আজকেও বেতন হয়নি মাহমুদের। চারদিন পর ঈদ। এই সময়টায় বেতন না পাওয়ার চেয়ে ভয়ঙ্কর কোনও খবর তার কাছে নেই। হয়তো বাবা মারা যাওয়ার খবরটা এতটা ভাবিয়ে তুলতে পারেনি তাকে। বাবা অবশ্য মরেই বেঁচেছেন। বাড়িতে একমাত্র মেয়ে তৃষা আর স্ত্রী মনি অপেক্ষা করছে। আজ বেতন পাওয়ার পর শপিং সেরে সোজা গ্রামের বাড়ির উদ্দেশ্যে ওদের পাঠিয়ে দেওয়া। কালকের বাসের টিকেটও আগাম বুকিং দেওয়া আছে।
শালার পত্রিকা অফিসের ওপর কোনও ভরসা নেই। অ্যাকাউন্টেন্ট সুব্রত ‘বেতন কবে হবে’—এই প্রশ্ন শুনতে-শুনতে কানে তালা দিয়েছে। বেচারারও কিছুই করার নেই। মালিকপক্ষ নাকি এখনও চেক পাঠাননি। সেটা আসবে। তারপর ক্যাশ হবে। এরপর সবার অ্যাকাউন্টে টাকা ঢুকবে। ঈদের আর চারদিন থাকলেও ছুটির আর মাত্র তিনদিন বাঁকি আছে। এরমধ্যে এই কাজ শেষ করে বেতন পাওয়া সম্ভব কি না বোঝা যাচ্ছে না। আদৌ যদি চেক ক্যাশ না হয়, তাহলে ঈদের আগে বেতনের আশা একেবারে ছেড়ে দিতে হবে।
হাতে একদম টাকা নেই। বাড়ি যাওয়ার আগে বাসা ভাড়া, পেপার বিল, ফ্রিজের কিস্তি, বুয়ার বেতন, লন্ড্রির বিল সব দিয়ে হাঁটতে হবে। সকালে মনি বলছিল বুয়া এই মাসে বকশিস চেয়েছে। ঢাকার বুয়াদের বকশিস মানে শ’ পাঁচেক টাকা। বিরক্তিকর। নিজের পকেটে ২০০ টাকা নেই আর হাজার টাকার হিসাব করতে করতে ঘাম নেমে এলো কপাল বেয়ে।
নিউজ এডিটরের তাড়ায় সংবিত ফিরল।
বললেন, আমি আনছি আমার গাবলুকে। গাবলু নাম শুনেই আমি একটু নিশ্চিত হলাম এটা কুকুর বা বেড়াল টাইপ কিছু হবে। আমি মনে মনে জানাশোনা সব প্রাণীর নাম আউড়ে চলেছি। আমাকে এই চারলাখ টাকা জিততেই হবে।
মাহমুদ যাওয়ার আগে স্পেশাল রিপোর্ট দিয়ে যাবেন কিন্তু। আর ছুটি নিতে চাইলেন যে, অ্যাপ্লিকেশন তো দিলেন না! বেতন না হলে ছুটি নিয়ে কী হবে— বলতে চেয়েও বলা হলো না। বেতন তো তিনিও পাবেন না। সংকট তারও রয়েছে। সবারই কপাল এখানে একসূত্রে বাঁধা।
মনি বারবার মোবাইলে তাগাদা দিচ্ছে কখন আসবে। বেতন না হওয়ার কথাটা তাকে বোঝানো এখন খুব কঠিন। গত এক সপ্তাহ ধরে এই দিনটার কথা বুঝিয়ে আসছে। রোজার ঈদ শ্বশুর বাড়িতে করেছে মেয়েটা। এই প্রথমবার বলেছে ভাইদের সঙ্গে ঈদ করতে চায়। একেবারে খালি হাতে বাপের বাড়ি পাঠানোটা রীতিমতো অন্যায়ের পর্যায়ে পড়বে। ভাইয়ের বাচ্চাদের জন্য সামান্য কিছু উপহারের লিস্টিও করে রেখেছে মনি।
