ধীরে ধীরে পর্দা উঠছে একটি ভোরের। নতুন নরম কচি সূর্যের আলো হাত বুলিয়ে দিচ্ছে চরাচরে। পৃথিবীর রাত্রিকালীন স্থবিরতা একটা অস্পৃশ্য ছায়ার মতো সরে যাচ্ছে একটু একটু করে। বিন্দু বিন্দু জল, হয়তো বা শিশির জমতে শুরু করেছে ভূমিতে। ভূমি আজ তৃষিত। মনে-প্রাণে কর্ষণের অপেক্ষা। সূর্যের আলোয় কিসের যেন রং, কেমন যেন আভা। কতগুলো অজানা বীজ একত্রিত হলো যেন অজানা কোনো টানে। ওরা এখন জমাট, পরিপূর্ণ, পরিপুষ্ট একটাই মাত্র বীজ। বীজ রোপিত হয় ভূমিতে। ভূমি হয় গর্ভবতী। গর্ভবতী ভূমির উদর হেসে ওঠে। বহুদিন পর যেন মাতৃত্বের স্বপ্নে বিভোর সে। বীজটি কুঁড়ি হয়ে ওঠে, কুঁড়ি থেকে বৃক্ষ। বৃক্ষে দোলে পাতা, শাখায় শাখায় ফুল-ফল। হেসে খেলে থাকা যেন এক প্রণয়ী কিশোরী। বৃক্ষে আবার যৌবন। বীজ এখন তার গর্ভজুড়ে। একে একে বীজ ঝরে পড়ে মাটিতে। মাটিতেই লুকায় সে। এখান থেকে আবার অসংখ্য কুঁড়ি, তারপর ক্রমশ ঘন সবুজ অরণ্য। অসংখ্য প্রাণী সেই অরণ্যের প্রাণ। প্রাণ ও অরণ্য যেন একে অন্যের। এক সময় প্রাণের কাছেই ফিকে হয়ে আসে অরণ্যের সবুজ। বৃক্ষ ভূমিতে কেবল লাশ আর লাশ। অরণ্যের লাশ, এখানে-ওখানে ছড়িয়ে থাকা কত প্রাণীর লাশ! কেবল ভূমিই অক্ষয়। সে যেন একশ সন্তানহারা ভারতমাতা গান্ধারী। খাঁ খাঁ কোল তার ক্রমশ। এক সময় সে সৃষ্টি করেছিল প্রাণ ভরে। এখন কেবলই লয়। ক্রমশ এবং ক্রমশ।
ওরা সাত জন পরস্পরকে চেনে, কথা বলে, হাসে-কাঁদে, ঝগড়া করে, এমনকি মারামারিও। তবু মহিরুহের বিশালত্ব যখন ওদের চোখে পড়ে, তখন আবার ছুটে আসে এক হতে। ওরা ভাবে, ওদের অতীত, ভবিষ্যত।
এখানে এক বিশাল মহিরুহের নিচে ওদের বাস। ওরা সাত জন। একই বৃক্ষের গর্ভমূলের যেন সাত ফুল। ওরা সবাই এক কিন্তু সবাই যেন ভিন্ন। এই মহীরূহ ওদের ঘর। ওদের আশ্রয়, খাদ্য, বস্ত্র, চিকিৎসা সব। সকালের প্রখর রৌদ যখন ঝলসে দেয় মাঠ, এক চুমুকে যখন চুষে নেয় জল, তখন এই মহীরূহই তার শাখায়-শাখায় মায়ের চুড়ি পরা হাতের তালুর মতো পাতা দিয়ে ছায়া দেয় ওদের মাথার ওপর। মৃদু ঠাণ্ডা বাতাস দিয়ে জুড়িয়ে দেয় দেহ। অথবা খুব শীতের রাতে যখন দুনিয়ার শেষ আগুনটাও লুকিয়ে পড়ে দুনিয়ার কোনো এক কোণে, তখন মহীরূহকে জড়িয়ে ধরে উম নেয় ওরা সাত জন। কিংবা ঝড়ের রুদ্রমূর্তি যখন পাঞ্জা লড়ে দেবতার সঙ্গে, ক্রুদ্ধ মোষের উত্তপ্ত নিশ্বাসের মতো অথবা কালনাগীনির ফণার মতো ছোবল দিতে প্রস্তুত হয় বাতাস। মহীরূহ আবার ওদের নিয়ে নেয় মাতৃজঠরে। কখনো কখেনো ফুলের মিষ্টি সুবাসে সাতজনকে স্বপ্ন দেখায় সে। এই সাত জন ছাড়াও মহিরুহে বাসা বাঁধে পাখি। খড়কুটার ছোট্ট বাসায় ভবিষ্যতের জন্য সাবধানে রাখে ছোট্ট নীল ডিম। কোটরে বাস করে পিঁপড়ার দল। সবুজ পাতার ফাঁকে অদ্ভুত ভঙ্গিতে আটপেয়ে মাকড়সা। আরও কত কীট-পতঙ্গ। ওরা সাত জন পরস্পরকে চেনে, কথা বলে, হাসে-কাঁদে, ঝগড়া করে, এমনকি মারামারিও। তবু মহিরুহের বিশালত্ব যখন ওদের চোখে পড়ে, তখন আবার ছুটে আসে এক হতে। ওরা ভাবে, ওদের অতীত, ভবিষ্যত। কেমন ছিল কিংবা কী হতে পারতো। এই বিশাল মহিরুহের ছায়াতল ভাবিয়ে তোলে ওদের। একটা টিয়ার পালক সূর্যের আলোতে ডুব দিয়ে ভাসতে ভাসতে এসে পড়ে ওদের একজনের পায়ের কাছে। সে পালকটা হাতে তুলে নেয়। পালকে লেগে আছে গত উড়ালের গন্ধ। সে পালকটা নেড়ে চেড়ে দেখে। তারপর যেন কার উদ্দেশে বলে ওঠে—ঠিক আছে তুমিই বলো।
বাকি ৬ জন বুঝতে পারে না আসলে ঠিক কাকে বলতে বলা হয়েছে। সবাই যার-যার মতো করে প্রস্তুত হয় বলার জন্য। সবার মনে হয় সত্যিই ওদের অনেক কথা বলার আছে।
পালকটা কেমন ঝরে গেল তাই না?
