দুই ছেলেকে একসঙ্গে বিয়ে দিয়েছেন ওয়াজেদ আলী। বাড়ির উঠোনের পেয়ারাতলায় ঘুরঘুর করে তারা। সকালের রোদে যখন পেয়ারাপাতাগুলো ছায়া নিয়ে খেলা করে, বউরা পাটি পেতে বসে ওর তলায়। ওয়াজেদ প্রাণ ভরে দেখেন। বারান্দায় হুঁকো টানতে টানতে একগাল ধোঁয়া ছেড়ে মুখ বাঁকা ক’রে হাসেন। স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলেন, বুজিচাও ঝুনুর মা, ছেইলো দুডোর বে হইয়ে গেলিউ, মাইয়েডার কলাম বেশি কিলাশ পইন্ত পড়াবো। ওরে এটটা কুটো দুকোন করতি বলবা না, ও শুধু বই পড়বে’।
‘তুমার কতা শুনলি গা জ্বলে। মাইয়ের কিচু না শিকুলি শ্বকুরবাড়ী যাইয়ে কতা শোনবে। বাপ হইয়ে তা মানতি পারবা?’ পা দিয়ে ধান নাড়তে নাড়তে ঘোমটার ভেতর থেকে কথাগুলো ব’লে আঁচল দিয়ে ঘাম মোছেন ঝুনুর মা।
আমন ধান এসেছে বাড়িতে। ছোট্ট উঠোনের এককোণায় পল-গাদা সাজানো। গ্রামের সেরা ধনী একব্বার মোড়লের মতো অত বড়ো গাদা ওয়াজেদের হয় না কখনো। যা হয় তাতে গরুর জাবনা হয়ে যায় কোনোমতে। টান পড়লে ঘাস কাটতে যেতে হয় কিংবা ধার করা লাগে বিচালি। এই ধানগুলোয়ই শেষ। মলন মলার পর পল-গাদাটা বড় হবে আরেকটু। দুই ছেলে, সাজেদ আর মাজেদকে নিয়ে ধান গাদা করে রাখছেন ওয়াজেদ। শাড়িটা সামান্য উঠিয়ে দৌড়াদৌড়ি করছেন ঝুনুর মা। উঠোনে পড়ে থাকা দু’একটা খড়-কুটো পায়ে জড়িয়ে যাচ্ছে। ছাড়ানোর সময়ও নেই মনে হয়। সোনার রঙের ধান-কুটো লম্বা নূপুর হয়ে ঝুলছে পায়ে। দুপুর প্রায় হয়ে এলো। আকাশের দিকে একবার তাকিয়ে বউদের ডাক দিলেন। বউরা বেরিয়ে এলো ঘরের ভেতর থেকে।
‘তুমরা ধান গাদা করতি হাত লাগাও এটটু। আমি রানদা শেষ কইরেনি। মলন মলতি হবে আবার বিকেলে’। বউদের আসতে দেখে ওয়াজেদ বললেন, তুমাগের আসতি হবে না বউ। রান্নার জুগাড়-যন্তরে শ্বাকড়ির সাতে থাকো। মলন মলার সুমায় এটটু গরু খ্যাদায় দিলি হ’ব্যানে।
বিকেল বেলা। রোদ নতুন গামছার মতো বিছিয়ে আছে ওয়াজেদের উঠোনে। দুপুরে খেয়ে দেয়ে সবাই যে যার ঘরে গড়াগড়ি দিচ্ছিলো। ঝুনুর স্কুল থেকে আসতে দুপুর গড়িয়ে যায়।রোদের ওড়না মাথায় বাড়ি আসে ও। বারান্দায় ভাত বেড়ে রাখে মা। বই রেখে হাত মুখ ধুয়ে খেয়ে নেয়। আজও তেমনই হলো। ভাত খেয়ে নিজের ঘরে দিকে যাচ্ছিলো। কী মনে করে বড় ভাই সাজেদের ঘরের দিকে গেল। ভাইয়েরা তো এ সময় মাঠে বা বাজারের দিকে যায়।ভাবিরা শুধু গড়াগড়ি করে বিছানায়।
ভেজানো দরোজা হালকা খুলল ঝুনু। টালির চালের ফাঁকা দিয়ে এক ঝাঁঝরি রোদের মার্বেল লুটিয়ে আছে মাটির মেঝেয়। কাঠের বিমের নিচ দিয়ে আলো এসে ফিকে করেছে ঘরের আলতো অন্ধকার। সামনে চোখ পড়লে মুখটা ঝুলে গেলো ঝুনুর। ভুরু দুটো অনেক ওপরে উঠে স্থির হয়ে রইলো। দুটো নগ্ন শরীর ছটফট করছে বিছানায়। উপুড় হয়ে আছে সাজেদ। সাপের মতো ফোঁস ফোঁস ক’রে উঠানামা করছে। বউয়ের পা দুপাশ দিয়ে উঠে পেঁচিয়ে আছে সাজেদের কোমর। সাজেদ উবু হয়ে সরু সুড়ঙের ভেতর দিয়ে যেতে চাচ্ছে কোথাও। পা’দুটো মাঝে মাঝে খাটের প্রান্তে ঠেকিয়ে এগোতে চাইছে। শরীর নাড়িয়ে পথ ক’রে