রাসুর খালি খিদে পায়। তার কী দোষ! সে তো কোনোদিনই তিনবেলা পেট পুরে এক থালা ভাত খেতে পায় না। তাই সারাদিনেও তার খিদে যায় না। আট বছরের রাসুর বাবা নেই। ক্ষেতখোলাও নেই তেমন। থাকার মধ্যে আছে কেবল একখানা ভিটা। এর ওপর এক ঠ্যাংয়ে বকের মতো বেঁকেচুরে দাঁড়িয়ে আছে কুঁড়েঘরটা। সেখানেই কোনোমতে থাকে মা আর ছেলে। তার মা যাকে গ্রামের লোকজন গফুরের বৌ বলে ডাকে, সে সারাদিন গায়ের সচ্ছল গৃহস্থদের বাড়িতে কাজ করে। তাও রোজ জোটে কোথায়! খেতে ফসলাদির আবাদ ভালো হলে গফুরের বৌয়ের কদর বাড়ে। তখন মায়ে-পুতে কিছুদিন পেট পুরে ভাত খেতে পায়। এরপর রাসুর সেই খিদেটা আবার ফিরে আসে।
তার মা তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে,বাজান তুই আগে বড় হ। হেরপর আমাগো আর কোনো কষ্ট থাকব না। কিন্তু তার তো অনেক দেরি। তার ধারণা সে তেমন বাড়ছে না। অথচ মায়ের হতে বোনা সীমগাছটা কেমন তরতরিয়ে বেড়ে উঠছে। আর ক’দিন পরেই ওটা ওদের কুঁড়েঘরের চালে ওঠে যাবে। আর লাউগাছটার কথা তো বলাই যায় না। ডালপালা ছড়িয়ে মাচাটা প্রায় ঢেকেই ফেলেছে। তার স্পষ্ট মনে আছে, মাত্র ক’দিন আগেই মা তার হাতে পুকুর থেকে কচুরিপানা আনিয়েছিল। তারপর গোবর আর কচুরি একসঙ্গে রেখে মাটি দিয়ে ঢেকে দিয়েছিল গর্তটা। কিছুদিন পর এখানটাতেই তো লাউবিচি পুঁতেছিল রাসুর মা। মায়ের দেখানো কায়দায় রাসুও কয়েকটা বিচি গেঁথে দিয়েছিল। তারপর ছোট ছোট কঞ্চি দিয়ে জায়গাটা ঘিরে দিয়েছিল। যেন হাঁস-মুরগি আসতে না পারে। ক’দিনের মধ্যেই লাউয়ের চারা গজালো। এখন কেমন লকলকিয়ে বাড়ছে দেখো। মা বলেছেন,আর ক’দিন পরেই ফুল আসবে গাছটায়। আর সে কিনা আগের সেই ছোট্ট রাসুই রয়ে গেল! সে বলে,আমি আর কবে বড় হমু গো মা। ছেলের কথা শুনে মুখ টিপে হাসেন মা। রাসুর চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে বলেন,ওই পাগলা, মানুষ কি লাউগাছ যে দুই দিনেই লম্বা হইয়া যাইব? মানুষের বাড়তে যেমুন দেরি লাগে, বাঁচেও অনেক বছর। লাউগাছ বাঁচে কয়দিন! মা যে কী সব বলে কিছুই বোঝে না রাসু। মা তখন শ্লোক কাটতে শুরু করেছে, অতি বড় হইও না বাতাসে ভাইঙা যায়, অতি ছোট হইও না ছাগলে পাড়ায়। একরত্তি রাসু কি এর মর্ম বোঝে! সে বলে, মা এই কথার মাইনে কী?
