গল্পের পটভূমি
‘পায়েস’ গল্পটি সম্ভবত ২০১৭ সালে লেখা। গল্পটি প্রথম পরিবর্তন ডটকমে প্রকাশিত হয়েছিল। তবে এখন আর এর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। এছাড়া আমার ‘সুন্দরী সমগ্র’ বইতে পরে স্থান পেয়েছে। চিন্তাসূত্রে গল্পটি পুনরায় প্রকাশিত হবে জেনে ভালো লাগছে। আসলে আমার বেড়ে ওঠা গ্রামে। গ্রামীণ জনজীবন দেখেই আমি ভাবতে শিখেছি। সামান্য কিছু পাওয়ার জন্য মানুষের মধ্যে অনেক হাহাকার দেখেছি। চার আনার একটি চকলেট পাওয়া জন্য মাইলের পর মাইল ছুটে যেতে দেখেছি গরিব শিশু-কিশোরকে। আমরা মধ্যবিত্ত শ্রেণির। মাসে একবার হলেও ভালো-মন্দ খাওয়া হতো। গ্রামে এমনও অনেক পরিবার ছিল, যারা কালেভদ্রে এমন সুযোগ পেত আবার পেত না। তেমনই কিছু হাহাকার এ গল্পে উঠে এসেছে। তখনকার সামাজিক-অর্থনৈতিক অবস্থা তুলে ধরা হয়েছে। একজন দরিদ্র পিতার প্রাণান্তকর চেষ্টা, অবুঝ শিশুর মুখে হাসি ফোটানোর অকৃত্রিম প্রয়াস গল্পটিকে পূর্ণতা দিয়েছে। কাহিনির সময় শীতকাল হলেও গল্পটি বারো মাসই পাঠককে ভাবাতে পারে। শীত একটি উপলক্ষমাত্র।
বিষয়বস্তু
গল্পটির সময়কাল নব্বই দশক। তখনও আমাদের গ্রাম অনগ্রসর। বিদ্যুৎ নেই। রাস্তা-ঘাট ভাঙাচোড়া। পড়াশোনায় আগ্রহ কম। সরকার শিশুদের শিক্ষার প্রতি জোর দিচ্ছে। পরিবার পরিকল্পনা কর্মীরা বাড়ি বাড়ি সচেতনতামূলক প্রচার চালায়। এমনই একটি সময়ের খেটে খাওয়া পরিবারের গল্প এটি। শীতকালের গল্প এটি। কেননা আমাদের অঞ্চলে শীতের সময় খেজুর রসের পায়েস খুবই জনপ্রিয়। তবে তা সবার জন্য সহজলভ্য ছিল না। ছোট মেয়ে আহ্লাদির আবদারে পায়েস খাওয়ানোর চেষ্টা করে বাবা ছলেমান। এই পায়েস ঘিরে বাবা-মায়ের হাহাকার সেই সময়ের অর্থনৈতিক অবস্থাকে তুলে ধরেছে। পাশাপাশি শ্রমিকের প্রতি মালিকের অবহেলা এবং ভালোবাসাও তুলে ধরা হয়েছে। সবশেষে পায়েস পেয়ে আহ্লাদির উচ্ছ্বাস সবাইকে অশ্রুসিক্ত করে।
সমাজের সঙ্গে সম্পর্ক
গল্পটি আমাদের মানবিক হতে উদ্বুদ্ধ করবে। সমাজের অগ্রসর অবস্থার বিবরণ তুলে ধরবে। তৎকালীন সমাজব্যবস্থা স্পষ্ট হয়ে উঠবে। গল্পের ভেতর দিয়ে পাঠক রাষ্ট্রের উন্নয়নমুখী চিন্তার সঙ্গে পরিচিত হবেন। ঋতুভিত্তিক কৃষিব্যবস্থা সম্পর্কে ধারণা দিতে পারবে। সমকালের সঙ্গে অতীতের সমাজকে তুলনা করতে সাহায্য করবে। আশাকরি গল্পটি পাঠকের মনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
পায়েস ॥ সালাহ উদ্দিন মাহমুদ
