অনেক সময়ই গল্পে চরিত্রেরা লেখকের নিয়ন্ত্রণে থাকে না। এমনও হয়েছে—আমি চেয়েছি, তাকে কিশোর নায়ক বানাবো কিন্তু সে বার বার বড় হয়ে যায়। আজকে একটি শিশুকে প্রধান নায়িকা বানিয়ে লিখবো। দেখি সে গায়ের জোরে বড় হতে পারে কি না। গায়ের জোরে মানুষ সমাজে নেতা হতে পারে, অধিনায়ক হতে পারে কিন্তু সাহিত্যের নায়ক বা নায়িকা হতে পারে না। রাজনীতিতে পারে। ইতিহাসের নায়ক হতে পারে না। সাহিত্যের নায়ক বা নায়িকা হতে হলে কী গুণ থাকতে হয়, তা এসব চরিত্রেরা জানে না।
আমি আজ যাকে নিয়ে লিখছি তার বয়স সাড়ি তিন বছর। সে তার দরিদ্র বাপের সংসারে মোটামুটি সুখেই আছে। এতটুকু বয়সে তার সামান্য চাহিদা সামান্য আয়াসে পূরণ করা যায়। তার বাপ চেষ্টা করেছে, নিজে না খেয়ে মেয়েকে ভালোটা খাওয়াতে, পরাতে। বাপের কোনো চাকরি নেই। এখানে-সেখানে স্বল্পমেয়াদে নিয়োগ পেয়ে কাজ করে। আমি জানি, এই মেয়ে বড় হয়ে হয়তো যুগে হাওয়ায় ভেসে ফ্রয়েডের তত্ত্বকে উড়িয়ে দিয়ে একদিন বাপের বিরুদ্ধে অভিযোগের আঙুল তুলে বলবে, ‘যেই বাপ সন্তানের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারে না, তার সন্তান জন্ম দেওয়া উচিত হয়নি। এমন বাপ আসলে বাপ নামের কলঙ্ক। একজন অযোগ্য পুরুষ।’
সে দিন আমাদের এই অনামিকার বাপ নীরবে চোখের পানি ফেলবে। নিজের সারাজীবনের হিসাবের খাতা তুলে বাকির পরিমাণ বেশি দেখে হতাশায় মরে যেতে চাইবে। কিন্তু বয়সের ভারে আর মৃত্যুভয়ে ভীত মন তখন মরে যাওয়ার সাহস হারিয়ে ফেলবে বলে তার আত্মহত্যা করাও হবে না। নিদারুণ যন্ত্রণায় আরও অনেক কাল ভুগে ভুগে মারা যাবে চরম অসহায়ভাবে।
সাড়ে তিন বছরের এই অনামিকা এখন সবার আদর পেয়েই বড় হচ্ছে। বাপের বংশের, মায়ের বংশের সমস্ত আত্মীয়ই তাকে স্নেহ করে। এই বাড়িতে কেউ বেড়াতে এলে তার কথা সবাই জিজ্ঞাসা করে। সবাই তার জন্য কিছু না কিছু হাতে করে উপহার নিয়ে আসে। তবে সে বড় হচ্ছে বাড়িতে একা। কারণ বাড়িতে অন্য কোনো শিশু নেই। মাঝখানে পাশের বাড়ির ভাড়াটেদের একটি মেয়ে ছিল তার চেয়ে দুই বছরের বড়। অনামিকা তাকেই বন্ধু বলে মেনে নিয়েছিল। পাশের বাড়ির সে ভাড়াটেরা ছিল অন্য জেলার লোক। মেয়েটির