মাকসুদ যখন আমার দিকে তাকালো, সেই তাকানোর মধ্যেই আমি প্রতারণা টের পাচ্ছিলাম। হঠাৎ হঠাৎ মাকসুদের এমন হয়। ইদানিং হয়। ওর ছোট মেয়েটা যেদিন প্রথম বলেছিল, বা-বা, ঠিক সেদিন মাকসুদ আড়ালে কাঁদছিল। সেদিনও আমি টের পেয়েছিলাম। আমি টের পাই। আট বছরের সংসার তো। তার আগে ৪ বছর প্রেম করেছি। দুজন দুজনকে দেখে দেখে ঠেকে ঠেকে এই সংসার জগৎ নামক পাহাড়ে উঠছি। অনেকদূর আসতে আসতে দু’জনকে তো চেনা হয়ে যায়, গেছেও। আর ওই যে বললাম, পাহাড়ে দু’জন উঠছি। এ সংসার তো পাহাড়ে ওঠার মতোই। উঠতে উঠতে ক্লান্তি ভর করে। এই ক্লান্তি বড় ভয়ঙ্কর। আমারই তো মনে হয়, এই সংসার যে সামলাচ্ছি, শেষ পর্যন্ত আমার অস্তিত্ব কোথায়?
মাকসুদ মাঝে মাঝে বলতো, সন্তানদের মধ্যে অস্তিত্ব খুঁজে বেড়াই। আমিও তাই।
তারপরও মাঝে মাঝে নির্জনে সেই তারুণ্যের উত্তাল সময়গুলো যখন ধরা দেয়, তখন সত্যিই বড় ক্লান্ত লাগে। এই জীবনের ক্লান্তি আমাকেও মাকসুদ থেকে দূরে সরিয়ে দেয়।
কথা হয় কখনো কখনো। মাকসুদ কখনো কখনো হয়তো তার কোনো কষ্টের কথা বলতে চেয়েছে, আমি শুনিনি কিংবা শোনার সময়ও হয়তো পাইনি। আমি বিরক্ত ছিলাম, এই সংসার জগতে।
কখনো কখনো মাকসুদ রাতে তীব্র ভালোবাসার আকুতি নিয়ে আমাকে আদর করতে চেয়েছিল, আমি হাত সরিয়ে তাকে দূরে ঠেলে দিয়েছিলাম। কারণ এক সন্তান সামলে সারাদিনে কাজ করে করে আমি ক্লান্ত।
তারপর দ্বিতীয় সন্তান যখন এলো, তখন যেন মাকসুদ হয়ে গেলো অন্য গ্রহের কোনো মানুষ। আমাদের দু’জনার যেন কথা বলাই বন্ধ হয়ে গেলো। এই যে সংসারের গ্লানি, এই গ্লানিবোধ দু’জনকে নিয়ে গেলো দুই পথে। মাকসুদ যেন আরও ব্যস্ত হলো, আরও হারিয়ে গেলো আমার কাছ থেকে। মাঝে মাঝে ভাবি, আমার এই যে হঠাৎ হঠাৎ অবজ্ঞা, অবহেলা—এই জন্যই কি মাকসুদ দূরে সরে গেলো? নাকি আমাকে আর তার ভালো লাগে না। আমার বুড়িয়ে যাওয়া শরীর কি মাকসুদকে আর টানে না? এই জন্যই কি অন্য কোথাও অন্য কোনো খানে, অন্য কারও কাছে শান্তি খুঁজে বেড়ায়?
সে যাইহোক। মাকসুদকে আমি যেদিন তার প্রেম নিয়ে প্রশ্ন করেছিলাম, মাকসুদ বলছিল, ইউ আর টোটালি ম্যাড।
আমি না হয় পাগল হলাম। তবু তাকে বলেছিলাম, আমি যে মিথ্যা, সেটা তুমি প্রমাণ করো।
মাকসুদ চিৎকার করে বলেছিল, বিয়ের আট বছর পর তোমার এসব ফালতু বিষয়ে ভাবার কোনো সময় আমার নেই।
সেদিন আমাদের প্রচণ্ড ঝগড়া হলো। এক পর্যায়ে মাকসুদ বলে বসলো, হ্যাঁ আমি প্রেম করি। এবার পারলে তুমি প্রমাণ করো।
আমি সারারাত ঘুমাইনি। সারারাত ভেবেছি। নিজের সঙ্গে নিজের বোঝাপড়া। আমি কি চলে যাবো এই সংসার ছেড়ে? আমি তো দুর্বল কেউ নই। শিক্ষা আছে, রেজাল্ট ভালো। চাকরিও করতে পারি। একসময় তো চাকরি করতামও। বাচ্চাদের কথা চিন্তা করে সেক্রিফাইস করেছি। যদিও মাকসুদ চায়নি চাকরিটা ছাড়ি। আপনারা ভাববেন না, খুব নারী স্বাধীনতায় সে বিশ্বাস করে বলে মানা করেছিল, মানা করেছিল কারণ অর্থনৈতিক সংকট কমানোর জন্য। এই শহরে একজনের ইনকামে চলা বড় কঠিন। এ জন্যই নিষেধ করেছিল। কিন্তু এত ছোট্ট বাচ্চাকে রেখে অফিস যেতে মন চাইতো না। তাই বাধ্য হয়েই রিজাইন দেই।
যদিও খুব ভালো স্বামীর মতো মাকসুদ বলেছিল, পায়ের তলায় মাটিটা তুমি হারালে।
আমি বলেছিলাম, যখন প্রয়োজন হবে আবার চাকরি খোঁজা শুরু করে দেব।
বলতে হয়, সংসার জীবনে এটা ছিল আমার প্রথম সেক্রিফাইস। একটু ভেবেই বললাম, আদৌ কি এটা আমার প্রথম সেক্রিফাইস?
খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলে তো বলতে হয়, যেদিন প্রথম স্বামীর ঘরে পা রেখেছিলাম, সেটাই তো সবচেয়ে বড় সেক্রিফাইস ছিল। জন্মের পর থেকে যে ঘরে আমার বেড়ে ওঠা, যে ঘরে আমার সব স্মৃতি, যে ঘরে আমার সব স্বপ্ন—সেটা ছেড়ে উঠেছিলাম স্বামীর ঘরে। এক অজানা অধ্যায়। যদিও এই ঘরে আসবো বলেই স্বপ্ন দেখেছিলাম।
দুই.
মাকসুদের সঙ্গে আমার প্রেম হয় ভার্সিটিতে পড়ার সময়। তখন আমরা পড়ছি। মাকসুদ ছিল আমার এক বছরের সিনিয়র। তখন আমি সেকেন্ড ইয়ারে, মাকসুদ থার্ড ইয়ারে। হঠাৎই টের পেলাম মাকসুদ আমাকে দেখলেই হকচকিয়ে যায়। দূরে সরে যায়। মাঝে মাঝে মনে হয় কথাও বলতে চায়। কিন্তু পারে না। আমি অত পাত্তা দেইনি।
কিন্তু প্রথম একদিন হুট করে একটা এসএমএস দেখে চমকে উঠি। এসএমএসে লেখা, ‘কত শতবার বলতে চাই ভালোবাসি, কিন্তু কখনো বলা হয় না ভালোবাসি, ভালোবাসি, ভালোবাসি…’।
কেনযেন সেদিন মনে হয়েছিল, এটা মাকসুদ। তবু ইগনোর করেছি, আবার একটা রোমাঞ্চ অনুভব করেছিলাম। ভাবছিলাম, কে হবে ছেলেটা! সত্যিকথা বলতে, মনে মনে চাচ্ছিলাম, এটা যেন মাকসুদই হয়। সেদিন আমি মনে মনে অনুভব করলাম, নিজের অজান্তে মাকসুদের প্রতি আমার একটা আগ্রহও তৈরি হয়েছে। পরদিন ভার্সিটি গিয়ে আমার সবচেয়ে কাছের বান্ধবী চৈতিকে জানাই, এমন একটা নম্বর থেকে আমার কাছে এসএমএস এসেছে।
চৈতি বলে, বলিস কী! তুই কাউকে সন্দেহ করিস?
আমি বললাম, হ্যাঁ করি, আমার ধারণা থার্ড ইয়ারের মাকসুদ ভাই।
চৈতিও আমার থেকে নম্বরটা নিয়ে কল দিলো সঙ্গে সঙ্গে। কেনযেন আমার বুকটা তখন কাঁপছিল, আহ যদি এটা মাকসুদ না হয়! খুব খারাপ লাগবে। আমি তো চাই মাকসুদই হোক। আমি চৈতির চোখের দিকে তাকিয়ে আছি। দেখি চৈতি ঠোঁট উল্টে বলে, দোস্ত নম্বরটা বন্ধ।
বিরক্ত হয়েছিলাম ঠিক, কিন্তু মনে মনে আশ্বস্ত হলাম। যাক এখনো প্রমাণিত হয়নি। এভাবে প্রতি রাতে ওই অচেনা নম্বরটা থেকে এসএমএস আসতো। আমি এসএমএস পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কল দিতাম। কিন্তু নম্বরটি বন্ধ পেতাম। চৈতিও বেশ চেষ্টা করলো, নম্বরটা কার এটা বের করার। কোনোভাবেই পাওয়া যায় না নম্বরটির মালিককে।
একদিন আমাকে একটা কবিতা পাঠানো হলো, কবিতাটা খুব ফালতু। কিন্তু আজও আমার মুখস্থ।
চোখ খুললেই দেখতে পাই তোমার হেয়ালিপনা,
দেখি তোমার অবহেলা ভরা চোখ;
দেখি তাচ্ছিল্য ভরা আচরণ।
এ সবই আমাকে গ্রাস করে প্রতি মুহূর্ত।
তাই ইচ্ছে হয়– আজীবন চোখ বন্ধ করে রাখি।
কারণ, চোখ বন্ধ করলেই আমি অনুভব করি তোমার সারাটা পৃথিবী জুড়ে–
শুধু আমি, আমি আর আমি।
অনুভব করি, যেন তোমার মাঝেই আমি জীবন্ত।
জীবন্ত থাকার জন্য হয়ত একদিন চলে যাবো চির নিদ্রায়।
ঠিক ওই মুহূর্তে তুমি বুঝবে আমার গভীরত্ব।
খুব ফালতু কবিতা। একদম কাঁচা কবি যাকে বলে। তবু বারবার আমার কানে বাজতে থাকে, চোখ বন্ধ করলেই আমি অনুভব করি তোমার সারাটা পৃথিবীজুড়ে—শুধু আমি, আমি আর আমি।
