—আল্লার গজব পড়বো না তো কী হইবো? দেশে মড়ক লাগসে এরমধ্যেও বেশ্যাগুলার কিড়কিড়ানি কমে নাই!
শায়লা সুলতানার কৌতূহল হয় রাহেলা খালার গজগজ শুনে। কিন্তু কিছু বলে না। কাজের বুয়াদের পার্টটাইম কাজ হচ্ছে বাসাবাড়ির ঘর ঝাড়মোছা করা, থালাবাসন-হাড়িপাতিল ধোয়া, কাপড় ধোয়া, রান্নার কুটাবাছা করা। আর ফুলটাইম কাজ হচ্ছে গসিপ করা। এখন এই মহিলাকে ‘কী হয়েছে’ প্রশ্ন করলেই আরও একহালি বাসাবাড়ির হাড়ির খবর রসিয়ে রসিয়ে বলতে শুরু করবে। তা করুক।, শায়লার নিজেরও ওসব গসিপ মন্দ লাগে না। কিন্তু, তার আগে সকালের এঁটো বাসনগুলো পরিষ্কার করিয়ে নেওয়াটা জরুরি।
শায়লা সুলতানার তাড়ায় রাহেলা বেগম তখন আর কথা বলতে পারে না। বাসনটাসন মেজে দ্রুত ফিরে এসে বিস্তারিত বলতে শুরু করে। ঘটনার সারমর্ম হচ্ছে, রাহেলা বেগম রোজকার মতো ভোরবেলায়ই বিল্ডিংটায় চলে এসেছে যখন, তখনই খেয়াল হয় চাদর দিয়ে মুখটুখ ঢেকে এক ‘ব্যাটামানুষ’ পলিথিন ব্যাগ হাতে নিয়ে গলির শেষমাথার দিকে যাচ্ছে। এই চান্দিফাটা গরমের মধ্যে কোন পাগলে আর চাদর পেচিয়ে বেরোবে? রাহেলা বেগমের তখনই সন্দেহ হয়, নিশ্চিত কোনো গড়বড় আছে। তাই সে ব্যাটালোকটার পেছন পেছন গিয়ে দেখে এসেছে। সে যেই পলিথিনটা নিয়ে ডাস্টবিনে ফেলে এসেছে, তা একটা অপরিণত মানবভ্রূণ। আল্লাহ কি এসব দেখে না? এইসব আকাম কুকাম করে বেড়ায় বেশ্যা মাগীরা, পেট বাঁধলে বাচ্চাগুলাকে জন্মের আগেই পেট থেকে বের করে ফেলে দেয়, আল্লাহ তো এজন্যই গজব দেয়।
—তুমি জিনিসটা চিনলে কিভাবে খালা? শায়লা সুলতানা প্রশ্ন করে। ভ্রূণ দেখতে কেমন, তার আবছা ধারণা আছে তার। কিন্তু দেখলে চিনবে কি না, তা নিশ্চিত নয়।
—আরে আম্মা, আমগো বস্তির জরিনির মা করে এই কাম। পেট খালাস করতে বড় বড় মাইনষেও আসে বস্তিতে। এই জিনিস বহুত দেখসি।
শায়লা সুলতানার মনে পড়ে, এই জরিনির মায়ের কথা সে আগেও শুনেছে। আরও মনে পড়ে, গতরাতেই তিনতলার সায়মা ভাবী ম্যাসেঞ্জারে বলেছিল, এবোরশন করায় বস্তির যেই মহিলাটা, তাকে নাকি এই বিল্ডিংয়ে ঢুকতে দেখেছে। শায়লা তখন মাথা ঘামায়নি। রাতের বেলায় তিন তলার জানালা দিয়ে কাউকে ঠিকঠাক চেনা যায় নাকি! আর এই বিল্ডিংয়ে এবোরশন করবেটাই বা কে! কিন্তু এখন তো নিশ্চিত, এই বিল্ডিংয়েই কেউ একজন এবোরশন করিয়েছে। ম্যাসেঞ্জার আর হোয়াটস অ্যাপের কল্যাণে এই খবর পুরো বিল্ডিংয়েই ছড়িয়ে যায় দুপুরের মধ্যে। আর দুপুরের পরেই দেখা যায় চার তলার তুপাকে তার স্বামী কোলে করে অ্যাম্বুলেন্সে তুলছে। অ্যাম্বুলেন্সটা তখন গেটের বাইরেই দাঁড়ানো। তুপার শাড়ি রক্তে ভিজে গেছে একদম।
