মানুষের মুখ তো বর্ষার আকাশ, ঝরাতেই থাকে।
টিপ্পনী আর টিটকিরির ঢল সামলে দাঁড়াতেই পারছেন না হাওয়া বিবি। কিন্তু কিছু করারও নেই। যে মুখে এদের রুখে দাঁড়াবেন, সে মুখ কি আর রেখেছে ছেলেটা? কত স্বপ্ন ছিল দেখে শুনে এলাকার সবচে লক্ষ্মী মেয়েকে ঘরে আনবেন। ঘোমটা তুলে দেখতেই চমকে উঠবেন, কত জন্মের ভাগ্য তার, ঘরে উঠেছে হুরপরি! অথচ কিনা এই ঢেমনা মাগি ধরে এনেছে ছেলেটা! কোত্থেকে জুটিয়েছে, কে জানে। ঘুরতে ফিরতে ধাঙড় বিটিকে দেখেই বিষিয়ে উঠছে চোখ। ক্ষোভে দুঃখে জ্বলছে সারা গা। কার শাপে যে এই ডাইনির আঁচলে বাধা পড়লো ছেলেটা! কিসের লোভে পড়লো তা-ই বা কে জানে!
কী দিয়ে যে কী হলো, তা ফিদ্দুসিও জানে না। শুধু মনে আছে, আলতাফকে তার পছন্দ হয়ে গিয়েছিল। কেমন যেন পাগল-পাগল ভালো মানুষ ছেলেটা। এত শ্রম, পাকানো দড়ার মতো শক্ত টান টান হয়ে থাকে রগ; তবু গলায় সুর ওঠে। অবিরাম বেজে চলে এলোমেলো গান। এমন সুরে এমন কথার গান সেসব, না হেসে পারা যায় না। টানারোদে কাজ করা, চামড়া পুড়ে কয়লা, গতর শুকিয়ে কাঠ; তবু তার হাসি থামে না। হুটহাট হেসে ওঠে হই হই স্বরে। ছন্নছাড়া দুষ্টুমি পাগলামি তো আছেই। গাঁতার লোকেরা বুঝে উঠতে পারে না, এসবে মন দেবে, না কাজ করবে! অবাক গলায় তারা প্রশ্ন করে ‘এরাম করে গাধার খাটুনি খাটতি খাটতিও তোর এত রস আসে কনতে রে?’ এত পাকনা, অথচ ফিদ্দুছির দিকে চোখ তুলেও তাকাতো না! আর কী ভালো লোকটার মন! কারও সুখ-দুঃখের কথায় সে-ই সবচে’ মনোযোগী শ্রোতা। কিছু করার থাকলে সে-ই করে সবার আগে। দলের সবার ছোট, অথচ বড়ভাইয়ের মতো সে-ই আগলে রাখে সবাইকে! দেখতে দেখতে বুঝতে বুঝতে একরকম মুগ্ধতা হয়তো চলে এসেছিল। তবে, ফিদ্দুসি ঠিক মনে করতে পারে না, কেন ওকে এত ভালোবাসলো।
কিভাবে কিভাবে যে হয়ে গেলো সব, মনে করতে পারে না আলতাফও।
পড়াশোনা হয়নি। সারাজীবনের ভবঘুরে স্বভাব। কাজ করতে ভালো লাগে না। বাপ বেঁচে থাকতে সে কররতাও না কিছু। কিন্তু এখন অন্যসময়। বুড়ো মাকে নিয়ে সংসার। ও না আগুন আনলে চুলো জ্বলে না। তার ওপর যা দাম এখন সবকিছুর, ছুঁয়ে দেখতেও টাকা লাগবে যেন! গতর না খাটালে তাই বাঁচা নেই। কিন্তু ওকে কাজ দেবে কে? ও পারেটাই বা কী? এটা সেটা অনেক চেষ্টা চরিত্র করেও লাভ হয়নি। শেষে গিয়ে তাই ধরলো চঞ্চল মিয়াকে। রাজমিস্ত্রি মানুষ, কত জোগানদারই তো লাগে। তা লাগে, কিন্তু লোকের অভাব নেই মিস্ত্রীর। কদিন পর ও পাড়ার হাসু অসুখে পড়লে তাই সুযোগ হয়েছিল শূন্যস্থান পূরণের। কাজ দিয়ে কথা দিয়ে আলতাফ স্থায়ীভাবেই পূরণ করে আছে ফাঁকটুকু। তবে চঞ্চল মিয়ার মুখ খারাপ। একটু এদিক-সেদিক হলেই ধুয়ে দেয় যাচ্ছেতাই ভাষায়। সব সহ্য করলেও মা বাপ তুলে গালাগাল নিতে পারে না ও। প্রায়ই তাই মনে হয় চলে যায় সব ছেড়েছুড়ে। প্রতি সকালে নিজেকে টেনে বয়ে কাজে আনাও তো আর এক ঝামেলা। ঝামেলাটা হঠাৎই নাই হয়ে গেলো আমির আলীর বাড়ি গিয়েই। মনে হলো কাজটা