এই কবিতা আমাকে মাতাল করে ফেলে। আমি কেনযেন সেদিনই সিদ্ধান্ত নেই, আজই মাকসুদকে জিজ্ঞেস করব এই কবিতাটির কথা। যদি মাকসুদ না হয়, তবু আমার এই চোর-পুলিশ খেলা তো বন্ধ হবে। এই নম্বরটি কার, এই ব্যক্তিটি কে, এই কবিতাটি কার— এসব ভেবে সে এক উত্তাল রাত গিয়েছিল আমার।
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে আমি ঘন নীল একটি জামা পরি। চোখে কাজল দেই। চুলটা সেদিন আর বাঁধি না। চুল খোলা রাখি। সেদিন ছিল তুমুল বৃষ্টি। আম্মা যেতে মানা করছিল। কিন্তু আমার যেতেই হবে। এই নম্বরটির ফয়সালা আমাকে করতেই হবে।
উত্তরা থেকে জসীমউদ্দীন পর্যন্ত রিকশা নেই। তুমুল বৃষ্টি। রিকশা চলছে। সামনে প্লাস্টিকের পর্দাও আমাকে ভিজে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করতে পারছে না। তীব্র বাতাস, আকাশে গর্জন, বৃষ্টির শব্দ যেন আমাকে আরও মাতাল করে তুলছিল।
ছাতাটা খুলে রিকশা থেকে নামি। ছাতাটা যেন উড়ে যেতে চায়। জসীমউদ্দীন এসে দেখি বাসে ওঠা অসম্ভব। বাসের লাইন যেখানে থাকে সেখানে পানি উঠে গেছে। ভাবলাম সিএনজি দিয়েই রওনা দেই। সিএনজি নিলাম, রওনা দিলাম ভার্সিটি। সারা রাস্তা সময় যেন আমার যাচ্ছেই না। ভার্সিটি গিয়ে ডিপার্টমেন্টে গিয়ে দেখি সুনসান নীরবতা। এই বৃষ্টির মধ্যে আসবে কিভাবে মানুষ। ঠিক তখন আমার যেন ঘোর ভাঙলো।
আমিও ভাবতে শুরু করলাম, ছিঃ মাকসুদকে আমি এই প্রশ্নটা কিভাবে করবো? সে যদি এই ব্যক্তিটি না হয়, তাহলে আমাকে কী ভাববে? আর আমি এ কাজ করলে তো পুরো ডিপার্টমেন্ট ছড়িয়ে যাবে। মানুষ আমাকে নিয়েও হাসাহাসি করবে। তাই পিছু হটলাম, সিদ্ধান্ত থেকে।
তখন একটি ফাঁকা ক্লাস পেয়ে সেখানে বসে গেলাম। খুব ক্লান্ত লাগছিল। হঠাৎ মনে হলো, আচ্ছা আমি কি রিকশা ভাড়া দিয়েছিলাম? আমি কি সিএনজি ভাড়াটা দিয়েছিলাম? সঙ্গে সঙ্গে ব্যাগে হাত দিয়ে আরও অবাক হয়ে পড়ি। পুরো ৫০০ টাকার একটা নোট। বের হওয়ার সময় আম্মা দিয়েছিল। সেটা রয়ে গেছে। তার মানে কারও ভাড়া না দিয়ে আমি দৌড়ে দৌড়ে যেন সমুদ্র পার হচ্ছিলাম। নিশ্চয় তারা পেছন থেকে ডেকেছে। আমি শুনিনি, কারণ তখন কানে ক্রমাগত বেজেছে রাতে পাওয়া সেই কবিতা।
ছিঃ! এটা কী করলাম?
বেঞ্চ থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ক্লাসরুম থেকে বের হলাম। বের হয়ে দেখি চৈতিও এসেছে। বললো, কী রে? তুই দেখি ভিজে শেষ।
আমিও তখন খেয়াল করলাম আমি ভিজে একাকার হয়ে আছি। চৈতি বলল, চল নিচে যাই, ফার্স্ট ইয়ারের জিকোরা আজ দেয়াল পত্রিকা ঝুলিয়েছে। দেখে আসি। ওরা কাল বারবার বলেছিল সন্ধ্যা পর্যন্ত থাকতে। কাজ ছিল তাই চলে গিয়েছিলাম, চল আজ দেখে আসি।
আমার বরাবরই এসবে আগ্রহ নেই। তাই চৈতিকে বললাম, ধ্যাৎ! তুই যা তো! ভালো লাগছে না।
চৈতি জোর করলো, আরে চল না। আমারও একটা লেখা আছে ওখানে।
আমি তো হাসতে হাসতে শেষ। বললাম, তুই টাংকি মেরে টাইম পাস না, আবার লেখালেখি?
চৈতি অভিমানের সুরে বলে, মানে কী? টাংকি মারলে বুঝি লেখালিখি করা যায় না?
যাইহোক, চৈতি যেহেতু বলেছে, তাই রওনা দিলাম। নিচে। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে জিজ্ঞেস করলাম, কী লিখেছিস?
