আগে খেয়ালই হতো না। এখন কেন যে বারবার চোখ যায়। চেয়ে থাকতে ইচ্ছে করে এক দৃষ্টিতে। হাঁটার তালে অথবা যেকোনোভাবে নড়ে ওঠার দমকে শিহরিত হয় বুকের দু’পাশ। দেখতে দেখতে আচমকা বুকের ভেতর ছলাৎ করে ওঠে। মুখে রক্ত এসে যায়। দু’বাহু অজান্তে গুটিয়ে আসে বুকের দিকে। শিরশির করে ওঠে সারা গা। হৃৎপিণ্ডের ধুঁকপুকানি বেড়ে যায়। চোখের দৃষ্টি স্থির হয়। নিবদ্ধ হয় কোথাও। কোথায়? বোঝা যায় না। বুঝতে গেলে অচিন আকাশ। অজানা সমুদ্দুর। পাশের বাড়ির মাধুভাইয়ের কেমন কেমন চোখ। ভয়। তবু যেন ভালোলাগাও।
দাদির মরচেধরা তোরঙ্গ থেকে আধপুরনো শাড়ি বের হয়। আধময়লা ডুমা খসে পড়ে। শরীরের ভোল পাল্টে যায়। একদিনে বেড়ে যায় এক বিঘত।
কিন্তু দশহাতি শাড়ি সামলানো দায়। বারবার জড়িয়ে যায় পায়ের সঙ্গে। আঁচল লুটোয় মাটিতে। এলোমেলো হয়ে যায়। পেট, পিঠ আর বুক ঢেকে মাথায় ঘোমটার মতো করে জড়ালে দম বন্ধ হয়ে আসে। শেষমেষ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কোমরে পেঁচিয়ে আঁচলের মাথা গুঁজে দিতে হয়। কোমর থেকে নিচের দিকে আজাব আজাব লাগে। তবু পেট-পিঠের স্বস্তি। রঙচঙে ব্লাউজ লেপ্টে থাকে বুকের সঙ্গে। বুকের দু’পাশ ফোলা ফোলা। ভাঁপা পিঠের মতো। যাহ্!
এদিক-ওদিক তাকায় তাড়াতাড়ি। জড়সড়ো ভঙ্গি। ফিক করে হেসে ফেলে তারপর। ছোট্ট একটা থাপ্পড় লাগায় একপাশের ফোলা জায়গায়—ব্যাদ্দপ, শরম লাগে না?
কোমরে প্যাঁচানো আঁচল খুলে নেয় আবার। বুকে পিঠে জড়িয়ে নেয় ভালো করে। পাশের ঝোপের দিকে এগিয়ে যায়—আয় আয় কুর কুর।
মুরগিটার দেখা নেই সকাল থেকে। ছ’টা ছানা নিয়ে কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। ঘাসের পাতা, ফুল, বীচি আর পোকামাকড় খাচ্ছে টুক টুক করে। চিঅঁক চিঅঁক করে ছানাগুলো চরে বেড়ায় মায়ের সঙ্গে। মায়ের দেখাদেখি ঘাসপাতা খুঁটে খায়। ছোট ছোট পা দিয়ে মাটি আঁচড়ে পোকামাকড় বের করে। আচমকা আহ্লাদে লাফিয়ে উঠে মায়ের পিঠে চড়ে বসে। ছোট ছোট ঠোঁটে মায়ের পালক খুঁটতে থাকে কুন কুন করে। মুরগিটা বড্ড ভালো। ঘরে-দোরে উৎপাত করে না। হেগে টেগে বরবাদ করে না।
কিন্তু নিশ্চিন্ত থাকার জো নেই। বেজী আর গুইসাপের বেজায় উপদ্রব। এদিক ওদিক চোখ ফেরানো যায় না। টুক করে মুখে তুলে নিয়ে দেবে দৌড়। ঝোপের ভেতর একদম গর্তে গিয়ে সেঁধোবে। খালের পাড়ে পাটখেতের কাছে শেয়াল আর বনবেড়ালের আস্তানা। দিনের বেলায়ও বেরিয়ে আসে মাঝে-মধ্যে। বাড়ির আশে পাশে ঘুর-ঘুর করে। কুকুরের চোখ বাঁচিয়ে চলে। সুযোগ পেলে খপ করে ধরে নেবে একটা।
ছানাঅলা মুরগিটা বীজের। এটার মায়ের মা, তারও মা নাকি ছিল প্রথম কেনা মুরগি। বংশানুক্রমিক আছে একটার পর আরেকটা। এটা এবারই ছানা ফুটিয়েছে। আটটার মধ্যে ছটা আছে। তিনটা ফকফকে শাদা। তিনটা মিশেল। শাদা তিনটা ‘রাতা’ হবে মনে হয়। নাও হতে পারে। দাদি বলে, হবে। হলে…যাহ্! ভারি লজ্জা লাগে। দাদি যে কী! সকাল বেলা মুরগিটাকে চাল খাওয়ানোর সময় কেমন বাজে একটা কথা বললো! বলে কি না, তোর বিয়ার সমে জবে করমু রাতা অইলে, বুইজ্জছ? ধুর, মরার বুড়ি!