কষ্টের, তবে খারাপ না। ভাবিকে প্রথমবার দেখেই কেমন যেন মায়া হয়েছিল। কী মিষ্টি একটা মানুষ, অথচ মলিন ভাঙা মুখ। গাঁতার সবাই কানঘুষা করতো তাকে নিয়ে। স্বভাবতই তাদের আগ্রহ ছিল ঢেউ খেলানো দেহটায়। কী সুন্দর গড়ন তার, আর কী সুন্দর মুখ! ফাঁক পেলেই তারা ভাবিকে গিলতো। আর জমিয়ে দিতো গালগল্পের ফেনা। কেউ হয়তো ভাবিকে দেখেছে গোসল করে আসার সময়। চামড়ার মতো করে লেপ্টে আছে ভেজা কাপড়। কাপড় বদলানোর সময় আড়ালে আবডালে থেকে হয়তো দেখে নিয়েছে কিছু। খেতে দেওয়ার সময় হয়তো স্পর্শ লেগেছে হাতে। নিচু হয়ে ভাত বেড়ে দেওয়ার সময় কেউ হয়তো চোখ ছুড়ে দিয়েছে ঢিলা হয়ে থাকা টানটান ব্লাউজের ভেতর। রসিয়ে রসিয়ে তারা এসব কথারই গোল্লা পাকাতো অবরে সবরে। এমন উত্তেজক আর রগরগে সেসব রসগোল্লা, নিজেকে সামলাতে হিমশিম খেতে হতো আলতাফের। কিন্তু বুকপকেটে রেহানার রুমাল। তার টান ছাড়িয়ে ভাবির দিকে নজর দেওয়ার সাহস ওর হতো না। লোহার মতো তাই শক্ত করে রাখত মনটাকে। দিনে দিনে তবু চম্বুক হয়ে উঠেছিল ভাবি। গাধার পালে ঘোড়া থাকলে অন্য ঘোড়ার নজরে তো সে-ই পড়বে! আর তাতে টানও জমবে দুই বুকে। ঠিকই ও বুঝত যে ভাবি কদর করে ওকে। ওকে দেখেই আলো হয়ে ওঠে মুখটা ভাবির। খাওয়ানোর সময় বড় মাছটা বেড়ে দেয়। যাওয়ার সময় তাকিয়ে থাকে আড়াল থেকে।
তলে তলে যে এসব ঘটে যাচ্ছে, ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি আমিরালী।
টের অবশ্য না পাওয়ারই কথা। ব্যস্ত ব্যবসায়ী সে, মস্ত বড় নেতা। মেম্বারি ইলেকশন তো এবার তারই করার কথা ছিল। সইদুল মেম্বারই এসে হাতে পায়ে ধরে থামিয়েছে। এতবার দাঁড়িয়েও পাস করতে পারল না। শেষ ট্রাইটা এইবারই মারতে চায়। ভোট তো লোকে লোক দেখে দেয় না, দেয় মার্কা দেখে। তার ওপর ইলেকশন যা হয়েছে, কলাগাছ দাঁড়ালেও পাশ করতো। জোয়ার বুঝেও মার্কাটা সে ছেড়ে দিলো সইদুল মেম্বারের জন্য। যাক, বুড়ো বয়সে হাউস মিটায়ে নিক। এই সুবাদে বেশ খানিকটা ফুলে উঠেছিল গাঁট। সঙ্গে ছিল কৃষি ব্যাংকের লোন। টাকা তো লোহা, কাজে না লাগালেই জং। অকারণ ফেলে রেখে লাভ কী। বাড়িটাও বড় করা দরকার। হাকিয়ে দিয়েছে তিনতলা। তার রড বালি সিমেন্টের হিসাব-কিতাব আছে। মিস্ত্রিদের ধানাই-ফানাই ওজর-আপত্তি আছে। গায়ে মাথায় হাতবুলিয়ে কাজ করিয়ে নেওয়া আছে। বড়বাজারে ধান চালের আড়ত। সেটার দেখাশোনা আছে। নেতাগিরি তো আছেই। দম ফেলারও কি ফুরসত ছিল তার? ফাঁকে তালে যে নাঙ জুটিয়েছে মাগিটা, খেয়াল করার সুযোগ তার স্বভাবতই হয়নি। তা সে খেয়াল করুক চাই না করুক, ‘মাগি তুই পড়ে থাকবি মাটি কামড়ে। দুনিয়া উল্টে গেলিও তো যে ভাতার, সে-ই ভাতার, নাকি?’ এছাড়া তার কি ঘাটতি ছিল কোনো? খাওয়া-পরা শোয়া—কিসের অভাব রেখেছিল সে ফিদ্দুসির? ‘তবু নাই ধরলাম খাই মিটিনি, চলে গিইচিস। কিন্তুক এরাম চান্দের টুকরো মেয়ের কতাও কি মনে পড়ে না? বুকডা কি কাঁপে না এটটুও?
