তাঁর ঘাম পিছলে শরীরে তখন শ্বেতবিন্দুর মতো ফোঁটা-ফোঁটা জলের ধারা। পা দুটোও ক্লান্ত; বয়সের ভারে কেবলি থেমে যেতে চায়। তবু নাতীনকে ধরার জন্য মইজদ্দিন মণ্ডল ব্যতিব্যস্ত। সাধ্যের সীমারেখা অতিক্রম করে বেচারা দৌড়ায় আর দৌড়ায়। দৌড়ের ফাঁকে মুখ থেকে এক-একবার খসে পড়ে বিচিত্র সব শাসানি, ওই রতন ওই, দাঁড়া কচ্চি; তা না হলি কপালে বোল জবর বেমত্তি আছে। তোর চৌদ্দগুষ্টিও আমার হাততি বাঁচাতি পারবেনানে, জিব টানি বের করি ফেলবুনে। শালা ইতর কনেকার!
রৌদ্রের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে বাম হাতে লুঙ্গি সামলিয়ে থেমে-থেমে দৌড়ায় সে। কিন্তু রতনের গতির সাথে কিছুতেই পেরে ওঠে না। অস্পষ্ট স্বরে আর্তনাদ করে, দ্যাক, আমি আর পাচ্চিনি বোল; জানে সয্যু হচ্চেনা। ইবার এট্টু থাম।
বস্তুত: মণ্ডলের খিটমিটে মেজাজ; বিগড়ে গেলে আর রক্ষে নেই; লাঠি হাতে আদরের নাতিনকে তাড়া করে। অবশ্য রতনও কম যায় না; পারলে কথার তীরে দাদুর মেজাজ সপ্তমীতে চড়িয়ে দেয়, ক্যানে দাদা, থামতি বুলছু ক্যানে, আমাক ধরবা না; কেরাম পারো ধরো দেকি; দেকি তুমার কোমরে কেরাম জোর আচে!
চলার গতি খানিকটা কমিয়ে রতন পুনরায় বলে, বুজলি দাদা, আমাক ধরা অতো সহল না; তুমার বাপ আলি’উ ধত্তি পারবে না।
নলখাঁগড়ার বন পিছনে ফেলে অবশেষে ওরা মাঠের পথ ধরে; ফসলহীন বিস্তীর্ণ মাঠ, সবুজের চিহ্ন পর্যন্ত নেই। বাউলের ক্ষ্যাপা চুলের মতোই রৌদ্রের উথাল-পাথাল ঢেউ। উত্তপ্ত ধুলিকণা; খাঁ-খাঁ প্রান্তরে রৌদ্র-কুয়াশা। রতনকে ঝাপটে ধরে মইজদ্দি মণ্ডল হাপানি রোগীর মতো হাঁফায়। শরীর বেয়ে চুয়েপড়া ঘামের জলে তার ক্ষোভও খানিকটা স্তিমিত হয়। লাঠির অগ্রভাগে থুঁতনি রেখে রতন জানতে চায়, আইচ্চা দাদা, তুমি বোলে আমাক খুব পিয়ার করো; আমার জন্যি নাকি পরান কাঁন্দে!
রতনের কথা শেষ হওয়ার আগেই মইজদ্দিনের পুরাতন ক্ষোভ নতুন করে আবার মাথাচাঁড়া দিয়ে উঠতে চায়, তথাপি ঠাণ্ডা মাথায় সজাগ দৃষ্টিতে নাতিনকে জিজ্ঞেস করে, কে, তাতে কি হয়িচে; তুই আবার এসব উৎফান্দি কতা শুদ কচ্চি ক্যান?
