নূপুরের সঙ্গে দেখা হয় কুয়াশাঢাকা শীতের সকালে বিএম কলেজের ভেতরে, পুকুরপাড়ে। এ রকম কুয়াশা এ-শীতে আর হয়নি। সাড়ে এগারোটায়ও সূর্যের দেখা নেই, দিগন্ত অন্ধকারপ্রায়। চোখের সামনে যেন প্রকাণ্ড একখানা ঘষা কাচ ঝুলছে। দশ বছরের বন্ধুত্ব-প্রথম দেখা-জমে থাকা কথারা—এবারই প্রথম, কিন্তু সবই পাশ ফিরে দেখার মতোন লাগে। নূপুরই বলে কথাটি—যখন বসন্ত ছিল, বন্ধুর মুখটা দেখার বাসনা এবং ভাবনাগুলো সত্যি হয়ে ওঠার সম্ভাবনা ছিল, তখনই দেখা হলো না। কিন্তু আজ এতদিন পর, বরিশালে এলে তুমি? কেন এলে?
নূপুর ও আবিদের ফস করে পরিচয় হয়নি। সবুজ অঙ্গন থেকে ওরা একসঙ্গে বেরিয়েছিল। সবুজ অঙ্গন ঢাকার শ্যামপুর থেকে প্রকাশিত সাহিত্য পত্রিকা, যেখানে নবীনরাই প্রধান লেখক হিসেবে গণ্য হতো। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের গোড়ায় সেই কাগজে লেখার সূত্র ধরে নিয়মিত পত্র-বিনিময় হয়। এ সবের আড়ালে বন্ধুত্বও গড়ে ওঠে। বন্ধুত্বের সঙ্গে মুগ্ধতা ও অনুরাগ মিশে যেতে-যেতে একসময় ছন্দপতন ঘটে যোগাযোগে, তৃতীয় একজনের অনুপ্রবেশে। সেটা অন্য গল্প।
আবিদ বলে, তোমাকে দেখার বাসনাটুকু আমাকে নিয়ে এলো গো!
হেঁয়ালি রাখো তো?
ওকে, রেখে দিলাম। অফিসের কাজের ছলে বেড়াতে এলাম। কিন্তু ভাবনায় তুমিও ছিলে। যদি একটিবার দেখা হয়, এতটুকুন কথা বলার সুযোগ ঘটে! ভাগ্যিস তোমার ঠিকানাটা স্মৃতিতে ছিল…
দেখা না-হওয়াটাই সাভাবিক ছিল। বিয়ের পর, আমি তো বরিশালে থাকিই না।
জীবনের কিছু ব্যাপার অলৌকিকভাবেই ঘটে—বলে আবিদ। কলেজের লাল বিল্ডিংয়ের সামনে দিয়ে দুজন হেঁটে যায়, ধীর পায়ে।
নূপুর মিষ্টি করে হাসে, বলে, চিঠিতে পড়া সেই সরল রোমান্টিক মানুষটিই রয়ে গেছ তুমি! অথচ জীবন থেকে কতগুলো দিন চলে গেছে। তা কেমন লাগছে আমাদের বরিশাল শহর?
যে শহরে তুমি আছ, সেখানে দেখার জন্য আর কী লাগে বলো!
তাই, না?
সত্যি নিজেকে এখন এই মুহূর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষটি মনে হচ্ছে আমার। রিয়েলি আই অ্যাম হ্যাপি!
আচ্ছা! তোমার বউ আবার রাগ করবে না তো? শেষে না বাড়ি গিয়ে সমস্ত সুখ ফেঁসে যায় তোমার?
বউ? কুসুম জানে, আমি অত্যন্ত ভদ্রলোক। মিথ্যা বলি না এবং যথারীতি দায়িত্ববান।
কুসুম তোমার বউয়ের নাম? বেশ তো। দেখতে নিশ্চয়ই খুব সুন্দরী?
হুম, লোকে তো বলে সুন্দর।
নূপুর কেমন করে যেন তাকায়—আমার হিংসে হচ্ছে কিন্তু!
হিংসা? সে কী—তোমার হিংসে হবে কেন?
একটু থেমে, দূরে কোথাও তাকিয়ে নূপুর বলে, মেয়েদের ও রকম হয়। ও তুমি বুঝবে না।
বুঝব না? কেন? ওহ আচ্ছা!