মাইনে হইল খালি হাতে পায়ে বড় হইলে চলব না। বুদ্ধিতেও পাকা হইতে হইব।
মা চলে যাওয়ার পর সে কিছুক্ষণ উঠোনের এককোণে পেয়ারা গাছটার নিচে বসে একা একাই খেলে। গাছের ছায়া দীর্ঘ হতে থাকলে তার খিদে পায়। কোন সকালে কাঁচামরিচ আর পিঁয়াজ দিয়ে কয়টা পান্তাভাত খেয়েছিল সে। এখন এক বাটি গরম ভাত পেলে অবশ্য এই আধদুপুরে তার খিদেটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠত না। এখন সে কী করে! মা বাড়ি ফিরতে ফিরতে সেই বিকেল। কোনো কোনো দিন তো সন্ধ্যা গড়িয়ে যায়। মা অবশ্য খাবার নিয়ে আসবে। মানুষের বাড়ি থেকে খুঁদ কুঁড়ো যা পায়, তা দিয়ে মা ছেলের কোনোমতে দিন যায়। তেল,লবণ কিনতে হলে গাছের ফল ফলান্তি বা শাক সব্জি বিক্রি করতে হয়। তার বয়সী ছেলেমেয়েরা নদী থেকে ছোট ছোট মাছ ধরে। বেশিরভাগই কুঁচো চিংড়ি। তারা তিনটি বাঁশের কঞ্চি আর পাতলা কাপড় একসঙ্গে জুড়ে দিয়ে তিন কোণা ছোট ছোট জাল তৈরি করে। এটা বানানো তেমন কঠিন কাজ নয়। জালের মধ্যে কিছু কুঁড়ো ছড়িয়ে দিয়ে নদীতে ঠেললে তাতে বেশ চিংড়ি ওঠে। অনেকে তো মাছ ধরতে দল বেঁধে বিলেও যায়। রাসু এখন বেশ জানে, পুকুর হচ্ছে মানুষের। নদী আর বিল হচ্ছে আল্লার। তাই ওইসব জলাশয়ে মাছ ধরতে কোনো বাধা নাই। কিন্তু মা এগুলো বুঝলে তো! সে তো রাসুকে একা একা বাড়ি থেকে বের হতেই দিতে চায় না। বলে,না রে বাবা, আমার মাছ খাওনের কাম নাই। মাছ ধরতে গিয়া তুই যদি পানিতে পইরা যাস।
রাসু সাঁতার জানে না। কিভাবে জানবে সে। মা তো তাকে গাঙ্গে যেতে দেয়নি। গাঙ্গে গিয়ে ডুবাডুবি না করলে আর কিছু নোনা পানি না খেলে কি সাঁতার শেখা যায়! নদীতে গোসল করতে হলে এখনো তাকে মায়ের সঙ্গে যেতে হয়। অথচ তার বয়সী ছেলেপুলেরা ল্যাংটা হয়ে নদীতে সমানে দাপাদাপি করছে। কিন্তু মাকে বোঝাবে কে! এখন আবার তার তাড়াতাড়ি বড় হতে না পারার দুঃখ মনে পড়ে যায়। একইসঙ্গে চাগিয়ে ওঠে লুকিয়ে থাকা খিদেটাও।
আর তো সহ্য হচ্ছে না। খিদে পেটে খেলাধুলাও ভাল্লাগছে না। কিন্তু ঘরে তো আজ কিছুই নেই। সে এখন কী করে! মায়ের কাছে যাওয়াও তো বারণ। এসময় রাসুকে দেখলে মা খুব রাগ করবেন। আসলে তার মা চায় না গৃহস্থবাড়ির বউ ঝিয়েরা রাসুকে দেখে বিরক্ত হোক কিংবা করুণা করুক। তাই সেখানে যাওয়া হবে না তার। এইসব ভাবতে ভাবতে বাড়ির চারপাশে একটা ঘুরান দিয়ে আসে সে। ঘরে ঢুকে এক মগ পানি খেয়ে পেটটা মাটিতে দিয়ে শুয়ে থাকে। এইটা তার খিদা দূর করার একটা কার্যকর পদ্ধতি। এই বুদ্ধিটা নতুন শিখেছে সে। সে দেখেছে, পেটটা মাটির সঙ্গে লাগিয়ে শুয়ে থাকলে কেমন ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা লাগে। তখন আর ক্ষুধা ভাবটা টের পাওয়া যায় না। এভাবে শুয়ে থাকতে থাকতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ে সে। সন্ধ্যার দিকে বাড়ি ফিরে ছেলের ঘুম ভাঙায় গফুরের বউ।
নে ভাত আনছি। খাইয়া ল।
তুমি খাইবা না?
আমি তো খাইয়া আইছি। তুই খা।
হাঁচা কইতাছ তো!
মিছা কমু ক্যান?
