কল্যাণপুর ফুটওভার ব্রিজের নিচে অন্তত পঁচিশ মিনিট ধরে গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে বসে আছে মহসীন। দুপুর দেড়টা বাজতে চললো। সূর্যের তাপ, রাস্তায় জট বাঁধা গাড়ির ধোঁয়া আর মানুষের নিঃশ্বাসের গরম সব মিলিয়ে পরিবেশটাকে যে কিসের সঙ্গে মেলানো যায় ভাবতে পারে না মহসীন। সিএনজি অটোরিকশার ড্রাইভার সে। ঢাকার রাস্তায় অটোরিকশা চালাতে গিয়ে যানজট দেখে অধৈর্য হলে চলবে কেন? কিন্তু ইদানিং যে কী হয়েছে কিছুতেই ধৈর্য রাখতে পারছে না মহসীন। চট করে রাগ হয়ে যাচ্ছে সব কিছুর ওপর। ভেজা কাপড় শুকোতে দেওয়ার আগে রাবেয়া যেভাবে কাপড়কে চিপে পানি বের করে, মহসীনের মনে হয় ঢাকা শহরে দুটো টাকা কামাই করতে গিয়ে ওর গায়ের ঘাম সেভাবে চিপে চিপে বের করতে হচ্ছে। রাবেয়াকে ও এরমধ্যে একদিন বলেছে,
ভাল্লাগে না। চল গেরামে যাই গা।
গেরামে গিয়া খাইবা কী?
কেন গেরামের মানুষেরা না খাইয়া থাকে?
না মানে কাম করবা কী?
কেন এখুন যে কাম করি, তাই করব। গেরামে অটো, ট্যাক্সি, নসিমন সব চলে। এখুন আর গেরামে কামের অভাব নাই।
মহসীনের কথায় রাবেয়া আর কথা বাড়ায় না। গ্রামে কাজের অভাব নেই, এই বোধটা সম্ভবত ওকে এক ধরনের স্বস্তি দেয়। ফলে তিন বছরের মেয়েটাকে মাখানো ভর্তা ভাত খাওয়াতে খাওয়াতে সে স্বামীর মুখের দিকে তাকায় নিশ্চিন্তে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে করণীয় কী, এটা মহসীনই আর ভেবে উঠতে পারে না। ঢাকা শহরে আর যাই হোক ইনকামটা মনে ধরার মতো। বড়লোকি করতে না পারুক, সংসারে সচ্ছলতা ব্যাপারটা আছে এটা মহসীন বোঝে। ওর নিজের ইনকামের সঙ্গে এখানে রাবেয়ার ইনকামটাও যোগ হচ্ছে। ফলে বয়স্ক মা বাপের হাতে কিছু তুলে দেওয়ার পরও নিজের সংসারের চাকাটা যত সহজে ঘুরছে, গ্রামে ফিরে গেলে সেটা সম্ভব হবে কি না, হিসাবটা মেলানো বেশ কঠিন হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সংসারে রাবেয়ার কামাই যোগ করতে গিয়ে মনের এক কোণায় যে খচখচানি এটাও আজকাল বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে মহসীনের জন্য। বিয়ের পরে অন্তত দুটো বছর এ ধরনের কোনো সমস্যা ছিল না। একটু টানাটনি ছিল সংসারে কিন্তু রাস্তার সারাদিনের ক্লান্তি ঘরে এসে কেমন দূর হয়ে যেত। রাবেয়া চাকরিটা নেওয়ার