লাল আলোয় থেমে বামে তাকাতেই লোকটা নজরে এলো। কোট পরা। অলতো পায়ে হেঁটে হেঁটে, আবার আগের জায়গায় এসে দাঁড়াচ্ছে। প্যান্টের পকেটে হাত রেখে অন্যহাতে চুরট শুষে ধোঁয়া ছেড়ে দিচ্ছে পথের দিকে। ধোঁয়ার পেছনে একগাল হাসি। বিকশিত দন্তের গন্তব্য আছে বলে বোঝা যায় না। এইটুকুই দেখা সেইদিন। গ্রিন হয়ে ওঠা আলোয় গাড়ির গতি পেল। ডানে মোড় নিয়ে সোজা বাড়ির রাস্তায় ওঠা।
লোকটা প্রায় প্রতিদিন সামনে পড়ে। হয়ত সেই মোড়ে, মন্টেলো স্ট্রিট থেকে মেইন স্ট্রিটে, মন্থর পায়চারীতে। ফুরিয়ে আসা শীতের দিনে, বসন্ত বা গ্রীষ্মেও গায়ে ভারী কোট চাপিয়ে রাখে। হাতে সিগার কিংবা সিগারেট। চলতে চলতে হঠাৎ থামে, চলন্ত গাড়ির দিকে হাত নাড়ায়। হাসি ছড়িয়ে রাখে মুখে। আমার প্রতিদিনকার যাতায়াত এই পথে। ব্রকটনে, লোকটার চলার স্ট্রিটে, মনটেলোয় এলে চোখ চঞ্চল হয়। এখন কেমন করে হেঁটে লোকজনের দিকে অযথা অভিবাদন বিলি করছে, দেখতে মন চায়। মাঝে মাঝে একেবারেই দেখো মেলে না। তখন সেই অর্থহীন অপেক্ষাটা বাড়ি আসবার গতির সঙ্গে মিলে হারিয়ে যায়। আবার হয়ত হুহু করে মনে আসে।
কারও সঙ্গে কথা বলতে দেখিনি। মাঝে মাঝে ডানকিন ডোনাটস্ থেকে কফি নিয়ে ঠাই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি। হাতের ইশারায় মৃদু হাসি মেলানো ছাড়া কাউকে ডেকে কথা বলা বা এগিয়ে গিয়ে কিছু জানতে চাওয়া—এমনও চোখে পড়েনি। এই ধরনের লোকজন সাধারণত রাস্তায় হেঁটে হেঁটে ভিক্ষা করে। কিংবা বাঁশপাতা রঙের বক্সের খণ্ডাংশে, Homeless. Will work for food. লিখে বুকের ওপরে ধরে থেমে যাওয়া গাড়ির ড্রাইভার-সিটের কাঁচ বরাবর দাঁড়ায়। ওরা জানে, কেউ ওদের কাজে নেবে না বা ওরাও কাজের নয়। জানালা খুলে দুএকটা ডলার মেলে ধরলে, অতি বিনয়ে ফুটপাত থেকে নেমে, পয়সা নেয়, ‘ত্যাংক য়্যূ বেড়ি মাচ্’ বলে অন্যদিকে চলে যায়। প্রথম প্রথম মনে করতাম, হয়ত দুদিন পরে দেখবো, বোর্ডে অক্ষর সাজিয়ে শহরের সুভদ্র মাধুকরী বেশে হেসে বেড়াবে লোকটা। কিন্তু বছরখানেক হলো, তার চলার ব্যতিক্রম নেই।
২.
