চার-পায়ের সঙ্গে অতিরিক্ত দু’পা যোগ হয়ে চেয়ারটি শূন্যে দোল খায়—একবার সম্মুখে একবার পশ্চাতে; মাঝে-মাঝে থামে, তারপর আগের মতোই দোল খায়। স্বয়ং পৃথিবীও যেন দুলে ওঠে! মেম্বারের কপাল বেয়ে নোনাজল চুঁয়ে পড়ে। সিদ্ধান্তহীনতায় আনমনে মাথা ঝাঁকায়, বুকের অতলান্ত হতে ক্ষণে-ক্ষণে দীর্ঘশ্বাস উগরিয়ে আসে। সঙ্গী-সাথীদের পানে তাকিয়েও কোন লাভ নেই; নির্বিকার চিত্তে অন্ধকার আকাশের নামহীন নক্ষত্রের পানে ওরা তাকিয়ে। উপস্থিত জনতার সবগুলো চোখ নিরীক্ষণ শেষে কলিম শেখ উচ্চস্বরে কেঁদে ওঠে, হেই মোর আল্লা, মোগো অহন কি হইবো রে! কাম না পাইলি খামু কি, যাব কই!
সাধারন শালিস হলে কথা ছিল না, খেদালী মেম্বার চোখ বন্ধ করে রায় দিয়ে দিতো; কেননা, ভুল হোক বা না হোক তার মুখের ওপর মুখ রেখে কেউ মুখ নড়ানোর সাহস দেখায় না। কিন্তু সাম্প্রতিকচিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। বাতাসের বুকে কান পাতলেই কান কথার ওড়াউড়ি! নানামুখী সম্ভাবনার ইঙ্গিত; ওইসব ইঙ্গিতের প্রান্তভাগেই মেম্বারের যত সংশয়!
অঘটন ঘটলে দায় এড়াবার পথ কোথায়! এছাড়া নিকট-অতীতে এমন দৃশ্যের অবতারণা তো আর কম হয়নি! কমবেশি সবাই জানে—
যাত্রীর বেশে বাস-ডাকাতি!
পুলিশের পোশাকে ডাকাতের বাহাদুরি!
দর্শক হয়ে সিনেমা হলে বোমা হামলা!
পুরোহিত হয়ে মন্দিরে নাশকতা!
ফকিরের দলবদ্ধ হামলায় বিশিষ্ট ব্যবসায়ী খুন!
বইয়ের পরিবর্তে ছাত্রদের ব্যাগে গান-পাউডার!
এতসব ঘটনার পরে কে কাকে বিশ্বাস করবে; নাহ, কাউকে বিশ্বাস নেই! অবিশ্বাসী চোখগুলো পুনঃপুনঃ নিরীক্ষণ শেষে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে কেউ কেউ, ধুর, শালা শয়তান; এক্ষুনি ওগের গিরাম তিকি তাড়ি বের করা দরকার।
হ,হ ঠিকই কোয়ুচ, আচ্চা মতো সান্টিং (মারধর) দি শালারা যে পতে আয়ি ও পতেই দি পেটাউ।
সমবেত জনতার গলার স্বর আরো খানিকটা উঁচু হলে মেম্বার বিরক্ত হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সচেষ্ট হয়, তুমরা সপ চুপ করোদিনি, আজুড়ি কতা বুলু না; কি কত্তি হয় না হয় আমিই দেকচি, তুমাগের আর মাতা ঘামাতি হবে নান।
মেম্বারের কথা শেষ হতে না হতে জোনাব মণ্ডল বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। ঝাঁঝ মেশানো কণ্ঠে হাত উঁচু করে জানান দেয়, ওগো ভাইসগল এডি ফেদাপাচালি (অকারন কথা বলা) করার জাগা না, কত্তি হয় অন্য জাগায় যায়ি করোগা।
কথা শেষ করে বসতে গিয়ে লোকটি পুনরায় বিড়বিড় করে বলে, আমরার জ্বালায় আমরা বাঁচচিনি আর উনাগের মুরকি-নগড়ি কতা, আরে বাপু এতই পারিস তে ঠেলা সামাল দে!
গুঞ্জন থামিয়ে মানুষগুলো এবার গজার মাঝের মতো ঝিম মেরে যায়। অশুভ আশঙ্কায় শঙ্কিত ওরা। আলো-আঁধারীর মাঝে একে অন্যের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে। কণ্ঠের সারল্য ধরে রাখতে কেউ-কেউ ঢোক গেলে, জিহবা দিয়ে ঠোঁটের শুষ্কতা দূর করে। অনাহূত এই ঝামেলায় কমবেশি সবাই বিচলিত। মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগ যেন বা!
দুর্যোগের দুর্ভোগ থেকে রক্ষা পেতে যে যার মতো ভাবিত। কারও-কারও মুখে পুলিশের কথা উচ্চারিত হয়। বিষয়টি মেম্বারের মাথায়ও এসেছে। কিন্তু পুলিশ বিষয়ে মনের মধ্যে দ্বিধা সংকোচ অনুভূত হয়। ভুবনডাঙার মাটিতে সর্বশেষ কে কবে পুলিশ দেখেছে!
