৩০ বছরের সংসারের বিশ্বাস, ভরসার ভিত আজ নড়ে গেছে। না, শুধু নড়ে যায়নি; ভেঙে গুঁড়িয়ে গেছে। হঠাৎ করে আসা কোনো কালবৈশাখী ঝড়ে সবটা মিশে গেছে মাটিতে।
পুরনো পলেস্তারা খসেপড়া দোতলা বাড়ির নিচতলার সবচেয়ে বড় ঘরটা বসার ঘর হিসেবে ব্যবহৃত হয়। পুরনো ২ সেট সোফা এত বড় ঘরটাকে যতটা না মানানসই ভাব ধরে রাখার চেষ্টা করেছে, ১৪ ইঞ্চি পুরনো সাদাকালো টিভিটা ততটাই বেমানান। কতগুলো মানিপ্লান্ট, অপরাজিতার সবুজ সতেজ ডগা আর নীল সাদা অপরাজিতা, জুঁই প্রমাণ দেয়, এ বাড়ির মানুষের ফুলের প্রতি ভালোবাসা কতটা। বাড়ির কর্ত্রী সুমাইয়া হক একটা কলেজের অফিস সহকারী হিসেবে কাজ করেন। ফুলের প্রতি এই মারাত্মক ঝোঁক তারই।
রঙ উঠে যাওয়া দোতলার পুরনো বেলকনিজুড়ে ফুলের মেলা। তাতে নানা রঙের প্রজাপতি উড়ে বেড়ায়। আর সেই প্রজাপতির পাখার রঙ-সুমাইয়া হকের মনেও রঙ ছড়ায়। হাসি ছড়িয়ে পড়ে তার মন থেকে চেহারায় ও প্রভাব পড়ে তার জীবনেও। সুমাইয়ার ভালো থাকার অন্যরকম কারণ এই ফুল।
কিন্তু আজ এই ফুলের দিকে তাকানোর ইচ্ছে বা মন কোনোটাই তার নেই। সুমাইয়া যে সোফায় বসে প্লাস্টার ওঠা মেঝের দিকে তাকিয়ে জীবনের হিসাব মেলানোর চেষ্টা করছে,সেই সোফার পাশেই নীল,সাদা অপরাজিতা এক মোহনীয় জগৎ সৃষ্টি করে আছে। সুমাইয়া এই মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করেছিল। অথচ আজ কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই তার এসবে। তার দৃষ্টি মেঝের দিকে। তার জীবনটা যে ভেঙেচুরে গেছে। যে সংসারকে নিজ হাতে সাজানোর এত চেষ্টা, পরিশ্রম; তার পুরোটাই মিথ্যা আর প্রতারণার চাদরে মোড়ানো।
কবরের নীরবতা ভেঙে প্রথমে কথা বলে উঠলো সুমাইয়ার বড় ভাই আশরাফ মিয়া। মনে হলো আদিম কোনো গুহার ভেতর থেকে ভেসে আসছে কথাগুলো। সে কথা সুমাইয়ার কাছ পর্যন্ত পৌঁছানোর আগেই মিলিয়ে যাচ্ছে বাতাসের গায়ে।
-তুমি কি মানুষ? তোমারে ফেরেশতার মতো মনে করছি আমরা। সেই মানুষ ভেতরে ভেতরে এই নোংরা চেহারা লুকাইয়া রাখছো ৩০টা বছর! এই বয়সে এসব নিয়া কথা কইতেও তো শরম লাগে। ছিঃ ছিঃ আমারই তো শরমে মইরা যাইতে ইচ্ছা করতাছে। বিয়া করতে চাইলে করো। তোমারে তো কেউ মানা করে নাই। আমার বোনরে ভালো না লাগলে পরিষ্কার কইরা কইতে পারতা। কিন্তু তুমি ভালো মানুষ সাইজা এই করতেছিলা এতদিন! এইসব নোংরামি কইরা পার পাবা? মরা লাগবো না? না কি তুমি মরবা না?