চার মাস আগে তুপার স্বামী আর বাচ্চা দুটোর করোনা পজিটিভ আসার পরেই বিল্ডিংটা লকডাউন করে দেওয়া হয়েছিল। গতমাসে মাত্র খুলেছে। তুপারা অবশ্য হোম কোয়ারেন্টাইনেই ছিল, হাসপাতালে রাখেনি কাউকে। তুপার স্বামী আর বাচ্চা দুটো অবশ্য সুস্থও হয়ে গেছে। কিন্তু তুপার এরমধ্যে একবারও কোনো অসুখ করেনি। করোনা নেগেটিভই ছিল পুরো সময়। তা ওরা এবোরশন করালো কেন! যাক করেছে করেছেই; হাসপাতালে নিয়ে করতে পারতো। এখন কী একটা কাণ্ড করলো বদনাম হয়ে যাবে পুরো বিল্ডিংয়ের।
শায়লা এসে সায়মাকে টেক্সট করে ম্যাসেঞ্জারে, ভাবী কাণ্ড দেখেছেন?
সায়মা ভাবীও অনলাইনেই ছিলো, হ্যাঁ দেখলাম তো। জানেন তো না ভেতরের খবর।
ভেতরের খবর জানার আগ্রহ না দেখিয়ে তো ফায়দা নেই। কাজেই শায়লা খুব আগ্রহ নিয়ে ভেতরের খবর জানতে চায়। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সায়মা ভাবী হোয়াটসঅ্যাপে কল দেয়। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে সায়মা ভাবীর উত্তেজিত গলা শোনা যায়, আরে ভাবী! বাচ্চাটা তো তুপার জামাইয়েরই না। আরেক লোকের।
ও শুধু রঙ দেখছে। তুপার কমলা রঙের শাড়িতে লাল লাল রঙ। রক্তের রঙ।
অবাক হয়ে যায় শায়লা, সে কী! এই লকডাউনের মধ্যে কীভাবে? মানে বাইরের কেউ তো ঢোকেই নাই এরমধ্যে। ওর জামাইও তো বাড়িতেই।
সায়মা ভাবী এবার নড়েচড়ে বসে। সম্ভবত। শায়লা কল্পনায় দেখতে পাচ্ছে, সায়মা ভাবী শুধুশুধু কপালের সামনের এক গোছা চুল আঙুল দিয়ে প্যাঁচাচ্ছে, আরে, আমার ননদরা যখন আসলো না ঘুরতে, লকডাউনের আগে; তখনই তুপাকে দেখসিল। আমার ননদের জামাই তো ডাক্তার। ওরাই জানাইলো ঘটনা। তুপার তো করোনা হয় নাই ঘরের মধ্যে তিন তিনটা রোগী থাকতেও। এইজন্যই নাকি হাসপাতালে কী কী চেক আপ করে দেখসিল ওর।
শায়লার অবশ্য এসব ঘটনা অজানা না। তারপরও সে ধৈর্য ধরে শুনতে থাকে। সায়মা ভাবীর স্বভাবই এইরকম৷ আগের বৃত্তান্ত সব ত্যানা পেচিয়ে না বলে আসল ঘটনা বলতেই পারে না।
—হ্যালো? ভাবী শুনছেন?
—হ্যাঁ হ্যাঁ ভাবী শুনছি। বলেন, তারপর?
—হ্যাঁ। ওই তো! তারপর নাকি দেখে ওর কী একটা আলাদা এন্টিবডি আছে। যেইটা নাকি আর মানুষের নাই।
—কী বলেন! তাইলে তো ওরে নিয়া গবেষণা হওয়ার কথা!