হাঁটতে হাঁটতেই কলেজের সীমানা প্রাচীরের গায়ে লেখাগুলো চোখে পড়ে আবিদের— কুসুমকুমারী দাশ, অশ্বিনীকুমার দত্ত, জীবনানন্দ দাশের চিরকালীন কথা-বাণী ও কবিতার অংশ। এ সব দেখে বেশ ভালো লাগে।
নূপুর বলে, বরিশালে কদিন থাকবে?
আবিদ সে-কথা হয়তো কানে তোলে না। আপনমনে হাঁটতে থাকে। কলেজের ভেতরের সবুজাভ প্রকৃতি, শান্তু পুকুর, ছেলেমেয়েদের কলকাকলি—কেমন মুগ্ধতায় ডুবে থাকে। একসময় বলে, শোনো, আমি তোমাদের শহরটা ঘুরে দেখতে চাই। বিশেষ করে কবি জীবনানন্দ দাশের বাড়িটা। তোমার কিছু সময় হবে? জানো, জীবনানন্দ আমার কাছে একদম স্বপ্নের মতোন একটা চরিত্র—; আবিদ পাশ ফিরে দেখে নূপুর নেই। সে দাঁড়িয়ে পড়ে। বেশ দূরে একটা মেয়ের সঙ্গে কথা বলছে নূপুর।
পূর্বদিকে হেঁটে রাস্তা ফুরিয়ে এলে ধীর পায়ে কলেজের মূল ভবনের দিকে আসতে থাকে আবিদ। তখন হঠাৎই মনে হয় তার—এই ভবনের ভেতরে ও বাইরে, এই দৃশ্যমান পথের ওপর দিয়ে একদিন কবি জীবনানন্দ দাশ হেঁটেছেন, দাঁড়িয়ে ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে কথা বলেছেন; হয়তো আনমনে তাকিয়ে থেকেছেন খোলা আকাশ বা মাঠের দিকে। তখন একটা চিল বা শালিক উড়ে যাচ্ছে…।
পুকুরের পাশেই, জলের কিনারে ধবধবে সাদা একটা হাঁস তার স্বরে ডেকে ওঠে। ডানা ঝাপটায়। এত সুন্দর, দীর্ঘদেহী এবং চমৎকার হাঁস দেখাই যায় না। একবার হাত বাড়িয়ে ছুঁতে ইচ্ছে হয় আবিদের। নূপুর তখনও বান্ধবীর সঙ্গে আলাপে মগ্ন, আবিদ ধীর পায়ে হাঁসটির সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। হাঁসটি কেমন অদ্ভুতভাবে মুখ তুলে তাকায়, কিন্তু ছুটে পালায় না। আবিদ হাত বাড়িয়ে দেয় স্পর্শ করার লোভে। তখনই, ডানচোখে কি যে পড়ে—পোকা না কি? আবিদের চোখমুখ কেমন অন্ধকার হয়ে আসে। হাতের উল্টোপিঠে চোখ ডলতে ডলতে সে সাভাবিক হয়, প্রথমে ঝাপসা দেখে হাঁসটি নেই। কোথাও দেখা যায় না। আশ্চর্য তো! রুমাল দিয়ে ভালো করে চোখ মোছে আবিদ। ক্যাম্পাসের ছেলেমেয়ের সাভাবিক চলাফেরা, সশব্দে বা নিঃশব্দে হেঁটে যাওয়া। নূপুরের কাছে যেতে পা বাড়ায় আবিদ। ঠিক এমন সময় দেখে ওঠে লোকটিকে—অবিকল তার মতো দেখতে। আবিদ এগিয়ে যায়, কাছে গিয়ে চোখ থেকে চশমাটা খোলে এবং অত্যন্ত সূক্ষ্মচোখে দেখতে থাকে লোকটিকে…
২
নূপুরের সঙ্গে ক্যাম্পাস ছেড়ে বেরিয়ে আসে আবিদ। কলেজ রোড ধরে হাঁটতে থাকে। রিকশা নেয়। একসময় তীর্থে পৌঁছেও যায়—ধানসিঁড়ি: পশ্চিম বগুড়া রোড, বরিশাল।