রাতে রাসুর মা পিঁয়াজ আর শুকনা মরিচ একসঙ্গে ডলে বেগুন ভর্তা করে। গরম গরম ভাতের সঙ্গে তাই যেন অমৃত মনে হয় রাসুর কাছে। সে সানকির সব ভাত চেটেপুটে খেয়ে নেয়। মাকে বলে,তোমার হাতে কি যাদু আছে? এমন মজার বেগুন ভর্তা তো জীবনেও খাই নাই। ছেলের কথা শুনে গোপনে চোখ মুছে গফুরের বউ। বিকেলে বাড়ি ফেরার পথে মোল্লাবাড়ির ছোট বউয়ের কাছে সে বেগুন চেয়েছিল। ওদের বাড়ির নামার জমিনটায় বেগুন চাষ করা হয়েছে। তাতে গোলাপ ফুলের মতো গোলাকার বেগুনগুলো কি সুন্দর ঝুলে আছে! এক একটা গাছে পনেরো বিশটা করে বেগুন ঝুলছে। দেখলেই লোভ লাগে। ছোট বউ মাত্র দুইটা বেগুন ছিঁড়ে ওর হাতে দিয়ে বলেছে, নে। আর গুলান বাত্তি হয় নাই।
রাতে ভাত রান্না করার পর চুলার কাঠকয়লার মধ্যে ফেলে ওগুলো সিদ্ধ করেছে। ঘরে সরিষার তেল ছিল না। একটা পিঁয়াজ আর দুইটা ভাজা মরিচ দিয়ে বেগুন দুইটা ডলেছে সে। তা খেয়েই ছেলের কি খুশি দেখ! ছেলেটার ভালোমন্দ খাওয়ার খুব শখ। কিন্তু তার পক্ষে ওর সেই শখ পূরণ করা সম্ভব হয় না। তিন বেলা তিন মুঠো ভাতই তো জোগাড় হয় না ঠিকমতো। আর অন্য কিছু কিভাবে করবে সে? অগ্রাহায়ণ মাস চলে যাচ্ছে। অথচ এই শীত মৌসুমে একটা পিঠাও তৈরি করতে পারেনি সে। অথচ রাসুর বাপ বেঁচে থাকতে এত অভাব ছিল না তাদের। এইসব কথা মনে করে অনেকক্ষণ ধরে কাঁদে গফুরের বউ।
যেন সেইদিনের কথা। গাদলার দিন টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছ। ভোরে ঘুম থেকে উঠেই মানুষটা গেল গাঙে মাছ ধরতে। বউ তারে বার বার বারণ করেছিল। কিন্তু সে শোনে নাই। কেননা তার ছিল মাছ ধরার তীব্র নেশা। যাওয়ার সময় ছিপ গোছাতে গোছাতে সে কেবল বলেছিল,আকাশের অবস্থা দেখছ। আইজ হইল মাছ মারার দিন। গাঙে অনেক মাছ দাপাদাপি করতাছে। যাই কয়টা মাছ ধইরা নিয়া আহি। রুই,বোয়াল নইলে একটা কাতলা পাইলে কি দারুণ হইব! তুমি মজা কইরা বিরান রানবা! গোসা কইর না বউ। আমি যামু আর আমু। কিন্তু সেই যে গেলো মানুষটা আর ফিরল না। দুপুরের দিকে তার নীথর দেহটা ধরাধরি করে বাড়ি নিয়ে এসেছিল গাঁয়ের লোকজন। মানুষটার কী হয়েছিল, কেউ বলতে পারেনি। কেউ বলে সাপে কেটেছে। কেউ বলে বাতাস লেগেছে। মাছ ধরার নেশাই শেষ করে দিল মানুষটারে। তাই সে রাসুরে গাঙে যেতে দেয় না।
পরদিন সকালে কাজে যাওয়ার আগে সে রাসুকে ডেকে বলে,অহন বিলে ধান কাটা শেষ। ক্ষেতে অনেক ধান পইরা আছে। পাড়ার পোলাপানের লগে গিয়া তুই ধান টোকাইতে পারবি না! মায়ের প্রস্তাব শুনে শুনে খুশিতে চোখ দুটো চকচক করে ওঠে রাসুর। সে বলে,পারুম মা। খুব পারুম।
সাবধানে থাকিস। পানির ধারে যাইস না যেন।
