বহুদিন আগ থেকেই আহারে রুচি কমে আসছিল নিতাইয়ের। আর এবারের খবর শুনে তার যে অবস্থা হয়, তাতে মনে হয় যেন সে আঠারো-ঊনিশ শতকের বালবিধবা—একাদশীর নিরম্বু উপবাস ছাড়া যেন তার পারলৌকিক মুক্তি অসম্ভব। এত বড় সাংঘাতিক খবর—যে খবরে নিতাইয়ের পেটে অন্নপ্রাশনের ভাতই ভাজা চাল হয়ে গেছে, সে খবরে দেখ নমিতার কোনো হেলদোল নেই। দিব্যি সে খাচ্ছে-দাচ্ছে-ঘুমুচ্ছে, এমনকি গোপনে পাড়ার ভজহরিটাকে দিয়ে বাজারের আজিজ ডাক্তারের ডিসপেনসারি থেকে ভিটামিন আনিয়ে সেবনও চলছে। এই নিরুদ্বেগ নিদ্রা, নিশ্চিন্ত আহার আর ভিটামিনের গুণেই কিনা ইদানীং নমিতা বেশ একটু মুটিয়েওছে। অথচ প্রথম দুটোর বেলায় সে ছিল হিলহিলে-গিলগিলে শরীরের, চোখবসা চেহারার পোয়াতি। কী চিন্তা সে করত কে জানে—মুখখানা তো ভার করে থাকতোই, দিনে দুই-চারবার গোপনে চোখও মুছতো। অবশ্য ওই ‘চোখমোছা’র পেছনে নিতাইয়ের বাপ-মায়ের কুলপ্রদীপ লাভের আশা, আর সে আশা যে দুরাশা, সে খবর আধুনিক প্রযুক্তির কল্যাণে অগ্রিম জানাটাই হয়তো মুখ্য কারণ ছিল। নিতাই কিন্তু প্রথমটার বেলায় খুব বেশি টেনশন নেয়নি। প্রথমবার বাপ হতে চলেছে সে। ছেলে হোক কী মেয়ে—ভগবানের দান হাত পেতে নেওয়াটাই নিয়ম।
কিন্তু দ্বিতীয়ার বেলায় ও নিয়মকে ঠিক নিয়ম বলে মানতে পারেনি। কেন? ভগবানেরই বা দানের বেলায় অত অনিয়ম কেন? তার বিবেচনাহীনতার সুযোগে জগতে যে কত অবিচার হয় তা কি তিনি জানেন না? ওই তো নিতাইয়ের মা—দুই বেলা নিয়মমতো আহ্নিক, ঠাকুরের ভোগ আর জপতপ নিয়ে থাকেন। তার এত প্রার্থনা, এত মাথা ঠোকাঠুকি, ঘটা করে ষষ্ঠীপুজো, মা শীতলার মন্দিরে মানত—সবই ব্যর্থ হওয়ায় তার মনের যে কী অবস্থা, তা কি ঠাকুর চেয়ে দেখেন না? আর তার প্রার্থনা ব্যর্থ হওয়ার কষ্ট ও হতাশাবোধ যদি কটূ কথার গরল হয়ে নমিতার শরীরে-মনে মাখামাখি হয়, তবে সে দায় কার?
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নিতাই নমিতার দিকে তাকায়। ওপাশের খাটে নিতা আর মিতাকে নিয়ে বেঢপ পেটটা উঁচু করে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে সে। পোয়াতি মানুষের ওভাবে চিৎ হয়ে শুতে নেই। কিন্তু নমিতা চিৎ হয়ে ছাড়া ঘুমুতেই পারে না। এখন এই দশওয়াট বাল্বের ঘোলাতে আলোতে তার ঘন নিশ্বাসের তালে ওঠা-নামা করা ভারী বুক, উঁচু পেটটার দিকে চেয়ে নিতাইয়ের হৃদয়ের অতল আঁধার থেকে যে হৃদয়হীনতা উঁকি দিচ্ছে, সে দায়ই বা কার?
