এক.
মধ্যরাতের ট্রেনের হুইসেলটা সিরাজের ভেতরের জমাট অস্তিত্বকে যেন বা খুঁচিয়ে দেয়। গত মাস থেকে যে স্বপ্ন সে বুনে যাচ্ছে, সেই স্বপ্নগুলোও নাড়াচাড়া দিয়ে আবার থিতু হয় ক্ষণিকের জন্য। তখন সে পাশ ফিরে ডান কাতে শোয়। পাশেই আজিজা বেহুঁশের মতো ঘুমাচ্ছে। চার-পাঁচটা সন্তানের মা আজিজার শরীর বলতে এখন আর কিছু নেই। দারিদ্র্য, অনাহার আর দুশ্চিন্তার কবলে পড়ে এখন জীবনের অস্তিত্বটুকুই কেবল বোঝা যায়। অনাহার আর অমানসিক পরিশ্রম নিত্যসঙ্গী। সারাদিন ধান-ভাঙানোর বয়লারে কাজ করে সন্ধ্যার পর কোনোক্রমে বিছানায় গা লাগাতে পারলেই ঘুমের অতলে সে ডুবে যায়─তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না।
আজিজার অন্য পাশে শুয়ে আছে তিনটি মেয়ে আর দুটি ছেলে। কনিষ্ঠ হান্নান মায়ের দুগ্ধহীন স্তন চুষে যাচ্ছে ঘুমের মধ্যে। ইদানীং সিরাজের মনে অশান্তির আগুন মাঝে মাঝেই দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে। নিজে আগে ভ্যান চালাতো। এখন ভ্যানমালিক জমার টাকা বাড়িয়ে দেওয়ায় সে রাগারাগি করে ভ্যান চালানো ছেড়ে ক্ষেতমজুরি শুরু করেছে। ক্ষেতেও এখন কাজ নেই। এই ছেলেমেয়েদের মুখে আহার জোটাতে পারে না, রুগ্ণ স্ত্রীর সঙ্গে দুটি কথাও সে ভালো করে বলতে পারে না। তার স্ত্রী সর্বক্ষণই চেঁচায়। খিঁচানো মেজাজের জন্যই এমনটি হয়, তা সিরাজ বুঝতে পারে ভালো করেই। এত আকাল! ডাক্তার দেখাবে, সে মুরোদও তার নেই। মাঝেমধ্যে মাথা খারাপ হয়, ছেলেমেয়েদের গালাগাল দিয়ে গুষ্টি উদ্ধার করে আর মাঝেমধ্যে চড়থাপ্পড় মারতেও তার প্রাণে বাধে না। তবে রাতে শুয়ে শুয়ে তার নিষ্ঠুর আচরণের জন্য অনুতপ্ত হয়, কষ্টে বুকের ভেতরটায় কাঁইকুঁই করে। কিন্তু এরপরও তার কিছু করার থাকে না।
আজ রাতেও আধপেটা খেয়ে সবাই শুয়েছে। অন্যরা ঘুমিয়ে পড়েছে কি না, তা সিরাজের পক্ষে বলা অসম্ভব। ক্যাঁওম্যাঁও তো আছেই মাঝেসাঝে; তারপর আবার কোনোটা স্বপ্নের ঘোরে উদ্ভট সুর তোলে। এতে চোখ জুড়ে ঘুম এলেও তাও সটকে পড়ে। নানা রকম দুশ্চিন্তায় এমনিতেই মাথা গজ গজ করছে; এরপরও বিভিন্ন শব্দে ঘুম আশপাশে আসতে পারছে না।
পুবের ঘরে বুড়ো মায়ের হাঁপানিটা বেড়ে গেছে। তারও হয়তো ঘুম আসছে না─তাও বুঝতে পারছে সিরাজ। আগামী মাসে মায়ের খাওয়ার ভার সিরাজের ওপর। এই মাস চালাচ্ছে তার ছোট ভাই ইন্তাজ আলী। বুড়িটা মরলেও জঞ্জাল কমতো─এমন একটা ভাবনা তার মাথায় গিজ গিজ করে।
মালেক কয়েক মাস আগে বলেছিল, ‘ঢাকায় গেলে কামের কোনো অভাব নাই।’ সে একটা প্রেসে পিয়নের কাজ করে। গ্রামের বুলি ভুলেই গেছে। শহরের ভাষায় কথা বলে। সিরাজ মনে মনে বলে, ‘হেই দিনের যুগি ভাতের কয় অন্ন। ঠমক কত! ইংলিশ মারে!’
‘যুগি হউক আর যা-ই হউক…কামের একটা বিহিতের কথা দিশানা দিছে। যদি একটা করা যায় তাতে মন্দ কী?’ সিরাজ মনে মনে বলে, আবার পাশ ফিরে শুয়ে ঘুমানোর জন্য চোখ বন্ধ করে। বাইরে শরতের চাঁদের জোছনা। বেড়ার ফাঁক গলে সামান্য আলো ঘরেও ঢুকেছে। স্নিগ্ধ বাতাস আর মোলায়েম জোছনায় বাইরের পরিবেশ সৌম্যশান্ত।
সে এসে সিরাজের আপাদমস্তক নিরীক্ষা করে বলল, ‘এই মিয়া, এই শরীর দেইখ্যা কোনো ব্যাটা তোমারে ভিক্ষা দিবোনি? ভং ধরো। না অইলে ভিক্ষা ফাইবা না।’
মালেকের বুদ্ধিতেই কালকের দিন পরেই সিরাজ চলে যাবে ঢাকায়─যদি কোনো কিছু করার উপায় করা যায়; গ্রামে এখন আর কোনো কাজ করে দুবেলা ভাত জোটানো সম্ভব নয়। ঢাকাতেও তার কেউ পরিচিত নেই, কোথায় থাকবে, কী খাবে ইত্যাদি বিষয়ও তার ভাবনাতে স্থান করে নেয়। মালেকের বুদ্ধি খারাপ নয়। সে বলেছিল, ‘সেখানে কত মানুষ থাকে; কেউ না কেউ একটু থাকার জায়গা দেবে। তুমি যাও। গেলেই ব্যবস্থা হয়ে যাইবে। শত এলোমেলো ভাবনা আর মনকথা মাঝরাতের দিকে থিতু হয়।
দুই.