অল্পবয়সী ছেলেরা স্মৃতি হাতড়িয়ে মনে করতে পারে না। নিজেদের ঝগড়াবিবাদ নিজেরাই মিটিয়েছে; একবার না হলে বার বার বসেছে, তবু থানা-পুলিশ পর্যন্ত যায়নি। শুধু ভুবনডাঙা না, কিছুকাল আগ পর্যন্ত এটা ছিল আমাদের গ্রামীণ ঐতিহ্য। সাধারণ জীবনযাপনে পুলিশের উপস্থিতি ছিল বিষধর সাপের মতোই উপেক্ষিত!
পরিবর্তন।
আহা, কি নিষ্ঠুর পরিবর্তন!
বিপন্ন মানবতা।
পারিবারিক কাঠামো ভেঙে টুকরো! ঘিঞ্জি বস্তিতে দখল হয়ে যাচ্ছে আবাদি জমিগুলো! চোর-পুলিশের সঙ্গে আমাদের সহাবস্থান! আঁধারের ঘেরাটোপে সাপলুডু খেলি!
আকবার মণ্ডলের স্মৃতিতে পুলিশের উপস্থিতি ঝাপসাপ্রায়। চৈতন্যের অলিগলি হাতড়ে ওই দৃশ্য যেন নতুন করে প্রাণ পায়। বেচারা খানিকটা নড়েচড়ে বসে। অনেকদিন; অনেকদিন আগে ভুবনডাঙার মাটিতে সর্বশেষ পুলিশ এসেছিল। দিন নয় তখন রাত ছিল; মাঘের হাঁড়কাপানো শীতরাত্রি। তাদের বাঁজানো বাঁশির চিৎকারে রাতের মগ্নতা ভেঙে খান-খান হয়ে গিয়েছিল। অসহায় চাষীদের চোখের আলোয় আঁধারের ঘনত্ব যেন খানিকটা ফিকে হয়ে এসেছিল! পাতাড়ির গাদায় লুকিয়ে মণ্ডল স্পষ্টই দেখতে পেয়েছিল—লাঠি হাতে পুলিশগুলোর সে কি রুদ্রমূর্তি! আখ মাড়ায়ের কল জব্দ করতে এসে সামনে যাকে পাচ্ছিল তাকেই বেধড়ক পেটাচ্ছিল। আহা, সে কি পেটানি! অসহায় মানুষগুলোকে দড়ি দিয়ে বেঁধে পেটাচ্ছিল। ওদের আক্রমণ থেকে অবলা গরুগুলোও সেদিন রেহাই পায়নি!
চাষীদের অপরাধ খুব সামান্যই; আখ থেকে গুড় উৎপাদনে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও তারা তা মানেননি। কিংবা কুষ্টিয়া চিনিকল অনেক দূরে হওয়ায় তারা নিরুপায় ছিলেন। পুলিশের ভূমিকায় সেদিন গ্রামময় ভীত-সন্ত্রস্ত হলেও শেষ মুহূর্তের আয়োজনে আকবার মণ্ডল নিজ চোখের কাছে লজ্জিত হয়েছিল। আসামির পরিবর্তে গুড়, পাটালি আর নগত টাকা বকশিস নেওয়ার দৃশ্য আজীবন তাকে লজ্জায় ডোবাবে!
পুলিশের প্রতি ঘৃণা জন্ম দেবে।
সত্য-মিথ্যার দ্বন্দ্ব অনিবার্য হয়ে উঠবে।
বিচার ব্যবস্থা প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
পাকবাহিনীর বুটের মচমচানি কানে বাজবে।
বুক চাপড়িয়ে কলিম শেখ পুনরায় কান্নার আবহ সৃষ্টি করে; স্থানীয় জনতার অনুকম্পা প্রার্থনা করে, ও মোর আল্লা, তুমি আমাগোরে রক্ষা করো, বিপদ-আপদ থিইক্যা রক্ষা করো। এই রাইতে যামু কই, খামু কী!
কলিম শেখের সঙ্গী-সাথীরাও তার স্বরে স্বর মিলিয়ে হাঁ-পিত্যেশ করে। এই হাঁ-পিত্যেশ অবশ্য খেদালী মেম্বারের কাছে অর্থহীন। সে বোঝে, লোকগুলোর এসব চালাকি, মানুষের চোখে ধুলো দিতে নানামুখী ফন্দিফিকির!
পর্দার আড়াল থেকে মাঝে-মধ্যে চাপা দীর্ঘশ্বাস ভেসে আসে। বুঝতে অসুবিধা হয় না, গ্রামের বৌ-ঝিরাও একত্রিত হয়েছে। তাদের কারও-কারও হৃদয়ে হয়তো মমতার জলীয়বাষ্প। কিন্তু সামাজিক বিধির কারণে ওই বাষ্প মণ্ডলের খোলাট পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে না; নিজ হৃদয়েই কুণ্ডুলী পাকায়।
একেই বলে বাঙালি নারী!