বেরিয়ে যাবে সুড়ঙের সামনে দিয়ে। বউ বের হতে দিচ্ছে না। প্রাণপণে সামলে রেখেছে নিজেকে। যেন ঝড়ের সময় প’ড়ে গিয়ে বাতাসের বিপরীতে শুয়ে আছে। দুহাতে ঠেলে দিতে চাইছে অবাধ্য উদ্দাম ঝড়। চোখ বুঁজে ধুলোর কুচি এড়াতে চাইছে বোধ হয়। কী উদ্দামতা! বিপরীতমুখী ঝোড়ো বাতাস একে অন্যের গায়ের গণ্ডি পেরিয়ে পেরিয়ে যাচ্ছে। সাজেদের মাটির সুড়ঙ ডিঙানোর চেষ্টা একটু বদলালো। পিঠ ওপরে উঠে এলো। সামনে যাওয়ার প্রচেষ্টা প্রচণ্ড হলো এবার। প্রবল ঝাঁকুনি। প্রাণপণ। ঝড়ে বিধ্বস্ত বউ। আলুথালু চুল। উচ্ছল উর্বশী বুক আরও উন্মুখ। এত যৌবন বোঝা যায় না তো। ব্লাউজে, শাড়িতে কিভাবে তা আটকায় ওর ভাবি, বুঝতে পারে না ঝুনু। জোর-বাতাসে নদীর জলে থোকা থোকা ঢেউ দেখেছে। সেই ঢেউ এখন এই ঘরে। হালকা গোঙানিতে ঢেউয়ে মুখ গুঁজে স্থির হয়ে গেল সাজেদ। বউ সাজেদের মুখটা তুলে ঠোঁটদুটো মুখে পুরে বাঁকা ক’রে তাকালো দরোজার দিকে। ঝুনুর চোখে চোখ পড়লো। সাজেদের মাথা একদিকে আলতো কাঁত করে দিয়ে হেসে রইলো ঝুনুর দিকে। সাজেদের পিঠ জড়িয়ে থাকা হাতটা উঠিয়ে ইশারা করলো। ভুরু নামলো ঝুনুর। দুপদাপ পায়ের শব্দ শুনতে পেলো ওর ভাবি।
গোলাঘরের পাশে মাটির ভিতের পরে চাঁচ আর খড়ের ছাউনির ঘর করেছে ওয়াজেদ। ছেলেদের বিয়ে দেওয়ার পর এই ঘরটা বানিয়েছিলো। বউকে নিয়ে এই ঘরেই থাকে। উঠোনে হাঁস-মুরগির ডাকাডাকিতে কাক-ঘুমটা ভেঙে গেলো ওয়াজেদের। উঠে চাঁচের জানালার ফাঁক দিয়ে দ্যাখে বউ ধানের আঁটি সাজিয়ে রাখছে উঠোনে। ধীরে ধীরে গোলাকার হয়ে উঠছে সাদা উঠোনটার বুক। সোনারঙ ধানের আঁটির আগায় বাজছে সোনার ধানের নুপুর। শাড়িটা একটু উঠিয়ে কোমরে গুঁজে নিয়েছে ঝুনুর মা। রাঙা দুটো পা মচ্ মচ্ করছে ধানের ওপর। আনন্দ আর ভালোলাগায় চোখ দুটো ছল ছল ক’রে উঠলো। পাখির পালকের মতো তার বউ। ভেসে ভেসে চলে যেন সব সময়। কোনো কিছুতে অনাগ্রহ দেখেনি কোনোদিন। খুকি বয়সে বিয়ে হয়েছিলো ওর সঙ্গে। ওয়াজেদেরও তখন পুরোপুরি বিয়ের বয়স হয়নি। গোঁফের রেখা কালো হয়ে উঠেছিল কেবল। বাপের বন্ধুর মেয়ে ও। মুক্তোরপুরের মহির উদ্দিন ওয়াজেদের শ্বশুর। বিয়ের দিন শাশুড়ি হাত ধরে বলেছিলেন, আমার পরানডা কাইটে তুমার হাতে দিলাম বাবা। খুকি একনও ছোটো। ওর বাপের জেদ বন্দুর ছেইলের সাতে বে দেবে। বাড়ির মতোন থাকপে….। চোখে আঁচল চেপে কেঁদে উঠেছিলেন শ্বাশুড়ি। ওয়াজেদের খুকি খুকিই রয়ে গেলো। বিয়ের পরও এই বাড়িতে এসে সিট কাপড়ের ফ্রক পরে থাকতো। মা শাড়ি পরাতে চাইলে বাপ বলতেন, ছোটো মানুষ শাড়ির নিচে চাপা পইড়ে যাবে, অজের মা, বউ বড় হলি কাপড় পরবে। একন যা পরতি চায়, পরতি দ্যাও। কে বলবে, খুকিও শাশুড়ি হয়েছে। মনে তো হয় না। শরীরে ও মনে একইরকম রয়েছে এখনও । আজও পয়লা রাতের মিলনের কথা প্রতি রাতেই মনে হয় ওয়াজেদের।
ধানের আঁটি বিছাতে বিছাতে উঁচু গলায় ওয়াজেদকে ডাকলেন ঝুনুর মা। কোমরে লুঙি পেঁচাতে পেঁচাতে বাইরে এলো ওয়াজেদ। বলল, খুকারা উটিনি। ডাক দোবো?। ব’লে, ঘরের দিকে একবার তাকালো।