চৈতি বলে, গত বছর কলকাতা গিয়েছিলাম না? ওই কলকাতা ভ্রমণ নিয়ে একটা ছোট্ট লিখা দিয়েছিলাম। ভাষার মাস উপলক্ষে দেয়াল পত্রিকা তো। তাই দুই বাংলায় গেলে যে ভাষা আমাদের মোটেও আলাদা করে না। মনে হয় ওটাও আমার দেশ, সেটাই বোঝাতে চেয়েছি লেখায়।
আমি বললাম, বাহ্। খুব ভালো বিষয় তো।
দুজন গিয়ে দেয়াল পত্রিকার সামনে দাঁড়ালাম। বিরাট এক দোয়েল পাখি বানিয়েছে। সেখানে বিভিন্ন লেখা। চৈতি তার লেখা খোঁজা শুরু করলো। তারপর দেখে বলল, ওই যে দেখ, দেখ আমার লেখা। চৈতির লেখাটা পড়া শুরু করলাম।
মাঝপথেই চৈতি আমাকে চিমটি দিয়ে বলছে, দেখ না তোর মাকসুদ তো দেখি কবি। কবিতা লিখেছে। চোখ খুললেই দেখতে পাই তোমার হেয়ালিপনা, দেখি, অবহেলা ভরা চোখ…
চৈতির কথা আর কানে আসছে না। আমার নিজের কানেই বেজে চলছে কবিতা। যেন মাকসুদ তার ভরাট কণ্ঠে আবৃত্তি করছে। বলছে,
অনুভব করি, যেন তোমার মাঝেই আমি জীবন্ত।
জীবন্ত থাকার জন্য হয়তো একদিন চলে যাবো চির নিদ্রায়।
ঠিক ঐ মুহূর্তে তুমি বুঝবে আমার গভীরত্ব।
আমার মাথা ঘুরছিল। চৈতিকে বললাম, আমি বাসায় যাবো। ভালো লাগছে না। চৈতি বলছিল, বৃষ্টির মধ্যে ক্লাস করতে আসলি। ক্লাসটা করে যা। আজ তো একটাই ক্লাস।
আমি তারপরও চলে এলাম।
সারা রাস্তা আমার বুক ফেটে কান্না পাচ্ছিল। আমার মনে হচ্ছিল, এই বৃষ্টিতে আমি মাকসুদের হাত ধরে চিৎকার করে কাঁদি। কেন এমন হয়েছিল? জানি না। পরিচয় নেই, কথা নেই—কেন একটা মানুষ আমার ভেতরে এভাবে জায়গা করে নিল? এর উত্তর আজও জানা নেই।
ওই কবিতাটিই যেন আমার প্রমাণ ছিল মাকসুদকে ধরার। আমি সেদিন বাসায় গিয়ে অনেক ভেবেছি, আমার এখন কী করা উচিত। তারপর চৈতিকে ফোন দিয়ে বললাম, আমার মাকসুদের নম্বরটা চাই।
চৈতি আমাকে জিজ্ঞেস করলো, কী হয়েছে হঠাৎ? কবিতা পড়ে পাগল হয়ে গেলি না কি?
আমি কথা না বাড়িয়ে বললাম, ওনার নম্বরটা যেভাবেই হোক ম্যানেজ করে দে।
চৈতি নম্বর এসএমএস করলো। আমি সেই নম্বরে এসএমএস করলাম, লিখলাম, আপনি অন্য যেই নম্বরটি থেকে আমাকে এসএমএস করছিলেন, সেটা বাদ দিয়ে নিজ নম্বর থেকে এসএমএস দেবেন। আমি নিশ্চিত ছিলাম সেটা আপনি। কিন্তু প্রমাণ ছিল না। কাল রাতের কবিতা আর আজ দেয়াল পত্রিকার কবিতা দেখে প্রমাণ পেয়ে গেলাম। আপনি ধরা।
খুব ভাব নিয়ে এসএমএস পাঠিয়ে আমি বসে আছি। রিপ্লাই পাওয়ার জন্য। কোনো রিপ্লাই নেই। সারারাত কোনো রিপ্লাই নেই। আমি জেগে থাকি, কিছুক্ষণ পরপর ফোনের স্ক্রিনে দেখি। নাহ কোনো ফিরতি এসএমএস নেই। খুব মেজাজ খারাপ হয়। তবু জেগে থাকি। যখন ভোর হয় তখন চোখটা বুজে আসে ক্লান্তিতে…
সকালে চোখ খুলে দেখি ১১টা বেজে গেছে। লাফ দিয়ে মোবাইলে চোখ দেই। দেখি খুব ছোট্ট একটা এসএমএস। লেখা, আপনি প্রমাণ পাননি। আমি ফুট প্রিন্ট রেখেছি। আপনি সেটা অনুসরণ করে আমার কাছে এসেছেন।
আমার তখন এত লজ্জা লাগছিল, বলার বাইরে। এরপর আমাদের এসএমএসে কথা বলা শুরু। আশ্চর্য বিষয়টি ছিল ভার্সিটিতে আমরা কেউ কাউকে চিনতাম না, কথাও বলতাম না। না চেনার ভান করে থাকতাম। কেন এমন করতাম আমরা জানি না। আমরা কথা বলাও শুরু করেছি প্রায় ৩ মাস পরে। এভাবেই প্রায় ৬/৭ মাস পর ভার্সিটিতে আমরা সামনা-সামনি স্বাভাবিক হয়েছি। কথা বলেছি, ঘুরেছি। তখন মাকসুদের পড়া প্রায় শেষের সময়। চুটিয়ে প্রেম করেছি আমরা। আমার খুব আফসোস হতো, কেন যে মাকসুদের সঙ্গে ফার্স্ট ইয়ারেই প্রেমটা করলাম না। হলে আরও কত দীর্ঘ সময় পাওয়া যেত।
এভাবেই আমার দিন গেলো। মাকসুদ পড়া শেষ করে চাকরি পেলো। তারপর দুই পরিবারের মধ্যে কথা হলো। ঝামেলাহীনভাবেই আমাদের বিয়ে হলো। এই প্রক্রিয়াটাও সময় লেগেছে। প্রায় তিন বছর সময় চলে গেছে মাঝে। মাকসুদ চাকরি করার পাশাপাশি মাস্টার্সও করলো। আমিও পাস করে চাকরিতে ঢুকলাম। সেসব তো অন্য সংগ্রাম।
বিয়ের পর এখন আট বছর পার করে দিলাম। দিন বদলে গেছে। সাধারণ মোবাইল ফোন থেকে স্মার্ট ফোনে ঠেকেছে। ট্যাব এসেছে। ফেসবুক নামক এক আশ্চর্য মিডিয়া এসেছে। যেখানে মাকসুদ বুঁদ হয়ে থাকে। আর আমাকে বলে, আমার সেকেন্ড ওয়াইফ হলো ফেসবুক।
তিন.