চেনা নেই, জানা নেই অথচ অসহায় মানুষগুলোর জন্য পাড়ভাঙা দহন অনুভব করে! হাঁটুর পরে ভর দিয়ে আর কতক্ষণ, শীতল পাটি বিঝিয়ে দিতে ইচ্ছে করে।
আহা, দিনুমান মনে হয় না খায়ি আচে, একডালা মুড়ি-মুড়কি দিলি চাবাতি পাত্তু।
দাঁতে দাঁত চেপে গনেশ হালদার এতক্ষণ চুপচাপ ছিল। বহিরাগত মানুষগুলোকে নিয়ে তার অসীম কৌতূহল। কৌতূহল নিবৃত্তি করতে মেম্বারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে সে।
বুজলি গো মেম্বার, বয়স তো আর কম হলু না, এরাম ঘটনা কেন্তক বাপের জম্মেউ দেকি ন!
গনেশ হালদার না দেখলে না দেখতে পারে, তবে সমকালীন প্রক্ষাপটে এমন ঘটনা হরহামেশাই ঘটছে! কাজের সন্ধানে এক এলাকার মানুষ অন্য এলাকায় যেতেই পারে! তাছাড়া জমি-জিরাত বিক্রি করে আমরা যে ভিনদেশে পাড়ি জমাচ্ছি সেও তো কাজের জন্যই; দু’পয়সা উপার্জনের জন্যই! বস্তুত সময়টাই খারাপ। তা না হলে মানুষে মানুষে এত ভেদাভেদ থাকবে কেন! কিংবা জঙ্গিবাদ ও শ্রমজীবীদের মধ্যকার বিভেদের দেয়াল ধসে যাবে কেন! জঙ্গি সন্দেহে স্বদেশে যারা অচ্ছূত, পরদেশে তারা ছুঁত হয় কিভাবে!
সমাধানসূত্র খুঁজে পেতে মেম্বার শেষপর্যন্ত হালদারের শরণাপন্ন হয়—একুন তালি কী করব কাকা, ওগেরে পুলিশির কাচ পাটাবো না কি?
হালদার নিজেও দ্বিধাগ্রস্ত; সিদ্ধান্তের ভারটা মেম্বারের কাঁধেই চাপায়, আমি ইর কী জানি বাপ; মুক্কুসুক্কু মানুষ, পেটে কিল মাল্লিউ ব বেরায় না। তার চায়ু তুমি যা ভালো বোজো তাই করো; তুমার কতাই তো আমাগের কতা!
সহানুভূতির দৃষ্টিতে হালদার জিজ্ঞেস করে, ওগো বাপ, তুমাগের দ্যাশ কনে; কনতি আয়ুছু?
নালমনিরহাট।
লালমনিরহাট নাম শুনে চোখ জোড়া কপালে ওঠার উপক্রম! বিশ্ময়-ভরা চোখে হালদার পুনরায় জিজ্ঞেস করে, কউ কী, তুমাগের বাড়ি নালমনিরহাট! সে কি যাহাইতাই দূর; মগের মুল্লুক!
হয় গো ভাইয়ে নালমনিরহাট; মোগো দ্যাশ নালমনিরহাট।
অবিশ্বাসের মাত্রা পুনরায় বিস্তৃত হয়। কোথায় কুষ্টিয়া আর কোথায় রালমনিরহাট! বরং জঙ্গি ভাবতেই সহজ মনে হয়। তাদের উদ্দেশ্য-বিধেয় নিয়ে চলে চুলচেরা বিশ্লেষণ। নানাজনের নানামত—
আমি আগেই বুলছালাম শালাগের মতলব ভালো না।
দেরি করা ঠিক হবে না, একুনি ওগের পুলিশি দিউয়া দরকার।
এক কাজ করো ভাই, মাদারের ডাল দি সুমুন্দিগের আগে ধুনি নেউ।
ডাগা-ডাগা চোক দোকিই বুজা যাচ্ছে, শালারা ডাকাইত।
আরে না না ডাকাইত হবে কেনে, শালারা জঙ্গি! দেকচু না শালারা কেরাম কুলুপ আটি রয়ি!
সুযোগ পেয়ে কলিম শেখ মুখ খোলে; হাত জোড় করে অনুনয়-বিনয় করে, জঙ্গি কইয়ো না গো ভাইয়ে, মোরা হলাম গিয়া কামলা; দ্যাশে দ্যাশে কাম করি ভাত খাই।
ক্যা, তুমাগের দ্যাশে কি কামকাজ নি?
কলিম আক্ষেপ করে বলে, না গো ভাইয়ে কুনু কাম নি। তুমাগের দ্যাশ সুনার দ্যাশ। চাদ্দিক খালি ফসল আর ফসল। চান্দের নাহাল ক্ষেত-খামার। আহা, দেইখ্যা বুকির মদ্দি উথালি-পাথালি করে।
কামলাদের অন্য আরেকজন বলে, মোগো হইলো মরুর দ্যাশ। খালি মঙ্গা আর মঙ্গা। পেটে ভাত নাই, পিন্দনের কাপড় নাই; ক্ষিদার জ্বালা সয্য হয় না ভাইয়ে; বমির লগে রক্ত উডে, বাচ্চা ছাওলের কান্দন সয্য করবার পারি না।
আগত মানুষগুলোর দুর্ভাগ্য কারও কারও অন্তরে রেখাপাত করে। নিজ-নিজ ভাগ্যকে কেউ কেউ আবার মিলিয়ে নেয়। বিশেষত বয়সী মানুষগুলো ৭৪’র দিনগুলোতে ফিরে যায় ফিরে আসে। বেঁচে থাকার ন্যূনতম চাহিদা পূরণ হওয়ার উপায় ছিল না তখন!