‘তুমি আবার উঁকি-ঝুঁকি দ্যাও কেন, উটলি উরা নিজিরা বাইরুব্যানে’।
‘না, ভাবলাম বিকেল থাকতি থাকতি মলনডা ভাঙতি পারলি ভালো হইতো’।
‘সনদে হলিও অসুবিদে নেই, চাঁননি রাইত আচে। আনন্দ লাইগব্যানে মলন মলতি’
সাজেদের বউ আস্তে আস্তে ঘরের দরোজা খুললো। কল-পাড়ে গিয়ে পা হাত মুখ ধুয়ে আঁচলে মুখ মুছতে মুছতে শাশুড়ির সঙ্গে হাত লাগালো। শাশুড়ি আড়চোখে দেখলেন বউকে। বউ একমনে কাজ করে যাচ্ছে। সাজেদ উঠে ঘাড়ে গামছা ঝুলিয়ে খালের দিকে গেলো। একটু পর কোমরে ভিজে লুঙি আর গামছা পেঁচিয়ে বাড়ি এলো ভিজে পায়ে। ছেলেকে দেখে ওয়াজেদ বললেন, কি রে সাজু, সইনদে বেলা চ্যান করলি ক্যন, ঠাণ্ডা লাইগব্যান্ না?
‘ না আব্বা, গরম লাগদিলো খুপ। চ্যান কইরে গা পাতলা কইরে নিলাম। পর পর দুডো মলন মলবো আইজগের’।
‘না না , তা হলিও ইরাম সুমায় চ্যান করিসনে। অসুক হবে’।
সাজেদ কিছু না ব’লে ঘরে গেলো। বউ বদনায় ক’রে পা ধোবার পানি আনতে গেলো টিউবওয়েলে। ঝুনুর মা যন্ত্রের মতো তাকালেন ওয়াজেদের দিকে। দৃষ্টি স্থির করে হাসলেন একটু। বউয়ের চোখে চোখ পড়লে একবার মাথা ঝাঁকিয়ে চোখ বড়ো ক’রে তাকালেন।
‘তুমি আবার আমার দিকি উরাম কইরে তাগায় আচো কেন?’ আমি আবার কী কল্লাম?’
‘ফাঁক পালি তুমিও একনও মাজে মাজে অসুমায় চ্যান করো না, আর আমারও করাও না। তাই কও। ওরা তো তুমারই ছেইলে’। ওয়াজেদ বুঝতে পেরে হাসলেন হো হো ক’রে। ঝুনুর মা-ও দাঁতে আঁচল চেপে হাসলেন।
সাজেদ দামানে গরু জুড়ছে। গোয়াল থেকে এক এক ক’রে গরু এনে ভাইয়ের হাতে দড়ি ধরিয়ে দিচ্ছে মাজেদ।দুই বউ ধানের আঁটি খুলে খুলে ছড়িয়ে দিচ্ছে মলনের বৃত্তে। পুরু হয়ে উঠছে ধীরে ধীরে জায়গাটা। ওয়াজেদ উঠোনের এককোণায় পিড়িতে বসে হুঁকোর কলকেয় তামাক ভরছেন। বাজারে এখন নিত্য নতুন বিড়ি বেরিয়েছে। আকিজ বিড়ি খায় অনেকে। ওয়াজেদ বাপের আমলের হুঁকোটা আঁকড়ে আছে এখনও। বাড়ির পাশে একটুখানি জায়গা কোদাল দিয়ে কুপিয়ে তামাক লাগায় ওয়াজেদ। পাতা শুকিয়ে তাতে উলা-গুড় (টক গুড়) মিশিয়ে মোলায়েম হুকোর তামাক বানায়। প্রতিদিন কয়েকবার পানি বদলিয়ে গুড়্ গুড়্ ক’রে তাজা তামাকের ধোঁয়া ছাড়ে। মুখ তুলে সেই ধোঁয়া দেখতে কী যে আনন্দ লাগে! পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে শূন্যে উঠে যায় নীলাভ ধোঁয়া। মিলিয়ে যায় এক সময়। প্রিয়জনের মুখ ছবি হয়ে ভেসে ওঠে সেই শুভ্রতায়। বাপের স্নেহভরা মুখ। মা। দাদাজান, দাদি, সবার। কেউ নেই আজ। খোলা মাঠের ওই কবরখানায় শুয়ে আছেন তারা। হুঁকোর ধোঁয়া চোখে গেলে গামছা দিয়ে চোখ মোছে ওয়াজেদ।
মাগরিবের আজান হচ্ছে। ওয়াজেদ হুকো রেখে অজু করতে গেলেন। ঝুনুর মা-ও জায়নামাজ নিয়ে চাঁচের ঘরের দিকে গেলেন। সাজেদ আর মাজেদ মাঠের দিকে গেল একটু। বারান্দায় বসে হেরিকেনের চিমনি মুছছে ঝুনু। মলনের গরু খেদাতে খেদাতে সেই দিকে দেখছে সাজেদের বউ। চোখে চোখ পড়লো একবার। চোখ নামিয়ে নিলো ঝুনু। মাজেদের বউ দেখলো এই চোখাচোখি। বললো, ভাবী, ঝুনু আইজ এতো চুপচাপ ক্যান্?’ আর এটটা কতা তুমার জিজ্ঞেস করব ভাবদিলাম, করব?’