কথাগুলো সুমাইয়া হকের স্বামী লাভলু হকের উদ্দেশে বলছে আশরাফ মিয়া। ঘরের মেঝেতে মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে আছে লাভলু। কোনো কথার উত্তর নেই তার। মনে হচ্ছে সে কিছুই জানে না এসবের।
বসার ঘরে সুমাইয়া, লাভলু ,আশরাফ মিয়া ছাড়াও আরও একজন রয়েছে। সুমাইয়া ও লাভলুর ৫ বছরের ছেলে স্বাধীন, দত্তক নেওয়া ছেলে। সে খেলছে আপন মনে। মাঝে মাঝে মায়ের কাছে এসে বলছে, মা, ক্ষুধা লাগছে। কিন্তু সুমাইয়ার কানে যেন কিছুই যাচ্ছে না। ভূমিকম্প বা বোমা বিস্ফোরণ ও যেন তাকে ফিরিয়ে আনতে পারবে না সেই দৃশ্য থেকে। তার চোখের সামনে এখন তারই বন্ধুসম,বোনের মতো পাশের বাড়ির সাবিনার ফর্সা নগ্ন শরীর আর সেই শরীরের প্রতি ভাঁজে ভাঁজে ৩০ বছরের বিশ্বাস, ভরসা, নির্ভরতার মগ্ন হয়ে বিচরণ করার দৃশ্য।
দুই.
ভালোবেসে বিয়ে করেছিল লাভলু আর সুমাইয়া। তাদের প্রেমটাও সিনেমার মত করে শুরু হয়েছিল। সুমাইয়া তখন বিএ দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। গোপালগঞ্জে মধুমতী নদীর পাড়ে বিয়ে হয় বড় বোনের। সুমাইয়ার বেশির ভাগ সময় কাটতো বড় বোনের বাড়িতে। বড় বোনের দুই মেয়েকে নিয়েই সারাদিন হুল্লোড় করতে ভালোবাসতো সুমাইয়া। মধুমতী নদীটা সুমাইয়াকে নেশার মতো টানতো। বেশি ভালো লাগতো নদীর পাড়ের হিজল গাছটাকে। যখন ফুল হতো হিজলের গাছে সুমাইয়া কিছুতেই বাড়ির ভেতরে যেতে ইচ্ছে করতো না। মাদুর পেতে হিজল তলায় বসে গল্প করতো। কখনো কখনো চুপচাপ নদীর দিকে তাকিয়ে থাকতো,আর হিজল ফুলের ঘ্রাণে হারিয়ে যেত যেন কোন অজানায়। পাড়ার মেয়েদের সঙ্গে দলবেঁধে সাঁতার কাটা, ঘুরে বেড়ালেও সুমাইয়া লেখাপড়ায় ছিল ভীষণ ভালো। রেজাল্ট ও কলেজের সেরা করতো সে।
এই মধুমতী-ই মিলিয়ে দিয়েছিল ওদের। লাভলু বন্ধুদের নিয়ে গোসল করতে আসতো। সে সুমাইয়ার বোনের চাচাতো দেবর। এম.এ পাস করে চাকরির চেষ্টা করছে তখন।
সুদর্শন লাভলুকে দেখে প্রেমে পড়েছিল সুমাইয়া। চমৎকার গান গাইতো লাভলু তখন। প্রথম চিঠিটা অবশ্য লাভলুই পাঠিয়েছিল। শুরু হয় চিঠির আদান-প্রাদান। ওদের সবচেয়ে পছন্দের উপহার ছিল গানের ক্যাসেট উপহার দেওয়া। মনির খান, এন্ড্রু কিশোর, ডলি সায়ন্তিনী,বেবি নাজনিন, কনকচাঁপার নতুন কোনো ক্যাসেট এলেই কে কার আগে উপহার দেবে, তা নিয়ে প্রতিযোগিতা চলতো। গানের কথাই যেন নিজেদের কথা ছিল তখন। চলতো গান শুনতে শুনতে অন্য সব কাজ। দুজনের এই সম্পর্ক গ্রামে জানাজানি হতে সময় লাগেনি। বেঁকে বসেছিল দুই পরিবারের সবাই। লাভলুর বাবা মায়ের কথা, এমন সুন্দর ছেলের জন্য অমন খাটো কালো মাইয়া আমরা জীবনেও আনবো না।
লাভলুর বাবা-মা সারাক্ষণ বলেছে, ছেলেকে বিয়ে দেওয়ার কথা। সুমাইয়া খুব শান্তভাবে বলেছে লাভলু চাইলে বিয়ে করতে পারে। তার কোনো আপত্তি নেই। স্বাধীনকে নিয়ে সে ভালো থাকতে পারবে। কিন্তু লাভলু রাজি হয়নি কিছুতেই।
এদিকে সুমাইয়ার পরিবারের কথা ছিল, এক মেয়ে দিয়েই জীবন শেষ, ওই গোষ্ঠীর ছেলের কাছে আর কোনো মেয়ে দেবো না, দরকার পড়লে ভাতে বিষ দিয়া মাইরা ফালাবো মাইয়া।
সুমাইয়া আর লাভলু সালমান শাহর স্বপ্নের পৃথিবী দেখতে দেখতেই সিনেমা হলে বসেই সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয় তারা আর বাড়ি ফিরবে না।
তিন.
