কৃতীর কোমরে মাদুলি!
বিশ্বাস হচ্ছে না—আমাদের মধ্যে সবচে’ বিজ্ঞানমনস্ক ও, অথচ তাবিজ রাখে! মমকে দেখেও বিশ্বাস হচ্ছে না। তলপেটে ভুড়ির শহর। ওর আবার জিরো ফিগারের গুমর! শ্রেয়াকে বেশ হৃষ্টপুষ্ট দেখি প্রতিদিন। অথচ কী শুকনো ভেতরে ভেতরে! কিভাবে কী? নিশ্চয় কায়দা কানুন আছে। এই ডামাডোল শেষ হোক, জিজ্ঞেস করব।
অবাক হচ্ছি ছবিকে দেখেও। সারা গা ঢেকে রাখে বোরখায়। পায়ে মোজা। হাতে মোজা। ভ্রূ বাদে একটা লোম পর্যন্ত দেখিনি কোনো দিন। ওরও একটা সুতো পর্যন্ত নেই গায়ে! সুতো অবশ্য কারও গায়েই নেই! একসঙ্গে দেখলে অদ্ভূত দেখাচ্ছে বড়। মনে হচ্ছে ইয়া বড় একটা পর্দা—সাদা লালচে-কালচে রঙে একাকার। মাঝে মাঝে কালো কালো ফোঁটা। প্রাকৃতিক চেহারাই নিয়েছে সবাই। আয়োজনটা কৃষ্টির জন্য।
কৃষ্টি আমার সবচে’ কাছের শত্রু! ওর ছায়ায় আমাকে দেখা যায়। আমার ছায়ায় ওকে। আলাদা হলে একলা লাগে। তাই একসঙ্গে উড়ি। একসঙ্গেই পুড়ি। অথচ ও আত্মহত্যা করেছে। একা! পরশু রাত। খেতে বসেছি। ফোন করল রাহিন। গলায় হন্তদন্ত রেশ—কৃষ্টি আর নেই!
মজা করছে নিশ্চয়। প্রায়ই এমন করে কৃষ্টি। এমন সব ঘটনা সাজায়, পিলে চমকে যায়। তারপর এমনভাবে হাসে, পিত্তি জ্বলে যায়! রাহিনকে দিয়ে হয়তো মিথ্যেমিথ্যি গল্পটা সাজিয়েছে। তাই পাত্তা দেইনি। কিন্তু না। ঘটনাটা সত্য। কৃষ্টি আসলেই নেই।
বাবা প্রেসারের রোগী। ঘুমের বড়ি খেতে হয়। তাতেই স্বস্তি খুঁজেছে ও। কিন্তু কেন?
কয়েকজনকে ফোন করলাম। জানে না। না জানলে মানুষ বেশি কথা বলে। গড়গড় করে কী সব বলল ওরা। বুঝলাম না। দ্রুত বের হলাম। চোখে জলের নহর। ভাসছে তাতে কৃষ্টির মুখ। সন্ধ্যাবেলার স্মৃতি। বসে ছিলাম মাঠে। বন্ধুবৃত্ত বড় হচ্ছিল। জমে গিয়েছিল আড্ডাটা। সবুজঘাসের জমাট জমিন তখন আকাশ। রঙধনু এঁকে চলেছি আমরা। কথার। স্বপ্নের। গল্পের। গল্পগুলো ছুটছিল দ্রুত। পাগলা ঘোড়ার মতো। আজ থেকে কাল। কাল থেকে পরশু। অতীত থেকে আজ। আজ থেকে আগামী।
হঠাৎ উঠে গেল কৃষ্টি। কী যেন কাজ। দেখা করতে বলেছেন স্যার। তাকিয়ে ছিলাম। চমৎকার করে হাঁটে ও। মাদল গীতল ভঙ্গি। দেখতেই ভালো লাগে। পোশাকে রুচির ছাপ। কথা বলে গুছিয়ে। শোনার সময় শোনে মন দিয়ে। আমরা কেউই ওর মতো না। ও না থাকলে তাই আড্ডার স্নিগ্ধ ভাবটাও থাকে না। সেদিনও সেটা চলে গেল ওর সাথে। এরপরই কাঠখোট্টা আর নোংরা হয়ে উঠল আলোচনা। মনে আছে। ঘণ্টার কাঁটা দু’দাগও পেরোয়নি। এর মধ্যেই কী হয়ে গেল!