—তাই তো হইসে ভাবী। হাসপাতালে ছিল না কয়দিন? ভুলে গেসেন? তখনই নাকি ওরে বলসে একটা বাচ্চা নিতে। বাচ্চাদের থেকে নাকি এন্টিবডি না কী জানি ওইগুলা সহজে পাওয়া যায়।
এ পর্যন্ত বলে সায়মা থামে। শায়লার হিসাব মেলে না।
—তাইলে ওর বাচ্চা দুইটার করোনা হইলো কিভাবে?
—আরে সেইটাই তো ঘটনা। ওরা যাওয়ার আগের সপ্তাহে নাকি আরেক লোক আসছিল ফ্যামিলি নিয়া। ব্যাটার বউবাচ্চার করোনা, কিন্তু ব্যাটা একদম ফিট। পরে পরীক্ষা করে দেখসিল ওই ব্যাটারও ওই এন্টিবডি আছে। এইজন্য হাসপাতালের সিনিয়র কোনো ডাক্তার বলসিল তুপাকে ওই লোকের বাচ্চা নিতে। তাইলে নাকি বাচ্চা ইমিউন হবে।
ইমিউন কী জিনিস, তা নিয়ে শায়লা মাথা ঘামায় না। তার কান ঝিমঝিম করছে। ছিঃ ছিঃ। হোক ডাক্তারি পরামর্শ। তাই বলে অন্য পুরুষের বাচ্চা পেটে নেবে?
শায়লার সঙ্গে একমত হয় সায়মাও। তুপার স্বামীর জন্য সমবেদনা প্রকাশ করে দুই জনই।
তুপা তখন অর্ধচেতন অবস্থায় বিড়বিড় করছে অ্যাম্বুলেন্সে। তার দুই ছেলেই বাসায় রেখে এসেছে। তুপা তখনো বলছে, বিশ্বাস করো, বাচ্চাটা তোমারই।
তুপার স্বামী, আরাফাতের মুখ সাদা হয়ে গেছে এত রক্ত দেখে। দুই মাস আগে যখন তুপা তাকে বাচ্চাটার কথা জানায়, তখনই তার সন্দেহ হয়। তুপা নিশ্চয়ই ওই প্রফেসরের কথায় ইমিউন বেবি প্রোজেক্টটায় রাজি হয়েছে। বাচ্চাটা নিশ্চয়ই আরাফাতের না। আরাফাতের মনে পড়ে, প্রফেসর যখন ওদের প্রস্তাব দিয়েছিল; তখন আশ্বস্ত করার চেষ্টা করে বলেছিল তুপার সঙ্গে ওই ছেলের কোনো যোগাযোগই হবে না। ওই ছেলের থেকে আলাদা করে শুক্রাণু সংগ্রহ করে এনে তুপার গর্ভধারণটা করানো হবে। তুপাও নিমরাজিই ছিল। আরাফাতকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিল, ওর একটা বাচ্চা জন্ম দেওয়ায় যদি এই মহামারীতে অনেক মানুষের জীবন বাঁচানোর ভ্যাক্সিন বানানো যায়, তাহলে ক্ষতি কী? আরাফাত মানতে পারেনি৷ না হোক যোগাযোগ, না হোক কোনো শারীরিক সংস্পর্শ, তবু তার স্ত্রী কেন অন্য পুরুষের শুক্রাণু দিয়ে গর্ভধারণ করবে? তুপা যদিও সেখানে না করে দিয়েছিল, মুখ অন্ধকার করে। কিন্তু হাসপাতাল থেকে ফেরার দেড় মাস পরে যখন ও জানায় ও প্রেগন্যান্ট। আরাফাতের মনে বদ্ধমূল হয়ে যায়, বাচ্চাটা ওই প্রোজেক্টের বাচ্চাই। অনেক খোঁজখবর করে ওই মহিলাকে তাই নিয়ে এসেছিল আরাফাত। প্রায় তিন মাসের ভ্রূণ৷ অতিক্ষুদ্র মাংসের দলা। আরাফাতের মায়া হয়নি। এখনো হচ্ছে না।
ও শুধু রঙ দেখছে। তুপার কমলা রঙের শাড়িতে লাল লাল রঙ। রক্তের রঙ।