দুর্ভিক্ষের লকলকে জিহ্বা।
তটিনীর বুকে রৌদ্র-কুয়াশা।
ফসলহীন বিস্তির্ন প্রান্তর।
ক্ষুধার জ্বালা সইতে না পেরে চেনা-জানা কত মানুষ আত্মহত্যা করেছে। কেউ-কেউ দেশান্তরী হয়ে আর ফিরে আসেনি। লজ্জা নিবারণের ভয়ে মেয়ে মানুষগুলো চার দেওয়ালের মাঝে নিজেকে আড়াল করে রাখতো; পুরুষ মানুষগুলোর ফিরে আসার জন্য অপেক্ষা করতো; ভবতো- চাল-ডাল, তরি-তরকারি, জামা-কাপড় নিয়ে কেউ একজন উঠোনে দাঁড়িয়ে হাঁক ছাড়বে, অথচ বাস্তবে তা হয়নি। কাজের সন্ধানে ঘুরে-ঘুরে শূন্যে-হাতে বাড়ি ফিরেছে। নিরুপায় হয়ে গাছের শাক-পাতা সিদ্ধ করে খেয়ে জীবন বাঁচিয়েছে।
কামলাদের মুখের পানে তাকিয়ে কারও কারও চোখে জলের ধারা বয়ে যায়; নিজের মধ্যে বিশেষ এক ধরনের তাড়না অনুভব করে। সংশয়ের শেষ চিহ্ন মুছে ফেলতে বিনয়ের সঙ্গে গোলাপ মণ্ডল জিজ্ঞেস করে, আইচ্চা, এই গিরামে তুমাগের কিডা পত দেকি নি আয়িচে?
মানুষগুলো তথাপি নিরুত্তর। অপরাধীর মতো ঘাড় নিচু করে বসে থাকে, হাতের নখ খোটায়, অকারণে মাথা চুলকায়, এক মুহূর্তের জন্য কারও চোখের পানে তাকিয়ে দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে নেয়। অল্পবয়সী ছেলেটিকে মেম্বার হাতের ইশারায় উঠে দাঁড়ানোর নির্দেশ দেয়।
ছেলেটি উঠে দাঁড়ায় কিন্তু তার নুয়েপড়া ঘাড় আরও বেশি নুয়ে পড়ে।
তুমার নাম কী গো বাপু?
ধরা গলায় ছেলেটি জানায়, অনিমেষ; জ্বে, মোর নাম অনিমেষ।
গনেশ হালদারের চোখে এবার আগুনের প্রজ্বলিত শিখা! ধর্ম নিয়েও তাহলে মিথ্যাচার! ধমকের স্বরে সে বলে, ওই ছেলি, মশকরা করো, তাই না?
জ্বে, মানে…
মোছলমানের ছেলির নাম কি অনিমেষ হয়!
অনিমেষ আত্মপক্ষ সমর্থন করে, মুই মোছলমান না, হিন্দুর জাত; বাপ-দাদা খাঁটি বিরাম্মন আছিল।
কতিপয় মানুষের আপত্তি সত্ত্বেও ছেলেটিকে তার বাজিয়ে দেখার সাধ জাগে। কিংবা নিজের মধ্যে বিশেষ কোনো কৌতূহল অনুভব করে। মনে মনে ভাবে, ছেলেটি যদি সত্যি-সত্যি হিন্দু হয়, তাহলে মন্দ হবে না; ধর্মীয় বিষয়ে একান্তে আলোচনা করা যাবে। এই ভুবনডাঙায় একদা অসংখ্য হিন্দু পরিবারের ঘরবসতি ছিল; বেশকিছু উপাসনালয়ও ছিল। ধর্মীয় সম্প্রীতি বজায় রেখে যে যার মতো ধর্মাচার পালন করতো, একে-অন্যের বিপদে বুক আগলে দাঁড়াত। অথচ কালের অভিঘাতে সব বাঁধন আলগা হয়ে গেল! ৪৭’র পর হিন্দু পরিবারগুলো দল বেঁধে ইন্ডিয়ায় পাড়ি জমালো। পোড়ো-ভিটার ওপর যে ক’ঘর অবশিষ্ট ছিল ৭১’র পর তারাও ধৈর্য হারিয়ে ফেললো। নিজেদের ভিটে-মাটি নিজোদের কাছে অপাঙ্ক্তেয় মনে হলো। বরং রাতের অন্ধকারে ওপারে পাড়ি জমানোয় নিয়তি বলে মনে করলো। এখন হিন্দু বলতে একমাত্র ওই হালদার পরিবার। কালের সাক্ষী হয়ে কতগুলো পোড়োবাড়ি মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে।
অনিমেষকে উদ্দেশ করে গনেশ জিজ্ঞেস করে, এই মিয়া মন্দিরে ঢোকনের পার্থনা জানো?
ঘাড় কাত করে অনিমেষ সায় দেয়, জ্বে, জানি কাহা।
তালি পইড়ি শুনাউ দেকি!
