গাছের ছায়ায় সূর্যরশ্মি ভেঙে টুকরো-টুকরো হয়; ফলে মাটির ওপর অস্থির-চিত্র আর শূন্যে ঘূর্ণিহাওয়ার বিক্ষিপ্ত নৃত্য; তার ঢেউ এসে লাগে জমির আলীর চোখেমুখে। বাধ্য হয়ে বেচারা তখন ভাসমান ধুলাদের গালমন্দ করে, ‘শালার ধুলুর বাইচ্চা ধুলু, খিজালত করার আর সুমায় পালিনি, তাই না? খালি বেহুদা কাজ, আর কত অভিশাপ কুড়াবি, কত জীবন নষ্ট করবি!’
ব্যাপারটা এমন না যে, গালি শুনে ক্ষণিকের জন্য বাতাস থমকে দাঁড়াবে; কিংবা তার কাছে বশ্যতা স্বীকার করবে। তবু গালাগাল করতে জমির আলীর মন্দ লাগে না; খুব মজা পায়। বেচারা আনমনে মাথা ঝাঁকায় আর হাসে, হাসে আর মাথা ঝাঁকায়, ‘এত দেমাগ ভালা নারে! তুই নিজিউ একদিন ভ্যনিস হয়ি যাবি! তকুন বুজবি ঠ্যালা, বুজবি কত ধানে কত চাইল। আল্লার হুকুমি সিঙ্গায় ফুঁ দিলি আর কুনু শালাক চোকে পড়বে না।’
রসুই ঘরের দাওয়ায় বসে রহিমন এতক্ষণ স্বামীর হাবভাব দেখছিল আর ভাবছিল। হাতের কাজ অসমাপ্ত রেখে শাড়ির আঁচল ঝাড়তে-ঝাড়তে সে নিচে নেমে আসে; জমির আলীর পাশ-ঘেঁষে দাঁড়ায়।
মানুষটার এতে বিন্দুমাত্র ভ্রূক্ষেপ নেই। পূর্বের মতোই অঙ্গভঙ্গি। বোধ হয় খেয়ালই করেনি।
‘এরাম করি কাকে গাইল দিচ্চু তুমি?’
রহিমনের কথায় জমির আলীর স্বপ্নের উড়োজাহাজ হঠাৎই ক্রাশল্যান্ড করে; রাধানগর থেকে সোজা রাধিকাগঞ্জ। সেই সাথে বদলে যায় দৃশ্যপট। মুখে হতাশার গান,‘আর কাক গাইল দেবোরে বৌ, একলা একলাই ভাবচি!’
‘কী ভাবচু যাদুর বাপ?’
জমির আলীর চোখেমুখে মমতার পেলব। তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে রহিমনের ভিতরটা বোধ হয় বুঝতে চেষ্টা করে।
‘ভাবনার কি শ্যাষ আচে? জীবনের কতা ভাবচি; ভাবচি পুড়ামুখী পদ্মার কতা। আমাগের জীবনডা একদম শ্যাষ করি দিলু; কুনুকালে মাজা শক্ত করি দাঁড়াতি পাল্লাম না।’
প্রতিদিন ওই এককথা; শুনতে আর ভালো লাগে না। রাধানগর নামটা বড্ড তেতো, বিস্বাদ। রহিমন যত ভুলতে চায়, জমির আলী ততই উগরে দেয়; নতুন-নতুন গল্পের ফাঁদ পাতে। তার ওই ফাঁদপাতা ভুবনে দশ্যমান হয়ে ওঠে চিরায়ত সব জীবনচিত্র। কল্পনার ডানায় ভর করে জমির আলী রাধানগরের মাটি স্পর্শ করলেও রহিমন রয়ে যায় বাস্তবের মাটিতে, রাধিকাগঞ্জের শ্যাওলা আচ্ছাদিত আঙিনায়। অনুযোগের স্বরে স্বামীকে বলে, ‘আইচ্চা, রাধানগর-রাধানগর করি মরবা না কি? কি আছে সেকেনে, কিচ্চুনি! ওই নামডা তুমি ভুলি যাউ, তালি দেকবা জবর ভালো লাগচে, জান টালা হবে, পিরানে শান্তি পাবা।’
রহিমনের কথাগুলো তার পছন্দ হয় না। আচ্ছা, ভুলতে চাইলেই কি ভোলা যায়; নাকি কেউ ভুলতে পারে!
দুই.
