ট্রাংকের ভেতরে নোট লেখা কাগজটি পাওয়া গেলো। ১৯৮০ সালের নোট। আজ ২০২০ সালে এর প্রয়োজনীয়তা কতটুকু? সেটা বিষয় নয়। কাগজটি একটি পাতলা খাকি খামের ভেতর ছিল, অন্য কাগজপত্রের সঙ্গে। আলাদাভাবে খুঁজতে গেলে হয়তো পেতাম না। কাগজটি পেয়ে ৪০ বছর পর বুকের মধ্যে নতুন স্পন্দন সৃষ্টি হলো। এই স্পন্দন বলে বোঝানোর নয়। পুরো শরীরটাই কেঁপে উঠলো কি না, বুঝতে পারছি না।
আসলে দৈনিক ইত্তেফাকের একটি কাটিং খুঁজছিলাম। তাও অনেক আগের। ১৯৮৫ সালের ২৫ ডিসেম্বরের পেপার কাটিং। ওটা ছিল আমার একটি কিশোর গল্প। শিরোনাম ‘কোঁকড়ানো চুল’। কচি-কাঁচার আসরে গল্পটি ছেপেছিলেন রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই। খুব যত্ন করে বড় ইলাস্ট্রেশন করেছিলেন শিল্পী আইনুল হক মুন্না। সেটা আমার কাছে একটা ইতিহাস। কাউকে চিনতাম না তখন। অথচ অজপাড়াগাঁয়ের একটি ছেলের লেখা এভাবে এত বড় দৈনিকে প্রকাশিত হয়েছিল, তা ভেবে আজও শিহরিত হই। যদিও ১৯৭৯ সাল থেকে আমার লেখা পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ শুরু হয়, তবু ইত্তেফাকে প্রথম লেখা ছাপা হওয়ার আবেগ এখনো চাপা রাখতে পারি না। ফলে মূল কাগজটি বের করা দরকার হয়ে পড়লো। আরও একটি বিশেষ কারণে, আমার বন্ধু নঈমের ওটা লাগবে।
নঈম অবশ্য জানে, আমি প্রকাশিত লেখার পেপার কাটিং রাখি। সে নিজেও আমার লেখালেখি নিয়ে বেশ উৎসাহ দেখায়। শুধু সে আর আমার স্ত্রী জানে, এই পারসোন্যাল ট্রাংকের খবর। লোহার শিট দিয়ে তৈরি এই ট্রাংকে মাঝারি সাইজের একটি তালা। চাবি থাকে আমার ডেস্কের ড্রয়ারে লক করা। ড্রয়ারের চাবিটি থাকে আমার প্রয়োজনীয় চাবিগুচ্ছের সঙ্গে। চাবিগুচ্ছ আমার সঙ্গী। সুতরাং ট্রাংকটি আমার স্ত্রী মন চাইলে খুলতে পারবে না। সে আমার ঘরে বউ হয়ে আসার পর থেকে দেখছে এটাকে আমি কিভাবে যত্নে রাখি।
ট্রাংকের বয়স ৪১ বছর। ফরিদপুর থেকে কিনেছিলাম। মা ও আব্বার গুরুত্বপূর্ণ কিছু চিঠি ছাড়াও বেশ কিছু প্রেমপত্র আছে। একসময় পেনফ্রেন্ড হিসেবে চিঠিপত্র আদান-প্রদান করতাম। তখন সাপ্তাহিক বিচিত্রায় ছেলে-মেয়েদের ঠিকানা ছাপানোর ব্যবস্থা ছিল। সেখান থেকেই এমন চিঠির সূত্রপাত। এছাড়া বিশিষ্ট ব্যক্তি যেমন, রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই, গীতিকবি মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান, সুরকার খন্দকার নূরুল আলম; এমন বিখ্যাত ব্যক্তির চিঠিও আছে এখানে। রেডিওর ঠিকানায় সুরকার খন্দকার নূরুল আলমকে একটি গানের প্রশংসা করে চিঠি লিখলে তিনি গানটির স্রষ্টা মোহাম্মদ রফিকউজ্জামানকে আমার কথা বলেন। এরপর থেকে নিয়মিত চিঠি লিখতেন এই প্রখ্যাত গীতিকবি। ১৯৮২ থেকে ১৯৮৫ পর্যন্ত তার সঙ্গে পত্র আদান-প্রদান নিয়মিত ব্যাপার ছিল।