মাকসুদের বাবা-মা গ্রামে থাকে। তাই এই শহরে সংসার গোছানোর কাজটা আমাদেরই একা একাই করতে হয়েছে। ওর বাবা-মাকে আমরা দু’জনই অনেকবার বলেছি, আসেন একসঙ্গে থাকি। কিন্তু তারা আসতে রাজি হন না। মাঝে মাঝে আসেন, কিছুদিন থেকে চলে যান। শহরে নাকি তাদের দম বন্ধ লাগে। তাই এই শহরটাতে দু’জন মানুষ ছিমছাম করে গোছানো শুরু করি সংসার।
আমাদের সংসার গোছানোর সংগ্রামটা অনেক কষ্টের ছিল। মাকসুদ ক’টাকাই বেতন পেতো তখন। অল্প কিছু টাকায় ঘর ভাড়া, বাজার সদাই, বিদ্যুৎ বিল, গ্যাস বিল এসব দিতে দিতে বেচারা হিমশিম খেতো।
শুরুতে মাকসুদ আমাকে অনেক সময় দিত। আমাকে বারবার বলতো, তুমি গরিব ছেলে বিয়ে করে বিপদে পড়ে গেলে। আমি হাসতাম। চুপি চুপি চাকরি খুঁজতাম। যদি পেয়ে যাই মাকসুদের হেল্প হবে। এমনও দিন গেছে মাসের ২৫ তারিখ মাকসুদের টাকা শেষ। তখন এক মহা বিপদে পড়ে যেতে হতো। কী করবো আমরা? বাজার করারই তো টাকা নেই। অফিস যাওয়ার ভাড়া নেই। তখন মাকসুদ বন্ধুদের কাছ থেকে ধার নিতো। আমার তখন খুব খারাপ লাগতো।
পরে সিদ্ধান্ত নিলাম, এভাবে তো চলতে পারে না। একটা চাকরি খুঁজতেই হবে। আর সংসারের খরচে লাগাম টানতে হবে। আমরা একবছরের মধ্যে বাসা বদল করলাম। আরও ছোট বাসায় ছিলাম।
সেখানেও দেখি একই অবস্থা হয়। সেই মাসের ২৫ তারিখ বেতন শেষ হয়ে আসে। তখন বুঝতে পারলাম, মধ্যবিত্তের জীবন এক অদ্ভুত গোলক ধাঁধাঁ। এটা থেকে বের হওয়া বড় মুশকিল।
শেষে চাকরি একটা জুটে গেলো আমার। ঠিক তখনই যেন ঘুরে দাঁড়ালাম আমরা। তাও সেটা বিয়ের দুই বছর। তখন সেই ২৫ তারিখের ফাঁড়াটাও আমরা পার করতে পারলাম।
কয়েকমাস পর একই সংকট দেখা দিলো। দেখা যায়, আবারও মাসের শেষে দুজনেরই টাকা শেষ হয়ে আসে। এভাবে চার বছর আমরা পার করলাম। এই চার বছরে ঘুরতে যাওয়া, নতুন জামা, ভালো খাবার খুব কমই হয়েছে। আসলে সত্যিকার অর্থে আমাদের তখন ঘোরাঘুরিও হয়নি তেমন। এমনও গেছে ঈদে আমরা খুব কম দামে নতুন জামা কিনেছি। কারণ দুজনের শ্বশুর বাড়ি ঈদের কাপড় পাঠাতে হচ্ছে।
সব চলছিল এভাবে। হঠাৎ একদিন আমি আবিষ্কার করলাম আমার গর্ভে তৈরি হচ্ছে একটি নতুন মানুষ। তখন আঁতকে উঠেছিলাম। ভাবছিলাম, দুজন মানুষই এই শহরে হিমশিম খাচ্ছি। আরও একজন মানুষ এলে তাকে সামলাবো কিভাবে?