পর থেকে মহসীনের মনে সেই শান্তিটা আর নেই। জীবনটা যেন একটা যন্ত্র হয়ে গেছে। সকাল সাতটায় দুটো ডাল, ভাত রেঁধে রাবেয়া সেই যে বের হয়ে যায়, ফিরে একেবারে রাত আটটায়। মাঝে দুপুরে একবার বাড়িতে আধঘণ্টার জন্য এসে সে বাচ্চাটাকে খাইয়ে রেখে যায়। বাচ্চাটা থাকে পাশের বাড়িতে রাবেয়ার বড় বোনের কাছে। রাবেয়া গার্মেন্টেসে চাকরি নেওয়ার পর এক রকম চেষ্টা চরিত্র করেই সে বড় বোনের কাছাকাছি বাড়ি ভাড়া নিয়েছে বাচ্চার জন্য। এমনিতে খালার কাছে মেয়েটার হয়তো যত্নের অভাব হয় না। কিন্তু সব দিন এক রকম থাকে না। কোনো কোনো দিন মেয়েটা ঘড়ি ঘণ্টা ধরে খেতে চায় না। অনেক সময় মায়ের জন্য কান্নাকাটি করে। কিন্তু রাবেয়ার কোনো উপায় থাকে না। টিফিন আওয়ারের একটু এদিক-সেদিক হলেই কারখানার মালিকের লোকেরা কটূ কথা শুনিয়ে দেয়। কখনো বা তারা বেতন থেকে শাস্তি স্বরূপ টাকা কেটে রেখে দেয়। তাই বাচ্চার কান্না দেখে মায়ের বুকের ভেতর যাই হোক, রাবেয়াকে চলে যেতে হয় ঘড়ি ধরেই। এই ব্যাপারগুলোই মহসীনের একদম ভালো লাগে না। ছোট্ট শিশুর কান্নার মূল্য যাদের কাছে নেই, আর যাই হোক তারা অন্তত ভালো মানুষ যে নয়, এ ব্যাপারে মহসীন নিশ্চিত। মহসীনের নিজের পক্ষে অবশ্য দুপুরে বাড়ি ফেরা সম্ভব হয় না। সাভার থেকে সকালে বেরিয়ে ঢাকা শহরে সারাদিন গাড়ি চালিয়ে একবারে সে সন্ধ্যায় ফেরে। ফেরার পথে যা বাজার নিয়ে আসে রাবেয়া কারখানা থেকে এসে সেটা চুলায় চাপায়। রান্না করতে করতেই দুজনের মধ্যে যেটুকু কথা হয়। এর বাইরে ওরা কেউ কারও মনের খবর রাখার অবসরই পায় না। একটা ঘর আর একটা বারান্দা, এই নিয়েই ওদের ছোট্ট সংসার। বারান্দার এক কোণায় রাবেয়া রান্না-বান্নার আয়োজন রেখেছে। গত রাতে আধা কেজি তেলাপিয়া কিনে এনেছিল মহসীন। গরম কড়াইয়ে ছ্যাঁৎ-ছ্যাঁৎ মাছ ভাজতে ভাজতে রাবেয়া কথাটা তুলে ছিল,
একজোড়া চাঁদির নূপুর গড়ায়ে দিবা?
ক্যান নূপুর পইরা কাকে দেখাবি? ওই কারখানার বদ মালিককে?
তুমার খালি আজেবাজে কথা! গড়ায়ে দিবা কিনা সেটা বুলো।
তাইলে চল গেরামে যাই গা। তুই নূপুর পায় বাড়ির বড় দিঘিতে ডুব দিবি আমি তাকায়ে তাকায়ে দেখপো।
এই হইলো তুমার দোষ। যা একবার মাথায় ঢুকে তা আর বাইর হয় না। চাঁদির নূপুরের সঙ্গে গেরামে যাওয়ার কী সম্পর্ক হইলো?