একমাত্র মেয়েটা তেমন কিছু চায় না। শুধু এই ঈদে মামাতো দুবোনের সঙ্গে একইরকম জামার বায়না ধরেছে। অর্থাৎ তিনটা বাচ্চার ঈদের জামার কাপড় কিনতে হবে। মায়ের জন্য কুরবানির টাকা পাঠাতে হবে। সব মিলিয়ে প্রায় ৩০ হাজার টাকার ধাক্কা। বেতন না হয়ে বোনাসটা হলেও ঈদটা চালিয়ে নেওয়া যায়।
কিন্তু সেটা হবে কি না বোঝা যাচ্ছে না।
অ্যাকাউন্টসের চিফ আশিক ভাই অনেকক্ষণ যাবত এডিটরের রুমে। আশা করা যাচ্ছে এবার একটা ভালো খবর নিয়ে ফিরবেন। সম্পাদক চাইলে টাকা ভাঙিয়ে ক্যাশ হওয়া আধ ঘণ্টার বিষয়। বাইরে সবাই উসখুস করছে। এই ঈদের আগে সবারই টাকা দরকার। সবাই কেনাকাটা নিয়ে চিন্তাভাবনা করছে। চিফ রিপোর্টার আরিফ ভাই সবাইকে নিউজের তাড়া দিচ্ছেন। গাবতলি থেকে ফেরার পথে একটা গরু ছিনতাই ক্রেতা খুন। এই নিউজটা নিয়ে খুব হইচই করছেন আরিফ ভাই। মোনাকে তাড়া দিলেন ঘটনাস্থল ঘুরে রিপোর্ট করার জন্য। মোনা বের হয়ে গেল। আমার ব্যাংক বিটের নিউজের তেমন কোনও তাড়া নেই। লেনদেন নিয়ে স্পেশাল নিউজ আগেই জমা দিয়ে দিয়েছি। মোনারা প্রায়ই বলে, ব্যাংক বিট আর ডেস্ক জব করা না কি সমান। কোনও কাজের চাপ নেই। ওরা জেনেও না জানার ভান করে। বড় বড় ব্যংক জালিয়াতি, মুদ্রস্ফীতি, ব্যাংক লুট, রিজার্ভ সংকটের সময় আমাকেও গোয়েন্দা হয়ে উঠতে হয়।
মনির ফোন। এই নিয়ে চারবার ফোন দিল সে। কাল সকাল ৮টার বাসে ও আর তৃষা বড় ভাইদের সঙ্গে বাড়ি রওনা হবে। আমি অফিস ছুটি হলে যাব। কাল যাওয়ার আগে আজকে যদি কেনাকাটা না সারতে পারে বিষয়টা মান-সম্মানের হয়ে উঠবে। ঈদের আগে খালি হাতে বাড়ি যেতে যাবে না মনিকে। বিয়ের পর এই প্রথম পর মনি বাপের বাড়ি যাচ্ছে ঈদ করতে। পালিয়ে বিয়ে করার পর গত সাত বছরে ভাইয়েদের বাড়িতে যাওয়া আসা থাকলেও বাপের বাড়ি যাওয়া হয়নি মনির। সাংবাদিক ছেলে বিয়ে করা নিয়েই যত ক্রোধ ছিল। ছেলে তাদের মেয়েকে খাওয়াবে কী, পরাবে কী। এইসব সাত-পাঁচ নিয়ে কম কথা শুনতে হয়নি দুজনের। আজ এতবছর পর মনিকে ছোট হতে দেওয়া যাবে না। কম কষ্ট তো করেনি মেয়েটা এই সংসারে থেকে।
আশিক ভাই বের হয়েছেন এডিটরের রুম থেকে। প্রায় সবাই তাকে ঘিরে ধরেছে। স্পোর্টসের শাকিল বের হয়ে এলো ভীড় ঠেলে। আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই মাথা নাড়ল। আগামী পরশুর আগে বেতন হবে না। সবাইকে ধৈর্য ধরার অনুরোধ করলেন আশিক ভাই। তারা তো বলেই খালাস। সংসারে আমরা কে কী সংকটের মুখোমুখি তার তারা কী জানবে। ৪ টার মতো বাজে। মনি ফোন করতে করতে বিরক্ত হয়ে ফোন করা বন্ধ করে দিয়েছে। ওকে কলব্যাক করতেও মন চাইছে না। ওর জন্য তো কোনও উত্তর নেই। কী বলব, জীবনে প্রথমবার বাপের বাড়ি যাও খালি হাতে। এটা হয় না কি।