দুই দিকে দুটি বাথরুম। ভাগ্যক্রমে আমি একদিকে বাস করার সুযোগ পেলাম। কথা ছিল বউ নিয়ে থাকব। কিন্তু বাবার অসুখের কারণে তার আসতে বিলম্ব হচ্ছে।
সুতরাং সব গুরুত্বপূর্ণ পত্রে ঠাসা ছিল আমার ট্রাংক। এর মধ্যে ১৯৮০ সালের নোট থাকা স্বাভাবিক। বিষয়টা আমার মাথায় ছিল না যে আমি একটি গল্প লেখার জন্য এই নোট লিখেছিলাম। নোটের বিষয়বস্তু এতটুকু, স্টেডিয়ামে দৌড়াতে গিয়ে মেয়েটি পড়ে গেলো। ধরাধরি করে রুমে আনা হলো। তার সবুজ পাজামার বেশ খানিক অংশ রক্তে ভিজে কালো হয়ে গেছে।
খাতা থেকে ছেঁড়া এক টুকরো কাগজ। উঁচু করে ধরে দেখলাম কর্ণফুলী পেপার মিলের কাগজ। কিছুদূর পর পর জলছাপের রেখা। কাগজটি মনে হলো পাতলা হয়ে গেছে এবং হলুদাভ রঙ। তবু বলপেনের লেখাগুলো স্পষ্ট পড়া গেলো।
এতটুকু নোট দেখে পুরো গল্প মাথায় আনা অনেক কষ্টসাধ্য ব্যাপার। কিন্তু বিষয়টা আমার মুহূর্তের মধ্যেই মনে পড়ে গেলো। এমনই হয়। কখনো কখনো পুরনো স্মৃতি খুব দ্রুত মনে পড়ে। আজ দুপুরে কী দিয়ে ভাত খেয়েছি, এটা মনে না থাকলেও ৪০ বছর আগে স্টেডিয়ামে একটি মেয়ে পড়ে গিয়েছিল, সেটা মনে করা সহজ। বয়স হলে স্মৃতিশক্তি লোপ পায় ঠিকই, তবে কৈশোর যৌবনের স্মৃতি গাঙের পানির মতো চোখের সামনে ভেসে ওঠে।
তখন আমি ফরিদপুর ইয়াছিন কলেজের ছাত্র। ইন্টারমিডিয়েটে পড়ি। বাংলা সাবজেক্ট-এর দুজন টিচার ছিলেন। আ.ন.ম. আবদুস সোবহান স্যার পড়াতেন কবিতা। গদ্য পড়াতেন আজিজুল হক খান। যাকে আমরা বলাই স্যার বলতাম। ইংরেজি গদ্য পড়াতেন আব্দুর রব স্যার আর পদ্য পড়াতেন মাহফুজ হোসেন স্যার। আমি তখন সাহিত্য বিষয়ে খুবই আগ্রহী হয়ে উঠেছিলাম। সোবহান স্যার যখন সৈয়দ আলী আহসানের ‘আমার পূর্ব বাংলা’ কবিতাটি ব্যাখ্যা করে পড়াতেন, তখন ভাবতাম কবি কত দূরদৃষ্টিসম্পন্ন। তার লেখায় এত চমৎকারভাবে দেশপ্রেম ফুটে উঠেছে, মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না। কিন্তু, পরবর্তীকালে যখন জানলাম, এই কবি স্বাধীনতার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন, তখন তার প্রতি ঘৃণা জন্মালো। যিনি এত নিবিড়ভাবে দেশের গুণগান করতে পারেন, তিনি কিভাবে মাতভূমির প্রতি বিতৃষ্ণ হলেন? লেখক হয়ে একজন লেখকের প্রতি ঘৃণা জন্মানো ঠিক নয়, তবু কেন যেন মানতে কষ্ট হয়।
রব স্যার ও হেনরি’র ‘গিফ্ট অব দ্য ম্যাজাই’ যখন পড়ান, তখন মুগ্ধ হয়ে এই গল্পের কথা ভাবি। কী অসাধারণ গল্প! তরুণ প্রাণে প্রেম-প্রেম একটা ভাব চলে আসে। এই সময়ে যদিও আমি অনেক কিছুই বুঝতাম না। যেমন বুঝতাম না ওই মেয়েটির কথা।