হি কর্। কী কতা?
তুমি তো চ্যান কইল্লে না।
দু্ই বউ পাশাপাশি গরুর পিছে ঘুরছিলো। খেজুর পাতার ছড়ি দুজনের হাতে। সাজেদের বউ গরুকে হালকা আঘাত করতে যাচ্ছিলো। শূন্যে উঠে রইলো ছড়িটা। মুখ বেঁকিয়ে তাকালো।
কোন্ সুমায় চ্যান কল্লাম না রে?
ক্যান্, কিচু যোনো বুজদি পারতিচাও না, ন্যাকা সাজিচাও?
ও, বুজদি পারিচি, বিকেলের কতা কচ্চিস, তাই না? ভালো কতা, তুই জানলি কী কইরে, ঝুনু কইয়ে দেচে? স্বাভাবিক গলায় বললো সাজেদের বউ।
কেউ কইনি। শুনতি পাই আমি তুমাগের ওই সুমাইর শব্দ। বাব্বা! রোজ কইবার লাগে তুমাগের!
ঠ্যালা আচে আমার বরের। এইরাম হন্যে হওয়া মানুষ দেকিনি কোনোদিন। মনে হয় সাপের ওষুদ খায়। তাই এতোবার শঙ্খ লাগাতি পারে। হিহি।
ভাবি, তুমার মুক আর রস জ্বাল দিয়া চুলো একরকম। দাউ দাউ করতি থাকে। যা-ই কও, চ্যান তুমার করা উচিত ছিল।
শোন্ ছোটবউ, কইবার চ্যান কইরে পারা যায় তুই ক’ দেকি? তাছাড়া সক্কাল বেলায় আবার তো ডুব দিয়া-ই লাগবে। হাত পা ধুয়ে, দমাদম এটটু উজু কইরে কাজ চালাচ্চি। হিহি।
রাতের রান্না করছেন ঝুনুর মা। গরু নিয়ে ফিরে এসেছে দুই ভাই। ঝুনু পড়ছে ওর ঘরে। দুই বউ গল্প করতে করতে মলন মলছে। পরিপূর্ণ চাঁদ আজ আকাশে। সন্ধ্যের আগেই হ্যাজাকের মতো জ্বলছিল। অন্ধকার ছেয়ে আসতে দেয়নি মোটে। গুটি পায়ে রাত একটু গেঁড়ে বসতে চাইলে আলো বাড়িয়ে দিলো চাঁদটা। ওয়াজেদের হুঁকোর মতো ধোঁয়া ছাড়ছে এখন। নীলাভ রূপোলি আলোয় ভরে আছে ওদের বাড়ির পাশের মাঠ, খালপাড়।
রান্নার একটু দেরি দেখে বাড়ি থেকে বের হলো ওয়াজেদ। পালাক্রমে ছেলে আর বউরা মলনের গরু তাড়াচ্ছে। এখনো খুটখুট টুং টাং শব্দ ভেসে আসছে রান্নাঘর থেকে। একবার গলা বাড়িয়ে ঝুনির মা বললেন, এই তুরা ভাত খাইয়ে যা। তোর বাপেরও ডাক দে। খাইয়ে দইয়ে কাজ কইশ্যানে আবার। গরুর হাঁটা থামলো। হাতমুখ ধুয়ে রান্নাঘরের দিকে যাবার প্রস্তুতি সবার। সাজেদের বউ বললো, মা আমি এটটু আসতিছি। ঝুনুর ডাইকে নে আসি। দেকি ওর পড়া শেষ হইয়েচি কি-না।
ঝুনুর ঘরের দরোজা আধখোলা। ওর টেবিলের ওপর থেকে হ্যারিকেনের আলো হলুদ কাগজের মতো হয়ে আছে। সবসময় দুপদাপ করে হাঁটে সাজেদের বউ। এখন নিঃশব্দে হাঁটছে। দরোজায় দাঁড়ালো। চুপচাপ। ঝুনু পড়ছে আর একটু পর পর মাথা ওপরে তুলছে। মনে হয় পড়া মুখস্ত ক’রে ক’রে গিলে ফেলছে। মন থেকে হারাবে না লাইনগুলো। একবার মাথা নিচু করতে যাবার সময় হাই তুললো একটু। দরোজার আলতো আওয়াজে ফিরে তাকালো। মুখ ঘুরিয়ে চোখ নামালো বইয়ের পাতায়। ঘরে ঢুকে স্থির হয়ে চেয়ারের পেছনে দাঁড়ালো সাজেদের বউ। দুই হাতের তালু কানের নিচ দিয়ে বাড়িয়ে ঝুনুর দু্ই চোয়ালে রাখলো। আস্তে ক’রে ঘুরিয়ে মুখটা নিজের দিকে নিয়ে এলো। বলল, এই