সামনের উঁচু দালানের পানে চোখ পড়তেই জমির আলী আঁতকে ওঠে। ফনা তুলে দালানটা যেন তার দিকেই এগিয়ে আসছে! পদ্মার মতো সেও হয়তো সবকিছু গোগ্রাসে গিলবে; পলিমাটি খুবলে-খুবলে খাবে। সাধের রাধিকাগঞ্জও হয়তো একদিন বিলিন হয়ে যাবে।
একটা বিষয় জমির আলী ঠিকঠাক মেলাতে পারে না; রাধিকাগঞ্জের কথা যতবার ভাবতে যায় ততবারই রাধানগরের স্মৃতি উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। মনের ক্যানভাসে উঁকিঝুঁকি মারে বিশেষ কিছু মূহুর্ত- সে এক ভয়ংকর রাত! বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎই ফুঁসে ওঠে প্রমত্ত পদ্মা। ঢেউয়ের পর ঢেউ এসে বেলাভূমিতে আছড়ে পড়ে। রাধানগরের পলিদ্বীপে শুরু হয় জল-পবনের ক্ষ্যাপা নৃত্য। প্রকৃতির অগ্নিদৃষ্টিতে রাতের মধ্যেই রাধানগর নামের গ্রামটি কালের অতল গর্ভে হারিয়ে যায়। বিলীন হয়ে যায় সাত-পুরুষের ভিটামাটি।
যাদু তখন ছয় মাসের কোলে। জমির আলীর দু-চোখে ঘোর অন্ধকার। অন্নবস্ত্রহীন খোলা আকাশই ছিল জীবনের একমাত্র সম্বল। ফোলা চোখে কেউ-কেউ নদীর পানে সারাক্ষণ তাকিয়ে থাকতো। নাঃ অথৈই জল ছাড়া কিচ্ছু চোখে পড়ে না। স্রোতের সঙ্গে জড়াজড়ি করে ভেসে যায় খড়কুটো। মানুষের জীবনও তখন ছিল ওইসব খড়কুটোর মতো।
দু-একদিন নদীপাড়ে অপেক্ষা করার পর যে যার মতো নিরুদ্দেশ হয়; কেউ উত্তরে, কেউবা দক্ষিণে। যুদ্ধের সময়ও মানুষ নাকি এভাবে ঝাক বেধে দেশান্তরী হয়েছিল। জীবনের ওই চরম দুর্যোগের কথা জমির আলী কিছুতেই ভুলতে পারে না। পোটলা-পুটলি মাথায় করে দিন কয়েক উদ্ভ্রান্তের মতো এদিক সেদিক ঘুরে বেড়ায়। কখনো মাটির বুকে নাক ঠুকে ঘ্রাণ নেয়। তারপর রেলব্রিজের এই পাদদেশে শেকড় গাড়ে, অসহায় কিছু মানুষকে নিয়ে শুরু করে জীবনের নতুন যুদ্ধ।
শস্যহীন বিস্তীর্ণ খাসজমিতে জমির আলী এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত বিরামহীন চষে বেড়াতো। কোনো ক্লান্তি নেই। দৃষ্টির প্রখরতায় দিক-বিদিক নিরীক্ষণ করে। দূর্বার বুক চিরে কোথাও-কোথাও কাশফুলের বিজয় নিশান। দূরে-দূরে অপুষ্ট বাবলার বিক্ষিপ্ত সারি। নলখাগড়ার বন পেরিয়ে উঁচু-নিচু মাটির ঢিবি। তার পাশ ঘেঁষে বয়ে গেছে গঙ্গা-কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্প। ঢিবির ওপর উঠে দাঁড়ালে জমির আলীর রক্ত কণিকায় নাচন ধরতো। মনে হতো, এই ভূমিতে তার একচ্ছত্র আধিপত্য- নতুন ভূ-স্বামী। রাধানগরের সঙ্গে মিল রেখে স্থানটির নামকরণ হয় রাধিকাগঞ্জ। জমির আলী আর একবার মাটির সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলে; ফুল-ফসলের স্বপ্ন দেখে। সকাল থেকে সন্ধ্যা-অবধি হাড়ভাঙা পরিশ্রম; সারাক্ষণ কাজ আর কাজ। জমির আলী রিকশা নিয়ে শহরে গেলেও রহিমন বসে থাকতো না, মেয়ে বিজলীকে সঙ্গে নিয়ে গাছগুলোর পরিচর্যা করতো; সকাল বিকেল পেট পুরে পানি দিত।