বাবা ছিল কারেন্ট জালের কারখানার শ্রমিক। আর মা ইট ভাঙতো। দরিদ্র বলে মেয়েটি অনামিকাদের ঘরে ঢুকতো না। দুয়ারে দাঁড়িয়ে অনামিকাকে ডেকে বাইরে নিয়ে একত্রে খেলতো। এই শ্রমিক শ্রেণীর মেয়েটি এ বছর থেকে স্কুলে যাওয়া শুরু করেছে। সে স্কুলে গেলে অনামিকা একা হয়ে যেতো। সে তার যাবতীয় খেলনা একটা ছালায় ভরে কাঁধে নিয়ে সারা বাড়ি ঘুরে বেড়াতো। নিঃসঙ্গতার কারণে সে কোথায় ছালা পেতে খেলবে, কার সঙ্গে খেলবে, তা জানতো না। খেলার সাথী না পেলে কতক্ষণ ঘুরে ফিরে মায়ের কাছে ফিরে এসে মায়ের রান্নার কাজে বাধা দিতো। এটা-ওটা অসম্ভব বস্তু চেয়ে বিরক্ত করতো।
মা বুঝতে পারতেন তার মেয়ে খেলার সঙ্গী না পেয়ে একাকিত্বের যন্ত্রণায় এমন করছে। তখন তিনি সান্ত্বনা দিয়ে বলতেন, ‘এই যে আম্মু, একটু পরেই হনুফা স্কুল থেইকা আইসা পড়বো। তুমি এখন ঘরে গিয়া কয়টা ভাত খাইয়া ঘুমাও। আর না হইলে বই খুলে ছবি দেখতে থাকো। এখনই হনুফা স্কুল থেইকা আসবো।’
অনামকিা মায়ের কোলে থেকেই গলা বাড়িয়ে রাস্তার দিকে চেয়ে বলতো, ‘কই, হনুফা আসে না তো! ও ইস্কুলে যায় ক্যান? ওরে ইস্কুলে যাইতে না করবা।’
‘হায় হায় এই কথা কয় না। হনুফা স্কুলে না গেলে ওর মা মারবো তো!’
‘তুমি ওর মায়রে না কইরা দিবা।’
‘স্কুলে যাইতে হয়, না হইলে বড় হইবো কেমনে?’
‘আম্মু, ইস্কুলে না গেলে কি মানুষ বড় হয় না?’
‘না। স্কুলে গেলেই বড় হয়।’
মায়ের এই কথা অনামিকা বিশ্বাস করে না। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ভাবে। শিশুরা আমাদের চোখের সামনে বড় হয়। কিন্তু তারা প্যারালাল ইউনিভার্স সৃষ্টি করে নেয়। নিজের জগতে তারা অনেক কিছুই জানে। ভিন্ন অভিজ্ঞতা নিয়ে তারা বড় হয়। অনামিকা তার চোখের সামনে বিড়াল, কুকুর, হাঁস-মুরগি, কবুতর দেখে। কত পাখি পোকামাকড় দেখে। নানা বাড়িতে গেলে গরু-বাছুর দেখে। নানা বাড়িতে যাওয়ার সময় একটা বাড়ির সামনে ভেড়া দেখে। এসব তো সবই বড় হচ্ছে। সে আগে ছোট দেখেছিল এবার দেখেছে ওরা অনেক বড় হয়েছে। কই ওরা তো ইস্কুলে যায় না। সে মায়ের হাতে চিমটি দিয়ে বলে, ‘তুমি মিছা কতা কও। ইস্কুলে না গেলেও সবাই বড় হয়। এই যে কুত্তা-বিলাই ওরা কি ইস্কুলে যায়?’