প্রথমে আস্তে তারপর ভক্তিভরে অনিমেষ প্রার্থনা আওড়ায়, ক্রীটিনঙ গদিনঙ চক্রহস্ত মিচ্ছামী ত্বাঙ দ্রষ্টমহৎ তথৈব রুপেম চর্তুভাজন সহস্রাবাহ ভব বিশ্বমুহূর্ত।
অনিমেষের মন্ত্রপাঠে গনেশ বা অন্যান্যরা খুশি হলেও খেদালী মেম্বার ওই খুশিতে শামিল হতে পারে না। উপরন্তু মনটা বিস্বাদে ভরে ওঠে। বিশেষ কিছু স্মৃতি বিবেকের দরজায় কুঠারাঘাত করে। হাতুড়ি পেটার ওই শব্দ স্পষ্টই তার কানে যেন তরঙ্গায়িত হয়! হিন্দুত্ব প্রমাণের জন্য যুদ্ধের সময় লুঙ্গি খুলে দেখাতে হতো! হায় বড়ই দুর্দিন; প্রাণভয়ে মুসলমান পরিচয় দিয়েও রক্ষা ছিল না, সুরা-কেরাত বয়ান করে শোনাতে হতো। পরীক্ষায় ফেল করলে মৃত্যু অনিবার্য, ঠাণ্ডা মাথায় জীবনের ওপারে পাঠিয়ে দিত। এখানেই শেষ না; একদল হায়েনা লাশের ওপর দাঁড়িয়ে পরম উল্লাসে বুক চাপড়াতো। ছিঃ ওরা কি মানুষ; ওদের শরীরের রক্ত শীতল না উঞ্চ! এত বছর পরেও অনিমেষ ও অনিমেষদের পরিণতি যেন অভিন্ন!
হায়, এপারের হিন্দু আর ওপারের মুসলমানগুলো কি খণ্ডিত কপাল নিয়ে জন্মেছিল!
রাতের নীরবতা ভেঙে, অন্ধকার আলোড়িত করে কয়েকটা মোটরযান দৃশ্যপটে হাজির হয়। চলমান ঘটনায় যোগ হয় নতুন মাত্রা। ওরা কারা, পুলিশ নয়তো! কারও-কারও মতে তাদের ভাবনা অমূলক ছিল না। লোকগুলো সম্ভবত জঙ্গিদের পশ্চাৎবর্তী দল! মেম্বারের মুখে রা নেই। আলোর তীব্রতা থেকে রক্ষা পেতে বাম হাতটা চোখের সম্মুখে মেলে ধরে। লাল রঙের বিশেষ গাড়িটি আরও কয়েকপা এগিয়ে মেম্বারের পায়ের কাছাকাছি ভটভট আওয়াজ তুলে থেমে যায়। আড়চোখে কেউ-কেউ পানে তাকায়। তাদের চোখে-মুখেও সীমাহীন উৎকণ্ঠা।
হেলমেট খুলতে খুলতে কেউ একজন মেম্বারকে উদ্দেশ করে বলে, কী খবর খেদালী ভাই, কেমন আছেন?
মেম্বারের বুকের ওপর থেকে যেন জগদ্দল পাথর অপসারিত হয়! লোকটিকে চিনতে তার বেগ পেতে হয় না- মাবুদ, কমরেড মাবুদ আলী; শ্রমজীবী মুক্তি আন্দোলনের নেতা সে। এলাকার লোকজন তাকে বড়ভাই হিসেবেই জানে এবং মানে। মেম্বার নিজেও একবার তদবিরের জন্য তার শরণাপন্ন হয়েছিল। বংশীয় ঘরের ছেলে। উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত। চেষ্টা করলে অনেক বড়-বড় চাকরি পেতে পারতো; বিলাসিতার স্রোতে গা ভাসিয়ে জীবন ও যৌবন উপভোগ করতে পারতো। কিন্তু এসব তার ভালো লাগেনি; স্রোতের বিপরীতে নাও ভাসিয়েছে, অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে; সর্বহারা মানুষের মাঝে সুখ খুঁজেছে।
কমরেড মাবুদ কি সত্যি-সত্যি সুখি হয়েছে!
প্রশ্নটা আপেক্ষিক। কেননা, জেল-হাজতের মধ্যেও কেউ-কেউ হয়তো সুখের হাট বসাতে পারে! একবার না, মানুষটি অসংখ্যবার লালঘরের ছোঁয়া পেয়েছে। তথাপি ক্রসফায়ারের উর্বর সময়ে মাবুদ যেবার মেজর মঙ-এর হাতে ধরা পড়েছিল; তাকে বহনকারী গাড়িটি বুনো মহিষের গতিতে কাঁটাখাল অভিমুখে রওনা দিয়েছিল। সবাই ধারণা করেছিল এ যাত্রায় বুঝি আর রক্ষা হলো না; বিচার বর্হিভূত হত্যাকাণ্ডের তালিকায় আরও একটি নাম যুক্ত হবে। অথচ সব আশঙ্কা মিথ্যে প্রমাণ করে কমরেড মাবুদ সাধারণ মানুষের মাঝে ফিরে এসেছিল। সন্তু লারমার একটিমাত্র মোবাইল কলে সব হিসাব বদলে গিয়েছিল।
মাবুদ আলীর তদবিরে কামলাগুলোর শেষপর্যন্ত হিল্লে হয়। ঘনীভূত মেঘ কেটে গিয়ে মুখে সূর্যের হাসি ফোটে। খেদালী মেম্বার নিজেই তাদের দেখভাল করবে। কমরেড নিজেও মাঝে-মধ্যে খোঁজ-খবর নেবে।
শ্রদ্ধায় কলিম শেখের মাথা নুয়ে পড়ে। পা ছুঁয়ে সালাম করে বলে, ভাইয়ে, আপনে মানুষ না ফেরেশতা; মোগো লাইগ্যা এতকিছু কইল্লেন!