প্রিয় মানুষ বা কাঙ্ক্ষিত বস্তুটিকে বহু প্রতীক্ষার পর দেখে উঠলে যে অনুভূতি হয়, বুকের ভেতরটা কেমন করে ওঠে, ভাবনারা এলোমেলো হয়ে যেতে থাকে, নিজের ভেতর তেমন একটা ধাক্কা টের পায় আবিদ। ধানসিঁড়ি বাড়িটির গেটের কাছে এসে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে ওরা। বাড়ির ভেতরটাও ঘুরে আসে। বাড়ির ভেতরের আঙিনা-ঘর-পরিপার্শ্ব আগের মতো নেই, থাকার কথাও নয়। কিন্তু শতবর্ষী দুটি থাম সময়ের সাক্ষী হয়ে সটান দাঁড়িয়ে আছে। দুটো স্ন্যাপ তোলে আবিদ।
নূপুর প্রথমে রাজি হয় না, পরে সাঁয় দেয়। ধানসিঁড়ির সামনে দাঁড়িয়ে দুটো ছবি তোলা হয়। আরও কিছু ছবিও তোলে আবিদ মুঠোফোনের ক্যামেরায়। নূপুর পাশে দাঁড়িয়ে শুধু মিটমিট করে হাসতে থাকে। ছবি তোলা চলছে। কিন্তু কুয়াশায় ছবিগুলো বিষণ্ন দেখায়। হঠাৎ কোত্থেকে পাঞ্জাবি পরিহিত একজন লোক এসে দাঁড়ায় ক্যামেরার ফ্রেমের ঠিক মাঝখানে। ভারি বিপদ হলো তো! লোকটা দাঁড়ানোতে দেয়ালের গায়ে লেখা ‘ধানসিঁড়ি’ ভালো করে দেখা যাচ্ছে না।
ভাই, একটু সরেন তো —
বলতে গিয়েও থেমে যায় আবিদ, ভীষণ থতমত খায়। আরে, এতো সেই লোকটিই—হাঁসকে ছুঁতে গিয়ে হঠাৎ তাঁর দেখা পেয়েও পায়নি সে। অবিকল জীবনানন্দ দাশের মতোন দেখতে? গম্ভীর বলিষ্ঠ শরীর এবং আত্মনিমগ্ন!
ক্যামেরা বন্ধ করে লোকটির মুখোমুখি দাঁড়ায় আবিদ। আর একবার চমকায় সে। তিনিই তো! এবং তখন তার স্মৃতিতে ভেসে ওঠে আবদুল মান্নান সৈয়দের কবিতার কিছু চরণ—‘জীবনানন্দকে মাঝে মাঝে দেখি রাস্তায়; বলিষ্ঠ শরীর, আধ-ময়লা পাঞ্জাবি, আধ-ময়লা ধুতি, হাঁটুর নিচ অব্দি লেগে রয়েছে, পায়ে অস্পষ্ট স্যান্ডেল…’
সৈয়দের বর্ণনার সঙ্গে আবিদের দেখে ওঠা প্রায় মিলে যায়, সবটুকুই।
এমন অকল্পনীয়ভাবে ইতিহাসের নায়ককে সমুখে পেয়ে দিশেহারা বোধ করে আবিদ।
সাপ যেমন নিঃশব্দে হেঁটে চলে, আবিদও তখন কিছু বুঝে-ওঠার আগেই তিনি হাঁটতে থাকেন নাক বরাবর, অক্সফোর্ড মিশনের দিকে। আবিদ একবার নূপুরের দিকে এগোতে গিয়েও দাঁড়ায়। আবারও সে পরিচিত কোনো মহিলাকে পেয়ে ভীষণ আলাপে সে ডুবে গেছে। সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে, কিংবা ‘তোমার সঙ্গে পরে দেখা হবে বরং’— ভেবে নিয়ে জীবনানন্দের হেঁটে-যাওয়া পথকে অনুস্মরণ করে আবিদ।
সেলিব্রিটি এবং প্রিয় তারকাকে সামনে পেলে মুগ্ধতার আতিশয্যে কথা যেমন গুলিয়ে যায়, আবিদেরও তাই ঘটে। তবু, জীবনানন্দের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে নিজের পরিচয় দিয়ে কৌতূহলোদ্দিপক নানারকম কথা বলে যায় সে।
জীবনানন্দ ও আবিদের মাঝে বিস্তর ব্যবধান—বয়সের, যুগের, পারিপার্শ্বিকেরও। কিন্তু তবু, কিছু সময় পর, আবিদকে হন্টনের সহযোগী হিসেবেই তিনি ধরেন বলে মনে হয়।
লাল গীর্জার পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে একটু থামেন জীবনানন্দ। স্মিত হেসে ওঠেন… কিন্তু বরিশালে কেন?