মেয়েকে বাহু থেকে ছাড়িয়ে কড়াইতে তরকারির ওপরে ভাজা মাছ বিছিয়ে দিতে দিতে মা বলেন, ‘ওরা তো মানুষ না। মানুষদের স্কুলে যেতেই হয়। তুমিও বড় হইলে স্কুলে যাইবা।’
হাত-পা ছুড়ে অনামিকা বলে, ‘না, আমি কোনোদিন ইস্কুলে যামু না।’
হঠাৎ করে তার মনে পড়ে ইমন ভাইয়ার কথা। যে দোকানে তার ঈদের জামা বানানো হয়েছিলো সে দোকানের মালিকের ছেলে ইমন। অতি অল্প বয়স, সে ইস্কুলে যায় না, বাপের সঙ্গে দোকানে কাজ করে, তার কথাই বলে অনামিকা।
‘কই, ইমন ভাইয়া তো ইস্কুলে যায় না। আমি কোনোদিন ইস্কুলে যামু না। আমারে ইস্কুলে নিয়া যাইবা না।’
সাড়ে তিন বছরের মেয়ে অনেক কথা শিখেছে। তার কথার কোনো থই খুঁজে পান না শাহানা। আসলে এসব কোনো কথা নয় বাজে কথা। নিম্নশ্রেণীর পোলাপানদের সঙ্গে মিশলেই শিশুরা বাজে কথা শেখে। হনুফা হয়তো খেলার সময় স্কুলে না যাওয়ার পক্ষে এসব কথা বলেছে, না হলে অনামিকা এসব কোথায় শিখলো?
শিশুদের সম্পর্কে মায়েদের ধারণা এমনই হয়ে থাকে। যত দোষ পরের সন্তানদের। এবার অনামিকার মা বলেন, ‘ইমন ভাইয়া স্কুলে যায় নাই, ফাঁকি দিছে বলেই তো ভালো কাজ করতে পারে না। স্কুলে গেলে তুমি বড় হলে ভালো কাজ করতে পারবা।’
এ সময় অনামিকা পাল্টা প্রশ্ন করে, ‘সেদিন রাতে যে আব্বু কইলো, জীবনে কোনো ভালো কাজ পাইলাম না। আব্বু কি ইস্কুলে যায় নাই? আব্বু কি ইস্কুলে ফাঁকি দিছে?’
এতটুকু মেয়ের কথার ধারে অনামিকার মায়ের সব কথার মাথা কেটে যায়। কথারা ফুরিয়ে যায়। হাতের কাজও থেমে যায় তার। এই পিচ্চি মেয়ের প্রশ্নে সে স্তব্ধ হয়ে ভাবে, সে নিজেও মাস্টার্স পাস করে ঘরে বসে আছে। চাকরির মোটা-মোটা বই পড়ে। কত আবেদন পত্র লেখে, কত ইন্টারভিউ দেয়। চাকরি তার হয় না। বার বার ব্যর্থ হলে মানুষের বিশ্বাস বদলে যায়। অপরিবর্তনীয়তাকেই স্থির সত্য বলে মেনে নেয়। সে ধরেই নিয়েছে এদেশে বই পড়ে কোনো চাকরি পাওয়া যায় না। ঘাড়ের ওপর মাথার মতো বড় টিউমার হলে মানুষ প্রথমে চেষ্টা করে সুচিকিৎসা করাতে। কেটে ফেলে দিতে। টাকায় না কুলালে পরে তা শরীরের অনিবার্য অংশ বলেই মেনে নেয়। শাহানাও ধরে নিয়েছেন তার ভাগ্যে এটাই ছিলো। মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। তার সাড়ে তিন বছরের মেয়ে এত পাকা কথা বলে। এগুলো শুনলে ভবিষ্যতের অজানা আশঙ্কায় শরীর শিউরে ওঠে। তবে আজকাল অনেক শিশুই এমন করে কথা বলে। অনেকে বলে ডিজিটাল যুগের পোলাপান যে!