অভিভূত হওয়াটাই স্বাভাবিক। অন্য কোনো অবিবেচক হলে মানুষগুলোকে এতক্ষণে পুলিশের খাঁচায় বন্দি করে নকশা দেখতো। জঙ্গি না হলেও বুকে-পিঠে জঙ্গি তকমাটি স্থায়ীভাবে লটকে যেত। মাবুদ আলীর মধ্যে অহঙ্কারের লেশমাত্র নেই। সহানুভূতির দৃষ্টিতে কামলাগুলোর পানে তাকিয়ে রয়। পিঠ চাপড়ে সান্ত্বনার কথা শোনায়, এমন কী আর করলামরে ভাই! আমিও তোমাদের একজন; ঘর-সংসার কিচ্ছু নাই, রাস্তার মানুষ!
দঃখের অথৈই সাগরে যাদের ঘরবসতি; সুখ যাদের এলার্জি, তারাই কেবল পারে নিজের মধ্যে অন্যের দুঃখ লালন করতে! কামলাগুলোর অদৃষ্টের কথা ভেবে আমরা দুঃখ পাই, দুঃখ করিও। ফারাক্কার ভয়াল থাবায় আক্রান্ত না হলে মানুষগুলোর জীবনচিত্র অন্যরকম হতে পারতো। স্বপ্ন হারিয়ে উত্তরাঞ্চলের মানুষগুলো ইদানিং ঘোরের আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। শুধু উত্তরাঞ্চল কেন, সমগ্র দেশটাই যে মরুকরণের পথে! নদীমাতৃক বাংলাদেশের নদীগুলো যেন ঋতুস্রাব বন্ধ হাওয়া কোনো নারী!
নদী বিষয়ে কমরেড মাবুদ আলী বহুকৌনিক দৃষ্টিতে চিন্তা করেছে; মনে হয়েছে নতজানু পররাষ্ট্রনীতির কারণেই আজকের এই দুর্দশা।
কমরেড মাবুদ যাদের সমাদর করে, তাদের অনাদর করবে কে; নাহ, এ দিগরে ওই হিম্মত কারও নেই! ভুবনডাঙার ঘরে-বাইরে কামলাগুলোর অবাধ বিচরণ। গৃহস্থদের পক্ষে খাতির-যত্নেরও অভাব নেই। পুরাতন স্কুল বিল্ডিং আবাসনের জন্য নির্ধারণ হয়। খানিক দূরেই গনেশ হালদারের পোড়োবাড়ি। আশেপাশে আরও কিছু পরিত্যক্ত বাড়ি রয়েছে—বন-জঙ্গলে পরিপূর্ণ, কার্নিশে বট-পাকুড়ের চারা।
কাজ নিয়ে যেটুকু সংশয় ছিল দু’দিনেই তা উবে যায়। কামলাগুলোর হাতে যেন শিল্পের ছোঁয়া! কোথাও কোনো অনিয়ম নেই; কাজ দেখে পথচলতি মানুষ থমকে দাঁড়ায়। আহা কি চমৎকার কাজ! কোথাও কোনো ব্যাঁকাতেড়া নেই; আখক্ষেতের নগ্ন শরীরে যেন পাতার জড়োয়া! হাতে সময় থাকলে পথচলতি মানুষের সাথে দু-দণ্ড কথোপকথনও হয়, ও ভাই, বাপের জম্মে এরাম মানান করি তো কুসুর (আখ) জড়াতি তো দোকিনি,এরাম কাজ তুমরা কেরাম করি শিকলি!
খুশিতে কলিম শেখের বুকটা যেন ফুলে ওঠে! কপালের কুচকানো চামড়া খানিকটা ঢিলা হয়ে আসে। ওপরের দিকে আঙুল তুলে জানায়, ওই ওপরআলার দান গো ভাইয়ে; তিনি না থাকলি এই অধমের কোনো গতি নি।
সারিবদ্ধ বোরো ক্ষেতের পাশে দাঁড়ালে বুকের মধ্যে তিরতির করে বাতাস বইতে শুরু করে। নুয়েপড়া ধানফলের মধ্যেও রয়েছে সৃষ্টিকর্তার অপার মহিমা। কামলাগুলোর ফুরসত নেই, সারাক্ষণ কাজ আর কাজ। দুর-দুরান্ত থেকে কাজের অর্ডার আসে, কিন্তু কলিম শেখ পারতপক্ষে কাউকে বিমুখ করে না; প্রয়োজনে সময় প্রার্থনা করে।
আগত মানুষগুলো ধর্মভীরু। কাজের অবসরে কিংবা গভির রাতঅব্দি নামাজ-কালাম আদায় করে; খোদার দরবারে দু’হাত তুলে মোনাজাত করে; পরিবার-পরিজনের মঙ্গল কামনায় ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কাঁদে, সমস্বরে জিকির-আজকার করে। পাঁচ ওয়াক্ত না পারলেও মাগরিব ও এশা জামাতের সঙ্গে মসজিদে আদায় করে। ঈমামের সঙ্গে কলিমের বেশ হাবভাব; কোথাও মিলাদ মাহফিল থাকলে সঙ্গে করে নিয়ে যায়। দেখে মনে হয়, ওরা যেন গ্রামেরই মানুষ!