ঝুনু, তাগা আমার দিকি। আইজগে আমার সাতে কতাও কলি নে, হাসলিও নে, ঘটনাডা কী? সরে এসে সামনে দাঁড়ালো। ঝুনুর মুখ নিচু হলো। ধরা গলায় বলল, আমি বুজদি পারিনি ভাবি। তুমি আমার দিকি না তাগায় পড়া পইন্ত সিনিমার মতন চোকির সামনে ছবি ভাসতি লাইগলো। শুদু থ’ হইয়ে তাগায় ছিলাম। আমার মাফ করো ভাবি। ঝুনুর চোখের জলে সাজেদের বউর হাতের তালু ভিজে গেলো। ভেজা হাত দিয়েই আঙুল টান টান ক’রে চোখের পাতা মুছে দিলো ঝুনুর। বললো, এই ছেমড়ি। তুই কানতিচিস ক্যান, তুই কানতিচিস ক্যান। কাজডা করিচি আমি। ধরা পড়িচি আমি, লজ্জার কানদা তো আমার আসার কতা। আমি দ্যাখ কীরাম হাসতিচি। ভাবীর কথায় ঝুনু নাকি-সুরে হাসলো। ভেজা নাক চুলকিয়ে উঠালো মুখটা। ওর দুচোখের জল জমজ নদীর মতো নামছে এখনো। কান্না আর হাসির মাঝখানে ননদের এমন মুখ কখনও দেখেনি সাজেদের বউ। লজ্জার আবীরে রাঙা কী নিখুঁত বিনম্রতা!
তোর বে হলি দরজা একদিন খুইলে রাকিস, দেইকে শোদ কইরে নোবো। একন হইয়েচ্ তো। চল্, ভাত খাতি চল।
ভা-বি তুমার মুকি সপ সুমায় ফাজিল কতা তৈরি থাকে কী কইরে? ভাবির গায়ে হালকা চড় দিয়ে অপ্রস্তুত হাসলো ঝুনু।
অনেক রাতে ঘুমোতে হয়েছিলো সবার। খড়-বিচালি উঠাতে আর ধান জড়ো ক’রে রাখতে রাখতে দুপুর-রাত হয়েছিল প্রায়। ক্লান্ত হয়ে বেশ বেলা পর্যন্ত ঘুমিয়ে ছিল বউ আর ছেলেরা।
ভোর হতে এখনো বাকি। চারদিক ফর্সা হয় হয়।গোলাঘরের নিচু চালের পাশ দিয়ে তাকালে পুকুর পাড়ের কোল ঘেঁষে মেহগনি গাছের ঝাঁকড়া মাথা চোখে পড়ে। গাঙের ওপার থেকে সূর্যটা আসে পয়লা। মেহগনি বন থেকে পরীরা দিনের আলোয় ওদের ডেরায় যাবার আগে থালা বাসন মাজার মতো সূর্য-বাসনের সসার উড়িয়ে দেয় মাঠের পরে। আলোর গুঁড়ো ছিটিয়ে ছিটিয়ে কেমন রাগী হয়ে ওঠে ওই জ্বলজ্বলে থালাটা।
আজান হলো। ওইপাড়ার মসজিদটা বেশ দূরে। তবু ধূলোমাখা পথে চ্প্পলে শব্দ তুলে আবছা আঁধারে বেরিয়ে পড়েন ওয়াজেদ। যাবার আগে বউকে ডাকেন। ছেলে বউদের উঁচুস্বরে ডেকে নামাজের তাগিদ দেন।
মসজিদ থেকে বাড়ি এসে দেখেন ছেলেরা লাঙল আর গরু নিয়ে মাঠে যাবার জোগাড় করছে। ঝুনুর মা তড়িঘড়ি ক’রে ক’খানা কাঁচি-পোড়া পিঠে বানিয়ে দিয়েছিলেন। গরম গরম ভাঁপ-ওঠা পিঠে ঝোলাগুড়ে ডুবিয়ে খেয়ে নিয়েছিলো দু’ভাই। থালার তলায় গুড়ের প্রলেপ ধুতে ধুতে গলা তুলে বউদের ডাক দিলেন ঝুনুর মা। ওয়াজেদ বললেন, বউগের একন ডাইকে না। উরা কত রাইত জাইগে জাইগে কাজ কইরেচে, আরেটটু শুতি দ্যাও।
সকাল সকাল ঘুম ভাঙে ঝুনুর। উঠে রাতের পড়াগুলোয় আরেকবার চোখ বুলোয়। টিউবওয়েলের চারদিকে শুকনো কলাপাতা দিয়ে বৃত্তাকার বেড়া করা। সেই চাপকলের পানিতে গোসল করে ঝুনু। সকালের খাবার খেয়ে বই বুকে চেপে স্কুলে যাবার জন্যে তৈরি হয়। গোসল সেরে ভিজে পায়ে ঘরের দিকে যাবার সময় ওর মা বললেন, ও ঝুনু, তোর ভাবিদের এটটু ডাইকে দে দিনি।বেলা যে দুপুর হইয়ে গেলো। পল নাইড়ে দিতি হবে। খোকাগের ভাত-ও নিতি হবে মাটে’। একটু দাঁড়িয়ে মা’র কথা শুনে ঘাড় নেড়ে ঘরে গেলো।