অনেক কিছু হইলো। তুই বুঝবি না।
কথা আর এগোনোর সুযোগ হয়নি। বাচ্চাটা খাওয়ার জন্য কান্নাকাটি করলে রাবেয়া ব্যস্ত হয়ে যায় মেয়েকে নিয়ে।
আজ দুপুর রোদে যানজটে আটকে থাকতে থাকতে মহসীনের হঠাৎ কাল রাতের কথাটা মনে হয়। রাবেয়া কোনোদিন মুখ ফুটে ওর কাছে তেমন কিছু চায়নি। গরমে ঘামতে ঘামতে মহসীন এদিক-ওদিক তাকায় ছোটখাটো কোনো গয়নার দোকান চোখে পড়ে কি না। ঢাকা শহরের বড় মার্কেটে গিয়ে গয়না কেনার ক্ষমতা তার নেই। কিন্তু রাবেয়া যা চেয়েছে, এর জন্য কোনো অজুহাত খাড়া করা ঠিক হবে না। কল্যাণপুর থেকে কাকরাইল কোনো রকমে যাত্রী নামিয়ে মহসীন বাড়ির দিকে ফিরতে শুরু করে। ওর আর গাড়ি চালাতে মন চায় না। সেদিনই সন্ধ্যার আগে সাভার বাজারে মানিক মিয়ার গয়নার দোকানে গিয়ে সে একজোড়া চাঁদির নূপুরের অর্ডার দিয়ে দেয়।
এরপর বেশ কয়েক দিন ধরে রাবেয়া যেখানে কাজ করে, সে কারখানায় নানা রকম ঝামেলা হতে থাকে। এমনিতেই কারখানার শ্রমিকদের কড়া নজরদারিতে থাকতে হতো। এরমধ্যে বেতনভাতা বাড়ানোর দাবি নিয়ে শ্রমিকদের কিছু অংশ রাস্তায় নেমে আন্দোলন মিছিল করতে গেলে মালিকপক্ষ আরও কঠোর ব্যবহার করতে শুরু করে শ্রমিকদের সঙ্গে। কাজে ঢোকার পর প্রায় বার ঘণ্টা ধরে কারখানার মূল ফটক বন্ধ করে রাখে তারা। ফলে দুপুরে টিফিন আওয়ারে যেটুকু বাইরে বের হওয়ার সুযোগ ছিল, এখন তাও বন্ধ হয়ে যায়। দেরি করে আসা, কাজে অবহেলা নানা ছুঁতায় শ্রমিক ছাঁটাই চলতে থাকে সমান তালে। এখানেই শেষ নয়, কারখানার মালিক যে রাজনৈতিক দলের সমর্থক, সে রাজনৈতিক দলের বিভিন্ন কর্মসূচিতে মালিকের পেটোয়া বাহিনী কারখানার মহিলা শ্রমিকদের ব্যবহার করতে শুরু করে। এরকম এক কর্মসূচিতে গিয়ে পুলিশের বাধার মুখে রাবেয়াকে বেশ বিব্রত হতে হয়। সেদিন রাবেয়ার সঙ্গী বেশ কয়েকজন মহিলা শ্রমিক শারীরিকভাবেও হেনস্থা হয়। ওই রাতে বাড়ি ফিরে রাবেয়াই স্বামীকে প্রস্তাবটা দেয়:
গেরামে চইল্ল্যা যামু। তুমি ব্যবস্থা করো।
সত্যি যাবি রাবেয়া!
মহসীনের চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। ওর বিশ্বাস হয় না বউটা সত্যি শহরের এ যন্ত্রজীবন থেকে পালাতে চাইছে! এতদিন মহসীন গ্রামে ফিরে যাওয়ার প্রস্তাব দিয়ে দিয়ে ক্লান্ত হয়ে গেছে। রাবেয়া মাথা পাতেনি তেমনভাবে। আজ হঠাৎ কী হলো? খারাপ কিছু ঘটেনি তো! মহসীন ভেতরে ভেতরে একটু দুর্বল বোধ করে। মহিলা মানুষ, খারাপ কিছু ঘটলেও মুখ ফুটে হয়তো বলতেই চাইবে না। কিন্তু মনের মধ্যে এক ধরনের অস্বস্তি নিয়েও মহসীনের ভেতরটা হালকা লাগে। ও সিদ্ধান্ত নেয়, আর দেরি করবে না। যে কারণেই হোক রাবেয়া যখন একবার রাজি হয়েছে গ্রামে ফিরে যেতে এ সুযোগ সে কাজে লাগাবে।
আমি কালক্যাই গেরামে গিয়া ভাইজানের সঙ্গে কথা কইয়া আসব। তারপর তোদের নিয়া যাওয়ার ব্যবস্থা করব।
হ যা করার তাড়াতাড়ি কইরো।
পরের দিন সকালটা অন্যদিনের চাইতে একটু আলাদাভাবে শুরু হয় ওদের। ঠিক হয় আজ রাতের কোচে মহসীন গ্রামে যাবে। দিনভর তাই সাভারের আশপাশেই গাড়ি চালাবে সে। রাবেয়া কোনো তোড়জোড় না করে অলসভাবে সংসারের কাজে মন দেয়।
কিরে কামে যাবি না? উঠোনে তিনজন জোয়ান পুরুষ লোকের কণ্ঠস্বর শোনা যায়।
না আইজ কামে যামু না। রাবেয়ার উত্তর শোনা যায়।
মহাজনের হুকুম কামে যাওয়াই লাগব। না অইলে চাকরি নট হইয়া যাব।
বড় সারেরা কইছে, ওই বিল্ডিং এ থাকা নিরাপদ না।
মানে! কী কইতে চাস। ওতো বড় বিল্ডিং ভাইঙ্গা তোর মাথায় পড়ব? পাগলনি তুই!
