স্যার, আপাতত এই ঘরটাতে থাকেন, আপনার জন্য একটা ভালো বাড়ি খুঁজছি। পেলে চলে যাবেন। বলতে বলতে খুট শব্দ করে তালা খুললো মজিদ। দরোজার পাল্লা দুটো হা করতেই এক ধরনের বোটকা গন্ধ নাকে এসে লাগলো। মাজিদের পিছু-পিছু আমি ঘরের ভেতরে পা দিলাম। ছোট ঘরটি, সিমেন্টের মেঝে,পাশাপাশি দুটো খাটের একটিতে বিছানা পাতা।
এই বেডে বাদশা নামের একজন বোর্ডার থাকেন। জানালাটা খুলে দিতে দিতে পাশের খাটের দিকে ইঙ্গিত করে সে বললো। এক ঝাপটা জলজ বাতাস জানালা গলিয়ে ঘরের ভেতরে ঢুকলো। জানালার ওপারে কচুরি পানায় ভরা ডোবা,এক পাশে ময়লা সবুজ পানিতে ক’টি হাঁস সাঁতার কাটছে।
মজিদ আমার স্কুলের দপ্তরি এবং এখানকার স্থানীয় লোক। এলাকার সবকিছু তার নখদর্পণে। তাকে আমার জন্য একটা বাসস্থান ঠিক করে দেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। মেসবাড়িটা সে-ই খুঁজে বের করেছে। ঘরের চাবিটা আমাকে গছিয়ে দিয়ে মজিদ বিদায় হলে আমি আমার বাক্সপেটরা গোছাতে মনোযোগ দিলাম। মমতাকে জানাতে হবে যে, আপাতত থাকার মতো একটা জায়গা মিলেছে। সে আমাকে নিয়ে বেশ চিন্তা করছে। সচরাচর স্ত্রীরা যে রকম করে থাকে। তবে মফস্বল থেকে বদলি হয়ে রাজধানীতে চাকরি করতে আসাটা যে কি পরিমাণ বিড়ম্বনার ব্যাপার, তা আমার মতো ক্ষুদে চাকরিজিবীরাই উপলব্ধি করতে পারে।
খাটের ওপর ভীষণ ধুলো জমে আছে। মনে হচ্ছে খাটটা বহুদিন কেউ ব্যবহার করেনি। ধুলো ঝেড়ে,তোষকটা বিছিয়ে তার ওপর মমতার মমতা মাখানো হাতে ধোয়া চাদরটা বিছিয়ে যখন আয়েশ করে বালিশে পিঠ ঠেকিয়ে বসলাম—তখন আমার চোখ পড়লো পাশের বিছানার ওপর। মেরুন রঙের চাদরটা আগোছালোভাবে বিছানায় পাতা, এখানে-ওখানে কুচঁকে আছে, পায়ের দিকে বেশ অনেকটা মেঝের ওপর ঝুলে পড়েছে। বেশ ময়লা, মনে হলো অনেক দিন থেকে ধোয়া হয় না। বালিশটাও ময়লা,তেল চিটচিটে। ওয়াড়টার রঙ কোনো এক সময় সাদা ছিল হয়তো। বিছানার পাশেই ছোট টুলের ওপর একটি পানির জগ,সঙ্গে একটা অ্যালুমিনিয়ামের মগ। মগের মুখে একটা মাছি সুড়সুড় করে হাঁটছে। মগের পাশে ওপুড় করে রাখা আয়না,পাশে টুথব্রাশ ও প্রায় শেষ হয়ে যাওয়া পেস্টের টিউব।
আমার রুমমেট সম্পর্কে একটু কৌতূহল জাগলো মনে। আপাতত তার ব্যবহার্য জিনিসপত্র দেখে মনে হচ্ছে—রুমমেট লোকটা সম্ভবত খুব আগোছালো ও অপরিচ্ছন্ন স্বভাবের। লোকটাকে নিয়ে বেশি কিছু ভাবার অবকাশ হলো না। একজন মহিলা এসে দরজায় দাড়ালো। একটু হেসে,পান খাওয়া খয়েরি দাঁত বের করে আমার উদ্দেশে বলল,আমি কাদেরের মা। এই মেসে রান্না করি। আপনি খাইবেন কিছু? রান্না হইয়া গেছে,আসেন।