হ্যাঁ, পালকটা ঝরেই গেল।
এ টিয়াটার শরীরে আর কতগুলো পালক আছে? সব পালক কি এভাবেই একসময় ঝরে যাবে!
চলো আমরা ওটা ধরে আনি। আমি পুষব।
পোষার কি দরকার, তারচেয়ে চলো ঝরে যাওয়ার আগেই ওর পালকগুলো সব খুলে নেই। তোমার জামার পকেটে কিংবা চুলের ফাঁকে গুঁজে দাও। দেখো দেখো, এই দেখো, কি সুন্দর লাগছে!
হ্যাঁ হ্যাঁ চলো ধরে আনি।
না ওটা ধরবে না। অনুরোধ করছি। টিয়াগুলো সব মরে যাচ্ছে। আর মাত্র এ কয়টাই অবশিষ্ট আছে। ওর পালকগুলো খুলে নিয়ো না দয়া করে।
তাহলে কি ওটা আবার উড়বে?
হ্যাঁ, ওটা উড়বে। ঝাঁকে-ঝাঁকে উড়বে। ভেবে দেখো, যখন ওর ডানায় ঢাকা পড়বে আকাশ, তখন মনে হবে, এই ভূমিতে যেন সৃষ্টি হয়েছে আরেকটা অরণ্য।
ওরা সাত জন আবার এক হয়ে আসে। প্রত্যেকে হাত বুলায় মহীরূহটার বিশাল কাণ্ডে। কী সুপ্রাচীন এই মহীরূহ! ওদের একমাত্র আশ্রয়স্থল। মহীরূহটার পাতাগুলো ঝরে যাচ্ছে। ভূমিতে এখন প্রায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে অসংখ্য পাতা। কাণ্ডের যে অংশটার ছাল ওদের খাদ্য, কিংবা যে অংশের ভেতরে থাকা রস ওদের পানীয়, সে অংশটা কেমন যেন বিবর্ণ হয়ে পড়ছে দিনে দিনে।
ওর ভেতরে মনে হয় আর তেমন রস জমা নেই। দেখো কেমন মরে আসছে এ পাশটা!
কিন্তু আমরা তো আমাদের তৃষ্ণা বন্ধ রাখতে পারি না। আমি খুব তৃষ্ণার্ত।
যখন ও পুরোপুরি মরে যাবে, তখন তৃষ্ণা কিভাবে মেটাবে?
আরে বোকা, ও মরে গেলে তো আমিও মরে যাব। তখন কি আমার তৃষ্ণা থাকবে?
কিন্তু যত দিন বেঁচে আছ?
তোমরা ওকে মেরে ফেলবে? ও আমাদের আশ্রয়দাতা। ও আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছে। ওকে আমরা এভাবে মেরে ফেলতে পারি না।
তাহলে কি আমরা না খেয়ে থাকব?
একটু না হয় কম খেলে। তারপরও যদি ও কিছু দিন বাঁচে।
ওরা সবাই ঝড়া পাতা কুড়িয়ে জড়ো করে। চিকন একটা শীত যেন জেঁকে বসেছে। ওরা ঝরা পাতায় আগুন জ্বালায়।
ঠিক আছে তুমি না হয় একটু কম খেয়ো। একজন একটু কম খেলে তো সমাধান হলোই।
সে একজনটা তুমিই হওনা।
না না বাবা আমি কম খেয়ে থাকতে পারি না।
তা হলে তুমি?
আমি কেন, তুমি তোমার নিজেকে কেন বলছ না?
আমি? আসলে… আচ্ছা তোমরা বসো, আমি একটু ছাল তুলে নিয়ে আসি। আজকের দিনটা তো কাটাই।
একটা জিনিষ ভেবে দেখেছো, ও যদি মরে যায় তাহলে আমাদের মতো অন্য সবাই মরে যাবে। ওর ডালে থাকা পাখি, কোটরে থাকা পিঁপড়ের দল, পাতার ফাঁকের মাকড়সা সব।
তাই তো, তাহলে আমরা মাংস পাব কোথায়?