আবার রাহিনের ফোন। এবার একটু আশান্বিত কণ্ঠ। হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে কৃষ্টিকে। লাইফ সাপোর্টে চলছে ঘড়িটা ওর। তার মানে আশা আছে! লাফিয়ে উঠলাম। কৃষ্টি আছে! তার মানে, আবার আসবে ও। আবার হাসবে। হাসাবে। আবৃত্তি করবে। গাইবে। আবার। বন্ধুদের চুলে গিঁট দেবে। মজা নেবে। ভেঙচি কাটবে। আবার।
ছুটে যাবে মানুষের বিপদে। অনাচারের প্রতিবাদ করবে। নিরুপায় হলে মুষড়ে পড়বে। আবার। কতকিছু হওয়ার কথা ওর। কৃষক ডাক্তার পুলিশ রাজনীতিবিদ শিক্ষক। এক একদিন এক এক পেশা ভালো লাগবে। গাল ভরে তার কারণও দর্শাবে। কোনো কোনো সময় বিরক্তি দেখাবে—এত অবিবেচক কেন আমরা? এত অমানবিক কেন? বিবেচনাবোধ উৎপাদনকারী কারখানার পরিকল্পনা করবে! আমরা হাসব।
নীলাকাশ পছন্দ না ওর। সবুজ একটা বানাবে। লাল সূর্য উঠবে যখন, মনে হবে প্রিয় পতাকাখানা ঝুলছে। দুলছে। বলবে আর দুলবে ও নিজেই। চোখ ভিজে যাবে। আবার। ভাবছিলাম। কিন্তু যদি না ফেরে? কষ্ট হচ্ছিল দম নিতেও। রাত তখন একঘুম দিয়ে উঠেছে। আড়মোড়া ভাঙছে। আরেক ঘুমে ডুববে। আমরা ছুটছি শহরের পথে। হাবুডুবু খাচ্ছি কান্নায়। সাঁতার কাটছি আশানিরাশার স্রোতে।
আমাদের ঢেউটা আছড়ে পড়ল ইমার্জেন্সিতে। গিজগিজ করছে লোক। কাঁচঘেরা ঘরটার সামনে শিকড় গেঁড়েছে ওর পরিবার। ওদের সঙ্গে মিশে গেলাম। শোকদলিত মলিন করুণ ফুলগুলো সব। এক হয়ে গেলাম আশার সুতোয়। ঘণ্টাখানেক পর ডাক্তার বের হলেন। বললেন তারা চেষ্টা করছেন। বাকি সব স্রষ্টার হাতে।
ওঁদের হাতেই থাকল সব। আমরা লেগে গেলাম কাজে। একটাই প্রশ্ন সবার। এমন কেন করল ও? খুব ভালো ছাত্রী কৃষ্টি না। কিন্তু অনেকের চে’ ভালো। আর সবার চে’ সৃজনমুখী। সবচে’ আলোকিত। সংস্কৃতিপ্রাণ চৌকস মেয়ে। স্যাররাও পছন্দ করেন ওকে। ও কেন আঁধার খুঁজবে? সময়টাই এমন এখন। যখন তখন দুর্যোগ ঘটতে পারে। কিন্তু কৃষ্টির ব্যাপারটা আন্দাজ করা যাচ্ছে।