একজোড়া কড়ির প্লেট হাতে নিয়ে খুশিমনেই এসেছিল। কিন্তু সেখানে যে আমিরালীর লোক বসে থাকবে আর তাকে পিঠমোড়া করে নিয়ে আসবে বেধে, ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেনি। বেশুমার চড় থাপ্পড় আর লাথি গুঁতো খেতে খেতে এখন ওর মনে হচ্ছে, মেরেই বুঝি ফেলবে। তারপর করবে গুম। কিন্তু সবার সামনে এভাবে কি কাউকে মেরে ফেলে মানুষ?
কাঁপলে কি আর যেতে পারতো? এই জন্যেই লোকে বলে ছোটঘরের মেয়ে নিতে নেই। কিন্তু নিষ্পাপ মুখ আর সুন্দর চেহারা দেখে পটে গিয়েছিলেন বাতাসি বেগম। সেই চেহারার আড়ালে যে এমন ডাইনি লুকিয়ে ছিল, ভাবতে পারেননি। মিস্ত্রিরা আসার পর থেকেই বউ ওই বজ্জাতটার কথা বলতো। তার এই ভালো, সেই ভালো, এটা এবং সেটা। এমন অবশ্য সে সবার বেলায়ই করে। কারও কোনো গুণ চোখে পড়লে আর রক্ষে নেই, গদগদ প্রশংসায় ফেনা তুলে ফেলে মুখে। তা গুণ গাওয়া আর গলায় ঝোলা তো আলাদ কথা! বেজম্মাটার দুঃখের গান আর কষ্টের তান যে ভেতরে ভেতরে বউটাকে মাতালই করে তুলছে, বুঝতে পারেননি তিনি। পারলে কি তিনি ঠ্যাঙ ভেঙে দিতেন না তার? গলায় শাড়ি পেঁচিয়ে আড়ায় ঝুলিয়ে রাখতেন না বউকে? বেরোনো বউয়ের বিতেন করতে করতে কান ঝালাপালা করে দিল গ্রামবাসী। মুখ বুজে এসব শোনার মানুষ নাকি তিনি? যেখানেই যাক, যতদূরেই থাক, আমির ঠিকই খুঁজে আনবে ডাইনিটাকে। তারপর মাগি বুঝবে কত ঝালে কত জ্বলে।
জ্বলতে জ্বলতে আপনাতেই ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে বাচ্চাটার চোখ।
মা চলে যাওয়ার পর থেকেই কাঁদছে—আম্মু তো নানাবাড়ি গিয়েছ, চলে আসবেনে কদিন পরই।
—হটাৎ অসুক হলো। সে কি যা তা অসুক! ধরে বেন্দে হাসপাতালে নিয়েই বাঁচন!
এমন তেমন কোনো মিথ্যে দিয়েই তাকে বোঝানো যাচ্ছে না। তার একটাই কথা—‘মাল কাতে দাবো। ইদানিংকালের বাচ্চা। পেট থেকেই পেকে আসে। কত যে ঢং তার, কত যে বাহানা দেখতে দেখতে আর হাসতে হাসতে দিন শেষ হয়ে যায়। কিছু একটা হলেই সে লুটিয়ে পড়ে মেঝেয়। বলে, লাগ হয়েতে। খুনসুটির সময় চোখে হাত দিয়ে বলে, তোক দলচে। সত্যিই হয়তো এখন জ্বলছে চোখদুটো তার, তবে সে জ্বালা জুড়ানোর বুকটা কাছে নেই। পড়ুটে দাদি, নিজেই পারে না উঠতে বসতে। তার পক্ষে দুরন্ত এই টগবগে কলিজা সামলানো দায়। বাবাকে পায় ভয়। এমনিতেই ব্যস্ততার দরুণ দেখা হয় কম। যাও বা হয়, গায়ে ঘেষতে দেয় না আমির। তার ওপর বউ হারিয়ে দিশেহারা এখন, ধমকের পর ধমক দিয়ে দূর করে দেয় বাচ্চাটাকে। চাচিরা এসে খাওয়ায় দাওয়ায়, গোসল করায়। বাচ্চাটা তবু পড়ে পড়ে কাঁদে নিজের মতো।
ওদিকে কান্না ভুলে হেসে উঠেছেন হাওয়া বিবি। ছেলের মতো তিনিও বাঁধা পড়েছেন ফিদ্দুসির আঁচলে।
কী যে লক্ষ্মী মেয়েটা! কদিন না যেতেই মায়ের আদর দিয়ে ভরিয়ে তুলেছে তাকে। কত বছর তিনি ভুলে ছিলেন মায়ের কথা, ঝড়ে ঝাপটায় আশ্রয় হিসেবেই কেবল ছুটে যেতেন মায়ের বটস্মৃতির কাছে। এখন আর তাকে স্মৃতি মনে হয় না। মনে হয় মা-ই যেন ফিরে এসেছে বউমা হয়ে। ফিরে এসেছে কড়া সেই শাসন নিয়ে, ভরা সেই আদর নিয়ে। পটের বিবি সাজিয়ে তাকে হাঁটতে নিয়ে যায় বউ। রাতে বাইরে যাওয়ার দরকার হলে বউও উঠে আসে। আলো নিয়ে গিয়ে দাঁড়ায় পায়খানার সামনে। একটু পর পর, ভয় পেয়ো না, মা, আমি আচি, বলে বলে গা কাঁপিয়ে দেয় এগিয়ে আসতে থাকা দেও দানোর! আর জোরাজুরি করে খাওয়ায়। মায়ের মতো একদম। অমন সুখের জোরাজুরিতে আর দু’চামচ ভাত তুলে নিয়েছেন তিনি দুপুরবেলা। মাছ নিয়েছেন আরেকটা। কী চমৎকার স্বাদ! খাচ্ছেন, আর বউমাকে খেতে বলছেন। কিন্তু সে খাবে না এখন। আলতাফের আসার কথা, একসাথে খাবে। তখনই এলো ফোন—মা, ইরা আমারে ধরে রেকেচে। বলচে তুমরা না আসলি ছাড়বে না।
সর্বনাশ! ধড়াস করে ওঠে বুকটা ফিদ্দুসির। দিঘাবাড়ি গেছে নাকি পাগলটা?