সিরাজ কমলাপুর স্টেশনে যখন নামল তখন সন্ধ্যা। পকেটে পঞ্চাশ বা দুই এক টাকা কম-বেশি হতে পারে─এই টাকাগুলোই তার পুঁজি। সকালে পান্তাভাত খেয়ে বাড়ি থেকে বের হয়েছিল। খিদায় শরীরটা আর চলে না। স্টেশন পার হয়ে সে সামনের দিকে হাঁটতে থাকে। ফকিরাপুলে এসে দেখে, এখানে হাজার হাজার মানুষ। হোটেলেও আছে অনেক। কত রঙের মানুষ খেয়েদেয়ে ঢেকুর তোলে হোটেল থেকে বের হচ্ছে। কোনো কোনো হোটেলের খাবারের খুশবু যেন মনে হয় বেহেশতি খাবার। এই সব হোটেলে একটু উঁকি দিয়ে দেখে সিরাজ কিন্তু ভেতরে ঢোকার সাহস পায় না। খেতে গেলে কত টাকা লাগে, কে জানে? ফুটপাতের টং-দোকান থেকে একটা বনরুটি আর একটা কলা খেয়ে পানি খেল সিরাজ। তারপর ঢাকা শহরের চা একটু না খেলে যেন তার অতৃপ্তি থেকে যাচ্ছে। একটা চাও খেল। প্রতিটি খাবারের আগে মূল্যটা জিগ্যেস করে নেয়, যাতে পাছে বেইজ্জত হতে না হয়। সন্ধ্যা গড়িয়ে সামনের দিকে যাচ্ছে। শহরের পথবাতিগুলো জ্বলে উঠেছে। ফকিরাপুলের মোড়ে দাঁড়িয়ে সিরাজ দেখছে, তার মতো হতদরিদ্র মানুষ আছে কি না, তারা কী করে, তাদের আচরণবিধি, মুভমেন্ট পরখ করে যাচ্ছে। সে ভাবছে, এখানে কীভাবে জীবন শুরু করবে? মালেকের ঠিকানাটা জানা থাকলে তার কাছে একটু আশ্রয় হয়তো নেওয়া যেত। না, তা রাখার বুদ্ধিও সেদিন হয়নি। এই সময় গ্রামের কথা, তার পরিবারের কথা, তার মায়ের কথা খুব মনে পড়ে। অন্তরাত্মায় কান্না অনুভ‚ত হয়। সিরাজ ভাবে, এসব ভাবলে আজ চলবে না।
ফুটপাতের ওপর একটা ঝুপড়ির কাছে সে বসে পড়ে। এখানে অনেকগুলো শিশু─ এগুলোর অবস্থা ভালো নয়। ওরা এখানে ঘুমায়─বুঝতে পারে সিরাজ। আজকে পথেই ঘুমানোর চিন্তা করছে সিরাজ। কিন্তু পেটের খিদা মেটেনি। আর কিছু খাওয়াও যাবে না। টাকাগুলো হিসাব করে খরচ করতে হবে যত দিন না কাজ পাওয়া যায়।
পকেট থেকে বিড়ির প্যাকেট বের করে সে আয়েশ করে একটা বিড়ি ধরায়। তখন ঝুপড়ির পাশ থেকে এক মধ্যবয়সী লোক এসে সিরাজের পাশে বসে জিগ্যেস করে, ভাইজানের সাকিন?
—সাকিন ঈশ্বরদী, পাবনা জেলা।
—ঢাকায় পরথম আইছেন?
—জে, পরথম।
—খাওয়া-দাওয়া হয়েছে?
—জে।
—পথেই ঘুমাইবেন?
—জে। থাহনের কুনো জায়গা নাই।
—আমিও পথেই ঘুমাই। সারা দিন কাজকর্ম করি। রোজগার ভালোই। পথে ঘুমাইলে নিচিন্তা ঘুমান যায়। চোরছেঁচুড়ের ভয়ডর নাই। ধরেন, আমি আইজ কামাইলাম তিন শ ট্যাহা। এই খবর কিন্তু কেউ বিশ্বাসই করবো না। নিচিন্তায় ঘুমাই। রাইত কাভার অইলে আবার কামের চিন্তা। মেলা ট্যাহা জমছে। দুই হপ্তা পর বাড়িত যাই।
তারা আরও কিছু আলাপ-আলোচনা করে পথের ওপরই পাশাপাশি শুয়ে পড়ে। ক্লান্তি আর ক্ষুধায় সিরাজের শরীরটা যেন বিলের তলার কাদার মতো হয়ে গেছে। মশার যন্ত্রণা থেকে বাঁচার জন্য গায়ের জামাটা খুলে কান দুটি পেঁচিয়ে শুয়ে পড়ে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সে বেঘোর ঘুমের মধ্যে ডুবে যায়।
ভোর বেলা সূর্য তির্যক আলোর ঘায়ে সিরাজের চোখে খোঁচা লাগে আর তখনই সে ধড়ফড়িয়ে জেগে উঠে দেখতে পায়, তার পাশের লোকটি নেই। মাথার নিচে ছোট কাপড়ের পোঁটলা এবং সেখানে লুকিয়ে রাখা টাকাগুলো নেই। এখন পরনের কাপড় আর নিজের শরীরটা ছাড়া তার কাছে আর কোনো কিছুই নেই।
নিরুপায় হয়ে কিছুক্ষণ আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। মনে মনে লোকটিকে অভিসম্পাত দেয়। উত্তুঙ্গ অট্টালিকার চ‚ড়া ভেদ করে বিকীর্ণ আলোকচ্ছটা এই শহরকে আলোকিত করে রাখলেও সিরাজের চোখ দুটি যেন অন্ধকারের পুরো মলাটে আবৃত। মাথাটা ঝিমঝিম করছে, নির্ভরতার পা দুটিও কাঁপছে। তবু সে আস্তে আস্তে হেঁটে সাহস সঞ্চয় করে।
একসময় হাঁটতে হাঁটতে সে চলে আসে হাইকোর্টের মাজারের পাশে। হাইকোর্টের মাজারের আঙিনা যেন ভিক্ষুক-কলোনি। মাজারে অনেক ভিক্ষুক বিভিন্ন কৌশলে ভিক্ষা করছে। সিরাজের এই মুহূর্তে পেটের ক্ষিধে মেটানোর জন্য ভিক্ষা করা ছাড়া দ্বিতীয় কোনো পথ সে আর খুঁজে পায়নি। ক্ষিধাটা একটা নির্মম দুশমন হয়ে তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। একজন ভিক্ষুকের ভিক্ষা করার কৌশল দেখে সেও হাত পাতে─ ‘স্যার, দুইডা ট্যাহা দেন, ভাত খামু।’
পাশ থেকে এক পৌঢ়, যে এখানকার ভিক্ষুকদের সর্দার এবং ভিক্ষা-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রক কিংবা আরও একটু ভালো ভাষায় বললে বলা যায় ভিক্ষুকদের গডফাদার। তার নাম তোরাব আলী। সে এসে সিরাজের আপাদমস্তক নিরীক্ষা করে বলল, ‘এই মিয়া, এই শরীর দেইখ্যা কোনো ব্যাটা তোমারে ভিক্ষা দিবোনি? ভং ধরো। না অইলে ভিক্ষা ফাইবা না।’
এই বলে সে খোঁড়া সেজে দেখিয়ে বলল, ‘এমবায় ভং ধরো। তাও যদি না ফারো, রোগা মানুষ লইয়্যা আইও। রোগা মানুষ অইলো ভিক্ষার বড় পুঞ্জি, বুঝলা মিয়া।’ বাড়িত কোনো রোগাসোগা মানুষ আছেনি?