আজ সুমাইয়ার সামনে কেউ একজন এক এক করে সকল পর্দা উন্মোচন করছে যেন অতীতের। কী স্বপ্ন ছিল দু চোখে। লাভলু তখন গ্রাম্য ডাক্তার হিসেব বাজারে দোকান নিয়েছে। দুই বাড়ি থেকেই তাদের মেনে নেওয়া হয়েছে ততদিনে। সুমাইয়া পড়ালেখা শেষ করে কলেজের অফিস সহকারীর চাকরিটা পেয়েছে। নতুন নতুন ফোন এসেছে তখন। কলরেট ছিল মিনিটে ৭ টাকা। তবু কাজের ফাঁকে তিন চারবেলা করে ফোন করা, খোঁজ নেওয়া চলতো।
অথচ আজ প্রায় ৫ বছর ধরে দুজনর ফোনে কোনো কথায় হয় না বলতে গেলে। সংসারে কিছু প্রয়োজন শুধু এই কথার জন্যই ফোনের ব্যবহার হয় দুজনের মধ্যে। ধীরে ধীরে খুবই যত্নে দূরত্ব তৈরি গেছে দুজনের মাঝে।
তাদের সম্পর্কে প্রথম ফাটল ধরে এমনি কোনো এক বর্ষাকালের মেঘলা দিনে। সুমাইয়া দোতলার বেলকনিতে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখছিল। বৃষ্টির পানি জবা, গোলাপ, বেলি, কাঠগোলাপের পাপড়িগুলোকে যত্ন করে কিভাবে ভিজিয়ে দিচ্ছিল, তা দেখেই আনন্দে ভাসছিল সুমাইয়া। রাতে হালকা ঝগড়া হয়েছিল লাভলুর সঙ্গে। তবে বৃষ্টি, ফুল, রবীন্দ্রনাথের গান মন খারাপের মেঘগুলোকে উড়িয়ে দিয়ে হালকা তুলোর মতো করে দিয়েছিল। তার শরীরে আরেকটা প্রাণের সঞ্চার হয়েছে। মন খারাপ করে থাকার দিন শেষ। লাভলু চাইছিল না এখনই সন্তান নিতে। মাত্র বিয়ে হয়েছে। দুই-এক বছর ঘুরে বেড়ানোর পর বাচ্চা নেওয়ার ইচ্ছে লাভলুর। এই নিয়েই রাতে কথা কাটাকাটি। সুমাইয়া ভেবেছিল এটা সাময়িক। সব ঠিক হয়ে যাবে।
হয়েছিল ও তাই। হাতে ফুলের তোড়া, সুমাইয়ার পছন্দের বিরিয়ানির প্যাকেট নিয়ে ঘরে ঢুকেছিল লাভলু। চমৎকার সেই রাতের সৌন্দর্য বিষাদে রূপান্তরিত হয়েছিল সুমাইয়ার আর্তনাদে। পছন্দের বিরিয়ানি খাওয়ার পরে শরীরের দুর্ববলতা কমানোর ওষুধ খাইয়েছিল লাভলু। সেটা ছিল ভ্রূণ নষ্ট করার ওষুধ। সুমাইয়াকে বুঝিয়ে লাভ নেই, এটা বুঝতে পেরেই এই বাঁকা পথটা বেছে নিতে তার গ্রাম্য ডাক্তারের সব বিদ্যের প্রতিফলন ঘটিয়েছিল লাভলু।
সেই দিন থেকে সম্পর্কের স্নিগ্ধতা, মাধুর্যতা হারিয়ে গিয়েছিল সুমাইয়ার জীবন থেকে। তবুও সেদিন সেই সম্পর্ক ছিন্ন করে যেতে পারেনি। মেয়েরা তো এমনি বোকার মতো ভালোবেসে যায় সারাজীবন। আর সেই ভালোবাসার মায়ায় পড়ে জীবনভর নিজের সঙ্গেই যুদ্ধ করে চলে আর অন্যায়ের সঙ্গে আপস করে। আর ভাবে একদিন সব হয়তো ঠিক হয়ে যাবে।