আয় আয় কুর কুর কুর—কাছে পিঠে কোথাও নেই মুরগিটা। ঝোপঝাড়ের আড়ালেও নেই মনে হয়। থাকলে ডাক শুনতো আর সাড়া দিতো কঁক কঁক করে। ছানারা চেঁচাতো চিঅঁক চিঅঁক করে।
খালপাড়ের দিকে গেলো নাকি? সর্বনাশ! খালপাড়ে শেয়ালের আড্ডা। গোসাপের রাজত্ব। ওপরে চিলের টহলদারি। আল্লাই জানে আছে কিনা? নাকি! কুর কুর কুর।
দুই.
-এই ফির ফির, শালার গরু! কঁডে যাছ, ফির!
দামড়াটা বড্ড বেতাল। এক জায়গায় থির হয়ে ঘাস খাবে না। একবার এখানে, আরেকবার ওখানে। বকলেও শুনবে না। ছিপ দেখালে ঘাড় বেঁকিয়ে দাঁড়াবে। লড়াই করবে যেন। ক’ঘা পড়লে তারপর সিধে। গাইদুটো ভালো। একমনে ঘাস খেয়ে যায়। লতাপাতা ছিঁড়ে খায় দাঁতে আটকিয়ে। কানদুটো আর লেজ নাড়াবে এক নাগাড়ে। ভোঁস করে নাক ঝাড়বে। মশা-মাছি তাড়াবে নাকের ওপর থেকে। বাচ্চা দুটো হাঁটবে মায়ের পিছু পিছু। ঘাস খাবে না। মাকে জ্বালাবে। দু’পায়ের ফাঁক দিয়ে মুখ ঢুকিয়ে দেবে। ওলানে গুঁতো দেবে দুধ খাওয়ার জন্যে। গাইদুটো পা আছড়ে বিরক্তি প্রকাশ করে। মাঝে মাঝে ঘাড় ফিরিয়ে ভোঁতা শিঙে গুঁতিয়ে শাসন করতে যায়।
দামড়াটার লাজ-শরম নেই। খাওয়া ফেলে গাইদুটোর পেছনে ছোঁক ছোঁক করে। ওপরের মোটা আর চওড়া ঠোঁট উল্টে গন্ধ শোঁকে। তারপর ঘাড় ফিরিয়ে নিজের পেটের তলায় চাটতে থাকে। সঙ্গে সঙ্গে দেয় মুতে। গাইগুলোর সামনেই। গাইদুটো ফিরেও দেখে না। যেন এসব কিছুই না। দুনিয়াতে শুধু মানুষদেরই যত লুকোচুরি। লজ্জা, শরম, ভয়। ধুশশালার!