সেদিন ফরিদপুর স্টেডিয়ামে ছিল আন্তঃজেলা স্কুল ক্রীড়া প্রতিযোগিতা। ফরিদপুরের বিভিন্ন স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরা এতে অংশ নিচ্ছে। গ্যালারিতে দর্শকদেরও ভিড় চোখে পড়ার মতো। যদিও আমার সাহিত্যের প্রতি বেশি ঝোঁক ছিল এবং খেলাধুলার বিষয়ে তেমন আগ্রহ ছিল না, তবু বেশ কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে খেলা দেখতে গেলাম। বর্শা নিক্ষেপ, গোলক নিক্ষেপ, লং জাম্প, হাই জাম্প, দৌড় ইত্যাদি খেলা বেশ উপভোগ্য মনে হচ্ছিল। ২০০ মিটার দৌড়ের সময় হঠাৎ একটি মেয়ে ঘাসের মাঠে পড়ে গেলো। ঠিক আমার কাছাকাছি। অনেকেই দৌড়ে গেলাম। মেয়েটিকে টেনে তুললাম। ওর দাঁড়ানোর শক্তি নেই। আমি পাঁজাকোলে করে দ্রুত একটি রুমের দিকে যেতে লাগলাম। মনে হলো আমার প্যান্ট ভিজে যাচ্ছে। আমি যখন ওকে একটি টেবিলে শুইয়ে দিলাম, তখন ও কাউকে যেন খুঁজছিল। ততক্ষণে কর্তৃপক্ষের লোক এসে গেছে। আমি সরে যাচ্ছিলাম, তখন মেয়েটি চেঁচিয়ে বলতে লাগলো, ‘আমার কোচ কই?’
আমি ওর মুখ থেকে এমন কথা শোনার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। মনে হলো সবারই মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। কর্তৃপক্ষের একজন বললেন, তুমি শান্ত হও, আমরা দেখছি।
মেয়েটি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললো, ‘আমার মা-বাবাকে খবর দিন।’
ব্যস্ত হয়ে নিজেকে আগলে রাখার চেষ্টা করছিল ও।
ট্রাংকের ভেতরে এমন একটি ঘটনা পেয়ে গেলাম। আমার মাথায়ও ঠিকঠাক কাজ করছিল না। মেয়েটিকে নিয়ে কী গল্প লিখতে চেয়েছিলাম, সেটাও মনে আসছে না। শুধু ঘটনা মনে পড়লো। এতকাল পরে ছোট্ট একটি নোট থেকে গল্প উদ্ধার করা কঠিন কাজ। সুতরাং গল্প লেখায় হাত দেওয়ার আগে আরও ভাবতে হবে।
৮ বছর পরের কথা। ১৯৮৮ সাল। আমি তখন দিনাজপুরে। যে কোম্পানিতে চাকরি করি, তাদের জোনাল অফিস ছিল দিনাজপুর। হেড অফিস ঢাকায়। কোম্পানি থেকে আমাকে একটি মোটরসাইকেল দেওয়া হয়েছিল। গ্রামাঞ্চলে যেতে হতো। ফুরফুরে মেজাজে চলাফেরা করতাম। বছর খানেক আগে নিজগ্রামে বিয়ে করেছি। সপ্তাহে একটা চিঠি লেখা ছিল বউয়ের সঙ্গে একমাত্র যোগাযোগ। যে বাড়িতে ভাড়া থাকতাম, সেটা একটা এল-শেপ একতলা বিল্ডিং। একজন স্থানীয় ল-ইয়ার সেই বাড়িটির মালিক। তিনি এটাকে চেম্বার বানাতে চেয়েছিলেন। পড়ে সিদ্ধান্ত পাল্টিয়ে তার পুরনো বাড়িতেই প্র্যাকটিসের কাজ সারেন। এল-শেপ বাড়িটি এমনভাবে তৈরি করা, দুটো পরিবার বাস করতে পারে। দুই দিকে দুটি বাথরুম। ভাগ্যক্রমে আমি একদিকে বাস করার সুযোগ পেলাম। কথা ছিল বউ নিয়ে থাকব। কিন্তু বাবার অসুখের কারণে তার আসতে বিলম্ব হচ্ছে।