আমি দুশ্চিন্তায় পড়লেও মাকসুদের কোনো বিকারই ছিল না। সে খুশিতে আত্মহারা। সে এই সংসারের অভাব টানতে টানতে অনেকটা নিশ্চুপ হয়ে উঠছিল, কিন্তু তখন তাকে খুব উচ্ছল মনে হতো। আমার খুব ভালো লাগতো তখন। মনে হতো একটা মানুষ কতটা বদলে যেতে পারে সন্তান আসার খবর শুনে।
প্রতিদিন অফিস থেকে এসে আমার সঙ্গে গল্প করতো। আমাকে বুকে নিয়ে ঘুমাতো। আমার তখন প্রায়ই রাতে ঘুম ভেঙে যেত। মাকসুদ তখন উঠে আমার সঙ্গে গল্প করতো। মাথা টিপে দিতো। আমাকে আদরে আদরে ঘুম পাড়িয়ে দিতো।
কিন্তু আর্থিক বিষয়টাতেও তো আমাদের মাথায় রাখতে হতো। ডাক্তারও দেখাতে পারতাম না। এমনকি কতটুকু খারাপ লাগলে আমরা ডাক্তারের কাছে যাবো—সেটাও আমি অনেক এক্সপেরিমেন্ট করতাম। মাকসুদকে বলতাম না কিছুই। লুকিয়ে রাখতাম। কারণ আমি তো জানি ঘনঘন ডাক্তারের কাছে দৌড়ালে সংসারের হিসাব চালানো কঠিন।
আমাদের যখন নতুন অতিথি এলো, আমার বড় মেয়ে। ওর নাম দিলাম রিদি।
তিন মাস পর আমি চাকরিতে জয়েন করলাম। ওই সময়টা আমার শ্বাশুড়ি ঢাকায় থাকা শুরু করলেন। কিন্তু আমার মন মানতো না। অতটুকু বাচ্চাকে রেখে আমি অফিস করি কিভাবে! পরে একদিন মাকসুদকে বললাম, আমি চাকরিটা ছাড়তে চাই।
সে তখন বললো, সেটা তোমার ইচ্ছা। কিন্তু পায়ের তলার মাটিটা তুমি হারালে।
আমি বলেছিলাম, অসুবিধা কী। যখন প্রয়োজন হবে আবার চাকরিতে ঢুকবো।
ওই যে ঘরে ঢুকলাম, আর বের হওয়া হলো না। এক সংসারের গোলোকে ঘুরতে থাকলাম। আবার সেই টানাটানির সংসার। তবে বাচ্চা হওয়ার পর অনেক কিছুতে আমরা সাবধানী হয়ে উঠলাম।
আমরা বাচ্চার জন্য প্রতি মাসের শুরুতে পাঁচ হাজার টাকা আলাদা করে রেখে দিতাম। কারণ যদি মাসের শেষে সে অসুস্থ হয়ে যায়। যদি তার জরুরি দুধ শেষ হয়ে যায়। তাহলে টাকা তো জোগাড় থাকতে হবে। এভাবে আমরা সংসারের খরচ কমিয়ে নিয়ে আনলাম।
এভাবেই সংসার চালানো। মাকসুদ এখন অবশ্য ভালো চাকরি করে। এর মধ্যে তো দ্বিতীয় মেয়ে নিধিও চলে এসেছে।
মাকসুদ এখন ভালো চাকরি করে। ছোট বাসা থেকে মাঝারি বাসায় এসেছি আমরা। শহরের চিকন গলি থেকে বের হয়ে একটু বড় গলিতে বাসা নিয়েছি। আমাদের ওই টানাটানির সংসারও এখন নেই। অনেকটা সচ্ছল হয়ে উঠেছি আমরা। শুধু যেন নেই দুজন দুজনের কাছে। এক বিস্ময়কর দূরত্ব দুজনের মধ্যে তৈরি হয়ে গেছে। এখন আর আদর নেই, স্নেহ নেই। শুধু টিকে আছে এই সংসার।
চার.
আজ যখন মাকসুদ ঘরে ঢুকলো। তখন হুট করেই ওর চোখে দিকে তাকালাম। ঠিক তখনই আমি তার চোখে প্রতারণা দেখতে পাচ্ছিলাম।
মাকসুদের চোখ খুব ধীর-স্থির। কিন্তু এখন তার চোখ হয়ে উঠেছে চঞ্চল। আমার দিকে তাকাতে পারে না। আমি জানি এটা ওর অপরাধবোধ।
যখন বাইরে থেকে ঘরে ঢোকে, আমাকে দেখে, সন্তানদের দেখে তখনই তার মধ্যে এক অপরাধবোধ তৈরি হয়। যেটা তাকে ক্রমাগত গ্রাস করে।
কিন্তু এটা থেকে সে বের হতে চায়। আর এজন্যই আমার সঙ্গে শোয় না, কথা কম বলে, আমি তার হাত ছুলে কেঁপে ওঠে। হাতটা নিজ থেকে ছুটিয়ে নিয়ে বলে, ভালো লাগছে না, বিরক্ত লাগছে।