রাসুর আজ খুব আনন্দের দিন। তার মা আজ তাদের ছোট্ট ডেরাঘরটায় বসে মুড়ি ভাজছে। কতদিন পর যে মুড়ি ভাজছে তার মা! সে তার হিসাব করতে পারে না। গত কয়েক দিনে বিল থেকে সে তিন সেরের মতো ধান কুড়িয়ে এনেছে। লোকজনের বাড়িতে কাজ করে তার মাও বেশ কিছ ধান জোগাড় করেছে। সেগুলো সব মিলিয়ে চাল করে আজ সে মুড়ি ভাজতে বসেছে। মুড়ি ভাজার সময় তার রান্নাঘরে যাওয়া বারণ। পিঠা বানানোর সময়ও তার মা এমন করে। বিশেষ করে যখন তেলের পিঠা তৈরি করে তখন। তার মা বলে,মাইনষের নজর লাগলে পিঠা ফুলে না। মা মুড়ি ভাজে আর রাসু চুপচাপ দাওয়ায় বসে থাকে। আজ বাড়িতে মুড়ি ভাজা হচ্ছে। তাই সে ধান কুড়াতেও যায়নি। মুড়ি ভাজার শব্দগুলো তার অদ্ভুত লাগে। গরম বালুতে চাল পড়লে কেমন পটপট শব্দে সেগুলো ফুটে মুড়ি হতে থাকে। মুড়ি ভাজার কাজটি সাধারণত দুই তিন জন মিলে করে। একজন দোআইক্কা চুলায় দুইটা মাটির হাড়িতে বালু আর চাল ভাজতে থাকে। এরপর গরম বালুতে চাল ফেলে হাড়িটা হাতে নিয়ে একটা নাড়া দিয়েই ঝাঁঝরিতে ঢেলে দেয়। অন্যজন শলা দিয়ে নেড়ে নেড়ে ঝাঁঝরি থেকে সেই বালু নিচে ফেলতে থাকে। কিন্তু হাসুর মা মুড়ি ভাজার মতো জটিল কাজও একা হাতেই করছে। সাহায্যের জন্য সে গ্রামের কাউকে ডাকেনি। মুড়ি ভাজার পটপট শব্দ বশির দাওয়ায় বসেই স্পষ্ট শুনতে পায়। আর ওর কেমন যেন ঘুম আসতে থাকে। সে বারান্দার মাটিতে গামছাখানা পেতে শুয়ে পরে। আহা কি মায়া! যেন এমন মধুর শব্দ এইটুকুন জীবনে সে আগে কখনো শোনেনি।
মুড়ি ভাজতে ভাজতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল। হাসুর মা মুড়ি দিয়ে মাচায় থাকা সমস্ত কলস আর টিনগুলো ভরে ফেলে। ওই কটা চালে অত মুড়ি হবে রাসু তো ভাবতেও পারেনি। ভালোই হলো, রাসু যখন বাড়িতে একা থাকবে তখন ক্ষিদে পেলে সে মুড়ি খেতে পারবে। গফুরের বৌ একটা ছোট বেতের ঝুড়িতে বেশ খানিকটা মুড়ি তুলে রাসুকে দিয়ে বলে,
তুই এগুলান খাইতে থাক। আমি গাঙ থেইকা একটা ডুব দিয়া আহি।
গরম ফুরফুরে মুড়ি খেতে খেতে রাসুর মনে হয় এমন সোয়াদের জিনিস সে আগে কোনোদিন খায়নি। ইস! মুড়ির লগে যদি এক টুকরা পাটালি হইত! এই চিন্তা মাথায় আসার পর মুড়িগুলো খেতে আরো সোয়াদ হয়ে যায়। সে যেন নিজের জিহ্বাতেও মিষ্টি গুড়ের স্বাদ পায়। মুঠি ভরে মুখে দেয় বকুল ফুলের মতো ঝরঝরে সাদা মুড়িগুলো। ঝুড়ির মুড়ি শেষ হওয়ার পর তার কি যে কষ্ট লাগে! ধুর ছাই! কী খাইলাম, খিদা-ই তো যায় নাই! সে মাচায় উঠে কলসি থেকে ফের মুড়ি ঢেলে নেয়। এরপর সে খায় আর খায়। ঝুড়ি খালি হলে আবার নেয়। এভাবে সারা বেলা সে মুড়িই খেয়ে চলে।
গোসল শেষে বাড়ি ফিরে গফুরের বৌ দেখে, রাসু বারান্দায় পেটখানা মাটিতে বিছিয়ে ঘুমিয়ে আছে। উঠোনের দড়িতে ভেজা কাপড়খানা মেলে দিয়ে সে ডেরাঘরে যায় এবং কাঁখের জলভরা ঠিল্লাখানা এককোণে রেখে দেয়। এই গাঙ্গের পানি দিয়েই রান্নাবান্নার যাবতীয় কাজ চলে। খাওয়ার জন্য টিউবয়েল থেকে পানি আনতে হয়। এই গ্রামে কোনো টিউবওয়েল নেই। পানির জন্য তাকে অনেক দূরে যেতে হয়। এসব ভাবতে ভাবতে রাসুর মা বেরিয়ে আসে। ছেলেটাকে তুলে ঘরে এনে শুইয়ে দিতে হবে। এর আগে মেঝেতে মাদুর বিছাতে হবে। কিন্তু ঘরে ঢুকে মাচা থেকে মাদুরটা নিতে গিয়ে দেখে, মাচার সব পাত্র খালি পড়ে আছে। একটাতেও মুড়ি নেই। শেষে কি গ্রামে মুড়ি চোর আসল! সে গিয়ে রাসুকে ডেকে তোলে।
অই রাসু, মুড়ি গেল কই?