সিরাজ কথা না বলে ভং ধরার চেষ্টা করল। ঘণ্টা দু-একের মধ্যে সত্যি সে কিছু টাকা পেয়েও গেল। টাকাগুলো হাতে নিয়ে মনে মনে বলে, ট্যাহা তো আইবোই, অহন একটা বোম্বাইয়া খাওয়া─তার পরে দেহা যাইবো কী করা যায়?
একটি চকলেট খেয়ে অন্য একটি হাতে রেখেছে অনেকক্ষণ ধরে, পাছে যদি শেষ হয়ে যায় সেই ভাবনায়।
সিরাজ খেল। দীর্ঘদিন পরে সে পেট পুরে খেয়ে হোটেলের বিল দিয়ে বাইরে এসে ঢেকুর তুলল। সিগারেটের দোকান থেকে এক খিলি পান আর একটা নেভি সিগারেট টেনে আস্তে আস্তে সে মাজারের পাশে এসে দাঁড়াল। একটা ফিল্টারঅলা সিগ্রেট খাওয়ার দীর্ঘদিনের শখ ছিল তার। তাই সিগ্রেটটা মাঝে মাঝে দেখে আর আস্তে করে টান দেয়, যাতে দীর্ঘক্ষণ এর ধূম্র সেবন করা যায়।
তিন
দু-তিন দিনের মধ্যেই সিরাজের সঙ্গে তোরাব আলীর খাতির জমে ওঠে। তোরাব আলী তাকে পঞ্চাশটা টাকা দিল বিপদে-আপদে খরচ করার জন্য। তারপর বলল, ভিক্ষা কইর্যা্ শোধ দিও। ষাইট ট্যাহা দিও। দুই দিন সোমায় দিলাম। সিরাজ রাজি হয়ে সহাস্যে টাকাগুলো নিল। তোরাব আলী একটি বস্তির ঘরও তাকে ঠিক করে দিল হাইকোর্টের পেছনে। এখন আর তাকে পথে ঘুমাতে হয় না।
—এক রাতে তোরাব আলী সিরাজের বস্তিঘরে ঢুকে। তোরাব আলী জিগ্যেস করে, কী সিরাজ মিয়া, রোজগার কেমুন?
—না ভাই, বেশি সুবিধার না।
—শুনো মিয়া…ঢাহা অইল গিয়া টাহার শহর। খালি মাথার বুদ্ধিডা খাডাইতে ফারলেই অইলো। কত আবাল-আবুল কোডি ট্যাহার মালিক অইল চৌক্ষের সামনে। ঢাহায় বাতাসে ট্যাহা ঘুইর্যাা বেড়ায়। যারা বাতাসে টাহা দেখতো ফারে, তারাই কোডি টাহার মালিক অয়। বুঝলা কিছু?
সিরাজ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, না। আমার মাথায় কুলায় না। কিছুই বুঝলাম না।
—তোমারে আগেই কইছিলাম না, ভিক্ষা করলে─ বুঝলা, রোগাসোগা মানুষ যদি অয়, তাইলে ভিক্ষা কইর্যাাই লাখ লাখ টাহা কামানো যায়। বুঝলা কিছু? আর যদি মানুষ না ফাওয়া যায়, তাইলে নিজেরই রোগা অওন লাগবো। বুঝলা কিছু?
বুঝছি। কিন্তুক রোগাসোগা মানুষ কই ফাই?
—আরে মিয়া, ভাড়া আনবা। ভাড়া ফাওয়া যায়। বুঝলা কিছু?
—আচ্ছা, দেহি চিন্তা কইর্যান।
তোরাব আলী ঝিম ধরে থাকে কিছুক্ষণ। ছোট্ট ঘরটিতে অকাট্য নীরবতা। কেউ কোনো কথা বলছে না। কিছুক্ষণ পর তোরাব আলী নীরবতা ভেঙে বলল, দুই নম্বরি পথ অনেক। মাইয়্যা মানুষ যদি জোগাড় করতা ফারো, তাইলেও টাহার অভাব নাই।
—কী কন মিয়া ভাই? মাইয়্যা মানুষ দিয়া কী অইবো?
—মনে অয় আসমান থাইক্যা ফরলা? কিছ্ছু বুঝলা না?
—অয় বুঝছি। তয় এই কাম আমার ফক্কে সম্ভাব না।
—তাইলে তোমারে আর কি বুদ্ধি দেই। যদি ভিক্ষাই করতা চাও, তাইলে রোগাসোগা মানুষ ভাড়া লইয়্যা আও। মানুষের শরীলডাই আসল সম্পদ। বুঝলা কিছু? তুমি যদি আঙুডি থাহো দেখবা মানুষ তোমারে তোয়াজ করতাছে, তোমারে কাম দিতাছে। বহুত মাইনসে তোমারে পছন্দ করতাছে। তোমার যদি বুদ্ধিজ্ঞান থাহে, তাইলে তুমি নিজেই সম্পদ কামাইতে ফারবা। আবার তোমার শরীলডা যদি অসুখ থাকে, তাইলেও মানুষ তোমারে দয়াদক্ষিণা করবো…ট্যাহা দিবো। এই কথাগুলো বলে তোরাব আলী কিছুক্ষণ থামে। পকেট থেকে বের করে একটা গোল্ডলিফ সিগারেট নিজে ধরায় আর একটা সিরাজকে দেয়। গোল্ডলিফ সিগারেট হাতে নিয়া সিরাজ হতভম্ব হয়ে যায়। চলিশ বছরের জীবনে এই প্রথম সে দামি সিগারেট হাতে ছুঁয়ে দেখল। ঘ্রাণটা তার নাকের ডগায় সুড়সুড়ি দেয়। মালেকের প্রতি মনে মনে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। ঢাকায় না এলে এত দামি সিগারেট হয়তো সে হাতেই নিতে পারত না। তোরাব আলী নিজের সিগারেট জ্বালিয়ে তারপর সিরাজের সিগারেট ধরিয়ে দেয়। দুটি দম দিয়ে তোরাব আলী আবার বলতে শুরু করে, মেরাডোনারে ছিনোনি?
—হে আবার কেডা?
—এইতো মিয়া জীবনে কী চিনলা আর কী দেখলা? টিভি দেহো না?
—না, তা কইত্থে দেহুম? গরিব মানুষের আবার টিভি দ্যাহে?