নিজের প্রতি অবিশ্বাস বশেই নিতাই চোখ বুজে পাশ ফিরে শোয়। এই নিশীথের নির্জনে নমিতার দিকে তার তাকাতেও ভয়। তার কোন কথাতেই এবার কান দেয়নি মেয়েমানুষটা। নিজের জেদ বহাল রাখতে সে স্বামী এমনকি শাশুড়ির সঙ্গেও কোমর বেঁধে লাগতে প্রস্তুত। এত অবাধ্য-একগুঁয়ে, এত কুঁদুলে তো আগে ছিল না নমিতা!
দ্বিতীয় মেয়েটা জন্মের পর নিতাই ভেবেছিল, ছেলে হোক মেয়ে হোক, আর না। কিন্তু নিতাইয়ের মা গিরিবালার ওসব স্লোগানে আস্থা ছিল না, আজও নেই। থাকবে কী করে? এক বাপের এক ব্যাটা নিতাই। তার যে তিনটে দিদি আছে তারা তো সেই কবেই বিয়ে-থা হয়ে একেক জন একক মুলুকে ঠাঁই পেতেছে। সাতপুরুষের ভিটেয় পিদিম জ্বালাতে নিতাই ছাড়া আর কে আছে? তা এই নিতাই কি জন্মাতো যদি সে সময় তার বাপ হরদয়াল চক্কোত্তি ‘সুখী সংসার’ স্লোগানে কান দিতো? সুখী সংসারে হরদয়ালের যে বিশ্বাস ছিল না, তা নয়। বছর বিয়ানি স্ত্রীলোককে তিনি যে খুব উঁচু চোখে দেখতেন এবং মা-ষষ্ঠীর অগাধ কৃপায় বিগলিত বোধ করতেন, তাও নয়। তবু যে তিনি পরিকল্পনার আপাদের তার অন্দরে ঢুকতে দিতেন না তার মূল কারণ—বংশরক্ষা। হ্যাঁ, বংশরক্ষার তাগিদে ও বংশ রক্ষা করতেই এ পৃথিবীতে নিতাইয়ের আগমন। কত প্রাচীন চক্রবর্তী বংশ! এককালে নাকি এ ভিটেতেই মহাআড়ম্বরে লক্ষ টাকা ব্যয় করে মা দুগ্গার পুজো হতো। কালীপুজোর পাঁঠাবলির রক্ত মন্দিরের চাতাল থেকে গড়িয়ে সত্তরটি সোপান ভিজিয়ে চিত্রার জল লাল করে তুলতো। সেসব দিন আজ গতায়ূ। এখন বারোয়ারি পুজোয় ঢাকের বাদ্যি বাজাতেই বুক ধুকধুক করে। ছেচল্লিশ থেকে একাত্তর অবধি যারা ওপারে গেছে, সেসব জ্ঞাতি-কুটুম্বের খবর নিতাইরা তত রাখতে পারেনি। তাদের বাড়ি-বাগান, ধানীজমির কী দশা ঘটেছিল, সে বাসি খবরেও নিতাইয়ের কোনো ঔৎসুক্য নেই। ওসব তার জন্মেরও আগের ব্যাপার। কিন্তু হরদয়াল তো সেসব দিনের কথা ভুলতে পারে না। তার নিজের যেটুকু দেখার ভাগ্য হয়েছিল আর জেঠি-ঠাকমাদের কাছ থেকে যতটা শুনেছিল, তাতে করে তার মনে এ বংশের মহিমা এমনই উৎকীর্ণ হয়েছিল যে, সেই বংশের স্মৃতিমাখা ভিটের মায়া সে কোনোকালেই কাটাতে পারলো না। শত ঘা খেলেও হরদয়াল তাই ওপারে যেতে রজি নয়। আর যাবেই বা কেন? ওপারে কে তাকে দুধভাত মেখে ডাকছে? পুশইন-পুশব্যাকের ঠ্যালায় হরদয়ালের মতো লোক হয়তো পড়বে না কিন্তু এ পারের সহায়-সম্পদ জলের দরে বিকানো টাকায় কি ওপারে মিলবে এমন সাতবিঘা বাগান, শ্যাওলা-সবুজ শানবাঁধানো পুকুর, মা শেতলার আধভাঙা মন্দির? এই প্রাচীন বংশের