আর পাখির পালকের নরম জামা?
এক্ষুনি চলো পাখিটাকে মেরে আনি।
আহ, পাগল হলে না কি? এটাই মহিরুহের শেষ টিয়া পাখি।
একজন মহিরুহের রস নিয়ে আসে। ওরা আগুনের পাশে বসে রস খায়। আমি যখন ওর কাণ্ডের আরও গভীর গর্ত খুঁড়ে রস তুলছিলাম, তখন মনে হলো ও যেন কাঁদছে।
আমার বাবা, যার গায়ের রঙটা ছিল একদম ঠিক দেখতে আবলুস কাঠের মতো, তিনি যখন তুনে তীর চড়াতেন, তখন তার চোখগুলো মনে হতো শিকারী সিংহের মতো। রোদে পুড়ে সোনালি হয়ে যাওয়া ঘাসের বনে যেন লুকিয়ে থাকা কোনো সিংহ, এক্ষুনি তার তীক্ষ্ম থাবা নিয়ে ঝাঁপ দিতে সে প্রস্তুত শূন্যে।
বাজে কথা বলো না। ওর কাঁদার শক্তি নেই।
আমি বলছি, আমি শুনেছি।
হতেও পারে। আমিও মাঝে মাঝে মনে হয় ওর কান্না শুনি। সেই যে শেষ সবুজ শুয়োপোকাটা যখন আমরা মেরে ফেল্লাম, তখন মনে হয়েছিল ও কাঁদছে। তোমাদের বলিনি। পাছে যদি পাগল ভাবো।
চলো, আমরা ওর শরীরে কান পাতি। যদি কিছু শোনা যায়…
ওরা সাত জন মহিরুহের খসখসে শরীরে কান পাতে। ওদের মস্তিষ্কের কোথায় যেন কে বলে দেয়, কাঁদো স্বপ্ন সন্তানেরা, আমার জন্য কাঁদো।
আমি যখন ছোট্ট ছিলাম তখন আমার বোনকে নিয়ে বাড়ির ধারে একটা জঙ্গলে বুড়ো ওক গাছে কান পাততাম। যদি কিছু শোনা যায়!
তুমি বুঝি তোমার বোনকে খুব আদর করতে?
হ্যাঁ, রোজ সকালে আমরা ৩ মাইল হেঁটে পাহাড়ি খাল থেকে জল নিয়ে আসতাম।
বাহ্, তোমরা অনেক সুখি ছিলে তাই না?
হ্যাঁ ঠিকই ধরেছ। আমরা সত্যিই খুব সুখি ছিলাম। আমার বাবা ছিলেন গ্রামের প্রধান পুরোহিত। আমি আর বাবা লম্বা ঘাসের বিস্তীর্ণ বন পাড়ি দিয়ে যেতাম পাথুরে পাড়ায়। ওখান থেকে বুনো শুয়োরের লোম সংগ্রহ করতেন তিনি। প্রথমে বাবার তীক্ষ্ম তীরের আঘাতে ক্রমাগত ওটা হুটোপুটি খেতো। ওর লম্বা দাঁত নিয়ে তেড়ে আসত আমাদের দিকে। আমরা উঠে যেতাম গাছে। শুয়োরটা ওর বাঁকানো দাঁত দিয়ে গাছটা ফেড়ে ফেলতে চাইতো। বাবা আবার তীর ছুঁড়ে মারতেন। একসময় বিষাক্ত তীরে ওটা নিস্তেজ হয়ে আসত। আমি আর বাবা ওর গা থেকে লোম তুলে নিতাম। তারপর ওটাকে বাঁশে বেঁধে গ্রামে নিয়ে আসতাম। রাতে আগুনের পাশে বসে ওটার ঝলসানো মাংস খেতে খেতে বাবা গ্রামবাসীদের শোনাতেন বামন মানব পিগমিদের কথা।
তোমার বাবা তাহলে সুন্দর গল্পও জানতেন।
আমার বাবা, যার গায়ের রঙটা ছিল একদম ঠিক দেখতে আবলুস কাঠের মতো, তিনি যখন তুনে তীর চড়াতেন, তখন তার চোখগুলো মনে হতো শিকারী সিংহের মতো। রোদে পুড়ে সোনালি হয়ে যাওয়া ঘাসের বনে যেন লুকিয়ে থাকা কোনো সিংহ, এক্ষুনি তার তীক্ষ্ম থাবা নিয়ে ঝাঁপ দিতে সে প্রস্তুত শূন্যে।
দেখ দেখ, মহিরুহের ডালগুলো যেন কেমন নড়ে উঠল। মনে হয় তোমার কথা যেন বুঝতে পেরেছে।
কে জানে হয়তো বুঝতেও পারে। আমাদের ওই ঘন বনাঞ্চলে হয়তো ও নিজেও ছিল।
এদিকে দেখো, ওর গা থেকে কেমন কষ বের হচ্ছে। মনে হয় ঠিক যেন রক্ত। তুমি এখান থেকেই ওর ছাল তুলে নিয়েছ তাই না?
