এমন কোনো নাম কখনো শুনেছেন,বাতাস? আমিও শুনিনি আগে।চড়িশ্বরের বনবিবির মেলায় আলাপ।
মাঠের মধ্যে মেলা,ধানকাটা মাঠে।তিনদিনের না কাটা দাড়ির মতো খোঁচা খোঁচা এবড়োখেবড়ো জমি। খিচুড়ি খাচ্ছিল সবাই সেই মাঠে,শালপাতায়।কি আশ্চর্য খাওয়া! আমি বিশাল বটদেবতার নিচে সাইকেলে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম গেঁয়ো মেলার জমক।
আমি আগন্তুক। তাই প্রসাদ নিতে বসে যেতে পারিনি। সে-ই ডাকল, বলল, বাবু দাঁইড়ে কেন এসো, মায়ের পেসাদ লজ্জা কী? তার সঙ্গে আলাপ জমে উঠল। একসঙ্গে খিচুড়ি খেলাম নাড়ার ওপরে বসে। জলখিচুড়ি, চালের দানা গোনা যায়,তবু অমৃত যেন।
আমার নাম বাবু বাতাস শেখ। চমকে উঠলাম মুসলমান!মুসলমান ভেবে চমকে ওঠা এ কারণেই, পরনে তার সাদা কাছামেরে পরা ধুতি, সাদা গেঞ্জি, গলায় তুলসির মালা, গালে শ্বেতশুভ্র দাড়ি-গোঁফ। মুসলমান ভাবা যায় না!
বাতাস নামের সঙ্গে তার সাযুজ্য আছে, ফুঁ দিলে সে হাওয়ায় উড়ে যাবে। কিন্তু তার হাসি, সে যেন বসন্তের দখিনা হাওয়া। সে নিজেকে বাতাস ফকির বলে। কিন্তু ফকিরি দীক্ষা তার নেই।
সে আমাকে তার বাড়ি যেতে বলেছিল, গিয়েছিলাম। এক তাজ্জব মানুষ তাজ্জব তার ধর্মমত। বিদ্যাধরী নদীর মজা কিনারায় তার পলাশ ছাওয়া কুটির। তার ছোট ডেরা ঘিরে রেখেছে শিরিষ, কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া। বসন্ত তখন। পল্লবিত গাছের নিচে বাতাসের দীনগৃহ স্বর্গোদ্যানের মতো লাগছিল। নিকোনো উঠোনের কোণে সন্ধ্যামণি, টগর, জুঁই অলঙ্কৃত করে রেখেছিল যেন তার ঘর।
অনেক আগে থেকেই বাতাস গান বাঁধত, মুখেমুখে রচনা করত গান। বিবির, গাজির,শেতলার পূজায় হাজতে তার ডাক পড়ত। মাঝে মাঝে সে এদেশ-ওদেশ বেরিয়ে পড়ত, ঠিকানা হদিস মিলত না। এই অবধি ঠিক ছিল। কিন্তু সে একবার নদীয়ায় গিয়ে হরিদাসের আশ্রমে ছিল একমাস। তারপর সেখান থেকে কাঠের গৌরাঙ্গ নিয়ে ফিরেছিল দেশে। বাড়িতে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়েই বাধল গোল। গাঁয়ের মুরুব্বি মাতব্বররা ওর বাবা রহমান আলির ওপর চাপ আনল। মসজিদে বিচার হলো তার। মারধোর, অত্যাচার হলো খুব,চুলদাড়ি কেটে দিল ওরা,কাঠের গৌর আছড়ে দিল ভেঙে। ঘর ছাড়ল বাতাস ফকির। সেই থেকেই তার আস্তানা এই মজা বিদ্যার কিনারে।
সে ভাঙা কাপে গুড়ের চা বানিয়ে আনল। বলল দাঁড়াও সন্ধ্যা ধরিয়ে আসি। কখন সূর্য পাটে গেছে বুঝতে পারিনি। এর মধ্যে বাতাস বেশ কয়েকটা গান শুনিয়েছে। দখিনা বাতাস আর বাতাসের গানে তন্ময় হয়ে আমি দেখছিলাম টুপটাপ খসে পড়া পলাশের ফুলে লাল হয়ে ওঠা উঠোনে ছড়িয়েছে আশ্চর্য বিভা। ময়ূর পালকের মতো দোদুল শিরিষের ফুল যেন হাজার রামধনুর চন্দ্রাতপ।
বাতাস শাঁখ বাজাল, শাঁখের শব্দ মজা নদীর প্রান্তরে যেন তরঙ্গ হয়ে ছড়িয়ে পড়ল। মাথার উপর তাকিয়ে দেখলাম কি অদ্ভুত সুন্দর রাত্রির আকাশ তার সহস্র নক্ষত্রপুঞ্জ নিয়ে কুটিরের কাছাকাছি নেমে এসেছে। বাতাস প্রদীপ ধরালো,দিল ধূপ। পলাশ গাছটির তলায় তার প্রিয় দেবতার থান। তুলসী মঞ্চে রাখা প্রদীপের আলোয় দেখলাম কাঠের গৌর আর তার পাশে কাবার অলঙ্কৃত ছবি,কোনো ক্যালেন্ডার থেকে কেটে নেওয়া, আরবি হরফে কি সব লেখা। আমি মুগ্ধ হলাম।
বাতাস ফিরে এসে শোনালো লালনের একখানি পদ। শুনতে শুনতে দেখলাম মানুষের ঈশ্বর তার উঠোনে টগর ফুলের মতো হাসছেন।
বাতাস গান থামিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিল, বাবু মানুষি মানুষি এত ভেদ কেন বলতি পারো? আমি বলতে পারিনি। সে অনেকক্ষণ থেমে বলেছিল, একজন্মে এর উত্তর খোঁজা যায় না তাই না বাবু?
অনেকদিন তার আখড়ায় যাইনি। বাতাসকে ভুলেই ছিলাম প্রায়। কাল হঠাৎ ইচ্ছে হতেই বেরিয়ে পড়েছিলাম। চড়িশ্বর বাজারে এসে তাকে পেলাম। কেউ তার খোঁজ দিতে পারল না। মনটা খারাপ হয়ে গেল। এতদূর এলাম, অথচ তার সঙ্গে দেখা না করেই চলে যাব? তার কথা ভাবছি, আপন মনে। কে যেন কানের কাছে এসে বলল, বাবু মানুষে মানুষে এত ভেদ কেন বলতি পারো? চমকে উঠলাম। চারিদিকে তাকিয়ে দেখি পরিচিত তেমন কেউ নেই। হঠাৎ দেখলাম, কেউ একজন এগিয়ে আসছেন হন্তদন্ত হয়ে। কাছে আসতেই জানতে চাইলাম, ভাই কী হয়েছে? এভাবে ছুটছেন কেন? লোকটির মুখ থেকে কোনো কথা বের হলো না, কেবল অস্ফুট স্বরে একবার বলল, বাতাস ফকির নেই, কারা যেন খুন করেছে তাকে। আর তখনই আমার দুকানের কাছে কারা যেন শত-সহস্র কণ্ঠে চিৎকার করে উঠলো,বাবু মানুষে মানুষে এত ভেদ কেন বলতি পারো?