ছলেমানের মেয়েটার খেজুর রসের পায়েস খাওয়ার খুব শখ হয়েছে। স্কুল থেকে ফিরে এসে মায়ের কাছে বায়না ধরেছে। কিন্তু ছলেমানের তো সেই সাধ্য নেই। দিন আনে দিন খায়, কখনো কখনো নুন আনতে পান্তা ফুরায়। আতপ চালও নেই ঘরে। রস-ই বা পাবে কোথায়? নিজের একটা খেজুর গাছও নেই।
শুধু বাপের দেওয়া ভিটেটা ছাড়া আর কোন জমি নেই ছলেমানের। পাঁচ ভাই, চার বোনের মধ্যে ঘর তোলার মতো এই জায়গাটুকুই পৈতৃক সূত্রে পেয়েছে সে। পরের জমিতে কামলা খেটেই সংসার চলে তার। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত পরের ক্ষেতে কাজ করে পায় ত্রিশ টাকা আর একবেলা খাবার। তা-ও আবার সবসময় কাজ থাকে না। বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে তেমন কাজ থাকে না বলে বসেই খেতে হয়। এ অঞ্চলে শীতের মৌসুমটাই জমি-জিরাতের জন্য উপযোগী। তাই কামলাদের কাজও থাকে ভালো। বলতে গেলে ছয় মাসের আয়ে বাকি ছয় মাস চলতে হয় এ অঞ্চলের মানুষের।
কৃষি জমি ছাড়া এ অঞ্চলে আর কোন আয়ের উৎস নেই বললেই চলে। শহর থেকে পনেরো কিলোমিটার দূরে বিচ্ছিন্ন একটি চরে ছলেমানদের বসতি। রাস্তা-ঘাট নেই বলে শহরের সাথে নৌপথ ছাড়া আর কোন যোগাযোগ ব্যবস্থা নেই। আড়িয়াল খাঁ নদবেষ্টিত পাতারচরে কৃষি কাজের পাশাপাশি নদীতে মাছ ধরে কিছু মানুষ। ছলেমানের নৌকা বা জাল কোনটাই নেই। তাই মাছ কিনেই খেতে হয়। অভাবের সঙ্গে নিত্য সখ্যতা গড়েই এগিয়ে চলে ছলেমানরা। সেখানে খেজুর রসের পায়েস এক ধরনের বিলাসী খাবার বলেই গণ্য করা হয়।
সন্ধ্যায় গোমড়া মুখে বাড়ি ফেরে ছলেমান। কাজের টাকাটা আজ পায়নি। গেরস্থদের স্বভাব ভালো না। আজ দেই, কাল দেই বলে ঘোরায়।
বাবার দৈন্যদশার বৃহৎ সংসারে পড়াশোনার সুযোগও হয়নি ছলেমানের। সরকারি খরচে চরের ওই প্রাইমারি স্কুলটাই শেষ করতে পেরেছিল কেবল। তারপর বাবার সাথে কাঁচি হাতে নিয়ে জমিতে জমিতে নিড়ানি দিয়ে আগাছা পরিষ্কার করে কেটেছে শৈশব, কৈশোর আর যৌবনের সংগ্রামী জীবন।
বছর কুড়ি যখন ছলেমানের বয়স; বলতে গেলে এক প্রকার পছন্দ করেই বিয়ে করেছিল তাসলিকে। কাজের উছিলায় তাসলিদের বাড়িতে মাঝে মাঝেই যাওয়া হতো ছলেমানের। দেখতে দেখতে চোখের সামনে কেমন প্রস্ফুটিত হতে থাকে তাসলি। ছলেমান শুধু মুখ ফুটে বলেছিল, ‘তুই আমার বউ হইবি?’ সে কী লজ্জা তাসলির চোখেমুখে। দৌড়ে গিয়ে কথাটা মাকে বলে দিয়েছিল। বিধবা সকিনার সামনে এর চেয়ে ভালো প্রস্তাব হয়তো আর ছিল না। তিনিও ডাকলেন ছলেমানকে। ছলেমান মাথা নিচু করে কাচুমাচু করে বলে, ‘চাচি কিছু কইবেন?’ কোন রাখডাক না রেখে সকিনা বলল, ‘প্রস্তাব নিয়া তোর বাপরে আইতে কইস!’