জানি না।
হুন। তাড়াতাড়ি কামে চইল্লা আয়। নাইলে পুরা মাসের বেতন কাইট্টা রাখবে মহাজন কইয়া দিছে।
মহসীন উঠোনে বের হয়ে আসার আগেই লোকগুলো চলে যায়। শুকনো মুখে মহসীনের দিকে তাকায় রাবেয়া। অভিযোগের সুরে বলে:
বিল্ডিং-এর দেওয়ালে এমুন ফাটল ধরছে, বড় বড় সারেরা কালক্যাই বইল্ল্যা গেছে কাম বন্ধ রাখতে। কিন্তু এদের কথাবার্তা তো শুনলা! কামে না গেলে পুরা মাসের বেতন আটকাইয়া দিবো।
মহসীন কী জবাব দেবে বুঝতে পারে না। এত বড় চকচকে একটা বিল্ডিংয়ে প্রাকৃতিক কোনো দুর্যোগ ছাড়াই ফাটল ধরেছে। আবার এমনই ফাটল যে, রাবেয়া সেখানে যেতেই ভয় পাচ্ছে। আসলে রাবেয়ার ভয়টা কতটা যৌক্তিক সেটাই ভেবে উঠতে পারে না মহসীন। আবার যেজন্য এত হাড় ভাঙা খাটুনি, সেই শ্রমের অর্থ বিনা বাধায় শোষকের হাতে ছেড়ে দিতে বলবে রাবেয়াকে তাই বা কী করে হয়! তবে মহসীনকে কোনো উত্তর জোগাড় করার সুযোগ না দিয়েই রাবেয়া কারখানায় যাবার জন্য বের হয়ে যায়। শুধু বলে যায় মেয়ে ঘুম থেকে জাগলে যেন তাকে তার খালার বাড়িতে রেখে আসা হয়।
_________________________________________________________________________________________________
মানুষ দেখা যায়। মহিলা মানুষ। মনে হয় বাঁইচা নাই। একটা পা ছাড়া কিছু দেখা যায় না। সমস্ত শরীরটা চাপা পড়ছে কংক্রিটে। জটলার ভেতর থেকে জবাব আসে।
_________________________________________________________________________________________________
স্ত্রীর কথামতো মেয়ে জেগে ওঠা পর্যন্ত মহসীন ঘরেই থাকে। তারপর গাড়িটা নিয়ে অনেকটা অলসভঙ্গিতেই বের হয় আসপাশে কিছু ভাড়া মারার জন্য। কিন্তু সাভার বাজারে আসার পর ওর মনে হয় আজ রাস্তায় বের হওয়া ঠিক হয়নি। মাইলের পর মাইল ট্রাক, বাস, লরি, ভ্যান দাঁড়ানো। জানা যায় প্রায় সপ্তাহ ধরে যে হরতাল কর্মসূচি দিয়েছিল রাজনৈতিক দলগুলো, গতকাল সে হরতাল কর্মসূচি আপাতত; বন্ধ থাকায় এ অবস্থা। সারাদেশের সব মানুষ যেন একসঙ্গে তাদের প্রয়োজনীয় কাজ সারতে ঢাকায় ছুটছে। দু’ঘণ্টার রাস্তা পেরোতে