আসার পর থেকে ঘুমাতে পারে না। বুকের মধ্যে গুটিশুটি মেরে ঘুমোতো কলিজার টুকরোটা তার। বুকটা তাই খালি খালি লাগে। চোখ ভেসে যায়। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার সময় জড়িয়ে ধরে থাকে আলতাফ। চোখ মুছে দেয়। বলে, চলো, একদিন দেকে আসি। কিন্তু চাইলেই কি আর যাওয়া যায়? আর গেলে কি রেহাই দেবে আমিরালী? দুজনকে একসাথে পুড়িয়ে মারবে না? তাই না না করে সে। কিন্তু তাতে কাজ হয়নি, বোঝাই যাচ্ছে। এখন কী হবে?
কী হবে না হবে ভেবেই আসলে কিছু করতে চায়নি আলতাফ। যদিও বাচ্চার কাছ থেকে ওকে নিয়ে আসার পর থেকেই অপরাধী লাগে। ফিদ্দুর কান্নার প্রতিটা ফোঁটাই তাকে দায়ী করে যায়। বউটার কষ্ট তো পোড়াচ্ছেই, বাচ্চার কষ্টের আঁচও গায়ে লাগে তার। ওকে যদি একবার নিয়ে আসতে পারে, মা মেয়ে দুজনেই ভালো থাকবে। কিন্তু আমিরালীকে সে চেনে। তার জিনিস নিয়ে একবার পালানো যায়, দুইবার না। সে চেষ্টা করার কথা ভেবেও তাই করেনি সে। মিস্ত্রির ছোটছেলের মোসলমানির দাওয়াত। একজোড়া কড়ির প্লেট হাতে নিয়ে খুশিমনেই এসেছিল। কিন্তু সেখানে যে আমিরালীর লোক বসে থাকবে আর তাকে পিঠমোড়া করে নিয়ে আসবে বেধে, ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেনি। বেশুমার চড় থাপ্পড় আর লাথি গুঁতো খেতে খেতে এখন ওর মনে হচ্ছে, মেরেই বুঝি ফেলবে। তারপর করবে গুম। কিন্তু সবার সামনে এভাবে কি কাউকে মেরে ফেলে মানুষ? সাক্ষী থেকে যাবে না?
অত কাঁচা কাজ আমিরালী করে না। কিভাবে কী করা হবে না হবে, খাওয়া ঘুম বাদ দিয়ে এ কদিন সেই ছকই কষেছে সে। শালা ছোটলোকের বাচ্চাটার বুকের পাটা কতবড় না দেখে তার কাজ নেই। তুলে আনার ব্যাপারটা জানাজানি যাতে না হয়, তার ব্যবস্থা নেওয়াই ছিল। এখানে যা হবে তা আবার যেন প্রচুর লোক দেখতে পায়, তার ব্যবস্থাও করা আছে। তিনরাস্তার মোড় থেকে নেমে এলেই শহরালির জমি। চারপাশে খোলামাঠ। সেখানেই চলছিল হালকা ধোলাই পাতলা মার। পথ দিয়ে শিয়াল কুকুর গেলেও নজরে পড়বে জটলাটা। ফলে লোক জড়ো হতে সময় লাগেনি। আলতুর মা আর ফিদ্দুসির জন্য অপেক্ষায় ছিল আমির। তারা এসে পৌঁছতেই পুরোদমে শুরু হয়েছে দ্বিতীয়বারের ধোলাই। ইতোমধ্যেই তার ফুলে গেছে হাত পা, কপালের কাছটায় কাটা। ফেটে গেছে ঠোঁটও। গা ফেটে উঁকি দিতে থাকা রক্ত নকশা আঁকছে কালো শরীরে। সেই সঙ্গে সমানে চলছে তিনজনের মিলিত মরাকান্না। ভারী হয়ে উঠেছে বাতাস। তার চেয়েও ভারী হয়ে আছে বুকটা আমিরের। তার বউ, তারই ঘরের বউ, পরপুরুষের জন্য আজ পায়ে পড়ছে তার। তবে ফিরেও তাকায়নি সে। ছেলেগুলোর মনের খায়েশ মিটিয়ে মারার হুকুম দিয়ে রেখেছে। শুয়োরটাকে সে ধরে এনেছে