ছোট ভাই রইসকে আসতে বললাম, হাজার দশেক টাকা নিয়ে। পরশু বেতন পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পেয়ে যাবে এই নিশ্চয়তা দেওয়ার পর ও বোধহয় একটু আশ্বস্ত হলো। বলল, ঘণ্টাখানেকের মধ্যে পাঠাচ্ছে কিংবা নিজেই নিয়ে আসছে। মনিকে জানালাম এক ঘণ্টা লাগবে আসতে। বেচারি বেশ ঝাড়ার চেষ্টা করল সেই সুযোগ দিলাম না।
একটা সিগারেট ধরিয়ে বসতেই রইস জানালো, আসতে দেরি হবে। ব্যাংকে ইনস্ট্যান্ট ক্যাশ ট্রান্সফার করে দিচ্ছে। আমি যেন বুথে চেক করি। রইসের সব প্রসেস হতে ঘণ্টা খানেক লাগবে। অফিসে অসহ্য লাগছে। সবার মধ্যে বেতন না হওয়া নিয়ে হা-হুতাশ। আমি চিফ রিপোর্টারকে বলে বের হয়ে আসলাম। আমার রিপোর্ট জমা দেওয়া শেষ, আটকে রাখারও কিছু নেই।
ব্যাংকের বুথটা অফিস থেকে প্রায় আধ মাইল দূরে। ঈদের আগে-আগে এই বুথটাতে বেশ ভিড় হয়। বুথের সামনে চায়ের দোকানে বসলাম। এই দোকানটা ৮/১০টা চায়ের দোকানের মতো না। বেশ সাজানো-গোছানো। হালকা-পাতলা নাস্তাও পাওয়া যায়। একটা চারভাগ করা কিমাপুরী আর চা নিয়ে বসলাম। আধঘণ্টা সময় কাটাতে যথেষ্ট। রাস্তার ওপারে বুথ, তার পাশে একটা ফুলের দোকান। একজোড়া কপোত-কপোতি ফুল দেখছে। কিনবে বলে মনে হচ্ছে। ওরা লাল না হলুদ গোলাপ কিনবে? পাশের লোকটার কথায় হাতের চা একটু ছলকে উঠল। আমি অবাক হলাম, লোকটা কী করে জানল, আমি ফুলের দোকানের দিকে তাকিয়ে আছি? লোকটার দিকে তাকালাম। বেশ বনেদি চেহারা, কিন্তু কোথায় যেন একটু পোড়খাওয়া। কপালের চামড়ায় নিরেট চিন্তার ছাপ সিলগালা করে দেওয়া। চোখে বেশ দামি চশমা। সাদা রঙের আস্তিন গোটানো শার্ট। চেহারায় জানাশোনা ভাব প্রবল। আমার পাশে বসতে বসতে চায়ের অর্ডার করলেন। খুব আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গিতে বললেন, ওরা হলুদ গোলাপই কিনবে। তার কথায় অবশ্য আমার কিছু যায় অ আসে না। আমার অপেক্ষা শুধুই রইসের একটা এসএমএসের। টাকা আসলেই আমি দৌড় লাগাব বুথে। এরপর শপিং ও অন্যান্য। মাকে জানিয়ে দিয়েছি, দুদিন পর কোরবানির টাকা পাঠাব। এর মধ্যে দরকার হলে ছোট কাকার কাছ থেকে যেন ম্যানেজ করে নেন।