পরিবারের কেউ রাজি না থাকলেও ছলেমানের জেদের কাছে হার মেনেছিল বাপ-চাচারা। তাসলিরা ছলেমানের পরিবারের সমপর্যায়ের। শুধু মেয়েটার বাপ ছিল না। জমি-জিরাত করেই বাপের ভিটায় মা একাই আগলে রেখেছিল তাসলিকে। শ্বশুর ছাড়া শ্বশুর বাড়ি কেমন অলক্ষণে মনে হয় ভেবে বিরোধিতা করে ছলেমানের বাপ-চাচারা। জামাইয়ের বিপদে-আপদে কে পাশে দাঁড়াবে? কিন্তু ছলেমান এক কথার মানুষ। তাই তেমন কোন ঘটা না করেই পারিবারিকভাবে বিয়ে হয় ছলেমান আর তাসলির। সমাজের রক্তচক্ষু আর লোলুপ মানসিকতাকে পাশ কাটিয়ে পনেরো বছর বয়সেই স্বামীর সংসারে পা রাখে তাসলি। শরীরে যখন আলসেমির হাওয়া লাগিয়ে ঘোরার কথা; সেই বয়সে পুরোদস্তুর সংসারি হতে হয় তাকে।
নতুন সংসারে এসে বাবার অভাবটা পূরণ হলেও স্বামীর সঙ্গে আলাদা সংসার পাততে হয় তাসলির। বর্ধিষ্ণু পরিবারে আলাদা করে থাকার মতো জায়গা তেমন নেই। পেছনের বারান্দায় পুরোনো কাপড় দিয়ে আড়াল করেই সম্পন্ন হয় মধুচন্দ্রিমা। সপ্তাহ যেতেই তারা উপলব্ধি করে- এখানে তারা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছে না। তাই ছলেমান আর তাসলি একটু স্বাধীনতা চায়। একান্তে কাছাকাছি থাকতে চায়। লাজ-শরমের মাথা খেয়ে বাবাকে বলেই বসে কথাটা, ‘এই ঘরে বউ লইয়া থাকোন যায় না বাজান। আপনে আমারে আলাদা ঘর কইরা দেন।’
বাপের সিদ্ধান্তে মূল বাড়ি থেকে নেমে যায় ছলেমান। একখণ্ড জমি পায় তারা। তাতেই দোচালা একটা টিনের ঘর তোলে ছলেমান। ঝাড়ের বাঁশ, পাটখড়ি, মেহগনি গাছের কাঠ আর বাপের কিনে দেওয়া কয়েক বান টিনে একটি থাকার বন্দোবস্ত হয় ছলেমানদের।
আলাদা হওয়ার এক বছর পরই ঘর আলো করে আসে একটি মেয়ে। শখ করে মেয়েটির নাম রাখে আহ্লাদি। সবাই ডাকে ‘আল্লাদি’ বলে। আমোদে-আহ্লাদে কেটে যায় ছলেমানদের জীবন। অশিক্ষিত হলেও স্বাস্থ্যকর্মী আপার পরামর্শ নেয় তাসলি। স্বামীকেও বোঝায়। ‘ছোট্ট এই ঘরে তিন জনের থাকনের জায়গাই তো অয় না। পোলাপান বাড়লে থাকতে দিবেন কই?’ বলে রাতের বেলা বিশেষ মুহূর্তে বিশেষ কিছু তুলে দেয় ছলেমানের হাতে।
বাবা-মায়ের চোখের সামনে চুলগুলো দোলাতে দোলাতে পাঁচ বছরে পা রাখে আহ্লাদি। একদিন সকালে স্কুল থেকে শিক্ষকরা আসেন। তারা সবার বাড়ি গিয়ে বাচ্চাদের স্কুলে পাঠানোর কথা বলেন। তাদের কথা শুনে নিজেরা পড়ালেখা না করলেও মেয়েকে পড়াতে চায় দু’জনই। পরদিন স্কুলে নিয়ে যায় ছলেমান। আহ্লাদির সাথে কথা বলে স্কুলের শিক্ষকরা বলে, ‘মেয়ের জ্ঞান-বুদ্ধি ভালোই। ভালো-মন্দ খাওয়াইলে বুদ্ধি আরও বাড়বে।’
শিক্ষকদের আশ্বাসে মেয়ের প্রতি বিশেষ যত্ন নেয় ছলেমান। যখন যা চায়, তা-ই কিনে আনার চেষ্টা করে। পাঁচ বছর বয়সেই গুটি গুটি পায়ে বিদ্যালয়ে যেতে শুরু করে আহ্লাদি। বিদ্যালয় থেকে বাড়ি এসে সুরেলা কণ্ঠে ছড়া পড়ে শোনায় বাবা-মাকে। খুশিতে দু’জনের চোখ চিকচিক করে ওঠে। আদর্শ লিপি, গণনা শেখাতে কম-বেশি সাহায্য করে তাসলিও।
ছলেমান সকাল হলেই কাঁচি-কোদাল নিয়ে ছুটে যায় অন্যের জমিতে। দিনভর হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে বিকেলে বাড়ি এসে মাদুর পেতে মেয়ের পাশে বসে। ছোট্ট গাল দুটো টিপে দিয়ে বলে, ‘আইজ ইশকুলে কী পড়ছো মাগো?’