একদিন কাজ থেকে সকাল সকাল বের হই। মন্টেলোর মোড়ের ডানকিনে কফি কিনে এককোণায়, রাস্তার দিকের টেবিলে বসে আছি। লোকটার পায়চারীর জায়গাটা ফাঁকা। সবাই যে যার কাজে। লাঞ্চটাইম হয়নি। স্ট্রিটে মাঝে মাঝে দুএকটা স্পোর্টস কার ব্রুম ব্রুম করে ছুটে বেরিয়ে যাচ্ছে। এই কারগুলোর সবসময় ব্যস্ততা লেগে থাকে। এদের থামার নিশানা মনে হয় অতি দূরে। কফি কাউন্টারে হঠাৎ হঠাৎ দুএকজন আসছে। কাস্টমার না থাকায় মেয়েরা কিচেনে কিচিরমিচির করছে। কাউকে দেখলে দৌঁড়ে এসে বাঁকা হয়ে দাঁড়িয়ে ঘাড় কাত করে জানতে চাইছে, ‘হাউ মেই আই হেল্প য়্যু?’ চোখে চোখে কোটওয়ালাকে খুঁজছি। যদি আসে কফি নিতে, শুনতে পারা যাবে, কেমন করে কথা বলে। আদৌ কথা কয় কিনা বলা মুশকিল। নির্বাক চলচ্চিত্রের মতো ওর হাত নাড়ানো আর হাসি ছাড়া তো আর কিছু জানা হয়নি।
কফি, ডোনাট্স, মাফিন আর সদ্য বেইক করা ক্রোসানের ঘ্রাণে কিছুটা বেভুলে বসেছিলাম। কেনই বা এখানে বসে আছি। কাজের শেষে এক নিঃশ্বাসে বাসায় যাওয়ার অভ্যাস। কালেভদ্রে হয়ত কোনও বন্ধুর ফোন পেলে যাবার পথে ক’দণ্ড দেখা করে যাই। কিন্তু আজ এমন একজনের জন্য একমুখি প্রতীক্ষায় রয়েছি—সে অজানা এক মানুষ, সারাটা দিন যার পায়ের নিচে পথ জেগে থাকে। মেঘলা দিনে, রোদের পারদে, বৃষ্টির বিহ্বলতায় কিংবা তুষারের তির্যক হিমেও যার হাসি মলিন হয় না। সে চেনে না আমাকে। তবু এক দুর্নিবার জানবার আকাঙ্ক্ষা।
কফির চুমুকে জেলি ডোনাটের শেষ খণ্ডটা মোলায়েম হয়ে মুখে রয়ে গেছে তখনো। স্বাদে বুঁদ হয়ে মুগ্ধচোখে বাইরের রোদ দেখছি। মুহূর্তের জন্য ভুলে ছিলাম অপেক্ষার কারণ। মার্চের শুরু হলেও এখনও বছর শুরুর মতো শীত। রোদের রাগেও হিম, ঝিম মেরে থাকে। আজ তাপমাত্রা কিছুটা উপরে। হাতমোজা না পরতে হবার মতো সহনীয় হিমেল হাওয়া। কফিতে শেষ চুমুক দিয়ে কাগজের কাপটা ট্র্যাস ক্যানে ফেলে বাইরে এলাম। গাড়ির ভেতরে বসতে যাব ভাবছি। ‘টোয়েন্টিফোর কর্নার’ কনভেনিয়েন্ট স্টোরের কোণা থেকে রাস্তা পার হচ্ছে লোকটা। হাতের সিগারেটটা সদ্য আগুনের ছোঁয়া পেয়ে ইচ্ছেমতো পেঁচানো ধোঁয়া ছাড়ছে।
৩.
পায়চারীর মাঝখানে থমকে দাঁড়ালো। পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম। শান্তভাবে বললাম, ‘ক্যান ইউ স্পেয়ার মি অ্যা স্মোউক, প্লিজ?’ আমার দিকে অবাক, বিশ্বাসহীন দৃষ্টিতে তাকাল। মনে হলো, শুনতে পায়নি। হয়ত কথা বলতে পারে না। আমি বিনীত হাসি ধরে রাখতে চাইলাম। চোয়াল ক্লান্ত হয়ে হাসি নিভে যাওয়ার উপক্রম। তখন মুখ খুলল লোকটা:
‘শুয়্যার, হিয়ার ইট ইজ।’
মার্লবোরো মেনথলের প্যাকেট বের করে মেলে ধরল। আমি ভরা প্যাকে গাদাগাদি করে শুয়ে থাকা সিগারেটগুলো থেকে একটির স্পঞ্জের মাথায় চিমটি দিয়ে বের করে নিলাম। সঙ্গে সঙ্গে লাইটার পট্ করে জ্বলে রইল মুখের সামনে। দুআঙুলের ফাঁকে রেখে ঠোঁটে এনে টান দিতেই চির চির করে তামাক পুড়ে আগুনে লাল হয়ে রইল সিগারেটের প্রান্ত। আমার মুখ-বুক ভরা ধোঁয়া। নাকদিয়ে গলগল করে ঘন কুয়াশা ঝরছে।
‘ইউ ডোন্ট স্মোক, ডু ইউ?’
‘রেয়ারলি, ইফ আই উইশ টু। একচুয়ালি, ছিগরেটস্ ডোন্ট স্মোক মি, আই স্মোক দেম।’ নিজেকে সামলে নিতে নিতে বললাম।
‘হাহাহ…। লুকস্ লাইক, দিস ওয়ান ইজ স্মোকিং ইউ, বাডি।’
আমি লজ্জিত হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে। কতকিছু জানতে চাইছিলাম এর কাছে। মনে হয়েছিল কিছুই বলবে না। বা কথা না বলে চুপচাপ পাশ কাটিয়ে চলে যাবে। এতদিনে মনেই হয়নি,এর মধ্যে এমন স্বাভাবিকতা আছে। তবু কেন, সারাটা দিন পথে পথে এমন করে ঘোরে!
