প্রিয় গল্প-প্রসঙ্গ
আমার প্রিয় গল্পটি যেন চিন্তাসূত্র বরাবর পাঠিয়ে দেই। সেইসঙ্গে গল্পটি আমার নিকট কেনই-বা প্রিয়, এ বিষয়ে পাঁচ-ছয় শ শব্দের অনুভব। সত্যি বলতে কী, এ গল্পটি কেন প্রিয়, কতটুকু প্রিয়, আদৌ প্রিয় কিনা এই ধরনের কথাবার্তা আমার জন্য প্রকাশ করা মুশকিল। কেননা আমার কোনো লেখা নিয়েই আমার ভেতর সচরাচর সে অর্থে তেমন কোনো আহ্লাদ জন্ম নেয় না। বরং আমার লেখা নিয়ে আমি বরাবরই দ্বিধান্বিত। যখন পৃথিবীর কালজয়ী লেখাগুলোর পাশাপাশি পৃথিবীর ভালোলাগা লেখাগুলো পাঠ করি, তখন এমন দ্বিধা আরও খানিকটা সক্রিয় হয়ে ওঠে।
অকপটে স্বীকার করছি, সব শ্রেণীর পাঠকদের জন্য লেখার মতো যোগ্যতা আমার কোনোকালেই ছিল না। আমার নিজের লেখা নিয়ে আমার তেমন কোনো আত্মতুষ্টিও নেই বরং রয়েছে এক ধরনের বিরক্তিমিশ্রিত অহম। ১৯৯৯ সালে প্রকাশিত আমার প্রথম গল্পের বই ‘ইলিশখাঁড়ি ও অন্যান্য গল্প’, এই বইয়ের দ্বিতীয় গল্প ‘প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী’। মাত্র হাজারখানেক শব্দের মধ্যে গল্পটির উপস্থাপন কৌশল আমাদের ভাষায় ঠিক ততটা প্রচল নয়। সচিন দেব নামের এক গণিতবিদের ব্যক্তিসংকটকে প্রজাতিসংকটে রূপান্তর করতে গিয়ে সময়ের প্রচল চৈতন্যকে এখানে অস্বীকার করা হয়েছে।
প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী ॥ শিমুল মাহমুদ
ক. প্রথম পর্ব: পরিভ্রমণ দৃশ্য
সাঁচচুয়ানা বসে ভাবতে চেষ্টা করছে পথে দেখা বালকটিকে। বালকটির বাহুতে সরিসৃপের উল্কি আঁকা। এ বালক এই শহরে কেন ঠিক মেলাতে পারছে না সাঁচচুয়ানা। উত্তরাঞ্চলের আনসিবানা গোত্রের যুবকদের বাম বাহুতে এই চিহ্ন দেখা যায়। সাঁচচুয়ানা নিজের বাম বাহুতে নিজ উল্কি চিহ্নটির দিকে গভীর চোখে এক মুহূর্ত তাকিয়ে হঠাৎ-ই পাশের টেবিলে বসা মেয়েটিকে দেখে চমকে উঠলো।
মেয়েটির ঊর্ধাঙ্গ সিবাচ পাতার পোশাকে মোড়ানো; নিম্নাঙ্গ চাখাই সাপের চামড়া দিয়ে তৈরি ক্ষুদ্র পোশাকে ঢাকা। কালো চিকচিক চোখ ডুবে আছে ঘনশ্যাম অন্ধকার ত্বকের ভেতর। কোঁকড়া চুলে সাদা ছাই জাতীয় কিছু একটা মেখেছে। ঠিক তিন চন্দ্রমাস আগে সাঁচচুয়ানা ঠিক এমন একজন সুঠামদেহী রমণীকে স্বপ্নে দেখেছিলেন।