রাধিকাগঞ্জ যে সত্যি-সত্যি একদিন গঞ্জে পরিণত হবে, জমির আলী স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি। অথচ তার সাজানো সুখের বাগানে হঠাৎই বিষধর সাপের অনুপ্রবেশ। ভূমিদস্যুর শ্যেণদৃষ্টি আর নগ্ন-হস্তক্ষেপে তার সবুজ পৃথিবী বারবার রঙ বদলায়। অদৃশ্য ইশারায় কেউ-কেউ আড়াল থেকে কলকাঠি নাড়ায়। বিস্তীর্ণ গালিচা জুড়ে এখন ঘিঞ্জি বস্তি। পাচ বছর পর-পর বস্তির মালিকানা হাতবদল হলেও মানুষের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয় না। একবার হাপি কানা আর একবার মুরগি গনি; কেউ কারও চাইতে কম যায় না। অসংখ্য আবদার, ঊনিশ-কুড়ি হলে আর রক্ষা নেই, মাথার ওপর খড়্গ নেমে আসে। অবশ্য ঘরে সুন্দরী মেয়ে থাকলে অন্য কথা।
জমির আলী আজ বড্ড নিরুপায়। শরীরের মধ্যে ঘুন পোকার বসবাস। নিজ-হাতে লাগানো গাছগুলোর সাথে এখন আর সম্পর্ক নেই। মুখ নিচু করে অস্থির চিত্তে পায়চারী করে। গভীর রাত অব্দি বুকের মধ্যে গাছকাটার শব্দ প্রতিধ্বনিত হয়। রহিমন প্রলেপ দেওয়ার বৃথা চেষ্টা করে, ‘দুক্কু কোরু না যাদুর বাপ, দেকু একদিন সপ ঠিক হয়ি যাবে।’
ওই একদিনটা যে কবে আসবে, জমির আলী আজও তা বুঝতে পারে না। ছোটবেলায় মা’র কাছে নতুন জামার আবদার করলে বলতো, ‘কান্দিসনি বুড়ু–একদিন তোর ম্যালা জামা হবে, সেদিন আর কুনু দুঃক্কু থাকপে না।’
অভাবের সংসারে বাবা শোনাতো অন্য কথা,‘কুনুদিন অধয্যু হয়ুনা বাপ। সারাজীবন আর এরাম দুঃক্কু থাকপে না; একদিন ঠিক সুকির মুক দেকবা।’
জমির আলী আজ অনেক বড়, দাড়ি-গোঁফে পাক ধরেছে। তবু ঐ দিনটা তার জীবনে কোনদিন আসেনি।
উপরন্তু একটার পর একটা ভাঙনের গল্প।
সংসারটা যখন গুছিয়ে উঠবে ঠিক তখনই দুর্ঘটনায় একটা পা হারালো। বিজলীর হৃদয় ছিল পলিমাটির মতো কোমল অথচ শহরের ইট, কাঠ, পাথরের ছোয়ায় সে এখন পাষাণ পৃথিবীর বাসিন্দা। বাবার মুখে চুনকালি মাখিয়ে একটা চোরের সাথে সংসার পেতেছে।
ইদানিং জমির আলী প্রায়ই স্বপ্নের ডানায় ভর করে রাধানগরের পথে ছুটে যায়, চেনাজানা স্থানসমূহ আতিপাতি করে ঘুরে বেড়ায়। রহিমনের উপস্থিতিতে স্বপ্নে ফাটল ধরলেও পুনরায় জমির আলী তা জোড়া লাগায়।
‘রহিমন।’
জমির আলী ঘোরের মধ্যে মাঝে-মাঝে স্ত্রীর নাম ধরে ডাকে। রহিমন উৎগ্রীব হয়ে সাড়া নেয়, ‘কিচু কবা নাকি?’
‘হ, কচ্চি, আমাক একদিন ওকেনে নিয়ি যাবা।’
‘কনে, শওরে যাওয়ার কতা বুলছু?’
‘না না, রাধানগরের কতা কচ্চি। খুব যাতি মন বোলে গো।’
রহিমন আপত্তি করে, ‘কিন্তুক, ক্যান যাবা ওকেনে, কী আচে সেকেনে? কিচ্চুনি। খালি-খালি কষ্ট পাবা; চোকের জলে বুক ভাসাবা।’
তিন.
