সদ্য গ্রাম থেকে আসা দুরন্ত কিশোরদের জন্য এক বালতি পানিতে গোসল সেরে ওঠা কত কঠিন, তা ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন। এতে গা ভেজানো যায় বটে, গোসল হয় না। যে বয়সে সিল্কি চুল হাওয়ায় উড়িয়ে তারুণ্যের অহঙ্কার জানান দেওয়ার কথা, সে বয়সে আয়রনযুক্ত ঘোলাটে পানিতে চুলে জটলা লাগানোর মতো বিড়ম্বনা আর কীই বা হতে পারে?
১৯৯৫ সালের কথা বলছি। মাইজদী শহরের বকসী মিজির পুলের পাশে হোটেল সুরভিতে মেস করে থাকতাম আমরা। পাশে নোয়াখালী জিলা স্কুল। সুরভির ছাদ থেকে চোখে পড়তো স্কুলের শানবাঁধানো পুকুরঘাট। কাকচক্ষুর মতো টলমলে জল যেন হাত ইশারায় ডাকতো আমাদের। কিন্তু এ ইশারায় সাড়া দিতে হলে স্কুল বাউন্ডারি পার হতে হবে, যেখানে সর্বসাধারণের প্রবেশ একেবারেই নিষিদ্ধ। শেষে এন্ট্রান্স সুবিধা পেলাম পাচক তবারক মিয়ার বিশেষ কল্যাণে।
তবারক মিয়া স্কুল হোস্টেলের রন্ধনশালার সহকারী। আর আমাদের পার্টটাইম কুক। পুরো নাম তবারক উল্যা জমাদার। কিন্তু ছোট পদে চাকরি করায় ওই জমাদার টাইটেলটি বোধহয় আর টেকেনি, খরচ হয়ে গেছে। আমরা বলতাম, তবারক ভাই। স্কুলের দক্ষিণ পাশে একটা ছোট্ট পকেট গেট ছিল। আর এর একটি চাবি থাকতো আমাদের তবারক ভাইয়ের তত্ত্বাবধানে। ব্যস, করিডোর সুবিধা পেয়ে গেলাম। তবে এই সুবিধার বিনিময়ে যে কতিপয় অসুবিধাও হজম করতে হতো না, তা কিন্তু নয়। তবারক ভাইয়ের কাজকর্ম ছিল একেবারে দায়সারা। রান্নার কাজে সময় দিতেন খুবই কম। আলু, পটল, ঝিঙা রান্না করতেন খোসাসহ। বরবটির পোকামাকড় প্রায়ই বেছে বেছে খেতে হতো। কখনো কখনো চিংড়ির মধ্যে পাওয়া যেতো দুই-একটি আস্ত কাঁকড়াপোনা। বড্ড (একমাত্র স্নাতক পড়ুয়া বড় ভাই) আস্তে করে খাবার থেকে এসব অনাকাঙ্ক্ষিত বস্তু এমনভাবে ফেলে দিতেন, যেন এর উর্বর অংশটুকু বাকি খাবারে একেবারেই মেশেনি। কী আর করা? এত খাবার তো আর এমনি এমনি ফেলে দেওয়া যায় না! মেস ম্যানেজার বলে কথা। আর দু’শ গজ সাঁতরে আসা এই কিশোরদের পরিপাকতন্ত্রটিও তখন খাবারের জন্য এতটাই মুখিয়ে থাকতো যে, এসব কুকথায় কান দেওয়ার সময়ও হতো না।
খাবার প্রায়ই ঢাকনাহীন থাকতো। অ্যালুমিনিয়ামের এই ঢাকনাগুলোরও যে একটা বিশেষ কাজ আছে, তা তবারক ভাইকে বোঝানো অত সহজ ছিল না। সয়াবিনের বোতলে ছিপি লাগানো হতো না। ভেতরে তেলাপোকা পড়ে মরে থাকতো। না দেখেই ঢেলে দেওয়া হতো তরকারিতে। বেচারা তেলাপোকার জলীয় অংশটুকু খুব মিহি হয়ে মিশে যেতো ডালে। খালি ওই অদ্রবণীয় অংশটুকুন জমা পড়তো তলানিতে। প্রায়ই রুবেলের পাতে ধরা পড়তো। একটু হালকা পাতলা বলে ডালের তলানি পছন্দ করতো কিনা! সবার তখন ওয়াক ওয়াক অবস্থা।