আবিদ মাথা চুলকায়। এমন সরল প্রশ্নটিও জটিল ঠেকে। সে পাশ কাটায়—না, এমনিতেই। বেড়াতে আসা আর কি!
জীবনানন্দ মৃদু হেসে আড়চোখে একবার আবিদকে দেখেন। বলেন, নদীবর্তী এই দূরের শহরে কেবল বেড়াতেই এলে তুমি? তা বেশ।
আবিদ এবার বলে ফেলে তার ভেতরের কথাটুকু। মানুষ কতরকম জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা অর্জন করে জীবনে, আর জগতও জয় করে ফেরে। কিন্তু অনেক সময় নিজেকেও যে মানুষ কত কম জানে, সেটি বেশ লজ্জকরই। কোথাও একটা দুর্বোধ্য অস্থিরতা কাজ করে চলে আমার ভেতরে। আমি নিজেও যে সবটুকু জানি, তা নয়। কিন্তু টের পাই। এই অস্থিরতা কিসের জন্য, খুঁজে পাই না। তেমন অভাব নেই, অসুখও নয়; কোনো দুঃখ নেই আমার। তবু। অফিসে, কিংবা বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে দিতে হঠাৎ একঘেয়ে বা একা হয়ে যাওয়াটা দপ করে জ্বলে ওঠে। কাজ আছে বলে পালিয়ে যাই। কাজও আসলে কিছু থাকে না…
মানুষ নিজের সঙ্গেই কেবল একা নয়, ভিড়ের মধ্যেও—কোলাহল এবং কথার আলো-আঁধারিতেও একা হয়ে যায়। এ-এক আশ্চর্য নিয়তি!
আপনার ছোটবোন সুচরিতার লেখায় পড়েছিলাম, কলকাতায় প্রথমদিকে খুব সমস্যা হতো আপনার; বরিশালের মতোন এমন শান্ত স্নিগ্ধ শহর ছেড়ে গিয়ে। শহর কিভাবে শান্ত কিংবা স্নিগ্ধ হয়? শহুরে জীবন যদিও মনোরম, এখানে মনোটনাসও কম নয়। আর শহর তো চিরকালই জনবহুল, কোলাহলপূর্ণ, একঘেয়ে! কিন্তু…
এবার জীবনানন্দ কৌতূহলে পাশ ফেরেন। আবিদকে দেখেন, উৎকর্ণ হন।
কিন্তু বরিশালে যখন এলাম, টের পেলাম, দিদি একবিন্দু মিথ্যে বলেননি। এখানে শহরের ভেতরে এত পুকুর, গাছপালা। নদীবেষ্টিত শহর…
জীবনানন্দ হাঁটতে হাঁটতে সদর রোডে ওঠেন। শুক্রবার বলে রাস্তা কিছুটা নির্জন। তখনো চারপাশে ঘনকুয়াশা। বিডিএস পেরিয়ে রাস্তার সঙ্গে লাগোয়া পুরনো ব্রাহ্মসমাজ ভবন। জীবনানন্দ এখানে এসে একটু দাঁড়ান। শতাব্দী পেরুনো ভবনটির দেয়ালে হাত রেখে কী যেন বলেন, বোঝা যায় না। শতায়ু মানুষের অবয়বে যে শ্রী হয়, স্থাপনাটির তেমন দশা এখন। অবহেলিত। পরিত্যক্ত। এখান থেকে একসময় সমাজ-ব্যক্তিমানস-গঠনের সৌরভ বিলি হতো।
ব্রাহ্মসমাজ পেছনে ফেলে তিনি হেঁটে চলেন, সঙ্গে আবিদও। চলতে চলতে নানা কথা হয়। একটি কথা আরেকটি কথার সূত্র তৈরি করে। আবিদ একটা ঘোরের ভেতর ঢুকে পড়ে—আপনি ভালো কবিতা আবৃত্তি করতেন?
মৃদু হেসে তিনি আকাশের দিকে তাকালেন।
আপনার উচ্চারণ ছিল সুন্দর। স্বর ছিল মেঘের মতোন…
জীবনানন্দ বললেন, মেঘের মতো?