ওরা সবাই মনোযোগ দিয়ে মহিরুহের ক্ষতস্থানটা দেখে। কারও কারও মনে বিষণ্নতা ভর করে। মনে পড়ে যায় একটু আগেই এই ছালটুকু মিটিয়ে ছিল ওদের ক্ষুধা।
একসময় যদি ওর সবটুকুই আমরা খেয়ে ফেলি তখন কী হবে?
ও আবার বীজ ছড়াবে। নতুন একটা মহিরুহের জন্ম দেবে তখন।
আর যদি না ছড়ায়?
আহ, তুমি বড্ড বেশি তর্কপ্রিয়।
আচ্ছা আমার মাথায় একটা প্রশ্ন এসেছে। ওর ডালপালা, পাতা এত সবুজ কেন? তুমি কি জানো?
না আমি জানি না। তুমি জানো?
না আমি জানি না। তুমি কিংবা তুমি?
ওরা কেউ এই প্রশ্নের যেন উত্তর জানে না। ওরা সবাই প্রশ্নের প্রাসঙ্গিকতায় বিব্রত। ওরা মহিরুহের পাতাগুলো খুটিয়ে খুটিয়ে দেখে। মহিরুহের গাঢ়মেটে রঙা একটা শাখায় ছোটাছুটি করছে কতগুলো পিঁপড়া। ওদের কেউ কেউ খুব মনোযোগ দিয়ে পিঁপড়াগুলো দেখে। পিঁপড়াগুলো যেন খুব জরুরি কোনো কাজে ছুটে চলেছে। ওগুলো একে অন্যকে পাশ কাটায়, মাঝে মাঝে শলাপরামর্শ করে। পিঁপড়াগুলোর ছুটন্ত কালো শরীরের সঙ্গে মনে হয় যেন মহিরুহের ডালে কেউ কালো দাগ কেটে দেয়।
আমাদের যে গ্রাম ছিলো, সে গ্রামের মেঠো পথে মাঝে মাঝেই এমন পিঁপড়ের ঢিবি চোখে পড়ত।
ওরা যেন সবাই আবার নতুন কোন গল্পের আচ্ছন্নতায় ঘনিষ্ঠ হয়ে আসে। প্রত্যেকের মুখ দেখে মনে হয় এ গল্প যেন ওরা আগেও অসংখ্যবার শুনেছে। তবু শুনতে ভালো লাগে।
সেই পিঁপড়েরা মাটি উঠিয়ে বড় ঢিবি বানাতো। বর্ষায় বৃষ্টির শুরুতে যখন চার দিকে ভেজা মাটির গন্ধ ছড়াতো, তখন ওরা আসন্ন ঢলের ভয়ে মুখে ডিম নিয়ে ছুটে যেত নিরাপদের সন্ধানে। বছরে যখন আমাদের গোলায় উঠত নতুন ধান, কাঁচা চালের গন্ধে যখন ম ম করত বাতাস, তখন ওরা আসত উচ্ছিষ্ট চাল খুঁটে নিতে। চাল মুখে নিয়ে ওরা দলে দলে ফিরে যেত ঢিবিতে।
তোমাদের গ্রামটা একদম যেন অন্য রকম।
হ্যাঁ, একদম। মাটি দিয়ে লেপা ঘর। তাল সুপারীর গাছ, ছায়া ছায়া অন্ধকার, ধান ধূপের গন্ধ, দেবতার ঘণ্টাধ্বনি। গ্রামের মানুষগুলো ছিল খুব পরিশ্রমী। সকালে ভোরে হাঁড়ভাঙা খাটুনি, বিকেলে ঘরে ফিরে এসে পুঁথি পাঠ, গান, দেবতাদের গুণকীর্তন।
তোমাদের গ্রামে কি নদী ছিল?
নদী? ভরা যৌবনা এবং বিস্তৃত। কত যে বাহারি তার নাম! দেবতার পুত্রের নামে, দেবীদের নামে, গল্প কথার স্মারক-স্মারিকাদের নামেও। সেই নদীর পলি কখনো আমাদের দিত অকৃপণ আশীর্বাদ, কখনো ঢল হয়ে ভাসিয়ে নিত নিঃস্ব করে। সুউচ্চ পর্বতশৃঙ্গে যাদের উৎপত্তি ছিল সবার।
নদীতে মাছ?
জেলেদের জালে হরেক রঙা মাছ। রূপালি রোদে জলের রূপালি ঝিলিকে শুধু যেন নদীতে মাছেরই রাজত্ব।
অদ্ভুত সুন্দর ছিল তাহলে তোমাদের শৈশবের দেশ?
