরতে থাকে রহস্যঘেরা এক নারী—কোন অদেখা রহস্যময়ী সুদূরিকা।
পাঁচ.
নামাপাড়া বস্তির কাছাকাছি উঠতি অভিজাত এলাকা মালতিনগরে আমার বাস। মধ্যপ্রাচ্য থেকে টাকাকড়ি করে ফিরে বছর দশেক হলো এ শহরে ঠাঁই পেতেছি। শহরটা সুন্দর। বড় শহরের নাগরিক সুবিধার পাশাপাশি ছোট শহরের মাধুর্য ও গ্রামীণ সারল্যমাখা বড় অদ্ভূত এ শহর। সেদিন শুক্রবার। সাপ্তাহিক ছুটির এ দিনটাতেও সকালবেলা একটু আয়েস করে গড়াগড়ি দেওয়ার জো নেই। আটটা না বাজতেই গিন্নি ঠেলে তুলে হাতে ধরিয়ে দিলো ইয়াবড় এক লিস্টি—বাজারের। সকালবেলার বাসী মুখের মতো মনটাও হয়ে গেলো তেতো। সেই বিস্বাদ মুখ ও তিক্ত মন নিয়েই পথ চলছিলাম। আমার বাসা থেকে বাজার দূরে নয়। নামাপাড়ার পাশ দিয়ে একটু হেঁটে এসপি ব্রিজ পার হলেই বউবাজার। এখানে বউ বিক্রি হয় না বটে, তবে বউয়েরাই বাজার বসান, আর বর-বউ নির্বিশেষে ক্রয় করে ফেরেন। খুব ভোরে বসা এ বাজারে মাছ-সব্জি পাওয়া যায় খুব টাটকা। সকাল আটটা মানে বাজার প্রায় সাঙ্গ। সেই অবেলায় আমি এলাম ইয়া বড় লিস্টি নিয়ে বাজার করতে!
ক্রেতাশূন্য বাজার প্রায় খাঁখাঁ। অস্থায়ী দোকানগুলো গুটিয়ে ফেলা হয়েছে। বাজারের মাঝখানের সড়কটাতে রিকশা-সিএনজি চলছে বেশ। তাদের ক্রিংক্রিং আর ভোঁভোঁ না থাকলে এলাকাটা এতক্ষণে নির্জন-নিঃশব্দ হয়ে পড়তে পারতো। এমন সময় তুমুল হট্টগোল। কয়েকজন নারী-পুরুষকে জাপ্টাজাপ্টি করতে দেখে এগিয়ে যাই। অতপর তাদের কাণ্ড দেখে থমকে যাই। আমার মুখে ভাষা সরে না।
একজন নারী একজন পুরুষের বুকের পড়ে চড়ে বসে তার গলা টিপে ধরেছে, পুরুষটির জিভ বেরিয়ে এসেছে, চোখ ঠিকরে বেরুচ্ছে। আরও দুজন নারী অসহায় লোকটার হাত ও পা চেপে ধরে রেখেছে। দৃশ্যটা নারকীয়। অথচ অনেক নারী-পুরুষ দাঁড়িয়ে তা দেখছে এবং ভাব-ভাষায় মনে হলো, তারা আক্রান্তের পক্ষ না নিয়ে বরং আক্রমণকারীদেরই উৎসাহ দিচ্ছে। আমি কী করব, কী বলব, তা বুঝে ওঠার আগেই শুনতে পেলাম মারমুখী নারী বলছে, মাংগির পুত, হামার সাথ বিটলামি! বসায়া বসায়া তিন বচ্ছর খাওয়ানু, বিদ্যাশ করা টিহা দিয়া দোকান কর্যা দিনু, এক্কন পাংখা গজাতে না গজাতেই সব বেচাবুচ্যা উড়াল দেওয়ার তাল! খাড়া, তোর পাংখা আগে কাটে লই—বলেই সে লোকটার হাতে দিল এক জোর মোচড়। লোকটা তীব্র গগনবিদারী স্বরে আর্ত চিৎকার করে উঠলো। রণচণ্ডী মূর্তিধারিণী মহিষাসুর মর্দনের ভয়াবহতায় পুরুষটির একহাত পা দিয়ে চেপে ধরে আরেক হাত ঘানিগাছের মতো ঘুরিয়ে চললো। তার তীব্র আর্তনাদ আমার কানে ইস্রাফিলের সিঙ্গা বাজিয়ে চললো। এই বুঝি দিবালোকে অদৃশ্য গ্রহ-নক্ষত্রেরা আমার মাথার পরেই খসে খসে পড়ে!