সেদিন ছিল একটা বিয়ের দাওয়াত। অনামিকা গিয়েছিল তার মায়ের সঙ্গে। মুন্সীগঞ্জ শহরেই। কনের বাড়ির দাওয়াত। ছাদের ওপরে খাওয়ার পরে আর বসে থাকার সুযোগ ছিলো না বলে শাহানার সঙ্গে অনামিকা নিচে নেমে আসে। তিন তলা বিল্ডিং। নিচে বাগানের মতো আছে। সেখানে সুদৃশ্য টাইলস লাগানো পাকা বেঞ্চি আছে। জ্যৈষ্ঠ মাসের গরমে দাওয়াত খেতে যাওয়া সুখের বিষয় না। দিন-মাস সম্পর্কে অনামিকার কোনো ধারণা নেই। কিন্তু সে গরমে অস্থির হয়ে উঠেছে। বাড়িতে ঢোকার সময় বেঞ্চিটা অনামিকার চোখে পড়েছিল। খাওয়া তার তেমন কিছু না। সে শাহানার দেখাদেখি পূর্ণ একটা প্লেটের আবদার করেছে। এতটুকু মানুষকে বিয়েবাড়িতে মাথাগণনা করা হবে—এই ভয়ে শাহানা চেয়েছিলেন নিজের পাত থেকে খাওয়াবেন। কিন্তু অনামিকা জেদ শুরু করে, তাকেও প্লেট দিতে হবে। অবশেষে একটা প্লেট আনিয়ে ফ্রাই আর রোস্ট থেকে ছিঁড়ে তাকে দেওয়া হলো কিছু পোলাওসহ। অনামিকা কিছুই খেলো না। এক চিমটি মাংস না, একনলা পোলাও না। সে চেয়ার থেকে নেমে বড় স্ট্যান্ড ফ্যানের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে জালির ভেতর থেকে সশব্দে ছিঁড়ে আসা বাতাসের সামনে দাঁড়িয়ে রইলো। ঘূর্ণায়মান ফ্যানটির সামনে আ আ আ করে শব্দ করতে শুরু করলো। সে কবে যেন আবিষ্কার করেছে, টেবিল ফ্যানের সামনে এভাবে আ আ করলে শব্দটির কম্পন সৃষ্টি হয়।
দই দিতে দেরি হয়েছিল। অনামিকা শুধু কয়েক চামচ দই খেয়েছে। দই খাওয়া শেষ হলে পরের বৈঠকের ভিড় দেখে দ্রুত তাদের নেমে আসতে হয়েছে। এর মধ্যে ঘামতে শুরু করেছে অনামিকা। তিন তলা থেকে নামতে নামতেই গলার নিচে ঘেমে গেছে। জামাও ভিজে গেছে। নিচে নামার পরে টাইলস লাগানো বেঞ্চিটা দেখে অনামিকা বললো, ‘আম্মু, চলো ওখানে বসি।’
অনামিকাকে নিয়ে শাহানা বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। এসময় তিন তলা থেকে নেমে আসে অনামিকার মা শাহানার বান্ধবী নাসরিন আর তার মেয়ে ঋতু। নাসরিন ছিল শাহানার ক্লাসমেট। একসঙ্গেই এভিজেএম স্কুল থেকে এসএসসি পাস করে হরগঙ্গা কলেজে ভর্তি হয়েছিল। সেখানে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে একসঙ্গেই অনার্সে ভর্তি হয়েছে। সমাজকর্ম নিয়ে দু’জনেই অনার্স পাস করেছে। এর মধ্যে নাসরিনের প্রাইমারি স্কুলে চাকরি হয়ে গেছে। সে আর মাস্টার্স পড়েনি। বিয়ে হয়ে গেছে। তার স্বামী ইউরোপের কোনো দেশে থাকে। তার মেয়েও হয়েছে। তার মেয়ের নাম ঋতু। সে অনামিকার চেয়ে পাঁচ মাসের ছোট। কিন্তু দেখতে অনামিকার চেয়ে বড় বলে মনে হয়। উচ্চতা এবং স্বাস্থ্য ভালো। অনামিকা