‘ইতকুলে আইদ পলছি- খ-তে খেজুল লস খেতে মিসতি।’ ভাঙা ভাঙা গলায় কথাটা বলে আহ্লাদি।
মনটা খারাপ হয়ে যায় ছলেমানের। খেজুর রস খেতে মিষ্টি। মিষ্টি তো অবশ্যই। কত শীত চলে গেল খেজুর রস খায়নি ছলেমানরা। খেজুর রসের পায়েসের স্বাদও যেন ভুলে যাচ্ছে ছলেমান পরিবার। চোখের কোণে পানি চলে আসে সহসাই। ছোট্ট আহ্লাদি সুর করে পড়তেই থাকে, ‘খ-তে খেজুল লস খেতে মিসতি। খ-তে খেজুল লস…’
ছলেমান মাদুর থেকে উঠে বউয়ের কাছে যায়। ছলেমানের মন খারাপ দেখে তাসলি জানতে চায়—
‘কী অইছে আপনের? মুখটা অমন শুকনা কেন? কয়ডা চাইল ভাইজ্যা দিমু?’
‘না রে বউ। চাইল কি আর মুখে যায়?’
‘হায় আল্লাহ! কন কি? কী অইছে আপনের?’
‘মাইয়াডা কইলো, ইশকুলে না-কি পড়ছে- খাজুর রস খাইতে মিষ্টি। শুইনা বুকটা ভাইঙা খান খান অইয়া গেল।’
‘আমি তো আপনেরে কইতে চাই নাই। ইশকুল তোন আইয়াই কইলো, মা খেজুর রস দেখতে কেমন? আমি তো কোন দিন দেহি নাই।’
‘হরে বউ! সবই তো বুঝি। তয় কি করুম কঅ? শীত তো চইলা যাইতাছে। এখনো মাইয়াডারে এক চামচ পায়েসও খাওয়াইতে পারলাম না।’
‘আপনে কোন চিন্তা কইরেন না। আল্লায় একটা বন্দোবস্ত করবোই দেইখেন।’
‘তাই যেন অয়রে তাসলি, তাই যেন অয়’ বলে বাড়ি থেকে বাইরে যাওয়ার উদ্যোগ নিতে থাকে ছলেমান।
‘কই যাইতাছেন?’