যে শিক্ষা দেওয়ার জন্য, তার আয়োজন একটু বাকি ছিল, কিছুক্ষণের বিরতি দিতে হলো তাই। ক্যামেরাটা এসে যেতেই তিন শুয়োরের কান্নার আওয়াজে ব্যঙ্গহাসির শোর মিশিয়ে নির্দেশ দিল আমির, আলতু মিয়া, ল্যাংটো হ। স্বভাবতই নড়ল না আলতাফ। তখন হুঙ্কার আবার—একজনও যদি একেনতে বেঁচে ফিরতি চাস, তো কাপড় খোল শুয়োরের বাচ্চা। তবু খুলল না সে। মায়ের গায়ে দু ঘা দিতেই অবশ্য সরসর করে নেমে গেল কাপড়গুলো আলতাফের। আর তাতেই হো হো করে হেসে উঠল আমিরালী।
ঘুরিয়ে ফিরিয়ে থেমে থেমে কয়েকবার বলার পরও পাথরদেহটা নড়লো না যখন, ভোঁতাস্বরে কথা আবার গলা বাড়ালো আমিরের হাতের লাঠিটা। মায়ের শরীর থেকে বেজে ওঠা সেই ঢোলবাজনায় নড়ে উঠলো আলতাফ।
—এইটুকুন এ্যাট্টা নুনু নিয়ে তুই আমার বউ ভাগায়ে নিয়ে গেলি কী করে হারাম জাদা! বলতে বলতে তাকালো ফিদ্দুসির দিকে। লাথি মেরে ছাড়িয়ে নিলো পা। ছিটকে গিয়ে কিছুটা দূরে পড়ল ফিদ্দুসি।
—এরাম অ্যাট্টা চিমসে নুনুর লোবে তুই আমার বাড়া ছাড়িচিস? নাকি কিচু জাদুটোনা আচে ওতে? যা তালি, জাদুডা করে দ্যাকা।
ফিদ্দুছিকে পাঠানো হলো বান্দরের কাছে। ভরা মজলিসে এখন বউকে উলঙ্গ করবে আলতাফ। হুকুমটা দিতে অবশ্য কেমন কেমন লাগল আমিরালীর। যদিও ঘৃণার হাঙর এসে মায়া মায়া মাছগুলোকে সাবাড় করেছে সব; যদিও বাচ্চা দেখাশোনার জন্য আরেকটা বিয়ে করতে হবে, মেয়ে দেখাদেখি চলছে; বয়স কম আর রস বেশি—এমন একটা পেলেই নিয়ে আসবে তুলে; ফিদ্দুসির কিছুতেই তার এসে যায় না কিছু, তবু মেয়েটার অপমানে যেন নিজেরই ঘাড় কাৎ হয়ে যাবে ভাবতে ভাবতে সে মন বদলালো। শিক্ষাটা তো আরো কার্যকর উপায়ে দেওয়া যায়! বউয়ের না, শুয়োরটা ওর মায়ের কাপড় খুলবে।
শুনেই যেন তিনহাত মাটির নিচে ঢুকে গেলেন হাওয়া বিবি। মনে হলো শরীরটা তার পাথর। পাথরটা দাঁড়িয়ে আছে গায়ে পশম পশম লজ্জা খোদাই করে। অনড় হয়ে অচল তিনি পুঁতে থাকলেন আলো আলো অন্ধকারের কালোয়। এক টুকরো বাতাস এসে যখন নাড়িয়ে দিয়ে গেল চোখের পাতা, তখনই মনে হলো এখন কী হবে! কী করে তিনি এই দাজ্জালের কাছ থেকে মুক্ত করবেন নিজেকে? মনে হলো এখনই অন্ধকার নেমে যাক। বা চিরঅন্ধ হয়ে যাক মানুষ। যেন তারা দেখতে না পায় আর। অথবা টগবগে সূর্য নিয়ে আকাশ নেমে আসুক। পুড়িয়ে দিয়ে যাক সব নষ্ট মাথা ভ্রষ্ট চোখ। কিংবা তার মরণ হোক, যেন এই মহাপাপ তাকে ছুঁতে না পারে।
ফিদ্দুসি তখন আরো জোরে চেপে ধরল আমিরালীর পা—ওগো, অপরাদ আমার। যা পারো আমার সাতে করো। আমার তুমি কেটে ভাসায়ে দেও বিলির পানিত। কিন্তুক মাকে কিছু বোলো না। তার হাটের সমস্যা। সহ্য কত্তি পারবে না। আমার বাচ্চাডার দুহাই, রহম করো।