এরপরের অধ্যায়টা আরও কঠিন ছিল সুমাইয়ার জীবনের। প্রথম সন্তান নষ্ট হওয়ায় মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছিল ঠিকই। কিন্তু তার জীবনে প্রতিদিন মৃত্যু যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়েছিল। ডাক্তার, ফকির, কবিরাজ যে যেখানে বলেছে, সেখানেই ছুটেছে একটা সন্তানের আাশায়। সবচেয়ে অপছন্দের কাজ ছিল যা, সেই তাবিজও গলায় ঝুলিয়ে রেখেছে বছরের পর বছর। কোনো লাভ হয়নি। সন্তান ধারণ করার ক্ষমতা আর হয়নি তার। সন্তানের জন্য হাহাকার ছাপিয়ে সুমাইয়াকে যন্ত্রণা দিতো মানুষের কথা। মানুষ মুখের কথা দিয়ে এতটা আঘাত করতে পারে, এত ক্ষমতা মানুষের কথার জানতো না সুমাইয়া। অফিসে, প্রতিবেশীদের মুখে, গ্রামে, আত্মীয়, অনাত্মীয়, কোনো অনুষ্ঠানে; যেখানেই যাক সুমাইয়া, কথা বলার বিষয় সেই একই।
কেউ হয়তো সহানুভূতি দেখাতে গিয়ে বলে, আহারে একটা সন্তান হলো না তোমাদের!আমি বুঝি তোমার কষ্ট! কেউ বলে, সন্তান না থাকলে সে জীবনের আর কী দাম বলো? কারও কারও প্রশ্ন , সমস্যা কার? তোমার না তোমার জামাইয়ের? কেউ কেউ তো মুখের ওপর বন্ধ্যা বলতেও দুবার ভাবেনি কখনো। শাশুড়ি একদিন বলেই দিলো, তোর পাপের ফসল এটা। এত কিছু করেও একটা নাতিনের মুখ দেখাতে পারলি না। নিশ্চয়ই তোর কোনো পাপ আছে।
বেশি খারাপ লাগতো সুমাইয়ার যখন বুঝতে পারতো যে কোনো বিয়ে বা আনন্দ অনুষ্ঠানে তাকে দেখে অনেকের মুখ কালো হয়ে যেতো, তখন। এড়িয়ে যেতে চাইতো তাকে সবাই। কাজ করতে দেওয়া হতো না। একদিন এক ননদের বিয়ের গায়ে হলুদে গিয়েছিল লাল শাড়িতে লাল, হলুদ ফুল মাথায় গুঁজে। ননদের গায়ে হলুদ ছোঁয়াতে যাবে এমন সময় চাচি শাশুড়ি ডেকে বলেছিল, কিছু মনে করোনা মা, এই শুভ কাজে তোমার না থাকাই ভালো। মনটা কেমন খচ খচ করে।
সেদিনের পর আর কারও কোনো অনুষ্ঠানে যায়নি সুমাইয়া। নিজেকে আড়াল করে রেখেছে সব আনন্দ অনুষ্ঠান থেকে।
ধীরে ধীরে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে লাভলুও ভুলে যেতে থাকলো তার করা অন্যায়ের কথা। সে ও দোষারোপ শুরু করলো সুমাইয়া হককে। একটা বাচ্চা জন্ম দিতে না পারলে আর মেয়ে মানুষের কীদাম আছে?
চার.