বাজি লাগবেন? বলেই ১ হাজার টাকার নোট বের করে টেবিলে রাখল। আমার দৃষ্টি বিস্ফারিত হওয়ার কথা কিন্তু কেন জানি এই অলস বিকেলে তার সঙ্গে বাজি লাগতে ইচ্ছা করছে। মন চাইছে লোকটাকে হারিয়ে দেই। মেয়েটা দুবার লাল ডায়ান্থাসে হাত দিয়েছে। তার হলুদ গোলাপ কেনার প্রশ্নই আসে না। আর এই অপরিচিত লোকটার ঠ্যাটামি আচরণও ভালো লাগছে না। চা দিয়ে যাওয়ার সময় চায়ের দোকানের ছেলেটা সালাম দিয়ে গেল। আগামীকাল সকালে নাস্তা দেবে কি না জানতে চাওয়ায় বুঝতে পারলাম তিনি স্থানীয়। হঠাৎ একদল তরুণ চা খেতে ঢুকল হইহই করে। আমাদের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় একদম মিইয়ে গিয়ে আমার পাশের ভদ্রলোককে সালাম দিল। একজন বেশ অস্বস্তি নিয়ে হাতের সিগারেট ফেলে দিয়ে বলল, মামুন কাকা কেমন আছেন। সবার আচরণে নিশ্চিত হলাম, লোকটা এখানে স্থানীয় এবং খুবই প্রভাবশালী কেউ, তার নাম মামুন।
কী হলো বললেন না কোন গোলাপ নেবে? তার গলার স্বরটা যেন আদেশ দেওয়া আর প্রশ্ন করার জন্যই তৈরি হয়েছে। আড়চোখে দেখলাম সেই তরুণী আবার ডায়ান্থাসে হাত দিয়েছে। লোকটার সঙ্গে এবার বাজি লাগাই যায়। তবে আমার হাতে কোনো টাকা নেই। তবু জিদ চেপে গেল। বললাম, আমি হারলে কিছু দিতে পারব না। আরে কিছু দিতে হবে না। তবে জিতলে এই একহাজার টাকা আপনার।
কপোত-কপোতির দুজন দুই ফুলের ঝুরির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আমি সাহস করে বলেই ফেললাম, মেয়েটা ওই লাল ডায়ান্থাস নেবে। উনি মাথা নাড়লেন এবং চায়ের খালি কাপ দিয়ে টাকাটা চাপা দিলেন। চকচকে একহাজার টাকা। পকেটে সাকুল্যে তিনশ’ টাকা আছে। কেমন জানি একটু লোভও লাগল। ব্যাংক বিটে এত রিপোর্ট করি, কত টাকা চোখের সামনে নাড়াচাড়া হয়, কোনোদিন কোনো অনুভূতি হয় না। মনে হচ্ছে টাকাটা আমাকে পেতেই হবে। আমি আবার বললাম, লাল ডায়ান্থাস।
মামুন সাহেব আমাকে বললেন, একটু অপেক্ষা করুন। দেখি কোনটা কেনে? আমাকে জয়ী করার জন্যই বোধহয় লাল ডায়ান্থাস কিনে বের হয়ে এলো ওরা দুজন। বিস্ময়ে আর উত্তেজনায় আমার দম বন্ধ হয়ে গেল। জীবনে যে আমি কোনোদিন বাজিতে কিংবা লটারিতে একটা ইকোনো কলমও জিতিনি, সে কিনা একহাজার টাকা জিতে গেছি।
লোকটা যেন আমাকে টাকা দিতে পেরে খুব খুশি হলেন। আমাদের জন্য চা আর পুরী অর্ডার করলেন। অর্ডার নিয়ে যাওয়া ছেলেটাকে চারটে ডালপুরী আর দুকাপ চা দিতে বললেন। ১ হাজার টাকা আমি হাতে নিয়ে বসে আছি। পকেটে ঢোকাব কি না বুঝতে পারছি না। সত্যিই কি জিতেছি, না কি এখনি লোকটা ফেরত চাইবে। খুব অস্বস্তি লাগছে। আমার অস্বস্তি না ভেঙে আরও বাড়িয়ে দিলেন মামুন সাহেব। আরেকটা বাজি লাগবেন? নিজের অজান্তে হাতের টাকা মুঠি করে ধরলাম। মনে হলো এবার হারলে এটা ফেরত নিয়ে নেবেন। জানতে চাইলাম কী বাজি? আর কত টাকা দিতে হবে?