আমার খুব কষ্ট হয়। আমি জানি এটা মাকসুদ বোঝে। আমি যখন বিরক্ত হয়ে এভাবে মাকসুদকে দূরে সরিয়ে দিতাম, তখন মাকসুদ চুপ করে থাকতো। একদিন রাতে আমাকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে চাইলে আমি তাকে মানা করেছিলাম, বলেছিলাম, জোর করো না, ভালো লাগছে না। সেদিন মাকসুদ সঙ্গে সঙ্গে পাশ ফিরে ঘুমিয়ে গিয়েছিল। সকালে খুব মন খারাপ করে অফিস চলে যায়। আমি সকালে অনুভব করি, কাজটা মোটেও ঠিক হয়নি। স্বামী তো! দিনের পর দিন এভাবে দূরে রাখলে খারাপ তো লাগবেই। আমি তাকে এসএমএস করি, স্যরি।
ফিরতি এসএমএসে মাকসুদ আমাকে লেখে, স্যরি না হয় বলছো। আমি তো কখনো কিছুর জন্য জোর খাটাইনি। তবে আমি ভাবছি, কখনো যদি আমি এমন করি, তখন তোমার সহ্য হবে তো? সেটা একটু ভেবে দেখো।
মাকসুদ খুব ঠাণ্ডা মাথার ছেলে। সঙ্গে অতি চালক তো বটেই। তার চালাকি আমি বুঝি। টের পাই। ঠাণ্ডা মাথার ছেলেরা ধুরন্ধর হয়। এটা মাকসুদই বলে। এই ঠাণ্ডার মাথার ছেলে যখন হঠাৎ হঠাৎ রেগে যায়, খুব চঞ্চল হয়ে যায়, ঘরে আসলেই নিজে নিজে গান গায়, বউকে রোমান্টিক দুটি স্বাভাবিক কথা বলারও সময় হয় না, তখন তো বুঝতে হয় অনেক কিছু বদলাচ্ছে।
আপনারা হয়তো ভাববেন, এসবের কারণেই আমি তাকে সন্দেহ করছি। বিষয়টা এত সহজ নয়। ওই যে বললাম, আট বছরের সংসার। স্বামীর গায়ের গন্ধও বুঝে ফেলি দূর থেকে। হঠাৎ যখন শার্টে হাসনাহেনার গন্ধ আসে বুঝে ফেলি ঘটনা সহজ নয়, যখন বাইরে থেকে আসলেই মেয়েদের গোসল করার আগ পর্যন্ত কোলে নিতে চায় না, তখনো বুঝে ফেলি ঘটনাটি সহজ নয়। যখন দেখি আমার স্বামী যার জামা-কাপড়ের কোনো স্টাইলই ছিল না, কিন্তু হঠাৎ করে তার নিত্য-নতুন শার্ট, প্যান্ট ঘরে কিনে আনে। তখন বুঝতে পারি ঘটনাটা সহজ নয়। যখন সে বউয়ের চোখের দিকে তাকাতে পারে, চোখে থাকে চঞ্চলতা অফুরান, তখন বুঝি ঘটনাটা এত সহজ নয়, এর ভেতর অনেক কিন্তু আছে। যখন আমি তার হাত ধরতে চাই তখন তার সারা শরীরে আমি অস্বত্বির ছাপ দেখতে পাই, তখন বুঝি বিষয়টা এত সহজ নয়।
আমার এক বান্ধবীর কথা বলেছিলাম না? চৈতি। একদিন চৈতিকে ফোন দিয়ে বলেছিলাম। চৈতি শুরুতে বিশ্বাসই করতে চায়নি মাকসুদের মতো ছেলে অন্য কোনো মেয়ের সঙ্গে এই বয়সে এসে জড়াতে পারে।
কিন্তু আমি তখন চৈতিকে বলি, দেখ আমার স্বামী গত আট বছর একবারই গোসল করে, সেটা সকালে। আর এখন সে অফিস থেকেই এসেও করে।
চৈতি আমার কথা শুনে হাসা শুরু করলো, চৈতিও বললো, আর ইউ ম্যাড? এটা কোনো কথা হলো? আট বছরে একটা মানুষ একটু বদলালো আর তুই ধরে নিলি সে অন্য মেয়ের সঙ্গে প্রেম করছে! তোর কি মাথা ঠিক আছে? আর বাচ্চাদের মতো কথা বলছিস কেন? গোসল করেছে, তাই তোর ধারণা অন্য মেয়ের সঙ্গে শুয়ে এসেছে? তোর তো মাথা পুরা গেলো!
আমি আবারও চৈতিকে বোঝালাম, দেখ, সে তো আমার স্বামী, আমি তো টের পাই।
এবার চৈতি আমাকে কাউন্সিলিং করা শুরু করলো। আমি খুব বিরক্ত হয়ে চৈতিকে বললাম, তোর কি মনে আছে মাকসুদ কিভাবে আমাকে অজগর সাপের মতো পেচিয়ে ঘায়েল করে প্রেমে ফেলেছিল?