দুর্ঘটনা কবলিত পা যেদিন কেটে ফেলেছিল, জমির আলী সেদিন খুব কেঁদেছিল; আকাশ-বাতাস কাঁপানো কান্না। তারপর আর কাঁদেনি। সব নিয়তি বলে মেনে নিয়েছে। কিন্তু এই মুহূর্তে হারানো পা’র কথা বার-বার মনে পড়ে, তার অভাব অনুভূত হয়। কারণ তার গন্তব্য আজ ভাটির পথে, পদ্মার চরে; শৈশব আর কৈশোরের স্মৃতি জড়ানো রাধানগর অভিমুখে লাঠি ভর দিয়ে হাঁটতে কষ্ট হয়; কিছুতেই পথ এগোয় না। সক্ষমতা থাকলে এতক্ষণে বাতাসের বুক চিরে ভৌঁ-দৌড় দিত।
চরের সর্বত্র চৈত্রের আগুনমুখো রোদ। জমির আলীর শরীর বেয়ে দরদর করে ঘাম ঝরতে শুরু করে। তবু ক্লান্তি নেই। মাথার টুপি খুলে মুখের ঘাম মোছে। চলার পথে কখনো বা বাতাসের বুকে কান পাতে। সফরসঙ্গী রহমত মিয়াকে চোখের ইশারায় জিজ্ঞেস করে, ‘কিচু বুজতি পাচ্চু রহমত ভাই?’
রহমত আগে-পিছে তাকায় কিন্তু তেমন কিছু দৃষ্টিগোচর হয় না। জমির আলী তখন বুক ফুলিয়ে হাসে আর বলে, ‘কেরাম করি বুজবারে ভাই; তুমরা হলি উজানের মানুষ, ভাটির খবর কেরাম করি বুজবা! ভালো করি খিয়াল করি দেকো,পদ্মার মিষ্টি হাওয়া আসচে। আহা, কি চমেটকার হাওয়ারে ভাই, পিরাণ জুড়ি যায় যিনি!’
নদীর বুক-জুড়ে শুধু ধু-ধু চর। রহমত মনে-মনে অবাক হয়। কোথাও রাধানগরের চিহ্ন পর্যন্ত নেই। বুকের মধ্যে একরাশ শূন্যতা। তীব্র হাহাকার। জল না থাকলে নদীর সৌন্দর্য কোথায়! যাদুর মতো পদ্মাও আজ লোলা। তপ্ত ধুলার ওপর জমির আলী দিক-বিদিক পায়চারী করে। হতাশাময় দৃষ্টিতে চর্তুদিকে তাকায়। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের খোজে বেচারা বোধ হয় অস্থির। উত্তর-দক্ষিণে সোজা এগিয়ে যায়। হাতের লাঠি দিয়ে মাটির ওপর আয়তাকার রেখা টানে। রহমত তাকে জিজ্ঞেস করে, ‘এডি আপনি কী কচ্চেন ভাই, পাগোল হয়ি গ্যালেন না কি?’
পাগল না হলেও শরীরের দৈন্যতায় জমির আলী ক্লান্ত। শ্বাস-প্রশ্বাসের গতিবেগ দ্রুত ওঠানামা করে। পেটের মধ্যে চিনচিনে ব্যথা। তথাপি সুস্থির থাকতে পারে না; অস্থিরচিত্তে বলে, ‘একেনে, ঠিক একেনে আমাগের ঘর ছিলুরে ভাই; দখিন দুয়োরী আটচালা কড়কা টিনির ঘর। আরেট্টু আগি যায়ি পচ্চিমে ছিলু বিরাট বড় এট্টা জুমারঘর। শুক্কুরবারে কতো মানুষ যে ছিন্নি খাতি জড়ো হতু! এক জুম্মারদিন মেজবান করি আমা বিজলীর মুকি পেত্তম ভাত দিছালাম।’
রাধানগর নামে যে এখানে একটি গ্রাম ছিল; হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী গ্রাম- শুনতে অবিশ্বাস্য মনে হয়। সময়ের ব্যবধানে কত অমিল! স্মৃতির টুকরো-টুকরো মেঘমালা ক্রমশ ঘণীভূত হতে শুরু করে। চোখের ওপর একের পর এক দৃশ্যপট জীবন্ত হয়ে ওঠে। কুয়াশার নৌকো বেয়ে নামে ছলাৎ-ছলাৎ জলতরঙ্গ।
দক্ষিণের রাস্তাটি ঠিক আগের মতোই প্রশস্ত; একটুও বদলায়নি। কতদিনের চেনা রাস্তা! গোধূলীক্ষণে ধুলা উড়িয়ে গরুর-পাল নিয়ে জমিররা ঘরে ফিরতো। হাতে থাকতো কয়েক গোছা ছোলা কিংবা মটরশুটি। বাড়ন্ত খেসারি-ক্ষেতে কতদিন বন্ধুদের নিয়ে হারিয়ে যেত; লুকোচুরি খেলতো। পরিপক্ক খেসারির সিদ্ধ ফলের স্বাদ যেন এখনো মুখে লেগে আছে!