আমাকেও ভাবী বলে গেছে কোনো কিছু লাগলে যেন মিমির কাছে চাই। কিন্তু এত প্রয়োজনীয় জিনিস আমার চাওয়ার সাহস ছিল না। মিমি ইচ্ছে করে দিচ্ছে।
বাড়ির অন্যদিকে যারা ভাড়া থাকে তারা রংপুর থেকে এসেছে। রংপুরে এক মঙ্গায় এই পরিবারটি খুব অসহায় হয়ে পড়েছিল। অভাবের কারণে এখানে এসেছে। পরিবারের কর্তা ব্যক্তিটির নাম খলিলুর রহমান। আমি খলিল ভাই বলে ডাকি। তার এক মাত্র মেয়ে ক্লাস সেভেনে পড়ে। তিন জনের সংসার। খলিল ভাই একটি ধানের মিলে চাকরি করে। এখন অভাব অনেক দূর হয়েছে। অভাব দূর হয়েছে বলেই সে তার শ্যালিকার পরিবারকে দিনাজপুর নিয়ে এসেছে। তারা কাছাকাছি কোথাও ভাড়া থাকে। খলিল ভাইয়ের স্ত্রী যাকে আমি ভাবী বলি, সে একদিন বললো, আমি আসার আগে নাকি এখানে এক বাজে পরিবার বাস করতো। সারাক্ষণ ঝগড়া চেঁচামেচি সহ্য করতে হতো। আমি একা বলে তাদের সুবিধা হয়েছে। সকালের নাস্তা আর রাতের খাবারের ব্যবস্থা তারাই করেছে। বিনিময়ে টাকা দেই আমি। খলিল ভাইয়ের মেয়ে আমাকে আংকেল ডাকে, মাঝে মাঝে আমার সঙ্গে মোটরসাইকেলে ঘুরতে যায়। ওর নাম মিমি। ফারজানা মিমি। কোনো কোনো বিকেলে শুধু শুধু ঘোরা হয়। মোটরসাইকেলের পেছনে বসতে মিমির নাকি বেশ ভালো লাগে। ওর ছোট ছোট দুটো বুক আমার পিঠের সঙ্গে খোঁচা খায়, আমারও ভালো লাগে। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে ব্রেক চেপে ধরি। ও হাসে খিলখিল করে। কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে যাই, ছোটদের সঙ্গে অমন কথা না বলাই শ্রেয়। ওর সঙ্গে আমার লেখালেখি নিয়ে গল্প করি। খুব মজা পায়। মাঝে মাঝে আমার লেখা ছড়া-কবিতা পড়ে শোনাই। পত্রিকায় ছাপা হলে সেটা দেখাই। এভাবে মিমিদের সঙ্গে একটা পারিবারিক সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেছে।
একদিনের কথা। আমার অফিস ছুটি। বাসায় বসে গোছগাছ করছি। কাপড় ধোবো বলে কিছু কাপড় ফ্লোরে রেখেছি। তখন মিমি এসে বললো, আংকেল কী করছেন?
-এই টুকটাক ঘরের কাজ। বোঝোই তো, তোমার আন্টি নেই বাসায়।
মিমি হাসলো। বসতে না বললেও খাটের ওপর গিয়ে পা ঝুলিয়ে বসলো। মাঝে মাঝে ও এভাবে বসে। হঠাৎ প্রশ্ন করলো, আংকেল একটা কথা বলব?
-বলো।
আমি একটু উৎসাহ নিয়ে এগিয়ে যাই কাছে। মিমি বললো, আমাদের স্কুলে একটা মেয়ে আছে, ভারি দুষ্টু। ও শুধু আমার এখানে ধরে।
আমার একটি হাত টেনে ওর বুকে নেয়। আমি চমকে উঠি। মৃদু চাপ দিতে দিতে বলি, এভাবে চাপ দেয়?