চৈতি এবারও আমাকে চুপ করিয়ে বলে বসলো, তুই ডাক্তার দেখা। তোর মাথায় সমস্যা হয়েছে। মাকসুদ ভাই তোকে একটা অন্য নম্বর থেকে এসএমএস করেছিল। সেটা পেয়ে পেয়ে তুই তার প্রেমে পড়েছিস। আর এখন আট বছর সংসার করার পর বলছিস অজগর সাপের মতো তোকে পেচিয়ে ঘায়েল করেছে! তুই সিরিয়াসলি সাইক্রেটিস্ট দেখা।
আমার প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ হলো। ফোন কেটে দিলাম। চৈতিও আমাকে বুঝলো না। কিন্তু আমি তো বুঝি। আমি তো টের পাচ্ছি আমার স্বামী জাড়িয়ে গেছে এক রোমাঞ্চকর জালে।
এবার চৈতিই আমাকে কল ব্যাক করলো, তারপর ঠাণ্ডা মাথায় বললো।
নীলু তুই এক কাজ কর। তোর যেই বিষয়গুলোতে খটকা লাগছে সেই বিষয়গুলো নিয়ে তুই মাকসুদ ভাইয়ের সঙ্গে ডিসকাস কর। এটা তোর সব সমস্যার সমাধান দেবে। মাকসুদ ভাইকে সরাসরি বলে দে—তার যদি প্রেম থাকে তোকে বলে দিতে, তোরা সেপারেট হয়ে গেলি। সংসারে তো দম বন্ধ করে থাকার মানে হয় না।
আমি চৈতির কথায় শুধু হুম হুম করে রেখে দিলাম।
কারণ আমি জানি চৈতিও বিষয়টাকে সিরিয়াসলি নেয়নি। কেউই নেবে না। কাউকেই বোঝাতে পারবো না। কিন্তু আমি যে বুঝতে পারছি। আমি যে ক্রমাগত বুছতে পারছি। এটা আমি কিভাবে অন্যকে বোঝাবো? আমি তো তার স্ত্রী। আমার শরীরের প্রতিটি অংশের সঙ্গে যেমন মাকসুদের জানা, তারও সব কিছু সম্পর্কে আমার জানা। শরীর-মন সব কিছুই তো আমাদের পরিচিত। এই পরিচিত জগতে অন্য কেউ প্রবেশ করেছে এটা আমি টের পাচ্ছি। এখন এজন্য তৃতীয় মানুষটাকে সরাবো নাকি নিজে সরে যাবে? এর উত্তরও বের করতে পারছি না।
কিন্তু আমি এও জানি, মাকসুদ আমাকে এত সহজে ছাড়বে না। তার দুই মেয়ের জন্য সে পাগল। আর মাকসুদ একটা রোমাঞ্চকর জালে জড়িয়েছে। এই জালটা কাঁচের। একদিন এ কাঁচ ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে।
আর তাছাড়া মাকসুদকে ধরার জন্য প্রমাণ লাগবে। সে তো বলেই দিয়েছে, প্রমাণ করো।
আমার কেনযেন এখন মনে হচ্ছে, সে এই বিষয়টা নিয়ে আমার সঙ্গে খেলছে। যেভাবে আমাকে পটানোর জন্য সে একটা খেলা খেলেছিল।
সেও বোঝে আমি বুঝতে পেরেছি, কিন্তু কোনো প্রমাণ না পাওয়ায় তাকে ঘায়েল আমি করতে পারবো না। কারণ সে ওই রোমাঞ্চ জগতেও থাকতে চায়, আবার বউ-বাচ্চাও ছাড়াতে চায় না।
কিন্তু এই দম বন্ধ করা পরিবেশে তো আমি থাকতে পারি না। একটা মানুষ আমার সঙ্গে প্রতারণা করবে আর আমি মুখ বুজে সহ্য করবো, তা তো হতে পারে না।
তাই আমি যেন মাকসুদের সেই চ্যালেঞ্জটাকে গ্রহণ করলাম। প্রমাণ খোঁজা। হাতে নাতে ধরে এই সংসারকে লাথি মেরে আমি চলে যাবো।
তাই আজ যখন মাকসুদ ঘরে ঢুকে আমার দিকে তাকালো তখন তার চোখে-মুখে আমি শুধু প্রতারণাটাই দেখতে পাচ্ছি। তার বড় মেয়ে দৌড়ে তার দিকে আসলো। আমি দেখলাম অন্যদিন সে মেয়েকে গোসল করার আগে কোলে নিতে চায় না। আজ ঠিকই নিলো। তারপর বেড রুমে যেতে যেতে আমাকে বলল, পানি দাও, তৃষ্ণা পেয়েছে।
আমি লেবুর শরবত বানিয়ে বেড রুমে গেছি। দেখি মাকসুদের শার্ট, পেন্ট এবং আন্ডারওয়্যার চেয়ারে ঝোলানো। মাকসুদ টয়লেটে। আমি লেবুর শরবতের গ্লাসটা টেবিলে রেখে তার আন্ডারওয়্যারটা হাতে নেই। আমার গা কাঁপছিল, বুক ফেটে কান্না পাচ্ছিল। ওই সাদা দাগের চেয়ে বড় প্রমাণ আর কী হতে পারে? আমি জানি আপনারা বলবেন, এটা তো অন্য কোনো কারণও হতে পারে। কয়বার বলবো, ও তো আমার স্বামী।
আমি সেটা রেখে দৌড়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াই। ভাবি, আজই শেষ, আর না। যে লোক অন্য মহিলার সঙ্গে শুয়ে এসেছে তার সঙ্গে একমুহূর্ত সংসার করার মানে হয় না। নিজের সঙ্গে নিজে তো প্রতারণা করে এই সমাজের কথা চিন্তা করে আমি থাকতে পারি না।
ওপাশ থেকে মাকসুদ আমাকে ডেকে উঠলো। নীলু নীলু, আমি চোখ মুছি।
হঠাৎ করে সেই ভার্সিটি জীবনের ম্যাসেজটির কথা মনে পড়ে গেলো। যেখানে মাকসুদ বলেছিল, আপনি প্রমাণ পাননি। আমি ফুট প্রিন্ট রেখেছি। আপনি সেটা অনুসরণ করেছেন।