সময় লাগছে দশ ঘণ্টা। ফলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে আটকে যাত্রীসাধারণের মধ্যে পানি, খাবার আর প্রয়োজনীয় স্যানিটেশনের অভাবে বিভৎস্য অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। বয়স্ক মহিলা, শিশু নিয়ে কেউ কেউ তাই দূরপাল্লার বাস থেকে নেমে পায়ে হেঁটে বা অটোরিকশাগুলোয় চড়ে পথ পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা করছে। উদ্দেশ্য, মূল পথ এড়িয়ে কোনো গলিপথ ব্যবহার করে একটু সচ্ছন্দে গন্তব্যে পৌঁছানোর প্রচেষ্টা! মহসীন লক্ষ্য করে বিচ্ছিরি রাজনৈতিক সংস্কৃতির শিকার এ মানুষগুলোর চোখে মুখে শুধু ঘৃণা! অকথ্য ভাষায় এদেশের রাজনৈতিক নেতাদের গালিগালাজ করতে করতে এ রকম দুজন লোক মহসীনের অটোরিকশায় এসে ওঠে।
এই পরিবেশে গাড়ি চালানোর কোনো ইচ্ছা ছিল না মহসীনের। ভাবছিল ঘরে ফিরে যাবে। কিন্তু লোকগুলোর মুখের দিকে তাকিয়ে ও কিছু বলতে পারে না। গাড়িতে স্টার্ট দেয়। পাকা রাস্তার নিচে মাটির এবড়ো-খেবড়ো পথ দিয়ে চলার চেষ্টা চালায়। এভাবে বড়জোর পনের মিনিট চলতে পারে ওরা। হঠাৎই বজ্রপাতের মতো কথাটা রটে যায় বাতাসে। কারখানায় মানুষ চাপা পড়ছে, হাজার হাজার মানুষ। মহসীনের অটোরিকশা একটা প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়ে বন্ধ হয়ে যায়। আগুনের মতো গরম হয়ে ওঠে ওর কান দুটো। যেন ধোঁয়া বেরিয়ে যাচ্ছে মাথার ভেতর থেকে এমনভাবে দুহাতে নিজের কান দুটো চেপে ধরে মহসীন। সকালে রাবেয়ার কারখানায় যেতে না চাওয়া, মালিকের লোকদের কাজে যাওয়ার জন্য জোরাজুরি ইলেক্ট্রনিক পর্দার ম্যুভির মতো রিলে হয় ওর চোখের সামনে।
কিভাবে উল্টোপথে বিধ্বস্ত বাড়িটার সামনে এসে পৌঁছেছিল মহসীন তা এখন আর মনে করতে পারে না। হয়তো হেঁটে অথবা দৌড়ে এসেছিল সে। তবে রাতের দুঃস্বপ্নেও এমন বিভীষিকাময় পরিবেশ মহসীন কোনোদিন দেখেনি। হাজার হাজার মানুষ অসহায় দৃষ্টি নিয়ে ধংসস্তূপ বুকে করে প্রলাপ বকছে। আকাশের যে জায়গাটা জুড়ে বাড়িটা দাঁড়িয়ে ছিল সে জায়গাটা এখন শূন্য। ভীষণ রকমের শূন্য। ঝড়ে তালগাছের মাথা ভেঙে গেলে যেমন লাগে দেখতে, আকাশ ছোঁয়া বিল্ডিং বাড়িটা মুখ থুবড়ে পড়ে আছে, তেমনই। আর মানুষের আর্তচিৎকার, ধোঁয়া-ধূলায় জায়গাটার বাতাস যেন জমাট বাঁধা সিমেন্টের মতো এক জায়গায় আটকে গেছে।