হঠাৎই আমি আমার নিজেকে আবিষ্কার করলাম এক অনন্য বীভৎস্যতার শিকার রূপে। আমি পড়ে আছি রাজপথে কুকুরের বিষ্ঠার পাশে। আমার সারাগায়ে ধুলো-বালি, মুখ ভরা মাটি। আমি প্রাণপণে চিৎকার করতে চাচ্ছি; পারছি না। আমার বুকের পরে পা রেখে দাঁড়িয়ে যেন ডজন ডজন অসুরদলিনী, দুগর্তিনাশিনীর রুদ্রমূর্তি। তাদের করাল চোখের অগ্নিদৃষ্টি আমাকে পুড়িয়ে ছাই করে দিতে দিতে বলে চলছে,কষ্টের টেকা, বড় কষ্টের টেকা। বিদ্যাশে খায়া, না খায়া, গতরের রক্ত পানি করা টেকা। তুই তা জুয়া খেল্যা ফুঁকে দিলি?
ছয়.
মুই কেলাশ থিরি তামাইৎ পড়ছিলাম। মোর নাম, মোর বাপের নাম, দাদার নাম সবই মুই বাংলায় লেখতে পারি। হ্যারা বাংলা বোজে না। হ্যারা সব কতাই কয় আরবি-উর্বিতে, খালি আজানডা দেয় বাংলায়। হেই দ্যাশে খাওন-পিন্দনের কুনো অভাব নাইক্যা। তাগো খাওন, ও মোর সুবানাল্লাহ! হেইডা যদি দেইখতা! আস্তা দুম্বা রোস্ট না কি জানি কইরা চাক্কু দিয়া কাইটা কাইটা খায়। মাইয়া লোকেরেও তারা অমনে কাইটা-কাইটা লবণ-মরিচ দিয়া বড় সোয়াদ কইরা খায়। মোরেও তারা…। আমার সেই টেহা, আমার গতর বেচ্যা পাওয়া ডলার ভাঙানো টেহা দিয়া তুই নয়া হৌরবারি হদাই অরস?
নামবিলাসী বাপ ভালোবেসে নাম দিয়েছিল সুদূরিকা। সুদূরে নয়, আমি চিরদিন সবার হাতের নাগালে পায়ের তলায় চড়-চাপড় আর লাথি-গুঁতা খেয়ে বেড়ে উঠেছি। বেড়েছি, কিন্তু বড় হতে পারিনি। কোনো রকম জীবনধারণই যাদের নিয়তি তারা কি আর শেষপর্যন্ত বড় হয়? কেউ কেউ হয়তো হয়—অর্থে, কর্মে অথবা মনে। তবে সবার স্বপ্নটা কি বড় হতে পারে না? স্বপ্ন দেখতে তো আর রাজপ্রাসাদে ঘুমানোর দরকার পড়ে না। ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে লাখ টাকার স্বপ্ন দেখতে না জানলে কী করে সফল হয় শ্রেণীদ্বন্দ্বের বিপ্লব আর কী করেই বা বদল হয় সভ্যতার, পৃথিবীর? মানুষের যেকোনো বিজয়ের, যেকোনো অর্জনের স্বপ্নটাই তো ভিত্তি। এই স্বপ্নবাজ মানুষেরাই তো একদিন ছড়িয়ে পড়বে এ পৃথিবী ছাড়িয়ে বহুদূরে—গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে, অন্য কোনো নক্ষত্রলোকে। আমিও কিন্তু জীবন পার করেছি স্বপন ঘোরে। কী দিবা আর কী নিশা—সবেতেই আমার স্বপ্ন ছিল বড় লোক হওয়ার। ছোট্ট থেকে আমি স্বপ্ন দেখতাম যে, আমি শহরের কোনো ধনীলোকের বা অফিসারের বউ হবো। তোমরা হেসে ফেললে? হাসো, এ তো তোমাদের কাছে হাসিরই কথা। গহর পাগলার পাঁচ নম্বর মেয়ে, খাল পাড়ের কুঁড়ে ঘরে যার জন্ম, সে স্বপ্ন দেখতো অফিসারের বউ হবে—এ তো তামাশারই কথা। কিন্তু হাসি-তামাশার পর একটু মন দিয়ে ভেবে দেখো তো, এর মধ্যে আসল তামাশা কোনটা—আমার স্বপ্ন, না কি আমার এই বাস্তবতা?