দামড়াটার তলপেট চাটা দেখতে দেখতে শরীরে শিহরণ খেলে যায়। চারপাশের চামড়ায়, চামড়ার ভেতরে মাংসে স্পর্শকাতরতা। তরল আগ্নেয় প্রদাহ সারা প্রদেশে। আচমকা দামড়াটা সামনের দু’পা তুলে লাফিয়ে উঠতে যায় একটা গাইয়ের ওপর। গাইটা সরে যায় আস্তে করে।
পাটখেতের এদিকটায় খোলামেলা নির্জনতা। মরা খালে পানি নেই। হালকা ঝোপঝাড়ে ঢাকা দু’পাড়। দূরে, মাঠের ধানখেতে মানুষের আবছা অবয়ব। সূর্য উঠে এসেছে মাথার ওপর। পাটখেতের ভেতরে আলো-ছায়ার কারচুপি। অল্প অল্প বাতাসে দুলছে পাটের পাতা, ঝোপঝাড়ের আগা। ধানের জমিতে মাঝে মাঝে ঢেউ খেলে যাচ্ছে নদীর মতো। পাটপাতা আর ঝোপঝাড়ের ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে আকাশ। নীল। মাঝে মাঝে শাদা-কালো মেঘের হালকা প্রলেপ। ঠিক মাথার ওপরে চিল উড়ছে একমনে।
দুই উরুর সন্ধিস্থলে তীব্র প্রদাহ। শরীরের সমস্ত রক্ত এসে জমা হয়েছে যেন। টগবগ করে ফুটছে প্রবল উত্তাপে। দামড়াটা আবার লাফিয়ে ওঠে। গাইটা নারাজ। হুড়মুড় করে সরে যায় একপাশে। বাছুর দুটো ভয় পেয়ে ছোটাছুটি শুরু করে দেয়। পছন্দ হচ্ছে না তাদের এ ধরনের উৎপাত।
—ধুশশালার গাই! সতী অইয়ছ, না? পলাছ কিয়েল্লাই?
উত্তেজনায় চোখের মণিদুটো ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চায়। ঘন নিঃশ্বাস শোঁ শোঁ ঝড়ের বেগে নাকের ছিদ্রপথে ঢুকে পড়ে। পর মুহূর্তে নাসারন্ধ্র ফাটিয়ে সশব্দে বেরিয়ে আসে। বুকের ভেতর পাঁচ শ’ হাতুড়ির ঘা।
—খাড়া শালার গাই।
খালের পাড়ে আম আর কড়ুই গাছ। একটা গাছের সঙ্গে ঠেসে বাঁধা পড়ে গাইটা। ভড়কে যায়। ষড়যন্ত্রটা আঁচ করতে পারে যেন। টানাটানি শুরু করে দেয় গলা ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্যে। কিন্তু শক্ত দড়ি। ছিঁড়বে না।
বড় বড় ড্যাবডেবে অবোধ চোখ মেলে তাকাচ্ছে গাইটা। এ কী বিপদ! এ কেমনতর কথা? এমন ব্যাপারের সঙ্গে আদৌ পরিচয় নেই তার। ভোঁস ভোঁস নিঃশ্বাস ছাড়ে দড়ি ছিঁড়তে না-পেরে। মুখ নেই, তাই নাক দিয়ে প্রবল প্রতিবাদের ফোঁসফোঁসানি ছাড়ে যেন।
দামড়াটা স্থির চোখে চেয়ে দেখে। বুঝতে পারে যেন আয়োজনটা তারই জন্যে। ধীরে সুস্থে এগিয়ে আসে। গাইয়ের কাছে এসে একবার পরিস্থিতিটা আঁচ করে নিতে চায়। গাইয়ের পাছা থেকে গন্ধ শোঁকে। ওপরের ঠোঁট উল্টে দাঁত দেখায়।
উত্তেজনায় চোখদুটো লাফিয়ে পড়তে চায় কোটর ছেড়ে। কপাল কুঞ্চিত। ঠোঁট শুকিয়ে চড় চড় করছে। জিভ বেরিয়ে আসে আধেক। দু’হাতের প্রবল মুঠোয় দুই ঊরুর সন্ধিস্থল নিষ্পিষ্ট হচ্ছে। গলা থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসে অস্ফুট গোঙানি—এইবার…এইবার…শালার গাই!
তিন.