হ্যাঁ, আমরা দেয়াল গড়েছিলাম শত্রু থেকে রক্ষা পাব বলে। তবু শত্রু এসেছে। আমরা লড়াইও করেছি। বীরত্বের ইতিহাস লেখা ছিল মাটির প্রতিটি কণায়-কণায়।
ওরা সবাই আবার নিশ্চুপ হয়ে যায়। প্রত্যেকের মাঝে যেন স্মৃতির দরিয়া নতুন করে ফুলে উঠেছে। কারও কারও মনে পড়ছে ছায়া ঢাকা সোঁদা মাটির গন্ধঅলা গ্রাম। কারও সুউচ্চ পর্বত সারির ওপর চকমকি হীরার মতো রোদের ছটা। কেউবা ভাবছে মরু বালুর পায়ের ছাপ। গনগনে সূর্যের নিচে কাঁচা ঘামের গন্ধ। হঠাৎ মহিরুহের পাতার ফাঁক দিয়ে একটা চিকন সূর্যের আলো ওদের গায়ে সে পড়ে। ওরা ৭জন একে অন্যের দিকে তাকায়। তারপর আবার ৭ জন আলাদা হয়ে বসে। আপন মনে কী যেন ভাবে ওরা।
কী ব্যপার তুমি মাটি তুলছ কেন?
ওর ভেতরের শেকড়টা বের করব। ওটার ভেতরের রসটা খুব মিষ্টি।
খবরদার আর একটুও মাটি খুঁড়বে না। শেকড়টা তোমার একার নয় যে, যখন ইচ্ছে তুলে রস খাবে।
ওটা আমিই আগে তোমাদের বলেছিলাম। সুতরাং ওটার ওপর আমার অধিকার সবচেয়ে বেশি।
দেখো প্রশ্নটা অধিকারের নয়। ওর শেকড় তুলে এভাবে শেষ করলে ও মরে যাবে। এই দেখো ওর এই অংশের পাতাগুলো কেমন বিবর্ণ। এই ডালটার পাতাও কেমন ঝরে যাচ্ছে।
এই শোনো, আমার না কেমন ভয় করছে। ও কি একদিন সত্যিই মরে যাবে?
ওরা সবাই সবার দিকে তাকায়। ওদের মনে হয় প্রশ্নটার উত্তর ওদের জানা নেই। আর জানা থাকলেও ওরা যেন নিজেদের কাছেই ওটা লুকাতে চাইছে। মহীরূহ থেকে একটা দুটো পাতা ঝরে পড়ে। মহীরূহ যেন কি বলতে চায় ওদের।
এমনই হয়েছিল সেসময়।
কী হয়েছিল? কোন সময়ের কথা বলছ?
সেই যে সেই সময়। শীতে যখন ভালুকের চামড়া দিয়ে বানানো কোট পরেছিলাম আমরা। তবু জানো, শীত মনে হয় একটুও কমছিল না। সকালে বরফে ঢাকা পাহাড়গুলোর দুধসাদা চুড়া রৌদ্রে চমকাতো। বিকেলে শুরু হতো তুষার ঝড়। আমরা আমাদের কাঠ দিয়ে বানানো ঘরের আগুন চুল্লির পাশে জড়ো হয়ে কফি খেতাম। আমি এখনো সেই মাদকতাময় গন্ধ পাই।
কফি! সত্যিই বড্ড মাদকতাময় গন্ধ।
সবুজ কচি ঘাসের জমিনে গোলাপি আপেল গাছ। বসন্তে এদিক-ওদিক ফুটে আছে টিউলিপ, চেরি। দূরে ম্যাপলের ঘন বন। সবুজ ঘাসে পড়ে থাকা আপেল কুড়াতাম আমরা। সবুজ, কালচে লাল, গোলাপি সব আপেল। শীতের মাঝামাঝি আমাদের গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীর জল জমে বরফ হয়ে যেত। সেই বরফের ওপর দিয়ে দৌড়াতাম আমরা। কেউ-কেউ বরফ খুঁড়তো। পাওয়া যেত নিচে হীমশীতল জল।
তুষারে যখন সব কিছু সাদা হয়ে যেত, তখন আমরা বরফ দিয়ে পুতুল বানাতাম। একটা ছোট্ট গাজর দিয়ে বানিয়ে দিতাম ওর নাক। আচ্ছা তোমরা কখনো আঙুর ক্ষেত দেখেছো? থোকা থোকা সবুজ আঙুর? কিংবা স্বর্গের অলৌকিক বৃক্ষের মতো আপেল গাছ? আমরা লতানো আঙুর ক্ষেত থেকে আঙুর পাড়তাম। তারপর সেগুলো থেকে বাছাই করে রেখে দেওয়া হতো বড় বড় সব পিপায়। একসময় গ্রামের লোকেরা আঙুর পচিয়ে বানাতো মদ। সেই মদ খেয়ে কি যে হুল্লোড় হতো।
আর আপেল?