জনপদের নাম ‘কিবাত’। গতরাতে কিবাত নগরীর এক সহস্র সৌর বৎসর পূর্ণ হয়েছে। আজ খ্রিষ্টপূর্ব ৪ আগস্ট ৩০২৮। কিবাত নগর কতটা স্বাধীন তা বোঝার চেষ্টা করছেন সাঁচচুয়ানা। তিনি গতরাত্রে মাত্র এসেছেন; তিনটি সমুদ্র এবং চারটি সৌর আকাশ পাড়ি দিয়ে।
সহস্র বৎসরে সজ্জিত এই কিবাত নগরীতে সাঁচচুয়ানা একজন আগন্তুক। নগরপথে তাকে প্রথমে যা খেতে দেওয়া হলো তা সম্ভবত ছিল কোনো এক গভীর তরল কৃষ্ণকায়া পানীয়। পান করার পর থেকে এ পর্যন্ত কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না।
সাঁচচুয়ানা পদব্রজে সর্বাপেক্ষা উঁচু পাহাড়টির পাদদেশে এসে দাঁড়ালেন। পাহাড়টির গভীর থেকে জলস্রোতের শব্দ ভেসে আসছে এবং মাঝে মাঝেই গোটা পাহাড়টি কেঁপে কেঁপে উঠছে। পাহাড়টির ডানপাশ-ঘেঁষে এই নগরীর সর্বাপেক্ষা উঁচু অট্টালিকা দাঁড়িয়ে আছে। অট্টালিকাটি মেঘেদের শরীর ছুঁয়ে একুশটি ধাপে নিরানব্বইটি কক্ষে সজ্জিত।
সাঁচচুয়ানা পাহাড়টিকে ছুঁয়ে দেখার চেষ্ট করলেন। কাঁটা জাতীয় ক্ষুদ্র আগাছা উপড়ে ফেলতেই কালো মাটি কর্কশ পাথরের মতো গড়িয়ে পড়লো পায়ের কাছে। বাঁপাশে লাঠা গাছের ঝোপের ভেতর থেকে গাঢ় শব্দ ভেসে আসছে। সাঁচচুয়ানা শব্দ বরাবর তাকালেন। অল্প অগ্রসর হলেন। হরিণ জাতীয় একটা জানোয়ার চুপ করে লাঠা বন হতে বেরিয়ে এসে সাঁচচুয়ানার পায়ে চুমু খেয়ে চোখ তুলে তাকালো।
ঠিক আজকের দিনে ১২ মাস আগে ‘ঐশি’ মারা গিয়েছে। ব্রেস্ট-ক্যান্সার। আজকে ১৯৯৬-এর ২০ ডিসেম্বর ‘একা’-র মায়ের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী।
হরিণ জাতীয় আকাই শিশুটির শুভ্র মস্তকে হাত বুলিয়ে দিলেন সাঁচচুয়ানা। তারপর আকাই শিশুটির গভীর নীল চোখে সবুজ দৃষ্টি রাখলেন। শিশুটিকে নিয়ে এগিয়ে যেতে থাকলেন আরও গভীর পাহাড়ে। ক্রমাগত কিবাত নগরের ঘণ্টাধ্বনি ক্ষীণ হয়ে আসছে। সূর্যরশ্মি ম্লান হয়ে হলুদ হতে হতে সাদা হওয়ার পর কালো কালো অন্ধকারের মধ্যে ডুবে গেলো।
খ. দ্বিতীয় পর্ব: সূর্য ডোবার পর
সাঁচচুয়ানা পদব্রজে স্বপ্নপ্রাপ্ত হলেন। স্বপ্নে গণিত শাস্ত্রের পরিচিত সংখ্যাগুলি জট পাকিয়ে যাচ্ছে। একটি বিশাল জ্যামিতিক জ্যা-এর সমান্তরাল দুটি আয়তক্ষেত্রের ভূমিতলে মাইল মাইল লম্বা দুটি সাদা ধবধবে কনফারেন্স রুম। উঁচু ভীষণ উঁচুতে আয়তকার বিল্ডিং দুটির ছাদ। ছাদের নিচে ঝুলে আছে ইস্পাত চকচকে ভীষণ দর্শন লোহালক্কড়। বিশাল মেঝের সম্পূর্ণটাই কাচ দিয়ে মোড়ানো।