আপনি যদি হারেন তবে আপনি আমাকে ৫০০ টাকা দেবেন। আর জিতলে আরও ২ হাজার টাকা পাবেন। অফার মোটেও খারাপ না। আমার মধ্যে লোভ হিসহিসিয়ে উঠল। আমি বললাম, বাজির বিষয় কী?
চায়ের অর্ডার নিল যে ছেলেটা, সে কয়টা পুরী আনবে?
কয়টা আনবে মানে? আপনি চারটা বলেছেন চারটাই আনবে।
উনি ২ হাজার টাকা টেবিলে রাখতে রাখতে বললেন, না হয় কম আনবে, নয় বেশি আনবে। কম আনবে না কি বেশি?
সাধারণত এসব দোকানে কম সার্ভ করে না। পারলে একটা বেশি করে, যত বিক্রি তত লাভ। আমি নিশ্চিত একটা বেশি আনবে। সাহস করে সেটাই বলে ফেললাম। আর হারলেও উনার টাকা থেকে ফেরত দেব বলে আমার মধ্যে একটা নিশ্চয়তা আছে। চায়ের দোকানের ছেলেটাও আমাকে জয়ী করার জোর প্রচেষ্টা চালিয়েছে মনে হয়। দুকাপ চায়ের সঙ্গে পাঁচটা পুরী নিয়ে এলো। আমি আবার সত্যিকারের বিস্মিত হলাম। নিজের ক্ষমতা দেখে নিজেই অবাক। ভদ্রলোক আমার হাতে কড়কড়ে দুটো একহাজার টাকার নোট তুলে দিলেন। তখনই এক বৃদ্ধ এসে ঢুকলেন। ঢুকেই তীক্ষèদৃষ্টিতে একবার আমার দিকে আরেকবার মামুন সাহেবের দিকে তাকালেন। মামুন সাহেব একটু আড়ষ্ট হয়ে গেলেন। আমিও একটু অস্বস্তিতে পড়ে গেলাম। আমাদের টেবিলে বসতে-বসতে তিনি মামুন সাহেবকে কঠিন ধমক দিলেন, আবার বাজি ধরেছিস। জীবনে যা আয় করেছিস সবই তো এই করে শেষ করবি দেখছি। মামুন সাহেব একটু হাসার চেষ্টা করলেন। আমাকে ইশারায় কিছু না বলতে বললেন। সেই বৃদ্ধলোক বললেন, কত টাকা হারলি?
তিনি উত্তর করলেন, ৩ হাজার।
আচ্ছা তোর চার লাখ টাকার বাজিতে কেউ জিতেছিল?
আমার তো চক্ষু চড়ক গাছ, চার লাখ টাকার বাজি? আজিব লোক তো!
মামুন সাহেব জানালেন, এখন পর্যন্ত তিনজন জিতেছে। টাকার অংকটা শুনেই আমার রক্ত নেচে উঠল। আজ আমায় বাজির নেশায় পেয়েছে। বাজিটা কী, তা জানার লোভ সামলাতে পারলাম না।
মামুন সাহেব জবাব দেওয়ার আগেই সেই বৃদ্ধ জানালেন, মামুনের একটা পোষা প্রাণী আছে। শুধু ডাক শুনে, না দেখে বলে দিতে হবে এটা কী। বলতে পারলেই পুরস্কার।
কয়বার সুযোগ পাব প্রাণীর নাম বলতে?