চোখের স্রোতে আমিরালীর পায়ের পাতা ভিজিয়ে দিয়েও লাভ হলো না। আরও একটা হ্যাচকা টানে সে ছাড়িয়ে নিলো পা। নিতেই মেয়েটা তড়পাতে লাগলো।
কাটা ধানের সুচালো গোড়া আর এবড়ো খেবড়ো হয়ে উঠে থাকা শুকনো শক্ত মাটি ঢুকে যেতে লাগলো তার দেহে। এখানে ওখানে এক দুই ফোঁটা করে রক্ত দেখা গেলো তখন। কিন্তু তাতে কি এই শুকনো শক্ত পাথুরে মাটি কাদা হবে? যেমন ছিল তেমন করেই তাই বসে থাকল আমিরালী। রাস্তার গায়ে দাঁড়ানো বাবলা গাছের মতো দাঁড়িয়ে থাকলো আলতাফও। আমিরালী তখন হুঙ্কার ছাড়লো—চোকের সামনে মারে মরতি দেকতি না চালি যা বলিচি তাই কর হারামজাদা।
ঘুরিয়ে ফিরিয়ে থেমে থেমে কয়েকবার বলার পরও পাথরদেহটা নড়লো না যখন, ভোঁতাস্বরে কথা আবার গলা বাড়ালো আমিরের হাতের লাঠিটা। মায়ের শরীর থেকে বেজে ওঠা সেই ঢোলবাজনায় নড়ে উঠলো আলতাফ। টনটনে ব্যথা এড়িয়ে টলতে থাকা পা দুটো একটু এগিয়ে গেলো মায়ের দিকে। তারপর নড়বড় একটা হাত উঠে এলো কাঁধ বরাবর। তখনই হঠাৎ কেঁপে উঠল মাটি—খবদ্দার বলে দিচ্চি আর এক পাও এগোবিনে! মা যেন রূপকথার ড্রাগন, মুখ খুললেই বেরিয়ে আসবে আগুনের স্রোত। চোখে তার সে আগুনেরই লাল আভা। দেখে ভড়কে গেলো আলতাফ। আর থমকে গেলো সময়। চারপাশে তীক্ষ্ণ চি চি আওয়াজ। নিপুণ শব্দহীনতায় যে শব্দটা ভরে রাখে পরিবেশ, সেই শব্দটাই ভরে তুলেছে আলতাফের কানদুটো। চোখের ভেতর টগবগ করে ফুটতে লাগলো বলক দিয়ে ওঠা ভাতের মাড়। তার ধোঁয়া ভেদ করেই স্পষ্ট হয়ে উঠলো আমিরের এক ষণ্ডা ভাঁড়ের মতো হাতপা নাচিয়ে সে এগিয়ে এলো, কাপড় খোলা তার খুব পছন্দের শখ। কিন্তু তাকে থামালো আমির। আলতাফের কাজ আলতাফই করবে। করানোর ব্যবস্থা তার জানা আছে।
চারপাশে গোল হয়ে দাঁড়ানো তার ছেলেরা। পেছনে দুই স্তরে জমে আছে উৎসুক লোকজন। তাদের কারও কারও মনে হলো, যা হচ্ছে তা হওয়ার কথা না। কারও কারও মনে হলো, যা হচ্ছে তা হতে দিতে নেই। কারও কারও মনে হলো, যা হচ্ছে তা দেখার সামর্থ্য তাদের নেই। কারও হয়তো এও মনে হলো, মত্ত আমিরকে থামানো দরকার। কিন্তু কেউই তারা সাহস পেলো না কিছু বলার। আবার তারা নড়লোও না। দাঁড়িয়ে থাকলো রাস্তার গায়ে সারবেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা কড়ই গাছের চারার মতো। তাদের মধ্যে কেউই হয়তো ভাবেনি যে এমন কিছুও ঘটতে পারে বাংলায়।
তখনই প্রশ্ন জাগলো, কিছুক্ষণ আগে ওকে ধাক্কাটা মেরেছিল কে? আমির ভেবেছিল মা-ই বোধহয় মেরেছে। কিন্তু না, সে তো পড়েই আছে। তাহলে? মাকে ছুঁতে ওকে নিষেধই বা করলো কে? আশে-পাশে তেমন কাউকে দেখাও তো যাচ্ছে না। দুবার চোখ কচলেও তাকে দেখতে পেল না আমির! তাহলে কি মায়ের অভিশাপ ফলে গেছে?