গন্ধমাখা সম্পদের মায়া ছেড়ে কোলকাতার কোনো এক চিপায় একখানা ফ্ল্যাট অনেক আধুনিক মনে হলেও হরদয়াল তো সে আধুনিকতায় টিকতে পারবে না। অতএব, হরদয়াল তার ঠাকুর্দার আমলের এই শালকাঠের খুঁটি আর ফিবছর পুরু করে আলকাতরা লেপা টিনের চালার তলায় শুয়ে পুত্র নিতাইয়ের অবর্তমানে এ ভিটেয় প্রদীপহীনতার আশঙ্কা করতে করতে পরপারে পাড়ি দেবে। তা দিক। নিতাইয়ের তাতে তত আপসোস নেই। কিন্তু তার মৃত্যুর পরে এই বিষয়-আশয়, জোত-জমি সব যে বারো ভূতে লুটে খাবে, নিতাইয়ের স্বরক্তের কেউ যে কানাকড়িও পাবে না—এ ভাবনাতেই সে অস্থির।
ঝিম ধরে বসে থাকে নিতাই। কাজে-কর্মেও তার আর কোনো উৎসাহ নেই। কী হবে কাজ করে? এই যে জমিজমা, পুকুর-বাগান, দোকান-ব্যবসা, ব্যাংকে নগদ জমা—এসব কে খাবে, কার ভোগে লাগবে? কোথাকার কোন পরের পুতেরা এসে এসবের পরে মাতবরি ফলাবে? কথায় আছে শালা, জামাই, ভাগিনা—এই তিন নয় আপনা। অথচ মনে হচ্ছে নিতাইয়ের সহায়-সম্পদ এদেরই কেউ ভোগ করবে। নিতাই তখন বেঁচে থাকবে না, তবু দৃশ্যটা কল্পনা করে তার গা হাত-পা কেমন চিড়বিড় করে। এত সাধের সম্পদ, পূর্বপুরুষের এত এত যত্নে গড়ে তোলা ধন সব কিনা শেষে বারো ভূতের পেটে যাবে!
নিতাইয়ের হাবভাব দেখে নমিতার বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বের হয়। স্বামীর খাবারে অনীহা দেখে তাকেও অরুচিতে পেয়ে বসতে চায়। তবু সে তার ‘আগামী’র জন্য পেটপুরে আহার করে আর তলপেটে হাত বোলায় পরম মমতায়। চোখ ফেটে তার জল আসে—আহারে!
রাতের ঘুমটা নমিতার আগে পলকা ছিল না মোটেই। নিতাইয়ের এখনকার ঘুমের চেয়ে ঢের গাঢ় ঘুম তার এককালে হত। সে বড় আগেকার দিনের কথা, যখন সে উঠোনে এক্কাদোক্কা খেলত। মা-মাসীরা তার ঘুম নিয়ে আশঙ্কায় থাকত। বালবিধবা সেজপিসি তো প্রায়ই বলতো, নমিরে তোমার খোলা ঘরে শুতি দিও না গো বৌদি। দিনকাল ভালো না। এ মেয়েরে কেউ ফুলের ডালির মতো তুলে নিয়ে গেলি এ টেরও পাবে না। সেই থেকে সে অসময়ে ঘুমালে মা ঘরের বাইরে হুড়কোয় তালা এঁটে তবেই কাজ-কর্মে মন দিতে পারতো। বয়স বাড়তে থাকলে ঘুম কমে যায়। আর মেয়েমানুষের চোখের ঘুম তো কত কারণেই উধাও হয়। আর শিশুসন্তানের মায়ের চোখে ঘুম ‘নাই’ হওয়াটাই স্বাভাবিক। তাই ইদানিং সামান্য শব্দ, পাশে সামান্য নড়াচড়ায় নমিতার চোখ খুলে যায়। বুকের ভেতর ছ্যাঁৎ করে ওঠে—এই বুঝি ছোট খুকিটা ঘুমের মাঝে নড়তে গিয়ে খাট থেকেই পড়ে গেল! নাকি কাঁথা ভিজিয়ে তার পরেই গুঁটিসুটি মেরে পড়ে থাকলো! হা ভগবান! ঠিক তাই! এ জন্যই মেয়ের নাক থেকে সর্দি শুকোয় না। ওপাশের খাটে শুকনো-নরম বিছানায় নিতাই একা শোয়। যত শব্দই হোক ঘরে, বাচ্চা-কাচ্চার চ্যা-ভ্যা দূরে থাক, কাঁসি-বাঁশী একসঙ্গে বাজলেও তো নিতাইয়ের ঘুম টলে না! তবু নমিতা সেই নিতাইয়ের ভয়েই এখন সারা রাত চোখ খুলে কাটায়।