কাপড় পাল্টেছে ঝুনু। স্কুলে ইউনিফরম প’রে যেতে হয় না। পছন্দমতো কাপড় পরা যায়। ঝুনুর পছন্দ হালকা রঙের যেকোনো জামা। একবার শখ ক’রে মেয়ের জন্যে লালরঙের কামিজ এনেছিলেন ওয়াজেদ। বাবা মনে কষ্ট পাবেন ভেবে মা’র কানে কানে ফিসফিসিয়ে বলেছিল, ও মা। এত রঙ-চইঙে কাপড় আমি পরবান না মাগো। আব্বার এটটু বুজোয়ে কইয়ানে’। মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলেন ঝুনুর মা। সেই চোখে কী অপরিসীম মুগ্ধতা! দুই ছেলের পর মেয়ের বায়না ধরেছিল ওর বাপ। বলেছিল, ছেইলেরা বড় হলি বউ-বাড়ি নে’ ব্যস্ত থাকপে। মাইয়ের মনের মদ্যিই শুদু বসত করে বাপ’। সকাল বিকেল নইড়ে চইড়ে ওই একইরকম কতা বইলতো। বাড়ি নামাজ পড়লি একবার মুনাজাতে হাত তুললি সেই হাত দুডো আর নামতি চ্যাইতো না। কী জানি, আল্লার কাচে কিরাম মাইয়ে চাইয়ে নেচে সাজেদের বাপ। মনের আশা পূরণ হয়েছে মনে হচ্চে। এই বয়েসে কতরকম সাজাগুজা করতি মন চায় মাইয়েগের। ছোনো-পাউডার লিপিস্টিকি মন যায় বেশি। আর ঝুনুর মন পইড়ে থাকে বই’র মদ্যি।
মাজেদের ঘরের ভেতর আলতো ক’রে দরোজা খুলে ঢুকল ঝুনু। আগে ভাইয়েরা বাড়ি না থাকলে নির্দিধায় ওদের ঘরে যেত। এখন কেমন গা ছ্ম ছম করে। লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে আসে পা।ছোটো ভাবি দরোজা খোলার শব্দে আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসলো। মিষ্টি করে হেসে ইশারায় বলল, আমি আসছি। বড় ভায়ের ঘরে ঢোকার আগে একটু দাঁড়ালো ঝুনু। খোলা দরোজায় হাত রাখলো আনমনে। কখন দরোজা ফাঁক হয়েছে বুঝতে পারেনি। ভাবির হাসিতে মুখ তুলে তাকালো। সবগুলো দাঁত বের ক’রে খুট খুট চাপা হাসিতে শরীর আলুথালু হয়ে উঠছে। কোনোমতে হাসি থামিয়ে বলল, আয় আয় ঝুনু। আমার ডাকতি আইচিস? আমি উটিচি অনেক আগে। গড়াগড়ি দে বিছেনডা এটটু জব্দ করতিলাম। হা হা হা। খাটটা ঠিকঠাক আচে কি-না তাতো এটটু পরীক্কা করতি হয়। ঝুনু ঠোঁট টিপে হেসে ভাবির পাশে এসে দাঁড়ালো। বলল, ভাবি, তুমি কি সব সুমায় রসে ডুইবে থাকো? কোনো সুমায় রস কি কোমে না? এক ঝাঁপটায় দু’হাতে জড়িয়ে বুকের ওপর টেনে নিল ঝুনুকে। ঝুনু উপুড় হয়ে লেপ্টে গেলো ভাবির বুকে। নিজেকে ছাড়াতে চাইছে। শক্ত ক’রে ধরে আছে ওর ভাবি। বলছে, তোর ভাইতো সারারাত চটকাচটকি কইরে মাটে গেলো। একন পাইচি তোর। ছাড়াছাড়ি নেই’। ঝুনু চেনে ওর ভাবিকে। কথা বাড়িয়ে লাভ হবে না জানে। শক্ত বাঁধনের ভেতর নরোম স্বরে বললো, ভাবি, ইশকুলি যাবো, ছাড়ো। বাঁধন শিথিল ক’রে ভাবি বলল, একন ছাইড়ে দিলাম। তোর ভাইগের জন্যি ভাত নে যাবো মাটে। তুই ইশকুলতে কিছু বিদ্যা শিকে আয়, বিকেলে আমি আরও কিছু মজার কতা বলবানে। নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে নিতে ঝুনু বললো, তুমার আর ‘মজার কতা’ বলতি হবে না। তুমি কিরাম কতা কতি পারো তা আমার জানা আচে।