জমির আলীর বাবা ছিল খুবই ব্যস্তসমস্ত মানুষ। সন্ধ্যা নামতে না নামতেই ডিঙি নৌকো নিয়ে পদ্মার বুকে নেমে যেত। তার জালে গেঁথে থাকতো হরেকপদের সব মাছ। পূর্ণিমা রাতে কিছুতেই ঘুম আসতো না। কেষ্টদের পূজোমণ্ডপে চলতো দীর্ঘ আড্ডা। নবদ্দি’র কণ্ঠে ধ্বনিত হতো রামায়ণের মধুর স্বর। কারবালা কিংবা সীতা-কাহিনি শুনে বৌঝিরা ফুপিয়েফুপিয়ে কাঁদতো, কেউবা শাড়ির আঁচলে মুখ লুকাতো।
অনেকদিন-বাদে দাদাজানের মুখটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। অবিকল সেই আগের মতো! লাঠিহাতে যেন গাছের গুঁড়ির ওপর বসে আছে। অবয়বজুড়ে পরিতৃপ্তির ঢেঁকুর। বাবার চোখ ফাঁকি দিয়ে জমির আলী প্রায়ই ভর দুপুরে বেরিয়ে পড়তো। বন্ধুদের সাথে ডাংগুলি খেলা, হাত-পা ছুঁড়ে নদীতে সাতার কাটা, হোগলার-ঝোপে কাউনের ডিম তালাশ, আরো কত কি!
বাড়ি ফিরলে বাবা গলা চড়িয়ে গালমন্দ করতো। কিন্তু দাদাজান তখন বাধা দিত, ‘শমসের, উক তুই বকচিস ক্যান; এই বয়াসি খেলা না কল্লি করবে ককুন? ছোটকালে তুই নিজিউ খুব খেলিচিস। আমাক কি কম জ্বালাতিস তকুন!’
এরপর বাবার মুখে আর কথা ফুটতো না।
আজ মনে হয়, দাদাজান ছিল মাথার ওপর বটবৃক্ষের ছায়া। পূজা-পার্বণ কিংবা মেলা উপলক্ষে হাজারটা বায়না ধরতো; অথচ কোনদিন মুখকালি করেনি, বিরক্ত হয়নি। পরম আদরে জমির আলীর গলা জড়িয়ে ধরে বলতো,‘দাদুরে, মরি গ্যালি তুই আমার লাশ টানবি, ভালো করি দাপন দিবি, রোজ-রোজ কব্বরের কাচে দাঁড়ি থাকবি; ক, পারবিনি?’
শুধু দাদাজান না, জমির আলীর কাঁধে বাবা-মাসহ আরো অনেকের লাশের বোঝা। অথচ ওইসব লাশের কোনো চিহ্ন আজ আর অবিশিষ্ট নেই; পদ্মার বুকে হারিয়ে গেছে।
প্রকৃতিতে ঘণায়মান অন্ধকার। জমির আলী হেঁটে-হেঁটে ক্লান্ত। বুকের মধ্যে যন্ত্রণার উথাল-পাথাল ঢেউ। প্রার্থনার ভঙ্গিতে মাটির ওপর হাটুগেড়ে বসে। এই মাটিতেই তার নাড়ি-পোঁতা! মনের ওপর নিয়ন্ত্রণ-ক্ষমতা ক্রমেই হারিয়ে ফেলে। নিজের মধ্যে লুকিয়ে থাকা শিশুমন আড়মোড়া দিয়ে জেগে ওঠে। ধুলার উপর গড়াগড়ি খায়। বুক চাপড়ে বিলাপ করে, ‘বাবা, ও বাবা তুমরা সব কনে আচো; আমাগের কতা কি ভুলি গিউছ? এ জীবন আর ভাল্লাগে না, বাঁচতি মন চায় না, ওপরে তুলি নেও।
জমির আলীর করুন আহাজারিতে রহমত মিয়ার অন্তরে তোলপাড় শুরু হয়; একটু-একটু করে মনের রুক্ষতা কেটে গিয়ে পলিবর্তী হয়ে ওঠে; অসহায় ঐ মানুষটির কান্না তার নিজের মধ্যে গভীরভাবে রেখাপাত করে। বয়ষ্ক পুরুষ যে এভাবে কাঁদতে পারে, জমির আলীকে না দেখলে কিছুতেই তা বিশ্বাস হওয়ার না।