কনফারেন্স কক্ষের মাঝ বরাবর সাঁচচুয়ানা দেখতে পেলেন কিবাত নগরের সেই যুবতীকে। যিনি চাখাই সাপের চামড়া ও সিবাচ পাতায় সজ্জিত। আর নগরপথে দেখা বালকটি, যার বাম বাহুতে উল্কি আঁকা। বালকটি সস্নেহে যুবতীর স্তন পানে রত।
অকস্মাৎ ট্রপিক্যাল স্যুট-এ সজ্জিত তিনজন পুরুষের ছবি ভেসে উঠলো কাচের মেঝের ওপর। স্তনপানরত বালক চিৎকার করতেই পুরুষত্রয়ের সরু তীক্ষ্ণ লম্বা আঙুলগুলো বালকের শ্বাস রোধ করে দিলো। নরম চোখজোড়া তীব্র ফেটে যাচ্ছে, ঠোঁট বেয়ে চিকন লাল রক্ত, সম্ভবত বালকটির মৃত্যু হচ্ছে। পুরুষত্রয় যুবতী মাতার স্তনদ্বয় খামচে নিচ্ছে, দাঁত বসে যাচ্ছে।
তীব্র চিৎকার। সাঁচচুয়ানা ছুটে যাচ্ছে ধর্ষণ দৃশ্যের দিকে। দেয়ালে হাত রাখতেই দেয়াল দুভাগ হয়ে আসে। সাঁচচুয়ানা এগিয়ে যায়। অভিজাত পুরুষত্রয় চতচকে ইস্পাত খণ্ড হাতে সাঁচচুয়ানা বরাবর অগ্রসর হলো। সাঁচচুয়ানার চোখে গণিত শাস্ত্রের সংখ্যাগুলি অপরিচিত হতে থাকে। দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হয়ে আসে। সাঁচচুয়ানা তীব্র দৃষ্টিরশ্মি ছুড়ে দিলো ইস্পাত খণ্ডের ধারালো দেহের ওপর। ইস্পাতখণ্ড মোমের আলোর শিখায় জ্বলে উঠে মোমের দেহের মতো গলে যেতে থাকে।
পুরুষত্রয় প্রথমে থমকে যায়, তারপর পিছিয়ে আসে। আর বিশার জ্যামিতিক জ্যা দুলে উঠতেই বিশাল বিশাল বিল্ডিং দুটির দৃশ্য সাঁচচুয়ানার মস্তিষ্ক হতে মিলিয়ে গেলো। সাঁচচুয়ানা পদব্রজে প্রাপ্ত স্বপ্নটির তাৎপর্য ঠিক বুঝতে পারলেন না। ক্রমেই তিনি পর্বতশীর্ষে পৌঁছে যাচ্ছেন।
গ. তৃতীয় পর্ব: শীর্ষদেশ
সূর্যোদয়ের খানিকটা আগে সাঁচচুয়ানা পাহাড়ের শীর্ষদেশ হতে কিবাত নগরীর শতছিন্ন চিৎকার শুনতে পেলেন। নিরানব্বই কক্ষে সজ্জিত কিবাত নগরীর সর্বাপেক্ষা উঁচু অট্টালিকাতে নয় শত নিরানব্বইটি মানব শিশু মাতৃদুগ্ধের পিপাসায় ক্রন্দনরত। মাতাগণ দুধরস সৃষ্টির তাড়নায় নিজ নিজ স্তনে সিবাচ পাতা ঘষছেন।
দুগ্ধ-বন্ধ্যা মাতাগণ প্রত্যূষ-প্রার্থনায় মিলিত হলেন। অট্টালিকার ছাদে নতজানু সারি সারি সিবাচ পাতা পরিহিতা মাতাগণ নিজ নিজ সন্তানদের শুইয়ে দিচ্ছেন সদ্য উত্থিত প্রত্যূষ আলোর নিচে। উন্মোচিত হতে যাচ্ছে প্রার্থনা সংগীতদৃশ্য।
ঘ. চতুর্থ পর্ব: গণিতশাস্ত্র অধ্যয়ন