অন্যের বিপদে-আপদে ছুটে যায়; পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। কাজ না থাকল গ্রামের রাস্তায় সারিবদ্ধভাবে হাঁটাহাঁটি করে। মানুষকে ধর্মের কথা শোনায়। দ্বীনের পথে আহ্বান করে।
মাথায় টুপি।
হাস্যোজ্জ্বল মুখ।
ময়লাটে পাঞ্জাবি।
চোখে সুরমার গাঢ় আস্তরণ।
আহা, সারিবদ্ধ বক যেন-বা; হাওয়ার ডানায় ভর করে ভেসে চলে!
এশার নামাজ শেষে ঈমাম সাহেব নিজেও কোনো কোনো দিন পুরাতন স্কুল বিল্ডংয়ে হাজির হন। ধর্মকর্ম বিষয়ে বিষদ আলোচনা করেন; মোলায়েম স্বরে পবিত্র কোরআন এর বিশেষ-বিশেষ আয়াত পাঠ করেন।
অনিমেষের শরীরটা ভালো না; এমনিতেই রোগা-পাতলা, তার ওপর নতুন জায়গা, কাজে-কর্মে পেরে ওঠে না, একটুতেই হাঁপিয়ে যায়। সবকিছু বিবেচনা করে কলিম শেখ তাকে রান্নার কাজে লাগায়। কিছুটা হলেও এতে তার খাটুনি লাঘব হবে, শারীরিক সুস্থতা ফিরে পাবে।
অনিমেষের ভাবনায় গনেশ হালদার নিজেও বেশ ভাবিত। তার করুণ মুখের পানে তাকালে স্বজাত্যবোধ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। বুকের অতলান্তে সূক্ষ্ম ব্যথার খচখচানি! মাথায় হাত বুলিয়ে আশীর্বাদ করে, চিন্তা কোরু না বাপ, আমি আচি না! আমি থাকতি তুমার কুনু চিন্তা নি। যেতো ঝড় আসপে সপ আমি সামাল দেবো।
চিন্তা করতে নিষেধ করলেও চিন্তা কিন্তু হালদারের পিছু ছাড়ে না। পুরানো স্মৃতি নতুন করে প্রাণ ফিরে পায়। অনিমেষের চোখের পানে তাকালে নিখিল, অমোল, বিঞ্চু, নিরোদ, কেষ্ট, গীতা মালতিসহ আরও অনেক মুখ হৃদয়পটে উঁকি মারে। দাদা-বৌদিরা দেশ না ছাড়লে, নির্জনতা তার জীবনের সঙ্গী হতো না। মানুষে মানুষে পাড়া গমগম করতো। বাতাসের ডানায় কঁচিকণ্ঠের আওয়াজ ধ্বনিত হতো।
কপাল!
কপাল!
সবই কপাল!
তা না হলে ভাগ্য বিপর্যয়ের ইতিহাস হবে কেন! তবে আর যাই হোক কামলাদের আগমনে হালদারের বেশ উপকারই হয়েছে; ভুবনডাঙার নির্জন প্রান্তে এক ঘর পড়শি জুটেছে। ঘরে সোমত্ত মেয়ে; নিজে মূর্খ, মেয়েটিকেও কিছু শেখাতে পারেনি, অনিমেষের প্রচেষ্টায় অন্তত দুই-একটা প্রার্থনা শিখতে পারবে!