স্যারের কাছে গিয়েছিল। মনে আছে। সন্ধ্যা তখন উৎরে গেছে। ডিপার্টমেন্ট ফাঁকা। একটা দুর্যোগ সেখানে ঘটতেই পারে। কৃষ্টির শেষ স্ট্যাটাসটা দেখলাম। ৯:৩৭ এ লেখা। ‘আপনার মতো উচ্চ-অশিক্ষিত অমানুষেরা আছে, তাই থাকা হলো না।’ ক্যাম্পাস থেকে ফিরেছে নয়টার দিকে। খালাম্মা অসুস্থ। নিজে খেতে পারেন না। ও-ই খাওয়ায় মাকে। প্রতিদিন। বছর দুয়েক এ-ই নিয়ম। ওইদিন তাও করেনি। ঘুমোতে গেছে সোজা। তখনই হয়তো খেয়েছে বড়িগুলো। তার আগে এটাই শেষ যোগাযোগ। কিন্তু ‘আপনি’টা কে? স্যারের দিকেই আঙুল সবার। সবারই এক মত। স্যারই কালপ্রিট। যুক্তিবোধও তাই বলছে।
মানুষ হিসেবে আমাদের স্যারেরা ভালোই। শিক্ষক হিসেবেও। উনিও খারাপ না। কিন্তু আলুর দোষ আছে। কেউ কেউ বলে কলার। চিন্তাচেতনায় মধ্যযুগীয়। চলনেও তাই। বলনেও। ছাত্রীরা তার কাছে শিক্ষার্থী না, মানুষ না; মেয়েমানুষ!
কাজে অকাজে খাটিয়ে মারেন সবাইকে। যা বলেন, করতে হয় শিক্ষার্থীদের। না করলে ধরা। বিশেষ শিক্ষার্থীরা বেশি নম্বর পায়। অন্যরা কম। বিশ্বাস করা কঠিন যদিও। কিন্তু এক না ঘটলে এগারো কি রটে?
রাজনৈতিক লিঙ্ক ভালো। কিছুদিন আগে একটা নির্বাচনেও জিতেছেন। তাই গুরুত্ব পান। তাছাড়া তিনি জনপ্রিয়ও বেশ। হাসিখুশি থাকেন। হাসান। জোকস বলেন। ব্রেইনলেস সব জোকস। বিলো স্ট্যান্ডার্ড ছেলেমেয়েরা খিকখিকিয়ে হাসে। চেম্বারে যায়। গল্প করে। পার্টি হয়! নানা পদের তরলও নাকি কলকলায় পার্টিগুলোতে।
পড়ান ভালো। পটান আরও ভালো। দুই সন্তানের জনক। ছ্যাবলামি যায়নি তবু। ঢলে ঢলে পড়েন এখনো। গলে গলে পড়েন।
এক আপুকে নিয়ে কথা উঠেছিল কদিন আগে।
এক ম্যাডামের সঙ্গে জড়িয়েও গল্প শুনেছি।
দৃষ্টি যে তাঁর ভালো না, বুঝতাম। কৃষ্টিও বুঝত। কিন্তু গা করেনি। মিশত খোলা মনে। সেটাই কাল হলো। লোকটাকে একটা শিক্ষা দিতে হবে। মেয়ে দেখলেই ছোঁক ছোঁক করার মজা দেখাতে হবে। হাসপাতালেই ছিলাম। চোখে জেগে থাকল রাত। একটু ঝিমোলো। একটু ঘুমোলো। তারপর ফিকে হলো। চোখে তখন রাজ্যের মেঘ। বুকের ভেতর ঝড়। মাথার ভেতর আগুন। সে আগুন নেভার আগেই জ্বালিয়ে দেব সব। তাই বেরিয়ে পড়লাম। কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না।
চেম্বারে আটকে রাখলাম স্যারকে। পুলিশ ছাড়িয়ে নিল।
অবরোধ বসালাম। শিক্ষকেরা উঠিয়ে দিলেন।
মানববন্ধন করলাম। স্মারকলিপি দিলাম। কাজ হলো না।
স্যারের পক্ষে যারা, একটাই কথা তাদের, প্রমাণ কই?