অপরাধীর মতো মুখ করে রাসু বলে,মা, আমার না খুব ক্ষুধা লাগছিল। তাই খায়া নিছি।
অতগুলান মুড়ি তুই খায়া নিছিস? একাই খাইছস? না অন্য কাউরে দিছস?
হ, একলাই খাইছি। কাউরে দেই নাই।
নিজের কানকেই যেন বিশ্বাস করতে পারছে না গফুরের বৌ। সকাল থেকে অতগুলো মুড়ি ভেজেছে সে। একটা মুড়ি দাঁতে কাটেনি। আর রাক্ষস ছেলে কিনা সব মুড়ি একাই খেয়ে নিল! রাগে দিশেহারা হয়ে যায় সে।
দাঁড়া তোর পেট কাইট্টা আমি সব মুড়ি বাইর করমু। দেহি তোর পেট কত বড় হইছে।
রান্নাঘর থেকে আঁশবটিটা নিয়ে আসে হাসুর মা। বঁটি হাতে রাসুর দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। আট বছর বয়সী ছোট্ট শিশু রাসুর পক্ষে একজন প্রাপ্তবয়স্ক নারীকে বাধা দেওয়া সম্ভব হয় না। তখন তার আবারও মনে হয়, সে আসলেও অনেক ছোট। তার আরও বড় হওয়া দরকার ছিল। এজন্য তার খুব আফসোস হয়। যদিও এতে কোনো লাভ হয় না। গফুরের বৌ ধারালো বটিটা দিয়ে ছেলের পেটটা কেটে দুই ভাগ করে ফেলে। কিন্তু পেট কাটার পর সে হতাশ হয়। কেননা রাসুর পেটে কোনো মুড়ি ছিল না। নাড়িভুড়ি সরিয়ে সে কেবল এককোণে ছোট্ট একখানা বল দেখতে পায় যা অনেকটা মুড়ির মোয়ার মতোই দেখতে। সে রাসুর নিস্তেজ দেহটা কোলে তুলে নদীতে নিয়ে যায়। ভাঁটার সময় ধানখালি নদীর পানি কমে যায়। তখন নদীটাকে একটা চিক্কন সুতানালি সাপের মতো লাগে। পানি সরে গেছে তীর থেকে অনেকখানি দূরে। অত বড় খস্রোতা নদীটাকে এখন দেখে মোটেই বোঝার উপায় নেই ওর আসল রূপ। ছোটখাটো একটা খাল বলেই ভ্রম হয়। যার তীরজুড়ে কেবল বালু আর বালু। স্লেটের মতো ছাই রংয়ের ভেজা বালুতে গর্ত করে ছেলের লাশটা পুঁতে রাখে গফুরের বৌ।
বাড়ি ফিরে আসার কিছুক্ষণ পর রাসুর মায়ের বুকের কোণে জেগে ওঠে এক টুকরো মমতা। উপলব্ধি হয় রাগের মাথায় কত বড় নিষ্ঠুরতা করেছে সে। সামান্য মুড়ির জন্য সে খুন করেছে নিজের ছেলেকে। তার এক মাত্র নাড়ি ছেঁড়া ধন রাসুকে। তখন কাঁদতে কাঁদতে পাগলের মতো নদীর তীরে ছুটে যায় রাসুর মা। কিন্তু ততক্ষণে জোয়ার এসে গেছে। ফুঁলে ফেঁপে অজগরের মতো বিশাল হয়ে গেছে ধানখালি। কুল উপচে পড়ছে তার কালো জল।ক্রন্দসী মা নদীতে নেমে বালুর মধ্যে দু হাত ঢুকিয়ে ছেলের কবরটা খুঁজতে থাকে। কিন্তু কিছুতেই সে আসল জায়গাটা ঠাহর করতে পারে না। অথবা এমনও হতে পারে স্রোতের টানে অন্য কোথায় সরে গেছে রাসুর মৃতদেহ। কিন্তু মায়ের মন তো অত বাস্তবতা বোঝে না। গফুরের বৌ তখনও অন্ধের মত নদীর ঘোলা জল হাতড়ে চলে। আর কেঁদে কেঁদে বলে:
ভাটিতে খাডাইলাম পুত
জোয়ারে নিল পুত
পুত পুত পুত
তোমরা যদি কখনো কোনো ভরা নদীর কূলে যাও, তখন শুনতে পাবে রাসুর মায়ের সেই করুণ কান্না। এখনো সে জলের মধ্যে ছেলেকে খুঁজে ফিরছে আর বিলাপ করে বলছে,পুত পুত পুত।