সকল কিছুকে কাটিয়ে জীবন বয়ে বেড়াচ্ছিল সুমাইয়া। জীবন থেকে পালিয়ে কোনো লাভ নেই। জীবনে থেকেই তার মোকাবিলা করতে হবে। তাই অনেক বুঝিয়ে লাভলুকে রাজি করিয়ে স্বাধীনকে দত্তক এনেছিল ওরা। স্বাধীনকে আনার পরে সত্যি জীবন পাল্টে গেছিল ওদের। একটা বাচ্চা জীবনের রঙ বদলে দিতে পারে। আশ্চর্য এক ক্ষমতা আছে । সুন্দর জীবন কাটছিল সুমাইয়ার। মানুষের কথা বন্ধ হয়নি, লাভলুর অবহেলাও স্পষ্ট! তবু স্বাধীনের জন্যে জীবনের সব সুন্দর হয়ে ধরা দিচ্ছিল ওর কাছে। লাভলুর বাবা-মা সারাক্ষণ বলেছে, ছেলেকে বিয়ে দেওয়ার কথা। সুমাইয়া খুব শান্তভাবে বলেছে লাভলু চাইলে বিয়ে করতে পারে। তার কোনো আপত্তি নেই। স্বাধীনকে নিয়ে সে ভালো থাকতে পারবে। কিন্তু লাভলু রাজি হয়নি কিছুতেই।
সমস্যা হচ্ছিল সুমাইয়ার অসুস্থতা। দিনের পর দিন সে দুর্বল হয়ে যাচ্ছিল। কোনো ওষুধে কাজ করছিল না। সারাদিন ঝিমাচ্ছিল সুমাইয়া। বিকেল থেকেই সে ঘুমায়। সকালেও ডেকে তোলা কঠিন। এই অবস্থায় স্বাধীনকে দেখা, রান্নাকরার জন্য পাশের বাড়ির সাবিনাকে অনুরোধ করে রাখা হয়েছিল। সাবিনার কাছে কৃতজ্ঞ সে জন্য সুমাইয়া।
একই বাড়িতে থাকলেও তাদের ঘর আলাদা,খাবার আলাদা। সব মিলিয়ে আলাদা জগৎ হবে দুজনের। আসলে, লাভলু নামের কোনো মানুষের কোনোরকম গুরুত্ব তার জীবনে আর নেই।
কিন্তু এমন নির্মম সত্য তার জন্যে অপেক্ষা করছিল, সে ভাবতেও পারেনি। কিছুদিন থেকে নানাজনের নানারকম কথা কানে এলেও লাভলুকে বিশ্বাস করেছিল সে। আর যাই হোক এভাবে ঠকাতে পারে না তাকে সে। সে তো চলেই যেতে চেয়েছিল লাভলুর জীবন থেকে। কিন্তু লাভলু দেয়নি যেতে। সে এমন কাজ কী করতে পারে? অস্থিরতা কাজ করে সুমাইয়ার ভেতরে।
সেদিন সুমাইয়ার কাছে এসেছিল লাভলুর বন্ধু মিজান। তার স্ত্রীকেও নিজের ঘরে আসার প্রস্তাব দেয় লাভলু। আর বলে সুমাইয়াকে দিনের পর দিন ঘুমের ওষুধ দিয়ে অসুস্থ করে রাখার প্ল্যানটাও তার। রাতে সুমাইয়া কিছুই টের পায় না। এসব শুনে মিজানকে যাচ্ছেতাইভাবে কথা শুনিয়ে দিয়ে পাগলের মতো কাঁদতে থাকে সুমাইয়া। বিশ্বাস হয় না তার কিছুতেই। তবুও মিজানকে কথা শোনাতে ছাড়েনি সে।
তার সেই লাভলু দিনের পর দিনে তাকেই ঘুমের ওষুধ দিয়ে অসুস্থ করে রাখছে? কেন? সে তো চলে যেতে চেয়েছিল। তাহলে কেন? সবই কি তার নামে থাকা জমি আর ডিপোজিটের টাকার জন্য? নিজের সঙ্গেই যুদ্ধ চলতে থাকে সুমাইয়ার। সে পরপর কয়েকদিন লাভলুর দেওয়া ওষুধ না খেয়ে লুকিয়ে ফেলে দিতে থাকে। আর তারপরই নিজের চোখের সামনে লাভলুর রাতের চেহারাটা উন্মুক্ত হয় স্পষ্ট হয়ে। তারই বেডরুমের মেঝেতে রাতের পর রাত তাহলে এভাবেই উন্মুক্ত হয়েছে অনেকের শরীর? এভাবেই লাভলু মেতে উঠেছে নোংরা এই খেলায়!