বাতাসি বেগমও তাদের দলের লোক। কাজের ছেলেটার কাছে এই বৃত্তান্ত শুনে তাই বিশ্বাস হয়নি তার। আম্বিয়া এসে বলতে লাগলেও তাকে তাড়িয়ে দিয়েছেন ধমক ধামক দিয়ে। তারপরই এগিয়ে এসেছেন আলতাফের মা স্বয়ং। ধরা গলায় তিনি বলে গেছেন আমিরের কুকীর্তির ফিরিস্তি। একবাজার লোকের সামনে তার ছেলেই যখন তাকে পরিয়ে দিলো লজ্জার বসন, সাতটা আসমান একসঙ্গে ভেঙে পড়েছিল তার ওপর! শুনতে শুনতে দুমড়ে মুচড়ে উঠলো বাতাসি বেগমের বুক। বুঝলেন, যে মানুষটাকে তিনি দেখেননি কোনোদিন, যার সঙ্গে তার লেনদেন নেই কোনো, তার কাছেই তার দায় জমে গেছে একপৃথিবী। নিজের ওপরই ঘৃণা জন্মালো তার। মনে হলো, এমন একটা কাজ যে করতে পারে, নিশ্চয়ই তাকে তিনি পেটে ধরেননি। যাকে ধরেছিলেন, সে আর কেউ। কদিন ধরেই যে আগুন লাগছে এখানে ওখানে, তার একটায় শুকনো পুরনো পাটকাঠির মতো পুড়ে সে ছারখার। বা পুড়ে মরার ভয়ে আকাশ সমান দালান থেকে লাফ দিয়ে পড়েছে নিচে, পড়তেই ফেটে চৌচির তার পাপের শরীর। অথবা ভেসে যাওয়া পচা লাশের মতো সে ভেসে গেছে গেলোবারের বন্যায়। কিংবা ছোটবেলায়ই সে মরে গেছে মুখ দিয়ে কালচে নীল পিত্তিরঙ রক্ত তুলতে তুলতে। এমনও হতে পারে তার জন্মই হয়নি। হলে তো সে তার ছেলে হতো। তার ছেলে হলে তার তো মানুষ হওয়ার কথা। না, হয় সে এ কাজ করেনি, নয় সে তার ছেলেই না! বকলেন বটে, কিন্তু পায়ের কাছে বসে হু হু স্বরে কেঁদে চলা মানুষটার বেদনাও ছুঁয়ে গেলো তাকে। তিনি বুঝলেন আমিরকে অস্বীকার করে দায় মেটানো যাবে না। কিছু একটা বিচার তাকেই করতে হবে। কিন্তু অনেক ভেবেও কোনো পথ এলো না মনে। হাতের বদলে হাত জানের বদলে জানের কথা শুনেছেন, তেমন কিছু হলেই হয়তো উপযুক্ত শাস্তি হতো এই অন্যায়ের। ভাবতেই টিক টিক টিক করে তাকে সমর্থন জানালো দেয়ালে আটকানো পোষা টিকটিকিটা। খুব কষ্টে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। খুলে ফেললেন শাড়িটা। অসুখের শেষ নেই। ওষুধে কাজ হচ্ছে না। গলায় তাই তাবিজ বাধা। শরীর শুকিয়ে কাঠি, শুধু বনের বাঁধনে আটকায় না শায়া। আলাদা ঘুনসি বাঁধা হয়েছে কোমরে। ওই মাদুলি আর ঘুনসিটুকুই লেগে আছে শরীরে। থাক, ওটুকু আর খুলে কাজ নেই।
সকাল। সোনাধোয়া রোদ উঠেছে। বাচ্চাটা কাঁদছে।
উঠোনে বসে আছে আমির। পাশে লোকজনের ভিড়। কেউ ব্যবসার কাজে, কেউ রাজনীতির প্রয়োজনে, কেউ নিছক সাহায্য চাইতে। আলতাফদের ঘামের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা দালানে রঙ চড়ছে। রঙমিস্ত্রিরাও আছে। বাড়িভর্তি লোক। দেখেই চুপসে গেলেন বাতাসি বেগম। এত লোকের সামনে কী করে দাঁড়াবেন তিনি বিনা কাপড়ে?