বেশ খিদে পেয়েছিল। কাদেরের মাকে অনুসরণ করে পাশের ঘরে এলাম। এটাই রান্না ও খাবার ঘর। ঘরের মাঝামাঝি জায়গায় একটা কাঠের টেবিল, দু’পাশে দুটো লম্বা বেঞ্চ পাতা রয়েছে। টেবিলে বড় বোলে ভাত আর পাশে বাটিতে ডাল রাখা। মাঝ বয়েসী একজন টেবিলের ওপর ঝুঁকে পড়ে প্লেট থেকে ভাতের লোকমা তুলে মুখে দিচ্ছিল। মুখ তুলে আমাকে দেখে হাসলো, আসেন ভাই।
আমি তার সামনের দিকের বেঞ্চটায় মুখোমুখি বসলাম। কাদেরের মা আমার সামনে একটা প্লেট রেখে গেলো। ভাতের বোল আমার দিকে ঠেলে দিতে দিতে লোকটি বলল,আমি জামাল,ওই পশ্চিমের ঘরটায় থাকি।
জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বুঝলাম, এখানে আরও কয়েকটা ঘর রয়েছে। সবাই বোধ হয় এখানেই খাওয়া-দাওয়া করে।
রাম্বোর ঘরে উঠেছেন বুঝি?—জামাল ডালমাখা ভাতের থালা উঁচিয়ে শব্দ করে ঝোল খেলো। তারপর হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে কষে লেগে থাকা ঝোল মুছতে মুছতে আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো। মনে হলো আমার রুমমেটটির নাম রাম্বো।
ওর নাম বাদশা, কথা বলে খুব কম, তাই আমরা সবাই ওকে রাম্বো বলে ডাকি। বড় অদ্ভুত লোক—জামাল বললো।
অদ্ভুত লোকটা সম্পর্কে জানার একটু ঔৎসুক্য জাগলেও আপাতত সেটা দমন করলাম। খাওয়ার পর ঘরে এলে নিজেকে খুব ক্লান্ত মনে হলো। অফিসের কিছু জরুরি কাগজপত্র দেখার কাজটা রাতের জন্য তুলে রেখে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম।
ঘুম ভাঙলো সন্ধ্যায়। মাথার কাছে জানালার ওপারে ডোবার চারধারে অচেনা অন্ধকার ভিড় করেছে। দূরে রাস্তার বাতিগুলো হলুদ আলো ফেলে জ্বলছে। কুয়া তলা থেকে মুখ ধুয়ে ঘরে ফিরে দেখলাম কাদেরের মা হারিকেনটা জ্বালিয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করছে। আমাকে দেখে বলল,স্যার, খাইয়া লন, আপনের খাওন হইলে আমি বাড়ি যাব।
খাবার ঘরে কেউ ছিল না। টেবিলে খাবার সাজিয়ে কাদেরের মা আমার অপেক্ষায় ছিল।
আর কেউ খাওয়ার নেই—আমি জানতে চাইলাম।
আইজ ছুটির দিন তো, যে যার মতো খাওয়া শেষ করে বাইরে চইলা গেছে। পান খাওয়া লাল ঠোঁটে হাসি ঝরিয়ে বললো কাদেরের মা।
খাওয়া শেষ হওয়ার পর কাদেরের মা এঁটো থালা বাসন নিতে এলে জিঙ্গাসা করলাম, রাম্বো সাহেব কখন আসবেন বলতে পারো?