ঋতুকে আগেও একবার দেখেছিল। দু’জনের মায়ের কলেজের কোনো এক পিঠা উৎসবে। সেদিন অনামিকা ঋতুর গায়ে বিদেশি ডিজাইনের পোশাক দেখে খুব খুশি হয়েছিল। অনামিকার গায়ের পোশাক তার মা বানিয়ে দেয়। সেগুলোও দেখতে খারাপ না। কিন্তু ঋতুর গায়ের জামাগুলো টিভির অনুষ্ঠানের বাবুদের জামার মতো। এ কারণেই ঋতুর গায়ের জামাটা সেদিন অনামিকার ভালো লেগেছিল। দু’জনে মায়েদের হাত ছেড়ে বাগানের কাছে চলে গিয়ে ফুল দেখছিল। অনামিকা কণ্ঠস্বর নিচে নামিয়ে সতর্কতার ভাষায় ঋতুকে বলে, ‘ফুল কিন্তু ছেঁড়ো না। তাহলে স্যারেরা মারবে।’
ঋতুকে সেদিন কেমন বোকা মনে হয়েছে অনামিকার। সে আস্তে করে ঘাড় কাত বলে বলেছে, ‘আচ্ছা।’
এসময় দু’জনের মা তাদের সন্তান খুঁজে খুঁজে বাগানের কাছে চলে আসে। বাগানের গ্রিলের কাছে ওদের দু’জনকে একত্রে দেখতে পেয়ে শাহানা তার মোবাইল ফোন বের করে ছবি তোলেন। নাসরিনও ছবি তুলেছে। পরদিন নাসরিন সে ছবি ফেসবুকে দিয়েছে। শাহানার ফেসবুক একাউন্টে অনেক মাস ধরে লগইন করা হয় না। তাই ছবিও আপলোড করা হয় না। অনামিকা মাঝে মাঝে মায়ের মোবাইল সেট অন করে গ্যালারি থেকে সে ছবি বের দেখে। মাকে দেখায়। বাবাকেও দেখায়।
এতটুকু শিশু এখন থেকে এভাবে কষ্ট পেলে ভবিষ্যতে মন-মানসিকতা খারাপ হয়ে যাবে। রাতে সে তার আব্বুকেও একই অভিযোগ করলো। কারও উত্তরেই সে শান্ত হয়নি।
মানুষের কোনো কিছুই বেশিদিন আগের মতো থাকে না। মোবাইল ফোন সে মানুষেরা চালায় বলে তার অবস্থাও মানুষের ভাগ্যের মতো হয়ে যায়। মানুষের স্মৃতির মতো হয়ে যায় ফটোগ্যালারি। সব গ্যালারি এক সময় ফিলআপ হয়ে গেলে পুরনো ছবি, অপ্রয়োজনীয় ছবি ডিলিট করে দিতে হয়। এভাবে অনেক ছবিই ডিলিট হয়ে যায়। ঋতুর একটা ছবিই অবশিষ্ট থাকে। অনেক মাস পরে একদিন অনামিকা আবার তার মায়ের মোবাইল সেট অন করে গ্যালারির নতুন নতুন ছবি দেখতে গিয়ে পুরনো সেই ছবিটা দেখতে পেয়ে মাকে বলে, ‘আম্মু, ঋতুরা কোথায় থাকে?’
‘মুন্সীগঞ্জে থাকে।’
শাহানারা থাকে মুক্তারপুরে। শহরের বাইরে। অনামিকা আবার বলে, ‘কই আমি তো ঋতুরে দেখি না। তোমার সাথে, আব্বুর সাথে জুতা কিনতে মুন্সীগঞ্জে যাই, ঋতুরে দেখিনা তো।’
শাহানা বুঝিয়ে দিয়ে বলেন, ‘ওরা থাকে উঁচা বিল্ডিংয়ে।’
বিল্ডিং শব্দটার সাথে অনামিকার পরিচয় থাকা স্বাভাবিক। কারণ আশেপাশে অনেক বিল্ডিং চোখে পড়ে। এ ছাড়া অনামিকার শিশুমনে শব্দটার ভিন্ন গুরুত্ব আছে। তার প্যারালাল ইউনিভার্সে প্লাস্টিকের ব্লক দিয়ে বিল্ডিং বানানোর স্মৃতি নিয়ে ভিন্ন অধ্যায় আছে।
‘আম্মু উঁচা বিল্ডিংয়ে কারা থাকে? যাগো টেকা বেশি তারা?’