দারোয়ান বলেছে, স্যারের রুমেই ঢুকেছিল কৃষ্টি। ওই ফ্লোরে তখন স্যার ছাড়া কেউ ছিলও না। অথচ প্রমাণ পাচ্ছে না কেউ! তবে আশার কথা, সরব হচ্ছে সংবাদমাধ্যম। সুতোয় টান পড়তে শুরু করেছে। কিন্তু ক্ষমতার চেরাগ আছে যে! কী হবে বলা মুশকিল! আমাদের কাজ তাই আমরা করব। কিন্তু কী করা যায়?
জ্বালাও পোড়াও আন্দোলনে দেশের ক্ষতি। সেটা চাই না। ব্যতিক্রম কিছু করব। যা তাঁকে মনে করিয়ে দেবে তিনিও মানুষ! যা তাঁকে শেখাবে নারীকে শ্রদ্ধা করতে হয়। ভালোবাসতে হয়। ভেবেই চলেছি। কিন্তু কিনার মিলছে না। তখনই এই সমাবেশের কথা মাথায় এলো।
একক্লাস মেয়ে। দাঁড়িয়ে থাকব কাপড় খুলে। তাকিয়ে থাকব তাঁর দিকে। অপলক। ছুঁতোনাতায় ছুঁয়ে দেন মেয়েদের। নিশ্চয় ভোগ করতেও ইচ্ছে হয়। ভোগের উপযুক্ত হয়েই দাঁড়াব। কোনো কথা বলব না। শুধু দাঁড়িয়ে থাকব। ক্লাসভর্তি ছাত্রী। বিবসনা। চোখে ঘৃণার সাগর। সাগরে উত্তাল ঢেউ। ঢেউয়ের ফেনায় আগুন। জ্বলমান।
হাজার হলেও মানুষ তো, লজ্জা হবে। জানাজানি হলে অন্যরাও বুঝবে। বললাম বন্ধুদের। ক্ষুব্ধ সবাই। প্রচণ্ড রেগে আছে। চাচ্ছে শাস্তি হোক স্যারের। কিন্তু আয়ডিয়াটা পছন্দ হলো না। নতুন কিছু করতে গেলে এমন হয়। আমি জানি। তাই লেগে থাকলাম। হলে গিয়ে গিয়ে বুঝোলাম। বাসায় বাসায় গিয়ে বুঝালাম। আস্তে আস্তে হাওয়া লাগল পালে।
গ্যালারিতে করব কাজটা। অন্য মেয়েরা ও ছেলেরা থাকবে বাইরে। সার বেঁধে বসে থাকবে। কোনো উচ্চবাচ্য হবে না। হট্টগোল হবে না। এটা আমাদের ছদ্মবেশ। ভেতর ভেতর আসল কাজ করে ফেলব। ঠিক করলাম মোবাইল, ক্যামেরা বা রেকর্ডার আনা যাবে না। কোনোকিছুর প্রমাণ থাকবে না। থাকবে কিংবদন্তী। থাকবে শুধুই গল্প! ছোটরা কেউ কেউ যোগ দিয়েছে আমাদের সঙ্গে। বড়রাও। বহু আন্দোলন করেছি। কিন্তু এমন পাগল পাগল বোধ করিনি কখনো। হাওয়ায় ভেসে চলেছি যেন।
ফাঁকে ফাঁকে খোঁজ নিয়েছি কৃষ্টির। একেকবার একেক খবর। এই শুনি ভালোর দিকে। পরেই আবার যেই কে সেই। তবে অবনতি হচ্ছে না। এটাই স্বস্তির।
অস্বস্তি যদিও ছিল একটা। সন্দেহের বশে এমন একটা কাজ করছি। ঠিক হচ্ছে তো? স্যার যদি নির্দোষ হন! মানুষ তো পরিস্থিতিরও শিকার হয়। দোনোমনা ছিলাম। কিন্তু সেটা কেটে গেছে পত্রিকা পড়ে। স্যার বলেছেন, একটু ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। এটা তাঁর আর কৃষ্টির ব্যাপার। একান্তই ব্যক্তিগত। এটাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিলে চলবে না। মিডিয়াকে নাক গলাতে নিষেধ করেছেন।