হ্যাঁ। আপনার মেয়ে মঞ্জুশ্রী তো এমনটিই বলেছিল। আপনি তাকে কালিদাসের মেঘদূত আবৃত্তি করে শুনিয়েছিলেন।
যদিও খুব কম কথা বলতেন আপনি। জীবনের এত যে রূঢ় রোদ, অভিঘাত, বিপন্নতা—এসব আপনার কবিতায় এসেছে। কিন্তু আপনার যাপিত জীবনে তেমন প্রকাশই পায়নি!
ঢের সময় পর, তিনি শুধু বললেন, তা বটে।
হাঁটতে হাঁটতে একটা পুকুরের সামনে এসে দাঁড়ালেন জীবনানন্দ। পুকুরঘেঁষা মাচানে লাউয়ের ডগা, অদূরে বড় দালান, সামনে দিয়ে পায়ে চলার ছোটরাস্তা।… পুকুরটা একসময় বেশ বড় ছিল। ওপারে দাদাঠাকুর টিনের বাড়ি করে থাকতেন। বিক্রমপুর থেকে বরিশালে এসে বাবা, তার বাবা এখানেই ঠায় গাড়েন। এখন সেসব গল্প। রূপকথা। তুমি কী যেন বলছিলে?
আপনি মানুষ হিসেবে ভয়াবহ নিঃশব্দ। বেশি কথা যদি দূষণীয় হয়, কম কথাও তাই। নয়?
হা হা করে হেসে ওঠেন জীবনানন্দ—কেন এমন মনে হলো তোমার?
১৯৫৩-তে কবি শামসুর রাহমান গিয়েছিলেন আপনার কলকাতার ল্যান্সডাউন রোডের বাসায়, আপনি এত সংকুচিত আর মৃদু থাকলেন—তিনি কিন্তু লজ্জাই পেয়েছিলেন। আবার, আপনি রবীন্দ্র পুরস্কার পেলেন নগদ ১০১ টাকা এবং কিছু ফল, চাদর। তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া ছিল না আপনার…
ওটাই আমার জীবনের একমাত্র পুরস্কার!
আপনি সেই পুরস্কারের ছোটখাটো জিনিসসমেত ডালাটি নিঃশব্দে খাটের নিচে রাখলেন। দেখতে পেয়ে মঞ্জুশ্রী শুধালো, এ সব কী বাবা? আপনি বললেন, ওই আর কি!
পুকুর ছেড়ে সরে এলেন জীবনানন্দ।
জীবনবাবু, একটা কথা খোলাসা করুন তো, অন্তর্নিহিত এমন কী কারণ ছিল যে, আপনি এত অজস্র গল্প উপন্যাস লিখলেন, কিন্তু জীবদ্দশায় একটাও প্রকাশ করলেন না?
তাঁর ঠোঁটে চাপা কিংবা বাঁকা হাসি; আমার কবিতারই যেখানে স্বীকৃতি জোটেনি, গল্প-উপন্যাস প্রকাশ করে কী লাভ? … তবে টাকার প্রয়োজনে পূর্বাশা-সম্পাদক সঞ্জয় ভট্টাচার্যকে উপন্যাস দেওয়ার কথা জানিয়েছিলাম। শর্ত ছিল বেনামে ছাপতে হবে।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটুকুও হয়ে ওঠেনি?