সুমাইয়াকে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠেছিল লাভলু। বিশ্বাস করতে পারেনি। সুমাইয়া না ঘুমিয়ে কী করে দাঁড়িয়ে আছে চোখের সামনে!
না। সুমাইয়া কাউকে কিছুই বলেনি। সাবিনা নিজের শাড়িটা টেনে নিয়ে দৌড়ে পালিয়েছিল। আর লাভলু সারারাত ক্ষমা চেয়েছে। বলেছে, তুমি চলে গেলে সমাজে আমি ছোট হয়ে যাবো, আর ভুল হবে না। যা শাস্তি দিতে চাও দিতে পারো, শেষবারের মতো তুমি আমাকে মাফ করো। সুমাইয়া শুধু তার ভাইকে বলেছিল এসে নিয়ে যেতে তাকে।
পাঁচ.
ভাইয়ের সঙ্গে চলে যাওয়ার প্রস্তাবে শেষে নিজেই না করে দেয় সুমাইয়া। লাভলু মনে করে সুমাইয়া হয়তো তাকে মাফ করে দিয়েছে। আবার সব ঠিক হয়ে যাবে। পরদিন সকাল। অনেকক্ষণ ধরে শাওয়ার শেষ করে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে শাড়ি ঠিক করে নিলো সুমাইয়া। পার্পল রঙের শাড়ির সঙ্গে ম্যাচিং করে পার্পল টিপ কপালের মঝখানে পরতে পরতে গুনগুন করে গান গাইছে সুমাইয়া। যেন কিছুই হয়নি তার জীবনে। আজ সে সত্যিকারের ভারমুক্ত। কোথাও কোনো বন্ধন নেই, প্রত্যাশা নেই। সত্যি দারুণ অনুভূতি। ঠোঁটে লিপিস্টিক পরে নিলো চট করে। অনেকদিন পর আজ সাজলো সুমাইয়া। এর মধ্যেই তার বন্ধু ফারিহার ফোন।
কী রে হঠাৎ ডাকলি যে?
আজ সিনেমা দেখবো। দুই বান্ধবী মিলে বাইরে খাবো। সারাদিন ঘুরবো।
তুই ঠিক আছিস? সুস্থ আছিস এখন? লাভলুর এই জঘন্য অপরাধ ক্ষমা করে দিয়ে রয়ে গেলি তুই?
খুব ভালো আছি আমি। একটা প্রিয় জিনিস হারিয়ে যাওয়ার ভয়ে ভয়ে সারাক্ষণ কুঁকড়ে থাকতাম আমি। সেটা যখন চিরতরে হারিয়ে যায়,তখন আর হারানোর ভয় থাকে না। তাই সকল ভারমুক্ত হয়ে আমি আজ সত্যি ভালো আছি। জীবনকে নিজের মতো করে উপভোগ করতে হয়। নিজেকে ভালোবেসে সুন্দরভাবে বাঁচতে চাই বাকিটা জীবন। এসে কথা বলছি।
কথাগুলো বলেই ফোন কেটে দিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এল সুমাইয়া। কারও কাছে বলে যাওয়ার আর কোনো তাড়া নেই তার। সিঁড়ি বাঁধানো পুকুর পাড়ে জংলি পার্পল রঙের ফুল দেখতে পেয়ে খোঁপায় পরে নিলো সুমাইয়া। না সে বাবার বাড়ি চলে গিয়ে এই বয়সে লোক হাসাবে না। আর লাভলুকেও সুন্দর, মুক্ত জীবন দিয়ে সে বাবার বাড়ির বোঝা হতে পারবে না। জীবনের শুরুতে যেটা করার প্রয়োজন ছিল, সেটা এখন এই বয়সে করে কী হবে! তার চেয়ে এই বাড়িতে থেকেই লাভলুকে উপেক্ষা করে নিজের মতো করে বাঁচার সিদ্ধান্তই সঠিক বলে মনে হলো তার। একই বাড়িতে থাকলেও তাদের ঘর আলাদা,খাবার আলাদা। সব মিলিয়ে আলাদা জগৎ হবে দুজনের। আসলে, লাভলু নামের কোনো মানুষের কোনোরকম গুরুত্ব তার জীবনে আর নেই।