খালপাড়ের জমিটাতে লাঙল দিয়েছে সাজেদ আর মাজেদ। খুব বড়ো খাল অবশ্য এটা নয়। একসময় নিচু জমি বলে ভুল হতো। ক’বছর আগে ওমর মেম্বর খালটা আবার কাটিয়েছেন। ওয়াজেদের বাড়ির পাশ থেকে এর শুরু, কপোতাক্ষের চরের ঘাটে এসে শেষ। শাখা-প্রশাখাহীন জলাধারা যেন একটু অন্যদিকে বইতে পেরে স্বস্তি পায়। খালের বদ্ধ আবরণে সুন্দরবনের ওইদিকে চলার ক্লান্তি মুছতে গা জুড়িয়ে নেয়। তাই এর জল কপোতাক্ষের মতোই টলটলে। শুকনোর সময় ঘের দিয়ে ধরে রাখা পানি সেঁচে ফসলের জমিতে দেয় এলাকার কৃষকেরা। বল্লার এই খাল যেন কপোতাক্ষকে নদ থেকে নদী ক’রে দিয়েছে অনেকটা। খালের একপাশে চওড়া ক’রে বাঁধানো মাটির পথ। ঘাসে ছাওয়া। একটু পর পর বাবলা গাছ লাগানো। মাঝে মাঝে দু’একটি জামগাছও চোখে পড়ে।
গল্প করতে করতে ওদের জমির কাছাকাছি এসে পড়লো দুই জা। জমিটা খালের ওই পারে। ছোট্ট একটা সাঁকো দিয়ে জুড়ে দেওয়া দুই-পাড়। মোটা একটা বাঁশের পথ বিছানো জলের একটু ওপরে। একহাত পর পর খুঁটি পুঁতে বাঁশের ওপরে হাঁটার অবলম্বন বানানো হয়েছে। প্রথম প্রথম ভয় করতো ওদের। এখন একটুও পা টলে না। একহাতে ভাতের পাত্র ধরে অন্যহাতে খুঁটির আগা ছুঁয়ে ছুঁয়ে পার হয় তরতর ক’রে।
বউদের আসতে দেখে লাঙল থামালো দুই ভাই। জমির এককোণায় ছোটমতো জামগাছটার নিচে এসে বসলো। মাজার গামছা খুলে মুখ মুছলো। তারপর উঠে এসে খালের স্বচ্ছ পানি দিয়ে হাতমুখ ধুয়ে নিলো। ফিরে এসে দেখে গামছার আবরণ খুলে প্লেটে ভাত তরকারি সাজিয়ে রাখছে দুই বউ। বড় দুটো গামলায় ভাত সমান ক’রে নানা-পদের তরকারি সাজানো বাটি পুঁতে পুঁতে দিয়েছেন ঝুনুর মা। আস্ত পিঁয়াজ ছুলে ছড়ানো সেই ভাতের পরে। বেশ কয়েকটা কাঁচা-ঝাল উল্টো ক’রে পুঁতে রাখা ভাতে। আলতো হাতে সেগুলো তুলে পাটির ওপর রাখছে ওরা। জমি চাষের সময় একটা বেদে পাটি আগেই এনে রাখা আছে। যাবার আগে গুটিয়ে রেখে যায় গাছের গোঁড়ায়। পাটির ওপরে পাশাপাশি দুটো থালা। দুই ভাই বউদের দিকে তাকিয়ে হাসলো একটু। লুঙি গুটিয়ে জাবুড় মেরে খেতে বসে গেলো।
এই ভরদুপুরে রোদের তেজ থাকলেও গরম লাগছে না তেমন। কেমন যেন হিম হিম ভাব বাতাসে। জাম-পাতা দুলছে। দূরের তালসারিতে মনে হয় সবুজ বাতাসের ঢেউ। খেতে খেতে দুই ভাই বউদের দিকে শান্ত চোখে তাকিয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে তাকালো গরুগুলোর দিকে। নিজেদের খাওয়া শেষ হলে খালের পানিতে মুখ ডুবিয়ে নিয়ে আসে ওদের।