এরপর আর সংশয় থাকে না। ডগমগ করছিলাম তাই। বেরও হয়েছি টগবগিয়ে। কিন্তু কিভাবে কিভাবে দেরি হয়ে গেল। তবু দেখি অনেকেই আসেনি। রেগে গিয়েছিলাম। অস্থির লাগছিল। পরে শান্ত হয়েছি। এতবড় একটা ঝুঁকি নিচ্ছে সবাই। সময় একটু লাগবেই। ফোন করলাম। আসছে বলল। চলেও এলো একে একে।
সব ঠিকঠাক। রুবিই শুধু আসেনি তখনো। অথচ সেই কখন রওনা করেছে। এদিকে সময় হয়ে যাচ্ছে। তাই প্রস্তুত হতে বললাম মেয়েদের। কিন্তু নড়ল না একজনও। বুঝি, এটাই স্বাভাবিক। বাধ্য হয়ে আমিই শুরু করলাম। জিন্সটা নামাচ্ছি যখন, দেখি ওরাও হাত লাগাল। তারপর জাদু! দেখছি আর অবাক হচ্ছি। কী পরিমাণ রহস্য আমরা লুকিয়ে রাখি কাপড়ে! কী নিবিড় আড়াল হয় আমাদের পোশাক!
এতজনকে এভাবে দেখিনি কখনো! অবিশ্বাস্য লাগছে। ফোন করল রুবি। মিনিট দুয়েক লাগবে ওর। স্যার কোথায় জানতে চাইলো। ডাকতে বললো। বের হলাম আমি। ভয় ভয় করছে। পার পাব তো?
ক্লাসরুমগুলোর পরেই একটু ফাঁকা জায়গা। সিঁড়ির উঠোন। একটা জানালা আছে ওখানে। ফাঁক পেয়ে আলো ঢোকে হুড়মুড়িয়ে। বাতাস ঢোকে। আকাশও। ফাঁক পেলে আমরাও দাঁড়াই এখানে। খোলা আকাশে শ্বাস ফেলি। কখনো হ্রস। কখনো দীর্ঘ। কোনো শ্বাসে মিশে থাকে স্বস্তি। কোনোটাতে আনন্দ। কোনোটাতে হতাশা।
ওখানেই দাঁড়ালাম। নিঃশ্বাসে আজ আগুন বেরুচ্ছে। ঘৃণার। দূরে দাঁড়িয়ে আছে ঝাঁকড়ামাথা বুড়ো গাছটা। তার নিচে রঙের মেলা। আমাদের ছদ্মবেশ। ষাট পঞ্চাশেক শিক্ষার্থী বসে আছে। সবাই মুখোশ পরা। দূর থেকে বোঝা যাচ্ছে না; তবে খুঁজে খুঁজে কিনেছি, তাই জানি মুখোশগুলো না নারীর, না পুরুষের। ওগুলোতে জেগে আছে মানুষের অবয়ব। চোখগুলো ফিতায় ঢাকা। কিছু দেখছে না ওরা। বলছেও না কিছু। টু শব্দটি নেই। নিথর এক নীরবতা ছেয়ে আছে ওদের। এমনই চেয়েছিলাম। ঠিক আছে সব। আশ্বস্ত হয়ে পা বাড়ালাম। বিভাগীয় প্রধানের চেম্বার। তারপর রব স্যারের। পরেরটা খালি। তারপরেই কাঙ্ক্ষিত ঘর। দাঁড়িয়ে আছি। সামনে দরজা। দরজায় নেম প্লেট…।
ঢুকে পড়ব? না কি নক করব? ভাবছি। ভদ্র থাকার অবস্থা কি আছে? মানুষের সঙ্গে মানুষের ব্যবহার। পশুর সঙ্গে পশুর। কিন্তু পশু হতে পারলাম না। নকই করলাম শেষ পর্যন্ত।