‘মাই ফ্রেন্ড, ইউ ওয়ানা নো সামথিং, রাইট?’
‘ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড।’
৪
ডানকিনের কোণার সিটে বসলাম আমরা। আমি শুধু জানতে চাইলাম, কেন ও এমন করে ঘুরে বেড়ায়। বন্ধ নদীর স্রোতে খুলে দেওয়ার মতো হলো। ওর কথার জোয়ার ছুটে চলল অজানা সমুদ্রের দিকে, আমার নাম ডমিনিক্। ওই পোস্ট অফিসটার পাশেই আমার বাড়ি। একাই থাকি।
‘তোমার পরিবার? মা-বাবা?’
‘মা-বাবা নেই। মারা গেছে অনেক আগে। আর পরিবার কখনও হয়নি। ঘর বাঁধা বাঁধা খেলা হয়েছে কত।’ চোখ বাঁকা করে বলল, ‘ইউ নো।’
‘ইয়া, আই আ-রস্ট্যা-।’
‘না না, ফ্রেন্ড, ইউ উইল নেভার গেট ইট।’
‘এনিওয়ে। একটি মেয়ে সত্যি সত্যি আমার সঙ্গে ঘর বাঁধতে চেয়েছিল। আমার ঘর সাজাতে চেয়েছিল তার সমস্ত ভালোসা দিয়ে। বছরের পর বছর একই ছাদের নিচে বসে বৃষ্টি দেখেছি, রোদ দেখেছি, বরফের শুভ্রতায় ছেয়ে আসা আকাশ দেখেছি। ও বাইরে তাকিয়ে থাকত, আর আমি দেখতাম ওর নীলচোখে আমার নীল আকাশ, ঢেউখেলা এমন সোনালি চুল জনমে কারও দেখিনি। খুব চাইতাম, যেমন আছি, তেমন করে দিন যাক। ঘরে ফিরে ওকে দেখি । কিন্তু, ঘরে বসে থাকা যে আমার রক্তে নেই। ঘর বসানো জানি না যে আমি। রুটিন মেনে কাজে যাওয়া। টিভি নামক যন্ত্রটার দিকে তাকিয়ে থাকা সে আমার কাজ নয়। তাই, সেই সুইটহার্ট হার্টে ক্ষত দিয়ে চলে গেল। কি যেন তোমার নাম?
‘আমি শহীদ। আমার নাম শহীদ।’
‘আচ্ছা। শাহীড। বাহ্, চমৎকার শুনতে। মানে কী?’
‘ উইটনেস্, সাক্ষী।’
‘আমরা তো সবাই এক হিসেবে শাহীড, মিস্টার শাহীড। হাহাহ।’
‘তুমি বেশ রসিক, ডমিনিক। আমি ভাবতাম, সারাদিন ঘুরঘুর করে বেড়াও। কথাটথা বোধহয় বলোই না।’
‘জানো বন্ধু, আমার কথা বলার কেউ নেই। আশাও করি না। ফোন পর্যন্ত রাখি ।’
‘তোমার চলে কি করে? থাকা খাওয়া?’
‘বাবার বাড়িটা এখন আমার। আর সরকার মাসে মাসে চেক দেয়। ঘুমানোর জায়গা আছে। ক্ষিদে পেলে খাবার কিনে খেতে পারি। আর কী চাই? তাই ঘর-বিবাগী আমি পথে পথে মানুষকে অভিবাদন জানিয়ে ফিরি। কেউ না হাসলেও হেসে তাকিয়ে থাকি তার দিকে। কর্মক্লান্ত কেউ কেউ আমার হাসি দেখে দেখে কষ্ট করে হলেও হাসি ফিরিয়ে দিয়ে চলে যায়। স্টেয়ারিঙের পেছনে বসে কতরকমের বৈষয়িক টানাপড়েনে পুড়ে পুড়ে ঘরে ফেরে তারা। তাদের সেই মলিন জগৎ-ক্লান্ত ক্লান্তিতে প্রশান্তি এনে দিতে পারি কিছুটা হলেও। আমি ডমিনেট করি দুঃখকে। সমস্ত বন্ধন, দগ্ধ-বিধূর, ধূসর পথের প্রচ্ছন্নতা, কর্মের ভারে, স্বার্থের প্রকোপে প্রকম্পিত মানুষগুলোর দূর যাত্রার আবহে সজীবতার হাওয়া খেলাতে পারি বলেই, জগতের জড়তাকে ডমিনেট করতে পারি বলেই আমি ডমিনিক্।