-না, ও আরও জোরে চাপ দেয়।
-তোমার ভালো লাগে?
-বেশি জোরে দিলে ব্যথা লাগে। আদর করে দিলে ভালো লাগে।
-এই ভাবে?
আমি মৃদু চাপ দিয়ে বললাম, এখন ভালো লাগছে?
মিমি মিষ্টি করে হাসলো। মাথা ঝাঁকালো, খুব ভালো লাগছে। ততক্ষণে আমার হাত ওর কামিজের ভেতরে ঢুকে গেছে। মিমি আরও ক্লোজ হচ্ছে। ওদিকে আমার টানটান অবস্থা। কতদিন বাড়ি যাই না। কতদিন বউকে দেখি না। মিমি আমাকে আরও শক্ত করে চেপে ধরে। বললাম, ভালো লাগছে?
-ভীষণ ভালো লাগছে আংকেল।
-তোমার মা যদি তোমার খালার বাসা থেকে এসে পড়ে?
-গেটের চাবি আমার কাছে। মা বলে গেছে, আপনার কিছু লাগলে যেন দেই।
আমাকেও ভাবী বলে গেছে কোনো কিছু লাগলে যেন মিমির কাছে চাই। কিন্তু এত প্রয়োজনীয় জিনিস আমার চাওয়ার সাহস ছিল না। মিমি ইচ্ছে করে দিচ্ছে। ওর বাবাও তখন ধানের কলে। সময়টা কত উপযোগী আমাদের জন্য। মিমি ততক্ষণে ওর জামাকাপড় নিজেই খুলে ফেলেছে। আমার পরনে লুঙ্গি আর স্যান্ডো গেঞ্জি। জামাকাপড় কাচতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম বলে এই পোশাক। মিমি আমাকে টেনে নিলো। কী কাচতে কী কাচা শুরু করলাম, নিজেও বুঝলাম না। তখন সকাল সাড়ে ১১টা। হঠাৎ দেখি মিমির নিম্নাঙ্গ দিয়ে রক্ত ঝরছে। ওর জীবনে এটা প্রথম। ও বুঝবে না বলে কত আদর করেছি। ওখানে চুষে দেওয়ার সময় লক্ষ করেছি, পিচ্ছিল আঠাযুক্ত স্বাদ আমার জিহ্বায়। তারপরও রক্ত কেন বুঝতে পারলাম না। ভয় পেয়ে গেলাম। মিমি তখনো হাসছে। আনন্দে হাসছে।
ওই দিন বিকাল ৫ টার দিকে অফিস থেকে পিয়ন এসে বললো, আমার একটা টেলিগ্রাম এসেছে। তখন মোবাইল ফোন ছিল না। টেলিগ্রামে অল্পকথা, ফাদার সিরিয়াস, কাম শার্প।
তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে ভাবীকে যখন বললাম, বাড়ি যাচ্ছি, তখন মিমি এমনভাবে আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো, মনে হলো ও ভেবেছে আমি ভয় পেয়ে পালাচ্ছি। দিনাজপুর থেকে ট্রেনে পোড়াদহ জং; গাড়ি বদল করে পোড়াদহ জং থেকে কালুখালি জং নামলাম। তখন ভোর হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি হাঁটা শুরু করে বাড়ি গিয়ে দেখি থমথমে অবস্থা। আমাকে দেখে মা ছুটে এসে হাউমাউ কান্না শুরু করলেন। ভাই-বোন সবাই চিৎকার করে কাঁদতে থাকলো। আমার বউ এসে কাঁদতে কাঁদতে বললো, অনেক চেষ্টা করেও সম্ভব হলো না।
জানতে পারলাম আব্বা গতকাল সকাল সাড়ে ১১টায় ইন্তেকাল করেছেন। গতকাল সন্ধ্যার আগেই দাফন হয়ে গেছে। আমি চিৎকার করে কাঁদতে গিয়ে দেখি আমার চোখে পানি নেই। গতকাল সকাল সাড়ে ১১টায় আমি অন্য কোনো রক্তের খেলায় মশগুল ছিলাম। আমার পুরো আনন্দের সময়টাকেই আজরাইল বেছে নিয়েছে আব্বার জান কবজের জন্য। কখনো কখনো অনেক দুঃখেও কান্না করা যায় না।