—আরে মিয়া, এই অইলো গিয়া গেরামের মানুষ আর টাউনের মানুষের মধ্যে পারতেক্ষ। মেরাডোনার দুই ঠ্যাংগের দাম কয়েক কোডি ট্যাহা। বুঝলা কিছু? মানুষের শইলের পেরতেকটা জিনিসেরই দাম আছে। মূল্য আছে। ধরো, তোমার ঠ্যাং আছে তুমি চলাফেরা করতাছো। আবার ঠ্যাং নাই তাও ভালা…তোরাব আলী সিগারেটে খুব জুতসই একটা দম দিয়ে বলে, ল্যাংরা ঠ্যাং দেহাইয়্যা অনেক টাহা কামাইতে ফারবা। তাইলে পেরতেকটা জিনিসের দাম অইলো না? অতঃপর তোরাব আলী মানুষের শরীরের প্রতিটি অঙ্গে বর্ণনা করতে করতে একসময় সে অশালীন ধারাবর্ণনায় পৌঁছায়। সিরাজের বিমূঢ়, অস্বচ্ছতা পাতলা চিন্তার বাইনে ঢুকে স্বচ্ছতা, মূর্ততা মিহিন বাইনে পরিণত হয়। তোরাব আলীর জ্ঞান-দর্শনের বর্ণনায় সিরাজ মুগ্ধ হয় এবং একসময় তার চোখে এক তোরাব আলী একজন আদর্শ মানুষ হিসেবে সিরাজের কাছে ধরা দেয়। তোরাব আলী সিরাজকে বোঝাতে সক্ষম হয় মানুষ মানুষের শরীর হলো বড় ক্যাপিট্যাল─ যারা বুঝেশুনে কাজে লাগাতে পারে, তাদের কাছে পারত্রিক জীবনের জন্য কোনো সমস্যা থাকে না। আর যারা না বোঝে, তারাই পড়ে নানা বিড়ম্বনায়।
তারা আরও কিছুক্ষণ প্রাসঙ্গিক-অপ্রাসঙ্গিক কথা বলে একসময় তোরাব আলী সিরাজের বস্তিঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়।
আজ রাতে সিরাজের মাথায় অন্য একটা চিন্তা ঘুরপাক খায়। আগামী মাস থেকে তার মায়ের খাওয়ার দায়িত্ব সিরাজের ওপর। মা তো রোগাও কম না। কোনোমতে হাঁটতে পারে। পাটকাঠির মতো শরীর। তাকে ঢাকায় নিয়ে এলে রোজগারের একটা অবলম্বন হতে পারে। হাঁপানির রোগী, কঙ্কালসার শরীর, গায়ে ছিন্নবস্ত্র…তার মায়ের ছবিটি চোখের সামনে ভেসে আসে। এখন মাকে কীভাবে ঢাকায় আনা যায়, কীভাবে ভিক্ষার কাজে লাগানো যায়─এমন চিন্তার জটলা তাকে সারা রাত নিদ্রাহীন করে রাখে।
পরদিন ভোরবেলা সিরাজ কাউকে কোনো কিছু না বলে বাড়ির পথে রওনা দেয়। বাড়ির কাছে রইন্যার বাজার থেকে চাল-ডাল-তরকারি-মাছসহ তার মায়ের জন্য কমলা কিনে সে হাসিমুখে বাড়িতে পৌঁছায়। আজকে মায়ের আদর খুব বেশি। মাস এখনো শেষ হয়নি। তবু ছোট ভাইকে ডেকে বলল, মা আমার ঘরেই খাওয়া-দাওয়া করুক। তোর আর টানা লাগবো না। আমি কাইল ঢাহা লইয়্যা যামু। সেইহানে ছিকিস্যা, অসুধ সব ব্যবুস্থাই আছে─মায়ের লাইগ্যা তর আর চিন্তা করা লাগবো না।
সিরাজের কথা শুনে ইন্তাজ আলী যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। একটা বড় বোঝা তার ঘাড় থেকে নেমে গেল। এখন দুই বাচ্চা আর বউ নিয়ে যা জুটে, তা দিয়ে সংসার চালানো যাবে। সেও খুশি হয়ে বলল, ভালা ব্যবুস্থা অইলো তো আর কোনো কথাই নাই। লইয়্যা যাও। এইডা তো খুব সুখের খবর।
কয়েক দিন পর সিরাজ বাড়িতে এসেছে এবং তার সঙ্গে বাজারসওদা দেখে আজিজা ও তার সন্তানেরা খুশিতে টগবগ করছে। হান্নান তো একেবারে কোল থেকেই নামতে চায় না। তার জন্য সিরাজ চকলেট এনেছে। একটি চকলেট খেয়ে অন্য একটি হাতে রেখেছে অনেকক্ষণ ধরে, পাছে যদি শেষ হয়ে যায় সেই ভাবনায়।
সিরাজ তার মাকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে ঢাকায় নেওয়ার কথা বলল। তার মা চিকিৎসার কথা শুনে মনে হয় একটু নড়েচড়ে শিরদাঁড়া শক্ত করে। কত দিন ধরে সে অসুস্থ, একটা ট্যাবলেটও তার জোটেনি। এখন বড় ছেলে ঢাকায় রোজগারের ব্যবস্থা করেছে, তার চিকিৎসা হবে─এর চেয়ে বড় সৌভাগ্য আর কী হতে পারে!
মর্জিনা বলল, আমারে তুমি বোকা মনে কইরো না। তোমার মা যত দিন বাঁচে তত দিন তোমার রোজগার। না খাওয়ায়া মারলে তো রোজগার শেষ অইবো─আমি তা বুঝি না?
সিরাজ তার মাকে নিয়ে ঢাকার সেই বস্তিঘরে উঠল। রাতে হোটেল থেকে খাবার এনে সিরাজ তার মাকে খাওয়াল। অসুস্থতা, দীর্ঘপথ ট্রেনে আসাতে শরীর বলতে যেন আর কিছু নেই। হাঁপানিটা বেড়ে গেছে। কোনোক্রমে সামান্য ভাত-পানি দিয়ে গিলে গলা পার করে বাইনমাছের মতো বাঁক মেরে শুয়ে পড়ে। সিরাজও তার মায়ের পাশে শোয়। বস্তিঘরে একটা ভাঙা চৌকি, তার ওপরে পাটি, একটা ছেঁড়া কাঁথা ও দুটি তেলছিটায় পড়া তক্তার মতো শক্ত বালিশ। এবার বাড়ি থেকে আসার সময় মায়ের ছেঁড়া কাঁথা আর বালিশ নিয়ে এসেছে। সিরাজ তার মায়ের পাশে শুয়ে আগামী স্বপ্নে বিভোর হয়।
চার
সিরাজ তার মাকে পাউরুটি আর মিষ্টি দিয়ে নাশতা করিয়ে সকালে বের হয়। পাউরুটি আর মিষ্টির নাশতা খেয়ে তার মা খুব খুশি। সেই ছোটবেলার কথা তার মনে পড়ে। তখন জ্বর হলে তার বাবা তাকে পাউরুটি আর রসগোলা এনে দিত। আজ সিরাজ যেন সেই বাবার ভ‚মিকাতেই অবতীর্ণ হলো রাস্তায় নামে সিরাজ তার মাকে নিয়ে। মায়ের অসাড় শরীরটা টেনে টেনে এগিয়ে যায়। শহরে এত মানুষ আর গাড়ি দেখে সিরাজের মা হতভম্ব।
শহরের ইতিহাস-ঐতিহ্য কিংবা প্রাচুর্যের বিষয় তার অজানা। অসাড় জীর্ণ-শীর্ণ শরীর আর ছিন্নভিন্ন কাপড়ে ঢাকা একটি মানুষকে দেখে যার কাছে হাত পাতছে, কিছু না কিছু পাচ্ছে। এক প্রৌঢ় একেবারে এক শ টাকার একটা নোট দিয়ে দিয়েছে। হয়তো তার বিপদাপদের কোনো সদকা দিয়েছে। এই এক শ টাকার নোট সিরাজ আর তার মায়ের কাছে দুর্লভ প্রাপ্তি। মা-ছেলে দুজনেই হাত তুলে লোকটার জন্য দোয়া করে। লোকটা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ওদের প্রার্থনার দৃশ্য দেখে তৃপ্ত হয়। প্রথম দিনেই ওদের রোজগার অবাক হওয়ার মতো─ সাত শ টাকা। সিরাজের মন আনন্দে টগবগ করে ওঠে।
সপ্তাহ খানেক পর সিরাজ বস্তিতেই একটা ভালো ঘর ভাড়া নেয়। তোরাব আলীকে মাঝে মাঝে ভিক্ষার টাকা থেকে বখরা দিতে হয়। তাতেও সিরাজ খুশি। তাদের প্রতিদিনের রোজগার প্রায় পাঁচ-ছয় শ টাকা।
সিরাজের মায়ের শরীরটা আরও খারাপ হয়ে গেছে। একদিন সিরাজকে বলল, তুই না কইছিলে ছিকিস্যা করাইবি? ওষুধ-টসুধ তো দিলি না? ছিকিস্যা করাইবি না?