এ-কথার বিপরীতে জীবনানন্দ এমন উত্তর করলেন, আবিদ হকচকিয়ে যায়, ঢোক গেলে এবং প্রায় হা করে তাকিয়ে থাকে।
… আমাদের দেশে কবিতার অর্ধশিক্ষিত অশিক্ষিত পাঠক হৃদয়হীনভাবে বেশি, কবিতা পাঠ যে মানুষের জীবনের কোনো অন্তরঙ্গ অনুধ্যানের মতো সমূহ অসঙ্গতির ওপর আলোকপাত করে আনন্দ দান করতে পারে, সেই বোধশক্তির অভাব। আমাদের জীবনে সময়ের অভাব, স্বচ্ছলতার অভাব।
আবিদ টের পায়, আলাপ জটিল হয়ে পড়ছে। সে অন্য প্রসঙ্গ পাড়ে—
এই যে এত গল্প-উপন্যাস-অগণন কবিতারাশি রেখে গেলেন; কিন্তু, নতুন একটি কবিতা কেউ চেয়ে পাঠালে, আপনি চিঠি লিখতেন—নানাকারণে অত্যন্ত বিব্রত আছি। কবিতা এখন হাতে কিছুই প্রায় নেই; লিখে উঠতে পারলে নিশ্চয়ই দেব। কিন্তু ট্রাম দুর্ঘটনার পর, শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়ার ফাঁকে টুক করে পালিয়ে গেলেন। দেখা গেল— অজস্র কবিতা-গল্প-উপন্যাস আর নানান রচনাসম্ভার…
জীবনানন্দ পাশে থেকেও অন্য কোথাও, এমন ভঙ্গিতে চিলের সৌখিন উড়ে যাওয়া দেখেন, ঘাস দেখেন, শালিক পাখি দেখে মুগ্ধ হয়ে দাঁড়ান। আরও কতকিছু দেখেন, হয়তো দেখেনও না। আবিদের জিজ্ঞাসার উত্তর মেলে না। তিনি হয়তো কিছুই শোনেননি।
দেখো—; নিজের চরিত্রে কিছু ব্যাপার এত নিবিড়ভাবে মিশে থাকে ব্যাখ্যা করা শক্ত। লেখাজোকা নিয়ে এত বিব্রতকর অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে আমাকে যেতে হয়েছে, কল্লোল যুগে কিছু সম্পাদক— এমনকি বন্ধুদের কেউ কেউ আমার কবিতা ফেরত পাঠিয়েছে। আর শনিবারের চিঠির বিষোদগার তো ছিলই!
কালীবাড়ি রোডে এসে জীবনানন্দ একটু থামেন। একটা বৈশিষ্ট্যহীন দোকানের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকেন। আবিদ সাইনবোর্ড দেখে— আদর্শ প্রেস।
কী-এক বিষণ্ন চেতনায় আচ্ছন্ন ছিলেন জীবনানন্দ। এবার নির্ভার হেসে ওঠেন… এটি সেই আদর্শ প্রেস। আমার একখানা কবিতার বই বেরুবার বন্দোবস্ত হয়েছিল। তখন বরিশাল একটা সামান্য জেলা শহরমাত্র। কবি হিসেবে আমিও কিছুই নই…
আবার ধীরপায়ে হাঁটতে থাকেন জীবনানন্দ। আবিদ কিছু বলার জন্য হাত কচলায়।
চাপা হেসে জীবনানন্দ বলেন, কিছু বলবে?
দাদা, বনলতা সেন কে ছিলেন? টুকরো বা দলছুট কৌতূহল বা জিজ্ঞাসাই নয়, আপনার লেখকজীবনে এবং ব্যক্তিগত জীবনেও, তিনি আছেন বলে ঠাহর হয়?
জীবনানন্দ পাশ ফিরে তাকিয়ে এমনভাবে হাসলেন— ‘ও এই কথা’ ধরনের অভিব্যক্তি ফুটে উঠল।
একবার লাবণ্য বৌদি তো আপনাকে চেপেই ধরেছিল—বনলতা মেয়েটা কে বলতেই হবে? কিন্তু, আমরা এই ভেবে বিস্মিত হই যে, একটা জাতি বা সাহিত্য-সংস্কৃতির ওপরে কবির শক্তি-প্রভাব কত ব্যাপক হতে পারে—এখনও মানুষ নাটোরে গিয়ে বনলতা সেনের বাড়ি খুঁজে ফেরে। আপনার জীবিতাবস্থায়, বনলতা সেন নামের একজন মারা গেছেন বলে আনন্দবাজার পত্রিকায় খবরও বেরিয়েছিল। আপনি সেই খবর পড়ে অত্যন্ত দুঃখও পেয়েছিলেন?
একটা দীর্ঘশ্বাস কি আড়াল করলেন জীবনানন্দ? টের পায় না আবিদ। তিনি মৃদুভাবে বলেন, কেউ একজন থাকে শিল্পীর জীবনে; হৃদয়-ভাবনাকুঞ্জকে অধিকার করে রাখে। সৃষ্টিশীল কাজে প্রেরণাটুকু দরকারিও; আশ্রয়ের মতোন। বনলতা সেন তেমনই একজন!