এবার ২০১৬ সালের কথা। আমি তার অনেক আগে থেকেই ঢাকায় অবস্থান করছি। কোম্পানি বদল করে ভালো একটি চাকরি করছি দীর্ঘদিন ধরে। আর্থিক অবস্থা অনেকটা ভালো হলেও এখনো ঢাকায় বাড়ি করা হয়নি। ভাড়া বাসাতেই থাকি। অনেক খরচ। ছেলেমেয়ে দুজনেই বিদেশে। ছেলে কানাডা গিয়ে পড়াশোনা শেষ করে একটা জব করছে। তার মায়ের মাধ্যমে জানতে পেরেছি, ওখানে নাকি একটি ভারতীয় মেয়ের সঙ্গে প্রেম করে। সে হিন্দু হলেও বিয়ের পর নাকি ধর্মান্তরিত হবে। মেয়েটির কোনো প্রেম আছে কি না, এখনো আমার কান পর্যন্ত পৌঁছায়নি। সে অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে আছে। আর এক বছর গেলে পড়ালেখা শেষ হবে। তখন দেশে চলে আসবে, না কি ওখানেই সেটেল্ড হবে ঠিক নেই। এরকম একটি সময়েও আমার ফুরফুরে মেজাজ। মাকে বাসায় নিয়ে এসেছি, ভাইবোনের আপত্তি সত্বেও। মার অনেক বয়স হয়েছে। মনে মনে আমার একটা ইচ্ছা, আব্বার মরা মুখটাও দেখতে পেলাম না, মাকে কাছে রাখি যেন সারাক্ষণ দেখতে পাই। বাসায় বাইরের লোক বলতে একটি কাজের মেয়ে। বয়স ১৫ কী ১৬। আমার বউকে বলেছি, মাকে একটু দেখে রাখতে, আদরযত্ন করতে। বউ খুব লক্ষ্মী আর সংসারী। গ্রামের মেয়ে। আমার মনের মতো সে। ইন্টার পর্যন্ত পড়েছিল, আমার সঙ্গে ঝুলে পড়ায় আর পড়া হয়নি।
একই রক্তে আনন্দ প্রবাহিত হয়, আবার কষ্টও সঞ্চালিত হয়।
সেদিন ছিল শনিবার। রাত সাড়ে ৮টা হবে। বউ রান্না ঘরে ব্যস্ত। কাজের মেয়েটি সাহায্য করছে। মা তার রুমে শুয়ে আছেন। সন্ধ্যায় একসঙ্গে তিন জন নাস্তা করেছি। আমার ফুরফুরে মেজাজে আজকাল যোগ হয়েছে ফেসবুক। বড়ই ভালো লাগে। অনেক লেখক বন্ধু অ্যাড হয়েছে। লেখালেখি নিয়ে কথা হয়, আবার অনেক অচেনা মানুষের সঙ্গেও পরিচয় হয়েছে। বেশির ভাগই তরুণী। তারা যে এই বয়স্ক লোকটার মধ্যে কী খুঁজে পায়, জানি না। কারও কারও সাথে ম্যাসেঞ্জারে টেক্সট আদান-প্রদান করতে হয়, কারও সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে হয়। কখনো অডিও কল, কখনো ভিডিও কল। এর মধ্যে সেক্সের কথাও থাকে। সেক্সের কথাতেই তারা উৎসাহ বেশি পায়। বউ রান্না ঘরে থাকায় শুয়ে শুয়ে ম্যাসেঞ্জারে কথা বলছি। প্রযুক্তির জন্য ভাষাও ব্যতিক্রম হয়ে গেছে। ওপাশ থেকে লিখলো, খাইছো?
-না। রান্না শেষ হলে খাবো।
মাঝে মাঝে শুদ্ধ লেখার চেষ্টা করি। কিন্তু অন্যপক্ষের তাণ্ডবে সম্ভব হয়ে ওঠে না। সে আবার জিজ্ঞেস করলো, কী করতেছ?