মহসীন প্রথমে দৌড়ে গিয়ে বাড়িটার সিঁড়িতে ওঠার চেষ্টা করে। কিন্তু কোথায় সিঁড়ি? মানুষের পেতে রাখা ফাঁদে ভুল করে আটকে গিয়ে বাদুড়ের যে অবস্থা হয় ধবংসস্তূপের প্রতিটা অলিগলি ঘুরতে ঘুরতে মহসীন একসময় বুঝতে পারে বাড়িটা এখন আসলে সিঁড়িবিহীন একটা মৃত্যুকূপ। এর ভেতরে মহসীন কেন কোনো মানুষের পক্ষেই ঢোকা সম্ভব না। হঠাৎ মহসীনের মনে হয় বিল্ডিং বাড়িটা যে আসলে কত তলা আর রাবেয়া এর কোনো তলায় কাজ করত সেটাই কোনোদিন জানতে চাওয়া হয়নি। নিজেকে খুব বোকা মনে হয় ওর। কিন্তু তারপরেও থামে না মহসীন। সিঁড়িবিহীন গুঁড়ো হয়ে যাওয়া রড-কংক্রিটের পাহাড় টপকে মৃত্যুকূপে ঢোকার চেষ্টা চালিয়ে যায় বারবার। এভাবে পাহাড় টপকাতে গিয়ে রক্তাক্ত হয় ওর নিজের শরীর। কিন্তু মন থামাতে পারে না রক্তমাংসের শরীরকে। স্যান্ডুইচের মতো চ্যাপটা হয়ে যাওয়া বাড়িটার একটা ফোকরের ভেতরে নিজের মাথা ঢুকিয়ে দিয়ে মহসীন প্রাণপণে ডেকে যায় রাবেয়ার নাম ধরে। কিন্তু অন্ধকার কূপের ভেতর থেকে কেবল গোঙানির শব্দ ছাড়া আর কিছুই ঠাওর হয় না। হঠাৎ মহসীনের বুক পকেটে রাখা মোবাইল ফোনটা নড়ে ওঠে। ফোনের সঙ্গে সঙ্গে মহসীনের সমস্ত শরীরটা ঝাঁকি দেয়। নিশ্চয়ই রাবেয়া ফোন করেছে। হয়তো কিছুতেই বেরোবার পথ খুঁজে না পেয়ে এতক্ষণে ওর মহসীনকে ফোন করার কথা মনে পড়েছে। মহসীন ফোকরের ভেতর থেকে মাথা বের করে তাড়াতাড়ি বুক পকেটে হাত রাখে। কিন্তু হতাশ হয় মহসীন। ফোনটা করেছে রাবেয়ার বড় বোন। এর মধ্যে বোন জেনে গেছে সবকিছু। স্নেহের আঁচল পেতে বড় বোন ছোট বোনের জীবনকে কুসুমাস্তীর্ণ করতে না পারুক স্নেহময় করে রেখেছিল। বোনের কণ্ঠস্বরে সে স্নেহ ঝরে পড়ে:
মহসীন তুমি কই আছ? বোনটা আমার চাপা পড়ছে। আল্লারে তার মোবাইল বাজে কিন্তুক সে তো ফোন ধরে না..এখুন কী হইব?