সবুজ কচি ঘাসের জমিনে গোলাপি আপেল গাছ। বসন্তে এদিক-ওদিক ফুটে আছে টিউলিপ, চেরি। দূরে ম্যাপলের ঘন বন। সবুজ ঘাসে পড়ে থাকা আপেল কুড়াতাম আমরা। সবুজ, কালচে লাল, গোলাপি সব আপেল। শীতের মাঝামাঝি আমাদের গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীর জল জমে বরফ হয়ে যেত। সেই বরফের ওপর দিয়ে দৌড়াতাম আমরা। কেউ-কেউ বরফ খুঁড়তো। পাওয়া যেত নিচে হীমশীতল জল।
ওদের মধ্যে একজন মহিরুহের নিচে খোঁড়া গর্তটাকে ভরাট করে। হ্যাঁ বলো, তোমার সে সময়ের গল্প।
সে সময়ের গল্প! ঠিকই বলেছ। সময় অনেক পেরিয়ে গেছে। সময় হয়তো পেরিয়েই যায়।
ওরা মহীরূহ ছাড়িয়ে দৃষ্টি দেয়। মহিরুহের ছায়াটি ছাড়া চারদিকে খাঁ খাঁ প্রান্তর। সূর্যের রোদে যেন ধীরে ধীরে তীব্রতার আভাস। ওদের বিষণ্ন লাগে। ওরা অবসন্ন হয়। মাথার ওপর এই বিশাল মহীরূহ ছাড়া কিছু অবশিষ্ট নেই কোথাও। হঠাৎ একটা ডালে দেখা যায় প্রজাপতি।
এই প্রজাপতিটা দেখো।
হ্যাঁ, একটা রঙিন প্রজাপতি। ওটার পেছনে দৌড়েছো কোনোদিন? ঘাসের বনে রঙবেরঙের প্রজাপতির পেছনে পেছেনে?
এই মহিরুহের প্রজাপতিগুলো দিনদিন সব মরে যাচ্ছে তাই না?
হ্যাঁ, একদিন হয়তো এটাও মরে যাবে।
ওটা এক সময় শুয়োপোকা ছিল?
তাতে কি? ওটা এখন তো প্রজাপতি।
প্রজাপতিটা উড়াল দেয়। ওরাও ওটার পেছনে যাওয়ার চেষ্টা করে। প্রজাপতিটা ওদের নাগালের বাইরে চলে যায়।
তোমরা কি কখনো মথ থেকে রেশম সুতো বের করতে দেখেছ?
হ্যাঁ, আমি দেখেছি।
সেইযে শান্ত সুনিবিড় গ্রামটা, ওখানে চাষিরা মথ চাষ করত। সাদা মথ থেকে তৈরি হতো রেশম সুতো। রঙিন জলে ডুবিয়ে নিলেই সেই সুতাও রঙিন হয়ে যেত। ঠিক যেন রংধনুর মতো।
আমরা কতদিন রংধনু দেখি না, তাই না।
এখানে বাতাস শুষ্ক। বৃষ্টির যে টুকু কণা মাটিতে পড়ে, চুষে নেয় মাটি সব হাড়-হাভাতের মতো। ঝমঝমিয়ে তো আর বৃষ্টিও নামে না।
হ্যাঁ, কত দিন আমরা বৃষ্টিতেও ভিজি না। মহিরুহের দিকে তাকাও, ও কেমন জলের অভাবে বিবর্ণ হয়ে আসছে। অথচ ওর পাতাগুলো একদিন প্রায়ই ধুয়ে দিত জলের কণা। দুই পাতার মাঝে লুকিয়ে থাকা মাকড়সার ভেজা পাতার গন্ধ নিয়ে বুনে চলত নকশিকাঁথার জাল। ওর স্যাঁতস্যাঁতে ভেজা গায়ের গন্ধে উড়ে বেড়াত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পোকা।
বৃষ্টি! কতদিন সত্যিই বৃষ্টি নামে না। ঠিক যেন মরুভূমিতে নিঃসঙ্গ ক্যাকটাস আমরা। আনেক আগে আমাদের ঘর ছিল গরম বালির দেশে। পাথর সাজিয়ে সাজিয়ে হঠাৎ স্বপ্নের মতো পাওয়া মরুদ্যানে ঘর তুলেছিলাম আমরা। দিনে গনগনে উত্তপ্ত কড়াইয়ের মতো সূর্য আমাদের জাগিয়ে রাখত সর্বক্ষণ। কখনো বা ভয়ানক বালুঝড়ে চাপা পড়ত যেন পৃথিবী। ঝড় থেমে গেলে মোটা বালির কণা ঝিকিয়ে উঠত খেজুর গাছগুলোর মাথায়। তারপর নামত রাত। দিনের গনগনে হাওয়ার চিত্রপটে উঠত বিশাল চাঁদ। ধীরে ধীরে ঠাণ্ডা হতো পৃথিবী। আবার দেখা দিত অসংখ্য তারা। একটা আরবি ঘোড়া চেঁচিয়ে উঠত কখনো। উটের শব্দও পাওয়া যেত। যেন ঐশ্বর্যময় এক ঝলমলে বালির জগৎ। আবার সকাল হতো। মরুদ্যানের লোকেরা চলত তাদের উটের চামড়ায় বানানো জলের থলি নিয়ে দূর জলাশয়ে। তখন চারদিকে কেবল সূর্যের চিহ্ন আর বালিয়াড়ি।
এ কি তুমি কাঁদছ কেন?