‘যাই, একটু হুড়ার মাতায়। কামের ট্যাকাটা যদি আইজ দেয়।’
ছলেমান কাঁধে গামছাটা ফেলে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। তাসলি তাকিয়ে থাকে ছলেমানের পথের দিকে।
ছলেমান চলে যাওয়ার পর মেয়ের পাশে বসে তাসলি। আহ্লাদি তখন সুর করে পড়ছে, ‘প-তে পায়েত খেতে ভালি মদা’। শুনে বেদনায় হু হু করে ওঠে মায়ের মন। চিকচিক করে ওঠে চোখের কোণ। ‘আইচ্ছা মা, তুমি কি পায়েত খাইতো? অনেক মদা?’ তাসলি মেয়েকে বুকে টেনে নেয়। বামহাতে আঁচলে চোখ মোছে। ডানহাতে মেয়ের মাথায় হাত রেখে চুলে বিলি কাটে। ‘খাইছিরে মা খাইছি। অনেক মজা।’ কান্নাভেজা কণ্ঠেই জবাব দেয় তাসলি। ‘তাইলে আমিও খামু’ বলে আবদার করে আহ্লাদি। ‘আইচ্ছা, তোর বাজান আইলে কইমুনে।’
সন্ধ্যায় গোমড়া মুখে বাড়ি ফেরে ছলেমান। কাজের টাকাটা আজ পায়নি। গেরস্থদের স্বভাব ভালো না। আজ দেই, কাল দেই বলে ঘোরায়। এক হাটবার থেকে পরের হাটবার পর্যন্ত সময় লেগে যায়। ভূমিহীন কৃষকের কষ্ট তো আর তারা বোঝে না। বুকের মাঝে ক্ষোভ থাকলে ঠান্ডা মাথায় বাড়ি আসে ছলেমান। উঠানে দাঁড়িয়েই তাসলিকে ডাকে—
‘কই গো, আমার স্যান্ডেল জোড়া আর এক বদনা পানি দাও।’
‘একটু খাড়ান, দিতাছি।’
বাবার গলার আওয়াজ পেয়ে দৌড়ে আসে আহ্লাদি। বাবাকে জড়িয়ে ধরে। ‘বাবা, বাবা, আমাল পায়েত খাইতে মন তায়।’
মেয়ের কথা শুনে থ-মেরে দাঁড়িয়ে থাকে ছলেমান। স্যান্ডেল আর পানি নিয়ে আসে তাসলি।
‘যা মা, ঘরে যা। তোর বাজান পা ধুইয়া আসুক।’ মায়ের কথায় ঘরে চলে যায় মেয়েটি।
‘বউরে মাইয়ায় তো পায়েস খাইতে চায়।’
‘হ, আমারেও কইছে। এহোন কী কমু কন?’
‘চিন্তা করিস না বউ, আইজ ট্যাকা না দিলেও দলিল কাকায় কইছে কাইল হাটবার কামের ট্যাকা দিবো। ট্যাকা দিলেই খেজুর রস কিইন্যা আনমু।’
‘কয়ডাই বা ট্যাহা পাইবেন? এক হাড়ি রস দশটা ট্যাহা। রস কিনলে সপ্তার বাজার করবেন কী দিয়া?’
‘বাজার পরে বোঝা যাইবো বউ। আমার আহ্লাদি পায়েস খাইতে চাইছে।’
বলতে বলতে পা ধোয়া শেষ করে স্যান্ডেল পায়ে দিয়ে ঘরের দিকে আগায় ছলেমান। তাসলি মাটি থেকে বদনাটা তুলে স্বামীর পেছন পেছন ঘরে যায়।
বাবা-মার কথা শুনেই বুঝতে পারে আহ্লাদি। সীমাহীন আনন্দ এসে ভর করে আহ্লাদির চোখেমুখে। চিৎকার করে বলে ওঠে, ‘কী মদা, কী মদা, পায়েত খাবো, পায়েত খাবো।’
পরদিন সকালে আহ্লাদিকে স্কুলে দিয়ে মায়ের কাছে যায় তাসলি। মাকে বলে, ‘তোমার নাতনি খেজুর রসের পায়েস খাইতে চাইছে। রস না হয় এক হাড়ি কিইন্যা আনলো। কিন্তু আলা চাউল (আতপ) পামু কই?’
‘কস কি মা? আল্লাদি পায়েস খাইতে চাইছে? খাড়া দেহি হাড়িতে আলা চাউল আছেনি।’
বলে তাসলির মা হাড়ির দিকে যায়। হাড়ির তলা কুড়ানির শব্দ পায় তাসলি। বুকের ভেতর কেমন খচখচ করে ওঠে।
‘এই নে। আহারে এক পুড়া (চাল মাপার পাত্র) অইলো না। আমি একলা মানুষ। চাইরডা ডাইল-ভাত খাইতে পারলেই বাঁচি। আলা চাউল তো এবার করি নাই মা। আগের এইগুলান আছে। অইবোনি তোগো?’