সিরাজ শান্তভাবে বলে। আরও টাহা অইলে ভালা ডাক্তারের কাছে লইয়্যা যামুনে। সিরাজ মাঝে মাঝে তোরাব আলীর পরামর্শ নেয়। চিকিৎসা করিয়ে তাকে ভালো করে ফেললে ভিক্ষা করা যাবে না। তাই মাঝে মাঝে তোরাব আলী ঘুমের বড়ি দেয় ওষুধ হিসেবে। সে-ই যেন বড় ডাক্তার। এতে সিরাজের মায়ের শরীর আরও খারাপ হয় কিন্তু সিরাজের তাতে কিছু যায় আসে না।
সিরাজের মেজাজে এখন আরও একটি মাত্রা যোগ হয়েছে। সন্ধ্যার পর থেকে সে এখন বস্তির পুব পাশে মর্জিনার ঘরে কিছু সময় কাটায়। আমোদ-ফুর্তি করে। তার জন্য সে প্রয়োজনমাফিক টাকা ব্যয় করে। কোনো সময় ভাবে, মর্জিনাকে বিয়ে করে ফেলবে কি না। আজিজার শরীর বলতে তো আর কিছু নেই। কেন তাকে মনে রাখা? মর্জিনা শহরের ভাষায় কথা বলে, হাসে সিনেমার নায়িকাদের মতো, ভালোবাসার কথা কয়─এমন এক নারীর কথা সে কোনোক্রমেই ভুলতে পারছে না। সারা দিন ভিক্ষা করার সময় মর্জিনা যেন হঠাৎ তার চোখের সামনে চলে আসে। মর্জিনা সর্বস্ব দিয়ে সিরাজের কাছে ধরা দিয়েছে। এটা তার কোনো জীবনের পুণ্যেরই ফল হয়তো হবে। মর্জিনাকে ছাড়া এখন সিরাজ আর একটি দিনও ভাবতে পারে না।
হাইকোর্টের মাজারে সিরাজ তার মাকে নিয়ে ভিক্ষা করছে। হঠাৎ মালেকের সঙ্গে দেখা। মালেককে দেখে সে নিজেকে লুকাতে চেয়েছিল সংকোচে, কিন্তু পারেনি। সিরাজের মা-ই তাকে কাছে ডেকে আনে। মালেকের কাছে খোলাখুলিই সিরাজ বলল, বর্তমান ইনকাম ভালা। প্রতিদিন পাঁচ-ছয় শ ট্যাহা অয়।
মালেক হকচকিয়ে যায়। এত টাকা ইনকাম ভিক্ষাবৃত্তিতে! আর হবে না কেন? মানুষ যত পেরেশানিতে পড়ে তত দান-খয়রাত করে মুক্তি চায়। দান-খয়রাত নাকি পেরেশানির ওষুধ─ এই বিশ্বাস অনেকের মধ্যেই বদ্ধমূল। কিন্তু মালেকের চিন্তা বেড়ে যায় সিরাজের মায়ের অবস্থা দেখে। সিরাজের মাও মালেককে অশ্রুভরা চোখে মিনতি করে বলল, বাবা, আমার একটু ছিকিস্যা করাইবা?
মালেক বুঝতে পারছে, সিরাজ তার মাকে শুধু ভিক্ষাবৃত্তিতেই ব্যবহার করছে। ওষুধপথ্য কিছু দিচ্ছে না। সে সিরাজকে বলল, তোর মায়ের চিকিৎসার ব্যবস্থা কর। এভাবে অসুস্থ মাকে খাটাচ্ছিস…মালেক কঠিন কথা বলতে গিয়ে একটু দম নিয়ে বলে, বুড়া মানুষ, একটু চিকিৎসার ব্যবস্থা করিস রে সিরাজ। মায়েরে কষ্ট দেওয়া ঠিক না।
সিরাজ অনুগত দাসের মতো মাথা নেড়ে জানায়, সে চিকিৎসা করাবে।
সন্ধ্যা হওয়ার পরপরই সিরাজ সবকিছু ভুলে যায়। সে মর্জিনার ঘরে গিয়ে বসে। আজকে মর্জিনা বেঁকে বসেছে। সবই তো দিলাম। আর না। যদি বিয়া করো, তাইলে কও, আমি তোমার সঙ্গে আছি। নইলে নাই।
সিরাজের মাথা গরম হয়ে যায়। সে সবকিছু ভুলে যায়। তার প্রথম স্ত্রী এবং চার-পাঁচটি ছেলেমেয়ের কথা ভুলে যায়। আজিজা তো আধমরা। নিজের সন্তানদেরকে সে কখনো আদর করে দেখেছে বলে মনে হয় না। তাদের প্রতি দয়ামায়াও তার নেই। তাহলে মর্জিনাকে বিয়ে করতে তার অসুবিধা কোথায়?