মানুষ বদলায়। তারও আগে বদলায় তার স্বপ্ন। বড়মানুষদের বাসায় বাসায় বুয়াগিরি করে করে বড়মানুষের বউ হওয়ার বয়স বয়ে গেলো, কখন জানি আমার স্বপ্নও বদলে গেলো। কারও বউ নয়, বরং নিজে বড়মানুষ হওয়ার স্বপ্নটা মনের গভীরে চাড় দিতে থাকলো।
কিন্তু জগতে বড় হওয়ার খোয়াব দেখা যত সহজ, বড় হয়ে ওঠার পথ খুঁজে পাওয়া তো আর তত সহজ না। উপায় ভাবতে ভাবতে আমার কত রাত কত দিন খোয়াবঘোরে কেটে গেলো! টাকা বানিয়ে বড়লোক হওয়া যায়। মহৎকর্ম করেও নাকি মানুষ বড়মানুষ হয় আর সেটাই নাকি সত্যিকারের বড়মানুষ। আমার বাপ বলতো, মন যার যত বড়, এ দুনিয়ায় সে তত বড়লোক। আপন অন্তর মাঝে ফকিরও বাদশা হতে পারে, বাদশাও ফকির। আমি অতসব মারেফতি কথা বুঝি না। আর আমার বাপের মতো অন্তরে বাদশা হয়ে রাজা-উজির মেরে বেড়ানো কি দস্যুবনহুর হয়ে গরিবের হিত করার বাসনাও আমার নেই। আমি আমার হিত করতে চাই সোজাসুজি উপায়ে, টাকা কামিয়ে। কিন্তু গরিব-মূর্খ মেয়েমানুষের পক্ষে টাকা কামানোর পথটা কি আর কোনোদিন সোজা হয়?
এমন সময় দেশে কাড়া পড়লো—সরকার নাকি গরিব-দুঃস্থ সব মেয়েমানুষেরে তরল সোনার দেশ সৌদি পাঠাচ্ছে নামমাত্র খরচে। লাখ লাখ টাকা খরচ করে পুরুষেরা বিদেশ যায়। কত জনের আবার ভিটে-বাড়ি বেচা টাকাও যায়, বিদেশভাগ্যও না হয়। কত জনে ভুয়া কোম্পানির হাত ধরে বিদেশ পৌঁছালেও শেষে জেলে পচে মরে। আবার কত জনের চাকরি হয়, টাকাও হয়। এ জগতের নিয়মই তাই—কারও ভাগ্যে সবই হয়, কারও শুধুই হায় হায়। শুনলাম মেয়েমানুষের বেলায় এসব ঝামেলা নেই। বন্দোবস্ত খুব পাকা। গৃহকর্মী মানে এখানকার কাজের বুয়াদের যে কাজ, সেখানেও তাই। তবে তারা খুব বড়লোক বলে কাজের পরিবেশ ভিন্ন, উন্নত। হাতের বদলে বেশিরভাগ কাজই হয় মেশিনে। খাটা-খাটনিও তাই কম।
আমি বিদেশ গেলাম।
কিভাবে গেলাম— কে আমার হয়ে অত সব জোগাড়যন্তর করে দিলো, সে আলোচনায় নাই গেলাম। বয়স আমার কিছু হয়েছে ঠিকই কিন্তু এখনো তো আর বুড়ি হয়ে যাইনি যে কেউ আমার একটা উপরোধও শুনবে না। চুপিচুপি বলে রাখি, আমি কিন্তু এখনো আগের মতোই সাহেবদের গোপন আদরের আর কাজে-কর্মে খুব চালু হওয়ায় ইদানীংকার গিন্নিদের পছন্দের।
সৌদি গিয়ে আমার মাথা কদিনেই নষ্ট হওয়ার জোগাড়। হায় আল্লাহ্! এরা বালির বুকে এ কি বেহেস্ত বানাইছে! দেশে থাকতেই শুনছিলাম যে এ দেশের বালির তলায় শুধু তেল আর তেল। সেই তেলে সারা দুনিয়ার গাড়ি চলে, কল-কারখানা চলে। আমেরিকার মত দেশ এ দেশের সাথে ‘দোস্তি’ করে নাকি ওই তেলের টানে। তেলে জগৎ চলে আর তেলে ‘মহব্বত’ টানবে না!