এদিকে, সুরক্ষিত পুকুর ঘাটটিকে এক দারুণ আড্ডাখানায় পরিণত করে ফেললাম আমরা। সারাদিনের পড়ালেখার একঘেয়েমিকে ওই কাকচক্ষু জলে ভাসিয়ে দিয়ে একেবারে ফুরফুরে হয়ে ফিরে আসতাম মেসে। মনের মণিকোঠায় জমানো কথাগুলো একেবারে উগরে পড়তো ওই শানবাঁধানো ঘাটে। শিল্প-সাহিত্য-রাজনীতি-অর্থনীতি কী আলোচনায় আসতো না এখানে? কার মনের বাগানে কোন ভ্রমরের উঁকিঝুঁকি কিংবা কার কব্জিতে খোদায় করা কার নামের আদ্যক্ষর, এসব অতি রোমান্টিক বিষয়ও আলচ্যসূচি হতো এই সভায়।
ঘাটের অনতিদূরে একটি আধাপাকা ঘর। সম্ভবত নৈশপ্রহরীর জন্য একসময় তৈরি হয়েছিল। এখন পরিত্যক্ত। মধ্যবয়সী এক লোক থাকতেন সে ঘরে। কাঁচাপাকা চুলদাড়ি, জীর্ণশীর্ণ চেহারা, পরিধানে ছেঁড়া বস্ত্র। দেখে খানিকটা অপ্রকৃতিস্থ বলে মনে হত। কোনো এক কালবৈশাখী ঝড়ে নাকি প্রথম আশ্রয়। এরপর থেকে এটাই তার ঘর-বাড়ি। লোকটি বেশিরভাগ সময় ঘাটে বসে থাকত।বিকেলে নাকি চা দোকানের পানি টানতো প্রতি কলস দু’টাকা হারে। লোকটির হাতে সবসময় দু’টি গেঞ্জি দেখতাম। একটি ধুয়ে শুকাতে দিতো আর একটিতে বসে বসে কাচতে থাকত, যতক্ষণ না অন্যটি শুকাচ্ছে। তারপর শুকনোটা পরে ঘরে ফিরতো। এটা বেশ অনাকাঙ্ক্ষিত ছিল আমাদের জন্য। এই ঘরোয়া পরিবেশে লোকটিকে বড় বিরক্তিকর মনে হতো। এই কিশোর বয়সের আলোচনায় যত ডালপালা গজায়, তা অন্য একজন শুনে ফেলুক, এটা কে চায়?
শেষপর্যন্ত শাওনের পরামর্শে আমরা একটি কৌশল এঁটে ফেললাম। এখন থেকে পুকুর ঘাটের সব কথা হবে ইংরেজিতে, যেন পাগলটা কিছু বুঝতে না পারে। বেশ! আমাদের ইংরেজিচর্চা ভালোই চলতে লাগলো। বৈয়াকরণিক কিছু ভুলভাল হচ্ছে তো হোকনা, আমরা নিজেরা নিজেরাই তো! পাগলটা তো আর ইংরেজি বুঝবে না। দেখলেন, বুদ্ধি থাকলে ঠেকায় কে! পাগলটা গেঞ্জি কাচতো আর মাঝেমাঝে মুচকি হাসতো। তবে তার এ হাসি তেমন অর্থবহ বলে মনে হতো না আমাদের। কারণ, আমরা ভালো করেই জানতাম পাগলের হাসির অর্থ খোঁজা অর্থহীন!
সেদিন আলোচনা চলছিল সাহিত্য নিয়ে। একেবারে নির্ভেজাল সাহিত্য। ‘টুইংকেল টুইংকেল লিটল স্টার/হাউ আই ওয়ান্ডার হোয়াট ইউ আর’—লেখাটি কার, এই নিয়ে মতবিরোধ দেখা দেয় আমাদের মধ্যে। ইংরেজিতে ভর্তিচ্ছুক শাওনের মতে—এটি কিটসের। তার যুক্তি—কিটস প্রকৃতি নিয়ে বেশি লিখেছেন। তবে তার সম স্বপ্নবিলাসী রতনের ভিন্নমত। তার মতে, ওয়ার্ডস ওয়ার্থ ছাড়া আর কেউ লিখতেই পারে না। আমরা যারা এই বিষয়ে খুব একটা খবর রাখি না, তারা শ্রোতা মাত্র। তবে শ্রোতাদেরও একটা গুরুত্ব আছে, ভোটের গুরুত্ব। গণতন্ত্রে ভোট খুব গুরুত্বপূর্ণ কিনা! আর এ ভোট ব্যাংক হলো শাওনের। ক্লাসের ফার্স্টবয়রা সবসময় এ সুবিধা পেয়ে থাকে, আমাদেরই বা কী দোষ?
পাগালটা যথারীতি গেঞ্জি কাচছে আর স্বভাবসুলভ মুচকি হাসছে। হাসবেই তো, ইংরেজি না বুঝলে কী আর করা! আমরা যখন মোটামুটি এ সিদ্ধান্তে উপনীত হলাম যে, এটি কিটসের, ঠিক তখনই নির্বাক পাগলটা তার সবাক রূপ জানান দিলো। শুদ্ধ-স্পষ্ট উচ্চারণে বলে উঠলো—নো,নো, মাই ডিয়ার সানস, ইটস রিটেন বাই পি বি শেলি!