ঠক ঠক ঠক। সাড়া নেই।
ঠক ঠক। সাড়া নেই।
কিছুক্ষণপর অনুমতি মিলল। এ ঘরেই সর্বনাশটা ঘটেছে। তাই রুচি হলো না ঢুকতে। ঠেলা দিলাম দরজাটা। দেখেই বকতে শুরু করলেন। বিরক্তিমাখা বিষাক্ত স্বর। কী শুরু করেছি এসব আমরা। ওখানে সঙ সেজেছে কারা? কী লাভ এসব করে? এখন দরকার দোয়াখয়রাত। তাতে করে বেঁচেও যেতে পারে মেয়েটা।
উত্তর দিলাম না। ক্লাসের কথা বললাম। তারপর বের হলাম।
হাতপা কাঁপছে। অস্থির লাগছে। কুরুক্ষেত্রে রওনা হয়েছি যেন।
হাঁটছি। হাঁটছি। হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলাম কিশোরকালে। চোখে লাগল পুরোনো ঘরের আবছা আলো। নাকে এলো গোয়ালের চুনাকাদার ঘ্রাণ। গল্লা গল্লা পাটকাঠি শুকোচ্ছে উঠোনে। রাজহাঁস ডাকছে। প্যাঁক প্যাঁক শব্দে কান কাড়া দায়। পেছনের বাঁশঝাড়ে শনশন হাওয়া। বিষণ্ন বিকেলটা ফিরে এলো। আবার। ফিরে এলো হায়েনাটাও। ছিঁড়েখুড়ে খেলো আমায়। চেটেপুটে খেলো। তারপর চলে গেল। শান্ত। স্বাভাবিক। যেন হয়নি কিছু।
অথচ পর না সে। খুব বিশ্বাস করতাম তাকে। পছন্দও। আমায় গান শোনাত। গল্প করত। একবারও বুঝিনি সে মানুষ নয়। মুখোশ ছেড়ে যখন পুরুষ হলো, তখন বুঝলাম। জানলাম পুরুষ যে-ই হোক, সে পুরুষ। উহ্! কী যন্ত্রণা! এখনো কুঁকড়ে উঠি। অথচ মা এসে বলল, চুপ থাকতে। কাউকে কিছু বলা যাবে না। ঝামেলা বাড়বে। ক্ষতি হবে।
ক্ষতি কিসে? মুখ খুললে, না কি বুজলে? কিসের ভয়ে চুপ থাকি আমরা? কোন জুজুর ভয়ে মেনে নেই সবকিছু? কিছু হলেই কেন লুকোতে চাই? আঙুলটাও তুলি না। কেন? ধর্ষক তো ধর্ষকই। সে কারও আত্মীয় না। শিক্ষক না। বন্ধু না। অন্যায়ের শিকার একটা কুকুরও ঘেউঘেউ করে। প্রতিবাদ করে বিড়ালও। বিচার চায়। আমরাই শুধু শাস্তি দেই নিজেদের। সয়ে যাই সব। সয়ে যাচ্ছি। সারাটা জীবন আমায় কুরে খায় এই চুপ থাকা। জ্বালাটা এবার জুড়োবে একটু হলেও।
কিন্তু সে গুড়ে বালি। ক্লাসে ঢুকেই ধাক্কা খেলাম। সব ভণ্ডুল করে রেখেছে রুবি! শুরু থেকেই আমার সঙ্গে ছিল ও। কিন্তু মত বদলেছে এখন। মানুষকে লজ্জা দেওয়া যায়, যে পশুরও অধম, তাকে কী করে দেব? যা-ই আমরা করি না কেন বুঝবে না সে। উল্টো তাজাতরুণ শরীরগুলো দেখে মজা লুটবে। কেন শুধু তার খোরাক হব? কথা ঠিক। এভাবে ভাবিনি আমি। তাই বলে থেমে যাব? মেনে নেব অন্যায়টা?