সৌদিতে কেমন ছিলাম, কী করতাম, কী খেতাম—সেসব আলোচনায় যাব না। দুনিয়া এখন আর একটা গ্রাম নয়, ছোট্ট এক পাড়া। এখন একদেশের খবর আরেক দেশে পৌঁছানো চোখের পলক ফেলার চেয়েও সহজ। নিজ জেলার বাইরে যে কোনদিন পাও রাখেনি সেও ‘রসুলের পুণ্যভূমি’র হালফিল খবর রাখে। শুধু আল্লাহর ঘরই নয়, সুলতান থেকে শুরু করে সাধারণ কোনো শেখের হেরেমে উঁকি দিয়ে বিবির সংখ্যা গুনতে চাইলে তাও তারা অনায়াসে পারে। আর বিদেশে গৃহকর্মীর চাকরির হাল নিয়ে বলারই বা কী আছে? কী স্বদেশ, কী বিদেশ- আমাদের হাল সবখানেতেই এক। সব জায়গার কর্তারাই আমাদের কাজের সাথে ‘কাম’টা ‘ওভারটাইম সার্ভিস’ হিসাবেই চায়। আর জগতের সব গিন্নিই আমাদের সম্পর্কে মনে করেন যে, যতক্ষণ এই বদগুলানের দেহে আছে জান, ততক্ষণই হাড়ে হাড়ে ইবলিশ শয়তান। কাজেই আমাদের দিয়ে হাড়ভাঙা পরিশ্রম না করালে আমাদের শয়তানিগুলো সব হাড় ফুঁড়ে বেরুতে শুরু করবে। গিন্নিরা তাই ওভারটাইম না, ফুলটাইম নীতিতে বিশ্বাসী। অবশ্য আমাদের ওভারটাইম বিষয়ে কোনো কথা এদেশের মানবাধিকার বা নারী উন্নয়নের কোনো কাগুজে নীতি-ধারাতেও ওঠেনি। এই ইংরেজি শব্দটা আমাদের বেলায় ঠিক খাটে না, কী বলেন? আসলে সাহেবলোকদের যেমন খুশি দরকারে দিন-রাতের যেকোনো সময়ই আমাদের ‘পিক আওয়ার’। কাজেই সৌদিবিত্তান্ত বাদ দিয়ে আমি বরং সরাসরি দেশে ফেরার পরের অবস্থায় চলে যাই।
এক দুপুরে বাংলাদেশ বিমানের এক ফ্লাইটে করে দেশে ফিরে আসলাম—অনিচ্ছায় নয়, স্বেচ্ছায়। এমন না যে আমার কাজ বা ‘কাম’ করার সামর্থ্য কমে গিয়েছিল, এমন নয় যে আমি মেয়াদের আগেই অনেক টাকার মালিক বনে গেছিলাম। আবার এমনও নয় যে আমার ‘বড়লোক’ হওয়ার সাধ মিটে গেছিল। আমি দেশে ফিরে আসলাম, কারণ ওখানে থেকেই আমি আমার রক্ত জল করা টাকার পরিণতি জানতে পারলাম।
হায়! প্রবাসীর টাকা! তাতে মেয়েমানুষ!