স্ত্রীর বোনের কান্নায় এবার মহসীনের চোয়াল শক্ত হয়ে যায়। হ্যাঁ রাবেয়ার কাছে একটা মোবাইল ফোন আছে। সেটা দিয়েই তো সবকিছু জানা যেত। কিন্তু রাবেয়া ফোন ধরছে না কেন? রাবেয়াকে তো ফোনটা ধরতেই হবে। দেরি হয়ে যাচ্ছে মহসীনের। আজ রাতেই ওকে গ্রামে যেতে হবে সব ঠিকঠাক করতে। তারপর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রাবেয়াকে নিয়ে সে গ্রামে চলে যাবে। আজ সকালে এমনই তো কথা হয়ে আছে দুজনের।
মহসীন এবার ফোন দিতে শুরু করে রাবেয়ার মোবাইলে। একবার-দুবার-দশবার, পঁচিশবার…অসংখ্যবার। রিং বেজে চলে। ফোনের রিং-রিং শব্দ এখন মহসীনের মাথার ভেতরেও বাজছে। কিন্তু ফোনের ওপাশে কারও সাড়া নেই। সেই সকাল দশটায় বাড়িটা ভেঙে পড়ার সঙ্গে-সঙ্গে মহসীন এখানে চলে এসেছিল। এখন বাজতে চললো দুপুর তিনটা। মেয়েটা নিশ্চয়ই ক্ষিধায় কান্নাকাটি জুড়ে দিয়েছে অথচ রাবেয়ার কোনো খোঁজ নেই। বুকের ভেতর কষ্টের পরিবর্তে এবার মহসীন ক্ষোভ অনুভব করে। স্ত্রীর প্রতি ক্ষোভ। কী দরকার ছিল মালিকের গুণ্ডাগুলোর কথা শুনে এখানে আসার? কারখানার বেতন ছাড়া মহসীন কি তাকে খাওয়াতে-পরাতে পারত না! নিজের মনে বিড়বিড় করতে করতে একসময় মহসীন রাবেয়াকে নয় সকালের ওই গুণ্ডাগুলোকে ভিড়ের মাধ্যে খুঁজতে থাকে। যদিও সকালে ওদের চেহারা মহসীন ভালো করে দেখার সুযোগ পায়নি তারপরেও ওর মনে হয় এখানকার হাজার জনতার ভিড়ে ওই শয়তানগুলো মিশে আছে। এই অদৃশ্য শত্রুকে লক্ষ্য করে ওর মুষ্টিবদ্ধ হাত শূন্যে উঠে যায়। পা এলোমেলো ঘুরে বেড়ায় ধবংস স্তূপের সীমানা ঘিরে।
আপনারা ভিড় করবেন না। ভাইসব আপনারা সরে যান। উদ্ধারকারী দলকে জায়গা করে দিন। দয়াকরে কাজে বাধা সৃষ্টি করবেন না। মাইকে সরকারি লোকদের কথা শোনা যায়। মহসীন লক্ষ্য করে পুলিশ, আর্মি, ফায়ার ব্রিগেডের লোকজন বড় বড় যন্ত্রপাতি নিয়ে জায়গাটা ঘিরে ফেলেছে। তারা বাঁশি বাজিয়ে লোকজনকে ভিড় না করতে মাইকিং করছে। কিন্তু আপনজন হারানো মানুষগুলোকে একচুল নড়ানো যাচ্ছে না তাদের জায়গা থেকে। কংক্রিটের নিচে চাপা পড়া মানুষগুলোর যন্ত্রণা স্পর্শ করতেই যেন তাদের এই ধনুকভাঙা পণ। তবে ভাগ্যের হাতে নিজেদের সঁপে দেওয়া মানুষগুলো সিদ্ধান্তে স্থির থাকতে পারে না। তাদের শেষ পর্যন্ত ওখান থেকে সরতে হয়। পরিবর্তে ছুটে যেতে হয় কখনো খোলা মাঠে, কখনো মর্গে কখনো হাসপাতালে যখন একে-একে বেরোতে থাকে থেঁতলে যাওয়া আপনজনদের শরীর।
তবে মহসীনের এক অদ্ভূত অনুভূতি হয়। কোনো বিভৎস থেতলে যাওয়া শরীর কিংবা লাশ কোনোটাই শনাক্ত করবার ইচ্ছা হয় না তার। রাবেয়া অবিকল নিখুঁত অবয়বে ওর সামনে বেরিয়ে আসবে এই ভাবনাতে সে অবিচল থাকে। নড়ে না ধবংস স্তূপের প্রান্ত থেকে। কিন্তু মহাকাল থেমে থাকে না। মহাকাল তার কাজ করে যায় নিজের নিয়মে। সারারাত কংক্রিটের স্তূপের ওপর একভাবে বসে থেকে মহসীনও পার করে ফেলে থেমে যাওয়া সময়। কেটে যায় একটা দিন ও রাত।
ভাই আপনের কে ভেতরে আছে?