অনামিকার এ ধরনের প্রশ্নে চমকে ওঠেন শাহানা। তিনি ভেবে পান না এতটুকু মেয়ে এসব কথা কোথা থেকে শিখেছে। মনে করেন কেউ বুঝি শিখিয়ে দিয়েছে।
‘হ।’ মেয়েকে নিরস্ত করার চেষ্টা করেন শাহানা।
‘আম্মু, আমি ঋতুদের বাসায় যামু। তুমি আমারে নিয়া যাইবা?’
এভাবে প্রায়ই অনামিকা তার মাকে ঋতুর একমাত্র ছবিটা দেখিয়ে বায়না করে। আজ না কাল এভাবে দিন যায়। আম্মু কোনোদিনই অনামিকাকে ঋতুদের বাসায় নিয়ে যায়নি।
আজ বিয়ের দাওয়াতে হঠাৎ দেখা। আজ কথা বলার মতো মানসিকতা ছিলো না বলে শাহানা অনামিকার হাত ধরে দ্রুত টেনে বাইরে নিয়ে যাচ্ছিলেন। দ্রুত ইজিবাইকে উঠে যেতে হবে। গাড়িতে উঠলে বাতাস লাগবে। শরীর জুড়াবে। দ্রুত নিচে নামার পরে অনামিকা সেই টাইলস লাগানো বেঞ্চিতে বসতে চায়। কিছুক্ষণের জন্য অনামিকা বসার সুযোগ পায়। তার গায়ের জামাটা ঘামে ভিজে গেছে। সে এই পুরান জামাটাই পছন্দ করে। নতুন কয়েকটা জামা আছে। সেগুলো পাতলাও। কিন্তু এই পুরানা নীল রঙের ভারী জামাটা তার ভালো লাগে। এই জামাটা পরেই ঋতুর সাথে এক বছর আগে ছবি তুলেছিলো। শাহানা বার বার বলেছেন, ‘এটা পরলে গরম লাগবে, নতুন একটা পরো।’
মায়ের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিয়েই অনামিকা সেই পুরানা জামাটা পরে এখানে বিয়ের দাওয়াতে এসেছে। এখন গরমে দরদর করে ঘামছে। দই খাওয়ার সময় জামাতে একটু লেগেছেও। মা টিসু দিয়ে মুছে দেওয়ার পরেও দাগ রয়ে গেছে। আজকাল দইয়েও কৃত্রিম রঙ ব্যবহার করা হয়। সে বেঞ্চিতে বসার একটু পরেই ঋতুকে দেখতে পায়; মায়ের হাত ধরে নেমে আসছে। ঋতুকে দেখে অনামিকা বেঞ্চি থেকে নেমে এগিয়ে যায়। নিজে থেকেই জিজ্ঞাসা করে, ‘তুমিও বিয়া খাইতে আইছো?’
ঋতু কোনো কথা বলে না। একবার অনামিকার দিকে তাকায়। তার গায়ের জামার দিকে তাকায়। অনামিকা আবার জিজ্ঞাসা করে, ‘তুমি কোথায় থাকো? উঁচা বিল্ডিংয়ে?’