দ্যাশের ভাইয়েরা ভাবেন, ভাই বড়লোকগো দ্যাশে গিয়া অঢেল কামায়া বড়লোক হয়া গ্যাছে। তাই তার টাকায় আমগো হক্ক আছে। আর বোন বিদ্যাশ গেলে ভায়েরা কত কী ভাবে। কী ভাবে, শোনেন আমার ওই ভাইয়ের মুখে।
সাত.
কোনোমতে দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেখি–এক বিধ্বস্ত চেহারার যুবক মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে। উপস্থিত জনতা আমারই মতো ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালে কয়েক ডজন চোখের সামনে সে যেন আরও সংকুচিত হয়ে গেলো। কিন্তু সে মাত্র কয়েক মুহূর্ত। হঠাৎই সে মাথাটা খাড়া করে ঘাড় তেরছা করে বাঁকিয়ে কুটিল চোখে বোনের দিকে তাকিয়ে জনতার উদ্দেশে বললো, দ্যাশ ছাইড়ে যারা টাহার নিশায় বিদ্যাশ যায়, তারা জাত খানকি। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই সুদূরিকা তার ভাইয়ের মুখে কিছু একটা চালিয়ে দিলো। তার মুখের বাক্য অসমাপ্ত থাকলো, উপড়ে গেলো দুটো দাঁত, বাকিগুলোর অবস্থাও বোধহয় হয়ে গেলো চিরকালের তরে নড়বড়ে। রক্তমাখা মুখে হাত দিয়ে যুবক মাটিতে উবু হয়ে পড়ে থাকলো। বিহ্বল জনতার কিছু অংশ জয়োধ্বনি দিলো।
সুদূরিকা, সুদূরিকা—আমি বিড়বিড় করে বলতে থাকলাম। আশ্চর্য! যেন কত দিনের চেনা এমন ভঙ্গিতে সুদূরিকা আমার দিকে চেয়ে হাসলো। তারপর অপার কৌতুকে বড় বড় দুচোখ নাচিয়ে ভ্রূভঙ্গি করে গাইতে শুরু করলো,
বাবুরাম সাপুড়ে
কোথা যাস বাপুরে
আয় বাবা দেখে যা
একটুখানি খে এ এ লে যা…
সেই লাস্যময় মধুর কণ্ঠ যা শুনে নাতাশা বেবির শিক্ষক আনমনা হয়ে যেতেন। না জানি আরও কত যুবক। একদিন কি আমিও? চলচ্চিত্রে ‘খেয়াল’ দেখার মতো করে হঠাৎ আমি দেখতে থাকলাম যেন আমার আর সুদূরিকার প্রেমের পুরা অধ্যায়। আহা! কী প্রগাঢ় ‘প্রেমে’ আমি তার চরণ ধরে তার মদ্যপ, গেঁজেল, জুয়াড়ি তৃতীয় স্বামীকে তালাক দিতে উসকানি দিচ্ছি! একদিন সুদূরিকা আমাতে মজলো। সরল বিশ্বাসে আমার হাত ধরে পালালো। আমি তাকে নিয়ে বিশেষ পল্লীর মাসীর জিম্মায় হাওলা করে দিলাম। তারপর কবে সুদূরিকা সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছিল? না কি পারেনি কোনোদিন? ওখানে একবার যে যায়, সে কি আর বেরিয়ে আসতে পারে? আর সুদূরিকাদের জন্য গোটা পৃথিবীই কি ওই ‘বিশেষ পল্লী’ নয়?
দূর হোক গে! কে আমি আর কে সুদূরিকা, তা কে জানে! আপাতত সকল কষ্ট ভুলে মন্ত্রমুগ্ধের মতো সুদূরিকার গান শুনতে থাকি।