আমার কথাশুনে ফিক করে হেসে ফেললো সে। ভেজা নেকড়া দিয়ে টেবিল মুছতে মুছতে বলল, রাম্বো সাবের কোনো কিছুর ঠিক নাই। মনে করেন,উনি কখন আসবেন কখন যাবেন,ফেরেস্তারাও সেইটা জানে না।
অমি কথা না বলে ঘরে ফিরে এলাম। অফিসের ফাইল খুলে বসলাম। মনোযোগ এলো না। ঘরে প্রচুর মশা। ময়লা ডোবা থেকে জানালা দিয়ে ঘরে ঢুকছে। জানালার কপাট দুটো বন্ধ করে দিলাম। মশার দাপট কমলো না। অগত্যা মশারি খাটাতে ব্যস্ত হলাম। মমতা মশারির সঙ্গে কিছু সুতলি গুঁজে দিয়েছিল। ওর গৃহস্হালী বুদ্ধি খুব প্রখর। মশারিটা সহজেই খাটানো গেলো।
সহসাই ঘুম এলো না চোখে। ঘুরেফিরে মমতার কথা মনে আসছে। বাচ্চা দুটোকে নিয়ে কী করছে সে এখন? রুমমেট রাম্বোর কথাও মনে এলো। লোকটা সন্পর্কে এক ধরনের ঔৎসুক মনের ভেতর দানা বাঁধছে। ওর সঙ্গে দেখা হওয়া প্রয়োজন। লোকটা কখন ফিরবে কে জানে। এসব চিন্তার ভেতর কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানি না। হটাৎ খুটখাট শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। মনে হলো বাইরে থেকে কেউ যেন দরোজায় ধাক্কা দিলো। ধড়ফর করে উঠে বসলাম। সলতের আলো থেকে চিমনীর অর্ধেকটা জুড়ে কালো কালির আস্তরণ পড়েছে। ঘরের ভেতর আলো-আধাঁরি ভরে আছে। দরোজায় আবার ধাক্কা পড়লো। দরোজার সিটকিনি খুললাম্। প্রায় ঢলতে ঢলতে ঘরে ঢুকলো লোকটি। ঠাস করে পাশের বিছানার ওপর গিয়ে বসল। আমার মনে হলো এই লোকটিই রাম্বো—আমার রুমমেট। লোকটি আমার দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। মনে হলো আমাকে যেন চেনার চেষ্টা করছে। যুবকবয়েসী লোকটার মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি,উস্কোখুস্কো চুল,ঢুলু ঢুলু লাল দুটি চোখে কেমন যেন ভাবলেশহীন দৃষ্টি। তার দৃষ্টির সামনে নিজেকে একটু বিব্রত বোধ হলো। আমি স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলাম। তার উদ্দেশে বললাম, আমি সাহাবুদ্দিন,এই মেসের নতুন বোর্ডার। আজ দুপুরে এসেছি।
কোনো প্রত্যুত্তর করল না সে। মাথা নিচু করে জুতার ফিতা খুলতে লাগলো। মোজা দুটো খুলে মেঝেয় ফেলে রেখে, আমার উল্টো দিকে মুখ করে কাত হয়ে শুয়ে পড়লো। ওকে শুয়ে পড়তে দেখে আমি দরোজা লাগিয়ে বিছানায় এলাম। ঘুম এলো না। কেমন একটা উৎকট গন্ধ ঘরের ভেতর ভেসে বেড়াচ্ছে। মনে হলো ঘামে ভেজা জুতো মোজা থেকেই গন্ধটা ছড়াচ্ছে। ভীষণ অস্বস্তিকর গন্ধ। ভাবলাম উঠে মাথার কাছে জানালাটা খুলে দেই। এমন সময় লোকটা নড়েচড়ে উঠলো। একটু গড়িয়ে বিছানার পাশে এসে মাথা ঝুকিয়ে হড়হড় করে বমি করলো। আমি বিছানায় উঠে বসলাম। কী করা উচিত—সেটা আমার মাথায় এলো না। দেখলাম লোকটা আবার তেমনি পাশ ফিরে শুয়ে পড়লো। জুতা-মোজার গন্ধ ছাপিয়ে স্পিরিট জাতীয় একটা বিচিত্র কটু গন্ধে ক্রমশই ঘরের বাতাস ভারী হয়ে উঠছে। লোকটা নিষ্পন্দভাবে শুয়ে আছে। চোখ দুটো বোজা, ভারী নিঃশ্বাসের শব্দে মনে হলো গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছে সে। ঘরের ভেতর এমন দুর্গন্ধে তার কোনো প্রতিক্রিয়া হওয়ার কথা নয়। উঠে জানালা খুলে দিলাম। ঘরের ভেতর এক ঝলক ঠাণ্ডা হাওয়া খেলে গেলো। তবু স্পিরিটের অস্বস্তিকর গন্ধটা ধোঁয়ার মতো ঘরের বাতাসে মিশে থাকলো। গন্ধের তীব্রতা কমলো না। এভাবে নিঃশ্বাস বন্ধ করে ঘরের ভেতর বসে থাকা সম্ভব নয়। দরোজা খুলে কুয়ো তলায় এলাম। বালতি ভরে জল এনে মেঝের ওপর ঢাললাম। দরোজার নিচে মেঝের ফাঁক দিয়ে ময়লা পানিটা বের হয়ে গেলো। স্পিরিটের কটু গন্ধটা একটু কমেছে অনুভব করে মনে কিছুটা স্বস্তি হলো। জলের শব্দ লোকটার মধ্যে কোনো সাড়া জাগালো না। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে থাকলো সে। দরোজা বন্ধ করে আবার যখন বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম,হাতঘড়িতে তখন রাত দুটো পার হয়েছে।