মামুন সাহেব জবাব দিলেন, ইচ্ছামতো বলতে পারেন। আপনি যদি ২০০তম বারে গিয়ে প্রাণীর নাম বলতে পারেন, তাহলেও কোনো সমস্যা নেই।
হেরে গেলে বিনিময়ে কী দিতে হবে?
কিচ্ছু দিতে হবে না, শুধু এই তিন হাজার টাকা ফেরত দেবেন।
আমার মধ্যের লোভের সাপ হিসহিস করে উঠল। দুলাখ টাকা দিয়ে সাংবাদিক সমিতিতে প্লট বুকিং, এক লাখ টাকা ফিক্সড ডিপোজিট, মনি আর তৃষাকে নিয়ে কাঠমণ্ডু থেকে ঘুরে আসা। কতদিনের সখ একটু মেয়েকে নিয়ে বাইরে ঘুরতে যাওয়া। সব স্বপ্ন একসঙ্গে নেচে উঠল। যদিও মনের মধ্যে ক‚-ডাক ডেকে উঠছে।
মামুন সাহেব বলে চলেছেন, প্রাণীটা আমাদের খুব পরিচিত। কিন্তু ডাক শুনে একটু বোকা হয়ে যাই বলে আমরা ঠিকমতো নাম বলতে পারি না। সহজ একটা বাজি। আসলে বুঝেছেন, বাজি আমার নেশা। কাকা জানে। এই জীবনে আমি যা করেছি সব বাজি ধরেই। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো মামুন সাহেবের কথা শুনছি। ভেতরে ভেতরে কেমন অস্থির হয়ে উঠছি আমি। রইস এখনও ফোন করেনি। তার আগেই যদি আমি টাকা পেয়ে যাই, তাহলে তো আমাকে আর কোনো ধারই করতে হবে না। অলরেডি আমার পকেটে বাজি জেতার তিন হাজার টাকা। মামুন সাহেবের বাসা এই হোটেলের পেছনেই। ভেতরে একটা ভয় থাকলেও বাজিতে জেতার নেশা আমাকে আঁকড়ে ধরেছে।
হোটেলের পেছনে গাছপালা ঘেরা একটি বাড়ি। বড় উঁচু দেওয়াল। আমাদের সঙ্গে সেই বুড়ো কাকা আসাতে একটু আশ্বস্ত হলাম। অন্তত একজন সাক্ষী তো আছে। মামুন সাহেব বাইরে থেকে তালা খুললেন। বাসায় কেউ নেই। একদম দমবন্ধ করা নীরবতা। সবার শেষে বাড়ির ভেতরে ঢুকলাম আমি। পেছন থেকে কেউ বলে উঠল, লোভ করিস না মাহমুদ। লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু। আমার মনির মুখ ভেসে উঠল। মেয়েটা এই সাত বছরে আমার সংসারের জন্য কম কষ্ট করেনি।
টিনসেডের একটা বাড়ি বাইরে থেকে দেখলে বোঝাই যাবে না ভেতরে ঘর আছে। শুধু গাছপালা দেখা যায়। ঘরে ঢুকতেই একটা কটূ গন্ধ টের পেলাম। ভেতরটা বেশ অন্ধকার। উনি আমাকে মাঝের ঘরে বসতে বলে ভেতরে গেলেন। সেই বুড়ো কাকাও আমার পাশে বসলেন। কেমন জানি পুরনো একটা গন্ধ এই বাড়িতে। কিন্তু বেশ গোছালো। মামুন সাহেব বললেন কারেন্ট নেই, উনি মোম জ্বালিয়ে আনলেন। বললেন, আমি আনছি আমার গাবলুকে। গাবলু নাম শুনেই আমি একটু নিশ্চিত হলাম এটা কুকুর বা বেড়াল টাইপ কিছু হবে। আমি মনে মনে জানাশোনা সব প্রাণীর নাম আউড়ে চলেছি। আমাকে এই চারলাখ টাকা জিততেই হবে।
বাধ্য হয়ে আমাকে এই প্রক্রিয়ায় যেতে হয়েছে। ছয়মাসে একবার আমার সোনাবাবাটা খাবে। তাও যদি ভালো কোনো তরতাজা খাবার জোগাড় না করতে পারি, তাহলে কেমনে কী হয়?