মাথায় লজ্জার আকাশ আর পায়ে দায়িত্বের পাহাড় বেঁধে তাই বসেই থাকলেন বিছানায়। দুচোখে দুটো ফুটন্ত পানির কড়াই নিয়ে ভাবলেন আকাশ পাতাল। আমির হওয়ার আগে থেকেই যত যন্ত্রণার সময় গেছে, সব আবার ফিরে ফিরে আসছে সেসব। ফুটতে ফুটতে বাষ্প হয়ে উড়ে যাচ্ছে মাকড়শার জালে ঢাকা পুরনো ঘুলঘুলি দিয়ে। বুকের ভেতর পাথর গড়ছে প্রতিটা শ্বাস প্রতি নিঃশ্বাস। তার ভার নিতে নিতে দম আটকে আসছে বাতাসি বেগমের। কুত্তাটা কাজে অকাজে বারবার ঘরে আসে। এলেই মাকে এভাবে দেখবে, দেখেই হাটফেল করে মরবে। মরুক। কিন্তু তার আসার নাম নেই। বার কয়েক ডাক দিলেন ছেলেকে—‘আসচি মা, আসচি মা’ বলে তবু বসেই থাকলো আমির। ক্ষোভটা তখন বাড়লো আরও। নাহ্ যেমন কুকুর তার তেমনই মগুর দিতে হবে। টলতে টলতে তাই বেরিয়ে এলেন বাতাসি বেগম। আসার আগে তাকে থামিয়েছেন হাওয়া বিবি। কাপড়টা নিয়ে জড়িয়ে দিয়েছেন গায়। দিতে দিতে বলেছেন—ছেলের শাস্তি দিতি হলি দেও, বু। কিন্তুক এই পাপ কোরোনে। এ লজ্জার কত যে তাপ, এ আগুন কতভাবে যে পুড়োয় তা আমি বুজিচি। দুয়া করি এর আঁচও যেন কারুর না লাগে আর।
তাই নতুন বিচার করতে হয়েছে হাওয়া বেগমকে। উঠোনে এসে দাঁড়িয়েই তিনি ঘোষণা করলেন সেই রায়—মরার পর আমার গায় য্যানো কাপন পরানো না হয়। এই শুয়োরডা পেটে ধরিছি, বুকির রক্ত পানি করে বড় করিছি, এত বড় পাপের শাস্তি তো আমার ভোগ করাই লাগবে। বিনা কাপনেই যেন আমার পুড়তি হয় দোজগে। অভিশাপ দিলেন, যে চোখ দিয়ে এই জঘন্য দৃশ্য দেখেছে, সে চোখ যেন আমিরের নষ্ট হয়ে যায়। যেন পচে যায় সেই জিব যা দিয়ে এই পাপকর্মের নির্দেশ দিয়েছে ও। বলতে বলতে খিঁচুনি উঠলো, কাঁপতে কাঁপতে পড়ে গেলেন। বহু পুরনো রোগ। চাগান দিলে যন্ত্রণার একশেষ। তবে আর বেশি ভুগতে হলো না। বার কয়েক ঘূর্ণিকাঁপন তুলেই স্থির হয়ে গেলো দেহটা। পড়ে রইলেন সটান। গোছালো দেহ, অগোছালো কাপড়।
ব্যাপারটা বুঝে উঠতে বাড়িভর্তি লোকের যতটা সময় লাগলো, হতভম্ব আমিরের লাগলো তারচেয়েও বেশি। বুঝতেই দুলে উঠলো পৃথিবী তার। মায়ের শরীরে চোখ পড়তেই নুয়ে গেলো মাথা। আর ছুটে গেলো পা। বুকের ভেতর একটা সমুদ্র্র যেন জেগে উঠেছে। ভীষণ ঢেউয়ে ভাঙছে পাড়। ভেঙে পড়ছে পাথরমাটির দেয়াল। আর ব্যথায় কুঁকড়ে যাচ্ছে আমির। এভাবে নেই হয়ে যাবে মা’টা তার! ভাবতে ভাবতে সে এগিয়ে গেলো দ্রুত। কিন্তু মায়ের কাছে বসতে যেতেই বুকে কে যেন ধাক্কা দিলো দুহাত দিয়ে। কানে এলো ঘৃণাভরা নারীকণ্ঠ—মাকে খবরদার ছুঁবিনে পাপীষ্ঠ তুই! ছিটকে যেতে যেতে হাতদুটো শরীরের পেছনে প্যালা দিয়ে পড়ে যাওয়া সামলালো আমির। পাদুটো ছড়ানো সামনে। সেগুলো গুছিয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়াতে হবে। এগিয়ে যেতে হবে। মার শরীর নিস্তেজ হয়ে পড়েছে। জ্ঞান হারালো, নাকি শ্বাস? বুকের কাছে আলগা হয়ে আছে কাপড়। ভেতরে ব্লাউজ পরেনি। কী লজ্জা! এত লোকের চোখের সামনে এই কাণ্ড! না, না, ঢেকে দিতে হবে। তারপর কোলে তুলে নিতে হবে শুকিয়ে যাওয়া বৃদ্ধমায়ের শিশুদেহটা। ছুটে যেতে হবে ডাক্তারের ঘরে। ভাবতে ভাবতেই খেয়াল করলো, কে যেন গুছিয়ে দিচ্ছে মায়ের আঁচল। হাঁটুর ওপর ভাঁজ হয়ে থাকা কাপড় টেনে গোড়ালি পর্যন্ত ঢেকেও দিলো এরপর। কিন্তু যে দিচ্ছে তাকে দেখা যাচ্ছে না। কেন? তখনই প্রশ্ন জাগলো, কিছুক্ষণ আগে ওকে ধাক্কাটা মেরেছিল কে? আমির ভেবেছিল মা-ই বোধহয় মেরেছে। কিন্তু না, সে তো পড়েই আছে। তাহলে? মাকে ছুঁতে ওকে নিষেধই বা করলো কে? আশে-পাশে তেমন কাউকে দেখাও তো যাচ্ছে না। দুবার চোখ কচলেও তাকে দেখতে পেল না আমির! তাহলে কি মায়ের অভিশাপ ফলে গেছে? অন্ধ হয়ে গেছে আমির? জিবটাও কি অকেজো? সেটা জানতেই চিৎকার করে উঠলো এরপর—এ আমার কী হয়ে গেলো, মা!
কেউই যদিও শুনতে পেলো না তা। না লোকজন, না আমির নিজেও।