ভোর বেলা ঘুম ভাঙলো কাকের চেচামেচিতে। কাকগুলো টিনের চালে জটলা করে হট্টগোল করছিল। একঘেঁয়ে বিরক্তিকর শব্দ। শহরের সকালগুলো এই কর্কশ স্বরের পাখিরা সরগরম করে তোলে। বিছানা ছেড়ে কুয়োতলা থেকে হাত-মুখ ধুয়ে এলাম। বাদশা মিয়া অর্থাৎ রাম্বো এখনো ঘুমাচ্ছে। একইভাবে চিৎ হয়ে ছাদের দিকে মুখ করে শুয়ে আছে।
কাদেরের মা ঝাড়ু হাতে ঘরে ঢুকলো। মেঝেতে পানির দাগ তখনো পুরোপুরি শুকোয়নি। সেদিকে তাকিয়ে একটা কিছু আঁচ করে ফিক করে হেসে ফেললো। মেঝের ওপর ঝাড়ু ঘষতে ঘষতে বললো, স্যার, রাইতে ঠিক মতো ঘুমাইতে পারছেন তো? আমি মাথা নাড়ালাম। কাদেরের মা কী বুঝলো, সে-ই জানে। গোছগাছ সেরে অফিসের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়লাম।
অফিস থেকে যখন ফিরলাম, তখন সন্ধ্যা উৎরে গেছে। ঘরের দরজায় তালা আটকানো। অর্থাৎ আমার রুমমেট বাইরে কোথাও গেছে। খাবার ঘরে জামালের সঙ্গে দেখা হয়ে গেলো। পাতে লেবু চিপতে চিপতে সে আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো। বলল, ভাইজান, আমাদের জায়গাটা কেমন লাগছে?
ভালোই তো লাগছে—ওর পাশে বসতে বসতে বললাম। জামাল আমার দিকে ঝুঁকে এসে আস্তে করে বললো, রাম্বোকে কেমন দেখলেন? বললাম, এখনো তো আলাপ হয়নি, তবে তাকে বেশ অদ্ভুত স্বভাবের লোক বলে মনে হলো। কী রকম?—আবার আমার দিকে ঝুঁকে এলো সে। তার দু’চোখের উদগ্রীব ভাব আমার নজর এড়ালো না।
জামালকে রাতের অভিজ্ঞতার কথা খুলে বললাম। সে হো হো করে হেসে উঠলো। বললো, এক রাতেই দেখছি আপনার অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছে। জানেন,এই লোক আজ পাঁচ মাস ধরে ওই ঘরে আছে। কারও সঙ্গেই তার মেলামেশা নেই। সকালে বের হলে- ফেরে মাঝরাতে, মাতাল হয়ে। দরজা বন্ধ করে পড়ে পড়ে ঘুমায়। কী কাজ করে, কোথায় যায়, কেউ জানে না। অদ্ভুত তো বটেই। গত ক’মাসে তিনটে বোর্ডার তার ঘরে উঠেছে আর পালিয়েছে। কথার মাঝখানে জামাল একটু নড়েচড়ে বসলো। তারপর আবারও আমার দিকে ঝুঁকে এসে ফিসফিস করে বলল,আমার মনে হয়, এই লোক আন্ডারগ্রাউন্ড করে। আমার দিকে গোল-গোল চোখে চতুর দৃষ্টি নিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল সে। মাথাটা এ পাশে-ও পাশে অল্প-অল্প দোলাতে লাগলো। জামালের কথার অর্থ বুঝতে একটু দেরি হলো আমার। দেশে আন্ডারগ্রাউন্ড দলের তৎপরতা আছে। তবে রাম্বো সন্পর্কে জামালের অনুমান কতটুকটু ঠিক তা বোঝা গেলো না। একজন সন্দেহজনক আন্ডারগ্রাউন্ড লোকের সঙ্গে একত্রে একই ছাদের নিচে বাস করাটা বেশ উদ্বেগের ব্যাপার বৈকি! কথাটা চিন্তা করে ভেতরে ভেতরে একটু দমে গেলাম। তবে আমার আশঙ্কার ভাব জামালকে বুঝতে দিলাম না। কিছু কিছু লোক আছে, যারা অল্প থেকেই অনেক কিছু বুঝে নিতে চায় এবং সেটা অন্যের কাছে জাহির করার চেষ্টা করে। এদের অনুমান যে সব সময় ঠিক হবে, তাও নয়। আমার মনে হলো, জামাল সে রকম স্বভাবের লোক।
ঘরে ফিরতে গিয়ে দেখলাম দরজাটা অল্প বোজানো। কপাটের ফাঁক দিয়ে আলো দেখা যাচ্ছে। আমার রুমমেট ফিরেছে বোধ হয়। দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকলাম। বিছানার ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে আছে সে। বাম হাতের তালু উল্টো করে কপালের ওপর রাখা। চোখদুটো ঢেকে রেখেছে। বিছানায় বসতে বসতে ওকে লক্ষ করলাম। মনে হল জেগে আছে। লোকটির সঙ্ড়ে একটু আলাপ করার ইচ্ছা হলো।
ঘুমাচ্ছেন না কি?
