আব্বা ঈদে জামা কেনার টাকা দেবেন না? দুই আঙুলে গরুর গোশত ছিঁড়তে ছিঁড়তে শবনম বললো তার বাবা মোশতাক ফরিদীকে। রাতের খাবার টেবিলে মোশতাক ফরিদী সপরিবারে বসেছে। তিন কন্যা, দুই পুত্রের জনক। বড় কন্যার কিছুদিন আগে বিয়ে দিয়েছে। তারই মতো ব্যবসায়ী পরিবারের ছেলের সঙ্গে। বাকি দুই কন্যা, দুই পুত্র ও তার স্ত্রী টেবিল ঘিরে বসেছে।
শবনমের কথার পিঠে মোশতাক ফরিদীর স্ত্রী রায়হানা বলে উঠলো, আমার বড় মাইয়াটা প্রথমবার শ্বশুর বাড়িতে ঈদ করবে, আগে তার ঐখানে ঈদের উপহার পাঠাইতে হবে। তারপর বাকি সব।
ইলিশের কাঁটা বাছতে বাছতে মোশতাক ফরিদী বললো, আল্লাহ চাইলে সবার সব হইবো। সবে তো দশ-এগারো রোজা গেলো। দোকানে কোটি টাকার মাল তুলছি। ইনশাআল্লাহ কুড়ি তারিখের পর তোমাগো সবার ঈদের বাজার করনের টাকা দিয়া দিব।
ছোট ছেলে মুহিত চামচে দই মুখে দিতে গিয়ে চামচ নামিয়ে রাখলো।
আমার কিন্তু আইফোন কিনতে টাকা দিবেন বলছিলেন।
ইনশাআল্লাহ বাপ। গত দুই বছর তো ঈদ তেমন হয় নাই। আল্লাহ চাইলে এইবার ব্যবসা ভালো হওয়ার আশা রাখি। তোমাদের কোনো সখ অপূর্ণ রাখুম না। একটু ধৈর্য ধর।
খাওয়ার টেবিলেই আত্মীয় স্বজন কাকে কী দিতে হবে এই বিষয়ে মোটামুটি একটা আলোচনা হয়ে যায়। স্ত্রী রায়হানা ডায়েট করে। সে রাতে ভাত খায় না। রুটি সবজি খায়। রুটি গলা দিয়ে নামতে চায় না। তরকারিতে রুটি মাখাতে মাখাতে রায়হানা স্বামীর সঙ্গে মৌখিক তালিকাটা করে ফেলে। তারপর বলে, আমার এবার কিছু কেনা লাগবে না। গেলো মাসে ইন্ডিয়া থেকে যে মাল আনছিলা ও থেকেই আমি কয়টা শাড়ি আর থ্রিপিস গনিরে দিয়া আনায়ে রাখছি।
এইবার মিঠু বেতন বোনাস পেলে বহুদিন পর বাড়িতে একটা সুখের হাওয়া বইবে। ভাবতে ভাবতে চোখের সামনে একটা আনন্দ মুখর পরিবারের ছবি ভেসে ওঠে।
গনি দোকানের কর্মচারী। কর্মচারী হলেও মোশতাক ফরিদীর এলাকার ছেলে বলে এ বাড়িতে তার একটা আলাদা দাম আছে। এ বাড়ির বড় বড় বাজার সদাই সেই করে। বাসায় পানি,বিদ্যুৎ বা অন্য কোনো সমস্যা হলে দোকান থেকে গনিকে পাঠিয়ে দেয় মোশতাক। গনি প্রয়োজনীয় মিস্ত্রি ডেকে এনে কাজ করায়।
রায়হানাকে সেই দোকানের এক্সক্লুসিভ কালেকশনের খবর দেয়।
রায়হানার কথা শুনে মোশতাক ফরিদী বলে,ঐ ছ্যামড়া আমার ব্যবসা লাটে উঠাইব বুঝতে পারছি।
সবাই এ কথায় হেসে ওঠে।
দেয়ালে ঝোলানো ঘড়ির সোনালি ডায়াল টিউবের আলোয় ঝিকমিক করে ওঠে।
মার্কেটটা বহু পুরাতন। পুরানা শহরের ভয়ঙ্কর ব্যস্ততম রাস্তার ওপর। রাস্তাটা তত চওড়া না হওয়ায় যানজট নিয়মিত ঘটনা। কম মূল্যে দেশি বিদেশি পোশাকের পাইকারি ও খুচরা মার্কেট। এ মার্কেটের দুতলায় মোশতাক ফরিদীর দুটো দোকান। একটা শুধু মেয়েদের। অন্যটায় মেয়ে ছেলে শিশু সকলের পোশাক বিক্রি হয় শাড়ি থেকে ওয়েস্টার্ন সব,এ মারকেটের আর সব দোকানের মতোই।