খুশিতে চিকচিক করে ওঠে তাসলির মুখ। ‘অইবো মা, অইবো। মাইয়াডা একলা খাইতে পারলেই অইবো।’ চালগুলো আঁচলে ঢালতে ঢালতে বলে, ‘আমি তাইলে অহোন যাই মা।’
জমির কাজ শেষ করে দুপুরের খাওয়ার জন্য মজিবর মৃধার বাড়ি যায় ছলেমান। সকাল আটটা থেকে জোহরের আজান পর্যন্ত কাজ করতে হয় কামলাদের। আজান দিলেই সব জমির কামলার কাজ শেষ হয়ে যায়। তারপর গোসল-নামাজ শেষে জমির মালিকের বাড়িতে একবেলা খেতে যায়। জমি থেকে বাড়ি দূরে হলে খাবার জমিতেই দিয়ে আসে মালিকপক্ষ। ক্ষেত থেকে মজিবর মৃধার বাড়ি কাছেই। তাই বাড়ির পশ্চিম পাশের ছোটপুকুর থেকে গোসল করে চটানে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়ে মৃধা বাড়ির উঠানে গিয়ে মজিবর মৃধাকে ডাকে ছলেমান।
‘ঘরে আছেননি কাকা?’
‘হঅ, কেডা? ছলেমান আইছো?’
‘হঅ কাকা, আইছি।’
‘আহো আহো, ঘরে আহো।’
ছলেমান ঘরের বারান্দায় গিয়ে বসে। মজিবর মৃধার বউ খাবার দিয়ে যায়। খেতে খেতে জমি-জিরাতের খোঁজ নেয় মজিবর। এমন সময় এক বাটি পায়েস নিয়ে আসে মজিবর মৃধার স্ত্রী—
‘ছলেমান, সব শ্যাষে পায়েসটুকু খাইও। আমাগো গাছের রস।’
প্লেট চাটতে চাটতে লোভাতুর চোখে তাকায় পায়েসের বাটির দিকে। হঠাৎ ভেসে ওঠে আহ্লাদির মুখ। হাত বাড়িয়েও আর হাতে নেয় না বাটিটা।
‘চাচি, কিছু মনে না করলে একটা কতা কইতাম।’
‘কও, কী কতা কইবা?’
‘পায়েসগুলা আমার আল্লাদির লাইগ্যা লইয়া যাইতে চাই। মাইয়াডা পায়েস খাইতে চাইছিল।’
‘ওহ, এই কতা? আইচ্ছা, নিয়া যাও। কাইলকা বাটিটা লইয়া আইসো?’
‘আইচ্ছা।’
বলতে বলতে হাত ধুয়ে গামছায় হাত মুছে গামছাটা দিয়ে বাটিটা বেঁধে বাড়ির দিকে রওয়ানা দেয়।
বাড়ির উঠানে পা রাখতেই ছলেমানের মুখে খুশির ঝিলিক দেখা যায়। কারণ রস আর কিনতে হলো না। খুশির ধাক্কায় একটু জোর গলায় ডাকে তাসলিকে—
‘কইরে বউ। আইজকা মন কয় আশা পূরণ অইবো। দেহো কী আনছি।’
ভেজা চুল গামছায় শুকাতে শুকাতে বাড়ির উঠানে আসে তাসলি। তাসলির পেছন পেছন আহ্লাদিও আসে। স্বামীর হাসিমাখা মুখ দেখে আনন্দে নেচে ওঠে তাসলির মন। আহ্লাদি কিছু বুঝে উঠতে পারে না। তাসলির হাতে গামছা পেঁচানো বাটিটা দিয়ে ছলেমান বলে—‘মজিবর কাকার বউ দিলো।’
গামছা খুলে বাটিতে পায়েস দেখে তাসলি আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ে। নিজের অজান্তেই মুখ থেকে বেরিয়ে আসে—
‘পায়েস!’
‘হঅ, খেজুর রসের পায়েস।’
বাবা-মার কথা শুনেই বুঝতে পারে আহ্লাদি। সীমাহীন আনন্দ এসে ভর করে আহ্লাদির চোখেমুখে। চিৎকার করে বলে ওঠে, ‘কী মদা, কী মদা, পায়েত খাবো, পায়েত খাবো।’