না—অনুচ্চস্বরে উত্তর দিলো সে।
আপনার সঙ্গে এখনো পরিচয় হলো না—বলে আমি থামলাম। ওর প্রতিক্রিয়া বোঝার জন্য অপেক্ষা করলাম। কিছুক্ষণ চুপ মেরে থাকলো সে। কপালের ওপর থেকে হাত সরালো না।
আপনাকে আমি চিনি। আপনি সাহাবুদ্দিন মাস্টার। গোলকদিয়া স্কুলে আমাদের অংকের স্যার ছিলেন। আপনার কপালের জরুলটা আমার মনে আছে।
অনুচ্চ অথচ বেশ দৃঢ়ভাবেই কথাগুলো বলল সে। আমি অবাক হলাম। মনে পড়লো শিক্ষক জীবনের শুরুতে যশোহরের গোলকদিয়া স্কুলে দুই বছর শিক্ষকতা করেছিলাম। সেটা দেশ স্বাধীন হওয়ার পর চুয়াত্তুর সালের কথা। বুঝতে অসুবিধা হলো না যে, এই লোকটি সেই স্কুলের কোনো পুরনো ছাত্র। আপনি গনি চেয়ারমেনের খুব বন্ধু লোক ছিলেন—সে বলল। গনি চেয়ারম্যান? স্কুল কমিটির সভাপতি গনি মাতবরের কথা বলছো?—আমি জিজ্ঞাসা করলাম। হ্যাঁ, আমি চেয়ারম্যানের ছেলের হাত মচকে দিয়েছিলাম বলে আপনি জিকা গাছের ডাল ভেঙে আমাকে পিটিয়েছিলেন। তার গলার স্বর কিছুটা চড়া হলো যেন।
আমি বেশ বিব্রত বোধ করলাম। সেই সময়ে কোন ছাত্রকে কোন অপরাধে কবে শাস্তি দিয়েছিলাম, সেটা এতদিন পর মনে থাকার কথা নয়। তবু কারণটা জানার জন্য মনটা খুঁত-খুঁত করতে লাগলো। চেয়ারম্যানের ছেলের হাত মচকে দিয়েছিলে কেন? আমি জিজ্ঞাসা করলাম। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো সে, তারপর বললো,চেয়ারম্যানের ছেলে সবসময় আমাকে ক্ষেপাতো। সেদিন অসহ্য লেগেছিল বলে ওকে মেরেছিলাম। একটু থামলো সে। তার কথায় চাপা অনুযোগের সুর। গনি মিয়ার সাথে আমার বাবার বিরোধ ছিল। কিসের বিরোধ ছিল?