মহসীনের পাশে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করে এক যুবক। মহসীন জবাব দেয় না।
দেখেন সরকারি লোক যেভাবে কাজ করতাছে তাতে ভেতরে যা আছে সব শেষ হইয়া যাবো। চলেন আমরা ভেতরে যাই। দেখি কিছু করণ যায় কি না? আমি কাল রাইতে চুপ কইরা ভেতরে ঢুকছিলাম। অনেক মানুষ এখনো বাইচ্চা আছে। তাদের কষ্ট দেইখা কানদন আটকানো যায় না ভাই। লোকটা বলে চলে জানেন কত জনের পা কাটা পড়ছে, কত জনের মাথা? ইস্রে খালি রক্ত আর রক্ত। সহ্য করতে না পাইরা পলাইয়া আইছি। এখন মনে হইতেছে পলাইয়া আসা ঠিক হয় নাই। চলেন ভাইজান আমরা ওই দিক দিয়া ভেতরে ঢুকি। মানুষগুলারে তাড়াতাড়ি বাইর করার চেষ্টা করি।
এবার মহসীন ওঠে। যন্ত্রের মতো সে লোকটিকে অনুসরণ করে বিল্ডিং বাড়িটার পশ্চিম দিকে হেঁটে যায়। তখন আরেকটা সকাল এসেছে দুনিয়াতে। নির্ঘুম রাত, না খাওয়া, রাবেয়ার খোঁজ না পাওয়া সবকিছু মিলেও মহসীনের শরীরে যেটুকু শক্তি অবশিষ্ট আছে তাতেই ও বেশ জোরে জোরে পা চালায়। বাড়িটার পূর্ব দিকের কোণায় অনেক লোক একজায়গায় জড়ো হয়ে কিছু দেখার চেষ্টা করছে। ছবি তুলছে সাংবাদিক ছেলেগুলো।
ভাই ওইখানে কী? সঙ্গের যুবক জটলার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে।
মানুষ দেখা যায়। মহিলা মানুষ। মনে হয় বাঁইচা নাই। একটা পা ছাড়া কিছু দেখা যায় না। সমস্ত শরীরটা চাপা পড়ছে কংক্রিটে। জটলার ভেতর থেকে জবাব আসে।
মহসীন এগিয়ে যায়। ওকে বাড়িটার ভেতরে ঢুকতে হবে। লাশ দেখার কোনো ইচ্ছা নেই তার। রাবেয়া কথা দিয়েছে গ্রামে ফিরে যাবে। মহসীনকে সে মোতাবেক ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু সঙ্গের যুবক সোজা পথে না হেঁটে জটলার ভেতর ঢুকে পড়ে। শার্টের হাতা ধরে টেনে মহসীনকেও সে ভিড়ের ভেতর ঠেলে নিয়ে যায়। কিন্তু ভিড়ের ভেতর প্রবেশ করে মহসীন হতবাক। এত মানুষ এক জায়গায় অথচ কেমন সুনসান নীরবতা। ভিড়ের প্রত্যেকটা মানুষের চোখের দিকে তাকিয়ে মহসীন উত্তর খুঁজার চেষ্টা করে। একটা মৃত মানুষের দিকে তাকিয়ে আছে অসংখ্য জীবন্ত মানুষ, অথচ তাদের চোখ লাশের মতো। মনের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই এবার মহসীন জনতার দৃষ্টিকে অনুসরণ করে তাকায়। একটা পা। একগাদা কংক্রিটের জঙ্গলের ভেতর থেকে একটুখানি বেরিয়ে এসেছে সাদা ধবধবে সে পা। মানিক মিয়ার দোকানের চাঁদির নূপুরে তখন সকালের আলো ঠিকরে পড়ছে। আর নূপুর পরা পা খানি লাথি মারছে এ রক্তচোষা সভ্যসমাজকে।