না। চুপচাপ বসতে বলল আমায়। মুখোশ পরালো সবাইকে। আমাকেও দিল একটা। পরলাম না। কী লাভ এতে? যে বোঝে না, তার কাছে মুখও যা, মুখোশও তা! দাঁড়িয়ে আছি। হতাশ। মনোবলহীন। ক্ষুব্ধ। চোখ পড়ল পেছনের এক চেয়ারে। বসে আছে স্যারের মেয়েটা। কী যে কিউট এই পিচ্চি! খলখল করে হাসে। থলথল করে হাঁটে। দেখলেই কোলে নেয় সবাই। কৃষ্টিও নিত। আদর করত। আমিও। কিন্তু এখন বিরক্ত হলাম। কিসের মধ্যে কী!
ভাবতেই তড়িৎ খেলল মাথায়—স্যার কি জেনে গেছে ব্যাপারটা? স্যারের কথাতেই কি রুবি পণ্ড করেছে সব? হতে পারে। না হলে পিচ্চিটাকে এনেছে কেন ও? আবার ব্যর্থ হলাম! না, এই সার্কাস দেখে সময় নষ্ট করব না। হাসপাতাল যেতে হবে।
বের হতেই জ্বলে উঠল চোখ। আসছেন স্যার। সেই হায়েনাকে দেখলাম তার মধ্যে। অবিকল সেই লোক। আলাদা হয় মানুষের চেহারা। ধর্ষকের চেহারা এক! পৃথিবীর সব ধর্ষক একই চোখে দেখে। গলায় তাদের একই ডাক। নখে একই ধার। ক্লাসে ঢুকলাম দ্রুত। এবং থ হয়ে গেলাম! কিছুক্ষণপর স্যার ঢুকলেন। এবং থমকে দাঁড়ালেন।
ক্লাসভর্তি মেয়েরা দাঁড়িয়ে আছে। মুখোশঢাকা মুখ। মুখোশগুলোতে কৃষ্টির ছবি। সব মেয়েই কৃষ্টি! প্রতিটা কৃষ্টিই হাসছে। ব্যঙ্গমাখা ধারালো তীক্ষ্ণ হাসি। সহ্য করা কঠিন। নড়তে পারলেন না স্যার। দাঁড়িয়েই আছেন। মাথাটা নিচু। তাকাচ্ছেন না কোনোদিকে। তখনই এগিয়ে এলো স্যারের মেয়েটা। মুখোশ একটা ওকেও পরানো হয়েছিল। খুলে ফেলেছে। গলায় ঝুলছে ওটা। বাবার দিকে এগিয়ে আসছে সে। টলমল পা। ডাকছে স্যারকে। বাব্বা। বাব্বা। ঘুনশি ছাড়া গায়ে কিচ্ছু নেই পিচ্চিটার! কী করেছে রুবি! এই ছিল ওর মনে?
সহ্য হলো না আমার। ছুটে গেলাম। কোলে নিলাম পিচ্চিটাকে। ওড়নাটা জড়িয়ে দিলাম গায়ে। কিন্তু চিৎকার জুড়লো। তাই নামিয়ে দিলাম। বাবার দিকেই যাচ্ছে সে। কাঁদছে। কখন যেন কেঁদে ফেলেছি আমিও! স্যার কি তাকিয়ে আছেন আমার দিকে? ওড়না সরালে বড়সড় বুকটা আমার আরো বড় দেখায়। দেখে নিশ্চয় আনন্দ হচ্ছে তার! ঝিলিক দিচ্ছে চোখে! জিহ্বাটা কি ঝুলে গেছে? লালা পড়ছে?
জানি না।
তাকাইনি।
আমার চোখ তখন বাচ্চাটার দিকে। কী মায়াময় ডাগর চোখদুটো বেয়ে অশ্রু ঝরছে! কী নরম গোটা গোটা পায়ে হাঁটছে! কী নিষ্পাপ স্বরে কাঁদছে! আমার তো অসহায় লাগছে। ভয় করছে। কোথায় যাচ্ছে মেয়েটা? ও কি জানে, ওর বাবা পুরুষ?