গনি মাতবর আমাদের ক্ষেতের জমি দখল করে রেখেছিল বলে, সেটা নিয়ে বাবা মামলা করেছিল। তারপর—একটু থামলো সে। আমি চুপ থেকে তাকে বলতে দিলাম। দেশ স্বাধীন হওয়ার দিনে গোলকদিয়া বাজারে বাবাকে পিটিয়ে মারলো। রাতে বাড়িতে হামলা করে মাকে ধরে নিয়ে গেল। দু’দিন পর বিলের পাড়ে মায়ের উলঙ্গ লাশ ফেলে রেখে গেলো ওরা। ওরা কারা?—আমি জানতে চাইলাম। গনি মাতবরের লোকজন। আস্তে করে বললো সে।
কিছুক্ষণ চুপচাপ কাটলো। হাতের উল্টো পিঠে কপাল ঢেকে কেমন নিঃসাড় শুয়ে থাকলো লোকটি। আমার মনে হলো সে আর কিছু বলবে না। একটা দুঃসহ স্মৃতি আর হাহাকার বুকে নিয়ে সে গভীর নিস্তব্ধতায় ডুবে গেছে যেন। ঘরের বাতাসে তার চাপা নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে। সেই শব্দে আমি তার বুকের ভেতর জমে থাকা কষ্ট অনুভব করতে থাকলাম। আমি ছেলেটিকে সেদিন পিটিয়ে ছিলাম তার অপরাধের ডিসিপ্লিনারি অ্যাকশনের জন্য। অবশ্য এর একটা বাড়তি কারণ ছিল যে, যাকে সে মেরেছিল, সেই ছেলেটির বাবা আমাদের স্কুল কমিটির সভাপতি এবং আমার বন্ধুস্হানীয়। ছাত্রটি গনি মাতবরের ছেলের হাত মচকে দিয়ে যে অপরাধ করেছিল, তার সেই অপরাধের নেপথ্যে তার মনে জমে থাকা ঘৃণা আর ক্ষোভের কথা জানতে পেরে একধরনের অস্বস্তিতে আমার মন ভরে উঠতে থাকলো। অনেক রাত পর্যন্ত চোখে ঘুম এলো না। গোলকদিয়ার প্রভাবশালী চেয়ারম্যান গনি মতবরের সঙ্গে আমার হৃদ্য সম্পর্ক হয়েছিল স্বল্পসময়ের জন্য। মূলত কাজের পরিচিতিতে। তার জীবনের অনেক কাহিনি আমার জানার সুযোগ হয়নি। আজ গনি চেয়ারম্যান সম্পর্কে এসব জানতে পেরে তার সঙ্গে সখ্যের জন্য নিজেকে কেমন অপরাধী মনে হতে লাগলো।
পরদিন স্কুলে পৌঁছাতেই মজিদ এসে জানালো যে একটা ভালো বাড়ি পাওয়া গেছে। স্কুলের কাছেই। সে বাড়িওয়ালার সঙ্গে কথা বলে রেখেছে। আজই উঠতে হবে। মজিদই নিজ উদ্যোগে মেস থেকে আমার সব জিনিসপত্র নতুন বাড়িতে এনে গোছগাছ করে দিলো।
বিকাল বেলা মেসঘরে এলাম সবাইকে বিদায় বলার জন্য। আমার রুমমেট ছাত্রটির সঙ্গে দেখা হলো না। কাদেরের মা জানালো সকাল বেলা সে বেরিয়ে গেছে।
সপ্তাহ খানেক পর সন্ধ্যায় জামালের সঙ্গে রাস্তায় দেখা। অফিস থেকে ফিরছিলো সে। আমাকে দেখেই এক ধরনের চতুর হাসিতে মুখ ভরিয়ে তুললো—খবর শুনেছেন স্যার? চোখ পিটপিট করে আমার দিকে তাকিয়ে বললো। কী খবর?—আমি উৎকর্ণ হলাম।
রাম্বোকে ধরতে পুলিশ এসেছিল।—একটু থেমে জামাল আবার বললো, তবে, ধরতে পারেনি। রাম্বো মিয়া তার আগেই লাপাত্তা। পুলিশ তার সব বাক্সপেটরা জব্দ করে নিয়ে গেছে। পুলিশ ওকে ধরতে এসেছিল কেন?—আমি বিচলিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম।
স্যার, বলেছিলামনা? আন্ডারগ্রাউন্ডের লোক! পুলিশ বলেছে চরমপন্থী। এক চেয়ারম্যানকে খুন করে পালিয়ে বেড়াচ্ছিল। গোল গোল বড় চোখে আমার দিকে তাকিয়ে জামাল বললো।
মনে পড়লো—খবরের কাগজে পড়েছিলাম,গোলকদিয়ার প্রতাপশালী-সমাজসেবী চেয়ারম্যান গনি মাতবর আততায়ীর হাতে নিহত হয়েছিলেন। তাও বছর খানেক আগে।