প্রায় প্রতিদিনই অনিমা আসে। রান্নার অবসরে অনিমেষ নিজেও ওদের বাড়ি পর্যন্ত ঢুঁ মারে। ধর্মের নীয়মনীতি ব্যাখ্যা করে শোনায়; মনোযোগ দিয়ে গীতার অংশবিশেষ পাঠ করে। প্রথম-প্রথম দ্বিধা জাগতো; চেষ্টা করেও আড়ষ্টতা কাটাতে পারতো না। এখন গা’সওয়া হয়ে গেছে। বরং একজনের অনুপস্থিতিতে অন্যের মনে উৎকণ্ঠা জাগে। অনিমার দু’চোখে মাঝে-মাঝে জলের ধারা ছলছল করে। ঘনঘন দীর্ঘশ্বাস ফেলে। দৃষ্টির সীমারেখা বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত করে কি সব ভাবে! তখন মনে হয়, কাছে থেকেও অনিমা যেন অনেক দূরের কেউ। নাম ধরে ডাকলেও উত্তর নেয় না। বই-খাতা গুছিয়ে ঘরের মধ্যে চলে যায়। বালিশে মুখ লুকিয়ে নিঃশব্দে কাঁদে। ওই কান্নার অর্থ অনিমেষের কাছে দুর্বোধ্য; ঠিকঠাক বুঝতে পারে না।
কামলাদের কেউ-কেউ এই নিয়ে রসিকতা করে; মুখ টিপে হাসাহাসি করে, অনেক সম্ভব-অসম্ভবের কথা শোনায়। অনিমেষ রাগ করে না; মনে-মনে খুশির উচ্ছ্বাস। নিজের মধ্যে বিশেষ এক ধরনের উত্তেজনা বোধ করে। এ যে প্রথম যৌবনের এলোমেলো হাওয়া! অনিমা এলে কিংবা ওদের বাড়ির পথে পা দিলে ছেলেটির হাত-পা ঘামতে শুরু করে। বার বার কলতলায় গিয়ে হাতে-মুখে পানি দেয়; ভাঙা আয়নার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মাথার চুলে আলগোছে আঙুল চালায়।
ধর্মের প্রতি অনিমা ইদানিং সীমাহীন উদাসীন—অনিমেষের সঙ্গে পোড়োবাড়ির চারপাশে হাঁটাহাঁটি করতেই অধিক পছন্দ। শেষ বিকেলের নরম রোদে হেলান দিয়ে বিলের ধারে দাঁড়িয়ে থাকে। সম্মুখে বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ। দূরের গ্রামগুলোর পানে তাকিয়ে আরও বেশি আনমনা হয়ে ওঠে। ছোটবেলা থেকেই ওই গ্রামগুলো দেখে আসছে; খুব যেতে ইচ্ছে করে কিন্তু যাওয়া হয় না। মেয়ে হয়ে জন্মালে ছোটখাটো ইচ্ছের কাছেও যেন নিজেকে বলি দিতে হয়!
একঘেঁয়ে জীবন আর ভালো লাগে না। একান্ত মুহূর্তে অনিমেষকে জিজ্ঞেস করে, অনিমেষ দা, ও অনিমেষ দা, ওই ভিনগিরামে তুমি আমাক নিয়ি যাবা!
কিছুক্ষণ নির্বিকার থেকে অনিমা পুনরায় জানতে চায়, আইচ্চা ওকেন যায়ি আমরা যেদি পত ভুলি যাই,তালি কী হবে; আমাক একলা ফেলি থুয়ি তুমি চলি যাবা না তো!
অনিমেষ নিরুত্তর। অনিমার কৌতূহলী দৃষ্টির সম্মুখে নিজেকে বড় অসহায় মনে হয়। কিংবা ছেলেটি নিজেও বোধহয় জেগে-জেগে স্বপ্ন দেখে; হৃদয়ের রঙতুলিত ভবিষ্যতের ছবি আঁকে—
ছোট্ট একটা সংসার।
এক চিলতে সুখ।
ঘরে ফেরার টান।
নতুন একটা মুখ।
নাহ, ভাবনাগুলো বড়বেশি আকাশবর্তী; কারও জীবনে যা হয়তো কোনো দিনই মাটিবর্তী হবে না! অনিমেষ ওই না হওয়া মানুষের দলে। তবু দুর্বল মুহূর্তে মানুষ স্বপ্ন দেখে; দেখবে আগামী দিনগুলোতেও।
দিনের আলো রাতের শরীরে বিলীন হলে এলাকাটা গাড় অন্ধকারে ঢেকে যায়। অন্ধকারের পর্দা মাড়িয়ে নিভু-নিভু প্রদীপ হাতে অনিমা আসে, অনিমেষকে ইঙ্গিত করে জিজ্ঞেস করে, ইট্টু কিরাসিন হবে হো পরদেশি?
কেরোসিন অজুহাত মাত্র। ম্লান আলোয় দুটি প্রাণ মুখোমুখি দাঁড়ায়। বুকের গভীর থেকে ঢিব-ঢিব শব্দ উত্থিত হয়। পলকহীন দৃষ্টিতে মায়ার কাজল! যৌবনের তাপ-উত্তাপ ধরে রাখা দায়!
এরই মধ্যে খানিকটা ইঙ্গিত ছিল; ইঙ্গিত ছিল বাতাসের প্রবাহে। অথচ ঘটনাটি মঞ্চস্থ হওয়ার আগে তা কেউই আন্দাজ করতে পারেনি। ফলত ভুবনডাঙার জীবনচিত্রে নাটকীয় পরিবর্তন! বাতাসের বুকে হাহাকার। রাতের বুক চিরে করুণ আর্তনাদ। স্কুল আঙিনায় লোকে লোকারণ্য। কামলাগুলোর হাত-পা দড়ি দিয়ে বাঁধা। পুলিশের বক্তব্য, ওরা নাকি জঙ্গি; বাংলাভায়ের লোক! কিন্তু এ কথা কেউ বিশ্বাস করতে নারাজ; ওরা নিশ্চয় প্রতিহিংসার শিকার!
ছেলে-বুড়ো সবাই মিলে কামলাগুলোর জন্য পুলিশের কাছে সুপারিশ করে; ওদের পক্ষে সাফায় গায়, নির্দোশ প্রমাণের চেষ্টা করে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয় না, পুলিশ নিজেদের সিদ্ধান্তে অবিচল। আসামিদের গাড়িতে তুলে থানা-সদর অভিমুখে রওনা দেয়। কেউ-কেউ বুক চাপড়ে কাঁদলেও অনিমা কাঁদতে পারে না; মানুষগুলোর চলে যাওয়ার পানে পাথর-চোখে তাকিয়ে রয়!