জানো, আমরা আনেক সুখী ছিলাম। অনন্ত সূর্যের নিচে অনেক জীবন্ত ছিলাম সবাই।
ওরা আবার ঘনিষ্ট হয়ে আসে। ওদের মধ্যে একজন কাঁদছে। সবাই তাকে ঘিরে থাকে।
আমরা সবাই অনেক সুখী ছিলাম।
আমরা সবাই অনেক আনন্দে ছিলাম।
আমরা সবাই অনেক জীবন্ত ছিলাম।
আমাদের সেই গ্রাম, কালো কালো মানুষের মিলিত সমন্বয়ে, জঙ্গলের পশুতে পাখিতে গাছেতে মিশে একাকার ছিল আমাদের সুখগুলো।
আর সেই যে নদীর দেশ, ছোট, বড়, মাঝারি, জল থই থই নাম না জানা অসংখ্য নদীর দেশ। সুফলা ভূমি, সবুজ ফসল, লতাগুল্মের ঝোপ, নীলাকাশ, পর্বতের শুভ্র সাদা হাওয়া, আহ…
আমারও মনে পড়ে সেই সব দিন। চওড়া বিস্তৃত নদী। দুপাশে মাইলের পর মাইল ঘন বন। যেন পুরো পৃথিবীটাকে ঢেকে ফেলবে যেন সবুজের চাদরে। জলে কুমির, মাছ, গাছে পাখি, সাপ, পোকামাকড়। আর বন পেরিয়ে একটা পাথুরে পাহাড়ে আমাদের শহর। মাথায় পাখির রঙিন পালক গুঁজে রঙিন জীবনযাপন। রাতে দূর আকাশে নক্ষত্রের মাঝে রেখা টেনে টেনে পুরোহিতের ফুটিয়ে তোলা দেবদেবীর শরীর।
অথবা আমাদের সেই সবুজ ঘাসের দেশ। ঘন নীল সমুদ্রের মাঝে যেন একটা দ্বীপ। পাইনের বন ছাড়িয়ে, সবুজ ঘাসের পথ মাড়িয়ে দেখা যায় বরফের টুপি মাথায় পাহাড়ের নিচে মিমোসা ফুলের গাছ। ঝিরিঝিরি বাতাসে দুলছে পাতা। একটা কোকাবুড়া পাখি একবার এডালে একবার ওডালে নেচে বেড়াত। জানো গাছটার নিচে হলুদ হয়ে থাকত ঝরা ফুল পড়ে। মনে হতো যেন হলুদ চাদর বিছিয়ে দিয়েছে কেউ সবুজের আঙিনায়।
সাদা সেই বরফের রাজ্য মনে পড়ে? জলে ভেসে যাওয়া খণ্ড-খণ্ড বরফের মাঠ। অথবা শ্বেত ভালুকের সাদা গা থেকে ঝেড়ে ফেলা বরফ কুচি। আচ্ছা তোমরা কি কখনো বরফের মাঝে চাঁর আলো দেখেছ? আমি দেখেছি। যে ওই আলোর নিস্তব্ধতা দেখেনি, তাকে বোঝানো যাবে না।
ওরা সবাই আবার চুপ করে বসে থাকে। কেউ কেউ কারও দিকে তাকাতে থাকে। ওদের হঠাৎ নিস্তব্ধতা যেন মহিরুহের ভালো লাগে না। তার ডাল নড়ে, পাতার খসখস শব্দ হয়।
আমরা নিজেরাই হারিয়েছি আমাদের জগৎ তাই না?
হ্যাঁ আমরাই।
আমাদের বনগুলো আমরা কেটে ফেলেছি। মেরে ফেলেছি ওখানের পশুপাখিগুলোকে। ওগুলোর কাঠ আমাদের তাপ দিয়েছে ঠিকই, জীবন ফিরিয়ে দিতে পারিনি। ওগুলোর কাঠ আমাদের আরাম আয়েশ বাড়িয়েছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে কেড়ে নিয়েছিল নিঃশ্বাস। আমাদের দরকার ছিল জমির। আমরা বন ধ্বংস করে গড়ে তুলেছি বসতি। আর ওই পশুপাখিগুলো, ওদের কেউ কেউ হয়েছে আমাদের খাদ্য অথবা কারও চামড়া হয়েছে আমাদের পোশাক। ওদের ধবধবে সাদা দাঁত কিংবা হাঁড় অলংকার হয়ে বাড়িয়েছে আমাদের সৌন্দর্য। আমরা কখনও খেলার আনন্দেই মেরেছি ওদের।
আমাদের জলগুলো আমরা করেছি দূষিত। নদীগুলো মরে গিয়েছিল ধীরে-ধীরে। আমরা ভূমির বক্ষ থেকে টেনে তুলেছি তার সন্তানদের। আহ, তবে কি তাই এই অভিশাপ!
এই যে দেখো, আমাদের ভিজিয়ে দিতে এখন আর বৃষ্টি আসে না। মন জুড়ায় না সবুজ ঘাসের ফড়িং। সূর্যের আলো এখন আমাদের কেবলই পুড়িয়ে চলে। এ যেন এক শেষ দহনের অপেক্ষা।
চাঁদের আলো এখন আর মায়াময় নেই। এই মহিরুহের বাইরে যতদূর চোখ যায় এখন কেবলই ক্লান্তিময় শূন্যতা। জোছনা এখন শুধু বিভ্রম বাড়ায়, ভালোবাসা নয়।
আমরা আধুনিকতার নামে প্রযুক্তির আশীর্বাদে চেয়েছিলাম বশ করতে প্রকৃতি। আমরা হয়ে পড়েছিলাম ঐতিহ্যবিমুখ। আমাদের মনের অসীম আকাশ হয়ে গেছে সসীম। আমরা এখন একা, এই বিশ্বের একদম একা কয়েকটি প্রাণ।
শোনো শোনো ও যেন কী বলছে ফিসফিসিয়ে। ওরা নিজেদের মধ্যে ঘন হয়ে আসে। সবাই কান পাতে মহিরুহের কাণ্ডে। কই কিছু বলছে না তো!