আচ্ছা, যদি এমন হয় যে মায়ের পেটে থাকতেই বাচ্চাটার লিঙ্গ বদলে গেলো! যাহ! তা আবার হয় নাকি? তবে যে কোথায় যেন শুনেছিল, খুলনা না কোথায়, সেই যে এক মেয়ে হঠাৎ ছেলে হয়ে গেলো! সে নাকি এখন বন্ধুদের সঙ্গে সাইকেল চালিয়ে ছেলেদের ইশকুলে পড়তে যায়! আরাক আচানক খবর একদিন সে স্বচক্ষে টিভিতে দেখেছিল। এই মোটা গিন্নীবান্নি চেহারার এক মেয়েলোক। মাথায় বেশ করে ঘোমটা টানা। নাকে বড় একটা নাকফুল, ঠেঁটে গোলাপি লিপস্টিক। মহিলার চেহারা দেখে আর কর্কশ কন্ঠস্বর শুনে তাকে কোনো শ্রমজীবী নারী নেত্রী বলে ভাবছিল নমিতা। কিন্তু পরনের শাড়িটা খুব দামি দেখে আর কথার মাঝে ফটর ফটর ইংরেজি শুনে নমিতা বুঝতে পারে যে এ মেয়েলোক যেন তেন কেউ নয়, কেউকেটা কেউই হওয়া সম্ভব। তাছাড়া যেভাবে টিভি স্টুডিওতে তার ইন্টারভিউ নেওয়া হচ্ছে সেটা তো এলেবেলে কারোর ক্ষেত্রে নেওয়ার কথা না! আরও কিছুক্ষণ দেখে-শুনে নমিতা ঘটনাটা ধরতে পারে। বিস্ময়ে তার চোখ প্রায় কপালে—তাই তো কই! নাকফুল, লিপস্টিক সব এত বেমানান ঠেকতেছে ক্যান!
জন্মেছিল পুরুষ হয়ে, বয়স বাড়লে হল নারী। বিয়েশাদি করে এখন সন্তানের মা। তারচে’ বড় আশ্চর্য এই যে, তিনি যে সে সাধারণ মেয়েমানুষ হননি। বুদ্ধি-কর্মে হাজারটা নয়, লাখ লাখ পুরুষকে টেক্কা দিতে পারেন, দিয়েও চলছেন। তার মেধা, পরিশ্রম, দক্ষতা ও তৎপরতায় নাকি এত এত প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে যেখানে হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। সেই লিঙ্গপরিবর্তিত নারীর আত্মপ্রত্যয়ী কঠিন পুরুষালী মুখটা মনে করে এখন নমিতার মনে হয়—ইস্! তার একটা মেয়ে যদি নিজেকে ওরকম প্রতিষ্ঠিত করতে পারতো! আচ্ছা, এমনকি হতে পারে না যে যে আসছে সে কালে-দিনে অমনই বিখ্যাত কেউ! হাহ্! তাই কিনা আছে এ কপালে! কিন্তু তার কপালে না থাক আরো বহুজনের কপালে তো দিব্যি আছে দেখা যায়। কত মেয়ে কত কাজে সুনাম কুড়োচ্ছে, বিখ্যাত হচ্ছে, দেশের কত গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করছে! এই দেশের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলীয় নেতা, স্পিকার, আরও কত মন্ত্রী তো!