হাঁটতে হাঁটতে ধীর পায়ে থেমে গেলেন জীবনানন্দ। পথের পাশেই পুকুর। পুকুরের গভীর জলে তিনি চোখ রাখেন, পুকুরঘেঁষা বহুতল বাড়ির আকর্ষণ, বাড়ির কোলঘেঁষে সামান্য পথ-গাছপালা— তিনি কিছু খোঁজেন।
কী আছে এখানে? কেন তিনি হঠাৎ থেমে গেলেন?
সময় দ্রুত গড়িয়ে যেতে থাকে।
জীবনানন্দ কথা বলে ওঠেন— এই হচ্ছে রাখাল বাবুর পুকুর!
রহস্যের দরজা পটাপট খুলে যায়। জীবনানন্দের কবিতায় যতটা, তারচেয়ে ডায়েরিতে, রাখাল বাবুর পুকুরের কথা পাওয়া যায়। বিকালের মুখে তিনি এখানে হাঁটতে আসতেন। বাবুর মেয়েকে একটু দেখার বা কথা বলার আকাক্সক্ষায় আসা-যাওয়া করতেন। মেয়েটি তাঁর জীবনে ধরা দিয়েছিল?
সে-প্রসঙ্গে আর কথা হয় না। জীবনানন্দ পুকুরপাড় ছেড়ে হেঁটে চলেন। ক্লান্তিহীন।
এবার তিনি বজ্রমোহন বিদ্যালয়ের সামনে এসে দাঁড়ালেন। আর্তচোখে প্রাচীন ভবনের গায়ে হাত রেখে নির্ণিমেষ তাকিয়ে থাকেন। …এখানে আমি প্রথম স্কুলে ভর্তি হয়েছিলাম। বাবা এখানেই শিক্ষকতা করতেন। আমার মানসগঠনে তিনজন মানুষের ঋণ কখনো ফুরোবার নয়— সত্যানন্দ দাশ, কুসুমকুমারী দাশ এবং স্কুলের প্রধান শিক্ষক জগদীশ মুখোপাধ্যায়…
স্কুলের সম্মুখভাগ থেকে ডানদিকে সরে এলেন তিনি। সামনে বিস্তৃত সবুজ ঘাস; ঘাস এত সবুজও হয়!
মহিনের ঘোড়াগুলি কবিতাখানি এই এখানেই পেয়েছিলাম, আনমনে বলে ওঠেন জীবনানন্দ।
বিএম কলেজের পুকুরপাড়ে এসে চমকে ওঠেন তিনি— ‘জীবনানন্দ চত্বর’ দেখে। ১৯১৭ সালে তিনি এখান থেকে আইএ পাস করেছিলেন। দূরে কোথাও চোখ রেখে নিজের মধ্যে ফিরে আসেন। কলেজের লাল বিল্ডিংয়ের সামনে দিয়ে মাঠ পেরিয়ে হেঁটে চলেন, পেছনে আবিদও। একতলা টিনশেড ছাত্রাবাসের সামনে দাঁড়িয়ে পড়েন। ‘কবি জীবনানন্দ হল’ লেখা দেখে আবিদের কাঁধে হাত রাখেন জীবনানন্দ। তাঁর চোখে আনন্দের ঝিলিক খেলে যায়। —একবার ভেতরে যাবে নাকি হে?
মোক্ষম কথাটুকু এবার পাড়ে আবিদ—দাদা, এমন কথাও চাউর আছে যে, ১৪ অক্টোবর ১৯৫৪, বিকালবেলা হাঁটতে বেরিয়ে, সন্ধ্যায় আপনি যখন ঘরে ফিরছিলেন কলকাতার রাসবিহারী এভিনিউ হয়ে, ট্রামের নিচে পড়ে গেলেন। পরদিন পত্রিকায় ছাপা হলো, ট্রামের নিচে পড়ে গুরুতর আহত হয়েছেন কবি জীবনানন্দ দাশ। কিন্তু এসবের মধ্যদিয়েই এ কথাও বেরিয়ে পড়েছে—আপনি নাকি আত্মহত্যা করেছেন?
হাঁটার গতি থামিয়ে স্মিত হাসলেন জীবনানন্দ। আবিদ বলে, চুপ থাকলে চলবে না দাদা, আপনি কি সত্যি আত্মহত্যা করেছিলেন?