-তোমার সাথে কথা বলি।
-যদি বাঁড়াটা দেখাও, তাইলে ভিডিও কল দেই।
-ওইডা দিয়া কী করবা?
-ঢুকামু।
-আমি বুড়া মানুষ।
-বুড়া মাইনষের বাঁড়া শক্ত হয়।
-বুঝলে কিভাবে?
-তুমি কি মনে করো তুমি আমার একলাই বুড়া? দেশে আর বুড়া নাই?
ভিডিও কল করলো মেয়েটা। রিসিভ করে দেখি সে উলঙ্গ। নাভি পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। নাভির পর থেকে পাতলা কম্বল। একটি মেয়ের নাভি থেকে মুখমণ্ডল পর্যন্ত খোলা দেখলে স্বাভাবিক একটি প্রতিক্রিয়া হয়। এই মেয়েটি নাকি ভার্সিটিতে পড়ে। উত্তর না দক্ষিণ, কী যেন বলেছিল পরিচয় দেওয়ার সময়। আজকাল তো নর্থ, সাউথ, ইস্ট, ওয়েস্ট; চারদিক নিয়েই ইউনিভার্সিটি আছে। ঠিক মনে পড়ছে না কোনটা। সে নিজের বুকে হাত ঘষতে ঘষতে বলল, কই? ওইডা দেখাও।
-কী করবা?
-আমি ফুটায়া ধরব, তুমি ফাটায়া দিবা।
-কী বললা?
-ফাটায়া দিবা।
আমি একহাতে মোবাইল ধরে অন্য হাতে টাউজারের ফিতা খুলি। হাতটা সবে ঢুকিয়েছি, ঠিক তখনই আমার বউয়ের চিৎকার। সঙ্গে সঙ্গেই কাজের মেয়েটি ঢুকে বললো, খালু, দাদি কথা বলতেছে না। শিগগির আসেন।
কাজের মেয়েটি দৌড়ে বের হলে, মোবাইল ফেলে আমিও দৌড়ে মা-র ঘরে যাই। বুঝতে পারলাম আমার মা আর এই জগতে নেই। আমার বউ চিৎকার করে কাঁদছে ‘আম্মা গো’ বলে। আমি কাঁদতে গিয়ে দেখি আমার চোখে পানি নেই। মাথার ভেতর ঢুকছে একটাই কথা ফাটায়া দিবা।
লাশবাহী গাড়িতে মায়ের লাশ নিয়ে বাড়ি যাবার পথে মাথায় আসে, ফাটায়া দিবা। মাকে কবরে নামানোর সময় একটি হাস্যোজ্জ্বল মুখের কণ্ঠস্বর শুনতে পাই, ফাটায়া দিবা।
ফাটানো মানেই তো রক্ত। মাথা ফাটলে রক্ত ঝরে, শরীরের যে কোনো জায়গা ফাটলে রক্ত ঝরে। ফরিদপুর স্টেডিয়ামে সেই মেয়েটির ওই রক্তও ফাটিয়ে দিয়ে ঝরানো হয়েছিল। মেয়েটি চিৎকার করে বলছিল, আমার কোচ কই? সে আমার এইখানে আজ মোটা ধোন ঢুকাইছিল। কইছিল, এইডা করলে নাকি দৌড়ে ফার্স্ট হওয়া যায়। আমি ফার্স্ট হবার চাইছিলাম। তাই আমার কোচের সব কথা আমি শুনছি।
ওই কোচ হয়তো স্কুলের শরীরচর্চা শিক্ষক হবে। শরীর নিয়েই তার কাজ। আমার এখনো মনে পড়ে মেয়েটির কথা। ওই রক্তের কথা। হয়তো প্রথম ঋতুস্রাব। কিন্তু এটা নিয়ে কী রকম গল্প লিখতে চেয়েছিলাম, মনে পড়ছে না। এতটুকু নোট থেকে কোনো গল্প তৈরি করা সম্ভব নয়। একটা দীর্ঘ জীবনে রক্ত সঞ্চালন যে কতভাবে হয় তার ইয়ত্তা নেই। আবার রক্তের সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘটনাও কম দেখতে হয় না। একই রক্তে আনন্দ প্রবাহিত হয়, আবার কষ্টও সঞ্চালিত হয়।