—ঠিক আছে, বিয়া করন লাগলে করুম। আমি তো কুনো সোময় না করি নাই।
—তাইলে আইজ যাও। যেদিন দুলা অইয়্যা আইব্যা, হেইদিন আমারে ফাইবা।
—মনে কর, আইজই আইলাম দুলা অইয়্যা।
—তাইলে মুন্সি ডাক দেও। কইলমা পড়ো। কাপড় আনো। বইস্যা আছো কেন? এই কথা বলে মর্জিনা সিরাজকে ধাক্কা দিয়ে চৌকির ওপর থেকে টেনে নিচে নামিয়ে আনে।
সিরাজ মর্জিনার জন্য জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে। কিছুক্ষণ কী যেন ভাবল এবং পরে ঠিক ঠিক নতুন কাপড়চোপড় কিনে সঙ্গে একজন মৌলানা ধরে নিয়ে এসে সে বিয়ে করে। আজ থেকে মর্জিনার ঘরে আসতে সিরাজের আর লুকোচুরি খেলতে হবে না। মর্জিনা তার বিবাহিতা স্ত্রী।
মর্জিনাকে সিরাজ বিয়ে করেছে, এই কথাটি তার মায়ের কাছে গোপন রাখে। তবে এখন সে রাতে তার মায়ের সঙ্গে থাকে না। এই ঘরে রান্নাও হয় না। কিন্তু ভালো ভালো খাবার আসে মর্জিনার ঘর থেকে। এত সব বিষয় চিন্তা করার ফুরসত সিরাজের মায়ের নেই কিংবা বলা যায়, এত সব চিন্তা করার ক্ষমতা তার নেই।
প্রথমে ভালো ভালো খাবার দেখে সিরাজ বলেছিল, বেশি ভালা খাবার দিলে মায় যদি ভালা অইয়্যা যায়; তাইলে রোজগার কইম্যা যাইবো। কোনো রকম খাওন দিও, যাতে বাঁইচ্যা থাহে।
মর্জিনা বলল, আমারে তুমি বোকা মনে কইরো না। তোমার মা যত দিন বাঁচে তত দিন তোমার রোজগার। না খাওয়ায়া মারলে তো রোজগার শেষ অইবো─আমি তা বুঝি না?
সিরাজ হাসে। তা ঠিক কইছো। তোমার যা বুদ্ধি─এই কথা বলে মর্জিনার গালে চিমটি কাটে সিরাজ।
পাঁচ
দিন সাতেক পরে মালেক বাড়িতে যায় এবং ইন্তাজ আলীকে সিরাজের কথা বিস্তারিত জানায়। মালেকের কথা শোনার পর ইন্তাজের মাথা প্রথম গরম হয়ে ওঠে এবং তার বড় ভাইকে গালিগালাজ করে। ‘হারামজাদা নিজের মাকে দিয়া ভিক্ষা করায়?’ প্রচণ্ড ক্ষোভ ও উত্তেজনায় এই কথাগুলো মালেকের সামনেই বলে।
আজিজার বিপদের সীমা-পরিসীমা নেই। কয়েক দিন জ্বরে-ডায়রিয়ায় ভোগে হান্নান মারা গেছে। এই খবরটা পর্যন্ত সিরাজকে দেওয়া যাচ্ছে না। দিন একবেলা খাবার জোটাতে পারে। ছেলেমেয়েগুলোর দিকে তাকানো যায় না। মালেকের কথা শুনে আজিজা বিলাপ করে হান্নানের জন্য। মালেকের হাতে ধরে তাদের দুরবস্থার কথা সিরাজকে বলার জন্য অনুরোধ করে।
রাতে ইন্তাজ তার স্ত্রী মনসুরাকে বলল পুরো ঘটনাটি, যা মালেকের কাছে শুনেছে। প্রথমে ইন্তাজের স্ত্রীও ক্ষ্যাপে গিয়েছিল। কিন্তু তার মাথাও ঘুরতে শুরু করছে, যখন শুনল প্রতিদিন পাঁচ-ছয় শ টাকা ইনকাম। এ তো সাধারণ কথা নয়।
মনসুরা হঠাৎ করেই বলল, মা কি তার একলার? তোমার না?
ইন্তাজ কথার হেতু বুঝতে পারেনি তাৎক্ষণিকভাবে। কিছুক্ষণ পর যখন বুঝতে পারল, তখন সে বলল, তো কী করন অহন?
ক্যান? তুমিও ঢাহা যাও। আগে বাড়িত যেমন আছিন, মা তোমার এক মাস তার এক মাস। অহনও তাই অইবো। তুমিও ঢাহা মায়ের দিয়া রোজগার করবা। এক মাস বাড়িত থাকবা আর এক মাস ঢাহা থাকবা।
সিরাজের চোখ পড়ে হঠাৎ ইন্তাজের দিকে। সে অদূরে দাঁড়িয়ে বিড়ি টানছিল। এই সময় সিরাজ তোরাবকে দেখাল, তোরাব ভাই ঐ যে, খাঁড়ায়া রইছে এই আমার ভাই।
মনসুরার কথা শুনে ইন্তাজের মাথা ঘুরে যায়। এখন তাহলে ভিক্ষা করতে হবে। তাও মায়ের অসুস্থ শরীর নিয়ে। মনসুরার কথায় প্রথম এক-দুইবার বাগড়া দিলেও পরে ইন্তাজও সম্মত হয় এই কাজ করতে। ঢাকা তো আর কেউ তাকে চেনে না। চিনলেই বা কী… কেউ কি তারে দুই আনা দিয়া সাহায্য করে? যখন গ্রামে কাজ থাকে না, যখন তাকে উপোস দিতে হয়, তখন কে আসে তারে সাহায্য করতে। কামলা মজুরের জাতের আবার ইজ্জত কিসের? ইন্তাজ রাতের মধ্যপ্রহর পর্যন্ত এভাবেই নিজে নিজে গজ গজ করতে থাকে। তবে কোনো কথাই সে স্পষ্ট করে মনসুরাকে বলেনি। দুটি মেয়ে মনসুরার পাশে শুয়ে ঘুমিয়ে আছে। চিকন সুরে ওদের নাক ডাকার শব্দ শুনতে পায় ইন্তাজ আলী।
কড়কড়ে রোদ যেন চারদিকে ধেই ধেই করছে। রোদের তেজ শরীর নিংড়িয়ে ঘাম ঝরাচ্ছে। হাইকোর্টের মাজারের পাশের বটগাছের ছায়ায় সিরাজ তার মাকে নিয়ে বসে আছে। দুপুরে খেয়ে একটু বিশ্রাম নিচ্ছে। একটু পরে রোদের তেজটা কমলে আবার মাজারের পাশে তার মাকে নিয়ে বসাবে অথবা মাকে জড়িয়ে ধরে ধরে হাঁটবে।
সিরাজের মায়ের মনও মাঝে মাঝে বিষিয়ে ওঠে। একি জীবন! সারা জীবন কোনোক্রমে পার করে এখন শেষ বয়সে মানুষের কাছে এভাবে ভিক্ষা করা। ‘সিরাজ তো ছিকিস্যার কথা কইয়্যা আনলো, তয় ছিকিস্যা কই?’ সিরাজের মা একা একা মনে মনে বিড়বিড় করে। তবে এখানে ভালো আছে— এই সব কথা ভেবে মাঝে মাঝে শান্তির নিঃশ্বাসও ফেলে। এখন অন্তত পেটের খিদায় অস্থির হতে হয় না। তিনবেলা খাবার জুটছে। পুত্রবধূদের ত্যাড়াং ত্যাড়াং কথা শুনতে হয় না। এক থালা ভাত দিল তো তরকারি দিল না। ভাতের সঙ্গে তরকারি নেই─একটা মরিচ আর লবণ দিয়েই শেষ। তারা নিজেরা কত কিছু খায়, যার ধারেকাছেও সিরাজের মা যেতে পারত না। দিনে সাতবার চাইয়েও ভাত পাওয়া যেত না। এখন সেই চিন্তা তো করতে হয় না। ভালোই আছে সিরাজের মা। তবে বুকের ভেতরটা মাঝে মাঝে হাহাকার করে ওঠে তার স্বামীর কথা মনে হলে, গ্রামের কথা মনে হলে কিংবা গ্রামের মানুষের কথা মনে হলে। একদিন সিরাজকে বলেও রেখেছে, ‘আমি যদি মইর্যাষ যাই, তর বাজানের কব্বরের সঙ্গে আমারে কব্বর দিস।’ সিরাজ মাথা নেড়ে কথা দিয়ে মা মারা গেলে তার বাবার পাশেই কবর দেওয়া হবে।
দুপুরের কিছুটা পরেই ইন্তাজ এসে দাঁড়াল সিরাজের সামনে। ইন্তাজকে দেখে সে দুঃস্বপ্ন দেখছে কি না, নাকি কোনো দৈত্য দেখছে, তা সে মেলাতে পারছে না। কিছছুটা হতভম্ব হয়ে সে ইন্তাজকে জিগ্যেস করে, তুই ঢাহা আইছস ক্যান? কোনো খবরটবর আছেনি?
—না, কোনো খবরটবর নাই। আইছি তোমরারে দেখতাম।
—তুই কেমনে জানলে, আমরা এহানে আছি?
—খবর কি আর লুকায়া থাহে? পাইছি। কত মানুষে কয়।
সিরাজ বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ে যেন, সে কিছু বলতে পারছে না। ইন্তাজ এই ফাঁকে তার মায়ের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। কিছুক্ষণ মা-ছেলে অবিচল দৃষ্টি মেলে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে থাকে। একসময় ইন্তাজ জিগ্যেস করে, মা, তুমি ভালা আছো?
আছি। ভালাই আছি।
তার মা আর কোনো কথা বলেনি। বলতে ইচ্ছে করেনি। সে আপন মনে মানুষের কাছে হাত পেতে টাকা চাইছে, বাবাজান, দুইডা ট্যাহা দেন, ভাত খামু। সারা দিন কিছু খাই নাই। কখনো শুধু হাত পাতে। কোনো কথা বলে না।
ইন্তাজ দেখে, তার মায়ের সামনে থালাটায় অনেকগুলো টাকা। প্রতিটি টাকা যেন তার কাছে সোনার মোহর মনে হয়। সে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে টাকাগুলোর দিকে। মনে হয় এই টাকাতে তারও পাওনা আছে। ভাগ আছে। মা তো আর সিরাজের একার নয়। সমান ভাগে টাকা সেও পায়। টাকাগুলো তার ভেতরে এক অজানা উত্তেজনা আর অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে। তাকে খুবই অস্থির দেখায়।
মায়ের কাছ থেকে সরে সে একটু দূরে দাঁড়িয়ে বিড়ি জ্বালায়। বিড়িতে টান দেওয়ার পর তার মাথাটা আরও ঝিমঝিম করে। সে পাশের দোকান থেকে একটা কেক আর কলা কিনে খেয়ে একটু পানি খায়। ইন্তাজকে আড়াল করার জন্য সিরাজ দূরে দাঁড়িয়ে দেখছে। ভাবছে, কোনোক্রমে সটকে পড়বে কি না। যদি মাকে বাড়িতে নিয়ে যেতে চায়, তাহলে তার দিন চলবে কেমনে? না, কোনোক্রমেই তার মাকে হাতছাড়া করা যাবে না। জীবন থাকতে না। এমন দৃঢ় সংকল্পের শেকড় তার মনের ভেতর ছড়িয়ে যেতে থাকে।
সন্ধ্যায় সিরাজ তার মাকে নিয়ে বস্তিঘরের দিকে রওনা হয়। ইন্তাজ সারা বিকেলে অশত্থগাছের ছায়ায় তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় ছিল। তবে তক্কে তক্কে রেখেছে, ওরা কখন কোথায় যায়। রাতেই সব আলোচনা করে ঠিক করবে, এই ভেবে তন্দ্রা ভাব কাটিয়ে মাঝে মাঝে দেখেছে। সন্ধ্যায় যখন ইন্তাজকে দেখেও না দেখার ভান করে সিরাজ চলে যাচ্ছিল, তখন ইন্তাজের মনে সন্দেহ দানা বাঁধতে থাকে। ইন্তাজ তাদেরকে অনেকটা দূর থেকে অনুসরণ করে।
সিরাজ তার মাকে বস্তিঘরের বিছানায় শুইয়ে দিয়ে উপার্জিত টাকাগুলো চৌকির নিচের ট্রাংকে রাখে। তারপর মর্জিনার ঘরে গিয়ে বসে। মর্জিনাও সোহাগী ভাব নিয়ে সিরাজের কাছে এসে বসে। সিরাজকে খুব উদ্বিগ্ন দেখায়। মর্জিনা মাথার চুলে চিরুনি চালান দিয়ে জিগ্যেস করল, তোমার মন খারাপ? আইজ রোজগার অয় নাই?
—তা অইছে? তয় অন্য ব্যাপার।
—কী ব্যাপার?
—রাইতে কমুনে। মনে অইতাছে, ভেজাল লাগতাছে একটা।
—কী ভেজাল?
—রাইতে কমুনে। অহন চুপ থাক।
কথা না বাড়িয়ে সে আস্তে আস্তে পরামর্শের জন্য তোরাব আলীর কাছে যায়। তোরাব আলী সন্ধ্যার কিছুক্ষণ পরে এসে ভিক্ষুকদের কাছ থেকে বখরা নেয়। তোরাব আলীকে ডেকে বস্তির পাশে এসে দাঁড়ায় সিরাজ। এই সময় ইন্তাজ আলীও সিরাজের গতিবিধি লক্ষ করে সিরাজের সামান্য দূরে দাঁড়িয়ে থাকে গোয়েন্দার মতো।
তোরাব আলীর কাছে সিরাজ তার ছোট ভাইয়ের আগমনের বার্তা জানিয়ে বলে, মনে অইতাছে, হে মায়েরে লইয়্যা যাইতে আইছে। অহন কী করি?
তোরাব আলী বলে, দিবি না।
—না করলেই অইবোনি?
—কয়েকটা ঠাউল্যা দিয়া দিমুনে, দেখবি দৌড়াইয়া ক‚ল পাইতো না। আর বেশি তেড়িবেড়ি করলে সাফা কইর্যায় দিমুনে। তুই চিন্তা করিস না। নিছিন্তায় গিয়া ঘুমা।
সিরাজের চোখ পড়ে হঠাৎ ইন্তাজের দিকে। সে অদূরে দাঁড়িয়ে বিড়ি টানছিল। এই সময় সিরাজ তোরাবকে দেখাল, তোরাব ভাই ঐ যে, খাঁড়ায়া রইছে এই আমার ভাই।
তোরাব আলী ইন্তাজকে লক্ষ্য করে ডাক দিল, এই, এদিকে আয়।
ইন্তাজ হকচকিয়ে যায়। কিন্তু শহরের ব্যাপার। না গেলেও উপায় নেই। ভয় ও সংকোচে সে এসে তোরাবের সামনে দাঁড়ায়।
তোরাব আলী বলে, আমার নাম তোরাব আলী। এই চাতালে কেউ যদি ঢুকে, আমার পারমিশন লাগে। তুই কিসের লাইগ্যা আইছোস— ক হুনি। আর আমার পারমিশন লইয়া এইহানে ঢুকছোস?
—ইন্তাজ বলল, বড় ভাই আমি, আমি…
—আমি আমি করবি না। তাড়াতাড়ি কবি।
—আমরা দুই ভাই। মা তো আমারও। তাই না? আমি চাই, মা আগে যেম্বায় আছিন হেম্বায় থাকবো।
—কেম্বায় আছিন?
—এক মাস আমার ঘরে খাইতো আর এক মাস ভাইয়ের ঘরে খাইতো।
—তুই তো অহন বাড়িত থাহোস। তয়, তর মা কই থাকবো?
—হেই বিওচনা আমার। আগে কন্ডিশন ঠিক হউক।
—এই দিকে আয়।
—ইন্তাজ তোরাব আলীর সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।
তোরাব আলী কোনো দিকে না তাকিয়ে কপালের সামনের চুলের গোছা ধরে টান দিয়ে মাটিতে ফেলে দিয়ে কয়েকটি লাথি দিয়ে নাক চেপটিয়ে দেয়। মুখ দিয়ে রক্ত ঝরছে। এর মধ্যে সিরাজও হাত চালাল। ধোলাইটা খারাপ হয়নি।
তারপর তোরাব আলী বলল, এক্ষণ এইহান তো যাইবে।
ইন্তাজ খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে অনেকটা পথ অগ্রসর হয়ে আবার রাস্তায় লুটিয়ে পড়ে। বাঁচবে কি মরবে, তা বলা মুশকিল।
তার চোখ দুটি আগুনের মতো লাল হয়ে আছে। সিরাজকে দেখে কানা বদি ও তোরাব আলী তাড়াতাড়ি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা টাকাগুলো কুড়িয়ে নিয়ে দ্রুত কেটে পড়ে। সিরাজ আস্তে আস্তে হেঁটে এসে তার মায়ের লাশের পাশে দাঁড়ায়।
তোরাব আলী সিরাজকে বলল, যা, অহন। ও আর আইবো না। তুই শান্তিমতো গিয়া ঘুমা। আর আইজ ডাবল ট্যাহা দিবি কিন্তু।
সিরাজ পকেট থেকে টাকা বের করের তোরাবের হাতে গুনে দিল।
আজ রাতে সিরাজ আর তার মায়ের কাছে যায়নি। সিরাজ সরাসরি মর্জিনার ঘরে গিয়ে বসে। মর্জিনা সন্ধ্যায় গিয়ে ভাত দিয়ে এসেছে তার শাশুড়িকে। তারা নিশ্চিন্তে খেতে বসে। খেতে খেতে ইন্তাজের ঘটনাটা সংক্ষেপে বলল সিরাজ।
মর্জিনা কিছুক্ষণ হাসল। কেন হাসল, তা আর উদ্ঘাটন করতে যায়নি সিরাজ।
ছয়
ইন্তাজ মারা গেছে, এ নিয়ে রাতে দুবার দুঃস্বপ্ন দেখেও সিরাজ মাথা থেকে এসব ঝেড়ে ফেলে দেয়। স্বপ্ন তো স্বপ্নই। স্বপ্ন কি আর সব সময় ফলে। তবে তার মধ্যে কিছুটা অস্থিরতা থাকলেও মর্জিনার দরদভরা কথায় সে শান্ত হয়।
নিত্যকার দিনের মতোই আজ সিরাজ সকালে ঘুম থেকে উঠে গোসল নাশতা করে বাইরে গিয়ে দাঁড়ায়নি। আলস্য আর দুর্ভাবনা, রাতে ঘুম হওয়ায় সে শুয়ে থাকে। মর্জিনা শুচিসাধ্বী হয়ে নাশতা তৈরি করে। নাশতা তৈরি হলে তার শাশুড়ির ঘরে নিয়ে যায়। মর্জিনা কিছুটা অবাক হয়। রাতের খাবারের থালাটি পড়ে আছে যেখানে ছিল সেখানেই। সেগুলো ঢাকা রয়েছে যথারীতি। কিন্তু মর্জিনা দেখল, তার শাশুড়ি নিথর। সে সিরাজকে ডাক দিল।
সিরাজ তার মাকে ডাক দিল, কিন্তু মা নিরুত্তর। শেষ পর্যন্ত সিরাজ তার মায়ের শরীরে হাত দিয়ে দেখে, সারা শরীর ঠান্ডা হয়ে আছে। নাড়ি নিশ্চল। নিঃশ্বাস বন্ধ।
সিরাজ চিৎকার দিয়ে ওঠে। মা নেই।
সে কান্নায় ভেঙে পড়ে।
তোরাব আলী এই পথ দিয়ে যাচ্ছিল। সে সিরাজের কান্নার শব্দ শুনে ঘরে ঢুকে সিরাজের মায়ের শরীর দেখে সেও বলল, না, নেই। মারা গেছে।
তোরাব আলীর চোখ চকচক করে ওঠে। সে সিরাজকে কিছু না বলে বস্তির কানা বদিকে ডাক দিল। সিরাজ মনের দুঃখে মর্জিনার ঘরে গিয়ে চৌকির ওপর থ মেরে বসে রইল।
কানা বদি যেন ডাকের অপেক্ষাতেই ছিল। তার কোনো চোখ যদিও কানা নয়, তবুও সে কানা সেজে ভিক্ষা করে, তাই তাকে কানা বদি ডাকা হয়।
তোরাব আর কানা বদি লাশ নিয়ে রাস্তার এক পাশে রাখে। এখন কানা বদি কান্নার অভিনয় করে মানুষের কাছে লাশ দাফন-কাফনের টাকা তুলছে। বৃষ্টির মতো টাকা যেন মানুষের পকেট থেকে ঝরে পড়ছে।
বস্তির ঘর থেকে সিরাজ আস্তে আস্তে বের হয়। তার চোখ দুটি আগুনের মতো লাল হয়ে আছে। সিরাজকে দেখে কানা বদি ও তোরাব আলী তাড়াতাড়ি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা টাকাগুলো কুড়িয়ে নিয়ে দ্রুত কেটে পড়ে। সিরাজ আস্তে আস্তে হেঁটে এসে তার মায়ের লাশের পাশে দাঁড়ায়।