মাজেদ একমনে খাওয়া শেষ করে হাত ধুয়ে নিলো। সাজেদের খাওয়া শেষ হয়েছে আগেই। জোয়াল থেকে একটা একটা ক’রে গরু খুলে পানি খাইয়ে আনছে খাল থেকে। সাজেদের বউ-ও গিয়েছে সঙ্গে। পাটিতে বসে আছে মাজেদ আর ওর বউ।মুগ্ধ হয়ে স্বামীকে দেখছে বউটা। মাজেদ একটু চুপচাপ। ওর বউয়ের মতো। দু’জনের চোখে চোখেই কথা হয় বেশি।দিনে রাতে ও-ঘর থেকে যখন বড় ভাই আর ভাবির নানা-রকম হাসিঠাট্টার আওয়াজ আসে, ওরা চোখে চোখ রেখে হাসে। ইশারায় বোঝে সব। প্রকৃতি যেন মিশে আছে এই দুজনের মধ্যে। নীরব, তবু অজস্র কথাময়।
গ্রামে সন্ধ্যার পর কিছু সময় গেলে মনে হয় গভীর রাত। আজ তেমন মনে হচ্ছে না। চাঁদ উঠেছে সন্ধ্যে আসার পর পরই। একদম গোল। কিছুটা ম্লান। তবু উজ্জ্বল আলো দিচ্ছে।বাড়ছে ধীরে ধীরে। একটু আগে মেহগনি বনের আড়ালে ছিল।এখন উঠে এসেছে উঠোনের ওপর। রাতের খাবারের পর মাজেদ আর দু্ই বউ মিলে বসেছে পেয়ারাতলায় পাটি পেতে। ঝুনু বই পড়ছে ওর ঘরে। সাজেদ ওর বাবার সঙ্গে গিয়েছে ও-পাড়ায়। ঝুনুর মা বারান্দায় পা ছড়িয়ে পান চিবুচ্ছেন। গোয়ালে গরুগুলোর নড়াচড়ার শব্দ আসছে। মিহি বাতাস পল-গাদার কাঁচা ঘ্রাণ বয়ে নিয়ে আসছে মাঝে মাঝে। পাকা ধানের এমন ঘ্রাণে উতলা হয়ে ওঠে ওদের মন। চেনা এই ঘ্রাণের ভেতর ডুবে ডুবে, অতল থেকে যেন উঠে এসে মাজেদের বউ বলল,আইজ দুপুরে তুমাগের ভাত খাওয়ায়ে আসার সুমায় দ্যাকলাম খালের পানিতি শাপলা ফুইটে আছে। চাননির আলোয় কিরাম দেকা যায় তা দেকতি যাবা। মাজেদ ওর ভাবির দিকে তাকালো। সাজেদের বউ বলল, মাজেদ, তুমি আর ছোটবউ যাও। চানের আলোয় টলমলে শাপলা ফুল দেইকে আইসো। আমি ঘরে গেলাম। তুমার ভাই একুনি আইসে পইড়ব্যানে।
মাঠের কিনারের এই বাড়িটার চারপাশে কত রকমে, কত কিছু দেখতে পায় ওরা। এই ভোর হচ্ছে। চকচকে দিনের আলো। রাত নামছে আবার। কখনো আঁধার। পূর্ণিমা। আধো-আঁধার। কখনো বা ভাঙা চাঁদ প’ড়ে থাকে আকাশের কোণায়। রাত-দিনের পরতে পরতে সাজানো এইসব চিত্রময় সময় দেখে দেখে জীবনের মুগ্ধতা, মূল্য নতুন ক’রে বুঝে নিয়েছে। ফিনফিনে কুয়াশার মতো এই চাঁদের আলোর প্রান্তর দেখতে মন চায় আজ।
মাজেদের হাত ধ’রে হাঁটছে ওর বউ। যেন অশরীরী দুটো ছায়া আলোয় ভেসে ভেসে সরে যাচ্ছে দূরে। দুজনারই স্বপ্ন-মগ্ন-মন। হাঁটতে হাঁটতে বউ’র হাতের টানে দাঁড়ালো মাজেদ। ফেনায়িত সাবানের মতো চাঁদটা গলে গলে যাচ্ছে পানিতে। ছোট্ট একটি মাছ তির তির ক’রে সাঁতরে ঢেউ তুললো। ঢেউ-খেলা চাঁদ সরে সরে যেতে লাগলো। শাপলা ফুলের ঝাঁকে মৃদু দুলুনি। এসব দেখতে দেখতে মাজেদের বউ গা লেপ্টে দাঁড়ালো। মাজেদ দু’হাত দিয়ে নিবিড় ক’রে জড়িয়ে ধরলো বউকে।