রোজা প্রায় মাঝামঝি হতে চলেছে। রাত বারোটা সাড়ে বারোটা পর্যন্ত মারকেটে লোক সমাগম থাকে। দূর থেকে বণিক আসে পাইকারি মাল নিতে। খুচরা ক্রেতারও অভাব নেই। অপেক্ষাকৃত কম টাকায় দেশি-বিদেশি পণ্য কিনতে, কিছু টাকার সাশ্রয়ের আশায় লোকজন আসতেই থাকে।
গনি, মনজু, দেবাশীষ এই রকম ছয় সাত জন কর্মচারী মোশতাক ফরিদীর দোকানে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কাজ করে। তবে রমজানে অতিরিক্ত আরও চার পাঁচজন লোক লাগে। তবু কুলিয়ে ওঠা যায় না।
আজ প্রচুর পরিশ্রম গেছে। লটে লটে কাপড় গোডাউনে তোলা হয়েছে। যত কষ্টই হোক এক একটা বান্ডিল এক একটা স্বপ্ন। মিঠু নতুন ছেলে। সে মুসলিম নয়। ভিন্ন ধর্মালম্বী। পক্ষাঘাতগ্রস্থ বাবা, মা আর দুইবোন সংসারে। এই বার বছর বয়সেই পেটের ক্ষুধা নিবারণের সংগ্রামে নেমে পড়েছে। ইট ভাঙা, মাটি কাটা কোনটা করেনি। অবশেষে এবার এই রমজান উপলক্ষে তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
তার কাজ সবাই নামাজে গেলে দোকান পাহারা দেওয়া আর গোডাউন থেকে মাল নামিয়ে আনা। কর্মচারীদের ফুটফরমাস খাটা।
ইফতারের পর গ্লাস বাটি ধোয়ার জন্য ওয়াশরুমের দিকে যাওয়ার সময় গণির সঙ্গে দেখা। গণি ফোনে কথা বলতে বলতে সিগারেট টানছে। মিঠুকে দেখতে পেয়ে বললো, ঈদের দিন সকালের বাসে বাড়ি যামু।
মিঠু দাঁড়ালো। কী কন?
গণি ফোন অফ করতে করতে বললো, চান রাইতে তো আর যাওন যাইব না। ঐ রাতেই তো আসল ব্যবসা।
বেতন কবে দিবো?
বেতন সাতাইশেই পাইবি। কিন্তু চান রাইতের বিক্রি শেষে সেই রাতেই মহাজন লাভ-ক্ষতি হিসাব করে। তারপর খুশি মনে সকলরে বখশিশ দেয়।
তাইলে ঈদের কেনাকাটা?
আরে বেক্কল। টাকা থাকলে রোজই ঈদ। বেতন তো বিকাশ কইরা দেই বাড়িতে। হেরা সব কিনা ফেলে।
মিঠু বোকার মতো হাসে। বলে, আমি ও তাই করুম। গণি ভাই আপনে বিয়া করছেন? আচমকা প্রশ্ন করে মিঠু।
গণি হেসে বলে, করছি না! আমার একটা তিন বছরের মাইয়াও আছে।
তাইলে তো আপনের বাজার সদাই মেলা লাগবো।
গণি হাসে। আমি সব কিছু কিনার টাকা আব্বার কাছে পাঠায়া দেই কিন্তু বউ আর মাইয়ার কাপড় নিজে কিনি। এইবার বউয়ের কাপড়ের রং ও ঠিক করে রাখছি।
মিঠু কী বলতে যায়, তার আগে দোকান থেকে ডাক আসে। গণি দৌড়ে যায়। মিঠুর মনেও বাড়ির ছবি ভাসে। গ্রামে তো এমনিতেই কাজ নাই। তার ওপর বাবা অসুস্থ হওয়ার পর সংসারে অভাব যেন হামলে পড়েছে। কতদিন তারা পেটপুরে তিনবেলা খায় নি। কতদিন নতুন কাপড় গায়ে ওঠেনি। মা সেলাই করে আর মুড়ি ভেজে যা আয় করে তা দিয়ে কেবল বেঁচে থাকা চলছিল। এইবার মিঠু বেতন বোনাস পেলে বহুদিন পর বাড়িতে একটা সুখের হাওয়া বইবে। ভাবতে ভাবতে চোখের সামনে একটা আনন্দ মুখর পরিবারের ছবি ভেসে ওঠে।