কাপাল হতে চুঁয়ে-পড়া ঘাম বামহ,তে দিয়ে মুছতে-মুছতে রতন তার দাদাকে নতুন আরেকটি পরামর্শ দেয়, কি আর হবে; বুলচি , উত্তরের মাটের ওই জমিডা তুমি আমার নামে লেকি দেও। তালি সপ ন্যাটা মরি যাবেনে। জমির লাগি কেউ আর তুমার উঁতুজ্বালা করবে নানে। দেকবা পানির নাকাল সপ ঠাণ্ডা হয়ি গিচে।
যত ঝামেলা ঐ একখণ্ড জমি নিয়ে; দখল নিতে যে যার মতো মরিয়া। একটার পর একটা কাহিনি; তার শান্তির সংসারে অশান্তি সুর। জমি নয়; সবাই যেন মইজদ্দিনকেই গ্রাস করতে চায়! আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে যোগ হয়েছে প্রতিবেশীরাও। সুযোগ পেলেই হাসিঠাট্টা করে; জমি বিষয়ক কথা বলে অকারণে মাথার চাঁন্দি গরম করে দেয়। কিন্তু এসব তামাশা তার অসহ্য লাগে। অল্পতেই মুখ ফসকে বেফাঁস কথা বেরিয়ে পড়ে। পেপুল্টি পাতার রসে আগে যাও বা কাজ হতো এখন আর হয় না।
দিনের আলোয় তার চোখে রাতের আধার নামতে শুরু করে। কতদিন, কতরকম করে ছেলেদের বুঝিয়েছে কিন্তু বাবার কথায় কারও আস্থা নেই। স্ব-স্ব অভাব-অভিযোগের পক্ষে অকাট্ট যুক্তি নিয়ে উপস্থিত হয়।
জমির দখলস্বত্ব প্রমাণের জন্য বড় ছেলে ইতোমধ্যে বাঁশের মাথায় লাল পতাকা উড়িয়ে দিয়েছে। মেজ লাগিয়েছে ইপিল-ইপিলের চারা; বৃক্ষরোপণের গুরুত্ব বোঝাতে বাবার দরবারে নানামুখী আলোচনা। স্কুলপড়ুয়া নাতীর মুখে ভূমিকম্প, কার্বন-ডাই-অক্সাইড, সমুদ্রের পানিতে জমিন তলিয়ে যাওয়া কথাগুলো মইজদ্দিন ঠিকঠাক বুঝতে পারে না। মনে হয়, জমি হাতাতে এসব নিত্য-নতুন ফন্দি-ফিকির!
বৈষয়িক জ্ঞানের অপবাদ থাকলেও হাতগুটিয়ে বসে নেই ছোট শফিকুল। কারণে-অকারণে বেচারা জমির ওপর পায়চারী করে;পাঠকাঠির সাহায্যে জমি মাপজোঁক করে।তার বুকের মধ্যে উত্তেজনা; উত্তরের জমিনটা যদি সত্যি-সত্যি হাতছাড়া হয়ে যায়!
দুই.
মণ্ডলের চিন্তা চেতনায় ইদানিং সম্ভাবনার নতুন-নতুন ইঙ্গিত পাখা ঝাঁপটায়।চাল-চলনেও আমূল পরিবর্তন।আগের সেই একরোখা ভাব আর নেই; বরং পলিমাটির মতো মসৃণ জীবনাচার। মনে হয়, ঈদের নতুন পোশাক পরিহিত শিশুর মত উৎফুল্ল যেন-বা! কদাচিৎ খেতে ভুল হলেও মসজিদে যেতে ভুল হয় না। গভীর রাতঅব্দি খোদার দরবারে দু-হাত তুলে আরবী-বাংলা মিশ্রিত দীর্ঘ মোনাজাত করে; চোখের কোন বেয়ে নেমে আসে সুরমামিশ্রিত নোনাজল। আগে কাঁদতে পারতো না, অথচ এখন অল্পতেই চোখের পাতা ভারী হয়ে ওঠে। ঝাপসা দৃষ্টিতে ছোট-খাট ভুলগুলো বড় হয়ে ধরা দেয়। পরিবর্তনের এই স্রোত ছেলেদের মধ্যেও। বাবার পিছু-পিছু ওরাও মসজিদমুখী। হঠাৎ-হঠাৎ পা ছুয়ে ছালাম করে; দোয়া চায়। বৌ-ঝিদের মুখ তো আজকাল চোখেই পড়ে না। পর্দার আড়াল থেকে ভেসে আসে মোলায়েম সব সুর; চুড়ির টুং টাং আওয়াজ।
ছোট ছেলেটা আজম্মের রোগা; তার শীর্ণকায় দেহাভ্যন্তরে জীবাণুদের অবাধ বিচরণ। গলায় ঝোলানো তাবিজগুলো যেন বাড়তি বোঝা! মাঝে মধ্যে আকাশের পানে দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে থাকে; বিড়বিড় করে কি সব আওড়ায়। এ নিয়ে মইজদ্দিন মণ্ডল খুবই চিন্তিত। ছেলেটি কি শেষ পর্যন্ত পাগল হয়ে যাবে!