শীতকালের বেলা সস্তা মোমবাতির ন্যায় দ্রুত ফুরিয়ে আসছিল। শিশিরের শব্দের মতোন আকাশের সিঁড়ি বেয়ে বিকালেই সন্ধ্যা নেমে আসে। জীবনানন্দের চোখের আকাশ-মাটি-ভ্রমণ শেষ হলে একটা দীর্ঘশ্বাস হয়তো আড়াল করেন। আবিদের কাঁধে হাত রাখেন— চলো, ওঠা যাক!
দাদা, ব্যক্তিগত জীবনে তো বটেই, কর্মজীবনে আর শিল্পী হিসেবেও আপনি অত্যন্ত আটপৌরে, নিরীহ ও লাজুক ম্যাড়মেড়ে জীবনযাপন করে গেলেন; এমনকি স্ত্রীর সঙ্গেও। এ নিয়ে কখনো দুঃখ বা গ্লানি হয়নি আপনার?
অত্যন্ত নির্মোহভাবে হেসে ওঠেন তিনি। বলেন—দেখো, প্রত্যেক প্রকৃত শিল্পীই বিদ্রোহী। বিদ্রোহ শুধু সাহিত্যের পুরনো রচনারীতির সঙ্গে নয়, সমাজের ও জাতির অন্ধকার ও কলঙ্কের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। আবার অনেক শিল্পী আছেন—তারা খুব উঁচু দরের শিল্পী নন—যাঁরা বিদ্রোহের জন্যই বিদ্রোহ করেন শুধু।
হঠাৎ বামচোখে কিছু-একটা পড়ে আবিদের। পোকা, কিংবা খড়কুটো। অস্বস্তি নিয়ে সে চোখ কচলায়। তখনই প্যান্টের পকেটে মুঠোফোনটা বেজে ওঠে তার। এক্সকিউজ মি, বলে সে ফোন রিসিভ করে কিছুটা আড়ালে যায়। দ্রুত কথা শেষ করে আগের জায়গায় ফিরে আসে। নেই। জীবনানন্দকে আর পায় না সে। দূরে মাঠের মধ্যে কিছু ছেলেমেয়ে বসে গল্প করছে। কিন্তু কোথাও তাঁর মতোন কাউকে সে দেখতে পায় না। জীবনানন্দের প্রতিবিম্ব, তাঁর ফেলে যাওয়া হাওয়া বা পথের চিহ্ন নেই। গন্ধটুকুও নয়। আকাশের সিঁড়ি বেয়ে সন্ধ্যা নামে। আদৌতে কুয়াশা। বিকেল তখনও ফুরায়নি। শীতের ভয়াবহ কুয়াশায় বিকালেই সন্ধ্যার আবেশ ছড়িয়ে পড়েছে।
৩.
দুপুরের মুখে যে-জায়গাটিতে দাঁড়িয়ে ছবি তোলার ফাঁকে কথা হচ্ছিল নূপুরের সঙ্গে, আবিদ যখন সেখানে ফিরে এলো, মেঘ ঠেলে সূর্য উঁকি দিয়েছে। গাছপালা, পথের মানুষ-গাড়ি-বাড়ি হেসে ওঠে আলোর ঝলকানিতে। দুপুরটা বিকেলের দিকে সামান্য হেলে পড়েছে।
কোত্থেকে খুব দ্রুত পায়ে নূপুর কাছে আসে। বলে, সরি, দেরি হয়ে গেল। কিছু মনে করো না প্লিজ!
আবিদ অবাক— বলে কী মেয়ে! একসঙ্গে দাঁড়িয়ে ছিল, হঠাৎ উধাও হয়ে গেল আবিদ নিজেই। ফিরে এলো প্রায় দুপুর গড়িয়ে।
তাহলে? এইটুকু সময়ের ভেতর এতকিছু কীভাবে ঘটে গেল?
নূপুর বলে, চলো, তোমাকে লাঞ্চ করাব। আজ বাসায় অনেক মেহমান। আম্মা অসুস্থ তো। তোমাকে একটা সুন্দর জায়গায় নিয়ে যাই!
আবিদ মাথা নেড়ে সায় দেয়। ধানসিঁড়িকে পেছনে ফেলে নূপুরের সমান্তরালে হাঁটতে শুরু করে। কিন্তু দ্বিধা ও ভাবালু বিস্ময় তার চোখেমুখে লেপ্টে থাকে। ঘোর তৈরি হয়। কিছুতেই সেই ঘোর কাটে না!