ঋতু এবারও চুপ থাকে। অনামিকা এবার সাহস হারিয়ে ফেলে। একটু পিছিয়ে যায়। তৃতীয়বার কিছু বলতে আর ইচ্ছা করে না। তার চেহারা ধীরে ধীরে মলিন হয়ে যায়। অনামিকার মায়ের সঙ্গে সামান্য কথা হয় ঋতুর মায়ের। তারপর নাসরিন মেয়েকে নিয়ে গেটের দিকে এগিয়ে যায়। অনামিকার মুখটা শুকিয়ে যায়। ওরা চলেই যাচ্ছে! আরেকবার বলে দেখা যাক। শেষবার সে ঋতুকে বলে, ‘তুমি আমাদের বাসায় আইসো। আমার সব খেলনা তোমারে খেলতে দিমু।’
গেটের কাছে চলে গিয়েছে ঋতুরা। গেট পার হওয়ার সময় ঋতু শুধু একবার পেছন ফিরে তাকিয়েছে। কাকে দেখেছে কে জানে! ঋতুরা চলে যাওয়ার পরে অনামিকা একেবারে চুপ হয়ে যায়। তার আম্মুও আর দেরি করে নাই। একটু পরেই অনামিকাকে নিয়ে গেট পার হয়ে গলিতে আসে। গলি শেষ হলে রাস্তায় ওঠে। সে রাস্তা শেষ হলে বড় রাস্তায় যায়। যাওয়ামাত্র ইজিবাইক পাওয়া যায়। এলাকায় এ গাড়ির সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। বিদেশ-ফেরত লোকজন সারাজীবনে সাইকেল চালানোর অভিজ্ঞতাও নাই সেও ইজিবাইক কিনে রাস্তায় নামছে। আগে গাড়ি পাওয়া যেতো মিনিটে মিনিটে এখন পাওয়া যায় সেকেন্ডে সেকেন্ডে।
গাড়িতে ওঠার আগে অনামিকা একেবারে চুপ করে রইলো। শাহানা ভেবেছেন, ওর ঘুম পাচ্ছে। কিন্তু গাড়িতে উঠে অনামিকা মাকে বললো, ‘আম্মু, ঋতু আমার সাথে কথা বলে না ক্যান?’
অনামিকার ভেতরের অবস্থা জানেন না শাহানা। তিনি উদাসভাবে বলেন, ‘গরম বেশি তো তাই কথা বলে নাই।’
অনামিকা চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ। গাড়ি এগিয়ে চলে।
কিছুক্ষণ পরে অনামিকা আবার জিজ্ঞাসা করে, ‘আম্মু, ঋতু কি আর আমার সাথে কথা বলবে না?’
‘বলবে না কেন? বলবে?’ শাহানার অন্যমনস্কতা এখনো কাটেনি। তিনি মেয়েকে লক্ষ করছেন না।
‘আম্মু, ঋতুদের বাসায় গেলে কি আমার সাথে কথা বলবে?’
শাহানা চুপ করে থাকেন। পরে বলেন, ‘বলবে।’
গাড়িতে আরো যাত্রী ওঠে। অনামিকাকে কোলে নিয়ে শাহানা একটু সরে বসে নতুন যাত্রীকে বসতে দেন। মোটা মহিলাটি বসায় শাহানাকে অনেক চেপে বসতে হয়েছে। মায়ের কোলে বসে ঘাড় ঘুরিয়ে মায়ের মুখের দিকে চেয়ে অনামিকা এবার বলে, ‘আম্মু, তুমি আমারে ঋতুদের বাসায় নিয়া যাইবা?’
‘ঠিক আছে। একদিন আমরা যামু।’ আশার বাণী শোনান শাহানা।
অনামিকা অনেকক্ষণ আর কোনো কথা বলে না। বাড়ির কাছাকাছি চলে আসে গাড়ি। নামার সময় অনামিকা গাড়িতে শক্ত হয়ে থাকে। নামতে চায় না। শাহানা ড্রাইভারকে টাকা দিয়ে মেয়েকে টেনে নামাতে গিয়ে দেখেন অনামিকা শক্ত হয়ে আছে। জোর করে টেনে নামানোর সময় অনামিকা কেঁদে ওঠে, ‘ঋতু আমার সাথে কথা বললো না কেন? আমার সাথে কথা বললো না কেন?’
সেদিন অনামিকা ঘরে গিয়ে অনেকক্ষণ কাঁদলো ঋতু তার সঙ্গে কথা বললো না কেন এই অভিযোগে। শাহানা তখন বুঝতে পারলেন আসলে কী ঘটেছে। ঋতুর উপক্ষোয় অনামিকা মনে প্রবল কষ্ট পেয়েছে। এতটুকু শিশু এখন থেকে এভাবে কষ্ট পেলে ভবিষ্যতে মন-মানসিকতা খারাপ হয়ে যাবে। রাতে সে তার আব্বুকেও একই অভিযোগ করলো। কারও উত্তরেই সে শান্ত হয়নি।
পরদিন শাহানার মোবাইল সেটে ঋতুর ছবিটা আর দেখা গেলো না।