কিন্তু ওসব সান্ত্বনার কথা নিতাইয়ের কাছে পাত্তা পায় না। দু-চারটা ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত দিয়ে যে বাস্তবতার বিচার চলে না তা নমিতা না বুঝলেও নিতাই বোঝে। নমিতার চেয়ে নিতাই তো আর দিন-দুনিয়া কিছু কম দেখেনি। কত বড় দেশ ভারত! কত জাতি ধর্মের মানুষের তাতে বসবাস! সেই দেশে আজ থেকে প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন একজন নারী। ক’বছর আগে সেখানে প্রেসিডেন্টও হলেন নারী। আর মন্ত্রিসভায় তো প্রতিবারই দু’চারটে সুন্দরী মুখশ্রী উঁকি দেয়। এছাড়া আছে বিভিন্ন দল-উপদলে সব ডাকসাইটে নেত্রী। তাতে করে সাধারণ ভারতীয় নারীর কী এমন এসে গেল? তাদের কি একখানা করে হাত বেশি হলো না বগলের নিচে দুটো ডানা গজালো? আর হাত বেশি হলেই বা কী? দূর্গা তো দশভূজা। ফিবছর বাংলা মুলুকজুড়ে দশভূজা মায়ের পুজোয়, আরও দশরকম দেবীর পুজোয় ‘মা-মা’ রব চলছেই। যেসব ভক্ত এই মা-মা করতে করতে কারখানার বর্জ্য আর শহরের সুয়ারেজ মেশা জলে পবিত্র গঙ্গাস্নান করছে তাদের কে চায় যে দেবী দূর্গার যত রূপ ঠিক ততগুলো কন্যা আসুক তার ঘরে? যদি চাইতো তাহলে ডা. রঞ্জিতাদের অত রমরমা থাকত কি?
ডা. রঞ্জিতা সান্যাল। দক্ষিণ কোলকাতার নামকরা গাইনোকোলজিস্ট। ভবানীপুর সিটি ডায়গনস্টিক অ্যান্ড নার্সিং হোমে নমিতাকে নিয়ে নিতাই তিনবার তার দ্বারস্থ হয়েছে। প্রতিবারই তিনি নিতাইকে ‘কনগ্রাচুলেশন মি. চক্রবর্তী, ইউ আর গোয়িং টু বি ড্যাড অব অ্যা বিউটিফুল ডটার’ বলে হাসিমুখে অভিনন্দিত করেছেন। নিতাই ভেবে পায় না যে প্রতিবার তিনি একই শব্দগুচ্ছ কী করে ব্যবহার করেছেন! না কি এটাই তার স্টাইল—ঠিক একই বাক্য দ্বারা তিনি প্রত্যেক হবু পিতাকেই অভিনন্দিত করেন? হতে পারে। কিন্তু ওই ইংরেজি শব্দগুলো যে কতটা বিদ্রূপের শেল হয়ে নিতাইয়ের বুকে বিঁধতো, তা কি তিনি বুঝতেন? না কি সব বুঝেই তিনি নিতাইয়ের সঙ্গে রসিকতাটা করতেন? নিতাই প্রতিবারই তার হাসির জবাবে একটা শুকনো হাসি মুখে ঝুলিয়ে বলেছে, আমাদের আরও দুটো মেয়ে আছে ম্যাডাম। ‘ও আই সি!’ বলে তিনি ঠোঁট সরু করে শিস বাজাতে বাজাতে সনোর কপিটা আরেকটু উল্টে-পাল্টে দেখতে দেখতে সরু চোখে নিতাইয়ের দিকে একবার অপাঙ্গে তাকিয়ে তার মনোভাবকে জরিপ করে নিয়েছেন। এরপর তাদের মাঝে যেসব কথা হয়েছে তা কেজো, সংক্ষিপ্ত ও চূড়ান্ত। নমিতা তার কিছু শুনেছে, কিছু শোনেনি। অন্তত, তার মুখ দেখে এ ভরসাই হয়েছে যে নিতাইয়ের মতই তার মত। কিন্তু তৃতীয়বারে বড্ড বেঁকে বসে নমিতা—না, সে কিছুতেই আর কোলকাতার ভাগাড়ে তার রক্তের ধনকে ফেলে যাবে না। নরম-শরম নমিতা এতটাই বেঁকে বসে যে ডা. রঞ্জিতা ইংরেজি-হিন্দির বদলে খাস বাংলাতেই বলেন, ‘আপনার স্ত্রীকে বোঝানো সম্ভব হলে তবেই এখানে এসে তারিখটা নিয়ে যাবেন। তা নইলে দেশে ফিরে যান, ওনার শরীরের ঠিক-ঠাক যত্ন নিন। আর তৃতীয় কন্যার একটা সুন্দর নাম ঠিক করুন।