লক্ষণ ভালো না; সেদিন গঞ্জ থেকে ফেরার পথে বাঁশঝাড়ের মধ্যে দেখা, ওপরে দুহাত তুলে শফিকুল দণ্ডায়মান ছিল। কোনো সাড়া-শব্দ নেই, বদ্ধ জলাশয়ের মতো ধীর-স্থির, শান্ত। বেচারা কি ঘুমিয়ে পড়েছে! অবশ্য ছোটবেলা থেকেই তার চোখ-খুলে ঘুমানোর অভ্যাস। মণ্ডল মোলায়েম সুরে ছেলেকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করে, বিটা, ও-বিটা, তুমি কি ঘুমি গিয়ুছু; দেকোদিনি কিঅসেলি কাণ্ড, তা বাড়ি থাকতি তুমি এই জঞ্জলে ঘুমাবা ক্যানে!
আড়মোড়া শফিকুল ভেঙে দ্রুত সজাগ হয়ে ওঠে। বাবাকে দেখে খানিকটা ঘাবড়ে যায়। মাথা চুলকাতে-চুলকাতে উত্তর দেয়, না না আব্বা, আমি ঘুমাইনি তো!
কও কী; তালি কি কইচ্চু একেনে!
কী আর কোরবু, আল্লার সাতে কতা বুলতিছিলাম। তিনার সাতে কতা বুল্লি নাকি যা চাওয়া যাই তাই পাওয়া যায়।
ও, তাই নাকি; তা তুমি এতুখুন কী চাইলি বিটা, উত্তরের ওই জমিডা নাকি?
শফিকুলের মুখ দিয়ে হ্যাঁ কিংবা না কোনোটাই প্রকাশ পায় না। মাথা নুঁয়ে দাঁড়িয়ে থাকে কেবল। মইজদ্দিন মণ্ডল আরেকটু সরে এসে ছেলের আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে। আহা শরীরের কাঠামোগুলো, দিন-দিন দৃশ্যমান হয়ে উঠছে! বেশভূষায় ক্লান্তির বলিরেখা।
নিজের মাথায় আঙুল নির্দেশ করে চোখের ইশারায় ছেলের কাছে মণ্ডল জানতে চায়,তা তুমার টুপি কুথায়,বিটা?
শফিকুল দ্রুত নিজের মাথায় হাত দেয়,কিন্তু সত্যি-সত্যি টুপিটা নেই! অবাক হওয়ার ভঙ্গিতে বলে, ওম্মা, আমার টুপি গ্যাল কনে; এট্টু আগেই তো মাতায় দিছালাম!
এদিক-ওদিক খোঁজাখুজি করে, দুইপকেট হাতড়িয়ে টুপির কোন হদিস না পেয়ে শফিকুল বাধ্য ছেলের মতো বাবাকে জানায়, আব্বা, টুপি মনে হয় বাসাতি উড়ি গিচে।
ছেলের উপর বিরক্ত হয়ে মুখ ভেংচি কেটে মণ্ডল গজ-গজ করে, কও কি, টুপি উড়ি গিচে; তালি তুমিউ তো করে উড়ি যাবা! যাক ভালুই হলু, তুমার মুরুদ আমার বুজা হয়ি গিচে। একুন তি ওই জমির কতা তুমি ভুলি যাউ। যে লোক মাতার টুপি সামলি রাকতি পারেনা সে জমি সামলি রাকপে কেরাম করি?
শফিকুল আর স্থির দাঁড়িয়ে থাকতে পারেনা; আচমকা বাপের পা জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি করে, এরাম কতা কয়ুনা আব্বা; ওই জমি না পালি আমি যে বাঁচপো নানে। ওই জমির লাগিই তো য্যাতো…
শফিকুলের কথা শেষ হওয়ার আগেই মইজদ্দি গর্জে ওঠে, ওই হারামির বাইচ্চা থামলি ক্যান; ক, ঠিক করি ক। জমির লাগিই য্যাতো নামায-কালাম পড়া, তাইনা; বেকুব কনেকার! আরে, তুই কি এট্টা মুনিষ্যি হলি! তোক আমার ছেলি বুলতিউ ঘিন্না হচ্চে।
বাদ এশা বড় ছেলে রিয়াজদ্দিনের আগমন। হাঁটু গেড়ে বাবার পা ছুঁয়ে কদমবুসি করে পাশে বসে থাকে। মাঝে-মাঝে ধীরলয়ে দরুদ আওড়ায়। মইজদ্দিন স্থির দৃষ্টিতে ছেলের এসব নতুন কর্মকাণ্ড লক্ষ করে। আড়ষ্ট কাটাতে গলা খেঁকাড়ি দিয়ে রিয়াজদ্দিন বাবাকে জিজ্ঞেস করে, আব্বা, আমাক নাকি তুমি তালাশ করুচু। কিচু বুলবা নাকি?
কিছুক্ষণ দম ধরে থেকে মইজদ্দি মণ্ডল ঘাড় নাড়ায়, হয় গো বিটা; আমি আর কদ্দিন, আজকাল নিশিরাতি তুমার মার ডাক শুনতি পাই। তাই ভাবচি…
কী এত ভাবচু আব্বা?
ভাবচি বড় ছ্যালি হিসাবে জমিডা তুমারি পাওনা হয়। ছোটকালে তুমার দাদা আমার শখ করি ওই জমিডা দিছূলু। বড্ডা পিয়ারের জমিরে বাপ! পাশে যায়ি দাঁড়ালি একুনু তিঁনাগের সুরত ভাসি ওঠে। মনে হয় আমার লাগি তিঁনারা অপেক্ষা কচ্চে।
বাবার অনুভূতি রিয়াজদ্দিনকে বিন্দুমাত্র স্পর্শ করে না। তার চোখে-মুখে আলোর দিশা। খুশির উচ্ছ্বাসে পুনরায় বাবার পা ছুঁয়ে কদমবুসি করে, আল হামদুলিল্লাহ; হককতা বুলুছ আব্বা। আমি জানতাম হকমারা লোক তুমি না, জমিডা আমাকিই দিবা। আল্লা তুমার হায়াৎ দারাজ করুক।
ঘোমটার আড়াল থেকে ভেসে আসে ছোট বউমার রুঢ় কণ্ঠস্বর, এইডি আব্বা অন্যায়। এই বয়াসি এরাম একখান হারামির মতোন কাজ কত্তি পাল্লি; তুমার তো দেকছি গোরেউ জাগা হবে না!
মইজদ্দিন মণ্ডল বিচলিত না হয়ে দাঁড়িতে হাত বুলাতে-বুলাতে জিজ্ঞেস করে, কুনডার কতা বুলছু গো মা?
উত্তর দিতে গিয়ে ছোট বউ এর গলা ভারী হয়ে আসে, তুমার ছোট ছাওয়াল পাগল-ছাগল মানুষ। জমিডার দিক চোখ করি তাকি ছিলু। আহা, জমিডা দিলি চড়া দামে বেচতি পাত্তাম।
মইজদ্দিন মণ্ডলের মনে খানিকটা হতাশার সুর, উর লাগি তো য্যাতো চিন্তারে মা!
ক্যান আব্বা, চিন্তার আবার কী হলু?
ক্যান আবার,ও মলি তুমি তো নিকি করবা; তকুন ছেলিমেয়িগুনির কী হাল হবে, উগেরে কিডা দেখপে?
ছেলেমেয়ের জন্য চিন্তা হলেও তার নিজের জন্য বিশেষ কোনো চিন্তা নেই। মেজাজ ভালো থাকলে সুর করে দোয়া-দরুদ আওড়ায়। পথচলতি মানুষের সঙ্গে টুকটাক ভাব বিনিময় হয়। পুরানো দিনের গল্পে হারিয়ে যায়। বিশেষ-বিশেষ দিনে তার আঙিনায় উপচেপড়া ভিড়; মেয়ে-জামাই, নাতী-নাতনিদের পদচারনায় মুখরিত। দুর্বল মুহূর্তে বাবার সান্নিধ্যে মেয়েগুলো কান্নাকাটি করে। আর ঐ কান্নার সাথে বেরিয়ে আসে তাদের ক্ষোভ-আক্ষেপ; অভাব-অভিযোগ। মণ্ডল অসহায় ভঙ্গিতে মেয়েদের জিজ্ঞেস করে, ওমা, তুরা এরাম করি কানচি ক্যান; তোগের আবার কি হলু?
নাকি কান্নার ফাঁকে-ফাঁকে মেয়েরা উত্তর দেয়, মার লাগি কানচি; মা থাকলি কি আর আমাগের ভাগ্যু এরাম মন্দ হতু? যার মা নি দুনিয়ায় তার কেউ নি।
ভিড় কমলে বড় মেয়েটা বাবার কাছে গোপনে বায়না ধরে, এট্টা কতা আব্বা, আমা ছকিনার বি’র বয়াস তো পিরাই হয়-হয়; দুদিন পর’ই শউর বাড়ি চলি যাবে। তা তুমার যা অবস্থা, আল্লা নিলি কতক্ষুন; তাই বুলতিছিলাম…
মইজদ্দিন মণ্ডল কথার অর্থ বুঝতে পারে না; মেয়ের মুখের পানে কৌতূহলী দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। ফুলঝরি তখন এক নিঃশ্বাসে নিজের আবেদন পেশ করে, ছকিনার খুব শখ, তুমার দিয়া একখান ঘড়ি পরবে। হাজার হোক নানার স্মৃতি; তুমি মরি গেলি চায়ি-চায়ি দেখপে আর কাঁনবে।
মইজদ্দিন দরদভরা দৃষ্টিতে নাতনির পানে তাকায়। কিন্তু নাতনির চোখ তখন অন্যপথে; হয়তো লজ্জা আড়াল করতে মেয়েটি ব্যতিব্যস্ত।
এক টুকরো জমি নিয়ে ঘটনার পর ঘটনা; শুরু হয় নানা প্রসঙ্গের অবতারণা। মণ্ডল পরিবারের আঙিনায় অশান্তির কালো মেঘ উড়াউড়ি করে। মেজ আর ছোট মসজিদমুখী হয় না; নামাজ কালামও ছেড়ে দিয়েছে। সারাক্ষণ কি সব গোপন শলা পরামর্শ করে। আজ পর্যন্ত এ বাড়িতে খুন-খারাবি হয়নি। কিন্তু এবার কি সেটাই হয়?
মইজদ্দিন মণ্ডল আনমনে মাথা ঝাঁকায়।
বড়ই চিন্তার বিষয়। বাতাসের বুকে কান পাতলেই আওয়াজ শোনা যায়; অন্দর মহলে ঝড় বইছে। বউদের মধ্যে স্পষ্ট বিভাজনের ইঙ্গিত। কেউ কাউকে ছেড়ে কথা বলেনা। দু-দিন পর হয়তো পুকুর-ঘাট পর্যন্ত গড়াবে। উড়ো সংবাদ মুখে করে রতন ছুটে আসে। তার সারামুখে আতঙ্কের জলছাপ, সব্বনাশ দাদা; জব্বর একখান খবর!