সাঁচচুয়ানা মেলাতে চেষ্টা করছেন এখন হতে ঠিক কতো সময় আগামীতে স্বপ্নে-প্রাপ্ত দৃশ্যটি বাস্তবে সংগঠিত হতে যাচ্ছে। পাথুরে মাটিতে সংখ্যাচিহ্নগুলো আঁকছেন; আধুনিক পুরুষগণ কখন এই গ্রহে আধুনিক সভ্যতার উদ্ভব ঘটাবেন; সাঁচচুয়ানা হিসাব মেলাতে পারছেন না; যদিও তিনি স্পষ্টতই জানেন কোনো দৃশ্যেরই বিনাশ নেই।
ঙ. অতিবাস্তব পর্ব: সহস্র বৎসর বয়স্কা যুবতীর দর্শন লাভ
এক চন্দ্রদিবস পর সাঁচচুয়ানা পাহাড় অতিক্রম করলেন এবং সমুদ্রের পাদদেশে সহস্র বৎসর বয়স্কা যুবতীর দর্শন লাভ করলেন।
যুবতী : সময় শাস্ত্র অনুসারে আমার অস্তিত্ব অবাস্তব।
সাঁচচুয়ানা : আমি সময়-এর রহস্য সম্পর্কে অবগত নই।
যুবতী : অথচ মানুষ সময়কে অতিক্রম করতে চায়।
সাঁচচুয়ানা : অভিজ্ঞতা বাস্তব সংখ্যা এবং সময় অবাস্তব সংখ্যা।
যুবতী : অভিজ্ঞতা আপাত বাস্তব সংখ্যা এবং সময় অতি বাস্তব সংখ্যা। এখন হতে চার সহস্র বৎসর পর একবিংশ শতাব্দীতে সভ্যতার আপাত শীর্ষে সভ্যতা দ্বারা শৃঙ্খলিত ‘মাতৃদুগ্ধপাপ’ সংঘটিত হবে। যে পাপদৃশ্যটি ইতিমধ্যেই তোমার মস্তিষ্কে স্বপ্ন সৃষ্টি করেছে। এবং আগামীতে যে পাপ সংঘটিত হতে যাচ্ছে তা আজকের কিবাত নগরীর সন্তানদের মাতৃদুগ্ধ হতে বঞ্চিত করেছে।
সাঁচচুয়ানা : কিবাত নগরবাসীর করণীয় কী?
যুবতী : বর্তমান সভ্যতার যাত্রাপথ কিঞ্চিত পাল্টিয়ে দেয়া, যাতে একবিংশ শতাব্দী বরাবর না পৌঁছে।
চ. বাস্তব পর্ব: ১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দ ২০ ডিসেম্বর
গণিত শাস্ত্র বিশারদ সচিন দেব ঘুম থেকে জেগে ওঠার পর দীর্ঘ সময় চুপচাপ শুয়ে রইলেন। পাশে ঘুমিয়ে থাকা মেয়ের মুখে তাকালেন। বেশ কিছু সময় পর মেয়েকে খুব আস্তে চুমু খেলেন। সাইড টিবিলের ওপর রাখা বইয়ের পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে এলোমেলো দাগে মেয়ের নাম লিখলেন, ‘একা’। ওর মায়ের নাম লিখলেন, ‘ঐশি’ আর নিজের নাম লিখতে গিয়ে লিখলেন, ‘সাঁচচুয়ানা’।
নামটার দিকে অপরিচিত চোখে তাকাচ্ছেন, ভয়ানক স্বপ্নটা মাথাটাকে ঝাপসা করে দিচ্ছে। চৌদ্দ মাসের ‘একা’-কে বুকে ঠেঁসে ধরলেন সচিন দেব। ঠিক আজকের দিনে ১২ মাস আগে ‘ঐশি’ মারা গিয়েছে। ব্রেস্ট-ক্যান্সার। আজকে ১৯৯৬-এর ২০ ডিসেম্বর ‘একা’-র মায়ের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী।