স্বর্গ জানালার কাঁচের ওপাশ থেকে ভেতরের দিকে তাকিয়ে থাকে। অনুসূয়া আইসিইউ’র বেডে শুয়ে, জীবন্মৃত। প্রাণ বায়ু বেরিয়ে যাবে যেকোনো সময়। ডাক্তারও কোনো আশার বাণী শোনাতে ব্যর্থ। স্বর্গ কাছে গিয়ে মাকে ডেকে তুলতে চায়, কিন্ত অনুসূয়া, অসাড় পড়ে থাকে, চেতনাহীন। স্বর্গের শিশুমনে কোনো উচ্ছ্বাস নেই, নেই উচ্ছলতা। আজ আঠারো জুন দুই হাজার বিশ। স্বর্গের জন্মদিন। মামা জন্মদিনের কেকের অর্ডার দিয়ে রেখেছিল ঢের আগে। এই বছর বন্ধুদের ছাড়াই কেক কাটতো স্বর্গ। কিন্তু বিকেলের দিকে মার শ্বাস নিতে খুব কষ্ট হচ্ছিল। শরীরের উত্তাপ বেড়ে জ্বর এলো একশ চার। অনুসূয়াকে প্রথমে যে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো সেখানে ভর্তি করানো যায়নি, আইসিইউ’র বেড খালি নেই। পরে আরও দুটো হাসপাতাল ঘুরে শেষে এক হাসপাতালে ভর্তি করানো সম্ভব হলো। মুহূর্তের এতসব ব্যস্ততার ভেতর স্বর্গের জন্মদিনের কেকটা আর কাটা হয়নি শেষে। অনুসূয়াকে দেখে স্বর্গ মামার সঙ্গে ফিরে গেছে বাসায়। পুরো সময়টা সে মামাকে জড়িয়ে থাকে। বলে, মামা আমি কিন্তু তোমার সঙ্গে মা’র কাছে আবার আসবো।
হাসপাতালের বারান্দায় অস্থিরভাবে পায়চারী করে দিব্যেন্দু। চেনা এক আতঙ্ক বুকে নিয়ে নির্দিষ্ট একটি ক্ষণের জন্য অপেক্ষা করে সে। মুহূর্তের জন্য অমনোযোগী হওয়ার সুযোগ নেই। এখন সে এক অতন্দ্র প্রহরী। আইসিইউ’র বাইরের করিডোরে রোগীদের এটেনডেন্টরা কেউ কেউ ফিসফাস আলাপে মগ্ন। কেউ মোবাইলের স্ক্রিন দেখে সময় কাটায় আবার কেউ সিঁড়ির ওপরে-নিচে হাঁটে, ফোনে কথা বলে। কেউবা সোফায় বসে ঝিমোয়। যমলোক থেকে পীতাম্বর এসে হাসপাতালে যখন পৌঁছায়, তখন রাত প্রায় এগারোটা। হাসপাতালের সদর দরজা দিয়ে ঢুকে সোজা লিফটের বাটন চারে টিপে উঠে আসে পাঁচ তলায়। লিফটের দরজা খুলে পীতাম্বর পাঁচতলায় পা রাখতেই করিডোরে অপেক্ষারত এক নারীর কোলের ঘুমন্ত শিশুটি কেঁদে ওঠে হঠাৎ। দিব্যেন্দুর সজাগ মন কৌতূহলী হয়ে ওঠে আরও, সোজা চোখ যায় পীতাম্বরের দিকে।
পীতাম্বরের কোনো তাড়া নেই। সে ধীর পায়ে পা বাড়ায় আইসিইউ’র দিকে। একটু দাঁড়াবেন?—কথাটা পীতাম্বরের কানে যেতেই মাথা ঘুরিয়ে তাকায়।
-আমাকে বলছেন?
-হুম, আপনাকে।
পীতাম্বর খানিকটা বিস্মিত হয়। মনে করার চেষ্টা করে এ মুখটা আগে কোথাও দেখেছে কি না!বলে, হ্যাঁ বলুন, কী বলবেন?
-আপনি যে কাজে এখানে এসেছেন, তা আমি জানি। আপনার সাথে একটু কথা ছিল।
এবার বিরক্ত হয় পীতাম্বর, আমার সাথে আপনার কী কথা। এখানে কারো সাথে আমার কোনো কথা নেই।
-আমি জানি। কিন্তু এ মুহূর্তে আমার সাথে আপনাকে কথা বলতেই হবে।
-যদি না বলি?
-কথা আপনাকে বলতেই হবে।
দিব্যেন্দুর কন্ঠে রাগ। আইসিইউ’র তিন নম্বর বেডে যে নারীটি শুয়ে আছে, তার আত্মা নিয়ে যেতে আপনি এ লোকে এসেছেন। তার নাম অনুসূয়া। আমার স্ত্রী। আপনার কাজে বাধা দেওয়ার সাধ্য আমার নেই, কেবল একটা অনুরোধ। কথাগুলো একটানা বলে থামে দিব্যেন্দু।
চাপা কণ্ঠে পীতাম্বর বলে, বলুন আগে শুনি!
-আপনার কাছে মিনতি, আজ রাতটা সে অন্তত আমাদের সাথে বেঁচে থাকুক। ভোর হওয়ার আগেই আপনি তার আত্মাটা নিয়ে যাবেন প্রয়োজনে!
-আমার তাড়া আছে। বিরক্ত কণ্ঠ পীতাম্বরের, মুখে মাছি তাড়ানোর ভঙ্গি।
-আপনার কিসের এত তাড়া? এক শিশুর কাছ থেকে তার মা’কে চিরজীবনের জন্য নিয়ে যাবেন, এ কেমন বোঝাপড়া আপনাদের?
-সেটা নিয়তির বিষয়। আমি কেবল আজ্ঞাবহ।
-আপনাকে করজোড়ে অনুরোধ করছি। আপনি অন্তত আর কিছু মুহূর্ত সময় দিন। কান্নায় ভেঙে পড়ে দিব্যেন্দু। তাকে দেখে মনে হয় যেন একটি শিশু কাঁদছে।
দিব্যেন্দুর কথায় মায়া হয় পীতাম্বরের। এই শহরে আজ প্রথম এসেছে পীতাম্বর। শহরটা দিব্যেন্দুর নিজের, আজন্ম পরিচিত। তাই রাতের অন্ধকারে দিব্যেন্দু এ শহরটা ঘুরে ঘুরে পীতাম্বরকে দেখাবে বলে সিদ্ধান্তে আসে তারা। ভোর রাতের দিকে অনুসূয়ার আত্মা নিয়ে ফিরে যাবে পীতাম্বর।
-এ লোকের জীবন্ত দুর্গা দেখাবো আপনাকে, তার সাথে অসুরও!
দিব্যেন্দুর এমন কথায় বেশ কৌতূহল জাগে পীতাম্বরের। মেডিক্যাল থেকে বের হয়ে বাম দিকে হাঁটতে শুরু করে তারা। পায়ে হেঁটে মিনিট তিনেক পর বামের একটি সরু পাহাড়ি পথ উত্তর থেকে দক্ষিণের দিকে উঠে গেছে। সে পথে তাকালে সুনসান নীরবতা, ঘুটঘুটে অন্ধকার। স্থির পলক ফেললেই শরীরে এক ধরনের শিহরণ জাগে। ভয় অনুভূত হয়। দিব্যেন্দুকে খেয়াল করে পীতাম্বর। বলে, আমি সাথে আছি, ভয় পাবেন না, আপনি যে বললেন জীবন্ত দুর্গা দেখাবেন?
-দিব্যেন্দু বলে, চলুন তবে এ পথেই।
ব্যেন্দু শিশুটির মাথা তার কোলের ওপর রেখে আইল্যান্ডে শুইয়ে দেয়, বলে, ভয় নেই। কুকুরগুলো চলে গেছে। তুমি ঘুমাও। আমি তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেই।
দু’জনে চুপিসারে দক্ষিণের উঁচু পথের দিকে হাঁটে। অন্ধকারে হঠাৎ খেয়াল করে রাস্তার এক পাশে ঝোপের আড়াল থেকে একজন পুরুষ বের হয়ে, দ্রুত দৌড়াতে থাকে দক্ষিণের পথে।
তাদের দু’জনকে আসতে দেখে লোকটি দ্রুত পালায়। দিব্যেন্দু হকচকিয়ে গেলেও পীতাম্বরের কাছে বিষয়টি বেশ কৌতূহলোদ্দীপক। সে ঝোপের দিকে ভাল করে খেয়াল করে, দেখে আড়ালে আরও কেউ আছে। পীতাম্বর মুহূর্তে মানবরূপ ধারণ করে সামনের দিকে পা বাড়ায়। পেছনে দিব্যেন্দু।
-তোগো চেহারা কয়, কাম তো করবি না। হুদাই ঝামেলা না কইবি। ফোট এইখান থিকা। কাস্টমার আইতে দে।
নারী কণ্ঠ। কণ্ঠে বিরক্তি স্পষ্ট। দিব্যেন্দুর কানে কথাগুলো পৌঁছাতেই ব্যাপারটা বুঝতে আর বাকি থাকে না তার। সস্তা পাউডারের গন্ধ নাকে এসে লাগে। পীতাম্বরের এ লোকের অপ্সরাতের সম্পর্কে কোনো অভিজ্ঞতা নেই। তার আগ্রহ হয় নারীটির সাথে কথা বলার। সে খেয়াল করে নারীটি দিব্যেন্দুর সঙ্গে মৃদুস্বরে কিছু্ একটা বলছে, কথাগুলো কান পর্যন্ত পৌঁছায় না তার। দিব্যেন্দু পকেটে হাত ঢুকিয়ে পাঁচশ টাকার নোট বের করে মেয়েটির সামনে ধরে। অনভ্যস্ত, মোটা গলায় বলে, আপনার কথা শুনবো।
মেয়েটির নাম পুতুল। হয়তো ছদ্মনাম। এমন নাম নিয়েই এ সমাজে এমন অসংখ্য পুতুল নিজেদের বাঁচিয়ে রাখে। কিন্তু তার জীবনের কথাগুলো যে অলীক নয়, তা বুঝতে বাকি থাকে না পীতাম্বরের। এ শহরের গল্প দিব্যেন্দুর জানা। শহরের অলিতে-গলিতে এমন অসংখ্য পুতুল জীবন্ত দুর্গা হয়ে মানুষরূপী অসুরগুলোকে শান্ত করে প্রতিনিয়ত। পুতুলের সঙ্গে তাদের কথা হয় মাঝরাত পর্যন্ত। পুলিশের গাড়ি কয়েকবার টহল দেয় এ রাস্তায়, ধীরগতিতে। ঝোপের আড়ালে উঁকিঝুঁকিও মারে। টর্চের আলো ভেদ করে ঝোপের আড়াল, কিন্তু কোনো অজানা কারণে পুতুলের সঙ্গে কাটানো তাদের সময়টুকু পুলিশের চোখ এড়িয়ে যায়। পুতুলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে হাঁটার সময় নীরব থাকে পীতাম্বর। পুতুলের সঙ্গে কথা বলে মনটা ভারী হয়ে ওঠে তার। যমলোকে তার অন্য দায়িত্ব। মর্ত্যলোকে তার আসা হয় না সহসা। অভিজ্ঞতাগুলোও তাই নতুন ঠেকে। চোখের পলকে অন্ধকারে প্রাণহীন দুর্গারূপ প্রতিভাত হয় জীবন্ত দুর্গা-মুখে। পুতুলের বলা কথাগুলো সে ভাবতে থাকে আনমনে। পুতুল মা। তারও অনুসূয়ার মতো একটি সন্তান আছে। তবে সে শিশুর কোনো পিতৃ পরিচয় নেই। নাম না জানা কোনো এক অসুরের ক্ষণিক আনন্দের ফল শিশুটির মা-ই একমাত্র পরিচয়, আশ্রয়। আজ সন্ধ্যায় মুখে পাউডার মেখে সে যখন খদ্দেরের জন্য অন্ধকার ঝোপে অপেক্ষা করছিল, তখন পুলিশের ভ্যান তাকে তুলে নিয়ে গেছিল, প্রায়দিনই হয় অমন। ঘণ্টা দুই পর আবার ছেড়েও দেয়। নিয়মিত ঘটনা এটা। লকডাউনের এই সময়ে আগের মতো আর খদ্দের নেই। ঘরে নেই খাবার। পুতুলকে খদ্দের খুঁজতে হয় বলে সন্তান রুবেল থাকে পুতুলের মায়ের সঙ্গে। তিন-তিনটে পেটের খাবারের জোগান দিতে হয় একা পুতুলকেই। মৃদু আলোর প্রায়ান্ধকার ঝুপসি ঘরে দিনের সময়টুকু কাটে তার। অসুরগুলোর ক্ষুধা মিটিয়ে নিজের সন্তানকে বাঁচিয়ে রাখার তার প্রাণান্তকর চেষ্টা।
যমলোকে এমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি কখনো হতে হয়নি পীতাম্বরকে। সে যমলোকের সদর দরজার প্রহরী। মর্ত্যলোকের পুতুলদের সঙ্গে তার পরিচয় নেই। কিছুটা এগোতেই ডানে কারুকার্যশোভিত একটি ভবন চোখে পড়ে পীতাম্বরের। জিজ্ঞেস করতেই দিব্যেন্দু উত্তর দেয়, এটা কালি মন্দির। পাশের ভবনটি পুলিশ ফাঁড়ি। মজার ব্যাপার হলো পুলিশ কালী মন্দিরে ডিউটির চেয়ে রাতের অন্ধকারে খদ্দেরের জন্য অপেক্ষারত কালো মেয়েদের পাহারায় রাখতে বেশি ব্যস্ত।
পীতাম্বর মৃদু হাসে। সঙ্গে হাঁটতে থাকে দিব্যেন্দু। দু’জনে হেঁটে তিন রাস্তার মোড়ের কাছাকাছি আসতেই দেখতে পায় একটি শিশুকে কয়েকটি কুকুর ঘিরে ধরেছে। কুকুরগুলো যত চিৎকার করছে শিশুটির কান্না বাড়ছে ততে। পীতাম্বরের মনে হয় কুকুরগুলো কামড়ে ছিঁড়ে নেবে শিশুটির শরীর। সে কিছু বুঝে ওঠার আগেই দিব্যেন্দু ঝড়ের বেগে দৌড়ে শিশুটির কাছে যায়, কুকুরগুলোর চোখ যায় দিব্যেন্দুর দিকে। দিব্যেন্দু কুকুরগুলোর চোখে চোখ রাখতেই আচমকা কুকুরগুলো ভীত হয়ে মুহূর্তে সটকে পড়ে। শিশুটির বয়স নয় কি দশ বছর। দিব্যেন্দু তাকে কোলে তুলে নিয়ে ট্রাফিক আইল্যান্ডে বসে। শিশুটি তখনো কাঁদে। দিব্যেন্দু শিশুটির মাথা তার কোলের ওপর রেখে আইল্যান্ডে শুইয়ে দেয়, বলে, ভয় নেই। কুকুরগুলো চলে গেছে। তুমি ঘুমাও। আমি তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেই।
পীতাম্বর এতক্ষণ ব্যাপারটা দেখছিল। এবার জিজ্ঞেস করে দিব্যেন্দুকে, কে এই শিশু? গভীর রাতে একা কেনই বা সে এখানে?
দিব্যেন্দু বলতে থাকে শিশুটির গল্প।
তন্দ্রায় এ কথা কানে আসে অনুসূয়ার। সন্তানের মুখটা না দেখেই সে হয়তো বিদায় নিতো এই পৃথিবী থেকে। অসহায় এক মা! শেষ পর্যন্ত নিয়তি অতটা নিষ্ঠুর হয়নি।
মাস দেড়েক আগে মা মারা গেছে শিশুটির। বাবা আবার বিয়ে করেছে। নববধুর দিকে মনোযোগ বেশি থাকাটা স্বাভাবিক। মা মারা যাওয়ার পরও বাবার সাথেই ঘুমাতো শিশুটি। নতুন মা এলে তার ঘুমানোর জায়গা হয় আলাদা রুমে, একা। রাতের অন্ধকারে একা থাকতে ভয় হয় তার। ঘুমোতে পারে না। মার কথা মনে পড়ে খুব। চোখের জলে ভিজে যায় বালিশ। বাবাও এখন তার কাছ থেকে অনেক দূরে। নতুন বউকে নিয়ে নিশ্চিত জড়িয়ে থাকা স্বপ্নঘুমে। শিশুটির মন মানে না। মাকে খুঁজতে এত রাতে নীরবে বেরিয়ে এসেছে সে ঘর থেকে। পথ ভুলে চলে এসেছে এখানে। একটানা বলে যায় দিব্যেন্দু।
পীতাম্বর শিশুটির মাথায় আলতো করে হাত রাখে। বলে, এখন কী করবেন এই শিশুকে নিয়ে? সে যে আপনার কোলে ঘুমিয়ে পড়লো!
দিব্যেন্দু জবাব দেয়, দেখুন কিছুক্ষণ পর কী হয়!
দিব্যেন্দু ভাবে, আজ রাতে স্বর্গ বাবা-মাকে ছাড়া একা ঘুমোচ্ছে। এ রাতের বাস্তবতা আগামীকাল থেকে তার জন্যও নিয়মিত হয়ে উঠবে।
মেয়ের কথা ভেবে চোখের কোলে জল জমে ওঠে তার। দিব্যেন্দুর মগ্নতা ভাঙে পাগলের মতো ছুটে আসা একজন মানুষকে দেখে।
এই যে ভাই, এদিকে আসেন। কাউকে খুঁজছেন? লোকটি দ্রুত কাছে আসে, তার চোখ স্থির হয় দিব্যেন্দুর কোলে ঘুমন্ত শিশুটির ওপর।
আপনার সন্তানকে খুঁজতে বের হয়েছেন? এই যে দেখুন, নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে।
-আপনারা কিভাবে বুঝলেন যে, আমি ওর বাবা? লোকটির চোখে-মুখে বিস্ময়।
মৃদু হেসে দিব্যেন্দু উত্তর দেয়, সেটা আপনাকে দেখেই আমরা অনুমান করে নিয়েছি। এই নিন। ঘুমোচ্ছে। সাবধানে কোলে নিন, যেন ঘুম না ভাঙে।
-আপনারা কারা? বিস্ময় কাটে না লোকটার।
-আপনি আমাদের চিনবেন না। যান, বাড়ি যান। পীতাম্বর নীরবে পুরো ব্যাপারটা দেখে, লোকটার চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে থাকে। কপালে গভীর চিন্তারেখা স্পষ্টতর হয়। ভাবে।
কিছুক্ষণ পর দিব্যেন্দুকে বলে, আর কয়েক ঘণ্টা পর তো আমি ফিরে যাব যমলোকে। অনূসূয়ার আত্মা নিয়েই আমাকে ফিরতে হবে। শেষ এ সময়ে আপনি কি অনুসূয়ার ব্যাপারে আর কোনো কথা আমাকে বলবেন?
দিব্যেন্দু ভাবে, এমন একটি ক্ষণের জন্যই আমি কয়েকদিন ধরে অপেক্ষা করছি! বলতে শুরু করে সে, আজ থেকে ছয় বছর আগের আঠারো জুনের বিকেলে একটি মাতৃসদনে স্বর্গের জন্ম। একদম অসময়ে। অনুসূয়ার শরীরে মাত্র সাত মাস হলো সে এসেছে, হঠাৎ প্রচুর রক্তক্ষরণ। তাড়াহুড়ো করে হাসপাতালে অপারেশন করে কোনো রকমে স্বর্গকে পৃথিবীর আলো দেখানো হয়। অনুসূয়া তখনো বাঁচা-মরার মাঝামাঝি। সদ্যজাত স্বর্গকে পেয়ে আমাদের সবার সে কী খুশি! কিন্তু অনুসূয়ার স্বাভাবিক চেতন আসতে সময় লাগে আরও তিন দিন। অনূসূয়া পরে বলেছিল, অবজারভেশন রুমে নাকি নার্সরা নিজেদের ভেতর বলাবলি করছিল, এই মহিলার তো রক্তক্ষরণ বন্ধ হচ্ছে না, বাঁচবে তো! তন্দ্রায় এ কথা কানে আসে অনুসূয়ার। সন্তানের মুখটা না দেখেই সে হয়তো বিদায় নিতো এই পৃথিবী থেকে। অসহায় এক মা! শেষ পর্যন্ত নিয়তি অতটা নিষ্ঠুর হয়নি। অনুসূয়ার বুকে শ্বাস নিতে নিতে বড় হয়ে ওঠে স্বর্গ।
কথা থামিয়ে দিব্যেন্দু একটু সময় নেয়। আবার বলতে শুরু করে, সেই মায়ের আত্মা নিতে আপনি আজ এ পৃথিবীলোকে। গত এক সপ্তাহ ধরে স্বর্গ তার মায়ের কাছে আসতে পারছে না বলে মেয়েটার চোখের জলও শুকিয়ে গেছে এখন। চোখের গভীরে আর কোনো অশ্রু অবশিষ্ট নেই তার। মায়ের সান্নিধ্য ছাড়া সন্তান কিভাবে বাঁচে!
গির্জার ঘণ্টাধ্বনি তাদের কথোপকথনে ছন্দপতন ঘটায় হঠাৎ। পীতাম্বর বলে, এ কিসের শব্দ?
-এই তো কাছেই গির্জা। এটা গির্জার ঘণ্টাধ্বনি। শান্ত কণ্ঠ দিব্যেন্দুর।
হাতে তো আরেকটু সময় আছে। চলুন গির্জার দিকে যাই। পীতাম্বর বলে।
-চলুন, তবে।
পীতাম্বরের চোখে চোখ রাখে দিব্যেন্দু, চোখে টলমল করে আনন্দাশ্রু। অতপর দু’জনেই হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। পুবাকাশে ততক্ষণে আগুন লেগেছে।
দু’জনে গির্জায় ঢোকে। মূল ফটক পেরিয়ে হাতের ডানে মাতা মেরির মূর্তি। সাদা আর হালকা নীল রঙের পাথরে উজ্জ্বল আভায় হাসছেন মাতা মেরি, কোলে দেবশিশু যিশু। প্রার্থনার পুরো জমিনে ঝরে পড়া কাঠালীচাঁপার সুগন্ধ বিমোহিত করে পীতাম্বরের হৃদয়। মা আর সন্তানের মুখের ওপর বৈদুতিক বাতির আলো পৃথিবীর মুখে জমা সুখের পরত মনে হয়। পীতাম্বর অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সে অবয়বের দিকে। এই প্রথম একা লাগে তার। নিঃসঙ্গ। দিব্যেন্দু মৃদুকণ্ঠে বলে, কী ভাবছেন?
পীতাম্বর শান্ত, ধীর কণ্ঠে উত্তর দেয়, এমন দায়িত্ব নিয়ে পৃথিবীতে আসার আগে জানা ছিল না একজন পুতুল, সেই দেবতুল্য শিশুটি আর অনুসূয়ার গল্প। পাথরের আকৃতিতে দেখুন এই শিশুটি মায়ের কোলে কেমন নিশ্চিন্ত! রাতের এই অন্ধকারে বুঝলাম এখানকার বাস্তবতা, অন্য কিছু।
দিব্যেন্দু বলে, আপনি সত্যিই ভাবছেন?
-হুম, ভাবছি! পৃথিবী থেকে বিদায় নেওয়ার পর আমি পুণ্যলোকের পথিক ছিলাম। শুনেছি পুণ্যলোকে জীবন কেমন, কিন্তু মায়া! তা আমার কাছে আরও আকাঙ্ক্ষিত। যমরাজ্যে আমার মায়া পড়ে যায়। থেকে গেলাম সেখানেই।
মৃদু হেসে পীতাম্বর আবার বলে, কদিন আগে যমরাজের ঘুমের সুযোগে পাহারায় না থেকে দেখা করতে গেছিলাম প্রেমিকার সাথে। তখন কেউ একজন যমলোক থেকে বেরিয়ে যায়। দায়িত্বে অবহেলার শাস্তি হিসেবে যমরাজ আমাকে পৃথিবীতে পাঠায় অনুসূয়ার আত্মা নিয়ে যেতে।
-তো আপনার কী অভিজ্ঞতা এই এক রাতের সফরে?
-মায়ের কোনো বিকল্প নেই, এটাই বুঝলাম। প্রত্যয়ের সুরে পীতাম্বরের উত্তর।
-তাহলে কী করবেন?
-ভাবছি, কী করা উচিত!
-আপনাকে একটা কথা বলি?
-বলুন।
-রেগে যেতে পারবেন না কিন্তু!
-আচ্ছা, তেমন কিছু কী? আগে শুনি তাহলে। মত পরে দেই।
-চৌদ্দো দিন আগে আমি মারা যাই। আমার মৃত্যু হয় করোনায়। অনুসূয়ার মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে ভাইরাস। যমলোকে গিয়ে জানতে পারি, অনুসূয়াকেও শিগগিরই আসতে হবে সেই লোকে। তখন সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে যমলোক থেকে বেরিয়ে আসা মানুষটি আমি। আমার আর কোনো উপায়ও ছিল না। নতুবা পৃথিবীতে আসতেই পারতাম না। বিশ্বাস করুন আমার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল স্বর্গ যেন তার মাকে না হারায়। বাবা ছাড়াও মা অনেকাংশে বাবার অভাব পূরণ করতে পারে। কিন্তু মা না থাকলে মায়ের অপূর্ণতা পূরণ হয় না। খুব ছোট বেলায় বাবাকে হারিয়ে এই সত্যটা উপলব্ধি করি। আমার কারণেই আপনাকে শাস্তি পেতে হলো। আপনি কি আমাকে ক্ষমা করবেন?
দিব্যেন্দুর চোখে চোখ রেখে পীতাম্বর বলে, মনে হচ্ছে আপনি কোনো অপরাধ করেননি। হাসপাতালে দেখেই আমি চিনেছিলাম আপনাকে। সময় নিচ্ছিলাম আপনার অনুভূতিটুকু বুঝতে।
-তাহলে কী সিদ্ধান্ত নিলেন, ভোর যে হতে চললো, আলো ফোটার আগেই তো আমাদের ফিরে যেতে হবে যমলোকে!
-অনুসূয়ার আত্মা নেবো না। ফিরে গিয়ে যমরাজকে এ রাতের গল্পটা শোনাবো। তারপর উনি যা সাব্যস্ত করবেন, তাই হবে! দৃঢ় কণ্ঠ পীতাম্বরের। দিব্যেন্দুর চোখে-মুখে কৃতজ্ঞতা।পীতাম্বরের চোখে চোখ রাখে দিব্যেন্দু, চোখে টলমল করে আনন্দাশ্রু। অতপর দু’জনেই হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। পুবাকাশে ততক্ষণে আগুন লেগেছে।