সেই থেকে নিতাইয়ের এমন নিষ্প্রাণ দশা।
ভগবানের আশীর্বাদে নিতাইয়ের জীবনে কোনো দুর্ভাবনারই ঠাঁই ছিল না। তার পিসি-মাসি-মামা-জেঠুরা সব চোখের সামনে এদেশ থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে ওপারে গেড়ে বসে গঙ্গাজলে কুলকুচি করার সৌভাগ্য লাভ করলেও বাস্তবের মাটিতে পথ হাঁটা নিতাই ভালো করেই জানে, তারা কে কেমন অবস্থায় আছে। শুধু নমিতাকে নিয়েই তো নয়, একা সে বারকয়েক নানা কাজে ওপারে গিয়েছে। একেক বার একেক ঠাঁই করায় ঠাঁই সে পেতেছে পিসি-মাসি-জেঠু সবেরই বাড়িতে। ধর্ম সাক্ষী—উন্মূল মানুষের এক-দুই প্রজন্মের কাল কেমন কাটে তা নিতাই ভালোই জানে। কাজেই নিতাই চোখ বুজলেই বাঙাল বোল ছেড়ে হিন্দিমেশানো ঘটি ভাষায় অভ্যস্থ সব তুতো ভাইপোরা বিস্মরণ হওয়া আত্মীয়তা গোছাতে যে ছুটে আসবে—এ ব্যাপারে সে নিশ্চিত। অথচ এদিকে কার হাতের আগুন যে তার মুখে উঠবে সে এক অনিশ্চিত প্রহেলিকা। সকাল-সন্ধ্যা গীতা পাঠ, গায়ত্রী মন্ত্র আবৃত্তি, আহ্নিক আর জপতপ যার জীবনের প্রধান কাজ সেই হরদয়াল চক্রবর্তীর একমাত্র পুত্রের কি না, এমনই অগতি দশা!
চাঁপাফুলের মতো ফুটফুটে কন্যা কোলে পথ চলে নিতাই। রঙজ্বলা গোলাপি ত্যানায় প্যাচানো তুলতুলে নরম শরীর। টুকটুকে লাল ঠোঁট ক্ষণে ক্ষণে অকারণেই বেঁকে বেঁকে হাসছে। আর দেখ কাণ্ড! এই এতটুকুন একজোড়া চোখ আধখোলা করে কেমন পিটপিটয়ে তাকায়! নিতাই কিন্তু তার চোখে চোখ রাখতে পারে না। অস্বস্তিতে দৃষ্টি ঘুরিয়ে নেয়। হঠাৎ মেয়েটা হাসে। নিঃশব্দ বাঁকা হাসি নয়, বরং খিলখিলিয়ে চতুর-বুঝদার শিশুর লুকোচুরি খেলার হাসি হাসে। চমকে নিতাই চারপাশে তাকায়। এই তো সে এসে পড়েছে। সামনেই কুমার নদ। ওখানে ওই তো সেই সেতু, যার শুভ উদ্বোধন হয়েছিল দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রীর হাতে। সেই অদৃষ্টপূর্ব মহান দৃশ্য দেখতে এসে প্রাণ গিয়েছিল শ’খানেক মানুষের—নৌ-দুর্ঘটনায়। আর ওখানে, ওই সেতুর মাঝখানে দাঁড়িয়েই এক বাবা ছুড়ে ফেলেছিল তার আত্মজাকে, কুমার নদীর গর্ভে, এই তো কদিন আগেই।
নিতাই হাঁটছে। সেতু অভিমুখে।
পুরনো বাড়ির জীর্ণতা কাঁপানো ওয়া-ওয়া আর কিছু কলস্বরে নিতাইয়ের ঘুম ভাঙে। ব্যাপার বুঝতে তার কিছু সময় যায়। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে উঠে গিয়ে সে উঁকি দেয় নতুন চালা বাঁধা আঁতুড় ঘরে। আশ্চর্য! নমিতার কোল আলো করে শুয়ে থাকা নবজাতিকা নিতাইয়ের দিকে চেয়ে চোখ মটকে হাসে। যেন ঐটুকু শিশুর চোখে নিজের দুর্বুদ্ধি ধরা পড়ায় নিতান্ত অপ্রতিভ নিতাই আরও হতবুদ্ধি হয়ে পড়ে যখন দেখে যে নমিতা শিশুটির নিম্নাঙ্গ তার দিকে উঁচিয়ে ধরে আগ্রাসী একরোখা বিজয়িনীর নির্লজ্জ হাসি হাসছে।