নতন করি আবার কি খবর আনলিরে,রতন?
হাঁফাতে-হাঁফাতে রতন বলে,দড়ি হাতে করি মাজি চাচা আর চাচি আমগাছে বসি আছে যে!
রতনের কথাটা মণ্ডল ঠিকঠাক বিশ্বাস করতে পারে না।মনে হয়, ছেলেটি তাকে মিথ্যে বলছে। তাই রসিকতা করে বলে, ও, তাই নাকি? তা উরা মাগি-মিনষি কি ঝোলোই খাবে!
রতন তার কথার গুরুত্ব বোঝাতে মাথার দিব্যি দেয়, না না, ঝোলোই খাবে না; উত্তরের জমিডা না দিলি নাকি আত্মহত্যা করবে।
খুবই ভয়ানক সংবাদ। মণ্ডল আর শুয়ে থাকতে পারে না, পিঠ সোজা করে বিছানার ওপর উঠে বসে। হৃদয়ের গভীরতম প্রদেশে যেন ভূমিকম্প অনুভূত হয়। বুক চাপড়াতে-চাপড়াতে বাগানের দিকে ছুটে যায়।
তিন.
জীবনের সরল সমীকরণ একটু-একটু করে জটিল হতে শুরু করে। নিজ হাতে গড়া সংসারে মইজদ্দিন আজ নিজেই পরবাসী। কোথাও কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। কেবলি ভাঙনের সুর। তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে যেদিন তার যৌথ পরিবার ভেঙে গেল, যেদিন একটা চুলার পাশে আরো কয়েকটি চুলা নির্মিত হলো সেদিন খুব কষ্ট পেয়েছিল। দিন-কয়েক চোখের পানি ধরে রাখতে পারেনি। খুঁটিতে হেলান দিয়ে নীরবে চোখের জল ঝরিয়েছে।
হাসিখুশি ভরা মানুষটার মধ্যে রাজ্যের বিষণ্নতা। সারাক্ষণ চুপচাপ; কারও সঙ্গে কথা নেই। নিজের মধ্যেই নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করে। অথচ বেচারা তখনো জানতো না তার জন্য আরও বড় আঘাত ওঁত পেতে বসে আছে। অবশ্য কিছুদিন থেকেই বিষয়টি নিয়ে কানাকুষা চলছিল, উত্তরের মাঠে নাকি আর চাষাবাদ হবে না; সেখানে মিল ফ্যাকটরি গড়ে উঠবে।
হুট করে একদল সাদা চামড়ার মানুষ একদিন ভুবনডাঙার মাটিতে উপস্থিত হয়। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে তারা জমিনের মাপজোঁক করে, মাটি পরিক্ষা করে, বিচিত্র সব চিত্র আঁকে। ঐ দৃশ্য দেখতে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে গ্রামের নানান শ্রেণীর মানুষ একত্রিত হয়েছিল। তাদের মুখে কোন কথা ছিল না, বোবাদৃষ্টিতে কেবল দেখছিল আর ভাবছিল, এসব কী হতে চলেছে!