বলছে, ভালো করে শোনো। ও বলছে আবার সব শুরু হবে। একেবারে সবকিছু নতুন করে। ও বলছে, যে মধুতে জন্ম তোমাদের অমৃতের সন্তানেরা, সেসব যেন ফিরে পাও আবার। হারতে হারতে যেমন কখনো জিতে যাওয়া যায়। ডুবতে ডুবতে যেমন হঠাৎ খুঁজে পাওয়া যায় অবলম্বন।
কিন্তু সত্যিই কি নতুন করে গড়া সম্ভব সব! যা হারিয়েছি আমরা আমাদেরই ভুলে, তাতো আর ফিরে পাওয়ার নয়। আমরা এখন অপেক্ষা করছি মহিরুহের সমাপ্তির। একে একে ওর কাণ্ডগুলো মরে যাচ্ছে। পাতা ঝরে বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে সবুজ। হয়তো এই বিশাল বিস্তৃতির কোথাও শেষ ফুলটি ফোটার অপেক্ষায় আছে এখন। শেষ মধু নিতে বেঁচে আছে শেষ মৌমাছিটি। শেষ পাখিটি বাসা বুনছে শেষ প্রত্যাশায়। পিঁপড়াটি মুখে নিয়ে চলেছে শেষ ভরসার ডিম। আহ, দুনিয়ার শেষ হতাশার দিনগুলো কি তবে এমনই নিরস!
এই মহীরূহ আবার তার গর্ভে ধারণ করবে বীজ। ডালে ডালে আবার ফুটবে ফুল। মৌমাছি রেনু বয়ে নিয়ে যাবে এক ফুল থেকে অন্য ফুলে। মাটিতে আবার লুকাবে সে। একদিন আবার সে হয়ে উঠবে মহীরূহ।
না এভাবে বলো না। একদিন সব শেষ হয়ে যাবে জানি। শেষ হওয়াই হয়তো প্রাণের নিয়তি। তবু এমন ধুঁকতে ধুঁকতে এই মহিরুহের মরে যাওয়া আমরা মেনে নিতে পারি না।
ঠিকই বলেছ। এই যে সৃষ্টি জগতে সকল প্রাণীকে ছাড়িয়ে মানবের উত্থান কেন হয়েছিল জানো? কারণ মানুষ আশাবাদী প্রাণী। সেই প্রাচীন যুগে বানর সাদৃশ বৃক্ষচারী মানব হিংস্র পশু ঝড় বৃষ্টি থেকে বাঁচার আশায় আশ্রয় নিয়েছিল পাহাড়ের গুহায়। উত্তাপের আশায় জ্বালিয়ে ছিল প্রথম আগুন। নিজের ছায়া পুনঃপ্রতিষ্ঠায় নারীর ভেতর ভবিষ্যত বুনে দিয়েছিল নর। নিজের সীমানা ছাড়িয়ে আরও শক্তির আশায় সে দখলে নিয়েছিল অন্যেরে। একে একে গড়ে উঠেছিল আশাবাদী সভ্যতার ইট ইমারত। আর সেই সভ্যতার থেকে আরও আশাবাদী হয়ে শুরু হয়েছিল নগর বন্দর।
হ্যাঁ, আমরা এখনো আশাবাদী, এই ধ্বংসের শেষ সীমানায় দাঁড়িয়েও। আমরা এই মহীরূহকে মরতে দিতে পারি না। এর একটি ফুল ফল, ডালে বাসা বাঁধা পাখি, কোটরের পোকা, প্রজাপতি, পিঁপড়া আর কেউই মরে যাবে না অকারণে। নতুন দুনিয়া শুধু আমাদেরই নয় ওদেরও হবে।
এই মহীরূহ আবার তার গর্ভে ধারণ করবে বীজ। ডালে ডালে আবার ফুটবে ফুল। মৌমাছি রেনু বয়ে নিয়ে যাবে এক ফুল থেকে অন্য ফুলে। মাটিতে আবার লুকাবে সে। একদিন আবার সে হয়ে উঠবে মহীরূহ।
আবার বৃষ্টি নামুক। নদীগুলো ভরে উঠুক থই থই জলে। বিবর্ণ মাঠ আবার বরে উঠুক সবুজ ঘাসে। চাঁদ আবার সৃষ্টি করবে মায়াবি আলো। সুর্যের আলো আবার হীরার মতো ঝকমক করবে বরফ শুভ্র পর্বতের চুড়ায়। পিঁপড়েগুলো আবার মুখে নিয়ে ছুটুক ডিম। আটপেয়ে মাকড়সাটা আবার বুনে চলুক জাল। আবার জমে উঠুক উৎসব।