মামুন সাহেব যেটা ঠেলে বসার ঘরে আনলেন, সেটা একটা দামি কারুকাজ করা কাঠের বাক্স। বাক্সের মধ্যে মধ্যেই খাজকাটা ফাঁকা সেখানে দিয়ে বাইরের আলোবাতাস ঢোকে বাক্সের ভেতরে। কিন্তু বাইরে থেকে কিচ্ছুটি দেখার জো নেই। মোটামুটি ৫ বছরের একটি বাচ্চাকে ঢুকিয়ে দেওয়া যাবে এমন বড় বাক্স।
মামুন সাহেব তাড়া লাগালেন, বলতে শুরু করুন।
আমি তো গলার আওয়াজ শুনিনি।
মামুন সাহেব ডেকে উঠলেন, গাবলু বেবি, পাপা ইজ হেয়ার, কিছু বলো তো ।
ভেতর থেকে অদ্ভুত হিসহিসানি আওয়াজ ভেসে এলো। আমি নিশ্চিত হয়ে গেলাম এটা সাপ। লোকটার সাহস দেখে অবাকও হলাম। এই আমলে কেউ সাপ পোষে? আর সাপ তার পোষও মেনেছে?
সাপ?
না।
বেজি?
না।
গিরগিটি?
না।
এই প্রজাতির প্রাণী ছাড়া আর কেউ হিসহিস করে না। আর মানুষের ডাকে সাড়া দেয় এমন কোনো প্রাণী আছে? আমি মোবাইল ব্যবহার করতে চাইলাম। মামুন সাহেব স্বেচ্ছায় সম্মতি দিলেন। আমার কেমন জানি অস্বস্তি লাগতে শুরু করছে। গুগল থেকে সব সরীসৃপের নাম বের করে পড়ে যেতে শুরু করলাম। কিন্তু কোনোটি নয় বলে অস্বীকৃতি জানালেন তিনি। এই মুহূর্তে তাকে মেনে নেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায়ও আমার নেই। আমাকে তাড়া দিলেন, তাড়াতাড়ি করুন চার লাখ টাকা পেতে হবে না? বলেই পাশের একটা চেস্টঅব ড্রয়ার থেকে লাখ টাকার ৪টা বান্ডিল বের করে আমার সামনে রাখলেন। আমি আরও একবার ডাক শুনতে চাইলাম, তিনি আবার ডেকে উঠলেন বেবি চিয়ার আপ প্লিজ…
আবার সেই রক্ত হিম করা হিসহিস শব্দ। মামুন সাহেব বলছেন, ক্ষুধা লেগেছে সোনা? এই তো আর ২০ মিনিট ধৈর্য ধরো খাবার তৈরি হচ্ছে। বাক্সবন্দি প্রাণীর সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করেই মামুন সাহেব আমাকে তাড়া দিলেন। কই বলুন, আপনাকেও বাড়ি ফিরতে হবে আমাকেও বেবিকে খাওয়াতে হবে।
আমি বলে যেতে লাগলাম, বাঘ, হরিণ, শজারু, ঘোড়া, ব্যাং, ক্যাঙ্গারু… খেয়াল করলাম, আমি একই নাম বারবার বলছি, আর মামুন সাহেব মাথা নেড়ে যাচ্ছেন। পানি পিপাসায় গলা শুকিয়ে আসছে। পানি এনে দিলেন সেই বৃদ্ধ চাচা। এরপর উনি বাইরে চলে গেলেন। আমাকে দেওয়া চায়ে কোনো সমস্যা ছিল কি? আমার খুব ঘুম পাচ্ছে। পানিতে কেমন কটু স্বাদ। সবকিছু ঘুরছে? কী ঘটছে কিছুই বুঝতে পারছি না।
মামুন সাহেব জিজ্ঞাসা করলেন হেরে গেছেন মাহমুদ সাহেব?