আধভাঙা বাংলায় লোকগুলো বোঝাতে চেয়েছে,যা কিছু হচ্ছে সব নাকি এলাকার মঙ্গলের জন্য! কারখানা নির্মিত হলে রাতারাতি গ্রামের চেহারা বদলে যাবে। কোনো মানুষ কর্মহীন থাকবে না। এখানে চাকরি করে সবাই সচ্ছল জীবনের মুখ দেখবে। ছেলে-মেয়েরা লেখাপড়া শিখে মানুষের মতো মানুষ হবে। হারিকেনের টিমটিমে আলোর পরিবর্তে বিজলীবাতির আলোর ঝলকানিতে চোখ নাচবে। বৃদ্ধ মানুষগুলোকে নিয়ে আর চিন্তা করতে হবে না; বৃদ্ধাশ্রম গড়ে উঠবে। পায়ের ওপর পা তুলে তারা আমৃত্যু খেতে পারেবে। আরও অনেক-অনেক কথা শুনিয়েছিল কিন্তু ঐসব কথা কারো মন ভরাতে পারেনি। উপরন্তু শঙ্কার নানামুখী আশঙ্কা দৃশ্যপটে হাজির হয়। মইজদ্দিন মণ্ডল উদ্যোগী হয়ে আশাহত মানুষগুলোকে আশার কথা শুনিয়েছে, ওই মিয়ারা কলি’ই হলু না কি; জমি কি ছেলির হাতের মুয়া নাকি যে চালি’ই দি দেবো?
না দিলে কি উরা শোনবে? দেইকু ঠিক একদিন দকল করি নেবে।
অউরা দকল করবে আর আমরা বসি থাকপো, তাই না? জীবন দি হলিউ ওই জমি আমরা বেহাত কোরবু না।
মইজদ্দিন একা না; সব কৃষকের এক কথা- কিছুতেই তারা জমি হাতছাড়া করবে না। দরকার হলে মাটিতে বুক দিয়ে পড়ে থাকবে; শরীরের রক্ত দেবে। অথচ কি আশ্চর্য জীবন আছে, রক্ত আছে কিন্তু ঐ জমি আর নেই। বিশ্বায়নের করাল গ্রাসে বিলীন হয়ে গেছে। তৈরি হয়েছে বহুজাতিক কোম্পানির নাট্যমঞ্চ। হারিয়ে গেছে চিরায়ত সব ঐতিহ্য।যেখানে একদিন পূবালী বাতাসে ফসলের ঢেউ ছিল, ছিল সবুজের বিস্তীর্ণ সমারোহ, সেখানেই আজ ঘিঞ্জি বস্তি আর বাহারি কল-কারখানা।
মইজদ্দিন মণ্ডল নিজেও বেদখল হয়ে গেছে। শরীরময় অসুখের রাজত্ব। চলাফেরার শক্তি লুপ্তপ্রায়; অসুস্থ সজ্জায় মৃত্যুর অপেক্ষারত প্রহরী। আলো চলাচলের ফাঁক-গলে খোলা আকাশের পানে তাকিয়ে থাকে। মৃদু আলোয় তখন দৃশ্যমান হয়ে ওঠে দুরন্ত কৈশর, শহর সংলগ্ন উত্তরের মাঠ, সোনাকান্দরের সোনাঝরা বিল, হোগলার ঝোপ, কাউনপাখির ডিম- সব যেন থরে-থরে সাজানো রয়েছে; ইচ্ছে করলেই ছুয়ে দেখতে পারে!
রতনের কাধে ভর করে মণ্ডল আরেকবার রাস্তায় নামে। চেনা দৃশ্যগুলোর সাথে নিজেকে মিলিয়ে নিতে চায়। কিন্তু এবার তার অবাক হওয়ার পালা; ভাবনার সঙ্গে বাস্তবের বিস্তর ফারাক। উত্তরের মাঠের কোনো অস্তিত্বই আজ আর অবশিষ্ঠ নেই। মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে ইটভাটার চিমনি, প্লাস্টিকের কারখানা আর বাতাসের ডানায়-ডানায় অচেনা ঘ্রাণ। মইজদ্দিন নিজেও বৈদ্যুতিক খুটির মতো ঠাই দাঁড়িয়ে। বুকের মধ্যে কেমন যেন থরথরানি অনুভূত হয়। হাত-পাগুলো অবশ হয়ে আসতে চায়। চিমনীর কালো ধোঁয়ার মধ্যে থেমে যেতে চায় জীবনের সব কোলাহল।