আশেপাশের লোকজনের আফসোস, হা-হুতাশ কিছুই তার কানে আসছে না। গনি পাশেই ছিল হয়তো, মিঠুর কাঁধে হাত রেখে বললো, সব শেষ।
রমজান মাসে দোকান খোলার টাইম নির্দিষ্ট থাকে কিন্তু বন্ধ হওয়ার কোনও নির্দিষ্ট টাইম নাই। যতক্ষণ কাস্টমারের আনাগোনা ততক্ষণই খোলা। বারোটা তো স্বাভাবিক। কোনোদিন একটা, কোনোদিন দেড়টাও বাজে। মার্কেট বন্ধ হলে পাহারার ফাঁকে ফাঁকে মার্কেটের সামনের চত্বরে বসে গল্প করে সিকিউরিটি গার্ড কয়জন। এদের সবার পরিবার পরিজন আছে। বেশিরভাগের পরিবারই দেশ গাঁয়ে থাকে। প্রায় সময়ই ঈদে বাড়ি যাওয়ার সুযোগ হয় না এদের অনেকের। তবুও মন খারাপ করে না। ঈদ মানে বেতনের পাশে বাড়তি বোনাস, বখশিশ। তাছাড়া কর্তব্যনিষ্ঠা। এই যে এতবড় মার্কেটটা এর পুরো ভার কয়েকজন গার্ডের হাতে ছেড়ে দিয়ে মালিকেরা নিশ্চিন্তে ঘুমায়। সেই বিশ্বাসের গর্বেও তারা আনন্দিত থাকে।
ঢাকা শহরে মিঠুর রাত কাটানোর নিজস্ব কোনো ব্যবস্থা নাই। গার্ডদের রুমের এক কোণে একটা চাদর ফেলে জড়োসড়ো হয়ে ঘুমিয়ে থাকে সে। গার্ডদের সাথেই নির্দিষ্ট টাকা দিয়ে রান্না-খাওয়ার ব্যবস্থা। সাহরির সময় গার্ডরা ভাগে ভাগে রুমে খেতে আসে। মিঠুও তাদের সঙ্গে সাহরি আর ইফতার করে। সে দেখেছে দুপুরে কাস্টমারের চাপ যেমন থাকে তেমনি বাধা বুয়া দুপুরে রান্না করে না জন্য মিঠুকে দোকানে কিনে খেতে হয়, এতে খরচা বেশি। মিঠু তাই সাহরি ইফতার করে রোজাদারদের মতোই দিন কাটায়।
সাহরির পর গরম লাগতে থাকায় মিঠু ছাদে চলে যায় ঘুমানোর আশায়।
নির্মল ভোর। স্নিগ্ধ সুন্দর মোলায়েম বাতাস জানলা দিয়ে ঘরে আসছে। মোশতাক ফরিদীর ঘুম ভাঙল ফোনের অবিরাম রিংটোনে।
ওপাশ থেকে ভেসে এল সর্বনাশের সংবাদ। পড়মড়ি ছুটল সে মার্কেটের পানে।
মিঠুই সর্ব প্রথম দেখেছিল আগুনের শিখা। পূর্বাকাশের রক্তিমাভার সঙ্গে মিশে যাচ্ছিল লকলকে জিভ।
স্বেচ্ছাসেবী আর অগ্নিনির্বাপক কর্মীদের কয়েক ঘন্টার সকাল চেষ্টাকে ধুলিসাৎ করে চোখের সামনে পুড়ে ছাই হয়ে গেল এতবড় মার্কেট,এত গুলো সম্পদ,এতগুলো মানুষের আশা আর স্বপ্ন। কাপড় আর হৃদয় পোড়া গন্ধে, সব হারানো মানুষের আর্তনাদে ভারি হয়ে উঠেছে এলাকার বাতাস।
গুটিগুটি পায়ে ভোর ঠেলে সকালের ঝলমলে সূর্য তার সোনালি আলোয় ছড়িয়ে পড়েছে চতুর্দিকে। দূরের কৃষ্ণচূড়া গাছের পাতা আপন মনে দোল খাচ্ছে চৈতালী বাতাসে।
ধ্বংস স্তূপের একটু দূরে শত শত মানুষের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে মিঠু। আশেপাশের লোকজনের আফসোস, হা-হুতাশ কিছুই তার কানে আসছে না। গনি পাশেই ছিল হয়তো, মিঠুর কাঁধে হাত রেখে বললো, সব শেষ।
মিঠু কিছু বললো না। হেঁটে হেঁটে চলে এলো মসজিদ চত্বরে। এখান থেকে মার্কেট টার ছাদ দেখা যেতো। সে একটা পিলারে হেলান দিয়ে বসে নির্নিমেষ চোখে তাকিয়ে রইলো আগুনপোড়া আকাশের দিকে।