—আয় আয় কুর কুর কুর।
ঝিরঝিরে বাতাস এসে দুলিয়ে দিচ্ছে পাটগাছের আগা। ঝোপঝাড়ের পাতা কেঁপে উঠছে তির তির। খোলামেলা নির্জনতায় অস্ফুট শব্দ উঠল ফিস ফিস। পাটখেতের ওপাশ থেকে ভেসে আসছে—আয় আয়…কুর কুর কুর।
দামড়াটা ছোঁক ছোঁক করতে থাকে ঠোঁট উল্টে। গাইটা যেন ফোঁস ফোঁস প্রতিবাদে ফল না-পেয়ে ক্ষোভে ঘৃণায় থুতু ছিঁটে দেওয়ার মতোই শেষ পর্যন্ত মুতে দিলো শর শর করে। দামড়াটা এক বিঘত লম্বা জিভ বের করে ঠোঁট চাটছে। গাইয়ের মুতে দুই ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়েছে।
—আয় আয় কুর কুর।
পাটের পাতা ক্রমশ কেঁপে উঠছে। সরল রেখার মতো সে কাঁপন এগিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে, ওপাশ থেকে ভেসে আসা শব্দ লক্ষ করে। ওপাশের শব্দও এগিয়ে আসছে এদিকে, পাটখেতের প্রান্ত ঘেঁষে। শব্দ লক্ষ করে পাটপাতার কাঁপন তার গতি বদলাচ্ছে। সরল রেখা বেঁকে বেঁকে যাচ্ছে একদিকে।
—আয় আয় কুর কুর কুর।
একটানা ছন্দময় গীতিধর্মী সুরেলা শব্দ সমন্বয়।
—কুর কুর কুর।
নিস্তব্ধ দুপুর প্রকৃতির একান্ত সংলাপ।
—কুর কুর কুর।
নির্জনতায় উদাস করা মুরলীর টান।
—কুর কুর কুর।
মুগ্ধতার গহীন গোপনে ঝাঁজালো দুপুর রোদে লতাপাতার ছায়াশ্রয়ী নীল ভোমরার অস্ফুট গুঞ্জন।
—কুর কুর কুর…কুর কুর কুর…আয় আয় কুর কুর।
মাতাল শব্দগুঞ্জনে উন্মাতাল পাটপাতার কাঁপন পৌঁছে গেছে শব্দের কাছাকাছি।
—আয় কুর কুর…কুর কুর। মা…ম্বা—চাপা আর্তনাদ ভেসে আসে আমগাছের গোড়া থেকে। হুড়মুড় শব্দে পতনের শব্দ শোনা যায়।
শোঁ শোঁ করে আকাশ থেকে নেমে আসছে একটা চিল। তীব্র, করুণ, সূঁচালো একটা স্বর সে-চিলের কণ্ঠ চিরে বেরিয়ে আসে যেন। নিস্তব্ধ প্রকৃতি আর নিঃসীম আকাশের নীল শূন্য বুকে আমূল বিদ্ধ হয়। পাটক্ষেত থেকে পাখঝাপটা দিয়ে বেরিয়ে আসে একটা মুরগি। কঁক কঁক শব্দে গলা ফাটিয়ে চিৎকার জুড়ে দেয়। তার পেছনে ছটা ছানা চিঅঁক চিঅঁক করে ভয়ার্ত গলায় চেঁচায়।
কুর কুর কুর শব্দের একটানা মোহিনী সুরভঙ্গে যেন বেদনায় মুহ্যমান হয় নিঃসঙ্গ দুপুর প্রকৃতি। ঝিরি ঝিরি বাতাস থেমে গেছে কখন। স্তব্ধতায় ছেয়ে গেছে সারা পাটক্ষেত। শুধু এক জায়গায়, পাটক্ষেতের ঠিক মধ্যস্থলে প্রচণ্ড কাঁপন, প্রবল আলোড়ন। যেন স্তব্ধতার বেদনা সইতে না-পেরে ফেটে যাচ্ছে পাটক্ষেতের হৃদয়। অথবা ভয়ে!