আমি মাথা নাড়লাম।
আপনাকে আর নাম বলতে হবে না। আপনি হেরে গেছেন। খুব চেনা একটা প্রাণী এটা। আমার কেমন মাথা ঘুরছে। উনার কথার কোনো জবাব দেওয়ার শক্তি নেই। সোফা থেকে ওঠারও কোনও শক্তি নেই। কিন্তু উনি বলেই চলেছেন।
মাহমুদ সাহেব এই প্রাণীটি মানুষের বাচ্চা, আমার বাচ্চা, আমার নিজের বাচ্চা।
আমার বোধশক্তিও বোধহয় লোপ পাচ্ছে। আমি উনাকে বলতে চাইলাম মিথ্যা কথা।
উনি বাক্সের ঢাকনা খুলে ডাকলেন বেবি, বেরিয়ে এসো, তোমার খাওয়ার রেডি।
বাক্সের দেওয়াল বেয়ে বিভৎস এক প্রাণী বের হয়ে এলো। এই প্রাণী এই জগতের কোনো প্রাণী নয়। হাত পা বলে কিছু নেই, থলথলে ভুড়ি আর মানুষের মাথার একাংশ, মুখের জায়গায় সাপের জিহ্বার মতো অদ্ভূত কিছু…। আমি চিৎকার দিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললাম। আমি নিশ্চয় কোনও দুঃস্বপ্ন দেখছি।
মাহমুদ সাহেব আপনি হেরে গেছেন তাই আজকে ওর খাদ্য হিসেবে আপনাকে ব্যবহার করব। আমার চার বছর বয়সী এই বাচ্চাটা জন্মের পরপরই ওর দাইকে খেয়েছে। খেয়েছে মানে রক্ত শুষে খেয়ে নেয়। এরপর মাকে খেয়েছে। এই বাড়িতেই জন্ম। আমাকে বড্ড ভালোবাসে। তাই আমাকে খায়নি। নিজের ছেলে তো মেরেও ফেলতে পারি না। তাই খাবার জুগিয়ে যাই। ও আজকে আপনার রক্ত চুষে খাবে। এরপর আপনার দেহ ফেলে দিয়ে আসব বাইরে কোথাও। অসুবিধা নেই। আপনার পরিবারের কাছে আমি চারলাখ টাকা পৌঁছে দেব। ওই চায়ের দোকান আমার। বুড়ো লোকটা আমার দীর্ঘদিনের সহকর্মী। আপনার চায়ে নেশাদ্রব্য দেওয়া হয়েছে। আপনি চাইলেও আর বের হতে পারবেন না নড়তে পারবেন না। মামুন সাহেবের একটা কথাও আমি বুঝতে পারছি না। আমার শুধু তৃষা আর মনির কথা মনে পড়ছে। ওরা অপেক্ষা করছে। আজকে ওদের নিয়ে ঈদ শপিংয়ে যাব।
মামুন সাহেব অনবরত কথা বলছেন, বুঝলেন মাহমুদ সাহেব ছেলে আমার ব্লাড ব্যাংকের রক্ত খায় না, জ্যান্ত মানুষ ছাড়া আর কিছুর রক্ত খায় না। বলেন, কী আর করব। অন্য কোনো প্রাণীর রক্তও খায় না। বাধ্য হয়ে আমাকে এই প্রক্রিয়ায় যেতে হয়েছে। ছয়মাসে একবার আমার সোনাবাবাটা খাবে। তাও যদি ভালো কোনো তরতাজা খাবার জোগাড় না করতে পারি, তাহলে কেমনে কী হয়?
আমি অনেক কষ্টে চোখ খুলে তাকালাম।
আমার সামনে জুলজুল চোখে সেই কিম্ভূত মানুষের বাচ্চাটি বসে আছে। এখন শুধু মামুন সাহেবের হুকুমের অপেক্ষায়…